কলঙ্কের শেষে
আজ কার মুখ দেখে অনুপমের ঘুম ভেঙ্গেছিল কে জানে? ছুটির দিনটা যে এইভাবে মাঠে মারা যাবে সে কি ভেবেছিল? ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাবার প্ল্যান ছিল। এখন কোনো রকমে হাজতবাস থেকে রক্ষা পেলেই বর্তে যায় অনুপম।
এই শীতেও অনুপমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখটা একবার সে মুছে নিল। কপালে ঘাম হলেও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তার – বিজয় কি খবর দেয় সেই উৎকণ্ঠায়। নীলরতন সরকার হাসপাতালের আউটপেশেন্ট বিভাগের বাইরে দাঁড়িয়ে অনুপম মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববার চেষ্টা করল, কোথায় তার ভুলটা হল।
সকালবেলায় জগিং সেরে ফেরার পথে অনুপম পিছন থেকে এক মিষ্টি স্বর শুনতে পায়, 'অনুপমদা, আমাকে যে দেখতেই পেলেন না?
অনুপম ফিরে দেখে একটি বিশ বাইশ বছরের মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হাসছে সেটা জানাতে । তাকে ঠিক চেনা কেউ তো মনে হল নাই মেয়েটির মুখে একটা বিদ্রূপমেশা চটুলতার ছায়া দেখতে পেল। কাছে এসে সে বলল, 'এখন না চিনতে পারলেই আপনার সুবিধে ঠিকই। আর দিনের আলোয় তো আপনার সঙ্গে বেশী দেখা হয় নি। যা হয়েছে অন্ধকারে।'
কি যে বলছে অনুপম ঠিক বুঝতে পারল না। মেয়েটির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। 'ডায়মন্ড হারবারে সেই রাতের পর আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন।' এবার সে পরিস্কার করে বলে, 'আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। আমার সর্বস্ব নিয়ে এখন আপনি আমাকে অস্বীকার করবেন, অনুপমদা?'
প্রথমটা একটা ধাক্কা খেল অনুপম। ডায়মন্ড হারবার...সে বাবা হতে চলেছে...! তারপরেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। মেয়েটির মতলব খারাপ। তাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ফাঁসাতে চাইছে। অনুপম প্রকৃত অর্থেই এক 'শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক'। ডায়মন্ডহারবারে অপরিচিত মহিলার সঙ্গে কুকর্ম করা দূরে থাক, এসব কথা সে ভাবতেই পারে না। জোরগলায় প্রতিবাদ জানিয়ে সে মেয়েটিকে এক ধমক লাগালো। কিন্তু তার ফলে মেয়েটি যা করলো, তার জন্য সে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। কাপড়চোপড় আলুথালু করে মেয়েটি সটান রাস্তায় শুয়ে পড়ে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ আরম্ভ করে দিল। অনুপম স্তম্ভিত। এমন এক অভিনব রসাল ঘটনায় আশেপাশে উৎসাহী লোকজন জড়ো হতে দেরী হল না। 'কি দাদা, ফুর্তি করে কেটে পড়ার তাল', 'সেটা তো হবে না, চাঁদ', 'এই সব কিছু লোকের জন্যে আমাদের ঘরের মেয়েরা আজকাল রাস্তায় বেরোতে পারে না', 'দুদিন শ্রীঘরের হাওয়া খেলেই রস নেমে যাবে', 'আবার ওসব কেন, এখানেই শালাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি' ইত্যাদি নানান মন্তব্য চারদিক থেকে কানে আসতে লাগলো। অনুপমের হাত-পা হিম হয়ে এলো।
ভাগ্যক্রমেই বলতে হবে, জনতা বেশী ক্ষেপে যাবার আগেই এক পুলিশ এসে পড়ল। লোকজন সরিয়ে তাড়াতাড়ি সে দু'জনকেই থানায় এনে হাজির করল। অনুপম নানাভাবে দারোগাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, সে এসবের কিছুই জানে না। হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখল। মেয়েটি ততোধিক কান্নাকাটি জুড়ে দিল। চারদিকে লোক জড়ো হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারির একশেষ। অবশেষে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য দু'জনকেই পাঠানো হল নীলরতন সরকারে। পরীক্ষায় দেখা গেল মেয়েটি সত্যিই অন্তঃস্বত্তা। অনুপমের অবস্থা কাঁদোকাঁদো। কিভাবে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে কিছুই তার মাথায় আসছিল না। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। সারাদিন চান খাওয়া হয়নি । বাড়িতেও কোন খবর দিতে পারেনি লজ্জায় । স্যাম্পল জমা দিয়ে এসে অনুপম শুধু দুর্গা নাম জপ করছিল । এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো স্কুলের সহপাঠী বিজয়ের সাথে । দু'জনে একই স্কুল থেকে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। তারপর আর যোগাযোগ ছিল না। অনুপম জানতো না বিজয় এখন এখানেই ডাক্তার হয়ে আছে। হাতে চাঁদ পাওয়া বলে একটা কথা আছে। আজ এই সময়ে বিজয়কে এখানে পেয়ে আকাশের পূর্ণচন্দ্রও তুচ্ছ মনে হল অনুপমের। বন্ধুর হাতদুটো ধরে, 'আমাকে বাঁচা মাইরি' বলে অনুপম কেঁদেই ফেলল। বিজয় সব শুনে গম্ভীর মুখে 'আচ্ছা, আমি দেখছি' বলে ভেতরে চলে গেল। তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা...।
কতক্ষণ সময় কেটেছে জানে না অনুপম, অবশেষে বিজয়কে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল সে। বিজয়ের মুখে হাসি, বলল, 'তুই খুব বেঁচে গেছিস, অনুপম। মেয়েটাই পাজী, তোকে মিথ্যে ফাঁসাচ্ছিল। প্রমাণ হয়ে গেছে, পুলিশকে রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে। তুই একবার অফিসারের সঙ্গে দেখা করে বাড়ী যেতে পারিস। ব্যাড লাক, অনেক ধকল গেল তোর সারাদিন।'
নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। হতবুদ্ধি অনুপম জিজ্ঞেস করল, 'কি করে কি হল, বিজয়?'
—'তোর লাক। টেস্টে তোর স্পার্ম কাউন্ট এতো কম পাওয়া গেছে,'বিজয় বুঝিয়ে দিল, 'তোর পক্ষে বাপ হওয়া সম্ভবই নয়। পুলিশ মেনে নিয়েছে সে যুক্তি।'
আ—হ, বুকের ওপর থেকে একটা পাথর যেন নেমে গেল অনুপমের। এমনও হয় তাহলে? এতো সহজ সমাধানে পুলিশের ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল সে। সেই সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এলো তার বুক ঠেলে, আমার মতো এক শান্তশিষ্ট নির্বিরোধী মানুষকে এতো কষ্ট দিলে ভগবান?
সব কাজ মিটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিল অনুপম। একটা বড় ফাঁড়া কাটল আজ। নিজের দৈহিক অক্ষমতার সংবাদে অন্যসময়ে হলে সে মর্মাহত হতো। কিন্তু সেই অক্ষমতাই আজ তাকে চূড়ান্ত লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণ করেছে, তাই এক অপরিসীম স্বস্তিবোধে ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় ছিল না। রাস্তাটা পেরিয়ে একটা টেলিফোন বুথ নজরে পড়লো তার। বউকে একটা খবর দেওয়া দরকার ভেবে সেদিকে এগোল সে। তখনই মনে এলো এলো তার কথাটা।
বাড়ীতে যে তার দুই ছেলেমেয়ে—!
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য
আজ কার মুখ দেখে অনুপমের ঘুম ভেঙ্গেছিল কে জানে? ছুটির দিনটা যে এইভাবে মাঠে মারা যাবে সে কি ভেবেছিল? ছেলেমেয়েদের নিয়ে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাবার প্ল্যান ছিল। এখন কোনো রকমে হাজতবাস থেকে রক্ষা পেলেই বর্তে যায় অনুপম।
এই শীতেও অনুপমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখটা একবার সে মুছে নিল। কপালে ঘাম হলেও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তার – বিজয় কি খবর দেয় সেই উৎকণ্ঠায়। নীলরতন সরকার হাসপাতালের আউটপেশেন্ট বিভাগের বাইরে দাঁড়িয়ে অনুপম মাথা ঠাণ্ডা করে ভাববার চেষ্টা করল, কোথায় তার ভুলটা হল।
সকালবেলায় জগিং সেরে ফেরার পথে অনুপম পিছন থেকে এক মিষ্টি স্বর শুনতে পায়, 'অনুপমদা, আমাকে যে দেখতেই পেলেন না?
অনুপম ফিরে দেখে একটি বিশ বাইশ বছরের মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে হাসছে সেটা জানাতে । তাকে ঠিক চেনা কেউ তো মনে হল নাই মেয়েটির মুখে একটা বিদ্রূপমেশা চটুলতার ছায়া দেখতে পেল। কাছে এসে সে বলল, 'এখন না চিনতে পারলেই আপনার সুবিধে ঠিকই। আর দিনের আলোয় তো আপনার সঙ্গে বেশী দেখা হয় নি। যা হয়েছে অন্ধকারে।'
কি যে বলছে অনুপম ঠিক বুঝতে পারল না। মেয়েটির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। 'ডায়মন্ড হারবারে সেই রাতের পর আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন।' এবার সে পরিস্কার করে বলে, 'আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। আমার সর্বস্ব নিয়ে এখন আপনি আমাকে অস্বীকার করবেন, অনুপমদা?'
প্রথমটা একটা ধাক্কা খেল অনুপম। ডায়মন্ড হারবার...সে বাবা হতে চলেছে...! তারপরেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। মেয়েটির মতলব খারাপ। তাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ফাঁসাতে চাইছে। অনুপম প্রকৃত অর্থেই এক 'শান্তশিষ্ট পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক'। ডায়মন্ডহারবারে অপরিচিত মহিলার সঙ্গে কুকর্ম করা দূরে থাক, এসব কথা সে ভাবতেই পারে না। জোরগলায় প্রতিবাদ জানিয়ে সে মেয়েটিকে এক ধমক লাগালো। কিন্তু তার ফলে মেয়েটি যা করলো, তার জন্য সে বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না। কাপড়চোপড় আলুথালু করে মেয়েটি সটান রাস্তায় শুয়ে পড়ে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ আরম্ভ করে দিল। অনুপম স্তম্ভিত। এমন এক অভিনব রসাল ঘটনায় আশেপাশে উৎসাহী লোকজন জড়ো হতে দেরী হল না। 'কি দাদা, ফুর্তি করে কেটে পড়ার তাল', 'সেটা তো হবে না, চাঁদ', 'এই সব কিছু লোকের জন্যে আমাদের ঘরের মেয়েরা আজকাল রাস্তায় বেরোতে পারে না', 'দুদিন শ্রীঘরের হাওয়া খেলেই রস নেমে যাবে', 'আবার ওসব কেন, এখানেই শালাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি' ইত্যাদি নানান মন্তব্য চারদিক থেকে কানে আসতে লাগলো। অনুপমের হাত-পা হিম হয়ে এলো।
ভাগ্যক্রমেই বলতে হবে, জনতা বেশী ক্ষেপে যাবার আগেই এক পুলিশ এসে পড়ল। লোকজন সরিয়ে তাড়াতাড়ি সে দু'জনকেই থানায় এনে হাজির করল। অনুপম নানাভাবে দারোগাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো, সে এসবের কিছুই জানে না। হাতে পায়ে ধরতে বাকি রাখল। মেয়েটি ততোধিক কান্নাকাটি জুড়ে দিল। চারদিকে লোক জড়ো হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারির একশেষ। অবশেষে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য দু'জনকেই পাঠানো হল নীলরতন সরকারে। পরীক্ষায় দেখা গেল মেয়েটি সত্যিই অন্তঃস্বত্তা। অনুপমের অবস্থা কাঁদোকাঁদো। কিভাবে সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে কিছুই তার মাথায় আসছিল না। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। সারাদিন চান খাওয়া হয়নি । বাড়িতেও কোন খবর দিতে পারেনি লজ্জায় । স্যাম্পল জমা দিয়ে এসে অনুপম শুধু দুর্গা নাম জপ করছিল । এমন সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো স্কুলের সহপাঠী বিজয়ের সাথে । দু'জনে একই স্কুল থেকে ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। তারপর আর যোগাযোগ ছিল না। অনুপম জানতো না বিজয় এখন এখানেই ডাক্তার হয়ে আছে। হাতে চাঁদ পাওয়া বলে একটা কথা আছে। আজ এই সময়ে বিজয়কে এখানে পেয়ে আকাশের পূর্ণচন্দ্রও তুচ্ছ মনে হল অনুপমের। বন্ধুর হাতদুটো ধরে, 'আমাকে বাঁচা মাইরি' বলে অনুপম কেঁদেই ফেলল। বিজয় সব শুনে গম্ভীর মুখে 'আচ্ছা, আমি দেখছি' বলে ভেতরে চলে গেল। তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা...।
কতক্ষণ সময় কেটেছে জানে না অনুপম, অবশেষে বিজয়কে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল সে। বিজয়ের মুখে হাসি, বলল, 'তুই খুব বেঁচে গেছিস, অনুপম। মেয়েটাই পাজী, তোকে মিথ্যে ফাঁসাচ্ছিল। প্রমাণ হয়ে গেছে, পুলিশকে রিপোর্ট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে। তুই একবার অফিসারের সঙ্গে দেখা করে বাড়ী যেতে পারিস। ব্যাড লাক, অনেক ধকল গেল তোর সারাদিন।'
নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। হতবুদ্ধি অনুপম জিজ্ঞেস করল, 'কি করে কি হল, বিজয়?'
—'তোর লাক। টেস্টে তোর স্পার্ম কাউন্ট এতো কম পাওয়া গেছে,'বিজয় বুঝিয়ে দিল, 'তোর পক্ষে বাপ হওয়া সম্ভবই নয়। পুলিশ মেনে নিয়েছে সে যুক্তি।'
আ—হ, বুকের ওপর থেকে একটা পাথর যেন নেমে গেল অনুপমের। এমনও হয় তাহলে? এতো সহজ সমাধানে পুলিশের ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল সে। সেই সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এলো তার বুক ঠেলে, আমার মতো এক শান্তশিষ্ট নির্বিরোধী মানুষকে এতো কষ্ট দিলে ভগবান?
সব কাজ মিটিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিল অনুপম। একটা বড় ফাঁড়া কাটল আজ। নিজের দৈহিক অক্ষমতার সংবাদে অন্যসময়ে হলে সে মর্মাহত হতো। কিন্তু সেই অক্ষমতাই আজ তাকে চূড়ান্ত লজ্জার হাত থেকে পরিত্রাণ করেছে, তাই এক অপরিসীম স্বস্তিবোধে ছাড়া আর কিছুই তার মাথায় ছিল না। রাস্তাটা পেরিয়ে একটা টেলিফোন বুথ নজরে পড়লো তার। বউকে একটা খবর দেওয়া দরকার ভেবে সেদিকে এগোল সে। তখনই মনে এলো এলো তার কথাটা।
বাড়ীতে যে তার দুই ছেলেমেয়ে—!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন