বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা

সম্পাদকীয়



ঘষা কাঁচের আড়াল থেকে
 
সময়টা বড় অস্থির এখন। চারদিকে অবিশ্বাস, সন্দেহ আর প্রতিহিংসা’র বাতাবরণ । তারপরেও আমরা সাহিত্য নিয়ে ভাবছি, পড়ছি অথবা নতুন কিছু করার চেষ্টা করছি সেটা অন্তত এটুকু বোঝায় যে বাঙালি আজও ভালোবাসতে জানে, অবসর সময়ে কবিতা,গল্প পড়ে খুঁজে নিতে জানে বাঁচার রসদ । এইঅন্ধকার সময়ে সেটুকুই যা আশার আলো ।

এবারের সংখ্যা - ঘষা কাঁচের আড়াল থেকে ।

এবারে আমাদের সামান্য চেষ্টা থাকবে সাহিত্যের সেই ঘষা কাঁচ সময়’কে কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রেখে এমন কয়েকজন কবি’কে দেখা -আপাতদৃষ্টিতে যাঁরা নেট জগতের তরুণতমদের কাছে ব্যাপক পরিচিত হয়তো নন কিন্তু প্রতিভায় অনন্য । বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এঁদের কবিতা পড়েননি , হয়তো নামও শোনেননি ।

সেই সব প্রায় অনালোচিত কবিদের থেকে কয়েকজনকে নিয়েই এই সংখ্যা । সময় কম হওয়ার কারণে খুব ছোট করেই শুরু করলাম আমরা । পরবর্তীতে ইচ্ছে রইলো আরও বড় আকারে কাজটি করার ।


এই দারুন দহন দিনে আপনাদের জন্য এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে আসুক‘ প্রাণ ভরিয়ে , তৃষা হরিয়ে ‘আসুক বৃষ্টি, আসুক ‘খুশির জোয়ার‘ । কেটে যাক অন্ধকার সময় - জ্ঞানের বিনম্র আলোয় ।

সবাই সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন ভালোবাসায় ।




ক্ষেপচুরিয়াসে'র পক্ষে -
মিলন চট্টোপাধ্যায় ও পৃথা রায়চৌধুরী

তৃতীয় ভুবনের কবি - পার্থ বসু

বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় ভবনের কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ
পার্থ বসু



দেখা হয় / ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ

শব্দ, অর্থ, উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমার সঙ্গে
মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়।
নার্সিংহোমের দরজায়, ডাক্তারের ভিড়ঠাসা
চেম্বারের মোমের আলোয়।
ম্লান হাসি বলে দেয় ওরা কেউ ভালো নেই।
কি খবর ! এই চলে যাচ্ছে আর কি ।
তবে সুগার অনেকটা হাই, ঘুম কম ।
ই সি জি রিপোর্ট খুব ভালো নয়।
গ্যাস পাও ঠিকমতো! জিনিসের দাম কিরকম
বেড়ে যাচ্ছে ।
ছেলেরা কি করছে , তোমাদের টি ভি তে বাংলাদেশ
কি রকম পাও ?
কালকের খবর শুনেছ?দিন দিন কি হচ্ছে এ সব ?
এ রকম আলাপের পর অনিবার্য — চলি, দেখা হবে।
দেখা হয়ে কি হবে এখন !

এই কবিতার কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহ বাংলা কবিতার তৃতীয় ভবনের বরাক উপত্যকার বাসিন্দা । মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী । বাংলা ভাষা তাঁর ধাত্রীমাতা ।দুই মায়েরই স্তন্যপান করে পুষ্ট হয়েছে তাঁর সাহিত্যবোধ । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাগোষ্ঠীর মানুষরা , যারা অবগত নন তাদের জন্য বলা, বাঙ্গালীর মতই দেশভাগের শিকার।তাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ওপার বাংলায় , মূলত সিলেট , চট্টগ্রামে ছড়িয়ে। এপারে

দেশভাগের পর সিলেটের যে তিনটি থানা / এলাকা আসামের ভাগে পড়ল এঁরা সেই বরাক উপত্যকায় পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসছেন। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে ১৯ শে মে যে ভাষা আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল বরাক - অসমীয়া ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে , বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় তাতে এঁরা বিপুল ভাবে সামিল হন। সামিল হয়েছিলেন অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীও যেমন নেপালী , ডিমাসা , এবং হিন্দীভাষী জনতা।১৯ এর প্রেরণা জুগিয়েছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী ।১৯ শে মে বরাকের মাটিতে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন আবিশ্ব ভাষা আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য । ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় মহিলা শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করেছিলেন আরও দুই দশকের ব্যবধানে। আমরা এই প্রসঙ্গে এই দুজন এবং ভাষা সংগ্রামের জানা ও অজানা সমস্ত শহীদদের শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রণাম জানাই।

এত কথা এ জন্যই বলা যে এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা উভয় বাংলায় বাংলা ভাষাকেও তাঁদের মেধা ও প্রতিভা দিয়ে সেবা করে চলেছেন। ওপার বাংলায় কবি শুভাশিস সিংহ বাংলায় লিখে সাহিত্যসাধনার জন্য ওদেশের জাতীয় পুরস্কার hsbc কালিকলম পুরস্কার পেয়েছেন। লক্ষ টাকার পুরস্কার। কবি ব্রজেন্দ্র কুমার সিংহর কবি পরিচিতি এবং আরও একটি বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা পোস্ট করা হল। আপাতত আমরা উদ্ধৃত কবিতা ‘দেখা হয়’-এর অন্তর্মোচনের প্রয়াস পাব।

একজন প্রখ্যাত মার্কিনী সাহিত্যিককে নাকি একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল স্বাভাবিক বানিয়া প্রবৃত্তি ছেড়ে তিনি সাহিত্য চর্চায় মন দিলেন কেন? লেখক জানিয়েছিলেন সকৌতুকে ---'বানিয়া বুদ্ধিতেই । লেখার পয়লা সুবিধে হল কাঁচা মাল, সবটাই মেলে মুফতে । দেখ আর লেখ । Absolutely no investment in raw material.'

বলা বাহুল্য উক্ত মার্কিন সাহিত্যিক এবং আলোচ্য কবি শুধু ভূগোলে নয় মননেও দুই মেরুর। কিন্তু দুজনের সাধারণ মিল তাঁরা দুজনেই দ্রষ্টা ।

পশু পাখিরও চোখ আছে ।তাদের ভাষা নেই। বহুস্তর শব্দ নেই।তারা ছবি দেখে অনুমান করি। মানুষ নিছক ছবি দেখে না ।যা দেখে তা শব্দে অনুবাদ করে , রূপ দেয়। স্মৃতি তা সঞ্চয় করে।গ্রহন বর্জন করে।কবি এখানেই থামেন না।তিনি তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে, অনুধাবন করে উপমায় যাচাই করেন। যেন উৎপ্রেক্ষা আকীর্ণ প্রেক্ষাপট। এরই মধ্যে তার প্রতীক্ষা বাকপ্রতিমার জন্য। চিত্রকল্পটির জন্য ।

তাহলে যা কিছু দেখছেন কবি তা সংশ্লিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট হচ্ছে শব্দে অর্থে উপমা উৎপ্রেক্ষা আর বাকপ্রতিমায়। এটি কবিতার সংগ্রহ পর্ব ।এই সংগ্রহ তাঁর জীবন যাপন থেকে, যে জীবনের ছবি এঁকেছেন পরবর্তী আপাত আটপৌরে কথোপকথনে । যেন কবিতাই মোক্ষ। কবিতাই আরোগ্য নিদান । নিরাময়।তার উপাদানগুলি এখন কিনা অসুখে ভুগছে।উদাসীন সরকারী হাসপাতাল নয় তারা ছুটে গেছে নার্সিং হোমে – ডাক্তারের চেম্বারে।সেখানে মোমের আলো।লোডশেডিং। এই নিত্য অভিজ্ঞতার মোড়কে প্রাত্যহিকের নানা বৈপরীত্য।প্রাণের প্রদীপ না জ্বালানো মেধা।এইসবে কবি কাতর। ডাক্তার কে? তাঁর পাঠক? সমালোচক? নাকি সহমর্মী কেউ? অথবা কবি নিজেই?

কথোপকথনে যেটা লক্ষ্যনীয়, কবি বিশেষ থেকে নির্বিশেষে বিস্তার করেছেন তাঁর অবলোকন। গ্যাস,বাজারদর,বাংলাদেশ টি ভি থেকে হঠাৎ প্রশ্ন করেন --- কালকের খবর শুনেছ? দিন দিন কি হচ্ছে এসব? কোন নির্দিষ্ট খবর কবি উল্লেখ করেন নি। কিন্ত দিন দিন কি হচ্ছে এসব এই প্রতিক্রিয়া এখন সার্বজনীন ।প্রতিদিনের।আমরা বিষণ্ণ হই, বিষাদে আক্রান্ত হই, আচ্ছন্ন হই।

অথচ কবিতা লিখতে হবে তাঁকে ।শব্দ যাপনের শীলিত অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন না তিনি। কবিতা লিখতে হবে এই আবহেই। এসব থেকেও। এসব দেখেও।

চলি, দেখা হবে এই অনিবার্য অন্তিম সংলাপের পর তাই তাঁর ব্যক্ত হাহাকার--- দেখা হয়ে কি হবে এখন! একটি নিটোল সুস্থ সুন্দর কবিতারসঙ্গে যদি দেখাই না হল! এই বেদনা , এই আক্ষেপ আমাদের স্পর্শ করে।

অমনি দেখা হয়ে যায় একটি মহৎ কবিতার সঙ্গে ।

কাব্য পরিচিতি - বাংলায় দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

( ১ ) ত্রাণ শিবির
( ২ ) ভিখারী বালকের গান। প্রবন্ধের বই --ছন্দের কারিগরি।

সম্পাদনা করেছেন রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ--উত্তরা।

সম্পাদিত পত্রিকা---সাহিত্য এবং সমাবর্তন । বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থ---৪৩, ৩ টি প্রেসে।

চড়াইপাখীরা কি হারিয়ে যাবে - গৌতম চট্টোপাধ্যায়

চড়াইপাখীরা কি হারিয়ে যাবে
গৌতম চট্টোপাধ্যায়

চড়ুই চিন্তা
নিজন দে চৌধুরী

রোজই দেখি, আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।

হায়রে চড়ুই ! কেবল হাহাকার ।
হায়রে চড়ুই, চারদিকে সব অভাবী সংসারঃ
খুঁটে খাবার খুদ কুড়ো কি রুটির টুকরো আর
তাও মেলে না, এমন হাহাকার ;
আহা, চড়ুই উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, তার
চারদিকে সব বাড়ন্ত সংসার ।

ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি,
ক্ষেত- খামারে মা লক্ষ্মীর শূন্য বরণ ডালি ।
নটে গাছটা মুড়িয়ে গেছে কবে ।
দুঃখী মায়ের থান কাপড়ে রোদ্দুর ধবধবে,
ফাঁকা উঠোন । শূন্য ধানের গোলা । মরাই খালি ।
তুলসী তলায় মাথুর গায় বলাই- বনমালী ।

তবুও আজো আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে বেড়ায় এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।
কেমন যে নির্ভয়ে, কেমন নির্ভাবনায় আসে
এই উঠোনে ঘুরে বেড়ায় এক- বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।

তখন ( ১৯৭০ এর দশক ) সত্যিই ছিল কবিদের ভুবন, কবিতার আবহ । নানা অছিলায় কবি সম্মেলন লেগেই থাকত । রাণাঘাট সহ নদীয়া প্রায় সব কবি সম্মেলনেই নিজন'দা ছিলেন অবধারিত ভাবে আমন্ত্রিত ও উপস্থিত । নিজন'দা কবিতা পড়তে শুরু করলেই অনুরোধ এসে যেত চড়াই চাই অথবা 'চড়ুই চিন্তা' হোক - নিজন'দাও স্বভাব সৌজন্যে নিরাশ করতেন না । এখানে বলে ফেলা যাক যে কোনো আবৃত্তিকারের দ্বারাই আজ পর্যন্ত কবি'র নিজস্ব অনুভূতি-অভিব্যক্তি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি - কবিরাই হতে পারেন কবিতা'র একমাত্র আবৃত্তিকার । আর মানুষটি যদি হন ভাষা- সাহিত্যের অধ্যাপক এবং নাট্যপ্রিয় ব্যক্তি - তবে তো কথাই নেই । নিজন'দা ছিলেন সেই বিরল কবি যিনি শুধুমাত্র তাঁর কবিতাই নয় অন্যের কবিতাও সমপর্যায়ের আবৃত্তি করতে সক্ষম ।

আমার জানা ছিল যে কবিরাও শুনেছেন অনেকবার, কবিতার তন্নিষ্ট পাঠকও পড়ে ফেলেছেন তবু বার বার প্রচারিত হওয়া দরকার এই বিবেচনায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশের পরের বছরই ১৯৭৭ এর শরৎকালে যখন আমি 'অনেক' সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা শুরু করলাম তখন আমার মনে হল ' চড়ুই চিন্তা ' কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করা যেতে পারে । নিজন'দাকে জানালাম , নিজন'দার মৃদু আপত্তিতে সম্মতির সুর লেগে আছে জেনেই পুনর্মুদ্রণের সাহস পেয়েছিলাম । কারণ কবিতাটি অব্যবহিত আগের বছর অর্থাৎ ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে ( ১৯৭৬ ইঙ্গাব্দ ) কলকাতা থেকে সুশীল রায় সম্পাদিত ' ধ্রুপদী ' ( ১৪ বর্ষ, ৭-৯ সংখ্যা ) সাহিত্যপত্রে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । এমনকি পরে ১৯৯০ এর দশকেও নাকি 'কফিহাউস' পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ।

আজ নিজন'দার অনুপস্থিতি বেদনা জাগায় মনে - আজ যা-ই লিখি না কেন আসলে সে তো ওবিচুয়ারিমাত্র । কিন্তু বিগত বছর পাঁচেক ধরে নিজের বাগানে দাঁড়ালে, ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধুই মনে হয় ওবিচুয়ারি লেখা দরকার চড়ুই পাখীদের বিষয়ে । কারণ মাত্র কয়েক বছর আগেও -

"রোজই (দেখতাম ), আমার ঘরের পাশে
কেমন করে ঘুরে ( বেড়াত ) এক-বুক বিশ্বাসে
দুটো তিনটে পাঁচটা দশটা চড়ুই ।" ( ছন্দচ্যুতি মার্জনীয় )

এখন আর দেখিনা চড়াই পাখীর ঝাঁক - ভিলেন সাব্যস্ত হয়েছে মোবাইল টাওয়ার । কিন্তু দরকার ছিল পেস্টিসাইড- দুষ্ট মাঠ, জল , মাটি - বিষদষ্ট কীটপতঙ্গ ও মাঠের বিষাক্ত ফসল- ফল - সব্জি ভক্ষণ করাকেই মূল ঘাতক রূপে চিহ্নিত করা । দিন এসেছে বোধয় হাতিবাগানের রবিবাসরীয় সকালে পাখীর হাটে ব্যাপারীদের কাছে খোঁজ নেওয়ার -চড়াই পাখী কিনতে পাওয়া যাবে কিনা ! নিজন'দার 'চড়ুই চিন্তা'র পুনর্নির্মাণ হতে পারে এই বন্ধ্যা সময়ে, তবে আমরা চাইব চড়াই-এর ঝাঁক আবার ঘুরে বেড়াক আমাদের উঠোনে এক- বুক বিশ্বাসে ।

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা - প্রসেনজিৎ দত্ত

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা
প্রসেনজিৎ দত্ত


অভিজ্ঞতাপ্রবণ লোকজনেদের নিয়ে কবিতার কাজকারবার। পৃথিবীর সমস্ত কারবারী উপাদানগুলিকে একত্র করে কবিতা কবির বেশে ভূমিষ্ঠ হল। আর ভূমিষ্ঠ হল যখন, তখন তো তার মাথা গোঁজবার জন্য প্রয়োজন ‘কবির রক্তমাংস’, বস্ত্রের জন্য প্রয়োজন ‘কবির সর্বস্ব’ আর খাদ্যের জন্য প্রয়োজন ‘কবির খিদে’। যদি বলা হয়, কবিতার খিদে পেয়েছে কবির! যদি বলা হয়, এই উত্তর কলকাতা, এই বাগবাজার, এই ঠাকুর রাধাকান্ত লেন, গঙ্গা, গঙ্গা থেকে গঙ্গাপূজা, ভাসান উৎসব, দুই পাড়ের পাট ও বাঁশ বিনিময়, পাড় লাগোয়া কারখানা, কাশিপুর গান অ্যান্ড সেল, সূচক হুটারে জেগে ওঠা সময় কবির সঙ্গে কথা বলে—তবে? অতিকাল চলো। কালস্য কুটিলা গতিঃ—প্রবাদ মিছে হল। এরপর পাতা উল্টে দেখব। গঙ্গায় সোপানের অপেক্ষা। সার পেতে গিয়ে নির্যাস পেলাম—গঙ্গার জল গঙ্গা র’ল, পিতৃপুরুষ উদ্ধার হল।
‘অতিকাল যাও... আমার অপর এই গঙ্গাধ্‌ধারে
বটবৃক্ষমূলে দ্যাখো গামছা পেতেছে... বাঁকুড়ার
গোলাপী গামছা... আহা কী শীতল... অতিকাল
যাও... ওকে একটু শুতে দাও বিরক্তও কোরো না...
ক্ষমতা বাচনে ঘেরা সমসত্ত্বা থেকে দূরে
ঐ গামছাটি পাতা... যাবতীয় মাধ্যমের
উদ্বেজনা থেকে দূরে ঐ গামছাটি পাতা...
বাগবাজারের গঙ্গাধ্‌ধারে পক্ষীবিষ্ঠাময় কোনো
বটমূলে বাঁধানো চাতালে... থামো অতিকাল...
দূর থেকে গামছাটিকে প্রণাম জানাও’

এ কোন দীক্ষা? সমালোচক অনুমান করেন, কিন্তু অনুধাবন? স্মরণ করি ‘উত্তর কলকাতার কবিতা’র কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা—
‘‘যং কাময়ে তং উগ্রং কৃণোমি
তং ব্রহ্মাণং তম্‌ ঋষিং তং সুমেধাম।

মানে, আমি যাকে কামনা করি তাকেই করে তুলি উগ্র বা প্রতিভাবান, করে তুলি ব্রহ্ম, করে তুলি ঋষি, করে তুলি জ্ঞানী। যারা জানেন বুঝবেন যে এই বাকসুক্তে ঋষি শব্দে ‘কবি’ অর্থই নিতে হয়। সার্থক কবিতা মাত্রই তাই প্রকৃত অপৌরুষেয়। কবিত্বশক্তির নিজস্ব স্বতন্ত্র লীলা। তাকে কী বলি? বলি, Our Lady Of Immaculate Conception? কারণ, পুরুষ তো কেবল সাক্ষিরূপ নিমিত্ত মাত্র! শিব। অথবা অন্য প্রান্তে দোষভাগ, জীব। এই দুইয়েরই আশ্রয়রূপা বর্ণমালা মা আমার, তোমাকে প্রণাম। তোমার সুন্দরীতমা প্রকাশরূপ কবিত্বশক্তিকে প্রণাম। তার অপৌরুষেয় প্রসবোল্লাস, Immaculate Conception—কবিতাকে প্রণাম।’’—বাগবাজারের গঙ্গাধ্‌ধারে পক্ষীবিষ্ঠাময় কোনো বটমূলে বাঁধানো চাতালে সত্যিই কি কখনও থেমে থাকতে পারে ‘অতিকাল’? ওই গামছাটিই বা কার? ছেলেছোকরার দল ওই গঙ্গায় গাঙ্গেয় সুখে মজে থাকে রোজ। ডুব ডুব গঙ্গা ভাজে। অথবা পুরোহিত তার নৈবেদ্য দেন গঙ্গা জলে। শেষ স্নানে শুদ্ধ হন তিনি। সবকিছুই আমাদের জানা ছবি। গঙ্গার দোষ নেই কোনও। আহা কী শীতল! হয়তো এই পাড়ের এক বাসিন্দা বলে উঠল—গঙ্গা গঙ্গা না জানি কত রঙ্গা-চঙ্গা। কেন বলল সে? কী তার কারণ? গঙ্গার পরিচয় ফলে। ওই বাসিন্দারও বিশ্বাস—গায়ের কালি ধুলে যায়, মনের কালি ম’লে যায়। ওই বাসিন্দা অতি সাধারণ। ওর বিশ্বাস ওকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা করলে ওটা হবে। ওটা করলে সেটা। সে জানে গঙ্গাস্নানে পুণ্যি। সে জানে ডুব বেশি দিলে কালি মুছবে। পাপ মুছবে। সে এটাও জানে, মনের কালি মোছে না সহজে; এমনকী মরলে পরও সহজে নয়। ওই বাসিন্দা রোজ দেখে। পায়ে হেঁটে মায়ের ঘাট যায়। বসে থাকে। ট্রেন যায়। ট্রেন আসে। তবু বাসিন্দার জীবন পাল্টে যায় না। জীবন যেন তার কাছে অনুপ্রেরণায় রূপান্তরিত। সে যখন পড়াশুনা করত, মাস্টারমশাই তাকে দার্শনিক ভালেরির কথা বলেছিলেন। পাঠককে অনুপ্রাণিতে রূপান্তরিত করবার কাজ নাকি কবির। সে কবিতা বোঝে না। জীবনের অত ভারি ভারি সার কথাও বোঝে না সে। তার গণ্ডী বাগবাজার। গঙ্গাধ্‌ধার। বটবৃক্ষমূল। ওই গোলাপী গামছাটি তার। অথবা তার মতো কারোর। অথচ এই সব পরিচিত দেখা যখন পরস্পর বাক্য হয়, তখন বুঝতে পারে ওই বাসিন্দা। এ যেন তার কাছে পরিচিত বহুদিনের। তা জটিল নয়। অহেতুক তাত্ত্বিক দর্শনে ভারি নয়। এ যেন তার চেনা প্রাত্যহিককে গুছিয়ে দেওয়া শুধু—
‘... মানুষের মনে কেন এত হনোলুলু চলছে... কেন এত
লোহূলালা বয়ে যাচ্ছে... অনাসৃষ্টি অনাসম্পাত... নতুন নতুন
প্যাঁচ... পতঞ্জল... যেন বদলের বুভুৎসব যেন ধোঁয়া উঠছে...
জীবনকে খানিকটা অন্তত বোঝা তো দরকার... বলো... কিন্তু
ধোঁয়ার মধ্যে ধুন্ধুমকার মধ্যে আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না...
বলো মনোময়... জীবন থেকে এত দুন্দুভি উঠছে কেন... আর
নেতিয়ে পড়ছে লিভার... জেলেপাড়া... পুরো মারহাট্টা ডিচ লেন’

একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওই বাসিন্দাকে­—‘আপনি কী ভাবেন সারাদিন?’ ফটাফ্‌ফট উত্তর মিলেছিল—‘ছাইপাশ’।

—দেখুন, এই অঞ্চল এমনই, আপনি না বললে আমি অবিশ্বাস করব।

—বিশ্বাস করা আবার কেমন ব্যাপার?

—আপনার ছাইপাশ শব্দে আমার বড় আপত্তি। আপনি জানেন অনেক কিছু!

—ভুল জানেন বলছি না, তবে আপনি ঠিক নন।

—ঠিক কোনটা?

—ওই ছাইপাশ ভাবনাগুলি।

—বেশ, তবে ছাইপাশ ভাবনাটা কি, জানতে পারি?

—চলুন, হাঁটা যাক, হাঁটবেন?

—চলুন।

আচরো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম্; নিষ্ঠা বৃত্তিস্তপো দানং নবধা কুললক্ষণম্। বোঝা গেল যে আজ কিছু মিলবে। যাই হোক, চলা যাক। চলতে চলতে পথ বর্তে দিল অনেক কিছু। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের দোহাই ছাড়া উপায় কি কিছু আছে বলতে পারেন? যে ভাষায় কথা বলি, সে তো হাজার বছরের বেশি পুরনো। আমি প্রসূনদা-র লেখা পড়ি আর ভাবি, ভাবনার বীজ কোথায় থাকে! এ যেন, আচারে বাড়া, বিচারে এড়া। বুঝি না কিছু। আবার কখনও-সখনও সবটাই বুঝে যাই—সবটা! সেই পেরিন সাহেব, পেরিন সাহেব থেকে পেরিন্স গার্ডেন, গার্ডেন পরবর্তী পেরিন-বাগ থেকে বাগবাজার, বাগবাজারি ভাগীরথীর কল্পিত সেতুপথ ডিঙিয়ে ধীবরের জেলেপাড়া, বর্গী আক্রমণের সেই সম্ভাবনা, ঘুমন্ত ইংরেজ শাসনের জেগে ওঠা, তাদের নিরাপত্তার সেতু, সেতুর নীচে খালকাটা, চারপাশ বসতি অতিপরিচিত মারহাট্টা ডিচ লেন! আবার বাগবাজার বলেই ভাষার ব্রজবুলিও আছে­—
‘বাদরিয়া ঘেরি আয়ি চারহু ঔর কারি
দোদুল ঘরে মাঝে সঘন মশারি
দোদুল গঙ্গামধ্যে ইলিশের নাও
খিচুড়ি চাপাও বঁধু খিচুড়ি চাপাও’

রসনার মেহেফিলে ছ্যাঁকা লাগছে। পাল্টে যাচ্ছে সমস্ত উচ্চারণ, সমস্ত বাক্যের বন্ধনী—
‘... আমার আর মাইরী প্রেমিক হতে
ভাল্লাগে না... তাই আমি ভুষো চাদর
আর চিটে নুঙি পরে একমুখ সাদা
দাড়ি নিয়ে তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি
আর ওদের বলছি মা দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা...
অনেকদিন কিছু লিখতে পারছি না... মা গো
দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা’

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা! ছলের বশে একজন স্বভাব কবির ঢঙেই বোধহয় এমন সম্ভব—দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা, মেট্রোপলিটন কলকাতার ‘ক্ষমতা বাচনে’ যেন সমস্ত ইতির শেষে উঁকি মারছে রকবাজ কলকাতা—মা গো, ব্যঙ্গার্থের আড়ালে দেখো তোমার স্তুতি, দেখো নেই-এর মাঝেও ফিরে আসা আড্ডা—দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা... সারদা, দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা !

ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন দেবদাস - মিলন চট্টোপাধ্যায়

ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন দেবদাস
মিলন চট্টোপাধ্যায়


আমার কন্যার জন্য
দেবদাস আচার্য


আমার কন্যাকে রক্ষা করো অন্ধকার থেকে, আলো দাও
আর কোন প্রার্থনা নেই
আমার কন্যা যেন স্বপ্ন দেখতে পায়
আর কোন প্রার্থনা নেই
আমার কন্যা যেন স্বপ্ন দেখতে পায়
আর কোন সান্ত্বনা নেই, আজ শুধু
শুধু তাকে যেন দেখতে পাই আলোয়, পথিক হয়ে যেতে

প্যালেটে রক্তের লাল, ক্যানভাসে দুরু দুরু কাঁপে
কন্যার হৃদপিণ্ড আমার
আমি চোখ খুলতে ভয় পাই
আমি চোখ খুলতে পারি না ...

( জলঙ্গী কবিতা উৎসব - ১৪১৯ এর স্মারকপত্র থেকে )

'আমি চোখ খুলতে ভয় পাই
আমি চোখ খুলতে পারি না ...'

  • কারণ - চোখ খুললেই তো সংবাদপত্রের পাতায় কন্যাদের শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, টিভি'র পর্দায় সাতকাহন ধর্ষণের । চোখ খুললেই কালির ফোঁটা'র সংখ্যা গোনায় ব্যস্ত মুখের মিছিল ।
  • রাজপথ থেকে গলি, প্রাসাদ থেকে ঝোপড়ি, উচ্চবর্ণ থেকে অন্ত্যজ ~ সব একাকার ধর্ষণ মুখরতায় ।আমরা দেখি, লজ্জা পাই, ভুলে যাই আবার চিন্তাগ্রস্থ হই । মনে মনে বলি -
"আমার কন্যা যেন স্বপ্ন দেখতে পায়
আর কোন সান্ত্বনা নেই.. "
  • বিগত পাঁচদশক ধরে এভাবেই দেবদাস আচার্য মফঃস্বলী রাস্তায় ' মৃৎ-শকট ' বাহিত হয়ে দেখে চলেছেন মানুষ আর গড়ে চলেছেন ' মানুষের মূর্তি ' ।

  • দেবদাস তাঁর চারপাশে যে বীভৎসা দেখেছেন তাতে তাঁর পক্ষেই সম্ভব বাংলা কবিতার জগতে 'ভাইরাস' আবিষ্কারের ! যে ভাইরাস পত্রিকা তদানীন্তন তরুণ প্রজন্মের কাছে ছিল আত্মপ্রকাশের গরিমা-ভূমি ।

"ড্রইং"-এর খাতা থেকে - বাণীব্রত কুণ্ডু

“ড্রইং”-এর খাতা থেকে : কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়
বাণীব্রত কুণ্ডু


‘ড্রইং’। একটি বই। ছবির বই। বাইশটি ছবি রচিত হয়েছে। কালো মলাটে মোড়া এই বইটিতে চিত্রিত ছবিগুলো কোনো আক্রেলিক বা প্যস্টেল, চারকোল কিংবা জল রঙ, তেল রঙ নয়, শিল্পী এঁকেছেন অক্ষরমাধ্যমে। আর যে শিল্পী অক্ষর সাজিয়ে ছবি আঁকেন তিনি তো কবি! আর কেউ নন। কোনো চিত্রশিল্পী তাঁর অমোঘ সৃষ্টি প্রস্ফুটিত করে তোলেন ক্যানভাসের উপর; আর একজন কবির ক্যানভাস হল সমকালীন সমাজ, দেশ-কাল-পাত্র। আর তেমনই কিছু কবিতার খোঁজ পাওয়া গেল এই “ড্রইং” বইটাতে। কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়। জন্ম – ১৯৫৩, নিবাস অক্ষরশহর শ্রীরামপুর, পেশা এবং নেশা যে একনিষ্ঠ সাহিত্যচর্চা সে বিষয়ে অঞ্চলের অনেক মানুষই জানেন। সম্পূর্ণ একক দায়িত্বে নিয়মিতভাবে (বর্তমানে) তিনি প্রকাশ করে যাচ্ছেন নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস, প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক কাগজ “শ্রীরামপুর”। এছাড়াও কবিতাপত্র “চিত্রল”। এবং সম্প্রতি “কলকাতা কলকাতা” নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা। এই নিভৃতচারী কবি আশির দশকের একজন অন্যতম কবি। আলোর নিচে যাঁর বাস। অথচ আলেয়া যাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি।

কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার ঝাঁ চকচকে প্যালেসের অভ্যন্তরের ঘষা কাঁচের আড়ালে যিনি রয়ে গেছেন! তাঁর কবিতাগুলিও যে আজকের সমাজের প্রেক্ষিতে দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক তা বলাই বাহুল্যমাত্র। “ড্রইং” থেকে কয়েকটি কবিতার নিবিষ্টপাঠে তা জলস্বচ্ছ্ব রূপ পায়। গ্রন্থিত প্রথম কবিতাতেই কবি সতর্ক করে দিচ্ছেন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি থেকে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে দুধকে দুধ আর জলকে জল আলাদা করে নেওয়ার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। যেহেতু কোনো কিছুই চিরদিন একই থাকে না। কবি “সংবাদ”এ লিখছেন –

“মাটি আর বালিকে বিচার করতে
না পারলে তুমি থেকে যেতে বাধ্য স্থানুবৎ

কারণ দু মলাটের ভিতর কোনোকিছুই
চিরকাল আটকে থাকে না

নিজের চোখেই তুমি দেখলে
ঘটনাগুলো এমন ছিল
যে তাদের নীরবতাই একমাত্র
আশ্রয় হয়নি”

“সার্কাস” কবিতায় অস্থির সমাজের ছবি এঁকেছেন কবি। যেখানে ঈশ্বর কিংবা শয়তানের প্রতিনিয়ত ছক পালটানোর ইতিহাস। সভ্যতার জ্বলে যাওয়ার ইতিহাস। কিংবা আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে ইতিহাস পুড়িয়ে দেবার কাহিনি প্রকট। য শুধু কবিই নন, পাঠকও সমভাবে হতবাক! সত্যিই এইসব তো কম কথা নয়!

“প্রতিনিয়ত দেখি তোর নতুন নতুন খেলা
জ্বলে যায় গ্রেনেডা, হণ্ডুরাস
অথবা পারস্য দ্বীপমালা

আগুন হাতে খেলা
আগুন নিয়ে খেলা
আগুনের সাথে খেলা

কম কথা!”

আবার “মুখ” কবিতায় কবি ধিক্কার জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিয়ত খাপ খাওয়ানোর বেঁচে থাকার জন্য যে নীতি-আদর্শ-বিবেকের বিকারকে। আর সেই বিকার যেন ঠিক দুধ থেকে দই-এর নয়, তা হল সেই ফলরসান্নের বিকারে উৎপন্ন বিষাক্ত সুরাস্বরুপ। আর আমাদের গজোল্লাকে। যার পানে হয়তো আমরা নিজেরাই চমকে উঠব নিজেদের সেই চেহারার মদোন্মত্ততায়। তাই মুখোশে ঢাকা পড়ে থাকা মুখ কি আর আহত শব্দের অর্থবোধে সক্ষম!

“সামনে কোনো আয়না নেই
যেমন খুশি বিকৃত করতে পারো মুখ
কি আসে যায়
মহৎ সে কখনোই নয়
তবু মানবিক যন্ত্রণা কাতর

আহত শব্দের অর্থ এখনও শেখোনি”

“প্রশ্ন” কবিতায় রচনা করেছেন দানবের লালসায় পৃথিবীর অন্ধত্ব। বর্তমান সময়ে পরিবেশের যে পরিস্থিতি স্থল-জল-বায়ু সর্বত্র তা থেকে রেহাই নেই নিরীহ জীবকূলেরও। আজ পৃথিবীর সব প্রাণ অস্তিত্বের সংকটসীমায়। মৃত্যুই আমাদের একমাত্র বাধ্য গন্তব্য। এমনই আষ্ঠেপৃষ্ঠে অতোপ্রতো যে সেখান থেকে মুক্তির আশা দুস্তর। আমাদের চোখের পাতায় ঘুম নামার মতোই একদিন পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে।

“দুঃসহ কঠিন সময়ের আবর্তে
জড়িয়েছ অজগরসম
ভয়ঙ্কর।
দেবে মৃত্যু চুম্বন
তারপর!

কোন পথে যাবে?
তোমার লোভের রক্তে
পৃথিবী কি অন্ধ হবে!”

“জন্মভূমি”র সম্পর্কেও কবি দারুণভাবে উত্কন্ঠিত। যে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য শতসহস্র তাজা প্রাণ বলি হয়েছে, ঝরেছে অঝোরে লক্ষ মায়ের অশ্রু! তা কি আমরা ভুলে যাচ্ছি! ভুলে যাচ্ছি সেই সব মহান আত্মত্যাগ! আজ এই দুর্নীতিগ্রস্ত সময়েও যাঁরা এইসব ভাবি একান্তে, দেখি পাখি উড়ে যায়... উড়েই যায়... তেপান্তরের মাঠ ছাড়িয়ে...

“যাবে কি মুছে কোনোদিন
অশ্রুর দাগ –

বিষণ্ণ তুমি
পথ অন্ধকার!

প্রান্তর ছাড়িয়ে উড়ে যায় পাখি
তুমি দেখ শুধু দেখ
যতদূর চোখ যায়!

সমাজে প্রবঞ্চক, স্বার্থান্বেষী মানুষের ভিড়ে একাকী কবি নয় আমরাও প্রত্যেকে খুঁজে বেড়াই যে যার মতো বিশ্বাসী মানুষ। যেহেতু জগতে সবকিছুই আপেক্ষিক তাই সত্যের নিরিখে অবিশ্বাসীরাও খুঁজে বেড়ায় তাদের বিশ্বাসী তথা সত্যের মানদণ্ডে অবিশ্বাসীদের। যারা নিজেদের মধ্যেই শুধু কথা বলে যায়, অথচ জগতে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাই বিশ্বাসকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে আগাম ধ্বংসের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে যাচ্ছে সকলের জন্য। তাই কবির “বিশ্বাস” প্রকৃতপ্রস্তাবে নীতিকথার মতোই শোনায় –

“তোমাদের বিশাওাস কতটা আছে
আমাদের জানা নেই
আমরা জেনে গেছি
তোমাদের শব্দের বাড়িগুলো
যার ভিতর একমাত্র তোমরাই বাস কর
জিভটা আলগা হতে হতে এখন এমন
এক জায়গায় এসে ঠেকেছে, যেখানে তোমরা
শুধু নিজেদের মধ্যেই কথা বলে যাচ্ছ

আমাদের বিশ্বাস কিন্তু আমরা
যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমাদেরই জন্য
কারণ এই পৃথিবীটাকে রোজ গড়ে পিটে
আমরাই তৈরি করছি কিনা”

শিরোনামের কবিতাটিতে কবি এক অপূর্ব আনন্দ রচনা করেছেন অবলীলায়। কবিতায় দুটি রঙের কথা বলা হচ্ছে। আসলে কিন্তু আমরা দেখি জগতে যা কিছু অস্তিত্ববান তা সবই এক এবং অন্য আর এক, অর্থাৎ মোট দুয়ের সহাবস্থান। এর বাইরে আর কিছুই হয় না। এটা অমোঘ। আর এই দুয়ের যথার্থ ব্যবহারই পারে সমস্তের সুবন্দোবস্ত। নির্মাণ স্বচ্ছতা। তাই কবির “ড্রইং” খাতায় –

“তোমার হাতে মাত্র দুটো রঙ
যদি ব্যবহারে কোথাও ভুল না হয়
তাহলে দ্বিবর্ণ এই রঙের খেলায়
সবকিছুই স্পষ্ট

মনে রেখো
জলের গভীরে যাওয়া ছাড়া
তোমার পথ নেই”

এভাবেই তিনি এঁকে গেছেন তাঁর ড্রইং খাতার পাতায় পাতায়। ক্কবির সমস্ত কবিতা নিছক কবিযশঃপ্রার্থী সাজা কবির কবিতা নয়। কবি রবীন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা বহন করে ঔপনিষদিক তাত্পর্য। প্রতিটি কবিতায় দার্শনিক ভাবের অনায়াস সাহচর্য আর তার সঙ্গে বাস্তবিক জগতের সুষম জারণ নির্মাণ করেছে সত্য-শিব-সুন্দরের ধ্যানধারণায় সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা। তাই অন্তরালের কবি হয়েও তাঁর রচনা শাশ্বত। যা আমাদের শেখায়, উর্বর করে মস্তিষ্কসঞ্চালন। তাই তাঁর সম্বন্ধে এবং তাঁর কবিতা সম্বন্ধে বেশি কিছু না বলে আমি চাইছি তাঁর সৃষ্টি অধিক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে। তাই আর একটি কবিতা তুলে দিয়ে শেষ করলাম ঘষা কাঁচের অন্তরাল থেকে খুঁজে নেওয়া কবিপরিচয়। যা সত্যিই “বিস্ময়”এর –

“জমে থাকা কান্না শুধু জমে যায়
কঠিন পাথরে
দুচোখের তারায় ভেসে আসে চৈত্রের রূপ
পৃথিবীর কচি কচি ঘাস মরে গিয়ে
জ্বলেছে আগুন
তাই এত তাপ, তীব্র জ্বালা
কঠিন রুক্ষ পথ ক্লান্ত শরীরে নিশ্চুপ হেঁটে
যাওয়া
এ বড় বিস্ময়, বড় বিদ্রূপ
জীবনের কাছে”

হঁ মা কাঁদিস কেনে - ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

হঁ মা কাঁদিস কেনে
ইন্দ্রনীল তেওয়ারী

ক্ষেপচুরিয়াসের সম্পাদক সেদিন হঠাৎ ফোন করল। সম্পাদককে চিনি ব্যাক্তিগত ভাবে। সর্বক্ষণ যেন বিদ্যুৎ এর উপর বসে আছে । বলল, আজ রাতের ভেতরেই কোন এক কবির পঠিত কোন একটি কবিতা নিয়ে লিখে দিতে হবে। হাসতে হাসতে বললুম ঠিক আছে, লিখে দেবো। কিন্তু কাকে নিয়ে লিখি, কোন কবিতা নিয়ে লিখি ? আমার কবিতা পড়া তো অনেকটা শ্বাস- প্রশ্বাস নেওয়ার মতো । অনেক সময় নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা বুঝে নিতে হয়। কবিতা পড়া ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। কখনোয় খেয়াল আসেনি, যে কোন বিশেষ কবির কোনও একটি কবিতা নিয়ে লিখতে হবে।কবিতা পড়লেই সে তো আমার প্রানের সাথে আত্মার সাথে কিরকম জড়িয়ে -মড়িয়ে যায় । তাকে টেনে বের করে আনার মতো পরিস্থিতি কোনদিন ঘটে নি । অতএব মুস্কিলে পড়লাম খুব ।

ফোনটা যখন এসেছিলরতখন আমার হাতে যে লিটিল ম্যাগাজিনটা ছিল তাতে কবি অরুনকুমার চট্টোপাধ্যায় এর তিনটি কবিতা ছিল। মনে মনে ভাবলুম দাঁড়াও, দেখাচ্ছি । কবির কাব্য গ্রন্থ "সাঁঝ বিহানের" থেকে একটি কবিতা ~


হঁ মা কাঁদিস কেনে
অরুনকুমার চট্টোপাধ্যায়


হঁ মা কাঁদিস কেনে
আমার পারাই দুখী বটিস...
তাথেই...নাকি...
তোর বুক ফাইঢ়ে তেল জল
কয়লা পাথর আর সকলি
উঠাইঁ লিছে...তাথেই...নাকি...

ইয়াতেও তুমার দয়ার শেষ নাই
ফসল দিছ ধান দিছ
ফুল দিছ ফল দিছ...
তাথেও উয়ারা টাঙ্গি শানাছে কেনে গো মা...
হঁ বুঝলুম... ইয়াতেই তোর চোখে জল...


কবিতাটি পড়তেই আমার আনন্দ ও কষ্ট যুগপৎ হু হু করে বেড়ে গেলো । এতো আমার ভাষা । আমার প্রানের আরাম। মানভুমের ভাষা । কবি তো বেঁচে থাকেন কবিতার মধ্যে, কবিতার ভাষার ভেতরে । হঠাৎ করেই অন্তরের সুদুরতম কোন থেকে বেড়িয়ে এলো "হঁ মা কাঁদিস কেনে"।

এবং কবিতাটি পড়তে পড়তে ক্রমশ নিজের ভিতর ঢুকে যাওয়া ছাড়া আমার আর যেন কিছুই করার ছিল না।

ছোটনাগপুর মালভূমির পায়ের তলায় আমার জন্ম। বেড়ে ওঠা, দাপিয়ে বেড়ানো । এই মাটির নীচে বিশাল খনিজ ভাণ্ডার। মাকড়সার জালের মতো মাটির নীচে ছড়িয়ে আছে গাঢ় অন্ধকার সুড়ঙ্গ । তার উপরের জমিতে কোনোদিন গড়ে ওঠা না বসত, গড়ে ওঠে না বিশাল বাড়ি। ঐ সব জমিতে জ্বল জ্বল করে সবুজ চারাগাছ, সোনালি ফসল ।

কালো সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে,কালো কালো মানুষেরা দুই চোখে চাঁদ আর সূর্য নিয়ে উঠে আসে উপরে, মাটিতে । সারা শরীরে জল ঢেলে পরিষ্কার হয় ,শুচি হয় । হয় পবিত্র। তারপর ক্ষেতে ফলানো ধান আর সবজির শক্তি শরীরে ধারণ করে বেঁচে-বর্তে থাকে।

অথচ এই সুখ ও শান্তির আলপনা মুছে দিয়ে এখানকার বাতাসে বাতসে চিৎকার করে বারুদের গন্ধ। বুলেটের ঝলকানি আর বোমার আগুনে আলোয় প্রতিটি নিস্পাপ চোখ আঁতকে আঁতকে ওঠে।

এই অঞ্চলের প্রতিটি মায়ের চোখ আর জলের যেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে রেখে গেছে কেউ। এবং এভাবেই যেন এক অমোঘ উচ্চারণ হয়ে ওঠে কবিতার শেষ পংক্তি "হঁ বুঝলুম... ইয়াতেই তোর চোখে জল..."।

ধীরে ধীরে আমার প্রানের সাথে, আত্মার সাথে মিশে যেতে থাকেন কবি অরুন কুমার চট্টোপাধ্যায়। ২৯ শে এপ্রিল ২০১২ সালে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও ,আমাকে বা আমার মতো মানুষদের তিনি যেন কিছুতেই ছেড়ে যেতে পারেন না।

কবিতা - যশোধরা রায়চৌধুরী

ভাই
যশোধরা রায়চৌধুরী



হে বঙ্গললনা, ভুলিও না
সস্তার সিনথেটিক শার্ট পরা, কোমরে লুঙ্গি কষিয়া বাঁধা,
আধপেটা খাওয়া ভারতবাসী তোমার ভাই
দুবছরে টাকা ডবলের স্বপ্নে মশগুল হইয়া সর্বস্বান্ত ভারতবাসী তোমার ভাই
কীটনাশক খাইয়া আত্মহত্যা করা ভারতবাসী তোমার ভাই
ফেভিকল শুঁকিয়া নেশা করা ভারতবাসী তোমার ভাই
আগের দিনের মত নরক, নারী এক করিয়া না দেখিয়া, টাকা, মেয়েছেলে ও সুরাকে
এক করিয়া দেখা ভারতবাসী তোমার ভাই
গ্রামে গঞ্জে শহরতলিতে অবিশ্রান্ত খাটিয়া খাওয়া একাকী পুরুষ তোমার ভাই
ক্ষতবিক্ষত জীবনে মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি দেখা ভারতবাসী তোমার ভাই

যতক্ষণ না সে তোমার রেপিস্ট হইয়া উঠে, ততক্ষণ সে তোমার ভাই ভাই ভাই...

কবিতা - বারীন ঘোষাল

থিওরিনা
বারীন ঘোষাল



কাকতাড়ুয়ার ওপরে বসেছে কাক
লেবুগাছে লেবু
স্তনে পম পম
                     সব ছিল
বিন্দু বিন্দু ছবিদের কোয়ান্টাম এসব নাচিয়ে দিলো রক্তে
চোলি ঘাগরা কালার-ব্যান্ড আর নাচুনীরা বিলয়ের নিয়মে পড়েছে

#

হৃদয়ে এ তার রক্ত
রক্তে রক্তিম প্রজাপতি ও তাদের উড়ন্ত ক্লোন
যেমন সিনেমায় বারে বারে

#

হেব্বি সেনিমা ইয়ার
তার ওপরে জোছনা ভেজা সিমেন
চাঁদ নেই তো কী
রানু তো আছে
                        নাবিক আছে বোতল আছে কত কী

#

ছেঁড়া থিওরি এরই থিওরিনা
বাতাসের পেছনে লাগা বাতাস
নাবারিশের দেশ
বিন্দুদের প্রজাপতিদের একটা মালা ভেবেছিলাম
সুতোর কথা
                   সেতারের কথা
                                        কবেকার টুং টাং-গুলোর কথা

কবিতা - অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

ক্ষমা ঘেন্না করে দাও...
অরুণাচল দত্ত চৌধুরী



তোমাকে যে ডেকেছিল, সে তো অন্যলোক
যাকগে যাক, ভাগ্যে থাকলে প্রসন্ন হোক
তার দিনকাল। দয়াময়ী বলোতো এবার
আমি কোনও দোষ করিনি। আপশোষ নেবার
জন্য আমি ডাক পাব কেন? কেন অতর্কিতে,
সাধ্য নেই, তবু বাধ্য যেতে হবে জ্যাকপট জিতে?
হলে ঝাড়পিট বই......অখাদ্য ভিলেন......
তার সাথে দয়াময়ী, কালরাত্রে কোথায় ছিলেন,
ভুল করেও জানিনি তো! তবু ভীত ঠান্ডা কুয়াশায়...
গুপ্তচরেরা এসে জেরা করে কি আনন্দ পায়!

তোমাকে দেখেছে যারা, তারা অন্যলোক...
দৃষ্টির প্রসাদে ... স্বাদে তারা ধন্য হোক!
আমি তো প্রবল অন্ধ, তুমি জানো বন্ধ ঘরে থাকি।
সেই আমাকেই ফেলে, আলো জ্বেলে, এ কোন মাজাকি!
এই দেখ হৃৎপিন্ডত ... মজ্জা দেখ... চূর্ণিত মগজ।
দেখ আর মাপো হাড়, ফিতে নিয়ে ক'ফুট ক'গজ!
রক্তে দেখ লোহা কম, অস্থিতে ক্যালসিয়ামও নেই...
চ্যাম্পিয়নস মিটএ কেন যেতে হবে তবু আমাকেই?
কিছুই চাইনা আর, ভালবাসা...স্নেহ...প্রেম...প্রীতি...
ক্ষমা ঘেন্না করে দাও। শুদ্ধ বললে চাইছি নিষ্কৃতি...

কবিতা - বিদিশা সরকার

তোতাকাহিনি
বিদিশা সরকার



ভ্যালিয়াম ঘুম আলস্য বিছানাবন্দী
জানালার ফ্রেমে সূর্যবন্দী ফটোগ্রাফি
আহির আলাপচারী আবাল্যের সই
কিশোরীর মনস্তাপ আশাবরী ধুন
এভাবে সকালকথা বিজন বিভূঁই

সাজানো বাগানে নানা পরিচর্যা
জড়িবুটি নিয়ে যাই এঘরে ওঘরে
প্রবাসী আত্মীয়তা আজীবন,শুধু
সাবেকি বোলচাল তোতা কাহিনি

কলঘরে জলকথা নিত্য নৈমিত্তিক
নির্জনতা দর্পণে প্রথম মুখোমুখি
ক্লান্ত শরীর ছুঁয়ে খাপে রেক্সোনা
বিছানার দাগ জানি ধুলেও যাবেনা

একবার দিনশেষে ক্লান্ত সূর্য
প্রান্তিকে স্তব্ধ বলে দেবো নিপাটরাত
দেহাতি শরীর তার কোন্‌ অপরাধ
ধানবাদী রাখাল তাকে দেখেও দেখেনা

রাতের অন্ধকার পাহার প্রেতশিলা
দরজা ভেজিয়ে করি সপিণ্ডকরণ
তৃপ্ত আত্মা মজে সেই মহাভোজে
অশরীরী নিয়ে যায় লাশকাটা ঘর !

কবিতা - সুমিত রঞ্জন দাস

যাপিতকাল
সুমিত রঞ্জন দাস



জেনে গেছি -
গোপন বৃত্তান্ত, আড়িপাতা
সাবধানবাণী লেখা নেই স্মৃতিকপালে ।

আধোরাত আধোমেঘ জোৎস্না
বানভাসি চন্দ্রিমায় প্রথম চুম্বন, সোমেশ্বরী সুগন্ধ ঘ্রাণ
নিসিন্দা সমীরে, বিনাশবৃক্ষের তৃষ্ণা -
বুঝে গেছি আমি !

এইসব আগামী,এইসব ভেসে আসা বেনোজল
নাম হোক ~
অন্তহীন বেদনার বাতায়নে ...

কবিতা - আসমা চৌধুরী

হিসাব
আসমা চৌধুরী



রাত ভাঙা সকালে
হেঁটে যেতে সহসাই,
মাছ কিংবা বিড়ি,কিছু দীর্ঘশ্বাস
ঘরে ফেরার হিসেব মেলে না।
ঠাণ্ডা উজানে আপস করে মাঝি
ও মন কী রেখে এলি...

কবিতা - পৃথা রায় চৌধুরী

ভদ্রলোক, তোমায়...
পৃথা রায় চৌধুরী



আঁজলা আঁজলা ফস্কানো তুখোড়
"তোমাকে চাই" দূর ছাই চটা ওঠা
বেঞ্চিকাঠ। পাগলা পাগলা টিক-ট্যাক-টো
আনচান প্রাণ, অস্বস্তির মোড়ে আগুন
হাতটা ধরলে না একবার, কেন এলে নিখুঁত!

কবেকার নহবতে তর্জনী লেগে নিখাদ
সপ্রতিভ ভাবিয়ে যায়, নাহ এ তো চুরি;
তাই জল রেখে দাও, ব্যস্ত দীর্ঘশ্বাসে ঘটি মুচড়িয়ে
মাথাতেই রাখো মাথা, চলকে যেতে নেই দোলক
কিচমিচে ভোর পূর্ব নিশানায়, ভালো থেকো।

স্পর্শকাতর, স্পর্শ কাতর পরমায়ু
হয়ে থেকে যাই অর্বুদ
বুদবুদ বাসা পালটে টালমাটাল।

কবিতা - রঙ্গীত মিত্র

ইনভার্সটা ভালো করে জানা দরকার
রঙ্গীত মিত্র



এখন দেখছি মুখোশেরা খেলে বেড়াচ্চে আমার সামনে
আমাকে তেল মারচে
আমাকে কত কি বলেই তারা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
তাদের এই ব্যাপক বৈতরণী পার করে
আমি সবে মোড়ল- মোড়ল ভাব নিয়ে কাউকে মেসেজ করতে গিয়ে দেখি
আমার পটি পেয়েচে।
এদিকে আমার তো শত্রুর শেষ নেই
দিনে দিনে রাবণের সংসার হয়ে গেছে সব।
তা বলে কি আমি কাউকে ভালোবাসবো না ?
একি, কি বলছি
এক কামসূত্র পেরিয়ে পানুহলগুলোতে ভীড় নেই
কম্পিউটার আর সাউথ সিটিতে অনেক লোক
তাও আমরা মিডিওক্রসির রাজা
রোজ রোজ আমি এইভাবেই গালি দিয়ে থাকি
আর সকালে দ্য হিন্দু পড়ি ।
তবে চাকরি ছেড়ে আর কি চাকরি পাবো জানি না,
তবে রাস্তারও চোখ আছে
বই-এর ভিতর যৌনকর্ম করে রাখা টিকটকি আর
পিছন থেকে সরিয়ে দেওয়র চেয়ার মদের দোকানের মতো
আমি কিন্তু নারী পুরুষের বিভেদের বিরুদ্ধে
একলেখায় লিখেছিলাম এক ভদ্রমহিলাকে মদের দোকানে দাঁড়িয়ে মদ কিনতে দেখি
আর একদিন আমার পাড়ার দোকানের সামানে রিক্সা থামিয়ে সিগারেট কেনা মেয়েটি
সব চোখের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে
আমি ভাবি অনেক সম্পর্ক করবো
সেক্স-এ আমার অরুচি নেই
এর মধ্যে সমাজটা হিপোক্রিটে ভর্তি
মার্কিনায়ন চেপেচে তার ঘারে
ভালো আর নতুন কোনোটাই তার লাগে না ভালো
ট্রাই না বাই জানি না এখনো
পরকীয়াও খুব প্রয়োজনীও
কন্ট্রোল প্লাস জি করে গ্রুপ করে দিলাম
যুক্তির আর যুক্তির বিপরীত
বলে অভিনয় করবো না...;
কন্ডোমটাও না কি একরকম দৈব
তাও এখনো সার্চ করে যাওয়া পুলিশের লাল চোখ
আমার পায়ে কাদার থেকেও মানুষের রক্ত থাকে
আমি ওপেন সোসাইটি
আমি একা থাকলেও একা অন্ধকারের বিরোধিতা করবোই।

( মাইক্রো মিনি না গ্রাউন/তরজায় লাগে /কেপ্রি / হট প্যান্ট থেকে জিন্সে/তোমাকে রোজ-ই দেখে/ফিদা হচ্চি )

কবিতা - শুভেন্দু দেবনাথ

শতাব্দী চলে যাবার পর
শুভেন্দু দেবনাথ



একদিন সমস্ত দুপুর খুলে তুই দেখিয়েছি্লি কমলালেবুর নিভৃত বন
ঘর গুলোর ডাকনাম পোষা বেড়াল,বনসাই হয়ে গেছে ঠোঁট
হাত থেকে খসে পড়া আয়নায় জন্ম নিচ্ছে টুকরো টুকরো বিষাদের মমি
সমস্ত দোটানা যখন গাঢ় হয় তখন সময় নয় ঘড়িটিই একটা ধারণা
টেবিলে তরঙ্গ ছিল কিছু, বদলে এখন খানিকটা পড়ে আছে আঁচ
এভাবেই আলগা মলাটে একদিন ধরা পড়ে যাবে কিছু জং ধরা শব্দ
যে সব শব্দ পাকস্থলির গভীরে জন্মে ক্রমে পায়ুন্মুখী,রোমন্থনের অনিবার্য প্রভাব
তাদের লালায় মিশিয়ে পায়ু পথে বিলীয়মান করে কতবার আশ্চর্য হয়েছি!
কারা আসলে পরিযায়ী হয়, পাখি না মানুষ, স্তিমিত মাত্রাবোধ খুঁজছে ফুলস্টপ
হাসির শিয়রে ভেজানো বালিশের ঘ্রাণ, অমোঘ টানে শেষ কবে উড়ে গেছে মরশুমী পাতা।
দরজা খুলে বহুবার ঘর থেকে টেনে নিয়েছিস কিছু মুহূর্তের মায়াজল,
আর বারোয়ারি দীর্ঘশ্বাস জমে জমে গোটা একটা শূন্যস্থানপুরোন
লালকাঁকড়ার ঝোপে সূর্য ডুবে গেলে নীল জলের বসন্ত ফুরিয়ে যায়
পরিত্যক্ত ইনবক্স জুড়ে খুঁজছি প্রজাপতির ফসিল আর কিছু বোতল বন্দী জোনাকি ।

কবিতা - পার্থ প্রতিম রায়

যেগুলো আরোপিত নয়
পার্থ প্রতিম রায়


এখন চাই বুকের উপর অনাবৃত জলন্ত চুল্লী..
স্রেফ আজন্মের অতৃপ্তি যন্ত্রনা তোকে দিতে পারি ।

পুরুষের বিলাসবাসিনী পুতুল হবি ?
নাকি উত্তপ্ত আবেগ ভাঙব তোর ওই উদ্বেল ঠোঁটে

সত্যসাক্ষী লেজ ভাঙ্গা টিকটিকি,তোর বুক বেয়ে
এলোমেলো মিশে যাচ্ছে দ্বিধা-নমিত মুখে

অদৃশ্য শিখা আমার শয্যাসঙ্গী, নিমেশইদ্বিধা
ঢেলে অশান্তির চুক্তি

মূলত- দর্জির মতো আনুষঙ্গিক ফাঁকিতে
দরজা কাঁপা আর্তনাদগুলো বারবার আরোপ করি

আর সঙ্গে সঙ্গে মুষড়ে পড়ে ঘোর বিরোধিতা।

তাই হয়তো ভাগ্যকে দোষ দিয়ে ঈশ্বরের নজরবন্দীহওয়া
-আমার কাজ নয়।

তাই আমি নস্টালজিক বদমাশ হতে পারি, কাপুরুষ নই।

ধারাবাহিক - অভীক দত্ত

বিলাভারত ৫
অভীক দত্ত



১।

আগের লেখায় পরস্ত্রী সম্পর্কে মহাভারতের ভূমিকা বললাম। এবার বলি সুরা বা সোমরস সম্পর্কে। দেবতা আর দানবের যুদ্ধে দানবদের গুরু ছিলেন শুক্রাচার্য। তিনি সঞ্জীবনী মন্ত্র জানতেন। দেবতারা যে সব দানবদের মন্ত্র শুক্রাচার্য ওই মন্ত্র পড়ে সবাইকে জ্যান্ত করে দিতেন। এদিকে দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি এই মন্ত্র জানতেন না বলে যুদ্ধে মৃত দেবতারা একের পর এক টপকে যেতে লাগল।

দেবতা দানব মানে কি ছিল তখনকার দিনে কে জানে, সত্যি সত্যি তো আর সব ভগার অবতার ছিল না, নিশ্চয়ই আর্য অনার্য বা অন্য কোন জাত পাতের মারপিট ছিল। যাই হোক, দেবতারা বৃহস্পতির পুত্র কচকে পাঠালেন শুক্রাচার্যের কাছে। আর টিপস দিলেন কচকে শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীকে তুলতে পারলে ওর বাপ ফিট হয়ে যাবে।

কি আর বলব । এই জিনিস তখনও ছিল এখনো আছে । মেয়ে ফিট তো বাপ ফিট । তা কচ ফিট করেও নিল দেবযানীকে । এদিকে ভিলেন দানবরা জেনে গেল সেটা । কচকে মেরে দেহ খন্ড খন্ড করে কুকুরকে খাইয়ে দিল । দেবযানী শুক্রাচার্যকে বললে সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে দিলেন কচকে । পরপর দুবার এই ঘটনা ঘটবার পর দানবরাও চালাক হয়ে গেল । কচের দেহ খন্ড করে মদের সাথে শুক্রাচার্যকে খাইয়ে দিল ।কি হবে এবার ? অনেক হুজ্জত করে বাঁচানো হল কচকে । তারপরই শুক্রাচার্য এই অ্যানাউন্স দেন

“যে মন্দমতি ব্রাহ্মণ মোহবশে সুরা পান করবে সে ধর্মহীন ও ব্রহ্মহত্যাকারী তুল্য হবে”।

অর্থাৎ সে আর ব্রাহ্মণ হিসেবে গণ্য হবে না।

নাও, এবার সামলাও ঠেলা। কে মাল খেল আর কেস খেল কে!!!

২।

যুদ্ধের গল্প ছোটবেলায় খুব শুনতাম। সেটা চর্বিত চর্বণ করার ইচ্ছা হল । কর্ণ আসলে কার ছেলে তখনকার দিনে সবাই জানলেও আসলে তাকে নিচুজাতি হিসেবেই দেখা হত । দুর্যোধন যখন কর্ণকে সেনাপতি নিযুক্ত করল কর্ণ হঠাৎ এক অদ্ভুত কথা বলে দিল । শল্যকে তার সারথি হতে হবে । দুর্যোধন যখন শল্যকে এই কথা বলল শল্য বহুত খচে গেলেন । তিনি যুদ্ধ ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন ।

দুর্যোধন শল্যকে আটকাতে গেলে শল্য ফিরলেন ঠিকই কিন্তু এই শর্ত রাখলেন যে তিনি কর্ণকে যুদ্ধের সময় মনের সুখে স্লেজিং করতে চান এবং তাতে যেন কেউ কিছু না বলে ।

এ যেন ইন্ডিয়া টিম অস্ট্রেলিয়া গিয়ে ০-৩ টেস্ট ম্যাচ হারছে আর দলের সিনিয়ার প্লেয়াররা গোষ্ঠীবাজি শুরু করেছে।

সারথি হবার সাথে সাথে শল্য কর্ণের এমন মাথা খারাপ করে দিয়েছিলেন যাতে পতন ও মৃত্যু ছাড়া কর্ণের আর কোন উপায় ছিল না। আসলে শল্য ছিলেন মাদ্রীর ভাই। দুর্যোধনকে যতটা ভালবাসতেন তার থেকে অনেকবেশি ভালবাসতেন পাণ্ডবদের। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় যখন তিনি পান্ডবপক্ষে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন তখনই দুর্যোধন তাকে বোকা বানিয়ে কৌরবদলে নিয়ে যান।

অনিচ্ছুক ঘোড়াকে নিয়ে যুদ্ধে গেলে কি কি ক্ষতি হতে পারে তা শল্যের কাহিনী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।

শল্য ছিলেন এক অদ্ভুত চরিত্র।



৩।

মহাভারতের সবথেকে ঘৃণ্য বীর হল দ্রোণাচার্যের ছেলে অশ্বত্থমা।কুরুক্ষেত্রের শেষে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত লোকেদের মেরে বিরাট বীরত্বের পরিচয় দিতে চেয়েছিল।

তবে এখানে একটা স্বপ্নের গল্প আছে।

অশ্বত্থমা যখন শিখন্ডী এবং দ্রৌপদীর ছেলেকে মারতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময় তাদের রক্ষীরা তাকে দেখে চমকে যায়। তারা নাকি কদিন আগে থেকেই স্বপ্ন দেখছিল মা কালীর (মা কালীর উল্লেখ মহাভারতে একমাত্র এখানে ) সাথে এক পুরুষ তান্ডবনৃত্য করে রাতের অন্ধকারে তাদের সংহার করতে আসবে । তারা যুদ্ধ করছে ভয়ে ভয়ে আর বলছে এই সেই লোক এই সেই লোক ।

বোঝো কান্ড ।

ধারাবাহিক - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার



২২।

নদীর ভিতর নদী শুয়ে থাকে।নদীর মধ্য থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।হাই তোলে।পায়ে পায়ে গড়িয়ে যায় রাস্তা,গলি তস্য গলি । বস্তির বাচ্চারা গান গায়।গানের গায়ে জড়িয়ে যায় খিস্তিখেউড়।আবার এক একদিন সীমাহীন এক প্রান্তর হয়ে ওঠে পৃথিবী। বাতিদান বেয়ে রক্ত গড়িয়ে নামে।রক্তের দাগ অনুসরণকারী পাখিরদের ডানার নীচে কাঁচপোকা,ফড়িং ।জীবন কাঁটাগাছের দিকে পাশ ফেরে। দেশাচারের নকশির ভিতর হরেকরকম মানুষজন।বিলাপরত স্কুলবালিকা।গান বাজনার তাড়সে সংকরমনতায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া মাঠ প্রান্তর থেকে উড়ে আসে প্রজন্মপীড়িত কথকেরা।তারপর লোককথার ঢঙে গল্প এগোতে থাকে।অন্ধকারের নদীর পাশে তখন ভূতুড়ে ভাটিখানা।আর চোখে জল আসতেই মাতালেরা সব প্রেমিক হয়ে যায়।প্রান্তবাসীর হাতে হাতে বাঁশি ঘোরে।বাঁশি বেজেও ওঠে আচমকা।তখন হেরম্ব বর্মন উঠে দাঁড়ায়।মহামানব হতে পাবার সুযোগ হেলায় সরিয়ে দিয়ে সে ধুলো-মাটি আর মানুষের আখ্যানমালা সাবলীল বলে যেতে থাকে।অবিরাম তাঁতকল ঘোরে।আর নদীর মধ্যে থেকে তুমুল এক নদী উঠে আসে।



২৩।

ভালো ভালো গান শুনে বড় হয়েছি।নানা রঙের মানুষ দেখে দেখে বেড়ে উঠেছি আমি।অপমানের পর অপমান,গলাধাক্কা ডিঙিয়ে আমি এসেছি খোলা আকাশের তলে।আর নতুন শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উলুধ্বনি ভেসে আসে,রাজবংশী মেয়েদের দলবদ্ধ নাচ।বিবাহ উৎসবের দিকে যাত্রা শুরু করল একটি নিঃসঙ্গ পালক।

এতসব টুকরো,ছেঁড়া খোঁড়া সময় যাপন অভিঞ্জতা আমাকে সবসময় ঘিরে থাকে

এই বহুমাত্রিক জীবনই তো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে।আমি ইতিমধ্যেই দেখে ফেলি সবচেয়ে নিষ্ঠুর তম মানুষটিকে।আর গাছের পাতায় আঠা মাখিয়ে সারাদিন ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করত বাবুলাল বাঁশফোঁড়।অন্ধকারে শতশত জোনাকি পোকা।আমার তরুণ বন্ধুরা সব গোল হয়ে বসে থাকে ।বাঁশের সাঁকো থেকে দীর্ঘতম সুড়ঙ্গপথ-সমস্তটাই আমার কবিতা জীবন।লোকায়ত ভুবন যার ভিতর থেকে আমার আর কোনওদিনই বেরিয়ে আসা হবে না।অথচ ব্যাধ যুবকেরা সব একদিন ভুলেযাবে প্রলাপকথন। আর মাটির ঊঠোন থেকে অনিবার্‍য কিছু গান গোটা জীবন আমার সঙ্গে থেকে যাবে।আর জীবনের বৃত্তে ঘনঘন আছড়ে পড়বে উড়ন্ত ঘোড়া,হস্তচিহ্ন।এবং উৎসব গাথা।

ধারাবাহিক - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়


১।

আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে...


সে তাকিয়ে থাকে আর দেখে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালগুলো শুয়ে, জানলাগুলো নুয়ে আর ছাদ ভুঁয়ে এসে পড়েছে। বাইরে আকাশের দিকে একটা তোরণ, হতে পারে কোন মণ্ডপ আর নহবতখানা। তার আগে মেঘে মেঘে কিছু রঙ হয়েছিল। পৃথিবীর কন্যাদের বিদায়। এই সময়, যে, কন্যে নয়, হাইওয়ের দিকে উঠছিল। পেট্রোল ভ্যানের আলো মাপমত তার পেছনে এসে পড়েছিল। তারপর আর কিছু জানা নেই।

বিষাদ জ্বর নিয়ে গাছগুলো, মনে হয়, দেখেছিল। প্রলাপমারীর মধ্যে ছিল তারা। তাই সে ভাষা পাতায় পাতায় বোনা আছে। কোনদিন পাঠোদ্ধার হতে পারে। এদিকে তোলাবাজরা আকছার দানা ব্যবহার করছে। সন্ধের পর থেকেই শোনা যাচ্ছে সেসব অনিপুণ হাতের কারবার। ভারী ভারী মোটরবাইক সব শহরে ঢুকে পড়ছে। যেসব দোকানীরা ফ্লাইওভার, মেট্রো, মল শুঁকে শুঁকে এসেছিল, তারা হাতের সাথে সাথে ল্যাজও গোটাচ্ছে। হয়েছে বেশ। খচ্চর ছোকরারা যা যা মারাচ্ছিল, তার সাথে সংস্কৃতি মিশিয়ে দিচ্ছে। দেদার। লুটছেও ভাল।

সে শুধু লক্ষ্য রাখছে। হিপ পকেটে একটা ছোট নোটবুক, আর পেন্সিলারদের হাতে যেরকম থাকে ঠিক সেরকম একটা পেন্সিল। সুযোগ পেলেই আঁকিবুঁকি কাটছে। আর এমন ভাবে লেখাগুলো আওড়াচ্ছে যে মনে হচ্ছে বাপের না হলেও তার নিজের শ্রাদ্ধের খরচপত্রাদি। একাজে স্টেশানটা তাকে সাহায্য করছে খুব। স্টেশানের নিচে বাজারচত্বর। সব কটা নেশার ঠেক। মদ্দামাগি। শনিমন্দির লাগোয়া মাদুলির দোকান। গেল শনিবারের শালপাতা যেখানে একটা বাছুর চাটছে, ঠিক তার পাশ দিয়েই হাইওয়েটাতে উঠে যাওয়া যায়। এখন একটা ছেলে আর দুটো মেয়ে উঠছে। আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে।



২।

তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে…
বাজারী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় যেসব মফঃস্বলের কবিদের লেখা ছাপানোর আমন্ত্রণ জানানো হয় নি, তারা স্টেশান পেরিয়ে, এই প্রাচীন রাস্তাটার মোড় পেরিয়ে, বহু জন্মের নার্সিংহোমটার ঠিক নিচে, অফ্-সপটার সামনে, বাওয়াল দেয়। আর নক্কা ছক্কা নেশার পর যাদের লেখা ছাপা হয়েছে তাদের মা-মাসি করে। এরকমই একটা চাপের সন্ধ্যায় সে সেই নার্স-দিদিমণিকে নার্সিংহোমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে ও দেখতে থাকে। তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে।

আর ঠিক তেমনই তার শাদা জুতো।

নার্সদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণেই সে বাওয়াল দৃশ্য ত্যাগ করে তাকে অনুসরণ করে। ফোর পয়েন্ট ক্রসিঙে যে একটা নিদারুণ শাদা গাড়ি যে একটা নিদারুণ লাল আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল, দিদিমণি এসে সে-টাতে উঠে পড়ে। গাড়িটা শান্ত ও স্নিগ্ধ ভাবে গড়াতে শুরু করে, যেন তার অ্যাক্সিলিয়েটরে চাপ পড়তেই সন্ধ্যে হেলে যায়। আর ঠিক

সে সময়েই, ভারী মোটরবাইকটা, এই দৃশ্য-কাব্যের মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়বে বলে, সাইলেন্সর পাইপ ফাটিয়ে, গর্জনরত অবস্থায় গাড়িটার পিছু নেয়। এরপর আর কিছু জানা নেই। কারণ, জানা যায় না।

সে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। গুনে গুনে দুটো হোঁচট খায়। কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টকে সময় জিজ্ঞাসা করে। কাঠিকাবাব রোলের দোকানটা বন্ধ দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তারপর তার ডেরায় ঢুকে পড়ে।সেদিনের যা যা অনুসন্ধান নোটবুকে লিখে ফেলে। পেন্সিলটাকে ভাঁজে যত্ন করে রাখে।

এ সময়ে মোবাইলটা দুলে দুলে ওঠে। শব্দ তার কাছে বিভীষিকা বলে সে ওটাকে নিথর করে, ঠিক সেই নির্দেশে, যেভাবে ভাষ্যময় গলায় থিয়েটার শুরুর আগে রেকর্ডেড বাজানো হয়। সে অজান্তে হেসে উঠে। নিজেকে হেসে উঠতে শুনে একটু লজ্জিতও হয়। কারণ, তার বুকশেলফের পেছনে আর একটুও তলানি স্কচ নেই। যে কলটা ইনকামিং, সেটা তাকে আরও কিছু সময় বিব্রত করবে। তার আগে গলায় ঢেলে দিতে পারলে হত। কান দুটো গরম আর ভারী পড়ত। সে বাদ দিতে দিতে শুনত। তারপর না হয় বাদানুবাদে যেত।


৩।

... তখন ঠিক কী কারণে আকাশে একটা তারাবাজি ফুটেছিল...
ফ্লাইওভারের ঠিক নিচে তাকে যখন ফেলে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ঠিক কী কারণে আকাশেএকটা তারাবাজি ফুটেছিল, তা অন্যান্য অনেক কিছুর মতই জানা যায় না। ট্রাকের খালাসিরা, এক-দুজন করে, এক্সপ্রেসওয়ের ওধার থেকে প্রাতঃক্রিত্য সেরে নেমে আসার সময়ে তাকে দেখে। তবে, তাকে দেখার মত শুধু যা ছিল, তা তার অনিন্দসুন্দর গোড়ালি। এই একটা ভাবেই তাকে শনাক্ত করা যেত। আর সেটা একজনই পারত। বাকি কিছুর জন্য ফরেন্সিক রিপোর্টের অপেক্ষা করতেহবে।

প্রথম রাতটায় সে বিশেষ একটা ঘুমোয় নি। তবে একটা ঘোর ছিল। বেশ কিছু ছায়া ও ছবিরা তার ঘরের উত্তরমুখো দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ওই দেওয়ালের জানলা থেকেই এক্সপ্রেসওয়েটা দেখা যায়।

সে ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন সে ওঠে, বেলা গড়িয়ে গেছে। সমস্ত প্রামাণ্যসাক্ষ্য-চিহ্ন সহ। জটলারা আরও দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। কথারাও কান থেকে কানে ছড়াতে ছড়াতে হাওয়াকথা হয়ে গেছে।


৪।

শালা হিজড়ের দল। সব কটার এক রা…
--খুব বেশি বাওয়ালি হচ্ছে...

লেখালেখির গাঁড় মেরে রেখে দেব

--হুঁ

-- হুঁ কি রে, বে? শ্লা...

--মাদারচোদ, সামনে এসে বল...

--দাদা হয়ে গেছ, সম্পাদকের দপ্তর পর্যন্ত এখন নাক গলাচ্ছ...

--মা,বউ, বউদিমণি সবার কোল ফাঁকা করে দেব

সে মনে করতে চাইছিল ঠিক কী ঘটেছিল, বাওয়ালটা কী নিয়ে কারা দিচ্ছিল...

এরপর কিছু মনে পড়ছিল না। আর কী নিয়ে দিতে পারত! দু আনার আবগারি। অল্প দাড়ি, পাঞ্জাবি গায়ে হাফ নেতা গোছের ছেলেটার চাকরিটা পর্যন্ত বদান্যাতায় পাওয়া। পাশেরটা রেহ্যাব থেকে সবে ফিরেছে। রেগ্যুলার উইথড্রয়াল।

শালা হিজড়ের দল। সব কটার এক রা।

তারপর সে রিপোর্টের দাগানো অংশগুলো আর এক বার দেখতে লাগলঃ


On December 14, 2012 Investigator Mr. Y of Kolkata Police, Law Enforcement Department sent me a sample to determine if the odor present in the sample was indicative of a decompositional human event.

… … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … …

However, a Secret Service agent asserted that a hair found on the white car window proved that Ms. X was sitting by the back passenger window, not out of range of the gun.

… … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … …

I’m willing to testify this fact in a court of law and I will prove to the court that my opinion is correct. My Curriculum Vitae is attached and incorporated herein by reference.

Respectfully submitted,

Z


পি. এইচডি. রিসার্চ সাইন্টিস্ট তার প্রিলিমিনারি রিপোর্টে যে তথ্যাদি জানিয়েছিলেন।



৫।

পেন্সিল বললেই ছোটবেলা নটরাজ হয়ে যায়...
সেদিন সকালবেলা সে যথারীতি হাঁটতে বেরিয়েছে। ব্যারাকপুর কমিশনারেট ফর য়্যু আলো ফোটার আগে থেকেই কর্তব্যরত। ফোর-পয়েন্ট ক্রসিঙের গোলচাক্কিটাতে রং ঝলমল করছে। টুনিও জ্বলছে। নিবছেও। সে এক হয়েছে মজার। কী, কেন, কবে, কোথায় অপ্রয়োজনীয়। একটা কিছু লাগিয়ে দাও। গোটা শহরটাই একটা চাঁদমারি। লাগাতে পারলেই হবে। দাউ দাউ হবে। হচ্ছেও।

নিজের মনে বকতে বকতে এক সময় বকা ছেড়ে সে গতি বাড়াল। ঘামে ভিজতে হবে। কেউ রক্তে। সে সব পরে ভাবা যাবে। মানিকের ‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্পটা তার মনে পড়ল। সে পড়াত। না, দম বাড়িয়ে নাও। চোখের ওপর আর জুলপিটাতে ঘাম সামান্য চিকচিক করছে। রাজরোগ বলে কথা। নিয়ন্ত্রণে রাখ। নাহলে তারিয়ে তারিয়ে ফুটে যাও। অবশ্য কাউকে হিসেব দাখিল করার নেই। কিন্তু প্রত্যেকেরই তো নিজের কাছে নিজের একটা লেনা দেনা থাকে। তার মাপের নিজস্ব একটা হিসেবের খাতাও থাকে। তার ভাঁজে একটা টুকরো পেন্সিল।

পেন্সিল বললেই ছোটবেলা নটরাজ হয়ে যায়।

সেই পরাগ না কেশরে স্মৃতি লেখায় সে পেন্সিলটাই মনে করতে পারে নি। আবার একটা মেমরি-গেম খেললে কেমন হয়!

হাঁটতে গিয়ে উল্লেখযোগ্য সে যা যা দেখেছেঃ

১। শারদীয়া ও দীপাবলীর শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। বুড়ীমার শব্দবিহীন আতসবাজী। বেলুড়, হাওড়া।
(সব কটা বানান নির্ভুল ছিল)

২। Xpert Tutorial, WB Board, ICSE & ISC, CBSE, VII- XII, NEET, JEE
Also Home Tutors Available for All Subjects.

৩। উত্তর ২৪ পরগণা জেলা কমিটির ডাকে, ১লা এপ্রিল, প্রগতি সংঘের মাঠে বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী
কমিউনিস্ট নেতার স্মরণ সভা।

ঠিক তার পাশেই-

৪। সাম্রাজ্যবাদ অনুসৃত কর্মসংকোচনের নীতির বিরুদ্ধে কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের দাবীতে যুব সমাজ
এক হও। (পাশে চে ও তারার ছবি)

৫। MAGMA GOLD LOAN (ম্যাগমা গোল্ড লোন) টোল-ফ্রী নম্বর 1800 3002 3200

৬। Entertainment, Real Estate & Food Hungama…

সে খুব মনে করতে চাইল ইভেন্টটা কোথায় ছিল। বাল, এগুলো তার কাজ!



৬।

অক্কা আর ফক্কার মিল মিশেলে কানাঘুষো ছড়াটা কেমন হত, সে যখন ভাবছে তখনই ফোনটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল।

জমে গেছে। শচীন কত্তার গানের মত। বাঁশি শুনে আর কাজ নেই। এখন খালি হুটার শোন আর লাল বাতি থেকে আলো ছিটকে পড়া দেখ। কানাঘুষো একটা ছড়াও শোনা যাচ্ছে, শোন সেটাঃ
ফকিরের কানা চোখে
রাতফুল ফোটে
চাতকেরা উড়ে উড়ে
চাঁদমারি লোটে

কানা ফকিরটাকে তাকে রক্ষা করতে হবে। চানা দিতে হবে আর পানি। সে অক্কা পেলে চলবে না। তাহলে সব ফক্কা। অক্কা আর ফক্কার মিল মিশেলে কানাঘুষো ছড়াটা কেমন হত, সে যখন ভাবছে তখনই ফোনটা কাঁপুনি দিয়ে উঠল। আধার কার্ডের নিচে ফোনটা ছিল। কাঁপতে কাঁপতে মুখ বাড়াল। মুখে অস্বস্তির রেখা। তারও মুখে চোখে জুড়ে বসল।

যে আলালের পো ফোনটা করেছে, সে তাকে চেনে। স্রিফ ছেনালি।

কিন্তু সে ততক্ষণে মাইন্ড গেম শুরু করে দিয়েছে।

অ্য্যপোলোতে সে যখন বসেছিল, খুব মনে করতে চাইল, কী দেখেছিল সে!

1st Floor (দ্বিতীয় তল)
Echocardiography (ইকো)
Ultrasound (ইউ এস জি)
Pulmonary Function Test (PFT)
Tread Mill Test (TMT)
Breathe Easy Clinic
Electro Cardio Graphy (ECG)

আর একটা সতর্কীকরণ ছিলঃ

Please Switch off Your Mobile Phone inside Consultation Suit

আবার ফোনটা দুলুনি দিয়ে উঠল...

ইংরাজী কবিতা - ইন্দ্রাণী সরকার

ইংরাজি কবিতা
ইন্দ্রাণী সরকার




A Silent Night

This night reveals its gorgeous beauty.
With distant stars dazzling on a black carpet.
And the full moon shines with her luminosity.
Fireflies kindle like wings of an angel in the dark.
The breeze flows through the whispering woods.
The flowing river in proximity breaks the silence,
When I walk with you with our hand in hand
And leaving behind our footprints on the land.




My Angel

My Angel, you are standing
on a silvery white rose,
With your arms raised high
in a ballerina- like pose.
Wearing a silky white garment
and silvery white shoes,
You fly in the sky spreading your
wings amid rainbow hues.
The golden crown on your head
creates a magnificent sight.
It glitters with enormous luster
on this starry moonlit night.
While you start floating through
the clouds amidst a blue sky.
The crescent moon and the stars
stare at you, as you fly high.



শিল্পকলা - প্রণব ঘোষ



UNTITLED
( 2010 )
Ink on paper
10" X 18"
Artist - Pranab Ghosh

শিল্পকলা - ময়ূর কৈলাস গুপ্তা




FRIENDS
( 2010 )
Colour on wood
20" * 6.5" * 7" each
Atrist – Mayur Kailash Gupta

শিল্পকলা - লালু প্রসাদ সাউ



UNTITLED
( 2010 )
Charcoal and pencil on paper
15" X 12.5"
Artist – Lalu Prasad Shaw


শিল্পকলা - সুধীর পাটোয়ারধান




HEAD
( 1998 )
Charcoal on paper
24" X 17"
Artist - Sudhir Patwardhan