শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

প্রবন্ধ - ব্রততী চক্রবর্তী

আমার শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন
ব্রততী চক্রবর্তী



শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রোমাঞ্চকর পর্ব । শ্রীকৃষ্ণকীর্তন আবিষ্কারের পর বাংলার সাহিত্য জগতে যে ঝড় উঠেছিল তার রেশ এখনো ফুরিয়ে যায়নি । রচয়িতা থেকে রচনাশৈলী তথা রচনা কাল - সমস্ত প্রকারে তৎকালীন বাংলা সাহিত্য মোদী তথা সমালোচকদের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যেভাবে বিচলিত করেছিল তার প্রমান সাহিত্য- পরিষৎ পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলি ! একদিকে চণ্ডীদাস বিতর্ক, ভাষা ও লিপির পুরাতাত্ত্বিক অবদান আর অপরদিকে রুচিহীনতার অভিযোগ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে সর্বকালে বিতর্ক ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু করে রেখেছে।



১৩১৬ সালে (ইং ১৯০৯) বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া বিষ্ণুপুরের কাকিল্যা গ্রামের শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের গৃহ থেকে এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক এই বৃহৎ কাব্যটি বসন্ত বাবুকে অত্যন্ত উৎসাহিত করে। ওই কাব্যের দ্বিতীয় অনুলেখন বহু সন্ধানে ও পাওয়া যায় নি। তাল শিক্ষার একটি পুঁথিতে কয়েকটি পদ পাওয়া গেলেও এই গ্রন্থ এক ও অদ্বিতীয় । প্রাপ্ত পুঁথির মধ্যে এক টুকরো তুলোট কাগজ পাওয়া যায় । এই চিরকুট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে বনবিষ্ণুপুরের রাজ গ্রন্থাগারে ১০৮৯ সালে পুঁথিটি বর্তমানের প্রমান পাওয়া যায় । অনুমান করা যায় বৈষ্ণবধর্ম অনুসারী বনবিষ্ণুপুরের রাজ পরিবারে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক অনেক পুঁথি ই ছিল। সম্ভবত ওই বংশের রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র বংশধর শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে রাজ পরবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারনে ওই পুঁথি শ্রী মুখোপাধ্যায়ের অধিকারে আসে। যাইহোক, ১৩১৮ সালে ওই গ্রন্থটি বসন্ত বাবু কর্তৃক সাহিত্য পরিষদের জন্য সংগৃহীত হয় এবং ওই বছর ই সাহিত্য- পরিষৎ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় এই গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রকাশিত হয় । কিন্তু মুদ্রিত না হওয়ার কারনে অনেকেই এর সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেননি । পরবর্তীতে ১৩২২ সালে বসন্ত বাবু এবং প্রাচীন লিপি বিশারদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মিলিত ভাবে সাহিত্য - পরিষৎ পত্রিকায় এই কাব্য সম্পর্কে একটি লেখা প্রকাশ করেন। এই লেখায় প্রাপ্ত পুঁথির লিপি বিচার করে এই রচনাকে অতিশয় প্রাচীন বলে বর্ণনা করা হয়।শুধু তাই নয় এই লেখায় প্রাপ্ত কাব্যের রচয়িতা বড়ু চণ্ডিদাস কে আদিতম চণ্ডিদাস বলে ঘোষণা করেন। এই লেখা পাঠক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন তোলে । এর কয়েক মাস পরে ১৩২৩ সালে (ইং ১৯১৬) বসন্ত রঞ্জনের সুযোগ্য সম্পাদনায় এই কাব্য বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয় আর প্রকাশ মাত্রেই চণ্ডীদাস বিতর্ক প্রবল আকার ধারন করে।


চণ্ডীদাস বাঙালি মনের অত্যন্ত কাছের একজন কবি। চণ্ডীদাস পদাবলীর সুমুধুর স্নিগ্ধ ধারায় বাঙালি সাহিত্য পিপাসা মিটে আসছে সুদীর্ঘ সময় ধরে। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে কেন্দ্র করে চণ্ডীদাস বিতর্ক এমন প্রবল আকার ধারন করে যার এক মাত্রিক সমাধান এখনো সম্ভব হয়নি । বলা বাহুল্য যে বাংলা সাহিত্যের আর কোন কবি ও কাব্যকে এত সওয়াল - জবাব, এত যুক্তি - প্রতি যুক্তির সম্মুখীন হতে হয়নি। এই বিতর্কের মূলে আছে চণ্ডীদাসের পদাবলীর সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাব ও প্রকাশ রীতির পার্থক্য । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে শৃঙ্গার ও আদি রসের আধিক্য আর পদাবলীতে 'যূথিকা-শুভ্র' নির্মল ও পবিত্র প্রেমের জোয়ার । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত শব্দ ও বানান রীতি ও যথেষ্ট প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে । প্রথমে পদাবলী ও শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের রচয়িতা হিসেবে এক জন চণ্ডীদাসের কথাই ভাবা হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধে স্বয়ং রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ও এই এক চণ্ডীদাস তত্ত্ব সমর্থন করেন । খেদের সাথে ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন ও বলেন - " অপরিনত বয়সের চাপল্যে চণ্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো একখানি অতি অশ্লীল কাব্য রচনা করেছিলেন । পরে শিল্পী স্বভাবের ক্রম বিবর্তনের ফলে সেই একই কবি অপূর্ব প্রেম-ভাব- সমৃদ্ধ পদ সাহিত্য রচনা করেন । " কিন্তু এই তত্ত্ব প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ল । মধুস্যন্দী পদাবলী রচয়িতার এমন স্থূল, অশালীন রচনার সম্ভাবনাকে বাঙালি মন মেনে নিতে পারল না। অনেকেই প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন । ভনিতা, শব্দ চয়ন, কাব্যের প্রাচীনতা ইত্যাদি বিচার করে দুজন চণ্ডীদাসের অস্তিত্বের কথা স্বীকৃত হয় - একজন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস এবং অন্যজন পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাস । যাইহোক চণ্ডীদাস সমস্যা ও সেই সংক্রান্ত আলোচনা ও বিতর্ক বিশাল এবং কোন রোমাঞ্চ উপন্যাসের থেকে কম উপভোগ্য নয় । পরবর্তীতে তৃতীয় একজন চণ্ডীদাসের অস্ত্বিত্ব এই বিতর্ককে আরও আকর্ষণীয় করে। তবে আজ পর্যন্ত চণ্ডীদাস - সমস্যা বিষয়ে শেষ কথা বলা সম্ভব হয়নি ।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনী 'খণ্ড' ভাগে বর্ণিত । পুঁথিটির কিছু অংশ মিসিং হলেও ঘটনার ধারা অনুসরন করতে অসুবিধে হয়না । মূলত তের খণ্ডে বিভক্ত এই কাব্য - জন্ম খণ্ড, তাম্বূল খণ্ড, দান খণ্ড, নৌকা খণ্ড, ভার খণ্ড, ছত্র খণ্ড, বৃন্দাবন খণ্ড, কালীয় দমন খণ্ড, যমুনা খণ্ড, হার খণ্ড, বাণ খণ্ড, বংশী খণ্ড ও রাধা বিরহ । জন্ম খণ্ডে দেবগনের প্রার্থনায় ভূভার হরনের জন্য ভগবান বিষ্ণু ও লক্ষ্মী দেবীর কৃষ্ণ ও রাধা রূপে জন্ম গ্রহন। তাম্বূল খণ্ডে রাধার অসামান্য রূপ লাবন্যের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বড়াই মারফত মিলন-আমন্ত্রন সূচক তাম্বূলাদি রাধাকে উপহার প্রেরণ, রাধা কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান ও বড়াইকে অপমান। দান খণ্ডে কৃষ্ণ ও বড়াইয়ের রাধা লাভে ষড়যন্ত্র এবং দানী সেজে বিভিন্ন ঘটনা ক্রমের পরে কৃষ্ণের বল পূর্বক রাধাকে সম্ভোগ । নৌকা খণ্ডে মাঝি বেশে কৃষ্ণ গোপীদের যমুনা পার করায় ও মাঝনদীতে ইচ্ছাকৃত নৌকাডুবি ঘটিয়ে রাধার সাথে জলবিহার করে। ভার খণ্ড ও ছত্র খণ্ডে শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক রাধার দধি-দুগ্ধের পসরা বহন ও ছত্র ধারনের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। বৃন্দাবন খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের মিলন ও যমুনা খণ্ডে কালীয় দমন, কৃষ্ণ দ্বারা গোপীদের বস্ত্র হরণ ইত্যাদি বিবৃত আছে। হার খণ্ডে রাধার হার অপহৃত হয়, অভিযোগের তীর কৃষ্ণের দিকে, যশোদার কাছে রাধার নালিশ। বাণ খণ্ডে ক্ষুব্ধ কৃষ্ণের প্রতিশোধ গ্রহনের জন্য রাধার প্রতি মদন বাণ নিক্ষেপ, রাধার মূর্ছা, কৃষ্ণের অনুতাপ, ক্রুদ্ধ বড়াই কর্তৃক কৃষ্ণকে বন্ধন, কৃষ্ণের সকাতর অনুনয়, বন্ধন মোচন - পরে রাধার মূর্ছা ভঙ্গ ও রাধা কৃষ্ণের মিলন। রাধা বিরহ খণ্ডে রাধার বিরহ, পরে রাধাঁ - কৃষ্ণ মিলন এবং পরিশেষে রাধার নিদ্রাবস্থার অবকাশে কৃষ্ণের মথুরা যাত্রা।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রধানত আখ্যান কাব্য। এতে নাট্য রসের প্রচুর উপাদান আছে । কাহিনীতে কবি কোথাও নিজে উপস্থিত থেকেছেন সূত্রধর হিসেবে কোথাও সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে সংলাপের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করেছেন । চরিত্র চিত্রায়নেও কবি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন । কাব্যের রচনা নীতি ও কাব্য কলা বিশেষ প্রশংসার দাবী রাখে - বিশেষত বর্ণনা কৌশল, অলঙ্কার সন্নিবেশ ও শব্দযোজনা অনুমান করা যায় ভাষা ও অলঙ্কার শাস্ত্রে কবি ছিলেন কৃতবিদ্য। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের ছন্দ বৈচিত্র্য ও অপূর্ব । এতে মোট সাত প্রকারের পয়ার বর্ণিত হয়েছে। মাত্রাগত কিছু ত্রুটি থাকলেও পয়ার ত্রিপদীর কাঠামো বজায় আছে। কাব্যটির কোথাও কোথাও কিছু শিথিল, নিয়মহীন, চঞ্চল ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্যবহার ইচ্ছাকৃত ও হতে পারে; তৎকালীন লোকসঙ্গীত বিশেষত ঝুমুরের প্রভাবে ও এমন নৃত্য চপল ছন্দ পরিকল্পিত হয়ে থাকতে পারে। তবে কোথাও দ্বিমাত্রিক পয়ারের ধ্বনি বৈশিষ্ট্য ক্লান্তিকর। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ব্যঙ্গ পরিহাসের বিশেষ প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় না । শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে রাধা ও কৃষ্ণের বাক্য বিনিময়ের মধ্যে কখনো তীব্র ব্যঙ্গ বিদ্রূপের তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে যা মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে সহজ লভ্য নয়। উল্লেখ্য যে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের কাব্যরস সংক্রান্ত আলোচনা বাংলা সাহিত্যে বেশ সীমিত।


চণ্ডীদাসের পদাবলী বাংলা সাহিত্যের অর্জুন হলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নিঃসন্দেহে কর্ণ ! সাহিত্য মূল্য তথা কাব্যগুণ ঢাকা পড়ে গেছে চণ্ডীদাস বিতর্ক ও অশ্লীলতার অভিযোগের আড়ালে। গ্রাম্য স্থূলতার অভিযোগের আড়ালে হারিয়ে গেছে দেবতার মানবীকরনের সাহস, ঐশী প্রেম সাধনার সুরকে এক বিশেষ দেশ-কালের সাধারন দুই মানব মানবীর প্রেমাচরণের বাস্তবের ধূলা - মাটি মাখা আখ্যানে রূপান্তরের স্পর্ধা ! উনবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্য প্রতিনিধিরা মুখ ফিরিয়ে থেকেছেন। অথচ শৃঙ্গার রসকে সমাদরে গ্রহন করেছে সংস্কৃত সাহিত্য এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার মধ্য যুগীয় সাহিত্য। এই ভাবনাকে শ্রী শিশির কুমার দাশ তার "The history of Indian literature" গ্রন্থে সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেছেন - " The representation of sex in Indian literature was not a new phenomenon. The classical as well as precolonial literature in various Indian languages had a strong erotic component, at times bordering the pornography. And yet from nineteenth century on wards sex became a taboo in Indian literature and representation of sex in literature was considered to be insidious effect of western literature. " যাইহোক, আদি রসের প্রাধান্য ছাপিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের আধুনিকমনস্ক সৃজন বাংলা সাহিত্যকে উজ্জ্বল করে। তাই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন আজও প্রাসঙ্গিকতার দাবী রাখে।