সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

সম্পাদকীয় - ৭ম সংখ্যা, ১ম বর্ষ


ছদ্মসাহিত্যিক

নিজের জন্মনাম পাল্টে গ্রীক Pseudonym বা বাংলায় ছদ্মনামের রীতি আজকের নয়, ষোড়শ শতক থেকেই ছদ্মনামের বাড়বাড়ন্ত পাশ্চাত্যে প্রকট হয় । বাংলায় এই রীতি উনিশ-শতকীয় বলা যায় – হুতোম (কালীপ্রসন্ন সিংহ), টেঁকচাদ ঠাকুর (প্যারীচাঁদ মিত্র), রবীন্দ্রনাথের নয় নয় করে ৫টি ছদ্মনাম- ভানুসিংহ , আন্নাকালী পাকড়াশি, বাণীবিনোদ বন্দ্যোপাধ্যায়, অকপট চন্দ্র লস্কর, শ্রীদিকশূন্য ভট্টাচার্য । এছাড়াও আমরা বহু বিখ্যাত লেখক-কবিদের পাই কখনো দাদাঠাকুর / অনিলা দেবী (শরৎচন্দ্র), ভীষ্মদেব খোসনবীশ (বঙ্কিমচন্দ্র), টিমোথি পেন পোয়েম (মাইকেল মধুসূদন দত্ত), শঙ্খ ঘোষ (চিত্তপ্রিয় ঘোষ), অপরাজিতা দেবী (রাধারাণী দেবী), শ্রীজাত থেকে আজকের মহালয়া বললেই যাঁর নাম ওতপ্রোত নিশ্বাসের মতো স্পন্দিত হয়, সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পর্যন্ত বিরূপাক্ষ নামে দীর্ঘদিন লেখালিখি করেছেন । ছদ্মনাম শুধু নিজেকে আত্মগোপন অথবা আত্মপ্রচারের উপায় না , কখনও এও এক আড়াল মাধুরী, নিজেকে বদলে ফেলা নিজের সঙ্গে । এই আড়াল রচনার মধ্যেও অদ্ভুত আনন্দ থাকে, চিনিয়াও চিনিতে না পারার । বাংলা সম্প্রতি অন্তর্জালের দৌলতে ছদ্মনামের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো । কেউ কালো বেড়াল তো কেউ হোয়াইট র‍্যাস । সোশ্যাল সাইটে লেখালিখির যে নতুন ট্রেন্ডটি আজ ফেসবুক বা অরকুটে দেখা যাচ্ছে সেখানে নিজেকে আড়াল রাখতে অবসম্ভাবী বাড়ছে ছদ্মনামের ভিড়। কিন্তু এর আড়ালে যে আর একটি ডেস্ট্রাক্টিভ ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে সেটাই ভয়ঙ্কর । আগে ছদ্মনামের আড়ালে ছিল কোনো গঠনমূলক প্রয়াস, ইদানীং সেই ছদ্মনামের আড়ালে জন্ম নিচ্ছে বেশ কিছু ছদ্মসাহিত্যিক ও কবি , যারা ছদ্মনামের আড়ালে বিভিন্ন লেখালিখির কমিউনিটিতে প্রবেশ করে সেখাঙ্কার সাহিত্যের পরিবেশ ধ্বংস করতে চাইছে এবং করছেও । এর আগে এই ভাবেই বেশ কিছু গ্রুপে এই ধরণের অন্তর্ঘাতের সাক্ষী বোধহয় অনেকেই হয়েছেন । তার তালিকায় সর্বাগ্রে আসবে ফেসবুকের শুকতারা গ্রুপ । তেমনি আমাদের ক্ষেপচুরিয়াস গ্রুপের সাহিত্যের সুপরিবেশ বজায় রাখতে কিছুদিন আগে সেই সব ছদ্মসাহিত্যিকদের আগাম চিহ্নিত করতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল , যাঁদের নামের আসল পরিচয় আমরা জানতাম না তাদেরকে গোপনে সম্পাদকমণ্ডলীর যে কোনো সদস্যকে তাঁর ন্যূন্যতম পরিচয়টি জানাতে অনুরোধ করা হয়েছিল, যার মূল উদ্দেশ্য গ্রুপের মধ্যে অন্তর্ঘাতের সম্ভবনাকে যতটা সম্ভব কমানো যায় ও গ্রুপের বাকি সদস্যদের কাছে একটা সুষ্ঠ পরিবেশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া । এর মধ্যেই কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখিন হয়ে বুঝলাম ক্ষেপচুরিয়াস এখন অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । অবশ্য ক্ষেপচুরিয়াস ঈর্ষা নয়, ভালোবাসাতে বিশ্বাসী, দুই বাংলার সাহিত্যিকদের একসঙ্গে করে অন্তর্জালে যে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করার প্রচেষ্টা আমরা করছি তাঁকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিতে শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে কিছু টিকিধারী ছদ্মকবি । এই ঈর্ষা যে তাঁদের বাকি পঞ্চরিপুকেও অধিকান্তর ত্বরান্বিত করছে তাঁর প্রমাণ http://words.bd24live.com/ নামে একটি ওয়েব সংবাদমাধ্যমের সাহিত্যপাতার একটি প্রতিবেদনে ক্ষেপচুরিয়াস সম্পর্কে প্রকাশ করা হলো সম্পূর্ণ প্ররোচিত ও মিথ্যা অপপ্রচার । এমন কী এই সম্পর্কীত প্রতিবেদনে বলা হলো আরও কিছু ভ্রান্ত তথ্য । ক্ষেপচুরিয়াসের মূল লক্ষ্যটিকে সামনে না রেখে সেখানে অপপ্রচার করা হলো ক্ষেপচুরিয়াসে নাকি “পিতৃদত্ত নাম ছাড়া লেখা প্রকাশ হয় না ” । এর পরিপ্রেক্ষিতে যে সকল কবি ক্ষেপচুরিয়াসে ছদ্মনামে লেখেন তাঁদের সমস্ত প্রতিবাদ লিপি নিঃশব্দে মুছে দেওয়া হতে লাগল । প্রসঙ্গত সেই সাহিত্যপাতার বিভাগীয় সম্পাদক কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ছদ্মনামেই ক্ষেপচুরিয়াসে লেখালিখি করেছেন । তবে এই অপপ্রচারের উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না । যাইহোক যে কথা বলছিলাম - কোনো টিকি সর্বস্ব ছদ্মসাহিত্যিকরা যতই প্রচেষ্টা চালিয়ে যান ক্ষেপচুরিয়াস তাঁর কাজ করে যাবে গোষ্ঠীতত্ত্বে বিশ্বাস না করেই । কে জানে এই তথাকথিত ভদ্রমহোদয়গণ কবে বুঝিবেন টিকির মাহাত্ম নামে নয় কর্মে ও নিষ্ঠায় থাকে । যতই সুকৌশলে ক্ষেপচুরিয়াসকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেবার চেষ্টা করা হোক, ক্ষেপচুরিয়াসে কোনোদিন কাঁটাতারের বেড়া ছিল না থাকবেও না । হাটের মাঝে বিষ্টা পাড়লেও কিছু বায়স গোত্রীয় প্রাণী ঠিক জুটে যায় । ছদ্মসাহত্যিকরা সেই রকমই । একা নামে রক্ষে নেই টিকি দোসর !



এবারের শারদীয় সংখ্যা এসে গেল হই হই করতে করতে, ঢাকের সাজের মতোই নতুন স্টাইলে । আশা করি আনাদের ভালো লাগবে । যে কথাগুলো না বললেই নয় তা হলো এই ওয়েব ম্যাগাজিনটা করতে সুমিত রঞ্জন দাস মহাশয়ের অক্লান্ত পরিশ্রম । তাঁর ঋণ আমরা কোনোদিন পূরণ করতে পারবো না । এই সংখ্যাতেও অলংকরণ করে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন কবি মেঘ অদিতি, কবি কৌশিক বিশ্বাস, কবি প্রদ্যুৎপ্রকাশ রায় ও চন্দ্রশেখর মিত্র । আমরা গৌরাবাণ্বিত এই সংখ্যা থেকে আমাদের অনুবাদ বিভাগের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন প্রখ্যাত কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও কবি জুয়েল মাজহার । সম্পাদনায় এসেছেন কবি জুঁই সরকার । এই প্রসঙ্গে আগামী সংখ্যাগুলোর সম্পর্কেও বলে রাখি – আগামী ১লা নভেম্বর সংখ্যা নারী সংখ্যা হতে চলেছে , এই সংখ্যার জন্য আমরা সমস্ত মহিলা কবিদের লেখা আহ্বান করছি ।

ওহো এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল । পুজো সংখ্যার জন্য আমরা ভারতের ভিন্ন রাজ্যবাসীর ৭০ দশকের এক বিখ্যাত কবির লেখা চাইতে গেলে তিনি বললেন “তোমরা বরং বাচ্চাদের পত্রিকা করো, আমি লিখবো না ” । ভাবছি , তাঁর কথার সম্মান রক্ষার্থে আগামী ১৫ই নভেম্বর তারিখে আমরা সুকুমার রায়ের স্মরণে একটি শিশুসাহিত্য সংখ্যা করবো । সকলের প্রতি রইল প্রাক-শারদীয় প্রীতি ও ভালোবাসা । সঙ্গে থাকুন । আপনাদের ভালোবাসাই আমাদের পথ চলার পাথেয় । এখানে কোনো গোষ্ঠী নেই ।


সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষ থেকে - জুবিন ঘোষ

মলয় রায়চৌধুরী


খামচানো কালপৃষ্ঠা
মাটিতে শাল বা শিশুকাঠের গুঁড়ি পুঁতে তাকে পাকিয়ে-পাকিয়ে চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে বাঁশের রেলিঙ আর কঞ্চির ধাপ দেয়া কাঠের সরু সিঁড়ি , এতই সরু যে একজন যদি নামতে থাকে তাহলে তাকে জায়গা দেবার জন্য রেলিঙে হেলে দাঁড়াতে হবে । তা সত্ত্বেও স্পর্শ বাঁচানো কঠিন । স্হান সংকুলানের জন্য দুই পাক ওঠার পর একতলা, তার পর দুই পাক উঠে দু'তলা, এইভাবে পাক খেয়ে চারতলা পর্যন্ত টালির চালে তৈরি কাঠের বাড়ি । অর্থাৎ সিঁড়িটা কেবল সরু নয়, তা বেশ প্যাঁচালো । প্রতিটি তলায় সিঁড়ির মুখে বাঁ'দিকে একটা ঘর আর ডান দিকে খোলা , কাঠের সরু করিডরে যাবার জন্য ; করিডরের একদিকে কাঠের ঘরের সারি , আরেক দিকে খোলাবারান্দা । বারান্দা থেকে ভেতরের উঠোন দেখতে পাওয়া যায় । ঘরের মেঝেও কাঠের, দুটি জানালার শিকগুলোও কাঠের । জানালাগুলো বিশাল, দরজার মাপেই । ঘরগুলো বারো বাই আট হবে । গ্রাউন্ড ফ্লোর বা একতলা ছাড়া ওপরের তলাগুলোয় আসবাব কম ; প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে আসবাব ওপরে ওঠানো কঠিন । বিছানা বলতে মাটিতে খড়ের আঁটি বিছিয়ে তার ওপর চাদর পাতা । ঘরভাড়া মাথা-প্রতি মাসে একটাকা ,যা সংগ্রহ করতে সামন্তের পেয়াদা আসে মাসের এক তারিখে । পাড়াটার নাম ঠমেল---তার রূপ সম্পূর্ণ বদলে গেছে গত কয়েক দশকে ।

অমন গুঁড়ি পুঁতে-পুঁতে , পঞ্চাশ মিটার বাই একশো মিটার জুড়ে একটা আয়তাকার উঠোন ঘিরে জনপ্রাসাদ । এই প্রাসাদের মূল দরজা একটিই এবং সেটি সদাসর্বদা খোলা ; দশ ফিট উঁচু চার ফিট চওড়া কাঠের ফ্রেমে কাঠের ক্ষয়াটে জনপ্রাসাদের সংদরজা । কতজন থাকতেন এই বাড়িটিতে অনুমান করা যেত সকালবেলায়, যখন উঠোনে জড়ো হতেন অনেকে প্রাতঃকৃত্য সারার জন্য, স্নানের জন্য । এই জনপ্রাসাদের সবাই প্রত্যেকদিন স্নান করতেন না বলে সুবিধা , প্রাতঃকৃত্য বলা হলেও সবাই সকালেই যেতেন না , অ্ভ্যাসমতো যেতেন । প্রতিদিন স্নান করার ব্যাপারটা আমিও বাদ দিয়েছিলুম । এই কুটিরপ্রাসাদে গরিব নেপালি ও নেওয়ারি পরিবার যেমন থাকতেন তেমনই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন হিপির দল, নেপালি কবি-লেখক-শিল্পী, আর ভারত থেকে আসা আমাদের মতোন উচ্ছন্নাকাঙ্খীরা । গ্রাউন্ডফ্লোরে, দু-তিন ঘরের ফ্ল্যাটে থাকতেন মধ্যবিত্তরা । একজন নেপালি অভিনেত্রীও থাকতেন ।


আমি ষাটের দশকের কথা বলছি , যে সময়ে ফান, ফুড, ফ্রিডাম, ফ্রিকাউট এবং ফাকিঙের উদ্দেশ্যে দলে-দলে তরুণ-তরুণী আমেরিকা-ইউরোপে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন ; লন্ডন বা অ্যামস্টারডম হয়ে বাসে, ট্রেনে, আর হিচহাইক করে তুরস্ক, ইরান, আফগানিসতান, পাকিস্তান , ভারতবর্ষ হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । লন্ডন আর অ্যামস্টারডম ছিল স্বাধঃপতিতদের জড়ো হবার ঘাঁটি । ভারত-পাকিস্তানের যে গেট দিয়ে তাঁরা আসতেন তার নাম ছিল গন্দাসিং ওয়ালা, তখনও ওয়াগার গেট হয়নি , পাকিস্তানের সঙ্গে এখনকার মতোন বোমাবুমির সম্পর্কও হয়নি , চিনের যুদ্ধ সত্ত্বেও । এই যাত্রাপথের নাম ছিল শামুক-গতির হিপি ট্রেইল , যে যাত্রাপথ ছিল যথেচ্ছাচার ও মহানন্দে সময় কাটাবার সহজ উত্তরণ । সে-সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যুবক-যুবতীরা চাইলেই চাকরি পেতেন অথচ বাড়ি ছেড়ে দলে-দলে বেরিয়ে পড়তেন । এখন চাকরি পাওয়া কঠিন , তবুও কেউ বেরিয়ে পড়েন না , তার কারণ পৃথিবীটা হয়ে গেছে ঝগড়াটে , খেঁকুরে, লোভী , জোচ্চোর ও মতলববাজ । শান্তির কোনো ট্রেইল আর নেই, দেশগুলোও অশান্ত ! পৃথিবীর অত্যন্ত ধনী এলাকাগুলোই কেবল শান্তিতে রয়েছে ।

ফ্রিকিং আউট হবার জন্যই কাঠমান্ডুতে জড়ো হতেন হিপি-হিপিনীরা , নেপালে চরস গাঁজা ভাঙ ইত্যাদি পথেঘাটে পাওয়া যেত বলে । ১৯৮০ র পর আমেরিকার চাপে প্রতিটি দেশে আইন করে ভেষজ মাদকসহ সব মাদক নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে । আমেরিকার বিজ্ঞানীরাই ভেষজ থেকে রসায়ন বের করে মাদককে কড়া আর বাজারু করে দিয়েছেন । আর ওই রসায়নেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট নামক জীবদের জন্ম । হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীরা এখনও ভেষজের ধোঁয়া ফুঁকে চলেছেন কিন্তু কেউই অ্যাডিক্ট হন না ।

হিপিরা বেরিয়ে পড়ার পথে আফগানিস্তান থেকে আনতেন উচ্চমানের চরস বা হ্যাশিশ আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাপাতার গুঁড়ো যাকে পাকিস্তানিরা বলতেন গরদা । নেপালি গাঁজার সঙ্গে হ্যাশিশ আর গরদা মিশিয়ে তৈরি হতো একরকমের ডেডলি মাদক । হিন্দু বা বৌদ্ধ , যেকোনো মন্দির চত্বরে গেলে দেখা যেত বৃদ্ধ মাদকসেবীরা গোল হয়ে বসে ছিলিম টানছেন ; তাঁদের পাশে বসে পড়লেই হলো, একখানা ফ্রি লম্বা টান দেবার জন্য । আর হিপি-হিপিনীরা তো ছিলই দরিয়াদিল ; চাইলে নিজেদেরই বিলিয়ে দেবার জন্যে তৈরি । স্বয়ম্ভূনাথ মন্দিরকে হিপিরা বলত মাংকি টেম্‌পল আর এই বৌদ্ধমন্দির ঘিরেই ছিল তাদের জমায়েত , নেশা করে নির্বাণপ্রাপ্তির প্রাঙ্গন ।

স্হানীয় তরুণ কবিরা পছন্দ করতেন কান্ট্রি লিকার, বিশেষত রাকসি এবং জাঁড় , যা খাওয়া হতো মাংসের আচার দিয়ে । অনেক সময়ে মোষের কাঁচা মাংস চটকে-চটকে তৈরি করা কাচিলা দিয়ে । রাকসির গন্ধ অত্যন্ত ঝাঁঝালো ; বহুদূর পর্যন্ত যায় তার নিশিডাক । এই কবি-লেখকরা স্হানীয় সংবাদপত্রে আমাদের সম্পর্কে লিখে অনেককিছু সহজলভ্য করে দিয়েছিলেন । প্রায়ই নিমন্ত্রণ আসতো কবিদের রাকসি-পান আড্ডায় কবিতাপাঠের জন্য ।

আমিও ওই জনপ্রাসাদটিতে থাকতুম । জুটেছিলুম গিয়ে বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে । করুণা আর চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই গিয়েছিল বেনারস থেকে । হিপিরা ভারতে এসে উঠত বেনারসে । সেই সুবাদে করুণা হয়ে উঠেছিল ওদের গাইড এবং দরকার পড়লে স্লিপ-ইন পার্টনার । বেনারসে ওই সময়ের জীবন নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলুম , 'অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা' নামে, যা প্রকাশিত হয়েছিল 'বিষয়মুখ' পত্রিকায় আর পুনর্মুদ্রণ হয়েছিল 'তেহাই' পত্রিকায় । নেপালের জীবনযাত্রা নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে । 'টাইম' পত্রিকায় আমার ফোটো বেরিয়েছিল বলে, আর আমার সঙ্গে বিটনিক কবি গিন্সবার্গ ও ফেরলিংঘেট্টির পরিচয় আছে এবং বিটনিকদের পত্রপত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশিত হবার দৌলতে আমার নাম জানতেন হবু-কবি হিপি-হিপিনীরা । সেকারণে মাদকের ও যৌনতার একটি বিভাময় হ্যালো ওনারা গড়ে দিয়েছিলেন আমার মাথাকে ঘিরে । জীবন হয়ে উঠেছিল অবাধ ও সীমালঙ্ঘনময় ।

আমার সবচেয়ে বেশি সমস্যা হত মাদকের নেশা করে রাতের বেলায় ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি দিয়ে নিজেদের ঘরে যাওয়া । আমি রাতে ফিরে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতুম । আমরা ছিলুম দোতলায় । কতবার ঘোরার পর দোতলায় যাব তা খেয়াল রাখতে পারতুম না । প্রত্যেকদিন বাঁদিকের কারোর ঘরের কাছে পৌঁছে টের পেতুম যে, এটা নয় , নিচে বা ওপরে গিয়ে ডানদিকে যেতে হবে । কারোর কারোর দরজায় ঝোলানো থাকত পরদা, বেশ নোংরা , মনে হত যে পরদাতেই হাত পোঁছে ভাড়াটেরা । অবশ্য হিপিদের ঘরে গিয়েও খড়ের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া যেত, বিনা বাধায় ।

মদ খেলে লোকে টলতে থাকে । ভেষজের নেশায় যা ঘটে তাকে বোধহয় বলা উচিত ভাসতে থাকা বা উড়তে থাকা । ছাদ থেকে ফেলে দেয়া ফালিকাগজের মতোন ।

একদিন রাতে ফিরে সিঁড়ির পাক গুলিয়ে ওপরে গেলুম, টের না পেয়ে নেমে এলুম, আরও কয়েকবার অমন ওঠা-নামা করার পর, উঠছি, একটি বাঁদিকের ঘর থেকে পরদার মাঝ দিয়ে স্বাস্হ্যবতী নারীর ডান হাত বেরিয়ে এলো, সবুজ কাঁচের চুড়ি, লাল রঙের ব্লাউজের হাতা, এক হ্যাঁচকায় ভেতরে টেনে মহিলা নেপালি-টানের হিন্দিতে বললেন, 'রোজই দেখি দরজা অব্দি আসো , ফিরে যাও কেন ?' 

পবিত্র সরকার


মৃণাল বসুচৌধুরী


রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

জাল নোট

পাঁচশ টাকার নোটটা অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল দোকানদার মুদি মদন! এই নিয়ে প্রায় বার দশেক হয়ে গেল! দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে আমি! একবার মিউ মিউ করে বললামও:- এইমাত্র ব্যাংকের এ.টি. এম থেকে তুলে এনেছি রে, মদন! মনে হয় না, জাল নোট হবে।
থামুন তো! ঝাঁজিয়ে উঠল মদন! আজকাল এ.টি. এম থেকেও জাল নোট বেরুচ্ছে! খবর টবর রাখেন না নাকি?
ক্ষেতু বাগচী এসে বসে, হাত বাড়িয়ে সকালের খবরের কাগজটা টেনে নিলেন। হেডলাইন থেকে প্রিন্টার্স লাইন পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়ে, মুখস্থ করা তাঁর রোজকার অভ্যেস। এককালে একটা জাঁদরেল চাকরী করতেন। সেই সুবাদে বিদেশেও গেছেন বেশ কয়েকবার! সব ব্যাপারেই, তাঁর মতো দেবার অধিকার আছে বলে, ক্ষেতু বাগচী মনে করেন। তিনি বেশ জাঁক করেই বলেন- অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে হে! তাঁর অভিমতোই যে শেষ কথা, সেটা আমরা সবাই মেনেও নিয়েছি!! যতই হোক! বিদেশ ফেরতা বলে কথা !
আজ, ক্ষেতু বাগচীকে আসতে দেখেই, চায়ের দোকানদার খগেন চায়ের গ্লাসটা ঠক করে কাউন্টারের ওপর রাখল। আমিও একটা চায়ের গ্লাস পেলাম। মদন, রোজ খাতির করে ক্ষেতুদাকে চা খাওয়ায়!
জলদ গম্ভীর স্বরে ক্ষেতুদা বললেন:- চাটা অন্যমনস্কভাবে বানিয়েছিস তো রে খগেন!
খগেন একটা কলগেট হাসি দিয়ে বলল;- আর ভুল হয় স্যার ?
আমি অবাক হয়ে তাকাতে, ক্ষেতুদা আমার অজ্ঞতাটা ভাঙ্গলেন !
খগেন যদি মন দিয়ে চা করে, তবে সেটা আর মুখতব্য থাকে না, মানে মুখে দেওয়া যায় না! বুয়েচ? তাই এই অন্যমনস্কতার টোটকা!
বাঃ! বাঃ! হাততালি দিয়ে উঠল মদন!
তা স্যার! এটার একটা ট্রায়াল নিশ্চয়ই দিয়ে রেখেছিলেন আগে থেকেই!
তা আর বলতে! ক্ষেতুদা উবাচ!
জানোই তো! আমি বাড়িতে বাঘ! অবশ্য তোমাদের বৌদি রিং মাস্টার! সে যাকগে! কিছুদিন হলো, যা রান্না করছিল না, তোমাদের বৌদি, তাতে আমাকে খেতে বসার সময় জিজ্ঞেস করতে হচ্ছিল- কোনটা কী !
বৌদি বলত- এটা ডাল, আমি ডাল মনে করে খেতাম।
বৌদি বলত- এটা মাছ! আমি মাছ মনে করে খেতাম!
করে করে সবই বলে দিচ্ছিলেন তোমাদের বৌদি আর আমি সেটা মনে করেই খাচ্ছিলাম। শেষে, জিজ্ঞেস করলাম! তুমি কি খুব মন দিয়ে রান্না কর?
আমার বৌ বলল- হ্যাঁ!
আমি বললাম- তা এক কাজ কর! আজ থেকে একটু অন্যমনস্ক হয়ে রান্না কর। ব্যাস্! কেল্লা ফতে! এবার আরাম করে, পদগুলো চিনে চিনে খেতে শুরু করলাম! সেই টোটকাটাই আমি খগেন কে দিয়েছি!
মদন এবার আর চুপ করে থাকতে পারে না! বলে ওঠে:-তা হলে তো অন্যমনস্ক হলে, প্রচুর ভালো ভালো কাজ করা যায়!
সে আর বলতে! ক্ষেতুদা আয়েস করে একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়ার রিং ছাড়তে ছাড়তে শুরু করলেন:- এই যে ধর, কিছুদিন আগে, দুধের ট্যাংকারে কস্টিক সোডা পাওয়া গেছিল, এটা তো অন্যমনস্কতারই ফল! অন্যমনস্ক হওয়াতে পাবলিকের কত সুবিধে হলো বলো দেখি!
কিরকম! এবারে আমি বললাম।
কি ফটফটে সাদা দুধ, একবার ভাবো দেখি! গরুও অমন দুধ দিতে পারে না! সোডা দিয়ে কাপড় কাচলে, জামাকাপড় যেমন ধবধবে সাদা হয়, ঠিক সেইরকম! অঙ্কটা পরিষ্কার! পেটও সাদা, দুধও সাদা!

একটানা বলে ক্ষেতুদা দম নিলেন।
দম নিয়ে আবার শুরু করলেন:-তবে সব সময় যে ভালো হয়, তা কিন্তু নয়!
- কী রকম? আমার জিজ্ঞাসা।
- এই দেখো না! পিন্টু আর সুকুরের কথা শুনেছ?
- পিন্টু? আমাদের পাড়ার? সুকুরকে তো ঠিক চিনলাম না!
- বলি, কাগজ তো রাখো বাড়িতে, পড় কি?
- তা পড়ি!
- ঘোড়ার আণ্ডা! পড়লে আর এইরকম বিদঘুটে প্রশ্ন করতে?
- কী রকম?
- পিন্টু হচ্ছে চোর! চুরি করতে গিয়ে ফ্যানের হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল!
- তারপর?
- তার আর পর নেই!
- এই দেখুন! হেঁয়ালি করতে শুরু করলেন তো!
- হেঁয়ালী করব কেন? চুরি করতে গেছিল পিন্টু, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে! উঠে দ্যাখে বাড়ির মালিক হাজির! তারপর বেদম ক্যালানি খেল!
- আর সুকুর?
- ওরও একই কেস! তবে ও ঘুমিয়েছিল মোবাইলের দোকানে! তারপর পিন্টুর হাল! বুঝলে হে!! অন্যমনস্ক হওয়ার বিপদও আছে!
আমার মোবাইল দুবার বেজে বন্ধ হয়ে গেল! মোবাইলটা বের করে দেখলাম, গিন্নি মিস কল দিয়েছেন! বুঝলাম, দেরি হচ্ছে দেখে, এই চেতাবনি!
ক্ষেতুদা জিজ্ঞেস করলেন:- কে মিস কল দিলে?
- মিসেস!
- বাঃ! এই বয়সেও তোমার মিসেস, তোমায় মিস কল দিচ্ছেন? খুব স্বাস্থ্যকর ব্যাপার! তোমার তো দুধ জমে ক্ষীর আর ক্ষীর জমে প্যাঁড়া হে!
মুচকি হাসি ছাড়া এসব ক্ষেত্রে আর কোনো উপায় থাকে না!
- তা, হ্যাঁ হে! তোমার মিসেসের কি মিস কল দেওয়াই অভ্যেস?
- না, না!
- তবে?
- ওই! আমাকে ওয়ার্নিং দিতে হলে, মিস কল দ্যায়!
- তা ভালো! আমার কিপ্টে শ্যালক বাহাদুর আবার জীবনে একটা গোটা কল করল না জীবনে! সামনের বাড়িতে একবার আগুন লেগেছিল! তা তিনি সমানে দমকলকে মিস কল দিয়ে গেছিলেন!
- তা দাদা, আপনার কোনো মিস কলের অভিজ্ঞতা?
- ভূরি, ভূরি! তোমাদের বৌদি প্রায়ই তাঁর মোবাইলটা অন্যমনস্ক হয়ে এখানে সেখানে রেখে দিয়ে আর খুঁজে পান না! আমাকেই ওনার মোবাইলে মিস কল দিয়ে, রিং টোনের উৎস ধরে মোবাইলটা বের করতে হয়!
- ওটা তো আমারও হয়!
- সে তো বুঝলাম! কিন্তু, কিছুদিন আগে তোমাদের বৌদি চশমাটা হারিয়ে, আমাকে বললেন, মিস কল দিয়ে চশমাটা খুঁজে বের করতে!
- কি করলেন আপনি?
- কী আর করব! চশমাটা কোথায় ছিল দেখতে পাচ্ছিলাম! তাই মিস কলের ভান করে চশমাটা বের করে দিলাম! শুধু টর্চের জন্য কেনা নতুন চারটে ব্যাটারির কিছু করতে পারিনি!
- ব্যাটারি ?
- নতুন ব্যাটারীগুলো ভালো থাকবে বলে, তোমাদের বৌদি ওগুলো ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন! ওই অন্যমনষ্কতার ফল! বুঝলে হে!

আবার গিন্নির মিস কল! আমি মদনকে বললাম- কী রে! মালগুলো দিয়ে দে! দেখছিস না , বারে বারে মিস কল আসছে!
দিতে তো অসুবিধে নেই, ঘনাদা! ওই নোটটাই যত নষ্টের গোড়া! বুঝতেই পারছি না, নোটটা আসল না জাল!
ক্ষেতু বাগচী বললেন:- প্রবলেমটা কী?
মদন:- কিছুই না, ঘনাদা একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়েছেন! নোটটা আসল না জাল, বুঝতেই পারছি না!
- ও! এই ব্যপার! এ তো খুব সোজা!- ক্ষেতুদা বললেন।
- আমার কাছে নোট চেক করার মেশিন যে নেই স্যার!
- দরকার নেই! এক কাজ কর হে মদন! গাঁধীজির ছবিটা ভেতরে রেখে- নোটটাকে দু ভাগে ভাঁজ কর!
- করলাম!
- বেশ, এবার ওই ভাঁজ করা নোটের ওপর জোরে জোরে ৫ বার ঘুঁসি মারো!
- মারছি! বলে মদন শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ভাঁজ করা নোটের ওপর জোরে জোরে ৫ বার ঘুঁসি মেরে হাতটা ঝাঁকাতে লাগলো!
- আহা! খুব লেগেছে বুঝি, মদন!
- তা আর বলতে! হাত টা টনটন করছে ব্যথাতে!
- ঠিক আছে! এবার নোটটার ভাঁজ খোলো!
- খুললাম, মদনের উত্তর!
- খুব ভালো! এবার দ্যাখো, গাঁধীজির চশমাটা ভেঙ্গেছে কি!
- না তো! মদন খুব ভালো করে দেখে বলল!
- তা’লে, ঘনার দেওয়া নোটটা আসল! নকল হলে গাঁধীজির চশমাটা ভেঙ্গে যেত!
- ওরে কানাই! ঘনাদার মালগুলো একটা রিক্সো ডেকে তুলে দে! মদনের হুকুম হলো।
- আমিও যাই! ক্ষেতুদা বললেন। সকাল থেকে পেটে একটাও গোটা কল আসে নি! এবার ঘন ঘন মিস কল দিচ্ছে! আর তো চাপা যাচ্ছে না!
বলে, ক্ষেতুদা আমার সাথে রিক্সোয় চেপে বসলেন। আসার সময় দেখলাম, মদন তখনও ডান হাতটা ঝাঁকিয়েই চলেছে, ঝাঁকিয়েই চলেছে!

অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস ও প্রদ্যুৎপ্রকাশ রায়

গৌতম চট্টোপাধ্যায়

দুই কন্যা


(সরস্বতী বিদ্যেবতী তোমার সাথে আজন্মকাল
ঘর করেছি ,পর করেছি লক্ষ্মীরাণী ধনবতী )

দ্যাখো, উঠে যাচ্ছি মহাশূন্যে , সাথে নিয়ে ডিজিক্যাম

তাক করছি তাক করছি আহা তাক দুম
দেখতে পাচ্ছি বিস্ফারিত পাছা
ধনবতী লক্ষ্মীর, ভয়ানক পা বিছিয়ে রয়েছে মাটিতে -
পায়ে মোটা পায়জোর, নগ্ন কোমরে
বিছাহার, নাভিমূলে ঝুলছে মডেল-প্রশস্ত নোলক ,
রঙিণ দুধহীন বুকে দোল খাচ্ছে জড়োয়া সীতাহার,
ক্রমশঃ সরু হয়ে যাচ্ছে গলা, খোঁজ খোঁজ মাথাটা -
ছোট হতে হতে তবে কি মায়ায় মেলালো ?

সরস্বতী বিদ্যেবতী

আবার মাটিতে নামছি
নতজানু হয়ে তোমাকে টিল্ট-আপ ফোকাস করছি
দেখছি হেঁড়ে মাথা সহ তুমি বেতসলতার মত স্লিম
দীর্ঘদেহে দাঁড়িয়ে আছো এলোচুলে
একমনে পড়ে যাচ্ছো 'মানব সভ্যতার ইতিহাস'
সরু দেহে শাড়ীর ক্রিজ ঠিক রাখা দায়
স্তনচ্ছায়ে কোনোমতে লেপটে রয়েছে আঁচল
আর পাড় দিয়ে ঢাকা দুটি পায়ের সামনে
বেত-ছড়ির বাঁটের মত আনত প্রণামে রত
ধনলক্ষ্মীর হারিয়ে যাওয়া মাথা ।



কন্যা-কে


গৌতম চট্টোপাধ্যায়


শান্ত ভয়রোঁর আবহে ভাসমান

ভাটিয়ালির পদ প্রতিপদে-পূর্ণিমায়
প্রতিটি চাঁদিনী রাতে গ্রহণ হয় না তবু
পূর্ণিমায় চাঁদের দিকে তাকাতে এত ভয় !

যা-রে ফাগুয়ার ভোর , বয়ে যাক তোর

দিন ক্ষণ সময়ের বিড়ম্বনা , আমি এখন মত্ত
কন্যার মুখ খুঁজতে, ফাঁকা এ্যালবাম খোলা সমুখে
সাজিয়ে রাখছি প্রিয় সব মুহূর্ত যত

ফোন বাজছে, ভেসে আসছে হুল্লোড় , ফাগুয়ার রঙিণ

স্তোত্রাবলী, যৌবন উজাড় করে গেয়ে যাস হোরী গীত
কিসের ভয় তোর মেয়ে, বন্ধু রয়েছে পাশে উষ্ণ,
তবুও কম্বল কেন খোলা, কীসের এত শীত !

ছবি সাজাই, স্মৃতির ডিঙা ভাসাই, অপেক্ষা নেই ফোনের

বজ্র পতনের শব্দ এলো, ঝলসে উঠলো আলো
দিবাকাশে গ্রহণ লেগে গেছে, দেরী আছে চাঁদিনী রাতের
কন্যে, তোর হাসিমুখ কারা করেছে কালো !

শান্তমুখে ঘুমিয়ে আছিস - চির প্রশান্তির ঘুম

শয়তানের চিমটি জানান দিচ্ছে আত্মহননের গল্প
কোথাও বাজছে না গান, থমথমে পড়শী মুখ
মেকী কান্না, চাপা ক্ষোভ বুঝিয়ে দিচ্ছে হত্যার রূপকল্প

'মর্গে কি হৃদয় জুড়াল'- কন্যে, কেন বিয়ে করিস !

কন্যাদের মুখগুলো আজ ফুলের বোঁটার মত
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেওয়া যায়, এখন সময়
বধূ নিধনের- মানুষের ইতিহাসের গভীরতম ক্ষত

অলংকরণ – মেঘ অদিতি

পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত

সামনের দিকে শিশি বোতল আছড়ে পড়ছে



সামনের দিকে শিশি বোতল আছড়ে পড়লো ধ্বংসকালীন মাথার বালিশ
ছুঁড়ে মারলাম হেডলাইটের হাংরি স্কুটার উষ্ণ আবেগ
আড়াল থেকে তুলকালাম শাপশাপান্ত হেয়ার স্টাইল
ফুটে উঠলো রোবো সিটির অষ্টাদশী মুখের ওপর
যুগে যুগে ইন্দ্রপ্রস্থ সেই ঘরানার ছায়ামূর্তি
মোহময়ীর বেডরুমে ঝাঁপ মুখ লুকোল ছবির নেটিভ
দোকান থেকে আলোর নদী প্রেমের নদী ভ্যাটিকানে
কনসার্ট নেই বাউল গানের প্রাইভেসি নেই বেডরুমে তার মেদ ঝরাতে
লেজার এলো মুখের কালো ছোপ হটাতে লোমের পালক মনস্তাত্ত্বিক
দেয়াল জুড়ে ফুলের সাজি বুকের ব্যথা পুরোনো প্রেম বেশ রোমাঞ্চ
আমার টাকা আসতে পারে কুম্ভ রাশি রান্না ঘরে
বাঁশির পুলক প্রেম দিয়েছি রাসায়নিক স্বর্ণচাঁপা
আমার ছবি তুলছ তুমি স্বপ্ন দেখি বিলাসিতার
নতুন ট্রিপে আর যাবনা
সুইচ অন করলে কেন সূর্য ওঠার স্বপ্ন দেখি
জানলাগুলো বাতাস খুলে দিচ্ছে বুঝি ও ডানা তুই মুক্তি দিবি
মাথার উপর চাঁদের বিউটি লাইট মেকআপ
মেঝের রঙে সিট্রোনেলা গন্ধ ছড়ায় লেমনগ্রাস
কাজের কাজ হয় না কিছু প্রেমকাহিনি পার্কে পার্কে নেমে পড়ল গড়িয়াহাট
টুক করে প্রেম টোকা মারল আঁচড়ে কামড়ে উত্তেজনায়
শিশি বোতল আছড়ে পড়লো কঠিন শরীর খুলে ফেললো জাঁতাকলের অনন্তকাল

দূরে যাও মেঘ প্রিয় সমাচার
পাতালে জটিল জমাট আধার
আমি খুলে খাই অতিসাধারণ
খয়েরি আকাশ উপন্যাসে
রূপারোপ দাও মধ্যবিন্দু
উপশম নেই চেয়ে বসে থাকি
মরশুমি মেঘ সীমানা ছাড়িয়ে
তাঁত বুনে যায় শত শত বুটি
মুখোমুখি সব অস্থিরতার
সারি সারি গাছে নেমে আসে চাঁদ
জীবন ছড়িয়ে পড়লো আকাশে
বিষাদ বদলে নিয়েছি আমোদ
সাদা ঘোড়াগুলো আমার কবিতা
চুম্বন খুলে দিয়েছি অনেক
উড়ে যেতে চাই শেষ কুয়াশায়




মধ্য-রাতের বাতাস
মৃদু শব্দ তুলে বলে চলেছে
কেন তোমার স্বপ্ন দেখা শেষ হয় না
চাঁদ আর ফেরেশতা
তারারা আর নীল আকাশ
রূপালি চাঁদের পাশে সর্বশক্তিমান
বেহেশত আর কাকে বলে
ঘরে যা কিছু বিচ্ছেদের কারণ
সে সব তুচ্ছ
অমৃতের পরিবর্তে ওগো রাত
আমাকে এক পিপে মদ দেবে


গরমাগরম কত্তা-গিন্নি
ম্যারেজ সারর্টিফিকেট নেই
লিভটুগেদার লিভটুগেদার
কপিরাইট থাকছেনা আর
কি করব এখন স্থগিতাদেশ দিচ্ছেনা বর
বউ মানেনা ক্ষতিপূরণ
কেউ জানেনা
হচ্ছেটা কি এই সিনেমায়
কেবল দেখ বাসনপত্র টুকরো টুকরো
বাড়াবাড়ির কম্পজিশন মেঘ জমলো বসার ঘরে
ছোট ছোট অভিমানের স্নায়ু যুদ্ধ পাটকিলে চাঁদ
বলতে পারো জ্যোতিপুঞ্জ নিভছে তুলির রঙ শুকিয়ে যাচ্ছে দেখো

আলো-বাতাস খেলবে কেমন করে দৈরথ চলছে যে
ইমেলে ম্যাগাজিনের পাতায় এক দুর্দান্ত ট্রাভেল এজেন্ট
স্ট্রবেরির ছন্দে দারুণ এফেক্ট দিতে লাগলেন
অন্তহীন মুক্তির গন্ধ তাকে নিয়ে চললো
একটি মন্দ্রিত পানশালায়

আমি চলে যাবো
আমি আর থাকব না
ভাঙচুর আর প্রবোধ বাক্যের মন্দিত স্নানে
আমি আর থাকব না

শরীরের কোথাও প্রসন্নতার ভাষা নেই
টুক করে খসে পড়ল অলিভঅয়েল
বিজ্ঞাপনের পাতায় পাতায় জেগে উঠলো ময়েশ্চারাইজার
হেলদি স্কিনের টনিক লাগবে লেবুর রসে আপেলগুড়ো
লাগবে ঘুমের আরামপাচক
ইলিউশনের স্বচ্ছ্ব ডানা
জাগিয়ে তুলবে কল্পনা-স্ট্রোক ডিজাইনারের সুয্যিমামা
স্নানের টাবে চম্পাকলি গাইবে গানের প্রথম কলি

ক্লাইমেক্স বদলে যাচ্ছে
বিগড়ে যাচ্ছে রিঙমাস্টার
নিঝুমরাতের শিউলিমাখা প্রেমের পদ্য
হারিয়ে যাচ্ছে পাতলা ঠোঁটের ব্রাউন লেয়ার
খুঁতখুঁতুনি আসছে যেন বয়ঃসন্ধি শিথিল শরীর
ব্রা আনতা একটু জটিল শুকনো নিপিল
আশানুরুপ ধনতেরাসে জুটছেনা খই
বিধিনিষেধ মানছিনা আর ক্লায়েন্ট আছে ইনফিনিটি
ভবিষ্যতের আর কি বাকি একমুঠো চাঁদ শুকনো নিপল
হজম করে কিউব উধাও ফস্টিনস্টির নয়া জার্নি হলো

অপার্থিব যা কিছু ফেরেস্তার জন্য ।
নানা রঙের বাসনায় চুল আঁচড়ালাম
পূর্নিমার ওমে মদ্যপান করছেন
দূরে দেখা যায় কবরখানার রূপসী ফুলের স্তবক

চাঁদ অনেকটা গোল হয়েছে
সম্পূর্ণ গোল না হওয়া পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই
এক টুকরো নদী দরগার ঠিক পাশেই তার মতই
অস্থির অন্বেষ্ণণ আমার কবিতার চরণে চরণে

এই অলৌকিক আলোর কথা
আমি কিছুতেই গোপন করতে পারবো না
বিবির গাল বেয়ে যা নেমে এসেছিল আমার কবিতায়

চিত্রনাট্যের প্রেক্ষিত আর যাই হোক
ইনসমনিয়ার গান আমি গাইবোই
সাজিয়ে ফেলবো দম্পতি ফ্ল্যাট বাতি আবহ নস্টালজিকে
সাজিয়ে ফেলবো স্বপ্নপূরণ ট্যাবলয়েড হুঁশ ফেরাতে
তাকিয়ে থাকো তলিয়ে যাবার হু হু বাতাস দেখবে রাতে
পরীর মতো পদ্মপাতা লিপলাইনার পাতলা ঠোঁটে

অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস

বিকাশ সরকার


প্রাইমারি স্কুলের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হতো বিগুলঝোরা নদীটির পাড়ে কাশফুল কত ঘন হলো। স্কুলের পিছনেই নদী, তারপর নদীর পাড়। নদীর ওপাড়ে একরত্তি চর জেগে থাকত, কিন্তু মাঝের এই জঙ্গলের জন্য সেটা দেখা যেত না। কিন্তু যখন একটু একটু করে সেখানে কাশফুল ফুটে উঠতে শুরু করত, আমরা ভাঙা জানালা দিয়ে একটু একটু করে দেখতে পেতাম। কেমন যেন এক আলো খেলা করত সবার চোখেমুখে। সে আলো শরৎকালের। কাশ যত মাথা উঁচু করে, আমাদের চোখেমুখে সে আলো আরও আনন্দিত হয়, আরও ঘন হয়। মনে হয় কলমির ওই জঙ্গল পেরিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি ওই পাড়ে। ওপাড়ের ঘন কাশবন যেন স্বপ্নের মধ্যেও আনাগোনা করে। না, আমাদের গ্রামে কোনো বুক দুরুদুরু করা আমলকী বন ছিল না। তবে গাছগুলি দেখে দিব্য বোঝা যেত সত্যিই পাতা খসানোর সময় হয়ে এসেছে। আর ছিল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এর বাড়ি-তার বাড়িতে বিস্তর শিউলি গাছ। রাস্তার ধারেও ছিল মালিকানাহীন সেইসব গাছগুলি। শিউলির গন্ধ ভেসে এলেই বোঝা যেত পুজোএসে গেছে। লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, কার্তিকপুজো...সব পুজোর সঙ্গেই দেবতার নাম জড়ানো থাকে; কিন্তু স্রেফ ‘পুজো’ মানে হলো দুর্গাপুজো। দেবতা এখানে নিমিত্তমাত্র, পুজোটাই আসল; এবং পুজোর আনন্দ। ঢাকিরা পুজো শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ঢাক বাজাতে বাজাতে মন্ডপের দিকে যেতে থাকেন; সেই বাদ্য বুকের ভিতর কী উন্মাদনা তোলে। ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালেবিলে’—এই বাক্যে তার সমর্থন চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অতএব কাশফুল ফুটল, শিউলির গন্ধ পেলাম আর বুকের মধ্যে বেজে উঠল ঢাক; এই ত্র্যহস্পর্শ না হলে আর পুজো কই?

গ্রাম বলতে তো তিনদিকে চা বাগান আর একদিকে বন। মাঝখানে একটুখানি লোকালয়। একচিলতে বাজার। পুজো হতো একটাই। সেটা বারোয়ারি মন্ডপে। শামিয়ানা টাঙানো হতো। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ কাগজ তেকোনা করে কেটে নারকেলের দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। সেই পতকাবৎ কাগজগুলি যত ওড়ে ততই যেন আনন্দ বাড়ে আমাদের। বেলুনওলা আসে সাপবেলুন ফুলিয়ে, লংকাবাজি-চরকি-বুড়িমার চকোলেট-তুবড়ি নিয়ে দোকান বসে, ঘুগনি আর পেঁয়াজির দোকান বসে। পুজো শুরু হয়ে যায়। মাইকে পুরুতমশায়ের মন্ত্র ভেসে আসে। টিউবলাইটের নীচে আরতি কম্পিটিশন হয়। সেখানে সারা বছরের জমানো যত কসরত দেখান বীরেনমিস্ত্রি-ফিটারকাকু-রমেনধোপা। আর আসে যাত্রাপার্টি। অষ্টমীতে আরতি কম্পিটিশন তো নবমীর রাতে ‘রহিম বাদশা রূপবান কন্যা’ দেখে চোখের জলে বুক ভেসে যায়।

এখন হঠাৎ করে দেখি দুর্গাপুজোর সেই উপচারগুলি যেন এক এক করে খসে পড়েছে। যেন দুর্গারই দশ হাত একটা একটা করে খসে পড়া। মহালয়ার ভোর যে কী উন্মাদনাকর ছিল সে আজ কাউকে বলেও বোঝানো যায় না। গ্রামজুড়ে হাজারটা রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র গমগম করে চন্ডীপাঠ করছেন, মাঝেমাঝে গান, সঙ্গে শিউলির গন্ধ, সেসব আজ আর নেই। এখন মহালয়া শোনার জিনিস নয়, দেখার জিনিস। পাঠটা গৌণ, মুখ্য হলো কে কত ড্রামা করতে পারছে। তেমনি দুর্গাপুজোও তার সেই রূপ হারিয়েছে। পালটে গেছে পরম্পরা। আলোর রোশনাই, গগনচুম্বী লক্ষ টাকার প্যান্ডেল, হিন্দি গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য—এসব এখন পুজোর অন্যতম অংশ। এত আলো তবু যেন মনে হয় যাঁর পুজো সেই দেবী দুর্গা অন্ধকারে ডুবে আছেন তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে; কেউ তাঁদের দিকে ফিরেও তাকায় না, সবাই প্যান্ডেলের কারুকাজ দেখতে মগ্ন। এখন তো বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য পুজো স্পনসর করছে। তাই ঢাকিরা সব কোনো মোবাইল নেটওয়ার্কের গেঞ্জি পরে ঢাক বাজায়, আর দূর থেকে কেউ তাঁদের ধমকে বলেন, ‘ওরে ঢাক বাজানো বন্ধ কর, এখন আমাদের হিমেশ রেশমিয়া শুরু হবে।’ ঢাকিরা সব মুখ কালো করে এক কোণে বসে থাকেন, শুরু হয়ে যায় ‘ঝলক দিখলা যা’র সঙ্গে নৃত্য। তান্ডবের ‘তা’ আর লয়-এর ‘ল’ দিয়ে যে ‘তাল’ হয়েছে তা এই বঙ্গসন্তানেরাই প্রমাণ করেছেন। ওদিকে বেচারা পুরুতমশায় যে তাঁর চেলা নিয়ে কী করছেন সেদিকে কারও কোনো লক্ষ্যই নেই। তিনি হয়তো তখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে মায়ের সন্ধ্যারতি করছেন। আসলে, পরম্পরাও যে পণ্য হতে পারে তা আজকের দুর্গাপুজোই জ্বলন্ত নমুনা। মনে হয়, একটা সময় আসবে যখন পুজোয় আর ঢাকই বাজবে না। অঞ্জলি হবে না। আরতি তো সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু প্যান্ডেল থাকবে। তীব্র আলোর ঝলকানি থাকবে। আর থাকবে উন্মাদনৃত্য।

এবং বাজির গন্ধে ভরে যাবে বাতাস, শিউলির গন্ধ সেখানে মুখ লুকনোরও জায়গা পাবে না। আমরা তখন ফিরে যাব সেই গ্রামটিতে, যেখানে কাশবনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন দুর্গা, পিছনে পিছনে ছুটছে অপু, আসলে আমি।



অলংকরণ – মেঘ অদিতি কৌশিক বিশ্বাস

মৃণালকান্তি দাশ


অলংকরণ – চন্দ্রশেখর মিত্র

মিতুল দত্ত


সমরজিৎ সিংহ

মোহমুদগর
­

১.

স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। তার পায়ের শব্দ। ওই যে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নামছে সে। একটু কি থামল? কেশে ওঠল যেন একবার? চুপ করে বসে আছি চেয়ারে। এ ছাড়া কিছুই করার ছিল না আমার। না কি ছিল? কী করতে পারতাম? না কি বলতাম, যা করেছ, সব ঠিক। তোমার কোনো দোষ নেই, অপরেশ। ভুল যা কিছু হয়েছে, আমারই!

তা হলেই কি মিটে যেত সব ঝামেলা? ফাটল আর থাকত না এই সম্পর্কে? সত্যি? তা কী করে হয়? ফাটল ধরে যাচ্ছে, এটা টের পেয়েছিলাম আগেই। গত দুবছর ধরে। মিলিকে নিয়ে। প্রথমে স্বীকার করেনি মিলি। চাইছিলাম, নিজে থেকেই বলুক সবকিছু। বলেনি। আমি যে টের পাচ্ছি, তাও বলিনি তাকে। লোকের মুখে শুনি। পাড়া থেকে অফিসে, সর্বত্র, একটা ফিসফিস শব্দ। ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাড়াময়। আমাকে দেখলেই থমকে যাচ্ছে তা। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পরিচিতজন। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল ক্রমশ। পাত্তা না দিতে গিয়ে, দেখি, পারছি না।

সেদিন, সকালে, পাড়ার সেলুনে, চুল কাটাতে গিয়ে, নিতাই, সেলুনের মালিক, বলে ওঠল, দাদা, একটা কথা বলব, রাগ করবেন না তো?

আয়নার ভেতর দিয়ে নিতাইকে দেখলাম। চিত্রগুপ্তের মতো। নির্বিকার, ভাবলেশহীন তার মুখ। আমার চুলে কাঁচি চালাচ্ছে। বললাম, বল, নিতাই।

অপরেশবাবু আপনার কেমন বন্ধু?

কেন?

না। এমনিতেই জানতে চাইছিলাম।

অপরেশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। খুব ভালো লোক। কেন বল তো? আবার তাকে পোষণ করি।

তার ভাবগতিক ভালো নয়, স্যর।

আর কিছু বলেনি নিতাই। ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠেছিলাম আমি। তা হলে, পাড়াতেও খুব চর্চা হচ্ছে অপরেশকে নিয়ে? কী কী আলাপ হয়? লোকে কেচ্ছার গন্ধ পেলে উৎসাহিত হয় খুব। মাছি যেমন একটু দুর্গন্ধের সন্ধান পেলে ভন ভন করতে থাকে, এটাও তাই। নির্ভেজাল এক কেচ্ছা, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মিলি।

ভেবেছিলাম, ঘরে ফিরে, জিগ্যেস করি। কী ভেবে, চুপ করে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, মিলি তো সেই আগের মতো আছে। দরোজা খুলে দিয়ে, বলল, জান, আজ তোমার জন্য চিংড়ির মালাইকারি করলাম। আর পোস্ত দিয়ে দেশি মুরগি। বাইরে বাইরে থাক, ঘরের খাবার মুখে দেবার সুযোগ আর কোথাও পাও? ভাবলাম—

মিলির দিকে তাকিয়ে হাসলাম। আমার কি পছন্দ, এখনও, মনে রেখেছে মিলি।

হাসছ যে?

তখনই মনে পড়ে গেল, অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। তিনদিনের। এইসব পরচর্চা থেকে অন্তত তিনদিন বেঁচে থাকতে পারব। পিএনপিসি ভালো লাগে না আমার। বললাম, রেডি হয়ে নাও। আমরা দুপুরে বেড়িয়ে পড়ব। জমপুই যাব।

সত্যি? খুশিতে নেচে ওঠল মিলি। বাচ্চা মেয়ের মতো। যেন সে পুজোর জামা পেয়েছে।


জমপুই হিল্‌স আমার ভালো লাগে খুব। লোকে গ্যাংটক যায়, শিলঙ যায়, আমার পছন্দ জমপুই। লুসাই অধ্যুষিত এই পাহাড়ে শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই। আগরতলা থেকে দুশ কিলোমিটার কি হবে না। একদিকে আইজল শহর, অপরদিকে, কাঞ্চনপুর। আগে কমলার জন্য বিখ্যাত ছিল এই জমপুই। ভুবনবিখ্যাত এই কমলার জন্য লোক আসত দেশবিদেশ থেকে। উৎসব হত কমলার। এখন তা নেই। কমলার বাগান নেই আর। যদিও, কিছু কিছু জায়গায়, পুনরায়, লাগানো হয়েছে কমলার গাছ। লোকের মন নেই সেদিকে। সবাই এখন রাবার চাষে উৎসাহী। সরকার ছাড় দিচ্ছে। ঐ ছাড়ের লোভে, যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে রাবার বাগান। পরিবেশ দুষিত হয়ে পড়ছে দ্রুত। কে রাখে সেদিকে খেয়াল?

তবু, জমপুই, এখনও, অনেকদিন দুষনমুক্ত। এই একটি কারণেই জমপুই আমার প্রিয়। তা ছাড়া প্রকৃতির ঐ চলচপলরূপ আর কোথায় দেখব? লুসাই কিশোরীর মতো তন্বী, শ্যামা এখন সে।

সরকারি লজ বুক করেছিলাম আগে থাকতেই। ভাঙমুনে এই লজ, সত্যিই, দু একদিন কাটানোর জন্য আদর্শ। কয়েকহাজার ফুট উঁচু এই ভাঙমুন। তবে, আর কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে গেলে, শিবলিঙ্গ। জমপুইয়ের শিখরদেশ। লজের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে, মেঘ এসে খেলা করে পায়ের নীচে। কোনো কোনো সময়, ভিজিয়ে দেয় শরীর। ঐ শীতল স্পর্শে, জুড়িয়ে যায় মন। লজ থেকে সামান্য এগিয়ে গেলে, বাজার, ব্লক অফিস। প্রতিটি দোকানে লুসাই মেয়েরা হাসি মুখে অভ্যর্থনা করছে খদ্দেরকে। বাংলা বোঝে না তারা। আধা হিন্দী, আধা ইংরাজিতে কথা বলে ভিনদেশী লোকের সঙ্গে। আর প্রতিটি কথায় হেসে ওঠে তাদের উচ্ছ্বল শরীর।

সন্ধ্যের একটু আগে, নতুন গড়ে ওঠা ইকো পার্কে, মিলিকে নিয়ে বসি। সূর্‍্য ডুবে যাচ্ছে শাখান পাহাড়ের পিঠে। মনে হচ্ছে, মোষের পিঠে চড়ে, সূর্‍্য যাচ্ছে বেড়াতে। অস্তাচলে। নিচে কাঞ্চনপুর শহর সেজে উঠছে আলোয়। ব্যাগ থেকে বের করি, মনপুই থেকে আনা লুসাই পানীয়। মগজকে মুহূর্তে চাঙ্গা করে তোলে এই পানীয়। মূলত ভাত থেকে তৈরি। তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। প্রথমে সামান্য ঝাঁঝ থাকলেও, দু’তিন গ্লাস নেবার পর, এর স্বাদ অনুভব করা যায়। একটা ওয়ান টাইম গ্লাস মিলিকে দিই। আমিও নিই আর একটা গ্লাস।

দু-গ্লাস নেবার পর, মিলি, উঠে গেল। একটু এগিয়ে গেল পশ্চিমে। সেখান থেকে, কাঞ্চনপুর শহর দেখা যায় ভালো। দূর নিচে জনপদ ক্রমে শহর হয়ে উঠেছে বেশিদিন নয়। মূলত চাকমা ও রিয়াংদের আধিপত্য ছিল সেখানে। উদ্বাস্তু বাঙালীরা এসে, এলাকার অধিকাংশ স্থান নিয়েছে তাদের করে। ব্লক থেকে এখন মহকুমা শহর।

একটা সিগারেট ধরালাম আমি। সাধারণত সিগারেট কম খাই। পানীয় গ্রহণের সময়, একটা সিগারেট হলে জমে ভালো। মিলিকে বললাম, নেবে?

সরে এল মিলি। আমার ধরানো সিগারেট নিয়ে, টান দিল। ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে, হঠাৎ বলে ওঠল, তোমাকে একটা কথা বলব, ভাবছিলাম।

তার দিকে তাকালাম। নেশা হবার কথা নয়। লুসাই পানীয় ধরে ধীরে ধীরে। ঘন্টা খানেক পর থেকে এর মজা পাওয়া যায়। তার আগে নয়। কি বলতে চায় মিলি?

কয়েকদিন ধরে, বলব বলব করেও বলতে পারিনি। অথচ না বললেই নয়।

আরেক রাউন্ড গ্লাসে ঢালি। তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, বলে ফেল। অনেক সময়, বলে ফেললে হালকা হয়ে যায় সমস্ত ভাত। হাতে গ্লাস নিয়ে, দেরি করল না মিলি। এক ঢোকে শেষ করল সবটা। তারপর পুনরায়, বাঁ-হাতে রাখা সিগারেট ঠোঁটে চেপে, টান দিল। লম্বা টান। আবার ছেড়ে দিল। তারপর বলে ওঠল, জান, পেটে যে আসছে, সে তোমার নয়। অপরেশের।

আমি কি ভুল শুনলাম? মিলি যেন কী বলল? কী বলল মিলি? ঠিক শুনতে পেয়েছি তো আমি? হাতের গ্লাস, মুহূর্তে, শূন্য করে দিয়ে, বললাম, তুমি ঠিক বলছ তো, মিলি?

পাথরের মতো মিলি। নাড়ির স্পন্দন যেন নেই। চোখ কি বন্ধ করে রেখেছে সে? ভাবলেশহীন তার মুখ। না কি তার উলটোটাই? ভেতরে ভেতরে একটা ঝড়ের মোকাবিলা করছে সে? আশ্চর্‍্য এক ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, তোমাকে ঠকাতে চাই না আমি। এই সন্তান তোমার নয়।

এতক্ষণ চাঁদ ছিল আকাশে। চাঁদের আলোয়, জমপুই হয়ে উঠেছিল অপার্থিব। মনে হচ্ছিল, এখনই, নেমে আসবে পরীর দল। তারা এসে নাচবে লুসাই যুবতীদের মতো। গীটার হাতে কেউ হয় তো বাজাবে তাদের সঙ্গে। সেই সুর ছড়িয়ে পড়বে জমপুইয়ের সর্বত্র। আর নাচের তালে তালে সমগ্র বন দুলতে থাকবে জ্যোৎস্নায়। মুহূর্তে, একটা মেঘ এসে, ঢেকে ফেলল চাঁদ। ম্লান ও আবছা হয়ে এল এই ইকো পার্ক।

এই গ্রীষ্মেও, বেশ ঠান্ডা জমপুইয়ে। এই পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যই এটা। সব সময় মিহি বসন্ত। হালকা একটা সোয়েটার পরে এসেছিলাম। মিলির এই কথা শুনে, মাথা শুধু নয়, গা হয়ে ওঠল গরম। ঘামতে শুরু করেছি। এমনই যে, খুলতে হল সোয়েটার। মাথা দিয়ে সোয়েটার গলিয়ে নিতে গিয়ে, টের পেলাম, গা গুলিয়ে উঠছে আমার। বমি কি হবে? এটা মদ্যপানের ফল, না, মিলির ওই কথার প্রেক্ষিতে?

চুপ করে বসে আছে মিলি। মাথা নিচু তার। এতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছিল উলটোদিকে। সেদিকে, দূর আইজল শহরের আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত জুড়ে। কেউ কোন কথা বলছি না আর। দু একটা বনচারী প্রাণীর চলাফেরা শব্দ, বয়ে যাওয়া হাওয়ার পাতার খসে পড়া ছাড়া, মনে হল, স্তব্ধতা এসে, ঘিরে ধরেছে আমাদের দুজনকে।

মিলি খুব সুন্দর এক সবুজ শিফনের শাড়ি পরেছিল আজ। আমিই গতবছর আমাদের বিবাহবার্ষিকিতে উপহার দিয়েছিলাম তাকে। ভালোবেসে। এই আমার বিবাহিত পত্নী? আগ্নিসাক্ষী রেখে যাকে পাঁচ বছর আগে, জীবনসঙ্গী করেছিলাম, এই তো সে-ই? না কি আর কেউ?

ক’দিন ধরে, কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড। চারদিন আগে, ডিজিএম বললেন, কয়েকটা দিন কোথাও ঘুরে এস হে! একটু রেস্ট নাও। তারপর তোমাকে যেতে হবে চেন্নাই। পুরো একমাসের জন্য।

আমার কাজের ধরণটাই এরকম। বেশিরভাগ সময় ঘুরে বেড়াতে হয় বাইরে বাইরে। ঘরে থাকি মাসে সাত-আটদিন। মিলির অসুবিধে হয় জানি। কিন্তু পেটের দায় বলে একটা কথা যে আছে। বড় দায় সেটা। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিয়েছিল মিলি। এখন বুঝতে পারছি, মিলি আসলে মেনে নেয়নি। না হলে, অপরেশের সঙ্গে এই অবৈধ সম্পর্ক রচিত হয় কী করে? অপরেশ আমার বাল্যবন্ধু। মুহূর্তে, আমার ক্রোধ আছড়ে পড়ল অপরেশের উপর। সেই অপরেশ, যে আমার আপদে-বিপদে থাকে! বিবাহিত, দুটি সন্তানের জনক। পার্টির বিভাগীয় কমিটির কী একটা পদে আছে। জনগণকে নীতিশিক্ষা দেয়, স্বপ্ন দেখায়। মিলিকেও কি স্বপ্ন দেখিয়েছিল অপরেশ? কী স্বপ্ন?

আচ্ছা! জয়তী কি এটা জানে? জয়তী, মানে, অপরেশের বউ? জানে? অপরেশের এই সব কীর্তি? না কি, তাকেও আড়ালে রেখে এই কান্ড করেছে? জয়তী জানতে পারলে কি হবে? কি হতে পারে?

তুমি কিছু বলবে না? অদ্ভূত ঠান্ডা এক গলায় বলে ওঠল মিলি।

চমকে ওঠলাম। এরপরও, আমার মতামতো জানতে চাইছে মিলি? কি বলব তাকে? গালি দেব? তার টুটি চেপে ধরব? না কি৮, বলব, এসব কথা আর কাউকে বলতে যেও না। যা হবার হয়েছে, অ্যাবোর্শন করিয়ে ফেল। অথবা, ঠিক আছে, বাচ্চাটাকে মানুষ করব আমরা। কি বলব?

জান, এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চাইছে না অপরেশ। আর আমি ঠিক করেছি, অ্যাবোর্শন করাব না। অ্যাবসার্ড। এই প্রথম, হ্যাঁ, এই প্রথম, মা হবার সুযোগ পেয়েছি। এই সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নই আমি। মিলির গলায় কি সামান্য কান্না লেগে আছে? না কি এটা তার দৃঢ় মানসিকতার স্পর্শ? কোনো অপরাধবোধ নেই তার? অনুশোচনা?

২.

জমপুই থেকে ফিরে এসে, আর কথা হয়নি মিলির সঙ্গে। চলে যেতে হল চেন্নাই। একমাসের জন্য বলা হলেও, যে এসাইনমেন্ট নিয়ে আমার যাওয়া, তা শেষ করে ফেলি আঠারো দিনের মাথায়। আমিও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে। আসলে, সেখানে আমার রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুল লাইফের একজন ক্লাশমেটকে পেয়ে যাই। অভাবিতভাবে। রেড্ডি। রেড্ডিই এই এসাইনমেন্টের বিষয়ে সাহায্য করে বেশি।

ডিজিএম, ফোনে, জানালেন, ওয়েল ডান, মিস্টার চৌধুরী। গুড নিউজ। কোম্পানী আপনাকে একটা গিফ্‌ট দেবার কথা ভাবছে। তিনচার দিন ছুটি কাটাতে কোথাও চলে যেতে পারেন। ইচ্ছে করলে, সিঙ্গাপুরও চলে যেতে পারেন। আপনার অপরেশ এই এলাকায় মিলনচক্রের দিকে থাকে।

অপরেশের কথা মনে পড়তেই মনে পড়ল মিলির কথা। চেন্নাই, কাজের ফাঁকে, দু একবার মিলির কথা মনে পড়েনি, তা নয়। আগে রোজ দুতিনবার ফোন করতাম। খোঁজ নিতাম তার। এবার তা করলাম না। কেন? রাগে? মিলির ঐ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এই ক্রোধ? জমপুইয়ে, সেদিন আর তেমন কোনো কথা হয়নি। একবার, বিছানায় যাবার আগে, মিলি বলেছিল, তুমি, তাহলে, কিছুই বললে না?

লাইট অফ্‌ করতে গিয়ে, গলা নিচু করেই বললাম, দেখ, বিষয়টা, সন্দেহ নেই, গুরুতর। সিদ্ধান্ত নিতে হবে তোমাকেই। কেন না, তুমি চাইছ, বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে আনতে—

হ্যাঁ। আমি ওকে নিয়ে আসতে চাই। অপরেশ দায়িত্ব না নিক, তাতে কি, আমি একাই ওকে বড় করব।

তবে কি?

বাচ্চার একটা পরিচয় দরকার।

আমার পরিচয়ে সে বড় হবে। সে তার মায়ের সন্তান।

আমি নিঃশব্দে হেসে উঠলাম। সে হাসি বড় ম্লান। লুসাই মেয়েরা বিবাহের আগেও সন্তানের মা হয়ে যায়। পিতৃত্বের দায় যদি কেউ না নেয়, সমাজ নেয়। এক্ষেত্রে আমাদের সমাজ কতখানি মেনে নেবে মিলিকে?

অফিসের গাড়ি ছিল এয়ারপোর্টে। প্রথমে ভাবলাম, ঘরে যাই আগে। তারপর, ভাবলাম, না, অফিস হয়ে ঘরে যাব। ডিজিএম-এর সঙ্গে দেখা করে, কয়েকটা দিন ছুটি নেব। যদিও তিনি ঘুরে আসতে বলেছিলেন আমাকে।

দুর্গা চৌমুহনীতে এসে দেখলাম, জনসভা চলছে রাস্তা আটকে দিয়ে। এফডি আইয়ের বিরুদ্ধে জনসভা। এফডিআই কতখানি বিপজ্জনক, এখনও বোঝা যাচ্ছে না এটা। প্রতিবাদ করা আর রাস্তা আটকে জনসভা করা যে এক নয়, কে বোঝাবে? এই শহর রাজনীতির দাদাদের দ্বারা পীড়িত। মুখ বুজে সইতে হয় সবাইকে। কেউ কিছু বলে না। মানুষ, এখনও, এইসব নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়! অবাক হতে হয়, এসব দেখলে। শিক্ষাদীক্ষায় যারা এগিয়ে আছেন, তারাও, সামান্য স্বার্থের জন্য দাদাদের অনুগামী হয়, সেই সব দাদা, যারা তাদের চেয়েও অশিক্ষিত, বোধহীন। কবে যে মানুষ মুক্তি পাবে এই যাঁতাকল থেকে?

অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে হল না। ডিজিএম, আমাকে দেখে, বললেন, কয়েকটা দিন বিশ্রাম কর। তারপর তোমাকে হয় তো, দেশের বাইরে যেতে হতে পারে।

ঘরে এসে, দেখি, তালা দেওয়া। অর্থাৎ মিলি নেই ঘরে। দ্বিতীয় চাবি থাকে আমার সঙ্গে। ফলে, অসুবিধে হল না কোনো। ঘরে ঢুকে, প্রথমেই চান করে নিলাম। ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিল খুব। তারপর, নিজেই বানিয়ে নিলাম কফি। টিভি চালিয়ে দিয়ে, ড্রয়িং রুমে বসেছি, তখনই বেজে ওঠল কলিংবেল।

এই সময় কে আসতে পারে? মিলি? ওর কাছে তো চাবি রয়েছেই। তা হলে?

দরজা খুলে, দেখি, অপরেশ।

মুহূর্তে, পায়ের রক্ত চড়ে গেল মাথায়। এক নিমেষ। না কি, তারও কম? প্ল-বিপলের চেয়েও কম? ক্রোধ গিলে ফেললাম পরক্ষণেই। থুথু গেলার মতো। দতজা ছেড়ে দিয়ে ঘরে ঢুকতে দিলাম তাকে।

কখন এলে? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, অপরেশ বলে ওঠল।

তার কথার জবাব না দিয়ে, পালটা জিগ্যেস করলাম, তুমি কি মিলির কাছে এসেছিলে?

হ্যাঁ! সকালে ফোন করেছিল। খুব জরুরি দরকার বলল। আসতে পারিনি। পার্টির একটা গোপন মিটিং ছিল। আটকে গেছি। মিটিং থেকে বেরিয়ে, ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। ভাবলাম ঘরে আছে।

মিলি তো ঘরে নেই। ঠান্ডা মাথায় বললাম আমি।

ঠিক আছে। পরে আসব।

চলে যাচ্ছিল অপরেশ। পেছন থেকে বললাম, দাঁড়াও, অপরেশ। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার।

ফিরে এসে, অপরেশ বসল সোফায়।

ড্রিংক্স নেবে?

দাও। খুব নির্লিপ্ত গলায় বলল অপরেশ।

অপরেশের হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে, একটা চেয়ার টেনে বসালাম আমি। প্রথম চুমুক গলা পর্যন্ত নিয়ে, তাকে বললাম, মিলি বলছিল, তার পেটে যে বাচ্চাটা আসছে, সেটা তোমার। এটা কি ঠিক? অপরেশ?

ঢোক গিলে উঠতে পারেনি অপরেশ। তার আগেই, আমার এই প্রশ্ন, বোধহয়, তাকে হতচকিত করে তুলল। হেঁচকি এল তার নাকে-মুখে দিয়ে। কাশতে লাগল সে।

বি কুল, অপরেশ! রেগে যাওয়ার কথা আমার। আর তুমি খাচ্ছ ভিড়মি?

আমার ভেতরে কি জেগে উঠছে শয়তান? আমি এখন ঠান্ডা মাথায় খুন পর্যন্ত করতে পারি। অপরেশ বুঝতে পারছে, ফাঁদে পড়ে গেছে সে। এখন আর পরিত্রাণ নেই তার।

নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করল অপরেশ। ঘোড়ার মুখে পড়ে গেছে তার নৌকা আর গজ। কোনো রকমে গজ বলি দিয়ে সে এখন চেষ্টা করছে নৌকা বাঁচাবার। মিলি বলেছে? মিলি?

অবাক হচ্ছ? কী করে তোমাদের গোপন অ্যাফেয়ার্সের কথা প্রকাশ করল মিলি? এই ভাবছ?

আমি গ্লাস খালি করে নিলাম এক চুমুকে। দ্বিতীয়বার গ্লাস ভরে নিতে নিতে, বললাম, মিলিকে চিনতে সামান্য ভুল করেছ, অপরেশ! অন্য মহিলাদের থেকে একটু আলাদা সে। পার্সোনালিটি বলতে যা বোঝায়, সেটা তার আছে। অকপটে কনফেস করার ক্ষমতা তার আছে। তা, তোমার বাচ্চা যখন, তোমার জন্য ফেঁসে গেছে সে, এখন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছ কেন? না কি, দায়িত্ব নিতে গেলে, জয়তী, তোমার দুই বাচ্চা, পার্টির ইমেজ, সব হারাবে, এই ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছ?

কোনো জবাব দিল না অপরেশ। হাতের গ্লাস রয়ে গেছে হাতেই। মুখটা রক্তশূন্য রোগীর মতো।

অবশ্য, তোমাকে দোষ দিয়েই-বা কী করব? তোমাদের তো গাছেরও খাবো, তলারও কুড়োব নীতি। ক্ষমতায়ও থাকবে, বিপ্লবও করবে। ইমেজ তো রাখতেই হয়। না হলে চলবে কেন?

টিভিতে, দিল্লীর নিউজ। পার্লামেন্ট-এ বিজেপির সুষমা স্বরাজ কী যেন বলছে। হৈচৈ হচ্ছে খুব। টিভি বন্ধ করে দিলাম। পার্লামেন্ট মূলত শুয়োরের খামার, কে যেন বলেছিল! এমপিদের কান্ড কীর্তি দেখলে, ওই কথাটিই মনে পড়ে আমার।

বিশ্বাস কর, জহর, যা ভাবছ, ঘটনাটা সেরকম না। অপরেশ হঠাৎ বলে ওঠল। আসলে—

আত্মপক্ষ সমর্থণ করার চেষ্টা করছ কেন, অপরেশ? তুমি আমার বাল্যবন্ধু। অবশ্য এখন থেকে আর কখনও বন্ধু ভাবতে পারব না তোমাকে। অ্যাবসার্ড। মধ্যযুগীয় ক্রোধ আমার ভেতরে থাকলে খুন করে ফেলতাম তোমাকে। একটু আগেও ইচ্ছে হয়েছিল। খুন চেপেছিল মাথায়। তা, আমি তো আর তুমি না!

ঘরে এখন ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া কিছু নেই। ভয়ংকর এক স্তব্ধতা ঘরটাকে গুমোট করে তুলছে। আর এক গ্লাস ভরে নিলাম আমার জন্য। অপরেশ, দেখলাম, আর নিল না। সেই গ্লাস এখনও অর্ধেক হয়ে আছে। বললাম, মিলি অ্যাবোর্শন করবে না। ও যে বলে, তাই করে। কিন্তু তুমি সেই বাচ্চার বাবা হয়েও, দায়িত্ব নিতে মানছ না কেন?

এটা অ্যাবসার্ড জহর। পার্টি আমাকে সাসপেন্ড করবে। জয়তী—

আমার কি হল হঠাৎ। চিৎকার করে ওঠলাম। স্কাউন্ডেল! বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে। গেট আউট। একটা মহিলার সর্বনাশ করে এখন সাধু সাজতে চাইছ? দায়িত্ব নেবার মুরোদ নেই যখন ভোগ করতে গেছিলে কেন? যাও। আর কখনও যেন তোমার মুখ না দেখি!

কোনো কথা না বলে, অপরেশ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। তার দিকে ফিরেও তাকালাম না আমি। এখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। খোঁড়াচ্ছে কেন সে? যখন এল, খোঁড়াতে দেখিনি তাকে। তা হলে?


৩.

সন্ধ্যেবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, মাথাটা ধরে আছে প্রচণ্ড। ঘড়ির দিকে তাকালাম। নটা বাজে। মাই গড! এতক্ষণ ঘুমিয়েছি? টয়লেট থেকে, এসে, দেখলাম, মিলি এখনও আসেনি। এরকম তো করে না! ফোন করলাম, স্যুইচ অফ। অপরেশও বলছিল এই কথা। কোথায় গেল মিলি? চন্দ্রপুরে তার বাবা থাকেন। একা। সেখানে যায়নি তো? তাড়াতাড়ি, মিলির বাবাকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। নট রিচেবল। তার মানে?

কার কাছে জানতে চাইব মিলির কথা? বৃষ্টির কথা মনে পড়ল। মিলির বন্ধু। দু-একবার এই ঘরে এসেছিল। কিন্তু তার ফোন নম্বর? হতাশ হয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

চন্দ্রপুর, বাসস্ট্যান্ডের পেছনে, মিলির বাবার বাড়ি। জামতোলা বলে লোকে। বারান্দায়, একটা চেয়ারে বসে রয়েছেন তিনি। অনেকদিন দেখিনি। আজ দেখলাম, দীর্ঘকায় লোকটা শীর্ণ হয়ে গেছে। মিলির মা নেই। আমাদের বিয়ের পরেই মারা গেলেন। লাংস-ক্যানসার। খুব কষ্ট পেয়েছেন ভদ্রমহিলা। বাবাকে আমাদের সঙ্গে থাকতে বলেছিলাম। মিলিও চাইছিল খুব। তিনি থাকবেন না। মেয়ের বাড়িতে থাকলে না কি মান-সম্মান থাকে না। অথচ তিনি থাকলে অপরেশ এই কান্ড করার সুযোগ পেত না। সাহস হত না মিলিরও।

আমাকে দেখে, গ্রিলের দরজা খুলে দিলেন তিনি। এত রাতে? কিছু হয়েছে জহর? কোনো বিপদ? উৎকন্ঠিত গলা কেঁপে গেল যেন।

মিলি আসেনি, বাবা? কোনো ভনিতা না করে জিগ্যেস করলাম আমি।

মিলি? না তো! ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন আমার কথা শুনে।

আশ্চর্‍্য!

মিলি তা হলে গেল কোথায়? আমার চেন্নাই থেকে আসার খবর তার জানার কথা নয়। তা হলে কোনো বন্ধুর কাছে গেছে? অদিতিদের বাড়ি? অদিতিরা থাকে রামনগর আট-এ। সেখানেও যায়নি সে। সব কথা শুনে, অবাক হয়ে গেল অদিতি। বলল, মিলির দায়িত্বজ্ঞান খুব বেশি। ঘরে যান, গিয়ে দেখবেন, ফিরে এসেছে সে।

বৃষ্টিও তাই বলল। চারদিন আগে, এসবিআইর কাউন্টারে দেখা হয়েছিল। খুব বেশি কথা হয়নি তখন। টেনশনে ছিল কি এক কারণে। ভেবেছিল, দু-একদিন পর, মিলির সঙ্গে দেখা করবে, গিয়ে।


রাতে, এই প্রথম, একা থাকতে হল ঘরে। খেতে ইচ্ছে করছিল না। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম বিছানায়। মিলি আসেনি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। ঘুমের ভেতর, দেখলাম, একটা থানার লক-আপ। আলোয় সাজানো হয়েছে সেই লক-আপ। শুধু লক-আপ নয়, পুরো এলাকাতেই আলোর রোশনাই। সেখান থেকে, দুজন সান্ত্রী নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ভেতরে। আরও একটা ঘরে। ঘরটায় কেউ নেই। একটা বালভ ঝুলছে মাঝখানে। কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধু মাঝখানে একটা হাতলহীন চেয়ার। পাশে কয়েক বোতল জল।

ঐ ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দিল সান্ত্রীরা। কিছুক্ষণ পরে, তিন-চারজন পুলিশ এলো। ওসি সহ একজন এস আইও এলেন সঙ্গে। ওসি বসলেন চেয়ারে। বাঁ-হাতে বেতের একটা পালিশ লাঠি। এস আই আমাকে জিগ্যেস করলেন, আপনিই তবে জহর চৌধুরী?

আমি মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ।

আপনি, শুনেছি, একটা ভালো কোম্পানির এগজিকিউটিভ। মান-সম্মানও আছে আপনার। টাকাকড়ির অভাব নেই সে অর্থে। তাহলে, কেন, আপনি আপনার স্ত্রী মিলি চৌধুরীকে খুন করলেন? কেন?

চুপ করে রইলাম আমি।

শুনুন, আপনি যদি কো-অপারেশন করেন, তাহলে, থার্ড ডিগ্রির কোনো প্রয়োজন হবে না। আর যদি আমাদের সহযোগিতা না করেন—

উলটো দিক থেকে, মানে, ওসি বলে ওঠলেন, মশাই, বলে ফেলুন। আপনার সকল গতিবিধি আমাদের জানা। আমরা শুধু আপনার মুখ থেকে একবার শুনতে চাই।

বলুন—

অ্যাই লিটন, ভদ্রলোকের প্যান্টের জিপটা নামিয়ে দে। বুঝতে পারছি, পেনিসে সিগারেটের ছ্যাঁকা না দিলে মুখ খুলবে না!


বলে কি! এই তাহলে থার্ড ডিগ্রি? আমার সারা শরীর কেঁপে ওঠল। মিলিকে আমি জমপুই থেকে ফেরার পথে, মনপুইয়ের কাছে একটা উঁচু জায়গা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। লজ থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম সকালেই। যাতে লজের কোনো লোক কিছু বুঝতে না পারে। কমলা বাগান দেখাবার নাম করে, মনপুইয়ের আগে, গাড়ি থেকে নেমে, একটা নির্জন স্থানে তার টুটি চেপে ধরি। শাঃলী! আমাকে ঠকাবে। আড়ালে আড়ালে আমার বন্ধুর সঙ্গে ফস্টিনস্টি? ছটফট করতে করতে, একসময়, নিথর হয়ে গেল মিলি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, না কোন শ্বাস পড়ছে না। তার মানে, মৃত সে। দেরি না করে, তার মৃতদেহ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। গড়াতে গড়াতে, দেখলাম, অনেক নিচে চলে গেল। সহসা আর কেউ দেখবে না উপর থেকে। তার আগেই শিয়াল-কুকুরে খেয়ে ফেলবে।

আমার মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। মিলির মুখে, ঐ কথা শোনার পর, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো টগবগ করছিল আমার ক্রোধ। এখন শান্ত। শিস দিতে দিতে, গাড়ি চালিয়ে, চলে আসি কাঞ্চনপুর। সেখান থেকে সোজা আগরতলা। তারপর, অফিসের কাজে চেন্নাই।

এত নিখুঁত প্ল্যানিং করেও ধরা পড়ে গেলাম আমি?

এস আই, হঠাৎ, হ্যাঁ, হঠাৎই, বলা নেই কওয়া নেই, হো হো করে হাসতে লাগল। সেই হাসি, ঐ নির্জন সেল পার হয়ে, টুকরো টুকরো হয়ে, ছড়িয়ে পড়তে লাগল চরাচরে। আর আমি কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মনে হল, আমার শরীর ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে, বিন্দু হয়ে যাচ্ছি না তো? মিলিয়ে যাচ্ছি না তো ঐ হাসির মতো?

ঐ সময়, ঐ আধো ঘুমের ভেতর মনে হল, কলিংবেল বাজছে। মুহূর্তে, থানার লক-আপ গেল মিলিয়ে। না, সত্যিই বাজছে কলিং বেল। আর আমি, লক-আপ নয়, বিছানায় আছি শুয়ে। তাড়াতাড়ি, উঠে গিয়ে, দরজা খুলে দিই। সামনে মিলি। সকাল হয়ে গেছে অনেক আগেই।

মিলিকে, মনে হল, অচেনা কোনো নারী। নারী নয়, এই মুহূর্তে, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কেউ। যুগ যুগ আগে, যে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছিল তার মনোজগতের স্বর্গ। বলল, চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

ভেতরে ঢুকে, কাঁধের ব্যাগ রেখে দিল সোফায়। তারপর, বসতে বসতে বল, কবে এসেছ ফিরে?

কোনো কথা না বলে, মিলির দিকে তাকিয়ে রইলাম অপলক। আমার ভেতরে ক্রমশ জেগে ওঠছে এক শয়তান, প্রবল হয়ে ওঠছে সে। একটু আগে, স্বপ্নে, খুন করেছিলাম মিলিকে। স্বপ্ন সত্যি নয়, তা বলে, এখন কি খুন করতে পারি না? কেউ জানতে পারবে না। সবাই জানে, কাল রাতে খুঁজে বেড়িয়েছি মিলিকে। তার বাবাও সাক্ষ্য দেবেন নিশ্চয়।

চুপচাপ তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তখনই, মিলি বলে ওঠল, এ শহর ছেড়ে চলে যাব আমি। একটা চাকরিও জুটিয়ে নিলাম। যা পাব, তাতে চলে যাবে। বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসতে কোনো অসুবিধে হবে না আর।

আর এগিয়ে যেতে পারলাম না মিলির দিকে। উলটো দিকের সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লাম। চারদিক থেকে, সহসা, আশ্চর্‍্য এক শূন্যতা চেপে ধরল আমাকে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেন। দৃষ্টি হয়ে আসছে ঝাপসা। চশমার কাচ কি ঘোলাটে হয়ে গেল? কি করব এখন? ঠাহর করতে না পেরে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠলাম, চলে যাবে?

মিলি কি শুনতে পেল? আমি জানি না। শুধু লক্ষ্য করলাম, মিলির সামনে, আমি ক্রমশ, টুকরো টুকরো হয়ে, ভেঙে, আছড়ে পড়ছি। যেন কেউ আমার অস্থি-মাংস-মজ্জা আলাদা আলাদা করে নিয়ে ছড়িয়ে ফেলছে মিলির পায়ের নিচে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মিলির। সে তখন গুন গুন করে গাইছে, তুমি আপনে কর পার... আমি চাহি না নিস্তার...

সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ

উইলিয়াম ব্লেইক-এর কবিতা


উইলিয়াম ব্লেইক (William Blake, ১৭৫৭-১৮২৭)
অঙ্কন: Thomas Phillips, ১৮০৭

অনুবাদ: সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ


উপক্রম


বাজাচ্ছিলাম বাঁশি যখন সুখের সুরে,
বাজাচ্ছিলাম বাঁশি যখন উপত্যকায়,
একটা মেঘে দেখতে পেলাম এক শিশুরে,
মোহন হাসি হেসে শিশু বলল আমায়:

“মেষশিশুকে নিয়ে গান-এক শুনিয়ে দাও!”
সুখের সুরে বাঁশিতে গান উঠল বেজে।
“বাঁশিওয়ালা, গানটি তুমি আবার বাজাও!”
তাই বাজালাম, কিন্তু শুনে কাঁদল সে যে!

“দাও, ফেলে দাও আনন্দিত বাঁশি তোমার,
গানখানি গাও গলা ছেড়ে, সুখের সুরে!”
গাইলাম তাই ঐ গানটাই ফের একবার,
সুখের সুরে ফের কাঁদালাম ঐ শিশুরে।

“বাঁশিওয়ালা, ব’সো এবার, লেখো এ-গান
পুথির পাতায়, সবাই যেন পড়তে পারে।”
বলতে-বলতে করল শিশু অন্তর্ধান–
হানা দিলাম খাগড়া-বনে, নদীর পাড়ে,

খাগড়া দিয়ে বানাই একটা গ্রাম্য কলম,
স্বচ্ছ জলে আলতা গুলে বানাই কালি;
গান লিখে যাই, আনন্দিত, আর মনোরম,
শুনে সকল শিশু বাজায় করতালি।


রাখাল

কী সুন্দর রাখালের ঐ মেষপাল!
তাদের চরায় সে যে সকাল-বিকাল।
পালের পিছনে ছুটে কোনো ক্লান্তি নাই,
গলায় মধুর গানে শুধু প্রশংসা-ই–

কারণ, সে শোনে, মেষশাবকের ডাকে
সজীব জবাব দেয় সুখী মাতা-মেষ;
পালক সতর্ক, তাই পাল সুখে থাকে,–
রাখাল কাছেই আছে–জানে তারা বেশ।


মুখর শ্যামলিমা

ভোরের সূর্য উঠল,
আকাশে পুলক ফুটল,
ঘণ্টার টংটং
বসন্ত স্বাগতং,
দোয়েল কোয়েল সব
পাখি করে কলরব,
মেলায় মুহুর্মুহু
ঘণ্টার টং-এ কুহু,
আমরা মাতি খেলায়
মুখর শ্যামলিমায়।

হাসে বুড়ো হরিদাস,
মাথা-ভরা সাদা কাশ,
পিঁপুল-গাছের তলে
বুড়োর আড্ডা চলে,
আমাদের দেখে হাসে,
কত ছবি মনে আসে,
তারাও তো শৈশবে
এম্নি মেতেছে সবে
সারাটা-দিন খেলায়
মুখর শ্যামলিমায়।

আমরা শ্রান্ত হই,
ক’মে আসে হৈচৈ,
সূর্য অস্তে নামে,
আমাদেরও খেলা থামে,
মায়ের কোলের কোণ
খোঁজে সব ভাই-বোন,
পাখি যথা যায় ফিরে
তন্দ্রা-আঢুল নীড়ে:
আয় ঘুম, ঘুম আয়,
তিমির শ্যামলিমায়।


মেষশাবক

মেষশিশু, শোন্ প্রশ্ন এ,
বল্ তো, তোকে গড়ল কে?
আহার দিল, বিহার দিল,
গোচর-ঘাসে, র্ঝনা-পাশে;
কাপড় দিল পশমি নরম
আরামদায়ক, সফেদ, গরম;
গলায় দিল কোমল সু-স্বর,
অধিত্যকায় তুলিস লহর–
মেষশিশু, শোন্ প্রশ্ন এ,
বল্ তো, তোকে গড়ল কে?

দিচ্ছি আমি এর উত্তর,
শোন্ রে কে যে স্রষ্টা তোর:
মেষশিশু কয় সবাই তাকে,
নিজ-কে নিজে এ-ই সে ডাকে–
সেও তো নম্র, নরমসরম,
পলকা, ছোট্ট, সেও আজনম;
মানুষ, মেষের আমরা শাবক,
তার নামে নাম আমরা পাবো।
মেষশিশু, পা’স্ প্রভুর আশিস্!
মেষশিশু, পা’স্ প্রভুর আশিস্!


কুঁড়ি

চলচঞ্চল চড়–ই ওরে,
ঘনসবুজ পাতার মেঘে
সুখী কুঁড়ি-এক দেখছে তোরে,
তুইছুটিস তিরের বেগে–
দ্যাখ্, তোর বাসা আছে
আমার বুকের কাছে।

চারু চিতলোল বাবুই ওরে,
ঘন-সবুজ পাতার ভিড়ে
সুখী কুঁড়ি-এক শুনছে তো রে
তুইকাঁদছিস ফিরে-ফিরে–
বাবুই, বাবুই, আছে!
আমার বুকের কাছে।


চিম্‌নি-ঝাড়ুদার

যখন আমি এতটুকুন, মা যে গেল ম’রে,
কথাও ভালো ফোটে নি, বাপ দিল বিক্রি ক’রে,
কাঁদতেও খুব পারি নি যে ওঁয়া ওঁয়া ওঁয়া–
তাই তো তোমার চিম্নি ঝাড়ি, তাই তো ছাইয়ে শো’য়া।

ঐ তো ছোট্ট লাভলু মিয়া, চেঁচাচ্ছিল খুব
ন্যাড়া হবার সময়–আমি বলি তাকে, “চুপ!
লাভলু বোকা, মাথায় যদি না-থাকে তোর চুল,
চুলে জটা হবে না আর লাগলে কালি-ঝুল।”

এই শুনে সে শান্ত হ’ল। সেই সে রাতেই, যখন
ঘুমে অচৈতন্য, লাভলু দেখতে পেল স্বপন:
আবুল ভুলু মণ্টু–হাজার চিম্‌নি ঝাড়ুদার,
বন্দি সবাই কালো-কালো কফিনে যে যার;

ফেরেস্তা এক এলো একটা দিব্য চাবি-হাতে,
খুলল কফিন–সবাই মুক্তি পেলো। সাথে-সাথে
নেচে, হেসে সবুজ মাঠে খেলল ঘুরে-ঘুরে,
গোসল করল নদীতে, গা শুকাল রোদ্দুরে–

ন্যাংটা এবং ফর্সা–সবাই ঝুড়িটুরি ফেলে
চড়ল মেঘে, খেলল তারা বাতাসে গা মেলে;
লাভলুকে কয় ফেরেস্তা, “তুই হ’লে ভালো ছেলে,
বিভু হবে বাবা রে তোর, যাবে না সে ফেলে।”

ঘুম ভাঙে ওর, আমরাও সব ভোর না-হ’তেই উঠি,
ঝুড়ি নিয়ে, ঝাড়ু নিয়ে, কাজের জন্য ছুটি;
ঠাণ্ডা সকাল, লাভলু তবু গরম আছে সুখে–
ফুর্তিতে কাজ করো যদি, শীত লাগে না বুকে।


হারিয়ে-যাওয়া ছেলে

“ও বাপি! বাপি! তুমি যাচ্ছ কোথায়?
হাঁটতে পারি না যে অমোন জোরে!
আমার সাথে তুমি কথা কও, বাপি,
হারিয়ে যাব তবে পিছনে প’ড়ে!”

অন্ধকার রাত, বাবা কাছে নেই,
ছেলেটা ভিজে গেছে শিশিরে, জলে,
কাদায়-ভরা পথে কাঁদল বেচারা,
কুহেলি উড়ে কই যায় যে চ’লে–


ফিরে-পাওয়া ছেলে

হারিয়েছিল পথ বিজন জলায়
ছেলেটা–ঘুরে-ফিরে আলেয়া-ধাঁধায়
কেঁদেছে–তারপর এসেছে ঈশ্বর
বাবার মতো সেজে, ধবল জামায়;

খেয়েছে চুমু সেই শিশুর মুখে,
নিয়েছে মা’র কাছে হাতটি ধ’রে–
ছেলেকে খুঁজে-খুঁজে, গভীর দুখে
পাণ্ডু হ’য়ে যে-মা রয়েছে প’ড়ে।


হাসির গান

হাসছে যখন সবুজ বনটা খুশিতে ডগমগ,
গালে-ঢেউয়ের-টোল–নদীটা হাসিতে ঝকমক,
আমাদের এই মজায়, দমকা রোল ওঠে বাতাসে,
সেই শব্দে, পাহাড় মুখে রুমাল দিয়ে হাসে,

যখন খুশি মাঠটি দেখায় সবুজ দাঁতের পাটি,
সেই ছবিটার মধ্যে যখন হাসে ঘাসপোকাটি,
হাসে মৌরি, হাসে সুজন, হাসে জোনাকি,
চাঁদের মতো গোল-মুখে সব হি হি হা হা হি

বাতির ছায়াটিতে যখন ছবির পাখি হাসে,
মাদুর-ভরা জাম, বাদামের, লিচুর হাসি আসে,
এসো, আমার পাশে ব’সো, প্রাণ জাগিয়ে দি
মধুর হাসির ঐকতানে হি হি হা হা হি


দোলনার গান

মধুর স্বপন, ছায়াটি দিয়ো রে
এই সুন্দর শিশুর শিয়রে,
পুলকনদীর মদির স্বপন,
আমুদে, নীরব, জোছনা-মগন।

নরম, গরম, সুমধুর ঘুম,
আমার সোনার চোখে দাও চুম,
ঘুমের পরি-রা, এই শিশুকে
দোলাও, দোলাও কোমল বুকে!

মধুর হাসি-রা, যাও ঘুরে-ফিরে
আমার সুখের ঠোঁটে, রাত্তিরে।
সুমধুর হাসি জননীর মুখে
সমস্ত রাত ভ’রে দিক সুখে।

অফুট কাঁদন, ঘুঘুর শ্বাস,
না-টানুক তোর ঘুমের রাস,
মধুর কাঁদুনি, মৌ-মৌ হাসি
সারারাতভর বাজাক সে বাঁশি।

ঘুমাও ঘুমাও তুষ্ট শিশুটি,
সকলের চোখ এখন নিদুটি,
পুলকিত ঘুম ঘুমাও ঘুমাও,
মা যখন কাঁদে, তুমি ঘুম যাও!

কচি-মুখে তোর, অ মোর সোনা লো,
দেখি যেন, আহা, স্বর্গের আলো;
তোমার স্রষ্টা একদা ঝুঁকে
আমার মুখেও–কেঁদেছে সুখে।

তোমার, আমার, সবার তরেই
কেঁদেছে–যখন শিশু সে নিজেই;
তার সোনামুখ–জানিস খোকন,
তোর মুখে হেসে উঠছে এখন?

তোমার, আমার, সবারই মুখে
হাসি-মুখে দেখি ঐ শিশুকে!
শিশুর হাসিই তার হাসি, হায়–
স্বর্গ-পৃথিবী সুখে ঘুম যায়।


ঐশী স্বরূপ

করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
কষ্টকালে ডাকে সবাই এদের,
ধন্যবাদ দেয় এদেরই কেবল
ঝঞ্ঝা থেমে গেলে বিপদাপদের।

করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
বিধাতা–যে সবার পিতার মতন;
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
মানুষ–শিশু তার, পরম যতন।

কারণ দয়া মানবাত্মারূপিণী,
করুণা মানুষের মুখেই সে হাসে,
ঐশীরূপ ভালোবাসা মানুষের,
শান্তি থাকে তার গায়ের লেবাসে।

কাজেই সঙ্কটে মানুষেরা সব
সর্বদেশে আর সর্বাঞ্চলে
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
ঐশীরূপে ডাকে এদের সকলে।

মানুষমাত্রেই সমপূজনীয়,
তুর্কি, য়িহুদি, বা নাস্তিক ঘোর–
করুণা দয়া ভালোবাসা ও শান্তি
-আকারে বিভু থাকে মানুষে বিভোর।


পুণ্য বৃহস্পতিবার

পুণ্য বৃহস্পতিবারে বাচ্চাগুলি অমল-আনন
নীল লাল আর সবুজ জামায় হেঁটে যাচ্ছে দু’জন-দু’জন
আগে-আগে পুরুত সচল, যষ্টি-হাতে তুষারধবল
ঢুকল সবাই সাধু পলের গির্জায় টেম্‌স নদীর মতন

আহা কী জনতা এটা লন্ডনের এই কুসুমনিচয়
বসেছে সব দলে-দলে স্বীয় প্রভায় প্রতিভাময়
গুঞ্জনশীল এই জনতা এই জনতা মেষের জাত
হাজার-হাজার ছেলেমেয়ে তুলছে তাদের পুণ্য হাত

প্রবল ঝ’ড়ো হাওয়ায় যেন মেলল তারা সুরের পাল
স্বর্গ-গাঙে কিংবা যেন সুসংহত বজ্রমাল
নীচে দীনের অভিভাবক প্রৌঢ় ভাঁজে করুণা-সুর
নইলে দুয়ার থেকে কোনো হুর খেদাবার ঝুঁকি প্রচুর


ধাত্রীর গান

যখন বাছাদের মুখর আমোদের
প্রতিধ্বনি শুনি পাহাড়ে
আমার সুখী বুকে হৃদয় থাকে সুখে,
নিখিল-নিশ্চল, আহা রে!

বাছারা ফিরে আয়, সুজ্জি ডুবে যায়,
শিশিরে ভ’রে ওঠে মেঠো ঘাস;
আজ না খেলা আর, সময় ঘুমাবার,
না-রাঙে যতখন পুবাকাশ।

ধাই মা, তুমি ভালো, দ্যাখো-না, আছে আলো,
এখুনি যায় নাকি ঘুমোনো?
একটু খেলা বাকি, আকাশে ওড়ে পাখি,
ভেড়ারা মাঠে চরে এখনও।

ঠিকাছে, র্ক খেলা যাবৎ আছে বেলা,
আসবি পরে সোজা বিছানায়–
শুনেই, কোলাহলে দস্যিগুলি তোলে
পাহাড়ে রুনুরুনু পুনরায়।


শিশু খুশি


“আমার কোনো নাম তো নেই,
দু’দিন বয়েস মোটে–”
কী নাম ধ’রে ডাকব তোরে তবে?
“খুশি আমি সবতাতেই,
নামটি খুশি-ই হবে।”
খুশি রে, তোর খুশি-ই যেন জোটে!

ছোট্ট খুশি, মিষ্টি খুশি,
ছোট্ট খুশি, দু’দিন বয়েস মোটে–
ছোট্ট খুশি, ডাকি তোরে,
মিটমিটিয়ে হাসিস, ওরে,
আমিও গাই আদর ক’রে:
খুশি রে, তোর খুশি-ই যেন জোটে!


স্বপ্ন

একদা স্বপন এক ফেলেছিল ছায়
দেবদূত-সুরক্ষিত আমার শয্যায়:
ঘাসে শুয়ে থেকে, আমি দেখি যেন চেয়ে,
পথ হারিয়েছে এক পিপীলিকা-মেয়ে।

বিক্ষিপ্ত, সন্ত্রস্ত, ব্যস্ত দেখি আমি তারে,
হেঁটে-হেঁটে ক্লান্ত, শ্রান্ত, অন্ধ অন্ধকারে,
ধস্তাধস্তি ক’রে-ক’রে পানিতে কাদায়
বুক-ফাটা আর্তনাদে বলল সে হায়:

“হা আমার খোকা-খুকু! কেঁদে বুঝি সারা,
বাপের ছটফটানি দেখে দিশাহারা,
বাইরে তাকায় শুধু ছোট্ট মাথা তুলে,
কাঁদে আর কাঁদে শুধু, খাওয়া-শো’য়া ভুলে!”

কথা শুনে আমি কেঁদে ফেলি করুণায়:
একটা জোনাকি এলো, এসেই শুধায়,
“রাতের প্রহরী আমি এই মধুবনে,
কে কাঁদো গো, কেন কাঁদো, কোন্ ব্যথা মনে?

“পথ হারিয়েছ, বাছা? খুঁজে দিতে হবে?
আলো জ্বেলে রাখলাম। ওঠো, মেয়ে, তবে।
গুবরেটা রোঁদ দেবে, সব ওর চেনা,
ওর সাথে চ’লে যাও, বিপদ্ হবে না।”

মুরারি সিংহ

যা-ইচ্ছা কবিতাগুচ্ছ


মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে সব চেনা হিসেবনিকেশ বদলে ফেলি। ইচ্ছে করে বাক্যের চেনা বিন্যাসকে ভেঙে ফেলে শব্দগুলোকে খানিক ছুটি করে দিই। কথার পাতায় স্বাধীনতা নামুক। শব্দরা ইচ্ছে মতো খুনসুটি করুক, ঝগড়া-মারামারি-ভাব-ভালোবাসা করুক। তারা শুয়ে থাকুক যার সঙ্গে যে খুশি, যার পাশে খুশি রাত কাটাক কথারা।



বুঁদ বলছে পিকনিক পাতা আঁচলে মুখোমুখি মেঘেরা আবার
ঘুম করে একটানা বেহুঁশ ভালোবাসা কাঁপা কাঁপা রোদে পালিত
বিস্তর সাজিয়ে পানপাত্র শাড়িতে নিষিদ্ধ ফুচকা ও আইসক্রিম
পছন্দ গুছিয়ে এঁকেবেঁকে পাশাপাশি তিলতিল প্রদাহ ফাটছে লিপস্টিক
নদীতীর কতবার ডাকাডাকি আর্তনাদ হাতেগোনা শরীরের


বাজছে আয়োজন মশারির পাঁঠাবলিতে আলতাপাড় গহ্বরে
তাপমাত্রা হৃদয় হেঁচকি কেমন ছত্রাক কতটা ধাঁধাঁ কতটা
তর্ক ও মোমের নষ্ট গাছে উল্লাস কাঁচা নজর নিঃস্ব দুকলি
আকরিক মাছের বাজার মাঠঘাট রোজ রোজ উদাত্ত আলপনা
ঘামেভেজা বিক্রিবাটা পাশফিরে জীবনকে ঢেউ যা ইচ্ছা উষ্ণতায়


তামসিক ছোটোমাসি ভাসছে কথাবার্তা ঘুটঘুটে ঘাসের চৌহদ্দি
এঁটোপাতা ছিমছাম হিমচম্পা নির্বান্ধব ছাপাখানা আরশোলা ইঁদুর
টিকটিকি একা একা নিরাময় হাঁটে তরতরিয়ে অধিকার নীলবিষে
কথাগুলো ভাসছে নিভছে উন্মাদ অসুখের সাময়িকী বেশ প্রতিদিনের
অপেক্ষায় সহজাত অভিমানে মুদ্রিত পাখি সাহস ডিঙোতে নষ্টই

অলংকরণ – মেঘ অদিতি

সুবীর বোস

সঞ্জীবনী


বেশ ছোটোবেলা থেকে অদিতি সময়-সুযোগ পেলেই ন্যাশনাল জিওগ্রাফি আর ডিসকভারি চ্যানেল খুব মনযোগ দিয়ে দেখে। ওই চ্যানেলগুলোর দৌলতেই অদিতি চেনা-অচেনা বহু জীব-জন্তুর আদব-কায়দা, স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে অনেকটাই ওয়াকিবহাল হতে পেরেছে। অন্যদিকে এইসব খবরাখবর রাখার সঙ্গে সঙ্গে বছর দুয়েক হলো অদিতি আরও একটা অভ্যাস রপ্ত করে ফেলেছে। নামকরণ। মানে অদিতি তার পরিচিত লোকজনদের ব্যবহারে বা আদব কায়দায় যদি কোনো জীব-জন্তুর ছায়া দেখতে পায়, সঙ্গে সঙ্গেই সে ব্যক্তির নতুন নামকরণ এ ক্ষেত্রে অনিবার্য। এমন নয় যে অদিতি রোজই একেক জনের একেকটা নামকরণ করছে। এ ক্ষেত্রে বরং উল্টোটাই ঘটেছে। গত কয়েক বছরে মাত্র কিছু হাতে গোনা ব্যক্তি অদিতির এই “নাম”এর তালিকায় প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে।

হ্যাঁ, এই নামকরণের তালিকা থেকে অদিতি নিজেকেও বাদ রাখেনি এবং অবস্থা অনুযায়ী নিজের নামটা সে বেশ ঘন ঘন বদল করেছে। এই যেমন যখন সে ঠাকুমার আচার চুরি করে ছোটো ভাইকে এড়িয়ে চিলেকোঠায় চলে যায়, তার নিজেকে মনে হয় লেপার্ড, যে অন্যদের হাত থেকে নিজের খাবারকে নিরাপদে গাছের মাথায় সরিয়ে নিয়ে গেল। আবার পরীক্ষায় কম নাম্বার পেয়ে নিজের রিপোর্ট কার্ডটা বাবাকে দেখানোর আগে যখন তার ইচ্ছে হয় বাবাকে একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের চকোলেট খাওয়ানোর, যাতে বাবা খাতা দেখায় একটু অমনোযোগী হয়ে পড়ে, তখন সে মনে মনে কাঠবেড়ালি, যে সাপকে ধোঁকা দেবার জন্য নিজের লেজটা বার বার এগিয়ে দিতে চায় সাপের দিকে। একবার তো সে নিজেকে কিছুদিন সিংহী হিসেবেও ভাবা শুরু করেছিল। সে অবশ্য অন্য কাহিনি!

অদিতির এই “নাম” এর তালিকায় প্রথম প্রবেশ করার যোগ্যতা অর্জন করেন জনৈক রিক্সাওয়ালা। অদিতি তখন ফার্স্ট ইয়ার। এক সকালে অদিতি খবর পেল যে তার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু মিলি খাট থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে তার হাতটি ভেঙেছেন। ব্যস, মিলির হাত ভাঙার খবরটা পেয়েই পাড়ায় মোটামুটি ডানপিটে বলে পরিচিত অদিতি তক্ষুণি পরিচিত এক রিক্সাওয়ালা কাকুর রিক্সায় চাপিয়ে মিলিকে নিয়ে চলল গোপাল ডাক্তারের কাছে।

ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পথেই অদিতির রিক্সাওয়ালাকাকু মিলির হাত ভাঙার কারণ শুনে খুব গম্ভীরভাবে বলল, এই জন্যেই আমাদের মাটির বাড়িই ভালো।

কথাটার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে না পেরে অদিতি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, কেন, মাটির বাড়ি ভালো কেন কাকু?

- সেটা বুঝতে পারলে না অ’দি?

এই রিক্সাওয়ালাকে প্রায়ই অদিতিকে নিয়ে এখানে-সেখানে যেতে হয় এবং সে আদর করেই হোক বা সুবিধার জন্যেই হোক - অদিতিকে ডাকে অ’দি। অদিতির ধারণা “অদিতিদি” জাতীয় জটিল উচ্চারণ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই এই ব্যবস্থা। তো “অ’দি” খুব করুণ মুখে বলল,

- না, বুঝতে পারিনি কাকু। তুমি বুঝিয়ে দাও।

- কী জানো তো অ’দি, মাটির বাড়ি মানে তো মেঝেও মাটির। মাটির মেঝে খুব নরম হয় তো। তাই আমার মনে হয় মাটির মেঝে হলে মিলিদির হাতটা ভাঙত না। রিক্সাওয়ালা নিদান দেয়।

রিক্সাওয়ালার নিদান শুনে এমনকি মিলিও ওই অত কষ্টের মধ্যে হেসে ফেলে। অন্যদিকে অদিতি আর কাল বিলম্ব না করে রিক্সাওয়ালার একটা নামকরণ করে। এই প্রথম। সে রিক্সাওয়ালার নাম রাখে জিরাফ।

এ ক্ষেত্রে রিক্সাওয়ালা তার সীটে বসে অনেকটা উচ্চতা পেয়ে গেছিল বলেই শুধু নয়, রিক্সাওয়ালার এই “প্রথমে শোনায়, পরে ভাবায়” পর্যবেক্ষণটাও অদিতির মনে ধরেছিল খুব। অদিতি জানে যে, এমনিতে নিরীহ কিন্তু উচ্চতার কারণে বিপদের আঁচ আগেভাগেই পেয়ে ঠিকঠাক প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে জিরাফের। আর সে জন্যেই অন্যান্য অনেক তৃণভোজী প্রাণী জিরাফের কাছাকাছি থাকতে নিরাপদ বোধ করে। কারণ তারা জানে যে, উচ্চতার কারণে অনেকটা দূর থেকে জিরাফ বিপদের গন্ধ আগেভাগেই পেয়ে যাবে আর নিজে সাবধান হবার সময়ে অন্যদের কাছেও সেই বার্তা পৌঁছে দিয়ে যাবে। রিক্সাওয়ালার সরল নিদানের আড়ালে অদিতি সেদিন যেন সেই বার্তারই আগাম আভাস পাওয়া শুরু করেছিল। তার মনে হচ্ছিল, সামনে আরও কিছু সমস্যা আছে যেটা সে বা মিলি বুঝতে পারছে না। তবু অদিতি ভয় পেল না। তার কেন জানি না মনে হলো, তার সঙ্গে আছে এক আন্তরিক অভিভাবক, যে তাদের বিপদে পাশে থেকে লড়বে।

এ সব ভাবত ভাবতেই আরেকটু হলেই আবেগে টলমলো অদিতি রিক্সাওয়ালাকে প্রায় “জিরাফকাকু” ডেকে ফেলেছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার “নতুন অভিভাবকক”কে বলে, কাকু, ভাবছি, মিলিকে গোপাল ডাক্তারের কাছে না নিয়ে ডাঃ নিখিল ব্যানার্জীর কাছে নিয়ে যাব। তুমি কি বলো?

অদিতি এই প্রশ্নটা আসলে জিরাফকে করেছিল, যে তার উচ্চতার জন্য অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। দেখা গেল অদিতি ভুল ভাবেনি। রিক্সাওয়ালা একটু ভেবে জানাল, ও হো, আজ তো বুধবার। মানে আজ গোপাল ডাক্তারের ছুটি। অ’দি, হ্যাঁ, তার চেয়ে চল আমরা নিখিল ডাক্তারের কাছেই যাই।

রিক্সাওয়ালার উত্তর শুনে আরও নিশ্চিন্ত অদিতি বুঝতে পারল যে, সে সঠিক লোকের সঠিক নামকরণ করেছে। তার মনে হলো, অনেকটা ঘাড় তুলে তার “জিরাফকাকু” আশপাশটা ভালো করে বুঝে নিয়ে তাকে এবং মিলিকে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেবে, দেবেই। তারপর সে হেসে বলল, হ্যাঁ, কাকু, তাই চল।

সেদিন সত্যিই অদিতির “জিরাফকাকু” সমস্ত সময়টা ওদের সঙ্গে থেকে মিলিকে ডাক্তার দেখিয়ে, এক্স রে করিয়ে, হাতে প্লাস্টার করিয়ে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে দিয়ে মিলি এবং অদিতিকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর ছুটি নিয়েছিল। মাঝের ঘটনা বলতে কম্পাউন্ডারকে জিরাফকাকুর হালকা ধমক “অত জোরে প্লাস্টার” করার জন্য আর ওষুধের দোকানদারকে বিড়বিড় করে গালমন্দ “বেশি দাম নেবার” জন্য।

সেদিন বাড়ি ফেরার পর অদিতির কেন জানি না মনে হয়েছিল ডাঃ নিখিল ব্যানার্জী যদি এক্স রে না করিয়েই মিলির হাতে ঠিক জায়গায় প্লাস্টার করে দিতে পারতেন তো তাঁর নাম দেওয়া যেত জ্ঞানী প্যাঁচা।

সেই অদিতি এখন ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স। গত দু’ বছরে আরমাত্র একজন অদিতির কাছ থেকে ওই “বিশেষ নাম” পাবার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেটা ওর নিজের ছোটো ভাই সন্তু। অদিতি দেখেছে, সন্তু খুব নিরীহ মুখ করে কখনো পাকা আম, কখনো পাটালি গুড়, কখনো কনডেন্সড মিল্কের কৌটো নিয়ে সোজা খাটের নিচে ঢুকে নিশ্চিন্তে সে গুলো সাবাড় করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দোষ পড়ে অদিতির উপর। এ ক্ষেত্রে প্রশ্রয়ী “দিদি” তার ভাইয়ের নাম রেখেছে কচ্ছপ।

সন্তুর বুকে হেঁটে খাটের তলায় ঢুকে পড়া, আদ্যন্ত নিরীহ মুখ করে সবার সামনে ঘুরে বেড়ানো, অপরাধ করেও খুব ঠান্ডা মাথায় সেটা প্রায় কাউকেই বুঝতে না দেওয়া অদিতিকে একটা ভিডিওর কথা মনে পড়িয়ে দেয়, যে ভিডিওতে অদিতি দেখেছিল একটা কচ্ছপ তার পাশে প্রায় নিশ্চিন্তে ইতিউতি চড়ে বেড়ানো এক ঝাঁক পায়রার থেকে একটাকে খপ করে মুখে তুলে নিচ্ছে। অবিশ্বাস্য! ভিডিওটা অদিতি অবিশ্বাসী চোখে বারবার ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছিল। তারপরেও ভিডিওতে দেখা দৃশ্যটা ভুলতে না পেরে অদিতি এক সময়ে তার বাবাকে বলেছিল ঘটনাটা। ওর বাবা সব শুনে বলেছিলেন, এর থেকেও অবাক করা উদাহরণ আছে।

- এর থেকেও অবাক করা মানে? একটু বুঝিয়ে বল। অদিতি তার বাবাকে চেপে ধরেছিল।

- আরে কচ্ছপের পায়রা খাওয়া তো তবু একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবলে একটা যুক্তিগ্রাহ্য বাতাবরণ পেয়ে যাবে। কিন্তু তুই যদি দেখিস যে, একটা পেলিক্যান খপ করে একটা পায়রা ধরে নিয়ে তার ঠোঁটের নিচে ঝোলা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিচ্ছে, তো কেমন লাগবে?

- এমনটা ঘটেছে নাকি? অদিতি চোখ বড়ো বড়ো করে বলে।

- হ্যাঁ, ঘটেছে। আর কী আশ্চর্য দেখ, এ ক্ষেত্রেও ভিকটিম সেই বেচারা পায়রা।

- এই ভিডিওটা খুঁজে দেখতে হবে। আমি এর আগে অনেকগুলো ভিডিওতে বেবুনকে দেখেছি হরিণের বাচ্চা ধরে মাংস খাচ্ছে, জলহস্তীকে দেখেছি কুমীরের থেকে জেব্রার মাংস কেড়ে নিয়ে খাচ্ছে।

- ঠিকই দেখেছিস। আসলে বেবুন অবস্থায় পড়ে কখনো কখনো তার খাদ্যাভ্যাস বদলায় আর জলহস্তী টাটকা মাংস পেলে কখনো-সখনও একটু গিলে নেয়। তবে তুই আরেকটা কথা শুনলে খুব অবাক হবি।

- কী? কী? বলো।

- অন্তত একবার দেখা গেছে একটা হরিণ খুব ছোটো একটা পাখি মুখে নিয়ে খাবার চেষ্টা করছে।

- কী বলছ তুমি বাবা? অদিতি প্রায় চীৎকার করে ওঠে।

- বুঝতে পারছি তুই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিস। তবে একটা কথা মনে রাখিস, জন্তু-জানোয়াররা যাই করুক না কেন তার পিছনে কোনো প্ররোচনা কাজ করে না। ওদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, ওদের প্রবৃত্তি ওদের যা করতে বলে, ওরা তাই করে। যা রাত হয়েছে শুয়ে পড়।

সব শুনে সে রাতে অদিতি ভালো করে ঘুমোতে পারেনি। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যে, সন্তুর নামকরণটা সে ঠিক লাইনেই রেখেছে। সবচেয়ে বড়ো কথা অদিতি এরপর থেকে সন্তুকে মাঝে-সাঝেই কচ্ছপ বলে ডাকত। এই নামকরণের পিছনের কারণটা জানা ছিল না বলে সন্তু মাঝে মাঝেই নিজের চেহারাটা আয়নায় একবার দেখে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করত যে, দিদি কেন হঠাৎ তাকে কচ্ছপ বলে ডাকছে।

ইদানিং অদিতি একটা নতুন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে ফেরার পথে ও লক্ষ্য করেছে চারটে ছেলে, হাতে বই-খাতা ওদের গলির মুখটায় জড় হয়। ছেলেগুলো অদিতিকে কোনোদিন কিছু বলেনি, কিন্তু তবুও অদিতি যে পথ দিয়ে আসে, সেদিকে ওদের হা করে তাকিয়ে থাকা অদিতির ভিতরে একটা অস্থিরতা তৈরি করে। সেই অস্থিরতা থেকেই অদিতি ছেলেগুলোর নাম রাখে “হায়নার পাল” এবং ওদের মোকাবিলা করার জন্য, নিজের মনে জোর আনার জন্য অদিতি এ ক্ষেত্রে নিজের নাম রাখে “সিংহী”। অদিতি জানে, জঙ্গলের নিয়ম অনুযায়ী একটা সিংহী চারটে হায়নাকে অনায়াসে রুখে দিতে পারে। অদিতি এও জানে যে, এ জন্যেই হায়নারা সংখ্যায় নিজেদের বাড়িয়ে নিয়ে সময়-সুযোগ পেলেই সিংহীকে আক্রমণ করে। যেহেতু সংখ্যায় ওরা চার, ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটে নাম পাওয়া অদিতির ভয় করে না। তার মনে হয়, ওই চারজনকে সে একাই সামলে নিতে পারবে।

কিন্তু অদিতির এই থিয়োরি হঠাৎ করেই একদিন সমস্যার মুখে পড়ল। সেদিন সে কলেজ থেকে ফেরার সময়ে লক্ষ্য করল ছেলেগুলো আর তার ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে নেই। কিন্তু বিপদ বেড়েছে অন্য জায়গায়। সেদিন দেখা গেল ছেলেগুলো সংখ্যায় নিজেদের বাড়িয়ে নিয়ে পাঁচে পৌঁছে গেছে। তার মানে বিপদ। তার মানে অদিতি বুঝতে পারল যে, নিজেকে বাঁচাতে তার কাছে দু’টো অপশন ওপেন আছে। প্রথম অপশন, কলেজ থেকে ফেরার সময়ে আরও একজন “সিংহী”কে তার সঙ্গে নেওয়া। অদিতি ভেবে নিল এটা সম্ভব। কিন্তু দ্বিতীয় অপশন, জঙ্গলের নিয়ম অনুযায়ী একটা সিংহ কাছাকাছি থাকা মানে হায়নারা তা সে সংখ্যায় যতই হোক, ধারে কাছে আসার চেষ্টা করবে না। তার মানে নিজের সঙ্গে একটা সিংহ রাখতে হবে। অদিতি জানে দ্বিতীয় অপশনটা একেবারেই সম্ভব না। কারণ তার কলেজের সিংহদের প্রায় সবারই একাধিক সিংহী আছে। এবং তারা অনেকেই আসলে এক-একটি ছদ্মবেশী হায়না। এ সময় অদিতির হঠাতই মনে হলো, আরে তার তো জিরাফ কাকু আছে। জিরাফের পিছনের পায়ের লাথি ঠিক জায়গায় পড়লে, হায়না তো কোন ছার, এমনকি পশুরাজও হাড়-গোড় ভেঙে মাটিতে পড়ে থাকবে।

অদিতি ভেবে নিল, “ঠিক হ্যায়, পরদিন থেকে সে জিরাফ কাকুর রিক্সাতেই ফিরবে”। এ সব ভাবতে ভাবতেই অদিতি ততক্ষণে তার কল্পিত “হায়না”দের কাছাকাছি এসে পড়ে। তারপর “ধুত্তোরি” বলে অদিতি “পাঁচটা হায়না”কে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবার সময়ে হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। ঠিক তার পরেই অদিতি অনুভব করল ওর ডান হাতের কনুই বরাবর কেউ যেন প্রবল ছ্যাঁকা দিয়েছে। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে অদিতি বুঝতে পারল ওর খুব কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রাখা একটা মারুতির টায়ার বার্স্ট করেছে এবং সেই টায়ারের একটা ছোটো গরম টুকরো ওর ডান হাত ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। কিছুটা ভয়, কিছুটা আতঙ্কে অদিতি রাস্তার ধারের ফুটপাথে বসে পড়ল।

অদিতি দেখল, কী আশ্চর্য, ওর ওই অবস্থা দেখে সবার আগে দৌড়ে আসছে তার “পাঁচ হায়না”। এরপর স্থানীয় একটা ওষুধের দোকানে অদিতির প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে ওই পাঁচ জনই অদিতিকে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে একটুও না দাঁড়িয়ে খুব দ্রুত কোথায় যেন চলে গেল।

পরের দৃশ্যে বাড়ির লোকের নানা প্রশ্ন, আহা, উহু সামলে অদিতি বাড়িতে টায়ার বার্স্টের ঘটনা এবং নিজের হাতে ছ্যাঁকা লাগার ঘটনাটা বলল, কিন্তু তার কল্পিত “হায়না”দের ব্যাপারটা পুরো চেপে গেল।

এই ঘটনাটার পর থেকে খুব স্বাভাবিক কারণেই অদিতির থিসিস পেপারটা পুরো ঘেঁটে গেল। কারণ ওই পাঁচজন সেদিন তার জন্যে যা করেছে, তারপর থেকে তাদের আর হায়না বলা যাচ্ছে না। “তবে ওরা কী?” এটা জানার জন্যেই অদিতি ঠিক করল যে, সে একদিন ওই পাঁচ মূর্তির সঙ্গে কথা বলে দেখবে। সরাসরি। মুখোমুখি।

দিন দুয়েক পর অদিতির সে সুযোগ এসে গেল। কলেজ ফেরত অদিতি দেখল যে, সেদিন “পাঁচ মূর্তি” নয়, “চার মূর্তি” দাঁড়িয়ে আছে গলির মুখে। আজও ওরা অদিতি যে দিক থেকে আসছে, সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আজ কিন্তু অদিতির একটুও ভয় লাগছিল না। সে সটান গিয়ে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই, তোমরা মাঝে মাঝেই এই গলির মুখে দাঁড়িয়ে কী করো বলো তো?

ছেলেগুলো সম্ভবত এমন প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। তবু ওদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা যে ছেলেটা সে হেসে বলল, আগে তুমি বলো, তোমার হাত এখন কেমন আছে?

- আমার হাত পুরো সেরে গেছে। একটা কালো দাগ অবশ্য এখনও রয়ে গেছে, তবে ডাক্তারবাবু বলেছেন, ওটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাবে। অদিতি একটানা বলে থামল।

- বাহ্‌, গুড নিউজ। ফের সেই লম্বা ছেলেটাই উত্তর দিল।

- সে না হয় হলো। তোমরা কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না। অদিতি ফের মূল স্রোতে ফিরে আসে।

- আরে, আগে আলাপ-পরিচয় হোক, তারপর তো বলব। এবারেও উত্তর দিল লম্বা ছেলেটা।

- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি অদিতি, ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স। তোমাদের নামগুলো বলো এবার।

অদিতির কথা শুনে ফের সেই লম্বা ছেলেটাই বলল, আমি অরিন্দম, আর আমার সঙ্গে এরা আমার সহপাঠী মিঠুন, রাজা আর নিলাদ্রী। আমাদের আরেক বন্ধু এখনই এসে পড়বে, ওর নাম সুদীপ। হ্যাঁ, আমরাও ফাইনাল ইয়ার, ইংলিশ অনার্স।

- তোমরা পড়াশোনা না করে হাতে বই-খাতা নিয়ে প্রায়ই এই মোড়ের মাথায় এসে আড্ডা মারো কেন? অদিতি হঠাৎ যেন অভিভাবক হয়ে যায় ছেলেগুলোর।

- অদিতি, আমরা এখানে আড্ডা মারতে আসি না। আসলে আমরা পাঁচজন আমাদের আরেক বন্ধু সমীর, যে এ পাড়াতেই থাকে তার বাড়িতে পড়তে যাই। মানে এক সঙ্গে একটা গ্রুপ বানিয়ে পড়াশোনা করি আর কী। নিজেরা যে যতটুকু জানি, সেটা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করি। আশা করছি এতে আমাদের রেজাল্টটা ভালো হবে। এবারে অরিন্দম নয়, উত্তরটা এলো মিঠুনের কাছ থেকে।

ওদের উত্তর শুনে অদিতি আক্ষরিক অর্থেই হতভম্ব হয়ে পড়ল। তবু শেষ কাঁটাটা উপড়ে ফেলার জন্য সে প্রশ্ন করল, তোমরা আমি যে পথ দিয়ে ফিরি সেদিকে তাকিয়ে থাক কেন?

অদিতির কথায় সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। তারপর অরিন্দমই বলল, আরে আমাদের “পঞ্চপান্ডব”এর পঞ্চম জন মানে সুদীপের আসতে একটু দেরি হয় কারণ ও একটু দূরে থাকে। আর সুদীপ আসে তুমি যে পথ দিয়ে আসো, সে দিক দিয়েই।

সেই সময়ই নিলাদ্রী বলে উঠল, আরে ওই তো সুদীপ আসছে।

অদিতি টের পেল তার ঘাড়টা নিজে থেকেই নুয়ে পড়ছে। সেই অবস্থাতেই সে তার একদা “হায়না”দের বলল, আজ তবে আসি। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল।

বাড়ি ফেরার পথে এই প্রথম অদিতি টের পেতে শুরু করল – ওর ভিতরে যেন অন্য একটা অদিতি জেগে উঠছে। অদিতি বুঝতে পারছিল – এই অদিতিকে সে চেনে না। তার মনে হলো একটা লম্বা ছায়া যেন তাকে অনুসরণ করছে। অথচ এমনটা হবার কোনো কারণ সে খুঁজে পায় না। প্রায় অপরিচিত একজনের সঙ্গে দু’-চারটে কথা বলার সঙ্গে এই অনুভূতি বদলের কী সম্পর্ক সেটা ভাবতে গিয়েই অদিতি যেন আরও ঘেঁটে যায়। বাড়ি ফেরার পরেও তার সে অস্থিরতা কমার বদলে যেন বেড়ে গেল। অন্য এক জিরাফের কথা ভেব অদিতি তখন যেন সেই জিরাফকেই অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে অন্যতর সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাওয়া অন্য কেউ।

এতদিন দস্যিপনা আর সরলতার আড়ালে মোড়া অদিতি কি সে জন্যেই সে রাতে তার বাবাকে “হায়না” পর্বের খানিকটা অংশ ধোঁয়াশায় রেখে একটা আবদার গুঁজে দিয়ে বলল, বাবা, আমি কি ওদের সঙ্গে ওই গ্রুপে পড়াশোনা করতে পারি? সপ্তাহে তো মাত্র তিন দিন।

- নিশ্চয়ই পারিস। তবে দেখ ওরা রাজি হয় কিনা। অদিতির বাবা হেসে বলেন।

- হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমার সঙ্গে ওদের ফের পরশু দেখা হবে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করে নেব। অদিতি মনের আনন্দ চেপে রেখেই বলে কথাগুলো।

পাশে বসে অদিতির ঠাকুমা তাঁর ছেলে আর নাতনীর শেষ কথোপকথনগুলো শুনে ফেলেছিলেন। এবং তিনি রেগে গিয়ে ছেলেকে দাবড়ানো শুরু করলেন, নারান, তোর কী আক্কেল বল তো, ওই ধিঙ্গি মেয়েটাকে একা কতগুলো জানা নেই - শোনা নেই ছেলেদের সঙ্গে পড়তে পাঠাবি। তোর কি কোনোদিনই বুদ্ধিশুদ্ধি হবে না রে?

মায়ের ধমক খেয়ে অদিতির বাবা থমকে যান। অদিতির বুক ঢিপঢিপ করে। তার ভয় হয় ঠাকুমার বকুনিতে যদি বাবা...।

ঠিক এই সময়ে ঘরে অদিতির মা’র প্রবেশ এবং তিনি সব শুনে অদিতির বাবাকে একটা প্রস্তাব দেন, দেখ না ছেলেগুলো আমাদের বাড়ি এসে পড়তে রাজী কিনা। আমাদের পূব দিকের ঘরটা তো খালিই আছে।

প্রস্তাবটা এমনকি অদিতির ঠাকুমারও পছন্দ হয়। তিনি বলেন, হুম্‌ম্‌, এমনটা হলে মন্দ হয় না। অদিতিও আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে একটা বড়ো চুমু এঁকে দেয়। ঠাকুমা এবারেও বিড়বিড় করেন, ধিঙ্গি মেয়ের কাণ্ড দেখ। বুঝি না বাপু, কী দিনকাল পড়ল।

অদিতি আজকাল তাদের বাড়ির পূবদিকের ঘরে সপ্তাহে তিনদিন ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে পড়াশোনা শেয়ার করে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে অদিতি বুঝতে পারে যে সে মনে মনে সেই লম্বা ছায়ার সান্নিধ্য পাবার জন্যে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছে। সে অপেক্ষা করে, গভীরভাবে অপেক্ষা করে এক দীর্ঘকায় তিরন্দাজের – কিন্তু বলা হয় না কিছুই।

এর মধ্যেই এক রাতে সন্তু হঠাৎ অদিতিকে জিজ্ঞেস করে, দিদি, আমাকে তো কচ্ছপ ডাকিস, তো ওই ছেলেগুলোর কী নাম রাখলি তুই?

- ডলফিন্‌। অদিতি এক কথায় উত্তর দেয়।

- ও আমি হলাম কচ্ছপ আর ওরা ডলফিন। কেন? দৃশ্যতই উত্তেজিত সন্তু প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।

- দেখ, ওরা দলবেঁধে থাকে, পরের উপকার করে...

অদিতির কথা শেষ হবার আগেই সন্তু তার হাসিতে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলে, দাঁড়া আমিও তোর একটা নাম ঠিক করব।

- অ্যাই ভাগ, তুই আবার কী নাম দিবি রে। তুই জানিস কী যে নামকরণ করবি। অদিতি প্রায় তেড়ে ওঠে।

- তবে শুনে রাখ, আমি আর ঠাকুমা দু’জনে মিলে তোর নাম রেখেছি পাগলিবুড়ি...

এবার সন্তুর কথা শেষ হবার আগেই অদিতি ওকে তাড়া করে। সন্তু দৌড়ে তার প্রিয় খাটের তলায় আশ্রয় নেয়।

এর কয়েক দিন পরেই অদিতিদের বাড়িতে দেখা গেল ওর ঠাকুমা চিৎকার করছেন, আমার বয়ম সমেত কুলের আচার কে চুরি করে নিয়ে গেল? আমি আজ এর একটা হেস্তনেস্ত চাই। আজ আসুক নারান...

অদিতির মা তখন ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ঠিক আছে মা, আমরা খুঁজে দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না। ঠাকুমা তবু বলেই যাচ্ছেন, আজ নারান আসুক...

ঘরের এক কোণে তখন অন্য দৃশ্য। সন্তু অদিতির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা দিদি, ডলফিনরা কি কুলের আচার খায়?

সন্তুর প্রশ্ন শুনে অদিতি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর খুব আস্তে আস্তে বলল, ডলফিন কুলের আচার খায় কিনা জানি না, তবে জিরাফ নিশ্চয়ই খায়। সে জন্যেই তো...

অবাক সন্তু দেখল তাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে তার একদা ডানপিটে দিদি খুব শান্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে পূবদিকের ঘর বরাবর।

অলংকরণ –কৌশিক বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি