শঙ্খ ঘোষের সৃষ্টিশীলতা’ র মুখ কবিতা সাহিত্য আলোচনা ও জীবন
অমলেন্দু চন্দ
লিখতে হবে “শঙ্খ ঘোষ” কে নিয়ে এটা শুনেই আমার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা চুটকি মনে পড়ে গেল।
বাড়িতে আত্মীয় পরিজনদের নেমন্তন্য, উপলক্ষ – সে একটা বিশেষ ব্যাপার। তো এমন ভালো রান্না যে খবর ছড়াল গন্ধে গন্ধে আর দল বেঁধে লোক আসতে আরম্ভ করল – আত্মীয়ের আত্মীয়, তার আবার মানে
আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয়, এভাবে যত সমাগম বাড়ে সুরুয়া ততই পাতলা হয়, শেষ কালে দেখা গেল শুধু জল পরিবেশন হচ্ছে। মানে যত আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয় এলেন তাদের জন্য সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া পরিবেশণ হতে লাগলো।
শঙ্খ ঘোষ আমার এক ভীষণ প্রিয় শিল্পী – না শুধু কবি বলছি না, কারন কবিতা ছাড়াও তিনি দিয়েছেন আরও অনেক লেখা, বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র পর্যায় অধ্যয়নে স্বীকৃত প্রামান্য সহায়ক গ্রন্থ। তার প্রণীত --
“নির্মাণ ও সৃষ্টি”, “ঐতিহ্যের বিস্তার” ও “এ আমির আবরন” কাব্যের অবস্থান, আবরন, অলঙ্কার ছন্দ, ভাষা ও জীবন দর্শন নিয়ে এক ভীষণ প্রাসঙ্গিক ধারনা দেয়। “ছন্দের বারান্দা” তো সর্বজনবিদিত, যেখানে
তিনি রবীন্দ্রনাথে শুরু হয়ে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব, সুধীন্দ্রনাথ সমর সেন সকলের শৈলী বৈশিষ্ট এই সব কে তুলে ধরেছেন।
যা বলছিলাম সেই এমন একজন প্রিয় ও চিত্তপ্রিয় লোককে নিয়ে লিখতে গেলে আমার কলম দিয়ে ওই সুরুয়ার সুরুয়ার সুরুয়া’ ই হয়ত পরিবেশিত হয়ে যাবে, কারন এমন একটা বিশেষ সঙ্খ্যার লেখার উৎসবে আমার
অবস্থা ওই রবাহুত আত্মীয়ের আত্মীয়ের আত্মীয়’ র মতই।
বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া এই চিত্তপ্রিয় ঘোষ আমাদের শঙ্খ ঘোষ। তার কবিতা লেখার প্রসঙ্গে তিনি তুলনা টানেন এক পথ চলার, যেখানে কবিতা দিশারী ও পথ দুইই, বলেন এ যেন “... এক টুকরো
থেকে অন্য টুকরোয় অবিরাম ... পা তোলা পা ফেলার মত ... এক কবিতার থেকে আরেক কবিতায় পৌঁছন...” (১)।
তাহলে কি শঙ্খ ঘোষের কবিতা কোন ক্রোনলজিক্যাল প্যাটার্ন ফলো করে বা একটি কবিতায় অন্য কবিতার সুক্ত বা সুত্র নিহিত থাকে ? সম্ভবত এর উত্তর হোল আরও গভীর – কবিতা তার কাছে ধর্ম,তাকে ধারন আর যাপন সেটাই পথ চলা। তিনি লেখেন
“...খসে পড়া নক্ষত্র বেজে রইল বুকের মাঝখানে...” (ক) যেন
কবিতাই সেই সুক্ত বা মন্ত্র যার সুত্রে তিনি করেন কবিতারই রূপ নির্মাণ। আর তাই হয়ত বলেন “... কবিতা নিজেই নিজের সম্পূর্ণ সত্তা...”(২) । কিন্তু শুধু এইটুকুতেই তার কাব্যবোধের আত্মস্থ গভীরতা ধরা পড়ে না।
ধরা পরে তার প্রাসঙ্গিকতায়! তিনি এমন এক কবি যার কাছে কবিতার চেয়ে কবিতার কিংবদন্তী কিছুতেই বড় হয়ে ওঠে না।
আজকে কবিতা যখন শুধুমাত্র পাঠকের আত্মস্থ গভীরতায় তৃপ্ত হচ্ছে না, সে চাইছে পাঠক শব্দ সমবায় আর সমাহারের অর্থোদ্ধার করুক, শব্দের চরিত্র ও তার বহুমাত্রিক ব্যাবহার কে নিজের রুচি ও শিক্ষার অঙ্গীভূত করে পাঠকত্ব অর্জন করুক, বিস্ময়বোধের নৃতত্ত্ব যেন তার আহরিত বিদ্যার অঙ্গ হয়, সে পাঠক হিসেবে উত্তীর্ণ হোক। আর এই ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের কার্ভে পাঠক বলছেন কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে।
এরকম একটা সময়ের নিরিখে তার কবিতা বা লেখা নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রসঙ্গ এসে পড়ে যে তিনি কতটা প্রাসঙ্গিক। কবিতা উপলব্ধি বা উপলব্ধি না করতে পারার তারতম্যের এই সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি কি
বলছেন বা বলেছেন?
শঙ্খ ঘোষ বলছেন “... নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন অর্থ সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়...” (২)।
কিন্তু যেখানে নতুন অর্থ সৃষ্টির প্রচেষ্টাই প্রশ্নবিদ্ধ ও দুর্বোধ্যতার তকমা পাচ্ছে পাঠক বা সমালোচকের কাছে, সেখানে তিনি কি শুধু শ্রেষ্ঠ কবি বা শিল্পীর ক্ষমতার দিকে তার ইঙ্গিত সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন?
সেইখানেই তিনি শঙ্খ ঘোষ, কারন তিনি একটা গ্রাহ্য সীমারেখার ব্যাক্ষাত অবস্থানের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। একটা সীমারেখার কথা জীবনানন্দও বলেছেন এ ব্যাপারে যে “... শেষ পর্যন্ত কবিতা সৃষ্টি ও পাঠ (রসাস্বাদন) একেবারে ব্যাক্তিমনের ব্যাপার। কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এতো তারতম্য...”।
জীবনানন্দ কবিতা বোঝা বা না বোঝার অ্যানালিসিস এড়িয়ে গেছেন তার নিজস্ব জীবন ও কবিতা চর্যার নিয়মে, তার ইম্প্রেশানিস্ট আলো আঁধারীর রহস্যময় বিস্ময়ের বিস্তারী বৈচিত্রের আভঙ্গে। শঙ্খ ঘোষ চেষ্টা করেছেন তারতম্যের অন্তরে নিহিত কারন কে তুলে ধরতে, সীমারেখা কোথায় সে সম্বন্ধে একটি ইঙ্গিতময় ধারনা দিতে । তিনি বলছেন শব্দসন্ধানের ম্যানারিস্ম এর কথা একধরনের আড়ম্বরের সঙ্কটের কথা – শব্দ স্বর ও শব্দমুল এর নির্ণায়ক সুর এর প্রতি তার ইঙ্গিত, শব্দকে তার প্রচলিত প্রাচীন অর্থের নিরিখ থেকে একটু বিস্থাপিত করতে চাওয়ার ইচ্ছা যেখানে প্রবল্ভাবে পরিলক্ষিত। তাই বলছেন এই ম্যানারিসম্ কবির ও তার কবিতার
“...স্বাতন্ত্র কে ধরিয়ে দেয়, - কিন্তু কবিতার কাজ শুধুমাত্র স্বাতন্ত্র কে বুঝিয়ে দেওয়া নয় ... শব্দ রচনার অতিসাধ্য প্রেরনা শেষ পর্যন্ত কবিকে ওই জড় অভ্যেসের মহাতমসায় ঠেলে নিয়ে যেতে পারে...” (২)।
কি স্বচ্ছ ও নির্মেদ ইঙ্গিত, সীমারেখার দিকে। তার কবিতায় সম্পৃক্ত জীবনবোধ তাকে দিয়ে বলায় যে
“... কবিতার প্রতিমা কবির কাছে একটা যুদ্ধের চিহ্ন, ... জীবনের সঙ্গে লগ্ন হওয়ার ... জীবনের প্রত্যক্ষ সংঘাতে নিজের বোধকে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব কবির...” (৩) এই বোধের প্রতিমা তার কবিতা। তার শব্দচয়ন,
তাদের নির্মেদ শরীর, তাদের অনলংকৃত স্বাস্থের ঔজ্জ্বল্য।
এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন যে শব্দকে
“... যখন বড় বেশী প্রধান করে তুলি ... শব্দ তখন বুঝিয়ে দেয়
যে সে হয়ে উঠেছে এক বিচ্ছিন্ন সত্তা ... বুঝিয়ে দেয় যে সে কোন সংযোগের বাহন নয় তার (কবিতার) ... সে (হয়ে উঠেছে ) কতগুলো আলগা প্রসাধন মাত্র...” (২)। কথাগুলো ভীষণ প্রাসঙ্গিক যে কোন সময়ের নিরিখে।
এক ভীষণ সচেতন মননশীল প্রক্রিয়ার কাজ দেখা যায় শঙ্খ ঘোষের মধ্যে যার আবেশে সেই চেনা জানা সঙ্কীর্ণ পৃথিবীর জগতটার মধ্যে এক ভিন্ন স্থান উঠে আসে যেখানে প্রাপ্তি বিচ্ছেদ, সাফল্য বা ব্যার্থতার তারতম্যের, কামনা বা বেদনার অকিঞ্চিতকর বিবর্তন কে ছাপিয়ে এক নীলকণ্ঠ আকাশ ধরা দেয় –
“... একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোনে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে...” কবি এখানে সময়ের বহতায় থাকা মুখ আর মুখোসের দিকে ইঙ্গিত করেন, করেন কস্মেটিক চেহারার জলছবির দিকে, যার সাথে রয়েছে অঙ্গাঙ্গী বেশ কিছুটা নিরুপায় অবস্থা। যে নিরুপা, অবস্থান আরও স্পষ্ট হয় এই কবিতার শেষ চার পঙক্তিতে -
“... মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোনে
ক্লান্ত আমার মুখোস শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে” -
তিনি আরও লেখেন --
“ কে কাকে ঠিক কেমন দেখে / বুঝতে পারা শক্ত খুবিই...”।
এটা কি শুধুই সভ্যতার বিবর্তনে মানুষী ক্রাইসিস এর দিকে আঙুল তুলেছেন? আমার মনে হয় এ আরও বিস্তারী – এক নৈতিক মন্তব্য যেখানে ব্যাক্তি, সমাজ রাষ্ট্র অর্থনীতি সব কোথাও না কোথাও প্রচ্ছন্ন ভাবে ইঙ্গিতের ট্রিগারের মুখে রয়েছে। তার কবিতায় এক ধরনের মেসেজধর্মী ইঙ্গিতময়তা থাকে, বা এভাবে বলা ভালো যে তার কবিতা শুধু চিত্রায়ন নয় শব্দে, শুধু ন্যারেটিভ ধর্মী নয়। কিন্তু সেই মেসেজ কখনই তার কবিতার ব্যাগেজ হয়ে ওঠে না, কারন তিনি কখনই তার কবিতায় সময়ের বিনাশী ক্ষমতা কে মরালিস্টিক মুঢতায় আবিল করেননি।
রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থানগত ক্রাইসিস তাকে কতটা নাড়া দিয়েছে সেটা তিনি লিখে ফেলেন --
“লাইনেই ছিলাম বাবা” নামের কবিতা সঙ্কলনে
“তুমি কোন দলে” কবিতায় –
“... কি কাজ কি কথা সেটা তত বড় কথা নয় আগে বল তুমি কোন দলে
...........
বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন কর তুমি কোন দলে
আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসী শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন কর তুমি কোন দলে”
আর এই অবস্থা আর অবস্থানের ক্রাইসিস যে কত গভীরে সেটা প্রকাশ পায় সেই কবিতাটির শেষ লাইনে যেখানে তিনি লেখেন –
“রাতে ঘুমোবার আগে ভালবাসবার আগে প্রশ্ন কর কোন দল তুমি কোন দল”
কি অসম্ভব মনস্তাত্বিক আর ভালবাসার বোধে জারিয়ে আঁকা শব্দছবি, এই সময়ের সমাজসত্ত্বায় পরিবেষ্টিত থাকা সত্তার ক্রাইসিসের ডেটনেটর যা প্রতিনিয়ত মানুষ, তার মন তার মনন, তার সম্পর্কগুলোকে অ্যাফেক্ট করে চলেছে। আর এই কথা তিনি অত্যন্ত সহজ দৈনন্দিনের বহুল প্রচলিত শব্দকে ব্যাবহার করে অনায়াসে লেখেন। যেন এটাই তার শব্দের নবায়ন।
সেই কবির নিজের কথাই আবার করে বলতে হয় – “জীবনের প্রত্যক্ষ সংঘাতে নিজের বোধকে চিনে নেওয়ার দায়িত্ব কবির...” আর এই বোধের প্রতিমাই তার কবিতা।
তার রাজনৈতিক প্রতীতি এক নির্মল নির্বেদ সাধারনত্যে ভিন্ন হয়ে ওঠে যখন তিনি লেখেন –
“ক্ষমতার উৎস থেকে ক্ষমতার মোহনা যা বল / সে কেবল ক্ষমতাকে দাপিয়ে বেড়ান ক্ষমতায়...” (চরিত্র)।
একজন সাধারন মানুষ হিসেবে তার এই বোধ কে স্থান কাল পাত্রের সীমানা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সত্য কথন বলে মনে হয়। ভাবনার বৈচিত্র নয় অনুভবের সান্দ্রতা মুগ্ধ করে।
সহজিয়া কবি তার অনন্যতার ছাপ রাখেন সেই সব পঙক্তিতে যেখানে ছুঁতে চান ও রাখেন তার বৈচিত্রময় ভাবনার শব্দছবি সময়ের আর মানুষের মূল্যায়নে – “... এতো যদি ব্যুহ চক্র তীর তীরন্দাজ / তবে কেন শরীর
দিয়েছ শুধু বর্মখানি দিতে গেছ ভুলে...” (বর্ম)(৪) । অনন্য জৈবনিক শব্দপ্রতিমা ধরে রাখে অদ্ভুত সত্যির এক আভাষ সহজাত হৃদয় বৃত্তির অনুষঙ্গে। তবু কিন্তু কোথাও মানুষ এক ক্রীড়নক এই তত্ত্ব উঠে আসে না তার কবিতায়, জীবন সম্বন্ধে এতটাই তার সম্ভ্রমবোধ, এতটাই তার ভালোবাসা।
একধরনের ডিফারেন্ট লেভেল অফ কন্সাসনেস এর কাছাকাছি যেটা আমাদের নরমাল কগ্নিসান অফ এক্সপিরিয়েন্স অফ লাইফ কে ছাপিয়ে যায় সেইখানে পৌঁছে দেন পাঠককে, পাঠকের উপলব্ধি কে যেখানে প্রেম
ভালোবাসা জীবন প্রার্থনা সব এক সঙ্গে জড়িয়ে থাকে –
"বুক পেতে শুয়ে আছি ঘাসের উপরে চক্রবালে
তোমার ধানের মুখে ধরে আছি আর্ত দুই ঠোঁট
তুমি চোখ বন্ধ করো, আমিও দুচোখ ঢেকে শুনি
যেন কোন্ তল থেকে উঠে আসে পাতালের শ্বাস
সমস্ত দিনের মূর্ছা সেচন পেয়েছে এইখানে
মুহূর্ত এখানে এসে হঠাত্ পেয়েছে তার মানে
নিজের পায়ের চিহ্ন নিজে আর মনেও রাখেনি
আমিও রাখিনি কিছু, তবু হাত রাখে পিছুটান
মাটিতে বসানো জালা, ঠান্ডা বুক ভরে আছে জলে
এখনও বুঝিনি ভালো কাকে ঠিক ভালোবাসা বলে ।"
কি নম্র আনত জীবনজায়িনী প্রায় এক অতিলৌকিক রম্যান্টিসিস্ম এর স্বাদ বয়ে আনে এই সব পঙ্ক্তি যেখানে কবি তার নিজের ধরনে প্রায় মিস্টিক হয়ে ওঠেন আবার সেই সব অনুভুতিময়তাকে তা, সীমানায় ধরে রাখেন জীবনের মাটিতে, বলেন প্রেমের কথা, ভালবাসার কথা, যার সন্ধানে তিনি এখনও হাল ছাড়েননি। এ যেন সেই অ্যাব্রাহাম ম্যাসলো’র সেলফ অ্যাকচুয়ালাইজেসান যে প্রসেস প্রতি মুহূর্তে নিজে কেন্দ্রাতিগ হয়ে বাইরে ছুটে যায় আবার কেন্দ্রাভিমুখী হয়ে জীবনের দিকেই ফিরে আসে। অদ্ভুত সুন্দর ইন্ট্রোভারটেড রিফ্লেক্টিভ লিরিসিস্ম। গ্রেস আর ডেপথের অদ্ভুত সুন্দর সমাহার। দেহাশ্রয়ী মানুষের ভালবাসার স্বাভাবিক বৃত্তি এ কবিতার পরিনতিকে ব্যাঞ্জনাময় করেছে।
প্রতিরোধের জটিলতা সত্ত্বেও শালীনতা বজায় রাখা পঙক্তিতে লেখেন এক নিবিড় সত্তার অনুভুত এমন অনেক কিছু যা মেনে নিতে হয় কিন্তু কিছুতে মনে নেওয়া যায় না, বলে ওঠেন –
“... লজ্জা বাকি আছে কিছু
/ এটাই লজ্জার, এখনও মজ্জার / ভেতরে এতো আগুপিছু...” ।
স্বচ্ছ ইঙ্গিতময়তা এত শালীন এত নিবিড় এতগভীর থেকে উঠে এসেছে যা মুগ্ধ করে। এক ধরনের অ্যাঙ্গুইস চিত্রায়িত যেন। ভাললাগার এইসব পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আবার সেই সীমারেখার বোধের কথা স্মরণযোগ্য। তার
প্রকাশভঙ্গীর সরল পেলব সৌকুমার্যের পাশাপাশি বর্তমান একজন স্থিতধী বুদ্ধিজীবীর স্বচ্ছ চিন্তা চেতনার যখন প্রাসঙ্গিকতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন--
“... প্রাসঙ্গিক বলতে বোঝায় যে সেটা অনুধাবনযোগ্য, সেটা অনুসরণযোগ্য নাও হতে পারে...”।
স্মৃতির কাজ জীবনের এক দ্বিতীয় রূপ সৃষ্টি করা (শিশিরকুমার ঘোষ)। শঙ্খ ঘোষের “ছোট্ট একটা স্কুল” ও “অল্প বয়েস, কল্প বয়েস” এ সংহিত সমন্বিত রচনা গুলি পড়তে পড়তে এই কথাটা অনন্য অর্থ নিয়ে ভেসে ওঠে পাঠকের উপলব্ধিতে। দারুন কোন রচনা নয়, কিন্তু এগুলো তার ছেলেবেলার স্মৃতি কে
রুপময় করেছে। ভালো লাগে। দে আর হোয়াট উই কল অ্যাজ স্কেচেস ইন ওয়ার্ডস।
এই স্কেচধর্মীতা তার কবিতায় ভীষণ ছাপ রাখে, যা মাঝে মাঝেই ব্রাশের টান হয়ে যায়, যেমন এই কবিতাটি – অনন্য জলরঙের অ্যাবস্ট্রাক্ট ধর্মী পেইন্টিং যেন –
“চুপ কর, শব্দহীন হও’ – এক অনন্য অ্যাঙ্গুইস -
এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙে পড়ে ঝাউ, বালির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নিচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও
এ এক ইঙ্গিত মুখর রূপ জগতের অনুভুতি, কোন চিত্র নেই কোন দৃশ্য নেই তবু যেন অনুভুতি এক অমেয় মাত্রায় চিত্রায়িত।
মাত্রাচেতনা শঙ্খ ঘোষের কবিতার এক সতত ক্রিয়াশীল লিটমাস। বোধহয় এ সেই মাত্রা চেতনা যা তার কবিতায় সে ভাবে নারী কে ছেনে দেখতে চায় নি। মানুষী অস্তিত্বের চিরন্তন অর্ধেক ভাগ, তার সম্পর্কিত বোধ বা সেই সান্নিধ্যের দ্বন্ধ বা বাস্তবিকতা, সেখান থেকে উঠে আসা আশ্লেষ বা মন্থন, বা
সেখান থেকে ধেয়ে আসা চঞ্চলতা বা অস্থিরতার ধন্ধ, আমার বিচারে, তার কবিতায় সে ভাবে উঠে আসে নি। খুব সচেতনভাবেই সম্ভবত এ দিকটা তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন তার মাত্রা চেতনার অঙ্গুলিহেলনে। নারী সে অর্থে
রক্ত মাংসের হয়ে ওঠে নি তার কবিতায়।
আমার মনে হয় এই সচেতন অ্যাভয়েড করা উঠে এসেছে তার “ভয়” কবিতায় – হয়ত আমি ভুল, তবু
এটাই মনে হয় যখন এই লাইনগুলো পড়ি –
"ভয়? কেন ভয়? আমি খুব
শান্ত হয়ে চলে যেতে পারি।
তুমি বলো ভয়। দেখো চেয়ে
অতিকায় আমার না-এর
চৌকাঠে ছড়িয়ে আছে হাত-
যে হাতে সমুদ্র, ঘন বন,
জ্যোতির্বলয়ের ঘেরাটোপে
শ্বাপদসুন্দর শ্যামলতা
রক্তপাত, জীবনযাপন।
প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর
স্মৃতি শুধু, ইতিহাস আছে-
তুমি আর আমি শান্ত তার
প্রবাহদুয়ার রাখি খুলে।
তার মাঝখানে যদি পেশি
একবারও কেঁপে ওঠে, সে কি
ভয়? ভয় নয়। ভয় শুধু
শূন্যতাও যদি মুছে যায়-
শুধু এই প্রতিধ্বনিহীন
অস্তীতির ঘট ভেঙে গিয়ে
কোথাও না থাকে যদি না
তার পায়ে উঠে আসে ভয়
শূন্যতাবিহীন শূন্যতায়।"
ভয় শুধু / শুন্যতাও যদি মুছে যায়-/ শুধু এই প্রতিধ্বনিহীন/ অস্তীতির ঘট ভেঙে গিয়ে/কোথাও না থাকে যদি
না/ তার পায়ে উঠে আসে ভয়/ শুন্যতাবিহীন শুন্যতায় –।
অন্য মাত্রায় ভাবতে গেলে মনে হয় এ লেখা যেন তার সেই দেশ ভাগের অনুভুত অ্যাঙ্গুইস। কিন্তু শুধুই কি তাই? আর তাই এ কথাই আমার বেশী মনে হয় যে তার বোধের প্রতীতি তে তিনি খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন রক্ত মাংসের নারীকে। যেখানে চেষ্টা করেছেন সেখানে নারী বড় আলঙ্কারিক হয়ে রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে আরও নাড়াচাড়া করেছেন যারা তারা হয়ত আরও ভালো বলতে পারবেন।
তিনি ইকবাল কে নিয়ে দীর্ঘদিন নাড়া চাড়া করেছেন, ফারসি থেকে নয়, প্রোফেসর আরথার জারবেরি’র জাভেদনামা’র ইংরেজি অনুবাদ থেকে কাজ করেছেন। বিদগ্ধ দের প্রসংসাপ্রাপ্ত এই প্রচেষ্টা ।
১৯৫৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় “দিনগুলি রাতগুলি” আর সেই সুত্রেই কৃত্তিবাসে তিনি অনেকখানি ক্রিটিক্যাল অ্যাটেন্সান পেয়ে যান তৎকালীন এক ঘোষিত কবিপ্রতিভা হিসেবে। সেই শুরু। ১৯৯৯
সালে তার বাংলায় অনুদিত নাটক “রক্তকল্যান” [ মুল নাটক গিরীশ করনাড (১৯৮৯)]। করনাডের এই কাজ ১২শ শতাব্দীর বাসভ আন্না নামিত তৎকালীন দক্ষিন ভারতের এক রিফরমারের কাহিনী, তার কাস্ট রিফরম চেষ্টা ও তার ভায়লেন্ট ঐতিহাসিক পরিনতি সেই সময়ের সমাজে।
৮০ র দশকের মন্ডল মসজিদ ইত্যদি কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ ও সেই সংক্রান্ত অ্যানালজি টানা রচনা ছিল করনাডের মুল নাটক। শঙ্খ ঘোষের কাজ (ওই নাটক নিয়ে) যথেষ্ট সমাদৃত।
সারা জীবন অসংখ্য লেখা লিখেছেন, যার মধ্যে অনেক গ্রন্থই প্রামান্য বলে স্বীকৃত, যেটা আগেও বলেছি। “এ আমির আবরন” গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের সঙ্কলন। সেই গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লেখেন “ সুর নয়, কথা...” হোল তার মৌল আলোচ্য বিষয় এই সব লেখায়। তিনি লেখেন রবীন্দ্রনাথের “মনের এক ইতিহাস প্রচ্ছন্ন আছে তার গান গুলির মধ্যে...”।
এর পরের গ্রন্থ (১৯৮২) “নির্মাণ আর সৃষ্টি” তে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান সাহিত্যের সঙ্গে তার ছবি আঁকা র মিল দেখানর, সুর ধরানর চেষ্টা করেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ “ছন্দময় জীবন”।
শিল্পসৃষ্টিকে নানা অ্যাংগল থেকে দেখা ও তার বিবরন – মুলত রবীন্দ্রশিল্পকে কেন্দ্রে রেখে লেখা এই প্রবন্ধমুলক গ্রন্থের মুখবন্ধে তিনি লেখেন – “মানুষের শিল্পের উপাদান তো কাঠপাথর নয়, মানুষ নিজে। বর্বর অবস্থা থেকে মানুষ নিজেকে সংস্কৃত করেছে, এই সংস্কৃতি তার স্বরচিত বিশেষ ছন্দময় শিল্প”।
শঙ্খ ঘোষের আর একটি সুন্দর রচনা “কবির অভিপ্রায়” গ্রন্থটি। এটি কতগুলো লেকচারের সঙ্কলন, রবীন্দ্রচর্চায় নিবেদিত এই গ্রন্থে অভিনব প্রয়াস হয়েছে লেখক, লেখা ও পাঠকের ভিন্ন বা অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির সুন্দর পর্যালোচনা।
অত্যন্ত আত্মস্থ এক ভদ্রলোক কবি যার সবকিছুই ভীষণ ডিসিপ্লিন্ড, সেই ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে তার একটি লেখা দিয়ে আমার লেখা শেষ করছি। প্রসঙ্গক্রমে আগে বলেছিলাম যে তিনি তার সীমারেখা ভীষণ ভাবে জানেন এবং সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন রক্ত মাংসের প্রতিমা – শুন্যের ভেতরে ঢেউ – তার আর এক উদাহরন বলে আমার মনে হয় –
বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না
অত্যন্ত মরমী দরদী শুদ্ধতায় নিবেদিত প্রান সহজিয়া ছান্দসিক এই কবি সম্পর্কে একটা কথাই খাটে – হে শিল্পী তুমি যাকে স্পর্শ কর সেই দেখ শিল্প হয়ে ওঠে। জীবন্ত নারী প্রতিমা নাই বা রইল তার লেখায়, যা আছে তাই অনন্য ছায়া মায়ার সরোবরে ডুব চান দিয়ে উঠে আসে। তিনি হলেন সেই জাতের শিল্পী যে নিজের সীমারেখা ভীষণ ভাবে চেনেন এবং সেই সীমারেখার মধ্যে থেকেই অনবদ্য এক্সেলেন্ট হয়ে ওঠেন। দুর্গম বা
ধ্যানগম্যতার লক্ষন তার কবিতায় সে ভাবে ছাপ রাখে না, বরং বুদ্ধি আর আবেগের সমন্বয় তার কবিতার উৎসমুখ।
বাংলার এই কবি একাশি বছরে পা রাখলেন। অভিনন্দন। কখনও কখনও আমার মনে হয় যে রেওয়াজ আছে তাই আমরা কবিতা প্রকাশ করি, বিচার করি, চর্চার অনুষঙ্গে কুতুহল, সহানুভুতি ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে গভীরাত্মক আলোচনায় ধিক্কার বা বাহবা কুড়োই। এত আদর যেখানে , সেখানে আমার অবাক লাগে যে এদের সৃষ্টি নিয়ে এতো লেখার বাজারে এদের জীবন নিয়ে প্রামান্য কোন স্বাদু জীবনী কেউ লেখে না – কেন সে প্রশ্নের উত্তর মহাকাল দিতে থাকুন, আমার মনে হয় এটাই বাংলা কবিতার সাধ সাধ্য আর আরাধ্য সাধনায় নিরত থাকা লোকেদের ভবিতব্য, কারন জীবনী লেখা বাঙ্গালীর ধাতে নেই। তিনি বাঁচুন আরও অনেক বছর এই কামনা কবিতা সাম্রাজ্যের একান্ত পেছনের বেঞ্চে বসে থাকা আমাদের এই মুগ্ধ সম্ভ্রমের।
উদ্ধৃতি – ১) কবিতার মুহূর্ত ২) নিঃশব্দের তর্জনী ৩) শব্দ এবং সত্য ৪) মূর্খ বড় সামাজিক নয়
উদ্ধৃতি কবিতা – ক) বিপুলা পৃথিবী , (ও অন্যান্য আর অনেক) -