লজ্জা
মূল অসমীয়া গল্প - সঞ্জীব পল ডেকা
বাংলা রূপান্তর - নন্দিতা ভট্টাচার্য
( সঞ্জীব পল ডেকার জন্ম ১৯৮৬ সালে দরং জেলার দীঘিরপারে । কটন কলেজ থেকে স্নাতক । বর্তমানে আসামের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘সাতসরী ‘র উপ-সম্পাদক । ২০০৫ এ ‘প্রান্তিক’ এ প্রকাশিত ‘সময় ‘ গল্পে আত্মপ্রকাশ । অগ্রণী প্রকাশন প্রতিষ্ঠান ‘পেঙ্গুইন‘ দ্বারা সঙ্কলিত ও প্রকাশিত ভারতের নতুন প্রজন্মের লেখক সঙ্কলন ‘ First Proof ‘ (2008) এ সঞ্জীবের গল্প স্থান পেয়েছে । ইংরেজি ছাড়াও মারাঠি , কন্নড় ও বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়েছে । )
নারায়ণ কাকতির গলা –তালু সব শুকিয়ে আসছিল । তার পুলিসী মেজাজটা বার বার বেরিয়ে পড়তে চাইছে । তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলেন । রাগ ই বা কার ওপরে দেখাবেন । এত ছোট জায়গাতেও যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা কে জানত । গ্রামের বেশীরভাগ মানুষই তো লেখা পড়া জানে না । একজন কেরানী ও একজন স্কুলমাস্টার ছাড়া সবার ই জীবিকা দিন-হাজিরা । অবশ্য তিনজন কাঠ মিস্ত্রী , দুজন রিক্সা চালক , ঠেলাওয়ালা তো রয়েছে ই । মানে এই ছোট্ট জায়গাটার প্রায় সকলেই সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ে । সন্ধ্যে বেলা আবার যার যার বাড়ীতে ফিরেও আসে ।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় কাকতির এবারের অভিজ্ঞতা অভিনব । সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়া এরকম একটি গ্রাম যে এদেশে থাকতে পারে সেটা কাকতির কল্পনাতেও ছিল না । তার ওপর ঘটনাটি যথেষ্ট উত্তেজনাপুর্ন ।
দোষী ধরা পড়ুক না পড়ুক , এ থেকে যে কিছু লাভ হবে না এ কথাই তিনি ইতিমধ্যে অনুমান করতে পেরেছেন । সে জন্যে ঘটনাটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন । কিন্তু পরশু এস পি সাহেবের কাছ থেকে আদেশ পেয়ে আবার এই গাঁয়ে তাকে উপস্থিত হতে হয়েছে ।
মাঠের একধারে থাকা মহিরামের বাড়ি থেকে ফিরে কাকতির দলটি প্রকাণ্ড আমগাছটার তলায় এসে জড় হল । প্রত্যেকেই মুছে নিল কপালে ও নাকে জমে ওঠা ঘাম । তারপর সেপাই বিমল কাকতিকে উদ্দেশ্য করে আমগাছের ঝুলে থাকা ডালটাকে দেখে মন্তব্য করল –এই গাছটাই যত নষ্টের গোঁড়া । এই গাছটা না থাকলে ঘটনাটাই ঘটত না , স্যার । কি বলেন স্যার ?
কথাটা বিমল ঠিকই বলেছে । পঞ্চায়েত কর্মীরা তাহলে কি আর ব্যানারটা মারতে পারত ? যে মানুষগুলোর ক খ জ্ঞান নেই , ওরা ব্যানারের ভাষা কি বুঝবে ? সরকারের সাফল্য , বছর পূর্ণ হওয়া ---এ গুলোর সঙ্গে ওদের সম্পর্কই বা কি ? ব্যানারের অর্থ বুঝতে না পারলে , কেউ কি ভাবতে পারবে এর থেকে কি উপকার হবে । এটা কি এত বড় কোন অপরাধ যে পুলিসকে অনুসন্ধান চালাতে হবে ? কাকতির এস পির এই আদিখ্যেতায় মাথা গরম হয়ে উঠল । এই নিচুতলার মানুষগুলো কোন অপরাধ করলেই ‘ প্রসাশন যন্ত্র ‘ যে শক্তিশালী সেটা দেখাতে চায় , এদিকে সারাদেশে রোজ কত কি ঘটে যাচ্ছে তার কোন মা বাপ নেই । মুল্যবান সম্পত্তি উধাও হচ্ছে । কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারী ধরা পড়ছে । যোগ্য শিক্ষকদের বঞ্চিত করে অযোগ্য লোকদের পয়সার বিনিময়ে শিক্ষক পদ দেয়া হচ্ছে । কিন্তু অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে কোথায়? তখন প্রসাশন যন্ত্র নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয় ?
অবশ্য কাকতির অপরাধীকে খুঁজে বের করতে কোন আপত্তি নেই । কিন্তু আজ এস পি সাহেবের জোর তলব পেয়ে মনে কতগুলো প্রশ্নের উদয় হয়েছে । এস পি তাকে বলেছিল-- আপনি ঘটনাটাকে হাল্কা ভাবে নিয়েছেন মনে হয় । এই দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষগুলোকে দেখে আপনার সহানুভূতি জাগা স্বাভাবিক । কিন্তু অপরাধী ওদের মধ্যে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দুই – তিন দিনের মধ্যে অপরাধী ধরতে না পারলে আমারও লজ্জা , আপনার ও লজ্জা । ওপর থেকেও বার বার ফোন আসছে ।
ঃ স্যার , কি ভাবছেন ? --- বিমলের ডাকে কাকতির সম্বিত ফিরে এল ।
ঃ দোষীকে আমাদের দু একদিনের মধ্যেই ধরতে হবে । আর এমন চুপ করে থাকতে পারব না বুঝেছ ।
কথাটা বলে কাকতি আমগাছের গুঁড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল । ওখানে বিশ –পঁচিশ দিন আগে সরকার একটি ব্যানার মেরেছিল , ওদের সরকারে আসার চতুর্থ বছর পুর্তি উপলক্ষ্যে । তাতে ছিল বিগত চার বছরের সকারের সাফল্যের খতিয়ান । কিন্তু আশ্চর্য , দুদিন পর ওটাকে আর সেখানে দেখা গেল না , অন্তর্হিত হয়েছে হঠাৎ করেই । কেই বা প্রথমে কথাটা জানতে পারল ! যেই হোক আস্তে আস্তে কথাটা মুখ্যমন্ত্রীর কানে গিয়ে পৌঁছল । চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল । এই এলাকার বিধায়ককে চেপে ধরলেন মুখ্যমন্ত্রী--- তোমার এলাকায় আমাকে এভাবে অপমান করার সাহস লোকে পায় কি করে? তারপর তিনি তড়িঘড়ি দোষীকে ধরার জন্যে এক নির্দেশ দিয়েছেন । ঘটনাটা ইতিমধ্যে খবরেরে কাগজে প্রকাশিত হয়েছে । প্রথম পৃষ্ঠাতে ছাপা হয়েছে ঃ সরকারী ব্যানার অন্তর্ধান । গ্রামের নিরক্ষর এলাকায় রাজনীতির খেলা । আসলে ঘটনাটা এতদূর পর্যন্ত গড়াত না । গায়ে গঞ্জের ছোটখাট ‘নেতা’দের জন্যেই এটা ঘটল । ওরা তো হুলুস্থুল লাগিয়ে দিয়েছে এই ঘটনায় বিরোধীদের হাত আছে বলে । ওপরমহলও তাই সন্দেহ করছে । এদিকে সামনে ইলেকশন ।
ঃ আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই । বাকি ঘরগুলো দেখে আসি চল । --কাকতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেপাইদের দিকে তাকিয়ে বলল ।
কাকতির দলটি লক্ষ্মী মাস্টারের ঘরের দরজায় এসে উপস্থিত হল । মাস্টারের সঙ্গে কাকতির এতিমধ্যে পরিচয় ঘটেছে । মাস্টার তাকে জলচৌকি টা এগিয়ে দিলেন ।
ঃ তাহলে নিয়ম মাফিক কথাবার্তা গুলো শুরু করি আর কি । আমার কাজই এরকম , বুঝলেন । কোন চার্ম নেই --- নারায়ন কাকতি লক্ষ্মী মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললেন ।
বিমলরা বাড়ীর ভেতরে ঢুকে গেলেন । কাকতি বাইরে রইলেন । এই চাতালেই পরশু মিটিং করে মানুষকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। লক্ষ্মী মাস্টার এই ব্যাপারে অনেক সহায়তা করেছিলেন । পুলিশ সভা করে কথাও দোষী ধরেছে বলে শোনা যায়নি । তবুও তিনি মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন ।
লক্ষ্মী মাস্টার মানুষজন ডেকে জড় করেছিলেন । গামছা পরে খালি গায়ে কিছু লোক এসেছিল , বুকে মেঠোনি ( মেখলা টা বুকে বাঁধা ) বেঁধে কিছু স্ত্রী লোক এসেছিল । এমনকি ধুলোমাখা আদুড় গায়ে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে- মেয়েরা ভিড় করেছিল লক্ষ্মী মাষ্টারের বারান্দায় । সবার চোখে কাকতি দেখেছিল এক ভয়ার্ত দৃষ্টি ।
কাকতি বলেছিল – আপনাদের এখানে কেন ডেকে আনা হয়েছে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন । আজ এক সপ্তাহ ধরে আপনাদের এখানে আসছি দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই । ঘরে ঘরে অনুসন্ধান করছি দেখতে পাচ্ছেন । এর কারণ হচ্ছে ওই ব্যানার । ব্যানারে সকারের সাফল্যের কথা উল্লেখ করা ছিল । সেখানে আপনাদের মত গরিব গুর্বোদের সাহায্যের কথা লেখা ছিল । কিন্তু আশ্চর্য কথা আপনারা সেটা গাছ থেকে উধাও করে দিলেন । দেখুন আপনারা , ছোট আছেন ছোট হয়েই থাকুন । কারোর চক্রান্তের বলি হলে আপনাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে । এখন সময় আছে বলুন কে এই কাজ করেছেন ।
কেউ কোন কথা বলছিল না । পুলিসের সামনে কেউ মুখ খুলতে সাহস করছিল না ।
নারায়ণ কাকতির অনুরোধে লক্ষী মাসটারও বলছিলেন ---আপনাদের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক । এই পুলিস সাহেব কি বলছেন বুঝতে পারছেন তো ? আমরা হাজিরা খেটে খাওয়া মানুষ , সারা জীবন হাজিরা খেটেই খেতে হবে । যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন , যে দলেরই পতন ঘটুক , আমাদের দুঃখ মোচন কেউ করতে পারবে না । কি লজ্জার কথা , আমাদের গাঁয়ের নাম পেপারে উঠেছে , সারা দেশের মানুষ চোরের গ্রাম বলে জেনেছে । গতিকে স্বীকার করুন ।
না , সভাতেও কাজ হল না । কাকতি ভেবেছিল এই সরল মানুষগুলো স্বীকার করবেই । সেদিন ভেবেছিলেন দেখতে সরল সোজা মানুষগুলোর মধ্যে কি কমপ্লেক্স রয়েছে ?
বিমলরা বেরিয়ে এল । নারায়ণ কাকতি উঠে বলল – আসছি , মিছিমিছি কষ্ট দিলাম আপনাকে ।
ঃ না না আপনারা কর্তব্য করেছেন মাত্র ।
কাকতিদের সাথে সাথে লক্ষ্মীমাস্টারও এল ।
এখানে একসঙ্গে তিন ঘর মানুষ আছেন । বিমলরা প্রথমে শেষের ঘরটায় গেল ।
ঘর দুটো । ছোট ছোট । নিচু নিচু । এই ঘর খড় দিয়ে ছাওয়া । দুটো ঘর খাগড়ার বেড়া । বৃষ্টিতে যে দুটো ঘরেই ভেসে যাবে সেটা সহজে অনুমেয় ।
নারায়ন কাকতি আগে কখনও এই বাড়ীটায় আসেননি , বিমলরা এসে ঘুরে গিয়েছিল । কাকতি লক্ষ্য করেছিল প্রথম তল্লাসিতে প্রত্যেকেই যেন ভয় ও লজ্জা পাচ্ছিল । কয়েকজন হেসে হেসে বলল , স্যার আমাদের কাপড় চোপড় এই যা পরনে দেখছেন সেটুকুই এর ওপরেই বাচ্চারা হাগা--মোতা করে । আপনাদের সরকারী লোকজন হয়ত এমন কাপড় চোপড় দেখেনি ।
কাকতি নিরাশ হয়েছিলেন । স্বামী – স্ত্রী – ছেলে – মেয়ে পাঁচটা মানুষ একই বিছানাতে শোয় । পরার কাপড়টুকু ছাড়া কেঁথা রয়েছে মাত্র ।
নারায়ণ কাকতি চাতালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ একজন স্ত্রীলোক তার পায়ে এসে পড়ল । কাঁদতে লাগল স্ত্রীলোকটি ।
ঃ দেখি, দেখি কি হয়েছে , কাঁদছেন কেন ?
স্ত্রীলোকটি উঠে দাঁড়াল ।
তারপর বলতে লাগল , --- স্যার আমাকে শাস্তি দেবেন না স্যার । এই ছোট ছেলেটার কথা ভাবুন স্যার । ওকে কে পালবে বলুন ? অন্তত যদি কোন কাজকর্ম করতে পারত তাও একটা কথা ছিল ।
ঃ কি হয়েছে বলছেন না কেন ? --- কাকতি ওর মখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ।
ঃ স্যার আমিই এনেছিলাম ঐ কাপড়টা । কিন্তু এত যে হৈচৈ হবে আমি ভাবতে পারিনি --- ভয়ার্ত গলায় কাঁদতে লাগল আবার ।
ঃ এত দিন কেন চুপ করেছিলে ?—কাকতি প্রশ্ন করল ।
ঃ স্যার পরশু দিন আমি বাড়ি ছিলাম না । তার আগেও আপনাদের লোকজন এসেছিল । কিন্তু......
ঃ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি এতদিন ? কেন চুরি করেছিলে ?
ঃ স্যার , এর বাবা গাছ কাটত কিন্তু গত কার্তিক মাসে গাছ থেকে পড়ে মারা গেল সে । তারপর আমিই হাজিরা কাজ করি , --- ধান ঝাড়ি , মাঠে কাজ করি , ...... বিধবা পেনশনের জন্যে কতদিন গেলাম । কিচ্ছু পাইনি । স্যার ।
ঃ বল কেন চুরি করেছ ?
ঃ স্যার , আমার পেটিকোটটা ছিঁড়ে গেছে । সেই বিয়েতে পাওয়া , আর কতদিন পরা যায় বলুন । স্যার আমি সেই কাপড়টা দিয়ে পেটিকোট বানিয়েছি । ঐ যে স্যার মেলা রয়েছে তারে । ...... আমাকে শাস্তি দেবেন না । ...... পরেছিলাম বলে আপনারা খুঁজে পান নি ।
কাকতি কি করবে , কি বলবে বুঝতে পারছিল না । বুকের কোন টা হুম হুম করে উঠল । যাইহোক না কেন ব্যানারটা এস পির অফিসে জমা দিতে হবে । কাকতির নির্দেশে বিমলরা পেটিকোটের সেলাই খুলে ফেলল । জলে ধোয়া কাচা হওয়া মার্কিন কাপড়ে অস্পষ্ট ভাবে সাম্যবাদী সরকারের বৃহৎ সাফল্য । দেশে দরিদ্র দূরীকরণ , নিরক্ষরতা , দূরীকরণ সবকিছুতেই অভূতপূর্ব সাফল্য । তার ওপর বিধবা পেনশন ,বার্দ্ধক্য ভাতা .........। তারপর তার আর কথা বলতে ইচ্ছা করল না ।
অসহায়ভাবে কাঁদতে থাকা মহিলার কাছে গিয়ে তিনি বললেন , শুনছেন আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নেই । আমরা আপনাকে এ্যারেস্ট করব না । শুনুন , এই নিন পাঁচশ টাকা । পেটিকোট কিনে নিন । নোটে থাকা মহাত্মা গান্ধীর ছবি ও স্বাধীনতা বিপ্লবের ছবিটির দিকে তাকাতে কাকতির ইচ্ছে হল না । খণ্ডিত ব্যানারটি নিয়ে ওরা জীপে বসল ।