খামচানো কালপৃষ্ঠা
গিন্সবার্গের লোগো ও গৌতমবুদ্ধের পদচিহ্ণমলয় রায়চৌধুরী
বিট আন্দোলনের কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন আমাদের পাটনার বাড়িতে । তার আগে তাঁর সঙ্গেআমার পরিচয় ছিল না । তিনি আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে চাইবাসায় দেখা করতে গিয়েছিলেন ১৯৬২ সালে দোল খেলার সময়ে । পাটনায়উনি এসেছিলেন বেনারসে থাকাকালীন, বোধগয়া হয়ে । বোধগয়াতে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি হিন্দু ও মুসলমান সাধুসন্তদের সম্পর্কে বেশি আগ্রহান্বিত ছিলেন । বোধগয়ায় ধানখেতের ধারে দুটো ইঁটের ওপর বসে হাগবার ( তখনও জাপানিদের টাকা বোধগয়াকে ঝলমলে করেনি ) সময় তিনি টের পান যেএকটা ইঁট একটি বৌদ্ধবিহারের, খুদে-খুদে বুদ্ধমূর্তি ছিল তাতে । সেটি ধুয়ে পুঁছে রেখে নেন নিজের কাছে । এই ঘটনার পরেই তিনি বৌদ্ধধর্মের প্রতিআকৃষ্ট হন । এই পাথরটি কোনো বৌদ্ধবিহারে জমা না দেওয়ায়, এবং ভিখারি, বিকলাঙ্গ, কাঙালি, কুষ্ঠরোগিদের ফোটো তুলে সেই ফিল্মটি আমার বাবার ফোটোগ্রাফির দোকানে ডেভেলপ করতে দেয়ায়, বাবার সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হয়েছিল । বাবা ওনাকে বলেছিলেন যে বিদেশি কবিদের সঙ্গে ট্যুরিস্টদের কোনো তফাত নেই ; সবাই গরিব ইন্ডিয়াকে বিক্রির ধান্দায় থাকে । বিট আন্দোলনের গবেষক বিল মর্গান এবং অ্যালেন গিন্সবার্গ ট্রাস্টের সচিব বব রোজেনথাল ২০০৪ সালে যখন কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, আমি ওনাদের এই ঘটনাটির কথা বলেছিলুম ।
ওনাদের দুজনকে আমি আরেকটি ব্যাপারের বিষয়ে বলেছিলুম । গিন্সবার্গের ইন্ডিয়ান জার্নালস বইটির শুরুতেই একটি ড্রইং আছে যা তিনি ভারত থেকে ফিরে গিয়ে প্রকাশিত তাঁর অন্যান্য গ্রন্হ, অ্যালবাম ও চিত্রপ্রদর্শনীর কার্ডেও ব্যবহার করতেন । বিল মর্গান ও বব রোজেনথালের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলুম যে অ্যালেনের কাগজপত্র থেকে ওনারা এই ড্রইংটির উৎস জানতে পারেননি । গিন্সবার্গ নিজেই স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে যাননি । একটি ক্যাথলিক গোষ্ঠী ভেবেছিল যে ড্রইংটির সাহায্যে ভারতীয়রা সম্ভবত যিশুখ্রিস্টের ক্রুসকাঠ এঁকে থাকবে । তাদের গিন্সবার্গ একটা ভাসাভাসা জটিল বাক্য লিখেছিলেন যেটি পড়ে মনে হবে ড্রইংটির সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সম্পর্ক আছে ।
ড্রইংটা হল এমন তিনটি মাছের যাদের দেহ আলাদা কিন্তু একটিই মাথা । এমনভাবে মাথাটি আঁকা যে তা একটি বৃত্তের মধ্যে ত্রিভূজের আকার পেয়েছে । তাদের মস্তিষ্ক যেহেতু একটি, তাদের চোখ আলাদা নয়, যদিও তিনটি মাছের কানকো আলাদা আলাদা । ড্রইংটা গিন্সবার্গ পেয়েছিলেন মোগল বাদশাহ আকবরের সমাধিক্ষেত্রে, যার প্রবেশপথের সিংদরোজার সামনে লাল পাথরের ওপর নকশাটা খোদাই করা দেখেছিলেন তিনি, এবং খাতায় টুকে নিয়েছিলেন । নকশাটা আকবরের সর্বধর্ম সমন্বয়ের দীন-এ-ইলাহি তত্বকে ব্যাখ্যা করে ; হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধরা হল তিনটি মাছের দেহ , এবং তাদের বক্তব্য যেহেতু একই, তাই তাদের একটিই মাথা । পাটনায় খুদাবক্শ লাইব্রেরিতে দীন-এ-ইলাহি গ্রন্হটির যে ক্যালিগ্রাফি-প্রতিলিপি ছিল তার প্রচ্ছদেও ড্রইংটি দেখেছিলেন গিন্সবার্গ ।
ভারত থেকে ফিরে গিয়ে বিল মর্গান আমাকে গিন্সবার্গের একটা প্রবন্ধসংগ্রহ পাঠিয়েছিলেন । তার ভূমিকায় বিল লিখেছেন যে ড্রইংটি হল গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ণ ! বিল যেহেতু একজন গিন্সবার্গ-বিশেষজ্ঞ, পরবর্তীকালে গিন্সবার্গ গবেষকরা সকলেই এই ড্রইংটিকে গৌতম বুদ্ধের পদচিহ্ণ বলে প্রচার করে চলেছেন । এই একই বক্তব্য ইনটারনেটেও পাওয়া যাবে ; অনেকে ড্রইংটিকে নানা রূপ দিয়েছেন , এমনকী পাথুরে রূপ । গৌতম বুদ্ধের পায়ের তলায় চাপা-পড়া তিনটি জীব, এরকম ধারণা মার্কিন বুদ্ধিজীবিরাই করতে পারেন ।
গিন্সবার্গ যদি বাঙালি কবি হতেন তাহলে বাঙালি আলোচকরা তাঁকে এই ড্রইংটির ভুল ব্যাখ্যার জন্য ছিঁড়ে ফালা-ফালা করে ফেলতেন ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন