মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৩

সম্পাদকীয় - ২য় বর্ষ, ৫ম সংখ্যা

সব চরিত্র কাল্পনিক
এক মসৃণত্বকা নারী চেয়ারে বসে আছেন, সামনে কাপড় ঢাকা টেবিল। সালাঙ্কার নারীর পরনে স্বচ্ছ শাড়ি। গায়ের অলঙ্কার বৈভবেব সাক্ষ্য দেয়। হাতদুটি টেবিলের উপর কাপড়ের ফালির উপর ন্যস্ত, অতি পরিচ্ছন্না। নারীটির ডানপাশে একটি হুলোবিড়াল উপস্থিত, মনে হবে টেবিলের প্রান্তে উঁকি মারছে অথবা টুলের উপর বসে আছে ...সর্বদা সঙ্গী। বামদিকে একটি বকগলা ফুলদানী আর তাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন ফুলগুচ্ছ দৃশমান। কটা কনীনিকা সমৃদ্ধা একমনে তাঁর গলার হার চিবুচ্ছে। পরিচ্ছন্ন কাজ। ছবিটিতে অদ্ভুতভাবে শাড়ির ভিতর দিয়ে শরীরী সম্পদ দৃশ্যমান। গণেশ পাইনের ছবি যারা দেখতে অভ্যস্থ তাদের নিশ্চয় এই ছবি অবাক করেছে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে লেখা চিঠিসূত্রে আমরা জানতে পারি টেম্পারায় আঁকা এই ছবিটির রচনাকাল ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি। একই সূত্রে তিনি লিখেছেন " এখন যেটি আঁকছি তার খসড়া পাঠালাম। খুবই সাদামাটা, হয়তো ছবিটির নাম হবে 'Woman biting her necklace!' হাসছো ?"। সমালোচক এলা দত্ত লিখেছেন 'This painting is a rare instance of a work where he escapes from tragic intersity and indulges in a lighter mood of fun.' ছবিটি নিয়ে গণেশ পাইনের মনে দ্বিধা ছিলো এবং সমালোচক বা রসিকরা এটিকে হালকা মেজাজের ছবি হিসাবে নিয়েছেন। সত্যি কি ছবিটি হালকা মেজাজের !!! দীর্ঘদিনের মনোবেদনা চেপে রাখলে সেটি হাস্যরসে রূপান্তরিত হয়ে বেরিয়ে আসে, একথা যেকোনো ভুক্তভোগী জনই স্বীকার করবেন। ধনীর দুলালী কাম ঘরানী বসে বসে নিরস ঐশ্বর্য চিবুচ্ছে, পাশে কৃত্তিম সৌন্দর্য্য আঁধার ফুল এবং হুলোমুখী স্বামী/পোষ্য দেখে ব্লাক কমেডির অস্তিত্ব সমর্থনে দৃঢ় ধারণা জন্মায়। এক অসাধারণ কুৎসিত ফ্যামিলী ফোটো ফ্রেম, যার পরতে পরতে রয়েছে না পাওয়ার বেদনাকে কৃত্তিম সৌন্দর্য, বৈভব এবং আধুনিকতা দিয়ে ঢাকবার প্রবল চেষ্টা।



শিল্পীর নির্মাণ নিয়ে দর্শক এমন কি অন্য শিল্পীদেরও অল্পবিস্তর কৌতূহল থাকে, আর শিল্পী যদি সদ্যপ্রয়াত গণেশ পাইন হন তাহলে তো আগ্রহ শতগুণ বৃদ্ধি পাবে। আমরা জানি শিল্পী তাঁর ভাবনার নির্যাসকে ক্যানভাসে লিপিবদ্ধ করেন রঙ ও রেখাকে সম্বল করে। নিজের ছবির নির্মান সম্পর্কে বলতে গিয়ে গণেশ পাইন এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন "আধুনিক চিত্রকলার দুটি প্রধান প্রবণতা। এক ছবির গঠন নির্মাণ নিয়ে নতুন ভাবনা। দুই মনে অবচেতন স্তর সম্পর্কে আগ্রহ"। প্রথম প্রবণতাটি শিল্পীদের জন্য তোলা থাক, কারণ শুধু নিরস তত্ত্বকথা এই প্রবন্ধের পক্ষে অপ্রয়োজনীয়। আমাদের আগ্রহ দ্বিতীয় প্রবণতা অর্থাৎ 'মনের অবচেতন স্তরের সম্পর্কে আগ্রহ', কারণ আমরা জানি ওঁনার ছবি মূলত আত্মজৈবনিক। অবচেতন নিয়ে যাদের সামান্য আগ্রহ এবং পড়াশুনা আছে তারা জানেন যে আমাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে শুরু করে বাস্তবিক অপ্রাসঙ্গিক অপ্রয়োজনীয় কাজের মধ্যেও একপ্রকার অবচেতন মন-শৃঙ্খল থাকে। এইসব কাজ স্থির মাথায় বিচার বিশ্লেষণ করলে কোনো ব্যক্তি বিশেষ সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায় যা তারা নিজের অজান্তেই নিজেদের মনের গভীর কুঠুরীতে লুকিয়ে রাখেন। আমরা এখানে দেখার চেষ্টা করব গণেশ পাইনের বিখ্যাত চারটি কাজকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব (হোক না তা লেখকের কষ্টকল্পনা)। লেখার শুরুতে সেই চেষ্টাই আমরা করেছি।



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী' নাটকের রঞ্জনের মৃত্যু নিয়ে ১৯৬১ সালে জলরঙে একটি ছবি এঁকেছিলেন গণেশ পাইন। ছবিটিতে দেখি রঞ্জনের মৃতদেহ পড়ে আছে মেঝেতে। তাঁর একপাশে সিঁড়ির মুখে এলিয়ে নতমস্তকে নন্দিনী বসে আছে। রঞ্জনের চিবুকটি অস্বাভাবিকভাবে উঁচু হয়ে আছে যেন বলছে মৃত কিন্তু মৃত্যুর কাছে হার মানে নি। নন্দিনীর ঠিক বিপরীতে অপর পাশে রাজবেশে মহাপরাক্রান্ত রাজা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর ব্রীজম্যান সদৃশ্য পেশীবহুল ডানহাতটি দৃশ্যমান। মাথার বদলে শূণ্যতা বিরাজ করছে। পিছনের ব্যাকগ্রাউন্ড নাটক বর্ণিত যান্ত্রিক সভ্যতার যন্ত্রণাময় উপস্থিতি। শিল্পীর বর্ণনা থেকে তাঁর এই ছবির করণকৌশল সম্পর্কে জানতে পারি। ড্রইং করার পরে সারারাত হলুদগোলা জলে কাগজটিকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ফলে হলদে রঙ কাগজের ফাইবারে ঢুকে যায়। এরপর সাদা রঙ দিয়ে এলোপাথাড়ি টেক্সচার করে নেন যা প্রথম পর্যায় থেকে ছবিতে রয়ে গেছে। এরপর অন্যান্য রঙ দিয়ে ছবিটিকে শেষ করেন তিনি। স্বভাবত মনে খটকা লাগে আপদমস্তক নিরীহ এবং ধীরস্থির শিল্পীর কি প্রয়োজন পড়লো কথিত 'এলোপাথাড়ি' টেক্সচারের যার আর কোনোদিন প্রয়োজন হয় নি শিল্পীর। প্রশ্নটি আপকে ভাবায় কি ?

আর্ট কলেজের শিক্ষা শেষ করে স্কুলশিক্ষকের চাকুরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে ওই কলেজেই একটি উড-ক্রাফসের কোর্স করেছিলেন গণেশ পাইন সালটি ১৯৫৯-৬০। সেই ক্লাসেই পরিচয় হয় সহপাঠিনী ধনীর দুলালী মীরাদেবীর(পোদ্দার) সঙ্গে। বন্ধুত্ব অচিরেই অনুচ্চারিত প্রেমে পরিণত হয় কিন্তু পূর্ণতায় পৌঁছনোর আগেই বিচ্ছেদ ঘটে। বাড়ির মনোনিত পাত্রের সঙ্গে শুভ পরিণয় ঘটে মীরাদেবীর। এই বিচ্ছেদ শিল্পীকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে থাকবে, আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তা এই বিচ্ছেদকে ধংসাত্মক রূপ দেয় নি, টেনে নিয়ে গেছে শৈল্পিক মনন নির্মাণে। সেই নির্মাণ থেকেই গড়ে উঠেছে 'রক্তকরবী' নামক চিত্রকর্মটি। মনের গভীরে থাকা যন্ত্রণা মুক্তি খুঁজেছে এলোপাথাড়ি টেক্সচারে, প্রশমিত করেছেন মনকে,আত্মাকে। আবার শৈল্পিক মনন ওই ক্ষত ঢেকেছে অন্যান্য রঙের নির্মাণ দ্বারা। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না আলোচনার শুরুর ছবি 'উওম্যান বাইটিং হার নেকলেস' সেই টানাপোড়েনের দ্বিতীয় উপলব্ধি, অনেকটাই প্রশমিত সিন্থেসাইজ রূপে। তাই হয়ত শিল্পীর চেতন মন অবচেতনের গভীরে থাকা বেদনাটিকে মনে করেছিলেন 'আহা বোধহয় খুবই সাদামাটা'।

তৃতীয় ছবিটির নাম 'ইভিল কনভহারসেশান', এটি মিশ্র মাধ্যমে আঁকা, রচনাকাল ১৯৮৫। একটা অপরাধবোধ ধীরে ধীরে পেয়ে বসেছে শিল্পীকে। তাঁর মনে হয়েছিল তিনি পরকীয়ায় মত্ত। ততোদিনে বিখ্যাত হয়েছেন তিনি, সমাজের মানী লোক তিনি, আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে, হুসেন স্বীকার করে নিয়েছেন ভারতের সেরা শিল্পী বলে, গুণমুগ্ধ সংখ্যাতিত। কিন্তু কিছুতেই মীরাদেবীকে মন থেকে মুছতে পারেন নি অর্থাৎ জীবনের দ্বিতীয় প্রেমকে (প্রথম প্রেম অবশ্যই ছবি)। তাই তলে তলে মীরাদেবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো। ততোদিনে মীরাদেবী এক পুত্রের জননী, ভরা সংসার। কিন্তু ঠিক মানাতে পারছেন না। তাদের এই দেখা-সাক্ষাত বা অনুচ্চারিত প্রেমের উপর গড়ে উঠেছিল এই ছবিটি। তাই ছবিটিতে দেখতে পাই রক্তকরবী নন্দিনী যিনি কিছুকাল পরে হয়েছিলেন মসৃণত্বকা, এখানে তাঁর সেই রূপ কিছুটা প্রশমিত স্তিমিত, চেয়ারে বসে আছেন হাঁটুর উপর হাতদুটি রেখে। তাঁর চেয়ারের ডান হাতলে উপবিষ্ট নিশাচর পেঁচা। পশ্চাদপট অন্ধকার, কোথাও কোথাও গাঢ়। গভীর পেঁচা কখনই আমাদের মনে মিঠে বাতাস বয়ে আনে না, যা আনে তা যেন অনেকটাই নষ্ট বা সামাজিক ভাবে অপবিত্র। বিস্তারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।



যতদূর জানি মূলত আত্মজৈবনিক শিল্পী গণেশ পাইন ব্যক্তিগত ঘটনা নিয়ে আরো দুটি ছবি এঁকেছেন যেগুলি এই রচনায় অন্তর্ভূক্ত নয়। একটির নাম 'দ্য ডোর, দ্য উইন্ডো' আবাল্য সঙ্গী দাদা কার্তিক পাইনের অকাল মৃত্যুর অনুভূতি থেকে সৃষ্ট। দ্বিতীয়টি স্নেহময়ী মায়ের জীবনাবসান নিয়ে আঁকা, শিরোনাম 'দ্য উডেন হর্স'। এছাড়া নিজের প্রতিকৃতির বদলে বারংবার এঁকেছেন বাঁদরের মুখ, সে আলোচনা অন্য কোনোদিন।



শিল্পীর আঁকা ছবি সত্যিই কি কোনো অনুভূতি জাগ্রত করে দর্শকের মনে? সত্যিই করে, অন্তত আলোচ্য চতুর্থক্সম ছবিটি তো বটেই। একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিশ্চয় এক্ষেত্রে অতিকথন হয়ে যাবে না। জেলা গ্রন্থাগারে দেশ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে পড়েছিল নতুন শতাব্দীর শুরুতে (৪ মার্চ ২০০০)। সেখানে একটি ছবি বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হল। একটি ভেলায় নরকঙ্কাল শুয়ে আছে, সামান্য একটু লজ্জাবস্ত্র দৃশ্যত। তার পাশে এক সালাঙ্কার নারী মাথায় মঙ্গলঘট নিয়ে বসে আছেন। তপ্তলোহিত বর্ণের শাড়ি পড়া নারীটির ডানহাত কঙ্কালটির ডান হাতের উপর আস্থাজ্ঞাপন স্পর্শ করেছে। পশ্চাদপট নীলের পর্দা নদীর সঙ্গে মিশে এক আধাভৌতিক রহস্যময় পরিমন্ডল তৈরি করছে। দূরে কিছুটা সাদা নিষ্পাপ আলো ঝরে পড়ছে। অঙ্কনশৈলী শিল্পীর সাক্ষর বহন করছে। নিচে ছোটো হরফে লেখা আছে 'গণেশ পাইন, বেহুলা, টেম্পারা ১৯৯৯'। ছবিটি চোখে পড়ার পর প্রথম যে কথাটি মনে এসেছিল সেটি হলো গণেশ পাইন বিয়ে করেছেন। বন্ধুদের বললাম, তারা আমার মানসিক সুস্থিরতা সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহে খোঁজখবর নিলো। প্রমাণ করবার উপায় নেই, সত্যিকথা বলতে কি মফস্বল শহরের জেলা গ্রন্থাগারই ছিলো আমাদের ভরসাস্থল ২০০০ সাল নাগাদ, এখনকার মতো তথ্য-প্রযুক্তি সহজলভ্য নয়। সেই সময় গণেশ পাইনের সম্পর্কে ধারণা বলতে মৃণাল ঘোষের লেখা 'গণেশ পাইনের ছবি' (প্রথম সংস্করণ) যা লাইব্রেরীর রেফারেন্স রুমের অন্ধকার আলমারীর বাসিন্দার। সেদিন শিল্পকলার উপর আমার ধারণা আর ওনার বইয়ের ভরসাতেই মনে এসেছিলো ছবি দেখে শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবনের এই বিশেষ ঘটনাটি। তখনও জানতাম না এই নারী সেই নারী কিনা যিনি বিভিন্ন রূপে পূর্বের আলোচিত তিনটি ছবিটে দৃশ্যত হয়েছেন। কিছুদিন পর মৃণাল ঘোষের অপর একটি বই থেকে জানতে পারলাম আমার ধারণা ঠিকই।



গণেশ পাইন বিবাহ করেছিলেন ১৯৯১ সালে সেপ্টেম্বব মাসে সেই নারী মীরাদেবীকেই। মৃণাল ঘোষকে দেওয়া একটা সাক্ষাতকারে শিল্পী জানিয়েছেন "এটা খুব দুঃখের ব্যাপার, এটা এক অনুচ্চারিত প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপার ছিল। তার মীরা যেহেতু খুব বড় বংশের কন্যা, ওঁর বাবা একজন Successful লোক ছিলেন business world-এ, আমার মতো হতচ্ছাড়া লোকের সঙ্গে তো বিয়ে দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। তাই একটা দুঃখের জীবন কাটিয়েছে ও প্রথম বিয়ের পর। কিন্তু তলায় তলায় ছিল সম্পর্কটা খুবই। তারপর যখন ও divorce করল, সাহসিকতার ব্যাপার, অখন আর বাধাটা রইলো না।" এই বিশেষ ঘটনাটিকে দীর্ঘ আট বছর পর তিনি মূর্ত করলেন ক্যানভাসে, মেশালেন বাঙালির মধ্যযুগের লোকসাহিত্যের মিথকে, মিথ আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা একাকার হয়ে জন্ম নিলো বিখ্যাত সৃষ্টি The voyage যারই বাংলা শিরোনাম 'বেহুলা'।




মকবুল ফিদা হুসেন একবার গণেশ পাইন সম্পর্কে বলেছিলেন, “যে কোনো শিল্পকর্ম যখন শিল্পীর ব্যক্তিগত উপলব্ধি মন্থন করে সৃষ্ট হয় তখন তা অমৃতের সমান হয়ে ওঠে। আর তা যদি গণেশ পাইনের মত ভারত সেরা শিল্পী হন তাহলে তো কোনো প্রকার দ্বিমত থাকে না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, মিথ, আধুনিক মনন জারিত হয়ে তা সর্বকালীন সেরা সম্ভারে পরিণত হয়। আরো একটি ছবির কথা আলোচনা করার বিশেষভাবে ইচ্ছা ছিলো কিন্তু না প্রাবন্ধিক না পাঠক কেউই এখন প্রস্তুত নন সেটার জন্যে। তাই জন্য আমাদের আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতেই হবে। সেই ছবিটি(গান্ধারী) দেখে আমার এক শিল্পী ভাই গৌরব রায় বলে উঠেছিল আরে এটা তো মীরাদেবীর মুখ। আগ্রহী পাঠকদের কাছে একটি ছবির কোলাজ তুলে দিলুম, দেখুন যদি কিছু আবিষ্কার করতে পারেন, আর এই সব নিয়েই এই বিশেষ সংখ্যা যা আমাদের পক্ষ থেকে শিল্পী গণেশ পাইনকে আমাদের মত করে শ্রদ্ধা, তার জীবনকে তুলে ধরার চেষ্টা ।”


এবার শোনা যাক নিজের জীবন সম্পর্কে একবার সদ্যপ্রয়াত চিত্রশিল্পী গণেশ পাইন কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, "আমার জীবনে ব্যাপ্তি নেই,বৈচিত্র নেই, ভ্রমণে আমার প্রবল অনীহা, আমার আছে জন্মার্জিত একবোধ, যা প্রাচীন জলে ভেসে আসা কোনো গুল্মের মত; যার শেকড় সঞ্চার আমার মনের গভীর প্রদেশে অবিরাম ঘটে চলেছে। জীবন এবং শিল্প সংক্রান্ত আমার যাবতীয় স্মৃতি স্বপ্ন অভিজ্ঞতা সবই তার সংশ্লেষিত হয়েছে সেই বোধ্যে। সে সংশ্লেষের তাৎপর্য আমি সঠিক বুঝিনা, শুধু তার ক্রিয়া অনুভব করতে পারি"। গণেশ পাইনের প্রয়াণ বাংলা তথা ভারতের নক্ষত্র পতন। বাঙালি চিত্রকলাকে পরম্পরা এবং নিজস্ব মনন মেধা দিয়ে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি তা নবীনদের সমৃদ্ধ এবং উৎসাহিত করবেই। ক্ষেপচুরিয়াসের এই সংখ্যা ওনার উপর আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। এই সংখ্যায় কবি, শিল্পী, সমালোচক এবং মুগ্ধ দর্শকের কলমে তাই উঠে এসেছে গণেশ পাইনের শিল্প ও জীবনের নানাদিক। ওনার আঁকা শিল্পকর্মের কিছু নমুনা রসিকদের জন্য রয়েছে। শিল্পীরা গণেশ পাইনকে কিভাবে দেখেছেন, থাকছে তার কিছু অনুভব। আশা করছি ক্ষেপচুরিয়াসের অন্যান্য সংখ্যার মত এই সংখ্যাও পাঠকমহলে সমাদৃত হবে।

ক্ষেপচুরিয়ানসের পক্ষে অমিত বিশ্বাস

মলয় রায়চৌধুরীর অপ্রকাশিত ডাইরি


খামচানো কালপৃষ্ঠা
গিন্সবার্গের লোগো ও গৌতমবুদ্ধের পদচিহ্ণ
মলয় রায়চৌধুরী


বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমাদের পাটনার বাড়িতে । তার আগে তাঁর সঙ্গেআমার পরিচয় ছিল না । তিনি আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে চাইবাসায় দেখা করতে গিয়েছিলেন ১৯৬২ সালে দোল খেলার সময়ে । পাটনায়উনি এসেছিলেন বেনারসে থাকাকালীন, বোধগয়া হয়ে । বোধগয়াতে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি হিন্দু ও মুসলমান সাধুসন্তদের সম্পর্কে বেশি আগ্রহান্বিত ছিলেন । বোধগয়ায় ধানখেতের ধারে দুটো ইঁটের ওপর বসে হাগবার ( তখনও জাপানিদের টাকা বোধগয়াকে ঝলমলে করেনি ) সময় তিনি টের পান যেএকটা ইঁট একটি বৌদ্ধবিহারের, খুদে-খুদে বুদ্ধমূর্তি ছিল তাতে । সেটি ধুয়ে পুঁছে রেখে নেন নিজের কাছে । এই ঘটনার পরেই তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতিআকৃষ্ট হন । এই পাথরটি কোনো বৌদ্ধবিহারে জমা না দেওয়ায়, এবং ভিখারি, বিকলাঙ্গ, কাঙালি, কুষ্ঠরোগিদের ফোটো তুলে সেই ফিল্মটি আমার বাবার ফোটোগ্রাফির দোকানে ডেভেলপ করতে দেয়ায়, বাবার সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হয়েছিল । বাবা ওনাকে বলেছিলেন যে বিদেশি কবিদের সঙ্গে ট্যুরিস্টদের কোনো তফাত নেই ; সবাই গরিব ইন্ডিয়াকে বিক্রির ধান্দায় থাকে । বিট আন্দোলনের গবেষক বিল মর্গান এবং অ্যালেন গিন্সবার্গ ট্রাস্টের সচিব বব রোজেনথাল ২০০৪ সালে যখন কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমি ওনাদের এই ঘটনাটির কথা বলেছিলুম ।



ওনাদের দুজনকে আমি আরেকটি ব্যাপারের বিষয়ে বলেছিলুম । গিন্সবার্গের ইন্ডিয়ান জার্নালস বইটির শুরুতেই একটি ড্রইং আছে যা তিনি ভারত থেকে ফিরে গিয়ে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য গ্রন্হ, অ্যালবাম ও চিত্রপ্রদর্শনীর কার্ডেও ব্যবহার করতেন । বিল মর্গান ও বব রোজেনথালের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলুম যে অ্যালেনের কাগজপত্র থেকে ওনারা এই ড্রইংটির উৎস জানতে পারেননি । গিন্সবার্গ নিজেই স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে যাননি । একটি ক্যাথলিক গোষ্ঠী ভেবেছিল যে ড্রইংটির সাহায্যে ভারতীয়রা সম্ভবত যিশুখ্রিস্টের ক্রুসকাঠ এঁকে থাকবে । তাদের গিন্সবার্গ একটা ভাসাভাসা জটিল বাক্য লিখেছিলেন যেটি পড়ে মনে হবে ড্রইংটির সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সম্পর্ক আছে ।



ড্রইংটা হল এমন তিনটি মাছের যাদের দেহ আলাদা কিন্তু একটিই মাথা । এমনভাবে মাথাটি আঁকা যে তা একটি বৃত্তের মধ্যে ত্রিভূজের আকার পেয়েছে । তাদের মস্তিষ্ক যেহেতু একটি, তাদের চোখ আলাদা নয়, যদিও তিনটি মাছের কানকো আলাদা আলাদা । ড্রইংটা গিন্সবার্গ পেয়েছিলেন মোগল বাদশাহ আকবরের সমাধিক্ষেত্রে, যার প্রবেশপথের সিংদরোজার সামনে লাল পাথরের ওপর নকশাটা খোদাই করা দেখেছিলেন তিনি, এবং খাতায় টুকে নিয়েছিলেন । নকশাটা আকবরের সর্বধর্ম সমন্বয়ের দীন-এ-ইলাহি তত্বকে ব্যাখ্যা করে ; হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধরা হল তিনটি মাছের দেহ , এবং তাদের বক্তব্য যেহেতু একই, তাই তাদের একটিই মাথা । পাটনায় খুদাবক্শ লাইব্রেরিতে দীন-এ-ইলাহি গ্রন্হটির যে ক্যালিগ্রাফি-প্রতিলিপি ছিল তার প্রচ্ছদেও ড্রইংটি দেখেছিলেন গিন্সবার্গ ।


ভারত থেকে ফিরে গিয়ে বিল মর্গান আমাকে গিন্সবার্গের একটা প্রবন্ধসংগ্রহ পাঠিয়েছিলেন । তার ভূমিকায় বিল লিখেছেন যে ড্রইংটি হল গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ণ ! বিল যেহেতু একজন গিন্সবার্গ-বিশেষজ্ঞ, পরবর্তীকালে গিন্সবার্গ গবেষকরা সকলেই এই ড্রইংটিকে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ণ বলে প্রচার করে চলেছেন । এই একই বক্তব্য ইনটারনেটেও পাওয়া যাবে ; অনেকে ড্রইংটিকে নানা রূপ দিয়েছেন , এমনকী পাথুরে রূপ । গৌতম বুদ্ধের পায়ের তলায় চাপা-পড়া তিনটি জীব, এরকম ধারণা মার্কিন বুদ্ধিজীবিরাই করতে পারেন ।


গিন্সবার্গ যদি বাঙালি কবি হতেন তাহলে বাঙালি আলোচকরা তাঁকে এই ড্রইংটির ভুল ব্যাখ্যার জন্য ছিঁড়ে ফালা-ফালা করে ফেলতেন ।

গণেশ পাইনের সংক্ষিপ্ত জীবনী – ইন্দ্রাণী সরকার

গণেশ পাইনের সংক্ষিপ্ত জীবনী
ইন্দ্রাণী সরকার


গণেশ পাইন ভারতবর্ষের বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একজন অন্যতম | তিমি ১৯৩৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি ঠাকুরমার কাছে পৌরানিক, শ্রুতি গল্প, রূপকথা শুনে বর্ হন | প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ভবিষ্যতে একজন চিত্রশিল্পী হবার মনস্থির করেন এবং কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হন | সেখান থেকে ১৯৫৯ সালে তিনি চিত্রশিল্প বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এর পরেই চাকরিতে যোগ না দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মন্দার মল্লিকের স্টুডিওতে অ্যানিমেশনের জন্য ছবি এঁকেছেন বেশ কিছুদিন। ১৯৬৩-তে সোসাইটি অফ কন্টেমপোরারি আর্টসের সদস্য হন। এর পর থেকেই সোসাইটির বার্ষিক প্রদর্শনীতে নিয়মিত তাঁর ছবি জায়গা পেতে থাকে।


গণেশ পাইন ভারতীয় চিত্রশিল্পকে নতুন মাত্রা দেন। শুধু দেশ নয়, বিদেশেও সমাদৃত হয়েছেন তাঁর গুণের জন্যে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় দেশ-বিদেশে তিনি অনেক পুরস্কার লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, জার্মানীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নেন। দ্বিমাত্রিক ছবি আঁকাতে অনন্য ছিলেন গণেশ পাইন।

শুরু থেকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব পড়ে গণেশ পাইনের কাজে। মূলত রঙ তুলিতেই মাধুরী মেশান তিনি | পাশ্চাত্যের শিল্পীদের মধ্যে মূলতঃ রেমব্রান্টের শ্যাডো এবং লাইটের মিশ্রনে চিত্রকলা তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করে |



আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী গণেশ পাইন মারা গেলেন ২০১৩ সালের ১২ ই মার্চ ৭৬ বছর বয়সে।

শিল্পকলা আর নিজের কাজ সম্পর্কে - গণেশ পাইন

শিল্পকলা আর নিজের কাজ সম্পর্কে
গণেশ পাইনের লিখিত উক্তি

গণেশ পাইন



আধুনিক চিত্রকলায় দুটি প্রধান প্রবণতা। এক, ছবির গঠন নির্মাণ নিয়ে নতুন ভাবনা। দুই, মনের অবচেতন স্তর সম্প্ররকে আগ্রহ। এই দুটি লক্ষণই সাধ্যমত বিবেচনা করেছি। গঠনের ব্যাপারে আমার ঝোঁক ঋজু রেখায় স্থাপত্যের মত করে ছবি গড়ার দিকে। ছবির বিষয়বস্তু বা theme সংগ্রহ করি অন্তর্মনের অভীপ্সা থেকে। সে কারণে আমার ছবি অনেকটা আদিরূপাত্মক (archetype)। ছবির সূচনা আবেশ থেকে। আবেশ বিমূর্ত অথচ অর্থময়। ছবি আঁকার প্রাথমিক স্তরে আবেশকে রূপ দেওয়ার তাগিদে ভাবপ্রকাশের উপযুক্ত ফর্ম খুঁজি। তা পেলে কাগজে খসড়া করি। খসড়া বারবার বদলাই যতক্ষণ না গঠন আর বিন্যাস মনোমত হয়। তারপর খসড়া থেকে মূল ছবি শুরু করি। রঙের কাজটা ধীরে ধীরে স্তরে স্তরে চলে। মধ্যপর্যায় ছবি যেন নিজেই নিজেকে বদলায়। এই সময়টা খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং উদ্বেগের। তখন যেন চেতন মনের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। ছবি প্রায়শই পন্ড হয় এই পর্যায়। দৈবাৎ এই সঙ্কট থেকে উতরে গেলে ছবি সাঙ্গ করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। এভাবেই আঁকি।



মনের ভিতরে একটা ক্রিস্ট্যালের মতো কিছুতে বাইরের জগতের সব ছাপ তো পড়ছে। সব অন্তর্মুখী মানুষের পড়ে। বাইরের জগতের সব ছাপ তো অতীত ও বর্তমানের সব অভিজ্ঞতা। বাইরের আলো বলুন, রিফলেকশন বল্লুন, সেগুলো তো সেই ক্রিস্ট্যালের ওপর পড়ছে। তবে পড়ে প্রতিসরিত হচ্ছে। হয়ে একটা কেন্দ্রগত বোধের মধ্যে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেইখান থেকেই আমার ছবির বেশিরভাগ ইমেজারিগুলো উঠে আসে।



কুৎসিতকে তার স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রকাশিত করা শিল্পীর পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ বিশেষ। শিল্পে শোধিত হয় বলেই সে আর যথার্থ কুৎসিত থাকে না, 'সুন্দর' হয়ে ওঠে। আমার ধারণা সত্যিকারের কুৎসিত শিল্পের শর্তাধীন নয়, যেহেতু শিল্প মাত্রই সুন্দর।



জনৈক সমালোচকের মতে শিল্প সমৃদ্ধ হলে শিল্প সমালোচনাও সমৃদ্ধ হয়। অতএব বাংলা শিল্প সমৃদ্ধ হলে বাংলায় শিল্পসমালোচনাও সমৃদ্ধ হবে। ইংরাজী পরিভাষার তর্জমা একটি দুর্ঘট ব্যাপার। শিল্প বিশ্লেষণের বিদেশী প্রধানত ইংরাজী নজির অনুসরণ করতে গিয়ে বাংলা সমালোচনা প্রায়ই জটিল আর অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে। সম্ভবত চিন্তার কাজটা সমালোচক ইংরাজীতে করেন, লেখন কাজটা করেন বাংলায়। শ্রম এবং নিষ্ঠায় যদি উৎকৃষ্ট শিল্প সম্ভব হয়, উৎকৃষ্ট সমালোচনার জন্যও শ্রম এবং নিষ্ঠার প্রয়োজন আছে। শিল্পের করণকৌশলগত দিকটি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকাটাও সমালোচনার পক্ষে জরুরী।



বুদ্ধি আর আবেগকে আলাদা করে দেখা যায় কিনা জানি না। আবেগ বলতে যদি তরল ভাবোচ্ছ্বা আর বুদ্ধি বলতে বিশুদ্ধ বিচার ঠাওরান, তাহলে বিপত্তি আছে। আমি সে রকম করে আবেগ বা বুদ্ধি আলাদা করে দেখি নি কখনও। Form-এর দৃঢ়তা, স্থাপত্যসুলভ গঠনই আমার আরাধ্য। এটি বুদ্ধি বা আবেগের একক প্রবণতা নয়। ছবির বিষয়বোধের চরিত্র রঙের Tone-ই বর্ণনা করতে পারে, আর সে চরিত্রও আবেগ বা বুদ্ধির একক ক্রিয়া নয়, পাস্কাল বলেছিলেনঃ হৃদয়েরও একটা যুক্তি আছে, বুদ্ধি যায় খোঁজ রাখে না। তেমনি একথাও হয়ত বলা যায়, বুদ্ধিরও একটা হৃদয় আছে, হৃদয় যার খোঁজ রাখে না।



আমি সবকিছুর ওপর একটা সর্বগ্রাসী সৌন্দর্য, সর্বব্যাপী একটা ব্যালান্সকে আবিষ্কার করে নিই। মানুষ যখন আত্মমগ্ন হয় তখন হয়তো জগতের মধ্যে জীবনের মধ্যে এটাকেই আবিষ্কার করতেই হয় তাকে। নদীর স্রোত থেকে পাখি উড়ে যাওয়া পর্যন্ত এর মধ্যে সে একই ছন্দকে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করে ধীরে ধীরে। এবং সে একটা একক জগতের অধিবাসী হতে থাকে ক্রমশ। যে জগতের একটা কমন অর্ডারটা একটা নিজস্ব নকশায় আবদ্ধ। এই পাটার্নটাই আসল। আমি চেষ্টা করি কতগুলো ক্রিস্ট্যালাইজড ফর্মকে আমার ছবিতে এস্টাব্লিশ করতে। প্রত্যক্ষ বাস্তবের স্থূল লক্ষণগুলো এক কারণে অনেকটাই রূপান্তরিত হয়ে যায় আমার ছবিতে। কিন্তু বাস্তবকে পরিহার করা বলতে যা বোঝায় তা নয় কিছুতেই।



জীবন কিন্তু নবজাতককে দু'হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় না। সে আঘাত করেই তাকে। তার প্রথম পরীক্ষাই হচ্ছে সেই আঘাত তাকে সামলে নিয়ে সবলে তাকে জয় করা।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - যোগেন চৌধুরী

গণেশ পাইনের ছবি
যোগেন চৌধুরী


তবে আত্মমগ্ন সৃষ্টিশীল একজন শিল্পী হিসেবেই তিনি মূলত নিজেকে ব্যস্ত রাখেন যেখানে দেখতে পাই প্রখর ইতিহাসবোধ -- যার শুরু প্রাচীন সুদীর্ঘ ইতিহাস, পশ্চিমি শিল্পকলা এবং তার রীতিনীতি নন্দনতত্ত্বকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন নিজস্ব সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু তাঁর নিজের সৃষ্টির মূল স্রোত অবশ্যই আত্মজৈবনিক। নিজের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। তাঁর প্রথম পর্যায়ের ছবিগুলো ছাড়া পরবর্তী সময়ের প্রায় প্রতিটি ছবিতে আমরা দেখতে পাই তাঁর জীবনের বিষাদময় অন্ধকারাচ্ছন্ন স্বপ্নময়তা, কখনও মৃত্যুর ছায়া কিংবা অত্যন্ত ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা। তাঁর ছবির টেক্সচার বা বুনটে শরীরের গড়নে বা ভাঙনে দেখি এই অবক্ষয়িত সমাজের চেহারা। তারই মধ্যে থাকে চকিত আলোর উদ্ভাস। আত্মমগ্ন শিল্পী মানুষটি তাঁর গভীর অনুভব থেকে ক্রমাগত আত্মপ্রকাশিত হয়েছেন তাঁর ছবি ও শিল্পকর্মের মধ্যে। সেখানে যুক্ত হয়েছে তাঁর মনন ও নান্দনিক দক্ষতা।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - শোভন সোম

শোভন সোম
গণেশ পাইনের ছবি


দর্শক তাঁর ছবির পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে যদি তাঁর অলৌকিক জলযানে আর অকম্প দীপশিখায় প্রতিকূলতা থেকে উত্তীর্ণ হবার আকাঙ্ক্ষাও দেখতে পান তাহলে কি সেটা ভুল হবে! বেহুলার কাহিনী অবশ্যই উপলক্ষ, বাঙালির যাবতীয় মঙ্গলকাব্যে, ব্রতকথায়, পাঁচালিতে পরতে পরতে রয়েছে বিচিত্র প্রতিকূলতার সঙ্গে অনবরত লড়াই করে বেঁচে থাকবার সংকল্প। বাঙালি নারী ব্রতকথায়, পাঁচালি পাঠকালে এই কথাই বারবার আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে। গণেশের কথায় "জীবন কখনও জাতকে সম্ভাষণ জানায় না। সে তাকে আঘাত করে। সেই আঘাতকে জাতক কীভাবে গ্রহণ করলে তার উপরেই তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনচর্যা নির্ভর করে।" এই আঘাত সম্ভবত তাঁর ছবির সুতীব্র প্রতিবাদকেই জাগাতে সাহায্য করেছে।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - শোভন তরফদার

গণেশ পাইনের ছবি
শোভন তরফদার



বিদ্রূপের ভিতর দিয়ে, নিপুণ হিংস্রতার ভিতর দিয়ে মধ্যবিত্তের মায়ার খেলাটি ঘুচিয়ে যেন যোগাযোগের অন্য একটি স্তরও গড়ছেন তিনি। এই পর্যন্ত এসে গণেশ পাইনের এই সব ছবিকে নেহাতই সিনিসিজম-এর একমুখী ধারায় বেঁধে রাখা যায় না আর। যে ছবিতে চূড়ান্ত নৈঃশব্দ্য আর নিঃসঙ্গতা, সেই ছবিই উল্টোমুখে হয়ে ওঠে শিল্পীর, এবং শিল্পের প্রতিরোধ। ছবির 'মানে' তখন নানার্থব্যঞ্জক হয় শিল্পের শর্ত মেনে।

যে ভাবে নৈঃশব্দ্যও সেতুবদ্ধ হয়, যে ভাবে সংসারে অনন্ত ছেঁদো কথামালা ভেঙে যায় শিল্পীর দৃষ্টির সামনে, যে ভাবে ফুঁসে ওঠা গভীর স্তব্ধতাই হয়ে ওঠে শিল্পীর ভাবপ্রকাশের মাধ্যম, সব নিয়ে সেই সর্বনাশেই ধরা দিলেন গণেশ পাইন।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - অরুণ ঘোষ

গণেশ পাইনের ছবি
অরুণ ঘোষ


মিনিয়েচার ছবি খুঁটিয়ে দেখার, অর্থাৎ ছবির প্রতিটি কাহিনী ঘুরেফিরে পর্যবেক্ষণ করার, এক স্বতন্ত্র রসাস্বাদনের দিক আছে। শ্রীপাইনের ছবিও সেই জাতের। ছবি খুঁটিয়ে না দেখলে সহজে চোখে ভাসে না অন্তর্নিহিত শিল্পবার্তা। এই ভাবে তুলনা করে দেখলে দেখা যায় ইদানীং ওঁর ছবির রঙ অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরিত হচ্ছে মৃদু অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে। অন্ধকারের কৃষ্ণবর্ণ আবহে সামাজিক নৈরাজ্যে যে ইঙ্গিত পাওয়া যেত ওঁর ছবিতে তার স্থান নিচ্ছে ঊষালগ্নের মানসিক প্রশান্তি।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - অঞ্জন সেন

গণেশ পাইনের ছবি
অঞ্জন সেন



অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলাল বসু (এঁদের দু জনেই স্বকীয় আঙ্গিকগত বিশিষ্ট উপস্থাপনা আছে) যে ভাবে ছবিতে মিথিক-ঐতিহাসিক উপাদান উপস্থাপ্ন করেছিলেন তা অনেকটাই সরাসরি পদ্ধতি বা প্রচলিত সাহিত্য-পুরাণ থেকে চিত্র ভাষায় সরাসরি ভাষান্তরিত করে দেওয়া। ইতিহাস-মিথ-ইতিহাস-সংবর্তন-সঞ্জনন পদ্ধতি তাঁদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনি ভাবে ধরা পড়ে না। ইতিহাস-মিথ-সাহিত্য-সংবর্তন এইভাবে হয়ত আসে। আর গণেশ পাইনের চিত্রকলা আরেকটি মাত্রা জুড়ে দেয় মিথ সঞ্জনন (Generation)। এই মিথ সঞ্জনন সম্ভব হয় মূর্ত থেকে বিমূর্তে যাতাযাতে। অবনীন্দ্র-নন্দলালের মিথ যেখানে মূর্ত গণেশ পাইনের মিথ সেখানে মূর্ত নয়, মূর্তবিমূর্ত; ঠিক বাস্তব রূপ নয় বাস্তব অধিবাস্তবে যাতাযাত। গণেশ পাইনের ছবিতে তাই মিথিক পরিমন্ডল থেকে একটি নতুন ভাষণ বা ডিসকোর্স পাওয়া যায়, পাওয়া যায় কথোপকথন বা ডায়লগ।

গণেশ পাইনের ছবি প্রসঙ্গে - প্রণবরঞ্জন রায়


গণেশ পাইনের ছবি
প্রণবরঞ্জন রায়


গণেশের ছবির রূপবন্ধমাত্রই আলোকিত উদ্ভাস। প্রতিটি রূপবন্ধই যেন অন্ধকারের গর্ভ থেকে আলোর শরীর নিয়ে ভেসে থাকতে চায়। কিন্তু তাদের শরীরের সর্বত্র আলোর ঔজ্জ্বল্য সমান না হওয়ায় মনে হয়, তারাও যেন তাদের গর্ভে, অন্তরে, কন্দরে কন্দরে সেই উৎসের অন্ধকার সংগোপনে লালন করে। এখানেও সেই দ্বন্দ্বসঙ্কুল দ্বৈতাদ্বৈতের প্রকাশ এবং এ প্রকাশ ইঙ্গিতসমৃদ্ধ। ছবির রূপবন্ধের সম্পূর্ণ আকার যাই হোক না কেন গণেশের ছবির বিভিন্ন ঔজ্জ্বল্যের চিত্রাংশ, তা রূপবন্ধাংশই হোক বা চিত্রদেশাংশই হোক, আলোর তারতম্যের কারণে ভিন্নতর রূপভাস বহন করে, অন্য রূপের ইঙ্গিত দেয়। গণেশের ছবির আলোছায়া ভৌত নয়, আধিভৌতিক। ওঁর ছবির রহস্যময়তার মূল অবলম্ব আধিভৌতিক আলো-আঁধারি, অন্য কোন কষ্টকল্পনায় বানিয়ে তোলা বর্ণণা নয়।

একটি ঘটনা যা বদলে দেয় জীবন - মৃণাল ঘোষ

একটি ঘটনা যা বদলে দেয় জীবন
মৃণাল ঘোষ


... তার আগে তাঁর (গণেশ পাইন) চাকরি না পেয়ে সম্পূর্ণভাবে শিল্পের কাছে সমর্পিত হওয়ার কাহিনীটি এখানে শেষ করে নি। শেষ ইন্টারভিউ তিনি দিয়েছিলেন কেশরাম কটন মিলসে -- শাড়ির নকশা প্রস্তুতকারক শিল্পীপদের জন্য। কয়েকদিন ধরে তাঁর যোগ্যতার পরীক্ষা হয়েছিল। নিজস্ব অনেক কাজ সেখানে দেখাতে হয়েছিল। সে-সব কাজ দেখে সেখানকার পরিচালকমন্ডলী তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিতও হয়েছিলেন। তাঁদেরই একজন, মিঃ ব্যাস, তাঁর মধ্যে একজন বড় শিল্পীর সম্ভবনা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এই চাকরিতে ঢুকলে সেই সম্ভবনা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি বলেছিলেন এরকম পদের জন্য "উই ডোন্ট ওয়ান্ট যামিনী রায়জ"। জানিয়েছিলেন যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর কোনো সংশয় নেই। নিয়োগপত্র তিনি তখনই দিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু আর এক দিন সময় নিয়ে ভেবে দেখতে বলেছিলেন তিনি, গণেশ পাইন সত্যিই এই চাকরি করতে চায় কিনা।



তারাতলা অঞ্চলের সেই ফ্যাক্টরি থেকে সেদিন বিকেলের দিকে ফিরছিলেন গণেশ পাইন। বাসে প্রচন্ড ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে একটি ছোট ছেলে তাঁর দিদির হাত ধরে কোনোরকমে চলছে। এত ভিড়ের মধ্যেও সেই শিশুটি তাঁর পকেটে একটা কিছু রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নামার সময় উঁকি মেরে দেখলেন ছেলেটির পকেটে একটি সিঙাড়া। তাকেই সে অক্ষত রাখতে চাইছে। দৃশ্যটি সেই মুহূর্তে তাঁর সামনে থেকে একটা আবরণ সরিয়ে নিয়েছিল। এই শিশুটি যদি সমস্ত শক্তি দিয়ে তাঁর কাঙ্খিত জিনিশটিকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে তিনি নিজে কেন পারবেন না, তাঁর নিজস্ব ঐশ্বর্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতে। তাঁর শিল্পীসত্তাকে কেন নষ্ট হয়ে যেতে দেবেন তিনি চাকরির গতানুগতিকতায় জড়িয়ে?



পরদিন ওই অফিসে গিয়ে তিনি জানিয়ে এসেছিলেন তিনি করবেন না ওই চাকরি। আর বাড়ি ফিরে সমস্ত সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা যা কিছু ছিল নষ্ট করে ফেলেন। ছবিকে তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ বা ব্রত হিশেবে বেছে নিতে হয়তো একটু বেশি সময়ই অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। সেটা ছিল ১৯৭৫ সাল। ততদিনে শিল্পী হিশেবে তাঁর খ্যাতি বিস্তৃত হয়েছে।

প্রচ্ছদকাহিনি – গণেশ পাইন - ভাস্কর লাহিড়ী

আদিম জ্ঞান এখনও আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে
ভাস্কর লাহিড়ী

গণেশ পাইনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় যখন আমার ১৪ বছর বয়স । অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় । ছোটবেলা থেকেই আঁকার দিকে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ বোধ করতাম । হয়তো সেই জন্যই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভালো আঁকা বা চিত্রকলা নিয়ে কোনো আর্টিকেল পেলে পেপার কাটিং করে রেখে দিলাম । সেই সূত্রেই গণেশ পাইন নামটার সঙ্গে হঠাতই পরিচয় হয়ে গেল । সালটা খুব সম্ভবত ১৯৭৪-৭৫ হবে । সে সময় ‘সাপ্তাহিক অমৃত’ বলে একটা পত্রিকায় প্রতি সংখ্যাতেই একটা বিভাগ থাকত ‘একালের চিত্রশিল্পী’ । তাতে প্রায়ই গণেশ পাইনের আর্টিকেল থাকত । সেই সময় থেকেই গণেশ পাইন নাম ও তার ছবির প্রতি একটা মোহ এসে গেল । সেখানেই একবার মুখশ্রী বলে চিত্রবিষয়কে দেখেছিলাম তিনি ‘মহাবলী পুরম’-এর উল্লেখ করেছিলেন । সেখানে সমুদ্র, ঝাউগাছ, অর্জুন হ্রদ, আর সামনের ভাস্কর্যের সম্পর্কে বলেছিলেন । সেই বয়সে হয়তো মুগ্ধতা ছিল । পরিণত বয়সে তখন আবার পড়ি, তখন বুঝি কী গভীর তাৎপর্য তার মধ্যে ছিল । গণেশ পাইন শুধু ছবিতেই নয়, কথায় ও লেখায় সবেতেই ছিল অসীম দার্শনিক গভীরতা । সেই গভীরতার ছোঁয়া যেন আমাদের শিল্পীজীবনের বাল্যকাল থেকেই ঘিরে রাখত ।

গণেশ পাইনকে আমি পুরো জীবনে তিনবার পেয়েছি । ফলে সেই অনুভূতির তীব্রতা চিরকাল থাকবে । তার সঙ্গে কথা বলা, আলোচনা করা কিংবা তার দর্শনের কাছাকাছি যাওয়া বা যাবার চেষ্টা করা । ৮ এর দশকে সেবার আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসে আমার প্রথম ডুয়েট শো । আর একজন বন্ধু চিত্রশিল্পীর সঙ্গে একসঙ্গে ছবির এগজিবিশন । প্রথম শো । শিল্পীদেরও আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছি আমাদের কাজগুলো দেখাবার জন্য । সেবারেই প্রথম চাক্ষুস দেখেছিলাম আমাদের এই প্রিয় শিল্পী গণেশ পাইনকে । সে সময় তিনি প্রতি নতুন শিল্পীর কাজ খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। প্রচুর সময় ধরে তিনি আমাদের কাজ দেখছেন । যেন মনে হচ্ছিল তিনি আমাদের খুব কাছের মানুষ । “কেমন লাগল ?” সব শেষে জিজ্ঞেস করতে গণেশ পাইন বললেন, “তোমরা যখন জলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছ, তখন কোথাও না কোথাও তো ঠেকবেই । ” আমিও তখন বললাম, “আমাদের তো সব ছোট ছোট কাগজের নৌকো, আপনারা তো বড় বড় জাহাজ ।” শুনে উনি আরও একটা চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন । আসলে তিনি ছিলেন মাটির মানুষ, শিল্পীদের কাজ দেখতেন, শিল্পীদের উৎসাহ দিতে তাঁর কৃপণতা ছিল না । তাঁর ধারা বেঙ্গল আর্ট স্কুলকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল । তাঁর ছবিতে অনেক প্রভাব থাকলেও তাকে তিনি মডিফাইড করেছিলেন । আসলে গগনেন্দ্র, অবনীন্দ্রের যে বেঙ্গল আর্ট ধারা প্রায় স্থবিরস্থায় চলে গেছিল , তিনি সেই ধারাকেই বাংলার মিথ, জীবন, গল্প আর নিজস্ব দর্শনকে একসঙ্গে মিশিয়ে তাতে গতি দিয়েছিলেন । নিজেও প্রভাবিত করেছেন বহু শিল্পীকে । এই সম্পর্কে আমি তাঁকে একটা প্রশ্নও করেছিলাম । সেবার আমাদের দ্বিতীয় দেখা । বর্তমানে এখন যিনি ‘সিমা আর্ট গ্যালারি’-এর কর্ণধার, সেই রাখি সরকার এর আয়জনায় ৮এর দশকেই গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, সোমনাথ হোড় ও আর এক শিল্পী নিয়ে (এই মুহূর্তে ঠিক স্মরণে আসছে না, যাইহোক) বিড়লা একাদেমিতে “ভিশন ’৮৪” বলে একটা প্রদর্শনী হয়েছিল । সেখানেই প্রথম বার গণেশ পাইনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার । সেখানে আমি কথায় কথায় প্রশ্ন করেছিলাম যে “আমাদের একজনের কাজের ওপর আর একজনের কাজের যে প্রভাব ফেলে সেটা কী ঠিক ?” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ধরতে পারলেন তিনি । তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আসলে আমরা যে আদিম গুহামানবের উত্তরপুরুষ, তাঁর যে আদিম জ্ঞান, সেই জ্ঞান এখনও আমাদের অবচেতনে লুকিয়ে রয়েছে । আমরা তো কেউই স্বয়ংভু নই।” এই বিড়লা একাদেমিতেই আর একবার ওনার সঙ্গে শেষ দেখা । সেই সময়ের গণেশ পাইনের সঙ্গে আমাদের যৌবনের দেখা গণেশ পাইনের অমিল অনেক । তখন তিনি নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছেন । শুধুই নিজের কাজ নিয়ে থাকতেন । কখনও কোনোদিন দলবাজি করেননি। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে তিনি নাকি হাওড়াব্রিজ পেরোননি । অবশ্য এই কথা শুনলে তিনি মৃদু হেসে বলতেন “আরে না না হাওড়া ব্রিজ পেরিয়েছি” । নিজেকে খুব গুটিয়ে নিয়েছিলেন শেষ জীবনে । হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায় প্রদর্শনী করতেন । বিদেশের মাটিতেও ছিল শক্ত জমি । হয়তো আমরাও সেই পূর্বপুরুষ অগ্রজদের কাছে ঋণী হয়ে যাবো । যেমন বহু যুগ অন্তর এক একজন লোক আমাদের ভাবনা প্রকাশের এক একটা মাধম্যের এক একটা নতুন স্রোত তৈরি করে, তারপর বহু নুড়ি পাথর নিয়ে সেই স্রোত এগিয়ে চলে । তেমনই এক স্রোত তৈরি করে গেলেন গণেশ পাইন ।

অনুলিখন – জুবিন ঘোষ

গণেশ পাইনকে অন্যভাবে - সুধীরঞ্জন মুখার্জী

গণেশ পাইনকে অন্যভাবে
সুধীরঞ্জন মুখার্জী


যে মানুষ কালও ছবি এঁকেছেন আজ তিনি আর নেই। পড়ে রইলো তাঁর রঙ, তুলি কালি, কলম আর পট। তাঁর শিল্পভাবনা নিয়ে তিনি লোকান্তরিত হলেন। এই বোধ আমাদের বেদনার গভীরে নিয়ে যায় যে ছবি সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী পর্যায়গুলি যা হতে পারতো আমরা তা হারালাম।

আমি কলেজে পড়ার সময় থেকেই তাঁর ছবি দেখে আসছি। শুনতাম শিল্পী গণেশ পাইনের ছবি নাকি সব বিক্রি হয়ে যায় আর তার নাকি অনেক দাম। ওনার ছবি দেখে প্রথম যে ভাব আমার মনের মধ্যে ফুটে উঠেছিল তা হলো তাঁর ছবির চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে তিনি যেন কাল অতিক্রম করে চলেছেন। দ্বিমাত্রিক পটে বিধৃত সেই সব চরিত্রের অভিব্যক্তি গড়ন এক চিরকালীন আবেদন নিয়ে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত সেই সব মানুষ, প্রানী, গাছ যেন অন্ধকার ও অনন্ত মহাকাশের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত। তাঁর ছবির জ্যামিতিক বিভাজন সংক্রান্ত সচেতনতা লক্ষণীয়ভাবে সব সময়েই ছবির আয়তকার পটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গড়ে উঠেছে। ওনার ছবির ভিতরে আকারের ভাঙ্গা-গড়া তাঁর অন্তর্নিহিত তাগিদ থেকেই হয়ে চলেছিল। রঙ, কালি, কলম ও তুলি ছাড়া অন্য কোনো আধুনিক মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে চমক সৃষ্টির পথে তিনি হাঁটেন নি। এক স্থিতপ্রজ্ঞ শিল্পী যিনি নিরন্তর আকারের মহাযাত্রায় যাত্রী হয়ে রইলেন।

আমার ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পরেই সামান্য ৩/৪ বার শিল্পী গণেশ পাইনের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই রকম একদিনের আলাপচারিতার কথা তখনই বাড়ি ফিরে ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আজ পাঠকের কাছে সেই পাতা ক'খানি খুলে দিলাম।

আজ ১১ ই মার্চ, ১৯৮১ আমি আর আমার দুই বন্ধু শ্রী উত্তম পাত্র আর শ্রী উত্তম সেনগুপ্ত গিয়েছিলাম কলেজস্ট্রীট মার্কেটের বসন্ত কেবিনে। অবশ্য এই যাওয়ার আগে এর সূত্র ধরে কয়েকদিন আগের ঘটনা মনে করতে হয়। সেটা ছিল একাডেমী অফ ফাইন আর্টস এ (১৯৮১) আমাদের যৌথ চিত্র প্রদর্শনীর শেষ দিন। শিল্পী গণেশ পাইন সেদিন একাডেমীতে এসেছিলেন। উনি একাডেমীর ক্যান্টিনের চা 'বিষ' মনে করতেন। কারণ আমাদের এর আগের প্রদর্শনীতে এসে চা খাওয়াতে প্রবল আপত্তি প্রকাশ করেছিলেন। তা এবারে (১৯৮১) সাউথ গ্যালারীতে আমাদের প্রদর্শনীতে জিজ্ঞাসা করলাম -- "চা খাবেন তো ? নাকি বিষ বলে আপত্তি আছে ?" উনি হাসিমুখে উত্তর দিলেন "না খেতে পারি এখন আর বিষ নেই, তবে তোমরা সকলে যদি খাও তবেই।"

আমি ক্যান্টিন থেকে যখন চা নিয়ে ফিরলাম অখন দেখলাম উনি আমার ছবিগুলোর সামনে একটা দেয়ার নিয়ে বসে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেখছেন। চা হাতে দিয়ে পাশে একটা চেয়ার নিয়ে আমি বসলাম অনুগত ছাত্রের মতো। উনি বললেন "আমি 'Statesman' পত্রিকায় তোমার ছবির review পড়েছি, আমার মনে হয় নীরদবাবুর (শ্রী নীরদ মজুমদার) schooling তোমার consciously follow করা উচিত। দ্যাখো বিদেশে শিল্পের ক্ষেত্রে একটা পরম্পরা আছে, একটা ধারাবাহিকতা আছে, একটা ঘরণাকে অনুসরণ করে তাকে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যেটা আমাদের দেশে হয় না। তুমি যদি নীরদবাবুর রীতিনীতি ও পদ্ধতিগত ক্রিয়াকৌশল ভালোভাবে আন্তরিকতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পারো তাহলে সেটা খোলাখুলিভাবে গ্রহণ করা উচিত।" আমি জানালাম আমার কথা -- "দেখুন, নীরদ মজুমদারের ছবি আমার খুবই ভালবাসি, তবে এটা ঠিক সেজান আমার কাছে অনেকখানি। আমি consciously সেজানকে যতটা বুঝতে চেষ্টা করি বা মেলাতে চেষ্টা করি সরাসরি নীরদবাবুর ছবিকে ততটা নয়।"


আমার ছবিগুলো থেকে গণেশদা ওঁর পছন্দ জানালেন -- "Nature এর বড় ছবিটা খুব ভালো হয়েছে।" সেদিনের কথা এই পর্যন্তই। এরপর ওঁর পরামর্শ মতোই আমরা মিলিত হলাম ১১ই মার্চ সন্ধ্যায় বসন্ত কেবিনে।

১১ই মার্চ সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। বসন্ত কেবিনে যখন পৌঁছালাম তখন ও পাড়ায় লোডশেডিং চলছে। হ্যাজাকের আলোয় চাপা গরমে উনি বসেছিলেন। আমরা গিয়ে ওনাকে ঘিরে বসলাম। চা না হলে চলবে না বিশেষ করে রেস্তোরাঁয় বসে শুকনো গল্প চলে না। সুতরাং টোস্ট, ফিস ফ্রাই ও চা এলো। নানারকম টুকরো টুকরো কথাবার্তা চলতে লাগলো। ছবিতে influence বা প্রভাবের কথা উঠলো। উনি শিল্পী অতুল বসুর কথা বলছিলেন। অতুলবাবু নাকি বলেছিলেন যে একজন শিল্পের ছাত্রের পক্ষে আর্ট কলেজের পাঁচ বছর খুব বেশী সময়। এ ক্ষেত্রে ছ মাসই যথেষ্ট। অর্থাৎ ছ মাসে তাকে How to draw and paint শিখিয়ে ছেড়ে দাও, তারপর সে তার নিজের পথ খুঁজে নেবে। গণেশদার মত -- "পাঁচ বছর ধরে শেখানোর ফলে আর্ট কলেজের ছাত্ররা ক্রমশঃ নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। অন্যের জামা গায়ে দিয়ে বেরোয়, সেটা কাম্য নয়।" আমি বলতে চাইলাম যে আপনি বলছেন তা ঠিক, কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্বতা অতি দুর্লভ বস্তু। খুব কম শিল্পীই একটি রেখা টেনে বলতে পারে যে এই লাইন টানলাম, রঙ লাগালাম -- এ পুরোপুরি আমার। এই রঙ রেখা এর আগে কোনো শিল্পী দেকাহতে পারেন নি। গণেশদা অবশ্য এ যুক্তি মানলেন। বললেন -- "হ্যাঁ, তা ঠিকই।" আমি তখন বললাম যে আমাদের অশেষ কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। মন দিয়ে ছবি আঁকার মধ্যে ডুবে থাকলে একদিন ঠিকই পত খুঁজে পাবো, তাই না ? উপস্থিত সকলেই একথা মানলেন। গণেশদা বললেন -- "হ্যাঁ, Passion for painting থাকতে হবে। রাতে ঘুম থেকে উঠে সদ্য করা ছবির গায়ে হাত বুলিয়ে তাপমাত্রা অনুভব করার চেষ্টা সেই শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব যে কাজ পাগল। যে জানে ছবির একটা প্রাণ আছে, তার শ্বাস-প্রশ্বাস সবই অনুভব করা যায়।" এই প্রসঙ্গে পিকাসোর একটা উক্তি মনে পড়ে গেলো যার অর্থ এইরকম যে একটা ছবি তার জন্মের পর থেকে একটা প্রাণীর মতই বাঁচে ও জীবনধারণ করে যার স্পন্দন অনুভব করা যায়।


এরপর প্রসঙ্গ উঠলো ছবিতে ভারতীয়ত্ব কিভাবে আনা যায়। আমি এই প্রশ্ন তুলতে গণেশদা বেশ হেসে উঠলেন। উনি বললেন " তোমরা জামাই হলে এই প্রশ্নটা করা হবে।" অর্থাৎ এটা বেশ জামাই ঠকানো প্রশ্ন। আমরা বুঝলাম যে এই ভারতীয় প্রসঙ্গটা ছবির ক্ষেত্রে বেশ ধোঁয়াটে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতা, শুধু পাশ্চাত্য বলিই বা কেন পৃথিবীর নানা সভ্যতার মধ্যে আদান প্রদান প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে। গণেশদা বললেন যে বর্তমান যুগে আমরা আমাদের জীবনে প্রতিমুহূর্তে পাশ্চাত্য উপাদানের প্রবেশ মেনে নিচ্ছি, না মানলে উপায় নেই এবং এ সব উপাদান আমাদের জীবনধারণ ও আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে এত জড়িয়ে যাচ্ছে যে তা আর আলাদা করা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমি কতখানি খাঁটি ভারতীয় আছি বা থাকতে পারবো তা ভাববার বিষয়। এই তর্কের অবশ্য কোনো শেষ হলো না।

গণেশদা জানতে চাইলেন যেহেতু আমরা রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র, সুতরাং চিত্রে ভারতীয়ত্ব সম্পর্কে আমাদের কোনো বিশেষ জ্ঞানলাভ হয়েছে কিনা। আমরা সবাই মাথা নাড়লাম -- অর্থাৎ জানি না। পরীক্ষার জন্য theory মুখস্থ করা ছাড়া এসব জানার চেষ্টা করিনি বা কেউ জানায়ওনি আমাদের।

উনি জিজ্ঞাসা করলেন -- "এখন ছবি আঁকতে আঁকতে কেমন বুঝছো ?" আমি বললাম -- "বড় ভয়ে আছি, কখন পিছলে না পড়ি।" গণেশদা হাসলেন, বললেন -- "বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাও। তবে এটা ঠিকই survive করা খুব শক্ত।" আমরাও মানলাম এ কথা। বললাম যে ঠিকই তো, কত কত ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর বিভিন্ন শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে বেরোচ্ছে। এরপর অনেক ঝরে যাচ্ছে, কিছু টিকছে। কয়েক বছর বাদে তাও থাকছে না, একজন বা দুজন ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে তার বাদবাকী সব জনারণ্যে মিশে যাচ্ছে। সুতরাং কাজ আর কাজ। নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। এর বেশী আমরা আর কিছু পারি না।

রাত তখন ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। বসন্ত কেবিনে লোডশেডিং শেষ হয়ে আলো ফিরে এসেছে। আমরা উঠে পড়লাম। গণেশদার সঙ্গে কথা হলো এখানেই আবার আমরা বসবো। না, সেটা আর হয় নি।

পশ্চিম পল্লী
শান্তিনিকেতন

থমকে সময়, তোমার পায়ে - দিবাকর দাস

থমকে সময়, তোমার পায়ে
দিবাকর দাস


দিগন্তটা একদম সামনে, কী আছে ওর ওপাশে, তার যা--খোঁজই চলছে জীবনভর। যে কজন স্মৃতিজন্মা সেই অদেখার খোঁজ নিয়ে পলাশ-শিউলির মত টুপ করে ঝরে পড়ে এই ভূমিতে -- গণেশ পাইন তাদের মধ্যে অগ্রগন্য। ভবিষ্যতের শিল্পীরা অবন-যোগেন-পাইন নামক মাইলফলক দেখেই সংখ্যাছবি চিনে যায়। কলকাতার সিমা প্রদর্শনশালায় তার সারা জীবনের শ্রেষ্ট শিল্পকর্মের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই অনুভূতিই হল। আমাদের দৃষ্টি শেষ হয়ে যায় দিগন্তে। আর ওনার ছবি শুরুই হয় দিগন্ত থেকে। অর্থাৎ সবই চতুর্থ ভুবনের (4th dimention) কথামালা। কী থেকে যে কী হয় শিল্পীও কি তার খবর রাখে ছাই ? তাঁর সৃষ্টিকর্মের সামনে দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায় -- মাতাল সমীরণ সব ওলট পালট করে দিয়েছে। পপ-কর্ন ফোটার আনন্দ। এক একটা ছবি যদি দুই-তিন মাস ধরে আঁকা হয়, তবে তো এরকম হবেই। শুরু হবে বোধের একস্তর থেকে, উন্নীত হয় অন্যস্তরে। আমাদের জীবন, সে তো পুতুল খেলা -- তার প্রকাশ ছড়িয়ে আছে মহাভারত বিষয়ক সব ছবিতে।


মন্দার বোস অমর, কেজরিওয়াল ও তাঁর কয়েক প্রজন্ম নিশ্চিন্ত, রাখীদি গর্বিত, মনে আনন্দ ও বেশ কিছু শব্দ কোলাহল শিল্পীকে স্মরণ করে পাওয়া যাবেই। আমার বাবা কদিন আগেই বলছিলেন (ওর ছবি দেখে), কী সব ছাই ভষ্ম টাঙিয়ে রেখেছিস ঘরে ...। তিনিই এখন বিচলিত, খবরের কাগজে ওনার মৃত্যু সংবাদ পড়ে। হায় পাইনবাবু, আপনি ঠিকদেশে ভুল মানুষের মাঝে টপকে পড়েছেন। এখানে আপনার নামের কদর আছে। কামের সাথে পরিচয় মুষ্টিমেয় কয়েকজনের। আর আপনার বোধ ? ঠহর করা যায় না বলেই আপনার শিল্পচিন্তা বিষয়ক অভিজ্ঞতার চিঠিপত্র এই দামে লোকে কেনে ...


আমিও তো বুঝি না, চেয়ে থাকতে ভালো লাগে তাই দেখি ...

দিগন্ত রেখাটা একদম সামনে।

গণেশ পাইন, আমি আর অমিত - অশোক সেন

গণেশ পাইন, আমি আর অমিত
অশোক সেন


এই লেখাটি আমি অনুজ বন্ধু অমিতের সনির্বন্ধ অনুরোধে লিখছি, এই বিষয়ে লেখার সঠিক যোগ্যতা আমার নেই ! অমিত ( নাহ্‌, রায় নয় বিশ্বাস ) নিজে একজন খুবই গুণী চিত্রশিল্পী । আর আমি একজন পদার্থবিদ; সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের পথিক ! তবে, সাহিত্য, নাটক, কবিতা, আবৃত্তি, ফটোগ্রাফি ইত্যাদির মত ফাইন আর্টের অনেকগুলি দিক - আমার মনকে আকর্ষণ করে ! আমাদের আলাপন শুরু হয় বছর খানেক আগে ফেসবুকের পাতা থেকে ; ওনার রঙ-তুলির ব্যবহার আমার ভালো লাগে । চাক্ষুষ পরিচয় হল কোলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস -এর চত্বরে ; অমিত আর বিশ্বজিৎ কর্মকারের ' 'The Visionary Minds' (15-19 February, 2013 ) নামক যৌথ প্রদর্শনীতে । আমি বলেছিলাম যে , গণেশ পাইন আর বিকাশ ভট্টাচার্য ( আমাদের সমকালীন ভারতের দুই কিংবদন্তী চিত্রশিল্পী ) ৭০ এর দশকের গোড়া থেকেই আমার খুবই প্রিয় চিত্রশিল্পী । আর অমিতের বেশ কিছু আঁকায় -গণেশের ছায়া বেশ ভালো ভাবেই বোঝা যায় । যেমন - দ্য এডিটর , টেম্পারা অন পেপার মিডিয়ামে । ফলত, আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও একটু বাড়লো বৈকি ! এর মাস খানেক পরে, ফেসবুকে আমাদের স্বতন্ত্র, একটু গভীর আলোচনা শুরু হয় । গত ১২ ই মার্চ এ, গণেশ পাইনের মৃত্যুদিনের পর থেকে ।

অমিত মূলত গণেশ পাইনের ওপর একটি লেখা দিতে বললেন আমাকে, একটি ব্লগ টাইপের ই - জার্নালের জন্য । শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে, আমি অনেক বললাম যে এই রকমের একটি লেখার জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা আমার নেই । আমার এই লেখা দেওয়া কি ঠিক হবে ? তখন অমিত বললেন যে - আমি ওনার সাথে কথা বলতে গিয়ে , আমার ভালো লাগার যে অনুভূতিটুকু পেয়েছি , সেই কথা লিখলেই চলবে । তো আমি সেই টুকুই লিখতে বসেছি ।
আর গণেশ পাইনের সঙ্গে কোন উপায়েই কথা বলার চেষ্টা করিনি ; ওনার তীব্র ' introvert ' মনোভাবের কথা জানতাম বলেই । আমি সেই অর্থে ঋদ্ধ নই ।তাই , হে পরিশীলিত পাঠক, এর মধ্যে যে ভুল-ভ্রান্তি পাবেন ,তা জানিয়ে দেবেন এবং নিজগুনে মাফ করে দেবেন - এই আশা রাখি ।

প্রথমেই তাহলে বলি যে , আমাদের বাসার লিভিং রুমে গণেশ -এর যে ছবির প্রিন্ট রয়েছে ~ সেটির কথা । সেই ছবির নাম হল ' দ্য ফ্লুট্‌ প্লেয়ার'। 'মিক্সড্‌ মিডিয়া অন পেপার'- এ এই ছবিটির সাল ১৯৯১ । ছবিটি অবশ্যই বংশীবাদক কৃষ্ণের ; ছবির মধ্যে কালচে নীল রঙের প্রাধান্য চোখে পড়ে । কৃষ্ণ ( কালো ) হালকা নীল এর প্রতীক হিসেবে ! আরও মনে হয়েছে যে , এই নীল যেন পিকাসোর ' ব্লু পিরিয়ড' এর অভিব্যক্তি তুল্য ।( শুরুর দিকে ওনার পিকাসো / গগনেন্দ্রনাথ, এবং দালি'র অবচেতন মনকে চিত্রায়ন করার প্রভাব ! অবশ্য , অবনেন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল আরো বেশী ) কিন্তু এটাও জানি যে , মাঝ বয়সের আগেই উনি এই সব রথী-মহারথীদের পথ থেকে বেঁকে, অনেক দূরে নিজস্ব একটি শৈলী গড়ে তুলেছিলেন । সেখানে আলোর থেকে অন্ধকার হয়তো কিঞ্চিৎ বেশী পরিমানেই থাকতো ! মৃত্যু প্রায় সব ছবিতেই জীবনের কাছেই স্থান করে নিত ! কিন্তু মিক্সড্‌ মিডিয়া অন পেপার, গুয়াশ শেষ পর্যন্ত টেম্পেরার অনন্য মাস্টার হিসেবে , ওনার সিগনেচার ছবিগুলি আন্তর্জাতিক স্তরে যথাযোগ্য স্বীকৃতি লাভ করেছিলো । এই অন্ধকারের আধিক্য নিয়ে অনেকে লিখেছেন । যেমন, ওনার জীবনের প্রথম অর্ধেক যে গলি ঘুঁজির মধ্যে ,আর তার আধো অন্ধকার , মলিন রঙচটা দেওয়াল এবং এই সবের ঊর্ধ্বে অপ্রকাশিত চিলেকোঠার ঘরের ( ওনার স্টুডিও ) কারনেই ঘটেছিল - তা তো প্রায় সত্যই । আমি তো তাই দেখি ওনার প্রায় সমস্ত মিক্সড মিডিয়া বা টেম্পারার কাজগুলির মধ্যে । তাই মনে হয় যে, কৃষ্ণের পটলমার্কা প্রায় নিমীলিত চোখ , অন্ধকারের বিজয় উৎসবকে সূচিত করে না , এটি বরং বহির্জগৎকে পুরো উপেক্ষা করে অন্তর্লীন জগতের উদ্দেশ্যে ধ্যানে মগ্ন !!

কবিতা - অরুণ চক্রবর্তী

তরাই
অরুণ চক্রবর্তী


উপলে খানখান চিরুণী
ধূসর শলাকায় বন্দী দেবদারুকে
বলে পথ করে দিতে
মেঘেরা আটকা পড়েছে মেঘের গায়ে
কাঁখে কোলে নীলাকাশ
বৈধব্যে নতমুখ
হেঁটে যায় ভূটিয়া শিশু
হিল কার্ট রোডের টুংটাং গানের ভেলায়।
স্বপ্নেরা নেমে আসে স্বপ্ন ফেলে
তরীমুখ মোছে পাউডার তিস্তায়
জলে ঘূর্ণিপাকে মাছরাঙা ঠোঁট শানায়
লতাপুতার ভাসন্ত শরীরে।
এইখানে দেখা কোর সিক্ত উপলে
নিঃশ্ছায়া দেবদারু বনে
ছোট এক মহানদীর জলে ভেসে
মনে রেখো স্বপ্নেরা জলপাথর
সব।

কবিতা - জুবিন ঘোষ

সহজিয়া
জুবিন ঘোষ

সহজ করে বলার চেয়ে সহজ কিছু নাই
সহজ করে বলার মতো সহজ হওয়া চাই

সহজ করে বলব কী ভাই সহজ কেউ নয়
কী এসে যায় তাতে তোমার সহজ অকুতভয়

সহজ ছিল ছেলেবেলা সহজ ছিল গ্রাম
সহজ ছিল আকাশবাতাস বাংলা নদীর নাম

সহজ হবে ভিতরবাহির সহজ পথ ধরে
জটিল ধুলো উড়িয়ে ছুটি সহজ সাদা ভোরে

হলোই-বা কিছু সহজ ভুল সহজ মনে তার
সহজ করে স্বীকার করতে সাহস দরকার

সহজ করে বলার চেয়ে সহজ কিছু নাই
সহজ করে বলার মতো সহজ হওয়া চাই

কবিতা - অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়

অনিদ্রা
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়


এইতো খরচে
ইশারা র র্যা ম্প
বেয়ে নামছে কার্নিশ
বিছানা থেকে অসম্ভব শাড়ি
#
পাল্টাচ্ছে রং
হেরে যাওয়া
কাছের জানালায়
#
আমাদের শেষ তখন শোনারপাতায়
টিলা থেকে নেমে আসা বাণ
নামিয়েছে সকাল
পাতাশের বৃষ্টি হয়ে
#
শিশুরা দেখছে এইসব
আর ঘুড়িতে রঙিন
#
আর প্রিয় শরীর চলে যাচ্ছে
বাগানের দিকে
আহা আহা
স্নানের দিকে

কবিতা - সাজ্জাদ সাঈফ

তমা সিরিজ
সাজ্জাদ সাঈফ


দেয়াল

এসো না অতটা কাছে মাঝামাঝি দেয়াল মেঘের-
সন্ধ্যেটা ঢেউগণিতের সমকোনে কদাকার মৌমাছি বৈ ত কিছু নয় ল্যাম্প পোস্টের আড়াআড়ি ছায়া ঘন কুয়াশায় কড়া পাতি চা দুর্মূল্যের ভেঁপু
তুমি পারো বটে,ওই অতখানি খাঁদ এক ঝটকায় লাফিয়ে পেরোনো আর যাই হোক ছাপোষা মাঝির এক জীবনে দুরুহ বোনাস,হাত বাড়ানোই সার,দেয়ালে কি সব শিশুতোষ আঁকিবুকি,কেউ এনে দিলো বুঝি সমনের ঘুঁটি ,আর এক পা,তমা,তোমাকে দূর্যোগে পেতে চাই আজ!


নকশা


আলজিভে কৃষকের ধান, বসন্ত বিপ্লবে, নিয়েছ চাবুকের গতি অস্ত সুর্যে ধীর, প্রিয়
শেমিজের আয়ত‌ণে, উরুবন্দি শাল বাগান বিষ্ঠা বীজ়ে সাবাড় ...

পতনে প্রাপ্প শোকের মত পায়রা গুনছি বসে ,বিকেল ছনের ব্যাস্ত বাতাসে কুমারি পুজোর জোগাড়,সত্যি হেসে
ফুলবাবু রোদ দাঁত কাটা পেন্সিলে ঝলমল করলে আড় চোখ ও'কে কুশলাদি সেধে বস্তুবাদি হয়,দেয়ালের বার্ধক্যে আমি ফের নকশা বসাই !


শুমারি করা নেই


সমস্ত পথ বুনো শরতের সাথে উত্‍সব গাঁথা পতাকার উদ্বোধন,হামাগুড়ি দিয়ে সরিয়ে আনো জেলখানাটা-

কচুরী-পানার স্রোতে দীঘি নালা'রাও সমূদ্রকে চায়,মাস্তুলে সুপুড়ি কুড়োতে আসা জেলেশিশুদের শেষতম হাড়, তা'ই বলো শীত কি পৃথক জলবিন্দু সাজাবে ঘাসে?

তোমার দখলে তবু খাস তরবারি,চৌরাস্তার জলে ঘূর্ণি পাঁকিয়ে উঠে আসা নদী...
ঘুম ঘুম চোখে সরীসৃপ যেটুকু চায়,তার চেয়ে বলো কে বেশি জাগ্রত?

সহজ বাণিজ্যে খোলসের মধু শুনি কোমরে সেতার,কোন দিকে যাবে,এ পথের কোনো শুমারি করা নেই।

কবিতা - শুভঙ্কর পাল

ব্যক্তিগত বিকেল
শুভঙ্কর পাল


বিকেল গড়িয়ে সাইকেলের প্যাডেল
ক্লান্তি চুমুকে চায়ের কাপ
আড্ডার চৌমুখ
প্রতীকি সময়ে কবিতার জন্য ল্যাম্পপোস্টের আলো
বেদীমুখী পাগলের শবমুদ্রা
আহা ! নতজানু খিলানগুলি কবিতাকে
খাতা ও চশমার ব্যবধান ঘুচিয়ে নিচ্ছে কেবল ।
যে রাস্তাটা বক্সাভিমুখী ছায়াগুলো সেখানেই থেমে যাচ্ছে
আর জোছনাদের ভিজিয়ে নিচ্ছে শরীর
আমার ফেরার রাস্তাটা ক্রমশঃ দীর্ঘ হতে থাকে......

কবিতা - কৌশিক বিশ্বাস

ভ্রমণ
কৌশিক বিশ্বাস



যে সব তোড়জোড় পড়ে ছিল
খোলা টিকিটের গন্তব্যে
অস্থায়ী নেশা নেশা ঘোরে বাদামি স্তাবক দিশেহারা

নোয়ানো জবা গাছ ব্যালকনি ঘিরে উঠে যাওয়া
ঘুম ঘুম পাণ্ডুলিপি

চুমুকে গিলে ফেলা অজুহাতে আমার হাত ...

রেখে দিয়ে গেছি কত না সমুদ্দুর
বহুদূর দিয়ে গড়ানো রেললাইনের কাহিনী
টিকিটের থেকে সরিয়ে রেখেছি খিদে
অসমাপ্ত ভ্রমণকথা ।

কবিতা - অনুপম মুখোপাধ্যায়

শহর
অনুপম মুখোপাধ্যায়



একটা শহর সেখানে দারুণ পনীর তৈরি হচ্ছে

আকাশটা আশ্চর্য নীল
ঘোড়সওয়ারের মূর্তির রঙ ঘন সবুজ , আর
দেওয়ালে দেওয়ালে সোনা ঝলসাচ্ছে

তুমি আমি সেই শহরে যাচ্ছি

তুমি আমি

বদলে দেওয়া দুধ ভালোবাসছি

কবিতা - শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস

ও মেরি জান
শঙ্খশুভ্র দে বিশ্বাস


১.
মন ও শরীর যেমন
একে অপরের বন্ধু হতে পারে না কখনোই
... সেরকম
আমাদের সম্পর্ক !

তোমার ভেতর আমার বীজ পোঁতা আছে
তবু
আমি তোমার ভেতর বেড়ে উঠতে পাচ্ছি না
বরং
তুমি আমার ভেতর
বাড়তে বাড়তে
আমাকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছ ক্রমশ...

২.
শরীর ছাড়িয়ে মন
কত অন্য শরীরের অন্দরমহল ঘুরে আসে
তাও তার নিজের শরীর তাকে আশ্রয় দেয়
যেরকম তোমার প্রশ্রয়
আমার মজবুত আশ্রয় !


কবিতা - সুমিতরঞ্জন দাস

সুইসাইডিয়াল
সুমিতরঞ্জন দাস


রক্তে মিশে আছে সব সমানুপাতিক হারে -
বাল্যকাল স্নেহ মায়া মমতা ...

আর ইর্ষা ?


মুহুর্তে ভেঙ্গে গেল নৈশব্দের মৌনমুখরতা,
খোলা দরজা দিয়ে ছুটে এলো উত্তুরে হাওয়ার ডাকে
ড্রেসিং টেবিলের মাসকারার দাগ, পরিচিত ঘামগন্ধ
দুরদার শব্দে জানান দিল বসন্তরঙীন দিন;

আজ কোন সুত্রেই যাদের মেলাতে পারি না ।

জল থেকে তুলে এনে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম জীবনের
রোমরোমে সেই অশ্রুসিক্ত আত্মসত্ত্বাই আজ বিদ্রোহী
ধীরেধীরে বেড়ে উঠেছে মৃত্যুঋন, চাইছে হিসাব

কি করে বোঝাই বড় হবার আর এক নাম আত্মহত্যা ।

কবিতা - প্রসেনজিৎ দত্ত

ইহান্তর
প্রসেনজিৎ দত্ত


অপার নাগরিক শেষ হয়ে গেছে!
সেই সব একলা অনুধ্যান রঙের খাদ্য।
শুয়ে আছে স্বপনছটা,
পুরনো ব্যাকরণ মেনে তার্কিক অঞ্চল ছাড়ে!
এ যাবত দুর্বোধ্য বন্ধুরা
শকুন-সংক্রান্তির দিনে উপোস করেছিল।

এই ভাবে ঘোষণা করা যায় ছুঁইশুচি—
মাটিজীবন পার করে কান্নাও কাঁদে;
দুশোছয় কঙ্কাল ছুঁয়ে গিয়ে
নরখণ্ড ব্যাধে মাথানত মুদ্রায় নিশানা সানায়।
এরপর শিল্পান্তর।
ছড়াছড়ি রং
সিদ্ধির শত্রুর কাছে গণেশভ্রমণ;
পংক্তিবিহীন পাইনকাঠে ভাঙাতে দিয়েছি পঞ্জিকা 
 
 

কবিতা - রাজীব ঘোষ

নাচ রাধা নাচ
রাজীব ঘোষ


চরণ ছুঁয়ে যে নিশিপদ্ম হেঁটে যায়
ঘুমন্ত ঝাউয়ের খেতে তুফান তুলে নিশ্বাস
মনের অনেক গভীরে ছড়িয়ে যায় কলমির ডগা
তবু পরকীয়া চায় গোপন পরিয়ায়ী দল
তোমায় আঁকড়ে ধরে কালাচাঁদ ওরা হাসে নির্জন
কত গল্প কত ধুলোঝড় আছড়ে পড়ে
শিয়োরবনী চিরদুর্জ্ঞেয় অনুভব থেকে ওঠে বাঁশি
তিনটি রুটে ঊড়ে যায় চাঁদের উপর দিয়ে
কোরাসে জম্মানো চাবুক ঠোঁটে ঠোঁটে ঘোরে
পুরুষ তুমিই জানো কী করে উর্বরা হয় মাটি
বসন্তে আবীর নদীর বক্ষে গাঁথা নাচ রাধা নাচ
নৃত্যচঞ্চলা ঢেউ আকুল মাটিকে ছিনিয়ে নিতে নাচ
শ্যাওলাধরা কোমরে সুগন্ধি স্বপ্ন লুকিয়ে -
মুছে ফেল সুন্দর দোষটুকু শ্যামল শোভন গায় !

কবিতা - কচি রেজা

গনেশ পাইন
কচি রেজা


ও পাড়ার লোকেদের পুনরুত্থান নেই অথচ আরেকটা জন্মের জন্য কেঁপে ওঠে পুনঃমৃত্যু --- যে-তুমি নির্বাচিত হও মাছেদের বহুদূর ভবিষ্যৎ দেখে, জানি না নখ ছুঁয়ে কেনো ঘেমে ওঠে জামা, কুকুর আঁচড়ে যাচ্ছে অস্থির শব, প্রত্যাহার করো এই চাপা বিষাদ, বেঁকে যাক ইউক্যালিপটাস আর লগ্নজীবী তরুনী, তালিকায় নিতে পারোr অসুখপর্ব? অজানা অবাধ্য আমি, নির্দিষ্ট অহংকারে বুনে যাচ্ছি সাদা সিল্ক,রাত জাগার সহচর তবে কী অতিচাঁদ অথবা রুদ্ধশ্বাস তাঁত?

কবিতা - অলকেশ দত্তরায়

উত্তর-ফাল্গুনী
অলকেশ দত্তরায়


অতঃপর; পোস্ট-মডার্ন সময়ে
তোমার রঙীন উত্তরীয় খোলার ছল।

ফাগুন হাওয়ায়
রাধার ধার্ষণীক লীলার
চমৎকারা মহরত চলছে
-বৃন্দাবনে-নাইটক্লাবে-বাসে-রাস্তায়-

সবার রঙে রঙ মিশিয়ে
যুবসমাজ আজ একাগ্রচিত্ত জাগ্রত।

হোলি হ্যায়!

কবিতা - ঊষসী ভট্টাচার্য

সময়ের একটি কোলাজ
ঊষসী ভট্টাচার্য



১.
এই তো রোদ্দুর, হাতের মুঠোয় আগুন নিয়ে উত্তাপ পোহাচ্ছি। কত রোদ চশমা ছুটে আসছে তোমার চোখে, কি নিঃসঙ্গ উষ্ণতা! সূর্যের মত লাভা পিণ্ড না হয়েও এক ঐতিহাসিক দহন উপহার দিলে, চেটোয় আজ সূর্যোদয়ের স্নান । মেলানকলি বৃষ্টির বাঁশি আজ তারা খসাবে না। চোখে শুধুই কাঠফাটা রোদ্দুর... এই তো দিনের শুরু।

২.
বৃষ্টি কোন এক সন্ধ্যায় শার্টের বোতাম আটকানো সভ্যতায় ধরা দিয়েছিল । খড় বিচালি লাফানো আবেগে বুকের মাঝের সিন্ড্রম মাস মানেনি। শুধুই নিতান্ত দাবানলের খেলা। মাস বৃষ্টির নয়, ঋতু তবু শরীরে শ্রাবণী।

৩.
আমাদের বাড়িতে কোনদিন কোন হিটার ছিলনা। সারাবছর ধরেই পাতা ঝরা খসখসানি। দাম্পত্যের শীতলতা,সম্পর্কের শীতলতা ... আর বাড়ির পুরনো ইট খসে যাওয়ায় ভাঙা সংসারের নিথর, পাথর শৈত্যপ্রবাহ। তাই রোজই আমরা পালন করেছি পৌষ পার্বন। পিঠে পুলি নয়, শীতল লোহিত কণিকার পৌষ পার্বণ ।

৪.
আজ পলাশ কুড়োতে এসেছিল পাড়ার মেয়েরা।বসন্ত উৎসব।কোন পলাশ নীল, কারোর পাঞ্জাবী আবার হলদেটে, কেউ আবার সদ্য কুঁড়ি- ক্লাস ইলেভেন। নোট দেওয়ার মাঝেই চিরকুট গলি।কুমারি কৃষ্ণচূড়ার মুখে তখন রঙমশালের চাকচিক্য। আজই তো বসন্ত উৎসব।

শেষ পর্ব ...

আমার শহরে কনক্রিটের দাগ ইট চেনায়, ধুলো শোঁকায় । ঋতু পাল্টায় শরীরে । কখনো শীত, কখনো গ্রীষ্ম ...এই তো , এই রকমই ... শিকড় প্রোথিত গভীরে, পাতা যাওয়া আসা এত স্পষ্ট তাই। চোখের সামনে ও নেপথ্যে রঙ নিয়ে পাল্টায় ঋতু, আমাদের ঘর ও দল বদলের মতো ।।

কবিতা - প্রশান্ত সরকার

মাথার ভেতরেই
প্রশান্ত সরকার



‘মাথার ভেতর শূন্য নয়, ষড়যন্ত্র আছে’ –
সোমাভ দা বলেছিল, ঠিকই
কিন্তু আমরা কেউই ততটা বোকা নই
যে ঘাতক ব্রুটাসের পিঠে
লুকোনো ছুরি দেখতে পাবোনা
দেখতে পাবোনা সহস্র ইটের ভেতরেও
একটা নরসিংহ মুখ
মুখোশ পরে বসে আছে যে একজন
বিষ্ণুর আদবকায়দা জেনে,
কোলে বসিয়ে, পরের দৃশ্যে
পেট চিরে ফালাফালা,
টেনে নেবে টোম্যাটো সসে দ্রবীভূত চাউমিন,
আর মাননীয় হিরন্যকশিপু
পাওনা চেয়ে নেবে বিকেলের পর,
সেসব আমাদের দেখার কথাও ছিল না
সোমাভ দা না বললেও আমরা বুঝতে পারতাম
প্রত্যেকটা কুরুক্ষেত্র
আসলে আমাদের মাথার ভেতরেই থাকে
পরিকল্পিত, প্রত্যেকটা যুদ্ধের আগে বা পরে

কবিতা - রাজীব ঘোষ

নাচ রাধা নাচ
রাজীব ঘোষ


চরণ ছুঁয়ে যে নিশিপদ্ম হেঁটে যায়
ঘুমন্ত ঝাউয়ের খেতে তুফন তুলে নিশ্বাস
মনের অনেক গভীরে জড়িয়ে যায় কলমির ডগা
তবু পরকীয়া চায় গোপন পরিয়ায়ী দল
তোমায় আঁকড়ে ধরে কালাচাদ ওরা হাসে নির্জন
কত গল্প কত ধুলোঝড় আছড়ে পড়ে
শিয়োরবনী চিরদুর্জ্ঞেয় অনুভব থেকে ওঠে বাঁশি
তিনটি রুটে ঊড়ে যায় চাঁদের উপর দিয়ে
কোরাসে জম্মানো চাবুক ঠোঁটে ঠোঁটে ঘোরে
পুরুষ তুমিই জানো কী করে উর্বরা হয় মাটি
বসন্তে আবীর নদীর বক্ষে গাঁথা নাচ রাধা নাচ
নৃত্যচঞ্চলা ঢেউ আকুল মাটিকে ছিনিয়ে নিতে নাচ
শ্যাওলাধরা কোমরে সুগন্ধি স্বপ্ন লুকিয়ে -
মুছে ফেল সুন্দর দোষটুকু শ্যামল শোভন গায় !

কবিতা - বর্ণশ্রী বক্‌সী


কাগজের নৌকা
বর্ণশ্রী বক্‌সী


কাগজের নৌকাখানি ভাসাই জলে
কাগজের নৌকাখানি ভাসাই জলে
প্রেমহীন মাঝ দরিয়ায়
           ভীষণ পাণি
সে পাণির সোয়াদ শুধু লবণ লবণ,
          এমনে দুঃখ-জ্বালা
          গরল ভেল !
এ কাঙাল হৃদয় কেবল
          কেঁদেই মলো,
মরমে ভীষণ তিয়াস
          আগুণ-জ্বলা,
ভালোবাসা প্রেম নাকি কয়
         কেবল মিছে,
খেলাঘর বাঁধতে চেয়ে
         ভেঙেই ফেলা ।

কবিতা - পিয়ুষকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়

বুধনার মা..
পিয়ুষকান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়


চল রি,ঘরকে,তাতছে মাটি
চাঁদি ফাটছে ,হলকা গায়ে
জল নাই,চুষছে ওলের ডাঁটি
শুকন্যা কাঁধায় ছায়েমায়ে

ঝনঝন কাঁপছে গমের কাঁচকি
হাঁ হুং বাজছে আংঠির খাল
ওই শুন হইহই,বায়ের আঁচ কি!
ফুসছে দাওদাও কার খড়-চাল?

দ্যাখ,ট্রাক চমকায় ধুল্যার পালকি
রাস্তার পাস দিং কলঘর যায়,
ড্রাইভার শিস দ্যায়,চাহুনির চাল কি
ভকভক গন্ধের লাল মদ খায়

ছুটকি,চল ভাই,বুধনার বাপটো
তিনদিন থেকি জ্বরজ্বর গায়,
থাম ভাই,এই ল্যান প্লাস্টিক কাপটো,
নুন লেই এইটুন,(উ)ভাত দিং খায়।

লোকটো মদ খেং চিল্ল্যায় দিনভর
মুনটো কিন্তুক ঠিক তালরস
কাঁদছি,কাটছি,করছি ধড়ফড়
মুনটো আজতক অর-পর বশ।

কবিতা - মিলন চট্টোপাধ্যায়

গাজন
মিলন চট্টোপাধ্যায়


নাগরদোলার মত মানুষেরা ঘোরে
পিঠেতে বেঁধানো কিছু
বঁড়শি রূপকে !

'চৈতী'হাওয়ায়
ঘুরপাক খায় - কিছু লুকোচুরি !

মুখে রঙ্‌ মাখা আমরা সবাই
আসলেতে গাজনের সঙ্‌ !

কবিতা - বেবী সাউ

প্রেম
বেবী সাউ


আমার এক গোপন কুঠুরী আছে
আর এক নৈঃশব্দ্য আকাশ

প্রত্যেক দিন যা হারিয়ে যায়
অথবা হারানোর ভবিষ্যৎ খোঁজে

ঠোঁট দিয়ে কি খোঁজ করো তুমি
ভয় ?
নাকি ভালোবাসা ?

হেমন্তের মাঠে রোজ কিছু কুয়াশা আসে
আমি ভুল করে ফিসফিসিয়ে উঠি 'ভালবাসি'

তুমি মৌন চোখে আকাশ দেখো

তারপর , এক এক পা করে পৌঁছে যাও প্রেমিকার বাড়ি ।

বলো , কেউ কি চাঁদ দেখে রোমাঞ্চহীন রাতে ?

কবিতা - সৈকত ঘোষ

চার আঙুলে রুপকথা
সৈকত ঘোষ


অলসতা কখনো কখনো
সময়কে ছুয়ে যায়, প্রায় প্রতিদিন
আমি তুলে আনি কিছু অক্ষর
আঙুলের ডগায় লেপ্টে থাকা
রঙিন আবর্তে
শিলালিপিরা দাম্ভিকতা হারায়
তুমি নিরাকার ঈশ্বর হলে
কাঁচের বয়ামে বন্দী মানুষ খুঁজতাম না
ঘড়ির কাঁটায় যতিচিহ্ন
কখনো কখনো বাধ্যতামূলক...

আমার ইচ্ছেরা রং পাল্টে
ইকোফ্রেন্ডলি খড়- কুটোয় নতুন ঠিকানা বানায়
শয়ে শয়ে তরঙ্গেরা সমুদ্র পার করে
জড়ো হয়

তোমার গর্ভে আর-তো ক’টা মাস
জন্ম হবে নতুন গ্রহের ...



ধারাবাহিক অবভাস - রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

অবভাস
রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

১।

আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে...



সে তাকিয়ে থাকে আর দেখে তার ছোট্ট ঘরের দেওয়ালগুলো শুয়ে, জানলাগুলো নুয়ে আর ছাদ ভুঁয়ে এসে পড়েছে। বাইরে আকাশের দিকে একটা তোরণ, হতে পারেকোন মণ্ডপ আর নহবতখানা। তার আগে মেঘে মেঘে কিছু রঙ হয়েছিল। পৃথিবীর কন্যাদের বিদায়। এই সময়, যে, কন্যে নয়, হাইওয়ের দিকে উঠছিল। পেট্রোলভ্যানের আলো মাপমত তার পেছনে এসে পড়েছিল। তারপর আর কিছু জানা নেই।

বিষাদ জ্বর নিয়ে গাছগুলো, মনে হয়, দেখেছিল। প্রলাপমারীর মধ্যে ছিল তারা। তাই সে ভাষা পাতায় পাতায় বোনা আছে। কোনদিন পাঠোদ্ধার হতে পারে। এদিকেতোলাবাজরা আকছার দানা ব্যবহার করছে। সন্ধের পর থেকেই শোনা যাচ্ছে সেসব অনিপুণ হাতের কারবার। ভারী ভারী মোটরবাইক সব শহরে ঢুকে পড়ছে। যেসবদোকানীরা ফ্লাইওভার, মেট্রো, মল শুঁকে শুঁকে এসেছিল, তারা হাতের সাথে সাথে ল্যাজও গোটাচ্ছে। হয়েছে বেশ। খচ্চর ছোকরারা যা যা মারাচ্ছিল, তার সাথে সংস্কৃতি মিশিয়ে দিচ্ছে। দেদার। লুটছেও ভাল।

সে শুধু লক্ষ্য রাখছে। হিপ পকেটে একটা ছোট নোটবুক, আর পেন্সিলারদের হাতে যেরকম থাকে ঠিক সেরকম একটা পেন্সিল। সুযোগ পেলেই আঁকিবুঁকি কাটছে। আর এমন ভাবে লেখাগুলো আওড়াচ্ছে যে মনে হচ্ছে বাপের না হলেও তার নিজের শ্রাদ্ধের খরচপত্রাদি। একাজে স্টেশানটা তাকে সাহায্য করছে খুব। স্টেশানের নিচে বাজারচত্বর। সব কটা নেশার ঠেক। মদ্দামাগি। শনিমন্দির লাগোয়া মাদুলির দোকান। গেল শনিবারের শালপাতা যেখানে একটা বাছুর চাটছে, ঠিক তার পাশ দিয়েই হাইওয়েটাতে উঠে যাওয়া যায়। এখন একটা ছেলে আর দুটো মেয়ে উঠছে। আসলে হাইওয়েটাই সবকিছু গুলিয়ে দিচ্ছে।



২।

তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে…



বাজারী পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় যেসব মফঃস্বলের কবিদের লেখা ছাপানোর আমন্ত্রণ জানানো হয় নি, তারা স্টেশান পেরিয়ে, এই প্রাচীন রাস্তাটার মোড় পেরিয়ে, বহু জন্মের নার্সিংহোমটার ঠিক নিচে, অফ্-সপটার সামনে, বাওয়াল দেয়। আর নক্কা ছক্কা নেশার পর যাদের লেখা ছাপা হয়েছে তাদের মা-মাসি করে। এরকমই একটা চাপের সন্ধ্যায় সে সেই নার্স-দিদিমণিকে নার্সিংহোমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখে ও দেখতে থাকে। তার ঘুরন্ত স্কার্টের নিচে অনেকটা টানা শাদা মোজা, যেন পৃথিবীর সমস্ত স্থিতিস্থাপকতাকে স্তব্ধ করে শালীন হয়ে রয়েছে।

আর ঠিক তেমনই তার শাদা জুতো।

নার্সদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণেই সে বাওয়াল দৃশ্য ত্যাগ করে তাকে অনুসরণ করে। ফোর পয়েন্ট ক্রসিঙে যে একটা নিদারুণ শাদা গাড়ি যে একটা নিদারুণ লাল আলো জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল, দিদিমণি এসে সে-টাতে উঠে পড়ে। গাড়িটা শান্ত ও স্নিগ্ধ ভাবে গড়াতে শুরু করে, যেন তার অ্যাক্সিলিয়েটরে চাপ পড়তেই সন্ধ্যে হেলে যায়। আর ঠিক সে সময়েই, ভারী মোটরবাইকটা, এই দৃশ্য-কাব্যের মধ্যে জোর করে ঢুকে পড়বে বলে, সাইলেন্সর পাইপ ফাটিয়ে, গর্জনরত অবস্থায় গাড়িটার পিছু নেয়। এরপর আর কিছু জানা নেই। কারণ, জানা যায় না।

সে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। গুনে গুনে দুটো হোঁচট খায়। কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্টকে সময় জিজ্ঞাসা করে। কাঠিকাবাব রোলের দোকানটা বন্ধ দেখে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। তারপর তার ডেরায় ঢুকে পড়ে।সেদিনের যা যা অনুসন্ধান নোটবুকে লিখে ফেলে। পেন্সিলটাকে ভাঁজে যত্ন করে রাখে।

এ সময়ে মোবাইলটা দুলে দুলে ওঠে। শব্দ তার কাছে বিভীষিকা বলে সে ওটাকে নিথর করে, ঠিক সেই নির্দেশে, যেভাবে ভাষ্যময় গলায় থিয়েটার শুরুর আগে রেকর্ডেড বাজানো হয়। সে অজান্তে হেসে উঠে। নিজেকে হেসে উঠতে শুনে একটু লজ্জিতও হয়। কারণ, তার বুকশেলফের পেছনে আর একটুও তলানি স্কচ নেই। যে কলটা ইনকামিং, সেটা তাকে আরও কিছু সময় বিব্রত করবে। তার আগে গলায় ঢেলে দিতে পারলে হত। কান দুটো গরম আর ভারী পড়ত। সে বাদ দিতে দিতে শুনত। তারপর না হয় বাদানুবাদে যেত।



৩।

... তখন ঠিক কী কারণে আকাশে একটা তারাবাজি ফুটেছিল...


ফ্লাইওভারের ঠিক নিচে তাকে যখন ফেলে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ঠিক কী কারণে আকাশে একটা তারাবাজি ফুটেছিল, তা অন্যান্য অনেক কিছুর মতই জানা যায় না। ট্রাকেরখালাসিরা, এক-দুজন করে, এক্সপ্রেসওয়ের ওধার থেকে প্রাতঃক্রিত্য সেরে নেমে আসার সময়ে তাকে দেখে। তবে, তাকে দেখার মত শুধু যা ছিল, তা তার অনিন্দসুন্দরগোড়ালি। এই একটা ভাবেই তাকে শনাক্ত করা যেত। আর সেটা একজনই পারত। বাকি কিছুর জন্য ফরেন্সিক রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হবে।

প্রথম রাতটায় সে বিশেষ একটা ঘুমোয় নি। তবে একটা ঘোর ছিল। বেশ কিছু ছায়া ও ছবিরা তার ঘরের উত্তরমুখো দেওয়ালে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। ওই দেওয়ালের জানলাথেকেই এক্সপ্রেসওয়েটা দেখা যায়।

সে ভোরবেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন সে ওঠে, বেলা গড়িয়ে গেছে। সমস্ত প্রামাণ্য সাক্ষ্য-চিহ্ন সহ। জটলারা আরও দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। কথারাও কান থেকে কানে ছড়াতেছড়াতে হাওয়াকথা হয়ে গেছে।



৪।

শালা হিজড়ের দল। সব কটার এক রা…



--খুব বেশি বাওয়ালি হচ্ছে...

লেখালেখির গাঁড় মেরে রেখে দেব

--হুঁ

-- হুঁ কি রে, বে? শ্লা...

--মাদারচোদ, সামনে এসে বল...

--দাদা হয়ে গেছ, সম্পাদকের দপ্তর পর্যন্ত এখন নাক গলাচ্ছ...

--মা,বউ, বউদিমণি সবার কোল ফাঁকা করে দেব


সে মনে করতে চাইছিল ঠিক কী ঘটেছিল, বাওয়ালটা কী নিয়ে কারা দিচ্ছিল...

এরপর কিছু মনে পড়ছিল না। আর কী নিয়ে দিতে পারত! দু আনার আবগারি। অল্প দাড়ি, পাঞ্জাবি গায়ে হাফ নেতা গোছের ছেলেটার চাকরিটা পর্যন্ত বদান্যাতায় পাওয়া। পাশেরটা রেহ্যাব থেকে সবে ফিরেছে। রেগ্যুলার উইথড্রয়াল।

শালা হিজড়ের দল। সব কটার এক রা।


তারপর সে রিপোর্টের দাগানো অংশগুলো আর এক বার দেখতে লাগলঃ


On December 14, 2012 Investigator Mr. Y of Kolkata Police, Law Enforcement Department sent me a sample to determine if the odor present in the sample was indicative of a decompositional human event.
...