কলম যোদ্ধা
রেজওয়ান তানিম
হাহ, আজ আবার হাতে নিয়েছি কলম!
কত দিন পরে ঠিক মনে নেই-
হয়ত বছর তিনেক হবে। বা আরো বেশি
অবশ্য এর কারণ এই নয় যে;
পুরোনো ধাঁচে, পুরোনো সুরে, সেই পুরোনো
বিষাদক্লিষ্ট মন নিয়ে, সেই গানগুলি আবার গাইব ।
যাক সে কথা, আগে বলে নেই, কেন ছেড়েছিলাম কলম আমি
তার কাহিনী।
বছর দু তিন আগেকার কথা।
তখন আমার পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর বয়স।
স্বীকার করছি, সময়ের চেয়ে ছিলাম
অনেক বেশী অপরিণত। নইলে এত মিছিল, মিটিং
দাবি আদায়ে এত মানুষের নিরন্তর সংগ্রাম দেখেও
আমি ছিলাম নির্বাক, নিশ্চুপ! নিয়মিত ক্লাস নেয়া
সন্ধ্যায় লেখালেখি - কেটে যেত নিরুত্তাপ জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের এত উত্তেজনা, মিছিল করা দেখে
মনে মনে বলতাম, ছেলেমানুষের দল!
ওদিকে আপামর জনতা, রাজনীতিবিদেরা হাতে মেলালেন হাত,
ছাত্রনেতাদের কণ্ঠ হয়ে উঠল অগ্নিঝরা।
বর্ষার ফুসে ওঠা, দুকূল ছাপানো পদ্মার জোয়ারের মত
বাড়ছে আন্দোলন, সবার মত মলয় বাবুরও বাড়ছে দুশ্চিন্তা।
আমায় বললেন তিনি; আনিস সাহেব, দেশের খবর রাখেন?
আমি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলি, রাখি তো ।
ইয়াহিয়া ক্ষমতা ছাড়বেন, বঙ্গবন্ধু হবেন প্রধানমন্ত্রী ।
কল্পনায় ভাসবেন না, থমথমে মুখে বলেন
মলয় চক্রবর্তী, যুদ্ধ আসন্ন ।
এরপর এলো কালরাত, অন্ধ বিভীষিকা, মারণাস্ত্রের
নগ্ন হুংকার ঢাকার আকাশে বাতাসে।
একাত্তরের পঁচিশ, সে রাতে আমি ঢাকায় ছিলাম না।
পরদিন এসে দেখি, ঢাকার রাস্তায় ছোপ ছোপ
জমাট রক্ত। ইকবাল হল, জগন্নাথ হল এখন ধ্বংসাবশেষ ।
আকাশে ওড়াউড়ি একদল হাড়গিলে শকুনের।
আমি ঘরের পানে পা বাড়াই, দুঃশ্চিন্তার ডালি নিয়ে।
ফিরে দেখি, মেঝেতে লুটানো মা’র কাতরানো, বোনটি ঘরে নেই।
ছোট ভাই’টার হাতে ধরা কোরআন, শক্ত নিথর লাশ তার
দেয়ালে হেলান দেয়া, খোলা চোখে কি বীভৎস ভীতি!
আমি স্তম্ভিত, চেয়ে দেখি-বাবার রক্তে ভেসে গেছে
ঘরের মেঝে। আমি ভুলে গেলাম কাঁদতে, এ কী নিষ্ঠুরতা,
ভাই হয়ে ভাইয়ের রক্তহরণ!
আমার বিবেক আমায় দিল ধিক্কার, তীব্র হুংকারে
বলল আমায়, কাপুরুষ তুমি ।
জেগে ওঠো, শক্ত করো তোমার পেশী গ্রন্থি। ছাড়ো কলম
তোলো অস্ত্র। জানিনা কোথা হতে এলো এত সাহস,
এই সাদাসিধে আমার প্রাণে, নিরস্ত্র আমি
যুদ্ধে নেমে পড়ি। কী দিয়ে যুদ্ধ করেছি,
সে প্রশ্ন একান্তই অবান্তর আজ। কেননা হৃদয় দিয়ে যে যুদ্ধ হয়
তাতে অস্ত্রের দরকার পড়ে না! সামান্য বিস্ফোরক তখন
হয়ে ওঠে ধ্বংসাত্মক, আর্জেস গ্রেনেডকে উড়িয়ে দেয় এক ফুঁৎকারে।
দোলনা রাইফেল তখন হারিয়ে দেয় একে-৪৭ কে।
মনে পড়ে - সেই গাঁয়ের বধূর কথা, যার ঘরে একবেলা
খেয়েছি ক্ষুধার অন্ন। আপনি খাবেন না
জিজ্ঞেস করতেই, হাসি মুখে উত্তর তার-
আপনারে খাওয়াতি পারলাম, এই মোর পুণ্যি।
ফিরবার সময় ফিরবার সময় তার কান্নার ধ্বনি
ভগবান আপনাগো ভালা করুক- এই যে ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ
জাত-পাত, ধর্মের বিভেদ ভোলা বাঙালির এক সুর;
সেই শক্তি মারণাস্ত্রের থেকে শক্তিশালী হাজারগুনে!
সে লিখল, বিজয়ের ঐতিহাসিক মহাকাব্য।
যুদ্ধ শেষ, দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠার দিন হল শেষ।
তথাকথিত বিজয়ে সবাই খুশি। কিন্তু আমার জীবন যুদ্ধ
চলতেই থাকে। সে আমায় গুপ্ত হন্তারকের মত
আঘাত করে নিয়ত, পিছন থেকে। বারবার মনে আসে
তার উপহাস ভরা কথাগুলি, কলমের দাসত্ব করে
কী পেলি? যাও বা পেলি, হারালি তো সর্বস্ব।
সত্যিই তাই-মায়ের পঙ্গুত্ব, বাবা, ভাইয়ের মৃত্যু
বোনের সম্ভ্রমহানি; আমারই ভুলে আমারই অবহেলায়।
অনুতাপে জর্জর আমি ছেড়ে দিলাম চাকরি,
ছাড়লাম লেখালেখি।
তারপর বছর খানেক যেতে না যেতেই দেখি
আবার যুদ্ধের ডাক! একী অনাচার, অবিচার-
বজ্রগর্জনে হুংকার দেয় সরকারি চাটার দল।
কবিরা লেখেন কবিতা - ভাত দে হারামজাদা,
সিরাজ শিকদারেরা হারায় ক্রসফায়ারে।
ছোট্ট শিশুর ক্ষুধার অন্ন জোটে না। গরিবের কম্বল
শোভা পায় চেয়ারম্যানের দামি খাটে। সামান্য খাবার নিয়ে
মা শিশুর কাড়াকাড়ি, মায়েরই ঢিলে মৃত্যু হয়
অভুক্ত সন্তানের। দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাস চারিদিকে;
আমায় নাড়া দেয়। আমার বিবেক জাগ্রত করে।
সে বলে, আবার এসেছে যুদ্ধ তবে ভিন্নরূপে।
এবারে কোন দৃশ্যমান শত্রু নেই, এবার যুদ্ধে জয় পাওয়া
হয়ত অনেক কঠিন, তবু এগিয়ে যাও লেখনীর যুদ্ধে;
কলম যোদ্ধা তুমি। তুলে ধর অন্যায় যত
তোমার লেখায়।
এই আমার দ্বিতীয়বার কলম ধরবার কাহিনী!
এবারের যুদ্ধেও আমি ঢেলেছি হৃদয়ের সবটুকু। একাত্তরে
অস্ত্র ছিল হৃদয়, তাই সে ছিল বল্লমসম লক্ষ্যভেদী।
আজও সেই আমি নির্ভয়ে নেমেছি অন্যায় দমনে, সত্য উদ্ধারে ।
হয়ত এ যুদ্ধ বিশাল দীর্ঘস্থায়ী, ক্ষয়ক্ষতি সীমাহীন;
তবু চলবে আমার যুদ্ধ। কারণ এ যুদ্ধের জয়েই
লেখা হবে বাঙালির সমৃদ্ধির ইতিহাস। যেমন একাত্তরে
লেখা হয়েছে আমাদের আত্মপরিচয়ের কথা। এবার
আমাদের জিততেই হবে, হেরে গেলে আমরা বিনষ্ট হব;
হারাবে আমাদের জাতিসত্তা। তাই এ যুদ্ধ
আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ।