শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ধারাবাহিক - বিমোচন ভট্টাচার্য

মুখোশ নয় মানুষ
বিমোচন ভট্টাচার্য 

 
নরহরি

নরহরি দাস , একজন মানুষের নাম । আমি তখন আমার মেন ব্রাঞ্চ, কলকাতায় , প্রায় ই আসেন নরহরি , আমাদের বাড়ির মালিক হলেন কলকাতার জালান রা , ওদের ওখানেই পিওন এর চাকরি করেন নরহরি ,চার ফুট দশ ইঞ্চির সদাহাস্যময় মানুষটি একদিন একটা বেশ বড় মিস্টির প্যাকেট নিয়ে এলেন সঙ্গে একটা মার্ক সিট , এইচ এস পাস করেছে ওর ছেলে । মার্ক সিট দেখে তো আমি থ । প্রায় ৯০% মম্বর পেয়েছে নরহরির ছেলে , আমি বললাম , আরে নরহরি বাবু এ কি করেছ?? এত ভালো রেজাল্ট করেছে তোমার ছেলে, আমরাই তো ওকে খাওয়াব , নরহরি বলল, স্যার , ও কলকাতায় এলেই আপনার কাছে নিয়ে আসব । ব্রাঞ্চ এর এর ছেলেদের বলে একটা ভালো ঘড়ি কিনে রাখলাম ওর জন্যে , পরদিন নরহরির হাতে সেটা দিতেই , কেঁদে ফেলল নরহরি,বলল , একটাই ছেলে আমার স্যার, অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি ওকে , তবে ছেলেটা আমার বড় ভালো স্যার, গ্রামের ছেলে তো ,আমাদের খুব ভালবাসে , আমরাও তাই , নয়নের মনি আমাদের । আমাদের বাড়ি মেদিনীপুর এ , ওখানেই কলেজ এ পড়বে এখন . একটু আশির্বাদ করবেন যেন জীবনে বড় হয়, তাহলে এই চাকরিটা ছেড়ে দেব আমি, দেশেই থাকব, চাষবাস করব, কিছুটা জমি আছে , তাতেই চলে যাবে । এরপর আমি বদলি হয়ে যাই, ফিরি বছর তিন পরে , ওই ব্রাঞ্চএই, আমাকে দেখে নরহরি তো খুব খুশি , বলে ছেলে এই বি এস সি পরীক্ষা দেবে । খুশিতে উচ্ছল নরহরিকে দেখে আমার ও খুব ই ভালো লাগলো । এরপর একদিন নরহরি আমার কাছে এসে বলে একটা কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হবে ওর ছেলে, যদি একটা লোন পাওয়া যায়, আমি বলি তুমি শোধ করবে কি করে ? ও বলে -সে ঠিক করে দেব আপনি তো আমায় দেখছেন , সেই সময় , আজ থেকে প্রায় কুড়ি পচিশ বছর আগে ওকে আমরা একটা ২০ হাজার টাকার লোন করে দিয়েছিলাম । নরহরি সেটা নিয়মিত শোধ করে যেত , আবার আমি বদলি হলাম , এরপর আর আমি মেন ব্রাঞ্চ এ ফিরিনি,রিটায়ার করার কয়েকদিন আগে ওখানে যেতে হচ্ছিল বেশ কযেকদিন, একদিন নরহরির সঙ্গে দেখা , বুড়ো হয়ে গাছে নরহরি। আমাকে দেখেই একগাল হাসি ,প্রথমেই বলল যে লোনটা শোধ করে দিয়েছি স্যার , দেশের জমিটা বিক্রি করে । বললাম - নরহরি, আমি তো চললাম, রিটায়ার করছি , তোমার খবর বল, এখনো চাকরি করছ, নরহরি বলল - খাব কি স্যার?চাকরি না করলে , বললাম কেন তোমার ছেলে ? সে এখন বিদেশে থাকে স্যার,ওর অফিস থেকে পাঠিয়েছে । অফিস এর ই এক বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেছে , ভালই আছে স্যার ।

- তোমরা ওর কাছে থাক না?
- কি যে বলেন স্যার, সারাজীবন এখানে বাবুদের লাঠি ঝাঁটা খেয়ে চাকরি করছি , এই বয়েসে কি ছেলে, ছেলের বউ এর লাঠি ঝেঁটা খাব ?
ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম , না নরহরির চোখে জল নেই , সেই নরহরি, যাকে আমরা ওর ছেলের জন্যে একটা হাতঘড়ি দিয়েছিলাম যেদিন, সেদিন আনন্দে ওকে হাউ হাউ করে ফোঁপাতে দেখেছিলাম।

আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না , এইসব তাহলে সিনেমায় ঘটে না , বাস্তবেও নরহরির মত মানুষদের জীবনেও ঘটে ।

নরহরি বলল - ভালো থাকবেন স্যার , সাবধানে থাকবেন , শরীরের যত্ন নেবেন ।
চলে গেল মৃদু হেসে চার ফুট দশ ইঞ্চির নরহরি দাস ।