শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা

সম্পাদকীয়


যে কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকে তাঁর বেঁচে থাকার সময়কালেই। নিজের জীবদ্দশার আগে এবং পরে কারোরই পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব নয়। অর্থাৎ কেউই অনাদি-অনন্ত নই। সুতরাং আমাদের যা কিছু করার তা তো ঐ জীবত্কালেই সমাধা করে যেতে হয়। আর তাই আমরাও আমাদের যে যাঁর মতো করেই কাজ করে থাকি। নিজের পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে সুপরিচিত করে তুলতে আমরাও শশব্যস্ত হই। সেকারণে প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকার বা বলা ভালো নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নিজস্ব কিছু কৌশল থেকেই থাকে; যেটা সম্পূর্ণভাবেই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। এমনকি নিজের পুরুষটির সঙ্গে বা নিজের স্ত্রীটির সঙ্গেও পরস্পরে বিভিন্ন সদ্‌-অসদুপায় অবলম্বন করেই দাম্পত্য যাপন করেন। তাই শুধু যে সমাজের এক্কেবারে নিচু থেকে উপরতলা পর্যন্ত ধান্দাবাজ, বেকার, সুবিধাখোর, পার্টির নেতাগোছের লোকেরাই কৌশল করে তা কিন্তু নয়।


যাইহোক, বিষয়ের কথায় আসি। এই যে ‘কৌশল’ এরই এক সংকীর্ণ অর্থে ‘রাজনীতি’ শব্দটির ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। যদিও শব্দটির আক্ষরিক অর্থ রাজার নীতি তথা রাষ্ট্রনীতি; তবুও একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় যে শব্দটিকে আমরা আখছার ‘কৌশল’ অর্থেই ব্যবহার করে থাকি। যেমন ধরুন, আমাদের স্কুল-লাইফে এইসব ছিল কিনা মনে পড়ে না, তবে কলেজ থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির সহপাঠী-পাঠিনীদের মধ্যে আর এখনও কর্মস্থলে কলিগদের মধ্যে আমরা বলেই থাকি ‘জানিস/জানেন তো ও/অমুক না দারুন পলিটিক্সে (রাজনীতিরই ইংরাজি অর্থ) চলে। এমনি এমনি একটা কথাও খরচ করেন না’। আবার কারাও-বা নিজেদের (আমরা) দিকে না দেখে শুধুই অন্যের দিকে তাক করে বলে থাকেন - ‘আরে বলবেন না মশাই, ওদের (ওরা) মধ্যে ভীষণ পলিটিক্স! স্বার্থ ছাড়া এক-পা’ও এগোয় না।’ ইত্যাদি, ইত্যাদি...


তাহলেই বুঝুন। যখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির হাঁড়িটি থেকে শুরু করে দেশ-মহাদেশের তাবড় তাবড় হাঁড়িগুলো ভরা হাটে ভাঙলে ভিতরে ঐ তথাকথিত ‘পলিটিক্সের পাঁশ’ ছাড়া দু-মুঠো স্বস্তির অন্নই পাওয়া দুষ্কর তখন সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলার ক্ষেত্রই বা কি করে ধৃতরাষ্ট্র হবে! আর যেহেতু, কোনো সৃষ্টিই কখনো সমকালকে এড়িয়ে অসম্ভব (যদিও সমকালকে নিয়েই লিখতেই হবে এমনটাও নয়) তাই রাজনীতির বহির্ভূত কেউ নেই কিছু নেই। কাব্যসংসারে এই রাজনীতির প্রাদুর্ভাব ঘটে দুভাবে। প্রথমত, কবি-লেখকগোষ্ঠীর মধ্যে আর দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের মধ্যে; কবিতার মধ্যে। তাই 'দেশ-কাল-পাত্র'র উপেক্ষা করে সাহিত্যে রাজনীতির গোছানো ঘরকন্না কিভাবে ছিল-আছে-থাকবে তা দেখে নিই 'ক্ষেপচুরিয়াস'এর পাতায় পাতায়...


ক্ষেপচুরিয়াস'এর পক্ষে
বাণীব্রত কুণ্ডু

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডায়রি

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডায়রি

খামচানো কালপৃষ্ঠা
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঠেলাগাড়িতে


দাদার অধিকাংশ সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে আমার পরিচয় দাদা কলকাতায় সিটি কলেজে পড়ার সময় থেকেই হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই আমাদের পাটনার বাড়িতে আসতেন । দাদার চাইবাসায় পোস্টিঙের সময়ে দল বেঁধে আসতেন বন্ধুরা । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চাইবাসায় তাঁদের কাণ্ডকারখানা নিয়ে নিজেদের মতন করে উপন্যাস লিখেছেন --- একই ঘটনা নিয়ে ।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল বহু পরে । শ্যামল দাদার কলেজের বন্ধু ছিলেন না ।উনি কখনও পাটনা বা চাইবাসায় আসেননি । আসেননি বলে আক্ষেপ করতেন । বলতেন, অনেক গল্প লিখতে পারতাম । মিস করলাম সুযোগটা । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল দাদার বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । দাদা পাটনায় থাকতেন বলে ওই বিশাল বাড়িতে থাকার জন্য বন্ধুদের অনুরোধ করতেন । কেউ রাজি হতেন না । বলতেন, ওটা কলকাতার বাইরে । তখন বাঁশদ্রোণীতে এখনকার মতন এত বাড়িঘর তৈরি হয়নি । প্রায় ফাঁকা ছিল । দাদার বাড়ি থেকে উষা ফ্যান মোড় পর্যন্ত রিকশা পাওয়া যেত না । এখন অটো চলে । উষায় মেট্রো ট্রেন স্টেশন তৈরি হয়েছে ।



বাড়িটা ফাঁকা পড়েছিল বলে দুশ্চিন্তায় ছিলেন দাদা । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রাজি হয়ে গেলেন বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে থাকতে । তিনি একাকীত্ব খুঁজছিলেন, বিভিন্ন কারণে । প্রথমত সুনীল-সন্দীপনদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে অবিরাম গল্প-উপন্যাস লেখার চাপ। দ্বিতীয়ত, তিনি প্রেমে পড়েছিলেন এবং সেকারণে পরিবার থেকে দূরে থাকতে চাইছিলেন । তৃতীয়ত, 'দারা শিকো' লেখার জন্য গবেষণা আর একাগ্রতার প্রয়োজন ছিল তাঁর ; কম বয়সী প্রেমিকাটি তাঁকে প্রচুর সাহায্য করতেন তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে ।

দাদার বাড়িতে যাঁরা গেছেন তাঁরাই জানেন সেখানে মশার দাপট কেমন । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ছিলেন তখন মশারা শুকনো মৌরি গাছ থেকে মৌরির মতন ঝরে-ঝরে পড়ত । দাদার বাড়িতে ঢোকার মুখে আট বর্গ ফুটের যে বারান্দা আছে তার মাপের বিশাল মশারি তৈরি করিয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার মধ্যে চেয়ার-টেবিল পেতে লেখালিখি করতেন । তাঁর সঙ্গে যাঁরা দেখা করতে আসতেন তাঁরাও বসতেনওই মশারির ভেতরে । দাদার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কেই দেখেছি পাঁজি মেনে দশকর্ম করতে, পৈতে পরতে, হোমযজ্ঞ করতে । একবার গিয়ে দেখি দাদার ছোটো সফেদা গাছ কাটিয়ে তার কাঠ দিয়ে যজ্ঞে বসেছেন ।

আমার সঙ্গে উনি সাহিত্যের আলোচনা করতেন না । কিন্তু আমার 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসটা প্রকাশিত হবার পর সেটা পড়ে জানতে চাইলেন টাকা গোলমালের ঘটনাগুলো সত্যি নাকি আমার কলম আমাকে দিয়ে ঘটনাগুলো লিখিয়ে নিয়েছে । আমি জানিয়েছিলুম যে ওগুলো আমার প্রথম চাকরি থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা । শুনে উনি 'আজকাল' সংবাদপত্রের হয়ে চলে গেলেন ব্যাঙ্গালুরু, সংবাদটা ফলাও করে ছাপলে বেশ সাড়া ফেলে দেয়া যাবে অনুমান করে । যাবার পথে আমার সঙ্গে দেখা করতেএসেছিলেন লাল টকটকে টিশার্ট পরে । ফিরে এসে বললেন, "ধ্যুৎ, অনেক পুরানো ঘটনা , তুমি তো ওই চাকরি করতে পঁচিশ বছর আগে, খেয়াল ছিল না" । ফলে 'আজকাল' সংবাদপত্রে উনি লিখলেন, বিয়েতেউপহার দেবার জন্য 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' একটি উৎকৃষ্ট উপন্যাস ।


আরকবার গেছি বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে । আমি মশারির ভেতরে বসে ওনার জন্য অপেক্ষা করলুম প্রায়আধ ঘন্টা । সিল্কের পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি পরে, পারফিউম মেখে বেরিয়ে এলেন । বললেন, তাড়াআছে । বুঝলুম যে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন । বাড়ির বাইরে বেরিয়ে কোনো রিকশা পাওয়া গেল না । মাথার ওপর দুপুরের রোদ । কিছুক্ষণ পর একটা ভ্যান রিকশাকে দেখা গেল গলির মুখে, সিমেন্টের ধুলোয় অত্যন্ত নোংরা, সঙ্গে দুটো সিমেন্টের বস্তা । । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে বললেন মোড় পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিতে । টের পেলুম, ইনিই আসল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বেশিক্ষণআড়ালে থাকতে পারেন না । অমন জামাই-সুলভ সাজগোজ করে দিব্বি বসে পড়লেন গুঁড়ো-গুঁড়ো সিমেন্টের ওপর । আমাকেও বসতে হল ওনার পাশে । দেখলুম উঠে বসতে গিয়ে ওনার পা বেশ ছড়ে গেছে । রুমাল দিয়ে পুঁছে নিলেন ।

মোড়ে নেমে বললেন, চলো ওই দোকানটায় । আমি ভাবলুম কিছু-কেনাকাটা করার আছে । উনি কিছুই কিনলেন না । সামনে রাখা সৈন্ধ্যব লবণের চটের বস্তা থেকে এক চিমটি নুন নিয়ে বললেন, "কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে শুনেছ তো ? দেখতে চাই তার প্রকৃত অর্থটা কী " !

ধারাবাহিক অবভাস - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

ধারাবাহিক অবভাস
(পর্ব - তিন)
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়



৩।

... তখন ঠিক কী কারণে আকাশে একটা তারাবাজি ফুটেছিল...


ফ্লাইওভারের ঠিক নিচে তাকে যখন ফেলে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ঠিক কী কারণে আকাশে একটা তারাবাজি ফুটেছিল, তা অন্যান্য অনেক কিছুর মতই জানা যায় না। ট্রাকের খালাসিরা, এক-দুজন করে, এক্সপ্রেসওয়ের ওধার থেকে প্রাতঃক্রিত্য সেরে নেমে আসার সময়ে তাকে দেখে। তবে, তাকে দেখার মত শুধু যা ছিল, তা তার অনিন্দসুন্দর গোড়ালি। এই একটা ভাবেই তাকে শনাক্ত করা যেত। আর সেটা একজনই পারত। বাকি কিছুর জন্য ফরেন্সিক রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হবে।

সে রাতটায় সে বিশেষ একটা ঘুমোয় নি। তবে একটা ঘোর ছিল। বেশ কিছু ছায়া ও ছবিরা তার ঘরের উত্তরমুখো দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ওই দেওয়ালের জানলা থেকেই এক্সপ্রেসওয়েটা দেখা যায়।

সে ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন সে ওঠে, বেলা গড়িয়ে গেছে। সমস্ত প্রামাণ্য সাক্ষ্য-চিহ্ন সহ। জটলারা আরও দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। কথারাও কান থেকে কানে ছড়াতে ছড়াতে হাওয়াকথা হয়ে গেছে।

সাক্ষাৎকার - মুখোমুখি বাণীব্রত এবং মৃগাঙ্ক

সাক্ষাৎকার life
- মুখোমুখি বাণীব্রত এবং মৃগাঙ্ক



বাণীব্রত কুণ্ডু শূন্য দশকের অন্যতম প্রধান কবি । মূলত ক্ষেপচুরিয়ান হিসেবেই পরিচিত । বাণীব্রত এর লেখায় একধরণের অতিলৌকিক চেতনা খুঁজে পাওয়া যায় । বানীব্রত থাকেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুর শহরে । পেশায় শিক্ষক এবং স্বভাবে আদ্যপান্ত এই কবি বরবরই প্রচারবিমুখ । সম্পাদনা করেছেন অন্বেষী , ক্ষেপচুরিয়াস প্রভৃতি পত্রিকা । এবার সেই বাণীব্রতকেই খুঁচিয়ে বের করে আনতে শূন্যদশকের আর এক প্রধান কবি মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলীর র‍্যাপিড ফায়ারের সামনে ফেলা হল বাণীব্রতকে । প্রায় তিন মাস ধরে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে আমরা জেনে নেবো এই সময়ের কবিতার ওপরে এই দুই কবি কী ভাবছেন ।

---------------------------------------------------------------------------------


অস্থি ছুঁয়ে থাকি এ কবিতা কোথার থেকে পেলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

কেন?
আমিই তো লিখেছিলাম। অন্য কোথাও দেখলে নাকি???
জানাও...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

না তা বলি নি
আমার মনে হয় কবিতা কোথার থেকে আসে... আমরা যেন তাকে কলম বন্দি করি।

বাণীব্রত কুণ্ডু

না, মৃগাঙ্ক!! কবিতাকে আমরা কলমবন্দী করি না বরং কোনো এক তুরীয় মুহূর্তের দুর্বলতায় (অবচেতন অবস্থায়) ঈশ্বর আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেন - এটা আমি মনে প্রাণে উপলব্ধি করেছি। তাই বিশ্বাসও করি। কারণ, যখন কবিতা লিখব বলে প্রস্তুত হই তখন তো কই কবিতা আসে না! আবার দেখো কোনো এক অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে - বাথরুমে, রাস্তায়, ভিড়বাসে কিংবা ক্লান্তিকর মুহূর্তে কবিতা আসে অনায়াসেই... কি করে হয়!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তাহালে কবিতায় কবি নিজের নাম দেয় কেন?

বাণীব্রত কুণ্ডু

দিই। কারণ, যেহেতু আমি কবিতা রচনায় 'ঈশ্বরের কর্তৃত্ব' স্বীকার করেছি তাই বলতেই হয়, কবিতায় কবি নিজের নাম দেয় ঠিক সেভাবেই, যেভাবে পিতা-মাতা তাঁর সন্তানের পরিচয় দিয়ে থাকেন। আমি মনে করি, নরনারীর মিলন-কামনা পার্থিব চেতনা থেকে আরম্ভ হলেও সেই মিলনের একটি পর্যায়ে আমাদের মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে থাকে। যখন আমাদের চিন্তনে বহিঃজাগতিক কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। যে একাগ্রতায় একজন ঋষি সমাধিস্থ হন সেই নিবিষ্টতাতেই নারীপুরুষের মিলনমুহূর্ত পরম সাধনার স্তরে উন্নীত হয়ে থাকে। তারপর সেই ভাবজগৎ-এর সমাপতনে আবার চেতনায় লৌকিকতা ন্যাস্ত হয়। তাই আমরা পার্থিব চিন্তাভাবনার প্রাধন্যতা বশতঃই সন্তানাদির নামকরণ করি এবং তাকে নিজের পরিচয়ে পরিচিত করে থাকি। সেইরূপ কবিতাকেও আমরা নিজের পরিচয়েই প্রকাশ করি অর্থাৎ কবিতার উপর আমার পার্থিব জনকত্ব প্রতিষ্ঠা করি।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আচ্ছা। কবিতা যখন পাঠকের হাতে তুলে দাও কি expect কর?

বাণীব্রত কুণ্ডু
যদি শুধুমাত্র 'পাঠক'এর কথা বলো তো বলি, - পাঠককে আমি উঁচু আসনে বসাই। যেমন, দাতা এবং দানগ্রহীতার সম্পর্ক (বর্তমানের নিরিখে নয়)। শাস্ত্র বলছে, যাঁকে দান করা হবে তাঁকে সশ্রদ্ধায় উচ্চস্থানে উপবেশন করানো হবে আর দাতা নীচে থেকে দুবাহু তুলে তাঁর দানসামগ্রী গ্রহণ করতে অনুরোধ জানাবেন। তাঁর কাছে দাতার এই প্রার্থনাই থাকবে , যেন তিনি প্রীত হন, এবং আশীর্বাদ করেন। যেমনটি আমরা পূজার্চনায় করে থাকি আরকি! ঠিক সেরকমই পাঠককুলের কাছে আমার এই expectation-ই থাকে যেন তাঁরা কবিতাটি পড়ে বিমল আনন্দানুভূতি লাভ করেন এবং আমায় আশীর্বাদ করেন!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

এটা একটু মহত্ত্ব দেখানো হয়ে গেলো না ? একটু ধার্মিক ধার্মিক?

বাণীব্রত কুণ্ডু

না, মৃগাঙ্ক! ব্যাপারটা ঠিক মহত্ব বলবো না। আমি যেমনটা শিখেছি তেমনভাবেই মানুষজনদের দেখি, বিচার করি, বুঝে নিই। আর যেখানে আমি নিজেকে কবি বলে মনে করি না; কিছু খেয়ালখুশি মতো লিখি, বন্ধুদের ভালো লাগে, ব্যাস্‌ এটুকুই! তখন মহত্ব দেখাবো কোথায়!! আর 'ধার্মিক' -এটাও আমি অন্যভাবে দেখি। কারণ ধর্মের আমি অন্য সংজ্ঞা জানি যে। যেখানে ধর্ম হল সেটাই যা সমাজকে ধারণ করে, অর্থাৎ সমাজের নীতি-নিষ্ঠাগুলোকে পালনের মাধ্যমে সামাজবদ্ধ মানুষকে সঠিক পথে; সত্যের পথে, সুন্দরের পথে, মানবধর্মের পথে চলতে সহায়তা করে। আজ যে সারা দেশব্যাপী এতো অরাজকতা তা তো 'প্রকৃত ধর্ম'কে আড়াল করে রাখার কারণেই। প্রসঙ্গত, আমি অভিমন্যুর কাহিনিটা বিশ্বাস করি। তথাকথিত 'ধর্ম'কে আমি বুঝি না। শুধু আক্ষরিক অর্থে তাদের সকলকেই সম্মান জানাই।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তোমার প্রিয় কবি কে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

এইটা সত্যিই একটা কঠিন প্রশ্ন। ছোটোবেলায় জানতাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সবাই বলত যে। মাধ্যমিকস্তরে নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট হলাম। 'সাম্যবাদ', 'আমার কৈফিয়ৎ', 'সর্বহারা', 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার'... তখন রবিঠাকুরকে শ্রেণিশত্রূ (শিক্ষামানের বিচারে)। জীবনানন্দ দাশ'এর কবিতা খুব ভালো লাগতো। 'রূপসী বাংলা', 'বনলতা সেন', 'আট বছর আগের একদিন'... ঠোঁটস্থ থাকত। তারপর আরো উঁচু ক্লাসে উঠলাম। আরো অনেক কবির কবিতার সংস্পর্শে এলাম। সুকান্ত ভট্টাচার্য, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং আরো এনেককেই পড়লাম। চিন্তা-ভাবনাগুলো মুহূর্তে মুহূর্তে ভাঙতে লাগলো। কবি আগে না কবিতা! কে বড়ো! কাকে ধরে এগিয়ে যাব! - এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মন বলল, কবিতা-কবিতা-কবিতা। আর তাই আমার ভালো লাগা কবিতার স্রষ্টা হিসাবে অনেক কবিই আমার খুব প্রিয়। অনেকের নাম বললাম। এঁরা ছাড়াও যাঁরা আমার কাছে অভিভাবকের মতো তাঁরা -শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জসীম উদ্দীন, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, শুভ দাশগুপ্ত, মল্লিকা সেনগুপ্ত, জয় গোস্বামী এবং আরো কেউ কেউ... আমার সমস্ত প্রিয় কবিতার স্রষ্টাই আমার প্রিয় কবি। এভাবেই বলতে হল।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

প্রিয় কবিতা ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

এই প্রশ্নের উত্তরেও তো আমি কোনো একটি কবিতার উল্লেখ করতে পারব না। অনেক কবিতার কথাই বলতে হবে। মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কবিতার 'প্রিয়'-উপাধি। এখন যেমন আমার খুব মনে পড়ছে ব্রত চক্রবর্তী'র 'মিলিদি' কবিতাটি। তাই বোধহয় তা উল্লেখ করতে গিয়ে এই আলোচনার পাতা দীর্ঘ করে লাভ হবে না। কি বল তুমি...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


ধর এই মুহূর্তে তোমার যে কবিতা টি মনে আসছে বল

বাণীব্রত কুণ্ডু

ওই যে বললাম, 'মিলিদি'।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

পুরো কবিতাই নাকি তার কিছু লাইন

বাণীব্রত কুণ্ডু


কবিতাটির কোনো লিখিতরূপ আমার কাছে নেই... বহুদিন আগে কোথাও শুনেছিলাম। আর দুবছর আগে লাস্ট পড়েছিলাম। তবু মনে পড়ে।পুরো বর্ণনাটাই পড়ে আবছা আবছা, আর শেষের সেই ক'লাইন তো ভুলতেই পারি না... (কোট করলাম না) - দুটো দেশ পারল, দুটো নদী পারল, দুটো মানুষ পারল না...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

হঠাৎ এই লাইন দুটিই এখন মনে এলো কেন ভাবে দেখলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু


কারণ, আজ বিকাল থেকে আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে অনেক কথা হচ্ছিল, ইভেন এখনো হচ্ছে। ছোটো থেকেই তাঁর জীবন অনেক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। তাও আবার তাঁর বাবার কারণেই। আমি ভাবতে পারছি না, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও 'মেয়ে' বলে তার কোনো মতামত থাকবে না তাঁর পরিবারের কাছে!! তাঁর সমস্ত সখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়েছে... দূরে পোস্টিং পাওয়ার কারণে চাকুরিতে জয়েন করার পার্মিশান দেওয়া হয়নি...ভাবা যায়!!! এই রকম অনেক কিছু কথা হল। যদিও দুটোর বিষয় হুবুহু এক নয় তবুও জীবনের যে দ্বন্দ্ব, যে টানাপোড়েন সেই অনুভূতিটা এক হওয়ার কারণেই এখন আমার মাথার মধ্যে কবিতার ঐ লাইনগুলোই মনে আছাড় খাচ্ছে বারংবার...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


তোমার নিজের লেখা কোন লাইন মাথায় এলো না কেন ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
প্রথমত, নিজের লেখা লাইন সেভাবে মনে থাকে না আর থাকলেও ওই প্রসঙ্গে কিছু লেখা নাই বা তত ভালো লেখা নাই। দ্বিতীয়ত, নিজের লেখা মনে রাখার মতো কিছু হয় বলে মনে হয় না। আজ যা লিখি কাল তা আর ভালো লাগে না। হয়তো তাই... তৃতীয়ত, একটা লাইন এসেছে মাথায় - হয়তো একমাস-দুমাস কিংবা আরো পড়ে কোনো এক তুরীয় মুহূর্তে কবিতা আকার নেবে ভাবনাগুলো।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আমি একজনকে তোমার কবিতা পড়তে দিয়েছিলাম। সে বলল অতি জঘন্য লেখা। লেখার হাতই তৈরী হয় নি।

বাণীব্রত কুণ্ডু

যেকোনো মতামত প্রত্যেকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর উপর তৈরী হয়। তিনি তাঁর স্বাধীন মত জানিয়েছেন। হতেই পারে তাঁর ভালো লাগেনি, কিংবা আমার 'লেখার হাত তৈরী হয়নি'। তেমনি আবার অনেক সমসাময়িক এবং অগ্রজকবি প্রশংসাও তো করেন। এই দুপক্ষই আমার সম্মানীয়। আমি উচ্ছ্বসিতও হচ্ছি না। আমি হতাশও হচ্ছি না। যেটুকু আমার নেওয়ার আমি নেব আর বাকিটুকু... মিলিয়ে যায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

এই নেওয়াটুকু কোথাও কাজে লাগে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

অবশ্যই। অবচেতনে, মনের মধ্যে সেইকথাগুলো ছায়ার মতো থাকে। হয়তো প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব ফেলে না। পরোক্ষভাবে চিন্তা-ভাবনায় প্রভাব রাখে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

ঠিক বুঝতে অয়ারলাম না। আর একটু ভেঙে বল

বাণীব্রত কুণ্ডু

ধর, যেমন তুমি বললে যে - একজনকে আমার লেখা পড়িতে দিয়েছিলে তাঁর 'জঘন্য' লেগেছে। এই শুধুমাত্র দূর থেকে জঘন্য লাগাটা আমার মনে কোনো দাগ কাটবে না। যদি তিনি আমাকে বুঝিয়ে দেন কেন 'জঘন্য' -আমি অবশ্যই ভাবব। এবং সেক্ষেত্রে ওই ভাবনাগুলো আমার মনের মধ্যে আমার অবচেতনে; হয়তো যখন আমি কোনো অন্য কাজেও ব্যস্ত থাকি, তখনও নিজে নিজেই গঠনশৈলীতে প্রবেশ করে। রচনারীতি পালটে দেয়। লেখা শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত যা আমিও জানতে পারি না - এরকমই মনে হয়!! আর প্রশংসার ব্যাপারেও একই কথা। আরো উন্নত করার কথা ঘুরপাক খেতে থাকে আমারই অজান্তে। বোঝাতে পারলাম কি!!

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তুমি তো বলো ঈশ্বর কবিতা লেখান।

বাণীব্রত কুণ্ডু

হ্যাঁ। লেখার মুহূর্তে সেই শক্তি কাজ করেন। অবশ্যই করেন।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তাহালে তুমি কি বল তার ওপর কারো মতামত প্রভাব ফেলে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

মানে কি - ঈশ্বরের উপর ব্যক্তিমতের (কবি/সমালোচক) প্রভাবের কথা বলছো কি??? একটু বল প্লিজ্‌...

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তুমি বললে ঈশ্বর কবিতা লেখান। আবার কারো মতামত কবিতায় প্রভাব ফেলে তাই জানতে চাইছি

বাণীব্রত কুণ্ডু

হ্যাঁ। কারোর মতামত যা প্রভাবিত করার আমাকে করে। আমার অবচেতনে। কবিতা লেখার সব আয়োজন (অগোছালো ভাবেই) আমার ভিতরে হয়ে থেকে। যখন লেখা আসে, ঘোর আসে তখন লেখা বেরিয়ে আসে আপনগতিতেই!! এখন পর্যন্ত আমার যেরকম অনুভূতি হয়। ঠিক যেন, সবজি-তরকারি কেটে রাখি আমি আর সেগুলো প্রয়োজন মতো প্রয়োগ করে মশলাপাতি (শব্দচয়ন, শব্দপ্রয়োগস্থান, ব্যাকরণ, বাক্যনির্মাণ, ভাবসংযোজন ইত্যাদি) দিয়ে সুস্বাদু করে পরিবেশন করেন সেই ঈশ্বর। আমার ধারণা। কারণ আমি আগাপাশতলা সামাজিক হোই-চৈ-এর মধ্যে থেকে হয়তো স্লোগান লিখতে পারবো, পোস্টার লিখতে পারবো...কিন্তু কবিতা!! পারি না।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


নতুন যে কবিতার বই এবছর প্রকাশ পেয়েছে। তার মধ্যে কোনো বই পড়েছ ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
এ বছরের প্রকাশিত...নাহ্‌! কোনো বই পড়িনি এখনো। কারণ, বইগুলো কেনা হয়নি। ওহ্‌, একটা বই অবশ্য কিনেছি। কিছুটা পড়েছিও বটে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আগের বছর ?

বাণীব্রত কুণ্ডু


হুম। আগের বছরের পড়েছি। "ভালোবাসার জন্য" - বোধিসত্ত্ব বন্দ্যোপাধ্যায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

কেমন লেগেছে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

ওভার অল ভালোই লেগেছে।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী


কিসের বই ছিল ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

কবিতার বইই ছিল।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তার থেকে পড়া কোন ভালোলাগা ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
ওনার কবিতায় একটা বাস্তব, মানসিক দ্বন্দ্ব, আবেগ এবং আত্মকথন-এর অদ্ভূত মেলবন্ধন তৈরী হয়। যা কবিতা পড়াকালীন মনকে কোনো এক মায়ারাজ্যে প্রবেশ করায় সহজ সাবলীলতায়। যেমন দেখো, - উনি লিখছেন,
"যাদের মুখ নির্বাসন দিয়েছো
তাদের শরীর আবার কেন টেনে আনতে চাও
ভালোবাসার জন্য তারা হাটে বসে আছে
তাদের হাতে একটা করে গোলাপ তুলে দাও।"
তারপর ধর, -
"ঈশ্বর, - তুমি ভাঙলে যখন আমায়
আমার বাউল সহাস্যে বসেছিল তোমার দাওয়ায়"
এরকম আরো অনেক শব্দবন্ধ কবিতায় মোহজাল বিস্তার করে যায় কবির।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

বাহ তোমার তো দারুণ মেমারি গো। আমাকে তো জিজ্ঞেস করলে এরকম বলতেই পারবো না।

তোমার প্রথম কবিতা লেখা কবে ?

বাণীব্রত কুণ্ডু
না না, মেমারী নয়। বইটা আমার কাছেই তো আছে।

প্রথম লিখি ভূতের গল্প। স্কুল ম্যাগে। তারপর কবিতা লিখেছিলাম কিন্তু স্যার সিলেক্ট করেছিলেন না। এখন বুঝি কেন ! তারপর দীর্ঘদিন লেখা হয়নি। কলেজ লাইফে আবার শুরু হয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক লিখেছি। এখন সেগুলোর দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না। তবু স্যারকে দেখিয়েছিলাম। উনি আবার অনার ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাডে আমাকে একটি সংশাপত্র দিয়েছিলেন। তারপর থেকে লেখাটা নিয়মিত করার চেষ্টা করি। আর লিটল ম্যাগে প্রথম লেখা ছাপা হয়েছিল তা ২০০৬সালে। স্বর্গীয় কাশীনাথ ঘোষ সম্পাদিত "সেই সন্দীপন" পত্রিকায়।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

আচ্ছা বলত এটা কেন হয়? দুই কবিতাই তো 'ঈশ্বরের লেখা'। তবে আগের লেখা কেন ভালো লাগে না?

বাণীব্রত কুণ্ডু


ওই যে, আমি যদি রান্নার যোগাড়ে শাক, উচ্ছে, কচু প্রভৃতি কুটে রাখি তা দিয়ে তো আর পোস্ত, পনির কিংবা মালাইকারি তৈরী হবে না!! তখন আমার যে সঞ্চয়, যে অর্থবোধ, যে শব্দভাণ্ডার কিংবা শব্দপ্রয়োগকৌশল বর্তমানের মতো ছিল না তাই এখন যখন আমি ভালো ভালো খাবারের সংস্থান করতে পারছি তা দিয়ে তো সুস্বাদু রান্না হবেই। তাই আর সেই শাক, উচ্ছে, কচুর দিকে মুখ ফেরাতে ভালো লাগে না।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী
কবিতায় পরীক্ষা নিরিক্ষা কে কি চোখে দেখ?

বাণীব্রত কুণ্ডু

পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবসময়েই ভালো। যে কোনো ক্ষেত্রেই তা হওয়া উচিত। তবে সেটা ভালো হলেই ভালো। কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে কবিতাতে বেশকিছু অসভ্যতা চলে। যেটা সুস্থ সংস্কৃতির বিরোধী বলে মনে করি।

সম্ভবত বছর তিনেক আগে ‘কবিসম্মেলন’এর মতো পত্রিকায় একটি কবিতা পড়েছিলাম। এবং সেই প্রথম আমি কোনো কবিতা পড়ে লজ্জাবোধ করেছিলাম। কবিতাটির উল্লেখ করতে চাই না কারণ, এভাবেই ঐ সমস্ত কুৎসিত কবিতা উদাহরণে উঠে এলে বাংলা কবিতা সম্পর্কে ভ্রান্তধারণাই প্রতিষ্ঠা পাবে। এসময়ে বেশ কিছু লেখায় দেখি কতকগুলো শরীরীশব্দ বসিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা হচ্ছে। এখানেই আমার আপত্তি। এইকথা শুনে কিছুসংখ্যক কবিতালিখিয়ে রে রে করে ছুটে আসবে। কৈফিয়ৎ চাইবে... কেন বাপু... দিনে-দুপুরে-রাতে শরীর ঘেঁটে ‘ঘ’ করে দিচ্ছ দোষ নেই আর আমরা কবিতায় একটু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বসিয়ে দিলেই যত মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বুঝি!! শুধু কবিতায় নয় সাহিত্যেই শব্দের যথার্থ প্রয়োগচেতনা বড়ো প্রয়োজন। যেমন আমরা সারমেয়বৎ সহবাস করি না তেমনই শব্দেরও আব্রূর প্রয়োজন আছে। আব্রূই সৌন্দর্যের প্রকাশক।

মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলী

তোমার কি মনে হয় এটা ইচ্ছাকৃত?

বাণীব্রত কুণ্ডু
লোকে বলে। আমিও জানতাম যে – মদ খেলেই মাতাল হয় আর মাতাল হয়ে গালিগালাজ করে। কিন্তু এটা সত্যি নয় মৃগাঙ্ক! যেহেতু মাতাল অবস্থায় মনের উপরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাই, মাতাল হলে আমাদের ভিতরকার প্রকৃত রুপটির নির্বাধ প্রকাশ ঘটে যায়। তখন যাঁর মধ্যে যেমন প্রবণতা থাকে সে তেমন আচরণই করে। সেখানে কোনো নাটক নেই। আর আমরা যাঁরা কবিতামদে মাতাল হই; যখন মাতাল হই অর্থাৎ কবিতা লিপিবদ্ধ করার সময় আমাদের ভিতরকার সেই প্রকৃত প্রবণতা অনুযায়ী কবির ভাষাব্যবহার, শব্দচয়ন, রচনারীতির প্রকাশ ঘটে। তাই সাহিত্যে যাঁরা শব্দকে বে-আব্রুভাবে, অশ্লীলভাবে গ্রন্থণা করেন হয়তো তাঁদের জীবনবোধও অনুরূপ! তাই ‘ইচ্ছাকৃত’ বলতে পারছি না।

ধারাবাহিক বিলাভারত – অভীক দত্ত

বিলাভারত
অভীক দত্ত



( মহাভারতের বিলা-রূপ, ভদ্রলোকের পড়ার জন্য নয়, এবং তারা এই লেখাটি পড়লে আমায় কু-শীল ইত্যাদি আখ্যা দিতে পারেন, তাই তাদের কাছে শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এবং দরজা দেখিয়ে দিচ্ছি।

কথায় আছে যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে। মহাভারত একটা ভাল ব্যবসা। শুধু মহাভারতকে বেস করেই প্রচুর পাবলিক করে কম্মে খাচ্ছে। আমার এই লেখা সেই ধরণের লেখাও বলা যায়, নাও বলা যায়। বিলাভারত লেখা শুরু করলাম মহাভারতের মাঝখান থেকে। যখন গল্প অনেকটাই শুরু হয়ে গেছে। জনগণের মতামতই এই লেখার ভবিষ্যৎ। )


কৃষ্ণা জয় সাঙ্গ হলে পাণ্ডবরা তাকে এনে মায়ের কাছে গেলে পৃথা বলে দিলেন যা ভিক্ষা এনেছ সবাই মিলে ভোগ কর। আর কি করা? কেলো যা হবার তা তো হলই। তখনকার দিনে তো থু থুক্কি ব্যাপারটা ছিল না। যা হইসে হইসে এবার চেপে যা পাগলা সেরকমটাও না। আর কৃষ্ণার ফিগারখানা ছিল রাঁচি হিলে পাটনা হিলে দিল্লি হিলে টাইপ। বাকি ভাইগুলো দেখেই হাত টাত মেরে নিয়েছিল। বৌদি বলে বেশি লোভ দিতে পারছিল না। কিন্তু কুন্তী একবার বলে ফেলেই... মানে ভিতরের ইচ্ছাটা সবারই ছিল, কেউ বলতে পারছিল না, কিন্তু কুন্তী বলে দিয়ে বিপদ ডেকে আনলেন।

শেষমেষ আর কি করা। কৃষ্ণ যখন এলেন তখন সবাই তাকে মোড়ল ভেবে ঘিরে ধরলেন। কৃষ্ণ পড়লেন মহা বিপদে। দিব্যি বোঝা যাচ্ছে এদের সবারই কৃষ্ণাকে দেখে ইয়ে হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সবাই কিরকম ভদ্র হয়ে জিজ্ঞেস করছে তাকে। পাবলিক পালস বুঝে তাই কৃষ্ণ এক গল্প দিয়ে দিলেন। কি সেই গল্প? পুরাকালে নাকি এক সুন্দরী মেয়ে বিয়ে না হবার জন্য কান্নাকাটি করছিল, তখন মহাদেব এসে তাকে বর দিতে বলায় সে পাঁচবার বলে দেয় তার ভাল বর লাগবে। মহাদেব তথাস্তু বলায় তার পাঁচজন স্বামী হয় পরবর্তী জন্মে। সেই মেয়েই দ্রুপদ রাজের কন্যা। দ্রৌপদী। আর প্রত্যেকবার প্রতিটি স্বামীর সাথে মিলনের সময় কৃষ্ণা কুমারী হয়ে যেত ব্যাসদেবের আশীর্বাদে। মানে কি সুন্দর সেটলমেন্ট। ভাবাই যায় না। পুরুষের ভোগের জন্য একটা মেয়েকে দিয়ে যতরকম এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব তাই করে গেছেন ব্যাসদেব।

ওদিকে দ্রুপদ রাজের স্বয়ম্বর সভায় ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। রূপে গুনে ডবকা কৃষ্ণার স্বামী হবার জন্য দুর্যোধন, কর্ণ, শল্য, জয়দ্রথ সবাই এসেছিল। কিন্তু কর্ণ সূতপুত্র বলে কৃষ্ণা তাকে ডিসকোয়ালিফাই করে দিলে। জাতপাতের রাজনীতির এক নিকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে আর কি। সেই বলে না, তেরে পাস ক্যা হে? মেরে পাস বাপ হে। তা কর্ণর কাছে বাপ ছিল না বলে সে রাজকন্যে পেল না। দুর্যোধন তো চিরকালই মুখে মারিতং জগত। সবাইকে হারিয়ে অর্জুন দিব্যি জিতে গেছিল।

যাকগে, ব্যাসদেব, কৃষ্ণ প্রমুখ দৌত্যের কাজ টাজ করে দ্রুপদকে অং বং বুঝিয়ে রাজি করিয়ে নিলেন। আর তখনকার দিনে ভগার নামে ঢপ দিলে পাবলিক খুব খেত। দ্রুপদও খেয়ে নিলে। অতঃপর রোশনাই সহযোগে শাদি বিয়া যা হবার তা হয়ে গেল, একটা নয়, পাঁচটা বরের সাথে।

জতুগৃহ থেকে পাণ্ডবরা বেঁচেছে, আর দ্রৌপদির মত একটা চরম মাল পেয়ে গেছে, এই দুটো খবর কৌরবদের কাছে ডুয়াল শক হয়ে গেল। বিদুর চিরকালই মহাভারতে বিভীষণের পার্ট প্লে করে এসেছে। সে ধৃতরাষ্ট্রকে জানাল কৌরবরা জিতেছে কৃষ্ণাকে। তাতে ধৃতরাষ্ট্র মহা খুশি হওয়ায় বিদুর এক্সপ্লেন করল অর্জুনরাও আসলে কৌরবই তো। মানে বৃহত্তর কমিউনিস্ট পার্টির মত একটা হৈ হৈ ব্যাপার আর কি। ধৃতরাষ্ট্রের ঝাট ফাট জ্বলে গেলেও মুখে কিছু বলল না। বিদুরের মত পাবলিকেরও তো দরকার। তাছাড়া দাসীর ছেলে হলে কি হবে। পাব্লিকে তো জানে ভাই। তাই আর কি করা।

তখনকার দিনের লোকেরা ভদ্র ছিল মুখে। আদতে বদের হাড্ডি ছিল। নিজেদের বউদের ব্রাম্ভনদের দিয়ে ইয়ে করাত। নিজেরা যখনই কনফি পেত না তখনই ওই সব করার দিকে ঝুঁকত। মহাভারত পড়লে জানা যায় বেশিরভাগই লোকই তাদের বাপের ছেলে নয়। মূলে বলা আছে কুন্তী বিয়ের আগে সূর্য, পরে পান্ডুর সাথে বিয়ের পরে ধর্ম, পবন, ইন্দ্রর সাথে ইয়ে করে কর্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনকে পয়দা করেছিল। মাদ্রীর ছিল কম বয়েস। পান্ডু কুন্তীর হেল্প চাওয়ায় কুন্তী মাদ্রীকে যে কোন একজন দেবতাকে ডাকার ব্যাপারে হেল্প করতে চায়। কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যায়। অশ্বিনীকুমার ভাইরা ছিল জমজ। মাদ্রী বুঝল যৌবনের যা জ্বালা তাতে একটা দিয়ে হবে না। সে যমজ দেবতাকেই ডেকে নিল। এতে কুন্তী খচে ব্যোম হয়ে গেল। আদতে পান্ডু কি ছিল? আদৌ কি কোন অভিশাপ ছিল তার উপরে? নাকি তার নাম থেকেই গান্ডু শব্দটার উৎপত্তি?

তখনকার দিন বলেই না, এখনকার দিনেও ঐতিহাসিকেরা বা বুদ্ধিজীবীরা নিরপেক্ষভাবে কিছু বলতে পারে না, কোন না কোন দলের ধামাধরা হতেই হবে তাদের। আসলে নাকি দুর্যোধনের আসল নাম ছিল সুযোধন। কোন বাপ তার ছেলের বদ নাম রাখে? আসলে এ সবই ছিল দুর্যোধনের চরিত্রে কালি মাখানোর ছল। অর্জুনের জন্য একলব্যের বুড়ো আঙুলটা গেল।সে ব্যাপারটা কিন্তু সেভাবে হাইলাইটেড হল না।

যাক গে, ধান ভাঙতে শিবের গীত না করে আবার ফিরি যেখানে ছিলাম। দ্রোণ, বিদুর, ভীস্ম প্রমুখের পরামর্শে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের ডেকে নিলেন হস্তিনাপুরে এবং অর্ধেকরাজ্যও দিয়ে দিলেন। সেখানে নারদ এসে তাদের ডেকে একটা মিটিং করে সুন্দ উপসুন্দের গল্প শোনালেন। যে একটা মেয়ের জন্য কিভাবে তাদের জীবনের বারোটা বেজে গিয়েছিল। তখন পান্ডবেরা গোল টেবিল বৈঠকে বসে একটা ভদ্রলোকের চুক্তি করল যে দ্রৌপদি প্রতি ভাইয়ের কাছে এক বছর করে থেকে সংসার করবে। যদি সেই সময় অন্য কোন ভাই তাকে দেখে ফেলে তবে সেই ভাইকে বারো বছর ব্রম্ভচারী(এইখানে শর্ত আছে, ব্রম্ভচারী শুধু দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে) হয়ে বনবাসে যেতে হবে।

এই নিয়মের বলি হয়ে গেল অর্জুন। গরু চোরেরা ব্রাম্ভনের গোরু নিয়ে ভাগছিল দেখে তারা অর্জুনের কাছে এসে বিচার চাইল। ওদিকে অর্জুনের অস্ত্র ছিল যুধিষ্ঠিরের ঘরে, অর্জুন রাজধর্ম পালনের জন্য সেই নিয়ম সত্ত্বেও ঘরে ঢুকে অস্ত্র নিয়ে গরুচোর ধরতে বেরিয়ে গেল, আর ফিরে এসে নিজের চুক্তিভঙ্গ নিজেই স্বীকার করে বনবাসে চলে গেল।

এখানে প্রশ্ন ওঠে অর্জুন কি ইচ্ছা করে এই কাজ করেছিল? কারণ হিসেবমত যুধিষ্ঠিরের পর ভীম তারপরে পালা ছিল অর্জুনের। মুখে না বলুক, আদতে অর্জুন তো মানুষই ছিল। দ্রৌপদী তো আসলে তারই বীরত্বের দ্বারা প্রাপ্ত। সেখানে বারোয়ারি হয়ে গেল, আর তার নম্বর আসতে লাগল দু ভাইয়ের পরে, এটা অভিমান ছিল না তো আসলে? নাকি দ্রৌপদী যখন দুভাইয়ের ঘরে থাকবে তখন ঘরছেড়ে বেরিয়ে বাইরে অন্যকিছু করার ছক ছিল? কারণ ঘরছাড়া অবস্থাতেই উলুপী, চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রাকে বিয়ে করে। দ্রৌপদী অর্জুনকে নিয়ে বরাবরই পজেসিভ ছিল। যখন অর্জুন সুভদ্রাকে নিয়ে ফিরল তখন মান অভিমান বেশ ভালই হয়েছিল। শেষমেষ অনেক কষ্টে পোষ মানে কৃষ্ণা।

মহাপ্রস্থানপর্বে এই কারণেই যখন কৃষ্ণার মৃত্যু ঘটার পূর্বে যুধিষ্ঠিরের কাছে সে জানতে চেয়েছিল কেন সে জীবিত অবস্থায় স্বর্গে যেতে পারবে না, তখন যুধিষ্ঠির তাকে এই কারণটাই বলেছিল, কৃষ্ণার বিয়ে হয়েছিল পাঁচ ভাইয়ের সাথে কিন্তু তার মন সবসময় অর্জুনকে প্রেফার করে এসেছিল। সেটাই ছিল তার দোষ। অন্য স্বামীদের সাথে মিলনে দ্রৌপদী অর্জুনকেই কল্পনা করতেন। সেটাই তার অপরাধ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এইভাবেই ব্যাখ্যা করে দ্রৌপদীর পাপ।

অথচ কৃষ্ণা কিন্তু অর্জুনকে মন থেকে বরণ করেছিল। যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল বা সহদেব কাউকেই সে চায়নি। চেয়েছিল যাকে তার সাথে ফাউ হিসেবে দেওয়া হল আরও চারজন পুরুষকে। তালিবানদের সাথে পার্থক্য আছে কিছু?

(চলবে)

দুটি কবিতা - দেবযানী বসু

দুটি কবিতা - দেবযানী বসু
নামান্তর- ১


তাকিয়ে দেখার কিছু আছে বলেই বুট ও বুটিকের প্যাঁচানো রিবননাচ ভালো লেগে যায়। লটারিতে বার বার উঠে আসছে গুঁড়ি মাকড়শাটি। লালচে ইতিহাসের খুচরো সাজাতে সালতামামির বাহারিপাম আর পাথরের হাতি নড়ে চড়ে বসছে ... বারবার। উজ্জ্বয়িনী মালব্যর হাতে গড়া রুটি অবধি পৌঁছেছি মাত্র। হরিণের ত্বকে লেখা রন্ধন- প্রণালী। হরিণ মাংসের। যে কোনো অধিবেশনের শেষে কাচের খাবার টেবিল পুরোপুরি ভাঙেনি কোনো ইতিহাস। এইরকম টেবিলের নিচে লালচে নুড়ির আলোয় কিশোর মমির কৈশোরকাল পড়ি।


নামান্তর- ২

একজন মাত্র ক্রেতা, খেলা ও খেলাৎ সবই তার জন্য। মেলা ও পসরা দুসরা হাত ঘুরে কোথাও যাবে না। আসল দরজার আন্তরিক অবস্থান খুঁজে ফিরি। আঞ্চলিক অবস্থান বলে দেয় ঠুকঠাক মিথ্যে কিছু। মুখের আউটলাইন ধরে কোলকাতার ভোর আসছে। তার দেয়াল চিত্র জুড়ে খামওয়ালা সৌধ , লুকাচ্ছুপা চুরি। কোলকাতার রূপকাঁথায় শৈশবের সইসাবুদ । মানুষ গুনতে গিয়ে, কোকিল গুনছে। গুণাগার নেই । ভিড় জমানো নীড়ে বারোমাসে কোকিলের কুচকাওয়াজ আওয়াজ ইত্যাদি ।

কবিতা - উৎস রায় চৌধুরী

একটি সংগ্রামের নর
উৎস রায় চৌধুরী


কি আছে বলার
সাদা পথ ,
লুকিয়ে রাখা সব-
ওরই ভেতর খুঁজে নাও,
শ্রমিকের ইতিহাস-
ওরই পাশে উন্মাদ হাসে,
হাসে অসহিষ্ণু পাগল-

কি কাগজে লেখো
কলম ও ঢেউ,
সবই তো ক্ষয়বোধ-
ওরই কাছে জঠরে বাঁধা,
ভাঙা প্রজাতি গান-
ওরই জীবনে নিঃসঙ্গতা বোধ,
রক্ত জলের মান ।

কবিতা - বিদিশা সরকার

বৃত্তি
বিদিশা সরকার


নিহিত ছিল কি কোনো স্বপ্ন
সে দাঁড়ায় ছেনাল মুদ্রায়
আলো আঁধারির কাছে বহুগামী পথ এসে থামে
তখন নৌকার পাটাতনে
আধপোড়া সিগারেট গুঁজে দিলো
নিভে গেল ত্রিবলী আক্ষেপ
বেকসুর চাঁদ ব্রিজের ওপরে আধখানা
হত্যাদৃশ্য রক্তপাতহীন
ঈশ্বর তাদের কাছে বেনামী খদ্দের ।

কবিতা - পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ-এর দুইটি কবিতা
ইতি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়


ফুলের বাগানে আর্তসুরভি;
ডেটলেও সারবে না এমন গুপ্তক্ষত।
রাতের রাস্তায় জোচ্চোর তারার সাথে
পাল্লা দিয়ে ফেরি করে বেড়াচ্ছি
পোড়া হিরোশিমা।

ভালোবাসি আরব গেরিলা,
ভালোবাসি সোনালি রুবির দিকে
অনন্ত হীরাযাত্রা।

এমন দেবগ্রস্ত
ক্রীতদাস-জনম
ক্রীতদাসী জনম!
মানুষজন্ম পেলে
আমার সব স্বর্গীয় অসুখ
ঠিক সেরে যাবে।



শিমুলপুর থেকে


হায় ঈশ্বরী, হায় গায়ত্রী,
অনুনয় ও সমর্পণের ভঙ্গিকে ভস্ম করে দিয়ে
বিনয় মজুমদার ছাই হয়ে যাচ্ছে।
সুনীল মাছের ওমে
কে শুষে নেবে
তোমার গায়ের শীত?
ফুল ও চকোলেটের ঘ্রাণে ভুলে যেও
আকাশের অলীক আশ্বাস।

মাঠে এত ভুট্টা ফলেছে
তবু কারও শব্দেরা যাবে না আর
লোডশেডিং কিংবা নক্ষত্রের দেশে।

দুই

শিমুলপুর
       বিনোদিনী কুঠি
    কার্তিকের মিহি কুয়াশায়
                  গায়ত্রীর ন্যায় চাঁদ।
                          পৃথিবীতে
অঘ্রাণের এমন অভূত ইন্দ্রজাল
        ছড়িয়ে যায়
                  উন্মাদ বিনয় মজুমদার।

কবিতা - শুভদীপ মৈত্র

নিবেদিতা মুন্সি
শুভদীপ মৈত্র

নিবেদিতা মুন্সি
ভোর পাঁচটায় ধরে লেডিজ ট্রেইন,
দুপুরের খিদে মেটে নিভৃত রেস্তোরাঁয়
বিদেশী ডিওডোর‍্যান্ট বিকেলে মিলিয়ে যায়
জানে শুধু নিবেদিতা মুন্সিই জানে।

জানে শুধু নিবেদিতা জানে
শহরের ঘুঘু ফাঁদ দেখে শুধু
আর দেখে কাঁধ বাদুড়ের চোখে।
কলসেন্টারে ফোন নিতে নিতে
কতো বেলা বাড়ে ভুলেছে বেবাক
নিবেদিতা মুন্সিই শুধু
নিবেদিতা মুন্সিই শুধু।

মাতাল বিকেলগুলো এসএমএস করে
রয়েছে দাঁড়িয়ে পার্কস্ট্রিট মোড়ে,
ফুটপাথ থেকে কেনা জিনস আর টপে
বিছানায় নিয়ে যেতে প্রেমিকের ঢপে
থাকে শুধু নিবেদিতা থাকে
থাকে শুধু নিবেদিতা থাকে,
রোজ রাত্তিরে ফেরে ঘামে ভেজা ট্রেনে
রোজ রাত্তিরে কী হয় কে জানে।

ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়াত সে জানলায়
একদিন চলে গেল চাঁদের মহল্লায়
তাকে নিয়ে গেল ডেকে দেবদারু পাতা
দুধ সাদা মেঘ আর একা বেঁচে থাকা।

চলে যায় নিবেদিতা
চলে যাবে নিবেদিতা
চলে গেল নিবেদিতা
খবর নেয়নি কোনো লেডিজ ট্রেইন
আর গায়ে পড়া ভিড়,
প্রেমিকের এসএমএস আসে নি গো
ভুলে গেল তাকে পিঁপড়ে শহর।

নিবেদিতা মুন্সি কি ছিল?
নিবেদিতা মুন্সি কি এ শহরে ছিল?
জানে শুধু দেবদারু গাছ
জানে শুধু সন্ধ্যের মেঘ।



কবিতা - মিলন চট্টোপাধ্যায়

হনন মিলন চট্টোপাধ্যায়


বারবার সীস পাল্টালাম
শুধু আঁচড় পড়লো খাতায় ।
কবিতা'র চিকিৎসা জানিনা বলে
দৈব জানিয়ে গেলো -
কলমে পক্ষাঘাত ।

মননের শীতঘুম এলে
অন্তহীন সূর্যের অপেক্ষায় থাকে কাল ।
আজ থেকে -
অন্ধকারের সমার্থক হল আলো !

প্রতীক্ষায় থাক্‌ ~ অলৌকিক জিয়োনো সকাল ।

কবিতা - রত্নদীপা দে ঘোষ

মন্দকাল রত্নদীপা দে ঘোষ


আকাশের মাপ ছেঁড়া ব্লাউসের হাতা
বৃন্তটি সাজানোর সময় হাল্কা বাদামি সূর্যের ন্যায়
সবাই ভাবছে তোমার অসাবধানতা
পাড় বুঝেছে পয়ারের উপায়হীনতা

হাফ অ্যান্ড হাফ হেমন্ত
পরব হতে ব্রেসিয়ারের ঢেউ
আগুনটি গজানোর তুষ উদ্বিগ্ন কাণ্ডমুখ
আমিও ফাঁকা হয়ে যাচ্ছি তোমার ভ্যানিটি-ব্যাগে

স্নায়ু সামলানো সিগারকে ডেকে বলি সন্তকথা
ধোঁয়ার ফিশারিজ যখন তুমি হয়ে যাও ...


কবিতা - মেঘ অদিতি

মেঘ অদিতি এর দুটি কবিতা
অর্জুনের পাতা


নিদ্রাহীনতার খুব কাছে
ওই পাণ্ডুরতা প্রচ্ছন্ন ইংগিতবাহী

চৈতন্য আঁচলে পাতা বিনম্র শামুক
জনশূন্য সমতট ধরে ধুলো অরণ্যে ফিরে এলে
স্তব্ধতায় ঝরে যায় অর্জুনের পাতা

ভয় হয়-

স্মৃতিবিনিময় শেষে মুছে যাবে সবাক চিত্র
এবার গুলঞ্চ ভরে যাবে ধোঁয়া অন্ধকারে



ছায়াটুকু পড়েছে উঠানে

ভেঙে যায় কন্ঠস্বর, ভাসমান জল
স্পর্ধিত হাতের চাপে ভেঙে পড়ে চাঁদ
দগ্ধে দগ্ধে বাঁচে শুধু নীলকন্ঠ পাখি
অরণ্যে লেগেছে আজ বারুদের তাপ

প্রকৃত অন্ধকার
তীব্র নখরে আঁকে বিভেদের ছাপ

গেরস্থালি ছাই মাখা স্পর্শাতুর ছায়াটুকু পড়েছে উঠানে
পোড়া আসবাবের পাশে হেলানো দ্বি-চক্রযান

আমার তীর্থভূমি কেন পুড়ে পুড়ে যায়...

কবিতা - অয়ন দাশগুপ্ত

নামগোত্রহীন
অয়ন দাশগুপ্ত


একটা সিগারেট ধরাতে শুধু একটিমাত্র ফুলকি
কিম্বা গোটা একটা অগ্ন্যুৎপাত - আমার নিরক্ষর স্বপ্নেরা
আদি-অন্তঃসার মৃত্যু
কিম্বা আগুনেরই মত লজ্জাহীন... বস্তুত আকার ধরে থাকে –

যেমন বদলের সময় জুড়ে
টুকরো টুকরো মাইল-ব্যাপী নিঃস্ব আশ্রয়...
তার আত্মগোপন আতিথ্যে
তবে কি তেমনটাই পড়ে থাকে ভালোবাসা... !

আমি প্রতিটি ডিজেল কণার গন্ধ নিই - যেতে যেতে স্বেদ গন্ধ মুছে ফেলি
সদ্য কাচা লিনেনে সারিবদ্ধ, শয্যার আশ্রয়...

ধুলোর গন্ধে ভাবি, কেই বা এভাবে আজো চিহ্ন থেকে চিহ্নে
এতোটা অচেতন...
নিঃস্ব হতে পারে !

কবিতা - অনীক ত্রিবেদী

একটি সনেট
অনীক ত্রিবেদী

সাঁঝবেলায় নক্ষত্রের আত্মপ্রকাশ
অসম্ভবের ঘরে আনে বজ্রের আলো ।

বে আব্রু রক্তিমতায় পূর্ণ হয় রীতি,
তারপর উজানে সব ডুবতে থাকে।

আবহের ইঙ্গিত আসে দুরান্ত থেকে।
শব্দের ধ্বনি নিরন্তর বহমান।
আচমকা সর্বনাশে সব শেষ হয়।
বন ভোর দুর্নাম গোছানোর পর
খুব খারাপ হয়ে উঠি তোমার মনে।
হারার পরেও অপরাজেয় প্রচেষ্টা ।
তোমার সম্ভাব্য আশঙ্কা নাস্যাৎ করে,
বদলে ফেলেছি আগের বোকামি গুলো।
অভিমান ভুলেছি , ব্যর্থতায় কাদিনা।
প্রতিদিনের সার্কাসে বাহবা কুড়োই ।

কবিতা - কচি রেজা

জন্মান্তরের পাখি
কচি রেজা


এ আমার কী বেঁচে থাকা, চারদিকে এত পাখি
প্রত্যাখানও পারে না ঘুম পাড়াতে
তাই এই অন্যমনস্ক!
একটু ও না ঘুমিয়ে বিস্মিত লাশ
ওই তো ঘোড়াগুলি ফিরে যাচ্ছে
পিছনে মেসোপটেমিয়ার মমি

বুকে কান পেতে কেঁপে উঠছে ক্ষুব্ধ
একটা দুটো
চুম্বনে ও পারো না ঘুমাতে!
পরে নিই চলো, জলপাইপাতা
দোলাই খালের জল কতবার পালটালো তারপর
পিঠ দেয়াল ঠেকলে বুঝি আমারও গজাচ্ছে
কবরের খোলা মুখ কী এক মানুষিক রঙে থকথকে
কুন্ডল
জন্মান্তর কী সাপ!

ভাবছো, মোম দিলে মুছে যাবে
যে-আমি কখন ও রাত্রি হই নি
পাথার পেরিয়ে
ব্লেডে কেটে রেখেছি নিজেকে নিজের ঘুমঘুম-স্তন

কবিতা - নীলাঞ্জন সাহা

দুটি নিস্পাপ কবিতা
নীলাঞ্জন সাহা


এক ।

নবীনা
কে বলেছে তুমি কবি না ?
কবি কবি কবি
শংখযুগলে বাজে তোমার
আনন্দ ভৈরবী !

দুই ।

ভেতরে গিয়ে কী যে করে তুমিই জানো
আমি শুধু দেখি তোমার মুখ
ফোয়ারার আলোর মতো
কেবলই বদলে বদলে যায় !

কবিতা - সুমী সিকানদার

লাশের পর
সুমী সিকানদার


মানুষের মৃত্যু দেখতে দেখতে কবিতার জন্ম থেমে যায়..
প্রতিদিন আগুন ধরানো হয় জীবন্ত অক্সিজেনে,
জ্যান্ত মানুষগুলো কোপের ভয়ে ছুটে পালায় ,
লাফিয়ে পড়ে বাস থেকে ...তাদের শরীরে ছোঁড়া হয় ককটেল...
প্রতিদিন লাশের ওপর বাঁশ
আর বাঁশের ওপর অগনিত লাশ
মাটির দেহে মাটির সামিয়ানা...।।
ভাষারা কি স্বাধীনতা পেলো?
তারা কি প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়?
সেই কবে থেকে বাংলা অক্ষরগুলো,কথাগুলো
বাংলায় আর্তনাদ করে করে বাঙ্গালী হতে চেয়েছে!!
মানুষ ছেড়েছে ঘর ,শিক্ষালয়, অফিস প্রাঙ্গন...প্রেমিকার হাত।
তারপর শুধু লাশের দস্তাবেজ......
এ লাশ সদ্যজাত শিশুটির গর্বিত বাবার...
এ লাশ সাহসী হকারের,বিকশাওয়ালার...
এ লাশের মুখটা থেতলে গেছে ,চেনা যায় না...
তুমি কে আমার ধর্মপ্রাণ ভাই? চলে যেতে যেতে বলে গেছো 'রাজাকারের ফাসি চাই।'

কবিতা - বিধান সাহা

রুহুচণ্ডালের বায়স্কোপ
বিধান সাহা
এসো। এসো এইখানে। এইখানে তুমুল বিষাদ। এইখানে নীল আগুনের ফুলকি ওড়ায় যে অনুরাগী, সে-ই ছিলো আজ্ঞাবহ তোমার যুবক। তার প্রার্থনা ও প্রতীকের আড়ালে, দেখ ঐ, নিদারুণ ভেসে যাচ্ছে রূপোর বুদ্বুদ। কিছুটা বেড়াল স্বভাব আর প্রতিবন্ধুর মগজের ব্ল-প্রিন্ট, এর বাইরে, আর কোন সত্য জেনেছিলে? পরিযায়ী পাখিরা এসেছে আজ। চলেও যাবে। তোমার কাজল চোখে তবু থেকে যাবে যুগপৎ ঘুণ ও ঘুমের কোলাজ। থেকে যাবে ছদ্মবেশ, রস ও রূপকে আড়াল।
তোমার সিথানে রাখা আছে স্বেচ্ছাতুর কাঠি, পৈথানে কাচের কলস আর প্রহরায় সুচতুর কাব্য-প্রতারক। ডালিমকুমার আজ নগরের প্রিয় পরিহাস !

**

মৃতের বুকের উপর চালায় যে বুলডোজার, তার চোখের কাজল দীর্ঘস্থায়ী হোক।

**

নিঃসঙ্গ ঐ প্রুফরিডারকেই বেশি ভালো লাগে- দরজার আড়ালে বসে যে কেটে কেটে ফেলে দেয় অক্ষরের বিষ!

**

রজনীভর আমাকে আপাদমস্তক আলোকিত করে রাখে যে দৈবজ্যোতি, তার নামই শশী। যমুনার নৈঋতে তার বাড়ি। গঙ্গাফড়িং তার প্রিয়। আর প্রিয় হলুদ শৈবাল। কাঙ্ক্ষামোচনের জন্য তাকে ডাকি, বলি- এই-যে, সমস্ত অযুহাত নিয়ে এসেছি। তীর্যক ভঙ্গিতে যতই দাড়াঁও আজ। সবুজ নাভিতে আজই দেখা যাবে রুহুচণ্ডালের বায়স্কোপ।
কার্নিশে আজ এতো সতেজ পাপড়ি কেন? কোনদিকে কোন অষ্টভুজ ভেঙ্গে গেল? কোন নিভৃতে গুটিয়ে গেল ডাকু সুজন আর তার লোভী স্বজনের দল?
আমার কোন প্রযত্ন নাই। অনামী প্রান্তর থেকে তাই আলোকিত আকাশ দেখলেই ডেকে বলি- শশী... ওগো শশধর...

**

একা একা একটি বটগাছ দীর্ঘ-জন্মের শাপ নিয়ে একাডেমী চত্তরে নিঃসঙ্গ কেঁদে যাচ্ছে। হাওয়ার ঘুর্নিতে ফেঁসে যাচ্ছে রমনার শুকনো পাতা, আর একটি আর্ত বিড়াল আশ্রয়হীন ঘুরে বেড়াচ্ছে কুয়াশা-মোড়ানো নগরের পথে পথে।
এইসব দৃশ্যের শেষে, আয়নাতে দেখি আমার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না !

**

নরকের চারপাশে জল-বৈঠক। নরকের চারপাশে সুপ্তসুধা। নরকের চারপাশেই তোমার মৌন ইশারা আর স্বর্গীয় অন্ধকার। একদিন এখান থেকেই দেখা যাবে- মীনচৈতন্যের রাঙা শশী। আর তোমার ঐ বক্ষ-ভূগোল, যেভাবে ফুলে উঠে নরকের পথ স্পষ্ট করে তুলছে, অন্ধ আমি, বিশ্বাসী আমি সে পথে ছুটেই নিশ্চিত পেয়ে যাবো জিয়ন কুয়ো, চণ্ডালের আনন্দধাম। সুতরাং, তাহাদের নমস্য মানি। অন্তরে যাপন করি। তাহাদের নামে একা একা রেখে আসি সন্ধ্যাপ্রনাম। এই দেখে, কদমতলায় সহস্র চন্দ্রবিন্দু সহ বাঁশি বাজিয়ে চলে স্বর্গীয় পিতামহ! কাণ্ড!!

জানো কী-না, তোমার গোপন সংকেতে যে কদমপাতা হেসে-ভেসে ওঠে, সেই ভাসমান পাতার উপরে লেখা আছে পিতামহের আত্মজীবনী আর আমার সেক্স-স্ক্যাণ্ডাল!

কবিতা - সতীশ বিশ্বাস

বাঁচা মরা সতীশ বিশ্বাস

যে কথাটা উঠে আসে কন্ঠের নালিতে-ফেরত পাঠাই
যে দৃষ্টি দিয়ে দেখি ঘটনার মুখ-নিমীলিত করি
আমার হাতের করতলে আঙুলেরা মূক ও বধির
আমার পায়ের পেশি খসে খসে পড়ে
আতংকের তাপে -আমার বোধ ও মেধা
শূন্যে উবে যায়
আমার সমস্ত অধিকারে
ঢ্যাঁড়া চিহ্ন এঁকে দিয়ে আজ
দিব্যি আছি বেঁচে কিম্বা মরে।

কবিতা- হাসান মসফিক

ভালোবাসা; দূরপাল্লার মেঘ
হাসান মসফিক


নীল মেঘে ঢেকে যায় যদি
কোন পুরুষালী দুপুর,
একলা হয়ো না;

খোঁপায় কোন ঘাসফুল গুজে নিয়ে
ওই বারান্দায় এসো,
ঠিক মাথায় উপর যেখানে আকাশ ঘন;
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দু’নদীর
বুকে চোখ রেখে যদি পারো বলতে
খুব ভালোবাসি, ভালোবাসি ......

শোনো, এভাবে আসো যদি-
দূরগামী কোন হাওয়া নয়, পেতে পারো
দু’ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া
রোমাঞ্চিত যমুনার দখল!




নির্মোহ নির্বাণ



চড়ুইগুলি এখনো সবাই যায়নি;
এদিকে ওদিকে এখনো পড়ে আছে
কিছু শ্লোগান,
বাবুই এসে নিয়ে যাচ্ছে কিছু
চারপাশ উত্তাপে জমিয়ে রাখার জন্য
এই বিরহী শীতে এর চে ভালো
অবলম্বন আর নেই কো!

না, চড়ুইগুলি এখনো সবাই যায়নি;
পাখা মেলে দিয়ে রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে
দ্রুত সেরে তোলার আয়োজনে, দীর্ঘ ক্ষত
তাই আর যাওয়া হয়নি!

এইমাত্র, চড়ুইয়ের ঠোঁট থেকে কিছু গন্ধ নিয়ে গেল
নবীন বাবুইয়ের আগামীর মুখে দিতে,
আমিও এসেছিলাম এখানে, এক মুঠো আগুন নিতে!

শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

কবিতা - মধুসূদন রায়

ওয়েটিং 
মধুসূদন রায়


সারারাত ভিজেছি অনেক
যন্ত্রনাকাতর আমি ভেঙেছি আমার
প্রতিরোধ সমস্ত শক্তি দিয়ে

আমার বাগানে কোনদিন
ফুলের কুড়ি ফোটে না
ঘরের আনাচে কানাচে চাপা নিস্তব্ধতা

কঙ্কালের এবড়ো খেবড়ো নির্যাস
প্রাগৌতিহাসিক ভালবাসার ছোঁয়ায়

শুধু আমি আর আমার কবিতা

শেষ ট্রেনের জন্য আমরা দু'জন

কবিতা - অঞ্জন আচার্য

স্তব্ধতা-জংশন
অঞ্জন আচার্য


তবুও স্তব্ধতা আসে তোমাদের আশে পাশে
সাদা বোরখা পরে চুয়ে চুয়ে নেমে আসে হিম,
এমনই জনান্তিকে কবিতার খাম মেলে ধরি মেঘে।

কখনো বিদায় নিয়ে, আর আসিনি ফিরে। জং-ধরা ডাকবাক্সে
আমপাতা ফেলে দৌড় দেয় কৈশোর স্মৃতি...

তবুও স্তব্ধতা আসে তোমাদের চারপাশে নীল থেকে ক্রমাগত লাল
মাঝরাতে স্বপ্নঘুম, গোপন বিবরে পরীদের ফুল ফোটা দেখি।

এমন জংশনে কখনো কোনো ট্রেন এসে থামে না বহুদিন
তবুও ক্লান্তিহীন সংকেত-কাপড় নাড়িয়ে যায়
                                                   কঙ্কাল হরিনাথ পোদ্দার।

কবিতা- মামনি দত্ত

বিশ্বাসে রেখেছি সব
মামনি দত্ত


দাড়িয়ে আছে লোকটা -গাছ বেয়ে চলা সময়
সীমা টেনেছে শিকড় বাঁধন
আলগা হয়ে এলে মুঠো
অঝরে বিলাপ প্রত্যয়,

চন্দন ফোঁটা বিদ্যুৎ এ লাগে
ঘুমপাড়ানি চোখ ও ঝলসে যায়
আমি লোকটার চন্দন কাঠ নেই
ঝুম নেশায় সংঘাত এড়ায়,

দয়াল বাবা দয়া করেনি
তাই শিল্প- ভ্রষ্ট কপালে বিঁধিয়েছে ছাপ
পাথর বেলায় সখ্যতা মেলেনি
একশো এক মরণে বিপজ্জনক অনুতাপ,

চামচ উত্তাপ গলে নামছে
বন্ধক ভাঙা অতীত
নিজেকে মুড়েছি থ' আসনে
পান্তায় লেগেছে শীত।

পলাশে শিমূলে আগুন লেগেছে
অপঘাতে টুপটাপ শান্তি
তোমাদের মৌচাকে স্বপ্ন ঝুলিয়ে
চুল্লিবহ্নি তে রেখো ক্রান্তি।

কবিতা - মনোরঞ্জন রায় বর্মণ

সেই কত দিন
মনোরঞ্জন রায় বর্মণ


আজ বহু দিন হলো বৈশাখ পার হবার
মিষ্টি আমের গন্ধ কিছুটা মনে আছে-
আছে তোমার ছোঁয়ারো কিছু স্বাদ।
সেই থেকে চলে গেছ হোস্টেল
আমাকে রেখে গ্রামে একা,
পথ চলার বামের গাছ গুলো আজও
সারি সারি চেয়ে দেখে আমি একা।
কচি পাতা চেয়ে থাকে তোমার আমার জন্য...

কবিতা-সৈকত ঘোষ

ঘুমন্ত পৃথিবীর রেপ্লিকা ৩সৈকত ঘোষ


তোর বুকে হাত রাখলে
শরীরের কক্ষপথ প্রায় সাড়ে উনিশ ডিগ্রি সরে যায়

ইদানিং তেষ্টা পেলে আমি বাথরুমে যাই
আমার হা এর ভেতর
তেত্রিশ কোটি নদী ...

নদীও শুকিয়ে যায়
তোর নাতিশীতোষ্ণ নাভি
অনেক জলবায়ু বদলের সাক্ষী|

কবিতা - অনুপ দত্ত

বসুন্ধরা,সে কি তুমি জানো
অনুপ দত্ত


আমার পৃথিবী ---
ভাবি যাবো তোমার কাছে একদিন
রোজ শরীর আমার ভিন্ন ভিন্ন বিজ্ঞাপনে ঢেকে যায়
একদিন সমর্পন হয় না কোনদিন
কি বিষাদ …কি অক্ষমতা..সে কি তুমি জানো !

আমার পৃথিবী ---
মনের ভেতরে ওড়াওড়ি করে অর্শ্বমেধ যজ্ঞ আহুতি
তোমাকে ছুঁয়ে এসে ভাবি ,না থাক
এই তো পাওয়া গেছে পবিত্র ধোঁয়া যজ্ঞের প্রস্তুতি ঘী জ্বলা পবিত্র শরীর
চেনা লাগে মানসী স্তনের জলভরা ঘ্রান ৷ বসুন্ধরা, সে কি তুমি জানো !

আমার পৃথিবী ---
শালিগ্রাম ছেড়ে বনজঙ্গল টুকু হেঁটে যেতে চাই
পেছনে তাকাতেই দেখি একরাশ ধুলো অতীত ঝাপছা করে দেয়
ভাবি ইতিহাস ভেঙ্গে অনাদি জ্যোত্স্না যে পৃথিবী রচনা করতে চেয়েছিল
সে বিবশ স্বপ্ন বিভুষিত এক বেনজীর উপখ্যান ৷সে কি তুমি জানো !

কবিতা - অমিতাভ দাশ


এখনো দেখিনি যে নদী
অমিতাভ দাশ


এখনো দেখিনি যে নদী
           দেখিনি দেখিনি
শুনেছি অপূর্ব অপূর্ব তার ঢেউ, 
            চাহনি গোধূলি থমকানো নাকি 
সে তাকায়, তাকায় ঔৎস্যুক্যে যদি
বিদ্যুৎ নাকি শিহরায়...
            এ ও বলেছে, বলেছে কেউ কেউ!

শুনেছি আকুলতা ছাপায় 
ছাপায় তন্ময় আঁখিপাতা তার
শুনেছি গালকে সাজিয়ে চুপ 
          পাপড়ি ও ফুলেরা
শুনেছি আবিষ্ট ঠোঁট 
          একটু থরথর মাতা, আর
এসব দেখেছে যারা 
         হারিয়ে গিয়েছে নাকি তারা
হাওয়ায় বিলিয়ে গন্ধধূপ!

এখনো দেখিনি যে নদী
আমি কি ছোঁব, ছোঁব তাকে 
          শিহরণে শিহরণে?
আমি কি ভরাব তাকে তাকে 
         নতুন জোয়ারে, বানে?
আমি কি যুগপৎ 
             হবো তার 
            আকাশ ও মোহনা?
যে নদী দেখিনি এখনো, ঈষৎ
অচেনা?
দেখিনি যে নদী এখনো 
জানি চোখ
         চোখে রেখে 
               পরালে...
নিবেদনের মালা
নিজেকে নিবেদনের সে ফুল গহনা
কয়েক জন্ম ধরে জমানো জমানো 
আকুলতা ভরে তাকালেই, 
চোখে ডাকলেই
সব ঢেউ নিয়ে হইহই
               সে নদী ধরা দেবে
অপরিচিতা নয়, জন্মভূমিরই মতো 
               হবে সে খুব খুউব চেনা!
কখনো দেখবো যে নদী !