সোমবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১২

বিকাশ সরকার


প্রাইমারি স্কুলের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হতো বিগুলঝোরা নদীটির পাড়ে কাশফুল কত ঘন হলো। স্কুলের পিছনেই নদী, তারপর নদীর পাড়। নদীর ওপাড়ে একরত্তি চর জেগে থাকত, কিন্তু মাঝের এই জঙ্গলের জন্য সেটা দেখা যেত না। কিন্তু যখন একটু একটু করে সেখানে কাশফুল ফুটে উঠতে শুরু করত, আমরা ভাঙা জানালা দিয়ে একটু একটু করে দেখতে পেতাম। কেমন যেন এক আলো খেলা করত সবার চোখেমুখে। সে আলো শরৎকালের। কাশ যত মাথা উঁচু করে, আমাদের চোখেমুখে সে আলো আরও আনন্দিত হয়, আরও ঘন হয়। মনে হয় কলমির ওই জঙ্গল পেরিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি ওই পাড়ে। ওপাড়ের ঘন কাশবন যেন স্বপ্নের মধ্যেও আনাগোনা করে। না, আমাদের গ্রামে কোনো বুক দুরুদুরু করা আমলকী বন ছিল না। তবে গাছগুলি দেখে দিব্য বোঝা যেত সত্যিই পাতা খসানোর সময় হয়ে এসেছে। আর ছিল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে এর বাড়ি-তার বাড়িতে বিস্তর শিউলি গাছ। রাস্তার ধারেও ছিল মালিকানাহীন সেইসব গাছগুলি। শিউলির গন্ধ ভেসে এলেই বোঝা যেত পুজোএসে গেছে। লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, কার্তিকপুজো...সব পুজোর সঙ্গেই দেবতার নাম জড়ানো থাকে; কিন্তু স্রেফ ‘পুজো’ মানে হলো দুর্গাপুজো। দেবতা এখানে নিমিত্তমাত্র, পুজোটাই আসল; এবং পুজোর আনন্দ। ঢাকিরা পুজো শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই ঢাক বাজাতে বাজাতে মন্ডপের দিকে যেতে থাকেন; সেই বাদ্য বুকের ভিতর কী উন্মাদনা তোলে। ‘ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালেবিলে’—এই বাক্যে তার সমর্থন চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। অতএব কাশফুল ফুটল, শিউলির গন্ধ পেলাম আর বুকের মধ্যে বেজে উঠল ঢাক; এই ত্র্যহস্পর্শ না হলে আর পুজো কই?

গ্রাম বলতে তো তিনদিকে চা বাগান আর একদিকে বন। মাঝখানে একটুখানি লোকালয়। একচিলতে বাজার। পুজো হতো একটাই। সেটা বারোয়ারি মন্ডপে। শামিয়ানা টাঙানো হতো। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ কাগজ তেকোনা করে কেটে নারকেলের দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। সেই পতকাবৎ কাগজগুলি যত ওড়ে ততই যেন আনন্দ বাড়ে আমাদের। বেলুনওলা আসে সাপবেলুন ফুলিয়ে, লংকাবাজি-চরকি-বুড়িমার চকোলেট-তুবড়ি নিয়ে দোকান বসে, ঘুগনি আর পেঁয়াজির দোকান বসে। পুজো শুরু হয়ে যায়। মাইকে পুরুতমশায়ের মন্ত্র ভেসে আসে। টিউবলাইটের নীচে আরতি কম্পিটিশন হয়। সেখানে সারা বছরের জমানো যত কসরত দেখান বীরেনমিস্ত্রি-ফিটারকাকু-রমেনধোপা। আর আসে যাত্রাপার্টি। অষ্টমীতে আরতি কম্পিটিশন তো নবমীর রাতে ‘রহিম বাদশা রূপবান কন্যা’ দেখে চোখের জলে বুক ভেসে যায়।

এখন হঠাৎ করে দেখি দুর্গাপুজোর সেই উপচারগুলি যেন এক এক করে খসে পড়েছে। যেন দুর্গারই দশ হাত একটা একটা করে খসে পড়া। মহালয়ার ভোর যে কী উন্মাদনাকর ছিল সে আজ কাউকে বলেও বোঝানো যায় না। গ্রামজুড়ে হাজারটা রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র গমগম করে চন্ডীপাঠ করছেন, মাঝেমাঝে গান, সঙ্গে শিউলির গন্ধ, সেসব আজ আর নেই। এখন মহালয়া শোনার জিনিস নয়, দেখার জিনিস। পাঠটা গৌণ, মুখ্য হলো কে কত ড্রামা করতে পারছে। তেমনি দুর্গাপুজোও তার সেই রূপ হারিয়েছে। পালটে গেছে পরম্পরা। আলোর রোশনাই, গগনচুম্বী লক্ষ টাকার প্যান্ডেল, হিন্দি গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য—এসব এখন পুজোর অন্যতম অংশ। এত আলো তবু যেন মনে হয় যাঁর পুজো সেই দেবী দুর্গা অন্ধকারে ডুবে আছেন তাঁর ছেলেপুলে নিয়ে; কেউ তাঁদের দিকে ফিরেও তাকায় না, সবাই প্যান্ডেলের কারুকাজ দেখতে মগ্ন। এখন তো বহুজাতিক কোম্পানিগুলিও তাদের পণ্যের প্রচারের জন্য পুজো স্পনসর করছে। তাই ঢাকিরা সব কোনো মোবাইল নেটওয়ার্কের গেঞ্জি পরে ঢাক বাজায়, আর দূর থেকে কেউ তাঁদের ধমকে বলেন, ‘ওরে ঢাক বাজানো বন্ধ কর, এখন আমাদের হিমেশ রেশমিয়া শুরু হবে।’ ঢাকিরা সব মুখ কালো করে এক কোণে বসে থাকেন, শুরু হয়ে যায় ‘ঝলক দিখলা যা’র সঙ্গে নৃত্য। তান্ডবের ‘তা’ আর লয়-এর ‘ল’ দিয়ে যে ‘তাল’ হয়েছে তা এই বঙ্গসন্তানেরাই প্রমাণ করেছেন। ওদিকে বেচারা পুরুতমশায় যে তাঁর চেলা নিয়ে কী করছেন সেদিকে কারও কোনো লক্ষ্যই নেই। তিনি হয়তো তখন বীতশ্রদ্ধ হয়ে মায়ের সন্ধ্যারতি করছেন। আসলে, পরম্পরাও যে পণ্য হতে পারে তা আজকের দুর্গাপুজোই জ্বলন্ত নমুনা। মনে হয়, একটা সময় আসবে যখন পুজোয় আর ঢাকই বাজবে না। অঞ্জলি হবে না। আরতি তো সেই কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু প্যান্ডেল থাকবে। তীব্র আলোর ঝলকানি থাকবে। আর থাকবে উন্মাদনৃত্য।

এবং বাজির গন্ধে ভরে যাবে বাতাস, শিউলির গন্ধ সেখানে মুখ লুকনোরও জায়গা পাবে না। আমরা তখন ফিরে যাব সেই গ্রামটিতে, যেখানে কাশবনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন দুর্গা, পিছনে পিছনে ছুটছে অপু, আসলে আমি।



অলংকরণ – মেঘ অদিতি কৌশিক বিশ্বাস