তুলিরেখার শেষ কল
মুস্তাইন সুজাত
-এক-
ট্রেনিংটা হয়েছিল অফিসের নির্ধারিত শিডিউল অনুসারে। ঢাকা থেকে সড়কপথেতিরিশ কিলোমিটার, তারপর নৌকা করে আরও চার কিলোমিটার গিয়ে ট্রেনিং সেন্টার। নির্জন চারপাশ,ভয়ার্ত শেয়াল কুকুরের কামড়াকামড়ি, ডুবায় ব্যাঙ-সাপেদের অবাধ আধিপত্য। ফসলের ক্ষেত, কাদামাটির রাস্তা, সকাল সন্ধ্যা গলায় লাল-সবুজ চেকের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে মোড়ের পাশে বসে থাকা কয়েক জোড়া রিক্সা চালকের ক্লান্ত দৃষ্টি। ট্রেনিং এর পুরুটা সময় জুড়ে একই চিত্র চোখে পড়েছে তুলিরেখার। ঢাকা শহরে যাদের জন্মলগ্ন বেড়ে উঠা তাদের কাছে এই জায়গাটাকে প্রত্যন্ত অঞ্চল বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। হঠাৎ করে মাস কয়েকের জন্য শহুরে কেউ এখানে এলে বেশ উপভোগ করবে প্রকৃতিটা। প্রতি বছর এই ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষানুবিশ নতুন অফিসাররা চার মাসের একটা ট্রেনিং নিতে আসে তুলিরেখারঢাকার অফিস থেকে।
হেড অফিসের ক্লার্ক যেদিন ট্রেনিং এর শিডিউলটা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল নোটিস বোর্ডে সেদিনই তুলিরেখা শিহরিত হয়েছিল আনন্দে। অনেক দিনের সুপ্ত মনটা জেগে উঠেছিল আবার নতুন করে। যাক এবার নিজের মত করে কিছুদিন বাইরে থাকা যাবে। দুই বছরের সংসার জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বিয়েটা হয়েছিলো মা বাবার পছন্দে। সেই সাথে তুলিরেখারও মত ছিল শতভাগ। তার পতিদেবতাটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা বেতনের চাকুরে। অভিজাত পাড়া বনানীতে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি তার উপর বাপের একমাত্র ছেলে। পরিচিতজন হয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল ছেলের বাড়ি থেকেই। তারপরও তুলিরেখার বাবা-মা এই সম্পর্কটা নিয়ে একবছর ভেবেছেন। নানা ভাবে যাচাই বাছাই করেছেন। একমাত্র মেয়ে, একটু বাজিয়ে দেখে শুনে বিয়ে না দিলে কি হয়!
বিয়েঅন্তেপ্রেম বলতে যা বুঝায় তুলিরেখা আর শাফিনের ক্ষেত্রে ওটাই ঘটে। বিয়ের কিছুদিন পেরুনোর পর শাফিনের প্রতি তুলিরেখার ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে আস্তে আস্তে। নানান ছলে সেটা প্রকাশও করেছে তুলিরেখা। অথচ আজ দু’বছরে একবারও শাফিন তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি, না কথায় না কাজে। তুলিরেখা একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ করেছে, সেই বাসররাত থেকেই শাফিন কেমন যেন আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। ভেবেছে শুরুতে অনেকেরই এমনটা হয় কিন্তু দিন অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তুলিরেখা বুঝে গেছে এটা তার জন্মগত স্বভাব। শাফিন নিজেকে নিয়ে মেতে থাকে সারাক্ষণ। নিজের চারদিকে একটা শক্ত প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে যা এপর্যন্ত তুলিরেখার পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি। নিজের মনের চারদিকে যেমন একটা নিজস্ব খোলস আছে তার, ঠিক তেমনি বাসায়ও একটা একান্ত রোম আছে। সেখানে কারো যাওয়া বারণ। অফিসের বাইরের সময়টাতে কিংবা ছুটির দিনে শাফিন ঐ রুমেই কাটায় বেশীরভাগ সময়। শুধু খাঁবার আর ঘুমানোর সময় তুলিরেখা তার দেখা পায়। বাকি সময়ের কিছুক্ষণ বাইরে থালেও টিভি নিয়ে পড়ে থাকে।
নিতান্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে দাপটের সাথে দীর্ঘদিন সরকারী চাকুরীর পর নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে বনানি বাড়িটা করেছে শাফিনের বাবা। তিনতলা বাড়ির দোতলায় গোছানো ফ্লাটে ওরা থাকে। বিয়ের দু’বছর পরও নাতি নাতনির মুখ দেখতে না পেয়ে স্বভাবতই শাশুড়ি কিছুটা নাখোশ তুলিরেখার উপর। সরাসরি কথা বার্তায় সেটা না বললেও তার শাশুড়িমা সকল শাশুড়িকূলের স্বভাবসুলভ চাতুরতায় অসন্তোষেরকারন খানিকটা বুঝিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই। এটা যে শুধুমাত্র তুলিরেখার একার সমস্যা নয় সেটা শাশুড়িকে বুঝাতে পারে না কোন রকমেই। পতিদেবতার উদাসীনতা, সংসারের দায়ভার, শাশুড়ির খোঁটা সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে উত্তরনের একটা মোক্ষম হাতিয়ার মনে করে এই চার মাসের ট্রেনিংকে। পারিবারিক এসব বিষয় নিয়ে অনেকটা দিশেহারা, অপ্রকৃতিস্থ গোছের হয়ে গেছে তুলিরেখা। সেখান থেকে পরিত্রাণ না পেলে আত্মহত্যা টাইপের একটা কিছু করে বসতে পারে, মাঝে মাঝে এরকমটাই ভাবে তুলিরেখা।
সন্তান সন্তুতি দেয়া না দেয়া বিধাতা পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে কিন্তু যাদের বছরের পর বছর পেরিয়েও সন্তান হয় না তারা ওসিলার জন্য ডাক্তার কবিরাজের শরণাপন্ন হয়, সেটাই স্বাভাবিক। অনেকবার তুলিরেখা ডাক্তারের কাছে গিয়েছে শাফিনকে নিয়ে। তাদের কোনরকম সমস্যা পায় নি ডাক্তার। পাবে কিভাবে, আসল ঘটনা তো তুলিরেখা জানে! সে না পারে ডাক্তারকে বলতে, না পারে কাউকে। আর তার শাশুড়ি তো বিশ্বাসই করবেন না। উল্টা গাল ফুলিয়ে বলবেন,
-তুমি কি গো বৌমা, আমার ছেলের উপর এত্তবড় অপবাদ! পাঁচ কান হলে মানুষজন কি বলবে, শুনি? বলেছ বলেছ, দ্বিতীয়বারের জন্য আর ওকথাটি যেন না শুনি। যত সমস্যা সব তোমার আর এসেছ আমার ছেলের নামে উটকো কথা বলতে? এইবার আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে।
তুলিরেখা জানে শাশুড়ির সাথে ডাক্তারখানায় গেলে জল কোনদিকে গড়াবে। তাই এ বিষয়ে শাশুড়িকে সে কিছুই বলে না। একবার ভাবে শাফিনকে ছেড়ে একেবারে চলে যায়। পরক্ষনেই কোথায় যেন টান পড়ে। চিনচিনে ব্যথা হয়। কি যেন হারানোর ব্যথা। আসলে শাফিনের প্রতি তার অদ্ভুত মায়া হয় ভাবলেই। মানুষ হিসেবে সে তো আর খারাপ নয়? তার সব রকম বাহ্যিক চাওয়া পাওয়া মিটাচ্ছে। এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে, নানান রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে গিয়ে খাচ্ছে। পার্বণগুলোতে এটা ওটা কিনে দিচ্ছে। কিন্তু যত আপত্তি ঐ এক জায়গাতেই। অথচ ওটাই যে একজন নারীর চরম পাওয়া। নারীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। নারী জন্মের সার্থকতা।
ইদানিং তার পতিদেবতাটির প্রতি কেমন যেন একটা অনীহা তৈরি হচ্ছে নিজের ভেতর। দিনকে দিন অসহ্য ঠেকছে তাকে। শুরুতে যে ভালোবাসা ছিল তা এখন শুধুই করুণা আর মায়া। সেই মায়াকরুনাতে মিশামিশি হয়েই সম্পর্কতা আজো টিকে আছে। জীবনের এই উথাল পাথাল সময়ে হঠাৎ একদিন মুহিনের সাথে আলাপ। মোবাইল ঘাটতে গিয়ে ফোন নাম্বার। পুরনো অফিসের কলিগ। পাশাপাশি কিউবিকলে বসতো ওরা। আগের অফিস ছাড়ার পরও মাঝে মাঝে কথা হয়েছে বারকয়েক। হঠাৎ তুলিরেখা নিজের মনের জটিল অবস্থাকে হালকা করার একটা দাওয়াই খুঁজে পেয়ে যায় মুহিনের ভার্চুয়াল আগমনে। ধরাবাঁধা জীবনের বাইরেও যে একটা আশ্চর্য শৃঙ্খলবিহীন জীবন আছে, সেই জীবনের তীব্র আমেজ আছে সেটা প্রথম বুঝতে পারে মুহিনের সাহচর্যে এসে। সাত রঙের সবকটা এসে তার জীবনটাকে স্বপ্নিল করে সাজিয়ে দেয় আলতো ছোঁয়ায়। অষ্টক রং ধরা দেয়।
মুহিনের সাথে তুলিরেখার আলাপ হয়েছিল ট্রেনিং শুরুর ঠিক মাস তিনেক আগে। ক্রমে ক্রমে এই সম্পর্কের গভীরতাটা পুরুপুরি গেঁড়ে বসে ট্রেনিং-এর চার মাসে। ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে পুরুটা সময় নিজের একান্ত। তার ট্রেনিংটা ছিল ক্লাস এবং ওয়ার্কশপের মিশ্রন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই তুলিরেখা ফেবুতে মেসেজ পাঠায়, মুহিনের তড়িৎ রিপ্লাই। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা, কত কথা! ধীরে ধীরে এই কথাবার্তা বনে যায় প্রেমরূপালাপে। বিশ্বাস আর ভালোলাগায় ভর করে তুলিরেখা বলে যায় জীবনের কথা, অতীত বর্তমানের কথা, ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা একে একে। প্রথমদিকে হঠাৎ একদিন তুলিরেখা মোহিনকে বলেছিল,
-ডু ইউ লাভ মি?
-হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর থিঙ্কিং? মুহিনের উত্তর।
-জাস্ট নাথিং। মনে হল তাই জিজ্ঞেস করলাম।
সেদিন এ পর্যন্তই শেষ ছিল ব্যাপারটা। এরপর আর কেউ এগোয়নি সেদিকে। বলতে গেলে মুহিনই রনে ভঙ্গ দিয়েছিল সজ্ঞানে। তারপরও তাদের যোগাযোগ থেমে থাকে নি। সময় বয়ে গেছে নিজের মেজাজে, সেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে তাদের সম্পর্কের উতলা বাতাস।
-দুই-
গেল সপ্তাহে ট্রেনিং শেষ হল পুরোপুরি। আবারো নিজের সংসার, স্বামী, শাশুড়ি নিয়ে সেই পুরনো ক্যাচাল। এই নিয়ে তুলিরেখা বড্ড অখুশি। তবে যতটা সময় অফিসে থাকবে সব কিছু ভুলে নিজের মত থাকতে পারবে এই যা একটু সান্ত্বনা। অনেকদিন পর স্বামীকে কাছে পেয়ে বাসায় ব্যস্ততা বাড়ে একটু। দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে আবার সংসারে মন দেয় বা দিতে চায় আগের সব কিছু ভুলে। অফিসের কাজেও আসে দায়িত্ববোধ আর ব্যস্ততা। মাঝে মাঝে মুহিন জানতে চাইলে এ কথাগুলোই বলে তুলিরেখা। মুহিনের সাথেও আর আগের মত কথা হয় না। চাপা ক্ষোভ নিয়ে মুহিন এড়িয়ে চলে তুলিরেখাকে। এতদিন যে শ্রেফ নিজের প্রয়োজননিজের অবসর সময় কাটাতে তুলিরেখা মুহিনের সাথে সম্পর্করেখেছেএতদিনে সেটা পরিস্কার হয় তার কাছে।মুহিন আজ নিজেকে ধিক্কার দেয় সবচেয়ে বেশি। নিজের মনকেই ঠাট্টা করে নির্মম ভাবে।
তুলিরেখার সাথে যোগাযোগটা একেবারে হয় না বললেই চলে আজকাল। বেশ কয়েকবারই মোহিন চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। নিজের ব্যস্ততা, একথা সেকথা বলে যখন তুলিরেখা অজুহাতের পর অজুহাত ফাঁদে, তখনই মোহিন বুঝে গেছে যা বুঝার। ফের নিজের আত্মসম্মান আর খোয়াতে চায় না সে।
তারও প্রায় মাস তিনেক পর মোহিন হঠাৎ একদিন তুলিরেখাকে দেখতে পায় অন্য একটি ছেলের সাথে। নিউমার্কেট হয়ে নীলক্ষেতের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ওরা দুজন। হাতে হাত, হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ছেলেটিকে মুহিনের চেনা চেনা মনে হয়। একটু কাছে আসতেই স্পষ্ট ধারনাকরতে পারে, এ তো তুলিরেখার সেই বন্ধু যার কথা অনেক আগেতাকে বলেছিল। বন্ধুটির কথা এতবার বলেছিল যে এখনো বর্ণনা চোখে লেগে আছে। বর্ণনার সাথে ছেলেটমিলে যাচ্ছে হুবুহু। শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে মোহিনের ঠোঁট জোড়ায়। করুণা হয় ছেলেটির জন্য, সেই সাথে তুলিরেখার প্রতিও। বেচারি তুলিরেখা!
এরই মাঝে দু’একবার তুলিরেখাও যে চেষ্টা করেনি মুহিনের সাথে যোগাযোগ করার তা কিন্তু নয়। তবে মুহিন পাত্তা দেয়নি। আর নিজ চোখে ছেলেটির সাথে তুলিরেখাকে দেখার পর থেকে কেমন যেন বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।
-তিন-
তারও মাস ছয়েক পর একটা নাম্বার থেকে পর পর আট দশটা কল আসে মুহিনের মোবাইলে। ফিরতি কলে ওপাশ থেকে এক পরিচিত অথচ কেমন যেন বিষণ্ণ এক নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠে।
-হ্যালো মুহিন, আমি তুলিরেখা বলছি।
মাঝে মাঝে তার এমন হয় যে কোন বন্ধু কিংবা আপনজন যাকে সে একবার মন থেকে মুছে ফেলেছে তার সাথে দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কথা হলে নিজের কথা আটকে যায়। মুখে আটকে থাকা কথাগুলোগলার মধ্যে দলা পাকাতে থাকে। তুরেখাকেও ততদিনে ভুলে গেছে সে। তুলিরেখা নামটা মুছে দিয়েছে স্মৃতি থেকে। আজ ইচ্ছে করলে কলটা কেটে দিতে পারতো, কিন্তু মুহিন তা করে নি। সে শুনতে চায় কি বলে তুলিরেখা।
-হ্যাঁ। মুহিন বলছি।
-কেমন আছো?
-যথারীতিভালো।
-আমার মনটা ক’দিন ধরে ভালো নেই। তোমার সাথে কি আজ একটু দেখা করা যাবে?
-সরি। আমি আজ ব্যস্ত আছি।
-তাহলে কাল?
-কালও ব্যস্ত থাকবো। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাব।
-ঠিক আছে। রাখলাম। বাই।
-বাই।
এতদিন পর হঠাৎ কেনই বা তুলিরেখা তাকে ফোন করে দেখা করতে চাইলো হিসাব মেলাতে পারছে না। অবশ্য মুহিন আজ হিসাব মেলাতেও চায় না। অনেক হিসাব মিলিয়েছে এতদিন, হৃদয়খাতা শুন্য আজ। সে ভুলে যেতে চায় সব। ইদানীং ভুলে যাওয়াটা বেশ রপ্ত করেছে। সকালের কথা বিকেলে, রাতের কথা সকালে আর মনে পড়ে না। এইসব হিজিবিজি ভাবনা ছেড়ে একসময় অফিসের কাজে ডুবে যায় মুহিন। সব কাজ ঘুচিয়ে রেখে কাল আবার সকাল সকাল অফিসে আসতে হবে। এগারোটা তিরিশের ঢাকা-কুমিল্লা প্রাইম সার্ভিস বাসের টিকেট কাটা।
-চার-
কাক ডাকাভোরে ঘুম ভাঙ্গে মুহিনের।আটটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োর মাঝে আজকের পত্রিকাটা দেখা হয় নি বাসায়। অফিসে পৌঁছেই পিয়নকে চা দিতে বলে টেবিলে রাখা আজকের একটা দৈনিক টেনে নেয় মুহিন। প্রথম পাতার শেষ দিকের একটা কলামে এসে স্থির হয়ে যায় চোখ।শিরোনাম “পারিবারিক অশান্তির জের ধরে তুলিরেখা নামের এক বধুর আত্মাহুতি।” লেখার ভেতরে ঢুকে বিস্তারিত পড়ার সাহস হয় না তার। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে।
অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় মনটা ছেয়ে যায় মুহিনের। মুহিন বুঝেযায় তুলিরেখাকে এতদিন উপেক্ষা করার বেদনা, গতকাল তুলিরেখার সাথে দেখা না করার দুঃখ, কিংবা তুলিরেখার এই চির প্রস্থান সংবাদ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনের বাকিটা সময়।
পরক্ষনেই ভয়ে কুচকেআসে মুহিন। চিন্তারা পাক খায় অবিরত, ভাবনায় ভিড় করেগতকাল তাকে করাফোন কলটাই যদি তুলিরেখার শেষ কল হয়!
-এক-
ট্রেনিংটা হয়েছিল অফিসের নির্ধারিত শিডিউল অনুসারে। ঢাকা থেকে সড়কপথেতিরিশ কিলোমিটার, তারপর নৌকা করে আরও চার কিলোমিটার গিয়ে ট্রেনিং সেন্টার। নির্জন চারপাশ,ভয়ার্ত শেয়াল কুকুরের কামড়াকামড়ি, ডুবায় ব্যাঙ-সাপেদের অবাধ আধিপত্য। ফসলের ক্ষেত, কাদামাটির রাস্তা, সকাল সন্ধ্যা গলায় লাল-সবুজ চেকের ময়লা গামছা ঝুলিয়ে মোড়ের পাশে বসে থাকা কয়েক জোড়া রিক্সা চালকের ক্লান্ত দৃষ্টি। ট্রেনিং এর পুরুটা সময় জুড়ে একই চিত্র চোখে পড়েছে তুলিরেখার। ঢাকা শহরে যাদের জন্মলগ্ন বেড়ে উঠা তাদের কাছে এই জায়গাটাকে প্রত্যন্ত অঞ্চল বললে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না। হঠাৎ করে মাস কয়েকের জন্য শহুরে কেউ এখানে এলে বেশ উপভোগ করবে প্রকৃতিটা। প্রতি বছর এই ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষানুবিশ নতুন অফিসাররা চার মাসের একটা ট্রেনিং নিতে আসে তুলিরেখারঢাকার অফিস থেকে।
হেড অফিসের ক্লার্ক যেদিন ট্রেনিং এর শিডিউলটা টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল নোটিস বোর্ডে সেদিনই তুলিরেখা শিহরিত হয়েছিল আনন্দে। অনেক দিনের সুপ্ত মনটা জেগে উঠেছিল আবার নতুন করে। যাক এবার নিজের মত করে কিছুদিন বাইরে থাকা যাবে। দুই বছরের সংসার জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। বিয়েটা হয়েছিলো মা বাবার পছন্দে। সেই সাথে তুলিরেখারও মত ছিল শতভাগ। তার পতিদেবতাটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা বেতনের চাকুরে। অভিজাত পাড়া বনানীতে বাড়ি, নিজস্ব গাড়ি তার উপর বাপের একমাত্র ছেলে। পরিচিতজন হয়ে বিয়ের প্রস্তাবটা এসেছিল ছেলের বাড়ি থেকেই। তারপরও তুলিরেখার বাবা-মা এই সম্পর্কটা নিয়ে একবছর ভেবেছেন। নানা ভাবে যাচাই বাছাই করেছেন। একমাত্র মেয়ে, একটু বাজিয়ে দেখে শুনে বিয়ে না দিলে কি হয়!
বিয়েঅন্তেপ্রেম বলতে যা বুঝায় তুলিরেখা আর শাফিনের ক্ষেত্রে ওটাই ঘটে। বিয়ের কিছুদিন পেরুনোর পর শাফিনের প্রতি তুলিরেখার ভালোবাসা জন্মাতে শুরু করে আস্তে আস্তে। নানান ছলে সেটা প্রকাশও করেছে তুলিরেখা। অথচ আজ দু’বছরে একবারও শাফিন তার ভালোবাসা প্রকাশ করেনি, না কথায় না কাজে। তুলিরেখা একটা জিনিস খুব ভালো করে লক্ষ করেছে, সেই বাসররাত থেকেই শাফিন কেমন যেন আত্মমগ্ন হয়ে থাকে। ভেবেছে শুরুতে অনেকেরই এমনটা হয় কিন্তু দিন অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তুলিরেখা বুঝে গেছে এটা তার জন্মগত স্বভাব। শাফিন নিজেকে নিয়ে মেতে থাকে সারাক্ষণ। নিজের চারদিকে একটা শক্ত প্রাচীর তৈরি করে রেখেছে যা এপর্যন্ত তুলিরেখার পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি। নিজের মনের চারদিকে যেমন একটা নিজস্ব খোলস আছে তার, ঠিক তেমনি বাসায়ও একটা একান্ত রোম আছে। সেখানে কারো যাওয়া বারণ। অফিসের বাইরের সময়টাতে কিংবা ছুটির দিনে শাফিন ঐ রুমেই কাটায় বেশীরভাগ সময়। শুধু খাঁবার আর ঘুমানোর সময় তুলিরেখা তার দেখা পায়। বাকি সময়ের কিছুক্ষণ বাইরে থালেও টিভি নিয়ে পড়ে থাকে।
নিতান্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে দাপটের সাথে দীর্ঘদিন সরকারী চাকুরীর পর নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে বনানি বাড়িটা করেছে শাফিনের বাবা। তিনতলা বাড়ির দোতলায় গোছানো ফ্লাটে ওরা থাকে। বিয়ের দু’বছর পরও নাতি নাতনির মুখ দেখতে না পেয়ে স্বভাবতই শাশুড়ি কিছুটা নাখোশ তুলিরেখার উপর। সরাসরি কথা বার্তায় সেটা না বললেও তার শাশুড়িমা সকল শাশুড়িকূলের স্বভাবসুলভ চাতুরতায় অসন্তোষেরকারন খানিকটা বুঝিয়ে দেয় সুযোগ পেলেই। এটা যে শুধুমাত্র তুলিরেখার একার সমস্যা নয় সেটা শাশুড়িকে বুঝাতে পারে না কোন রকমেই। পতিদেবতার উদাসীনতা, সংসারের দায়ভার, শাশুড়ির খোঁটা সব কিছু মিলিয়ে নিজেকে উত্তরনের একটা মোক্ষম হাতিয়ার মনে করে এই চার মাসের ট্রেনিংকে। পারিবারিক এসব বিষয় নিয়ে অনেকটা দিশেহারা, অপ্রকৃতিস্থ গোছের হয়ে গেছে তুলিরেখা। সেখান থেকে পরিত্রাণ না পেলে আত্মহত্যা টাইপের একটা কিছু করে বসতে পারে, মাঝে মাঝে এরকমটাই ভাবে তুলিরেখা।
সন্তান সন্তুতি দেয়া না দেয়া বিধাতা পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে কিন্তু যাদের বছরের পর বছর পেরিয়েও সন্তান হয় না তারা ওসিলার জন্য ডাক্তার কবিরাজের শরণাপন্ন হয়, সেটাই স্বাভাবিক। অনেকবার তুলিরেখা ডাক্তারের কাছে গিয়েছে শাফিনকে নিয়ে। তাদের কোনরকম সমস্যা পায় নি ডাক্তার। পাবে কিভাবে, আসল ঘটনা তো তুলিরেখা জানে! সে না পারে ডাক্তারকে বলতে, না পারে কাউকে। আর তার শাশুড়ি তো বিশ্বাসই করবেন না। উল্টা গাল ফুলিয়ে বলবেন,
-তুমি কি গো বৌমা, আমার ছেলের উপর এত্তবড় অপবাদ! পাঁচ কান হলে মানুষজন কি বলবে, শুনি? বলেছ বলেছ, দ্বিতীয়বারের জন্য আর ওকথাটি যেন না শুনি। যত সমস্যা সব তোমার আর এসেছ আমার ছেলের নামে উটকো কথা বলতে? এইবার আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে।
তুলিরেখা জানে শাশুড়ির সাথে ডাক্তারখানায় গেলে জল কোনদিকে গড়াবে। তাই এ বিষয়ে শাশুড়িকে সে কিছুই বলে না। একবার ভাবে শাফিনকে ছেড়ে একেবারে চলে যায়। পরক্ষনেই কোথায় যেন টান পড়ে। চিনচিনে ব্যথা হয়। কি যেন হারানোর ব্যথা। আসলে শাফিনের প্রতি তার অদ্ভুত মায়া হয় ভাবলেই। মানুষ হিসেবে সে তো আর খারাপ নয়? তার সব রকম বাহ্যিক চাওয়া পাওয়া মিটাচ্ছে। এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে, নানান রেস্টুরেন্ট এ নিয়ে গিয়ে খাচ্ছে। পার্বণগুলোতে এটা ওটা কিনে দিচ্ছে। কিন্তু যত আপত্তি ঐ এক জায়গাতেই। অথচ ওটাই যে একজন নারীর চরম পাওয়া। নারীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। নারী জন্মের সার্থকতা।
ইদানিং তার পতিদেবতাটির প্রতি কেমন যেন একটা অনীহা তৈরি হচ্ছে নিজের ভেতর। দিনকে দিন অসহ্য ঠেকছে তাকে। শুরুতে যে ভালোবাসা ছিল তা এখন শুধুই করুণা আর মায়া। সেই মায়াকরুনাতে মিশামিশি হয়েই সম্পর্কতা আজো টিকে আছে। জীবনের এই উথাল পাথাল সময়ে হঠাৎ একদিন মুহিনের সাথে আলাপ। মোবাইল ঘাটতে গিয়ে ফোন নাম্বার। পুরনো অফিসের কলিগ। পাশাপাশি কিউবিকলে বসতো ওরা। আগের অফিস ছাড়ার পরও মাঝে মাঝে কথা হয়েছে বারকয়েক। হঠাৎ তুলিরেখা নিজের মনের জটিল অবস্থাকে হালকা করার একটা দাওয়াই খুঁজে পেয়ে যায় মুহিনের ভার্চুয়াল আগমনে। ধরাবাঁধা জীবনের বাইরেও যে একটা আশ্চর্য শৃঙ্খলবিহীন জীবন আছে, সেই জীবনের তীব্র আমেজ আছে সেটা প্রথম বুঝতে পারে মুহিনের সাহচর্যে এসে। সাত রঙের সবকটা এসে তার জীবনটাকে স্বপ্নিল করে সাজিয়ে দেয় আলতো ছোঁয়ায়। অষ্টক রং ধরা দেয়।
মুহিনের সাথে তুলিরেখার আলাপ হয়েছিল ট্রেনিং শুরুর ঠিক মাস তিনেক আগে। ক্রমে ক্রমে এই সম্পর্কের গভীরতাটা পুরুপুরি গেঁড়ে বসে ট্রেনিং-এর চার মাসে। ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে পুরুটা সময় নিজের একান্ত। তার ট্রেনিংটা ছিল ক্লাস এবং ওয়ার্কশপের মিশ্রন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকেই তুলিরেখা ফেবুতে মেসেজ পাঠায়, মুহিনের তড়িৎ রিপ্লাই। রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা, কত কথা! ধীরে ধীরে এই কথাবার্তা বনে যায় প্রেমরূপালাপে। বিশ্বাস আর ভালোলাগায় ভর করে তুলিরেখা বলে যায় জীবনের কথা, অতীত বর্তমানের কথা, ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা একে একে। প্রথমদিকে হঠাৎ একদিন তুলিরেখা মোহিনকে বলেছিল,
-ডু ইউ লাভ মি?
-হোয়াট অ্যাবাউট ইয়োর থিঙ্কিং? মুহিনের উত্তর।
-জাস্ট নাথিং। মনে হল তাই জিজ্ঞেস করলাম।
সেদিন এ পর্যন্তই শেষ ছিল ব্যাপারটা। এরপর আর কেউ এগোয়নি সেদিকে। বলতে গেলে মুহিনই রনে ভঙ্গ দিয়েছিল সজ্ঞানে। তারপরও তাদের যোগাযোগ থেমে থাকে নি। সময় বয়ে গেছে নিজের মেজাজে, সেই সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে তাদের সম্পর্কের উতলা বাতাস।
-দুই-
গেল সপ্তাহে ট্রেনিং শেষ হল পুরোপুরি। আবারো নিজের সংসার, স্বামী, শাশুড়ি নিয়ে সেই পুরনো ক্যাচাল। এই নিয়ে তুলিরেখা বড্ড অখুশি। তবে যতটা সময় অফিসে থাকবে সব কিছু ভুলে নিজের মত থাকতে পারবে এই যা একটু সান্ত্বনা। অনেকদিন পর স্বামীকে কাছে পেয়ে বাসায় ব্যস্ততা বাড়ে একটু। দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে আবার সংসারে মন দেয় বা দিতে চায় আগের সব কিছু ভুলে। অফিসের কাজেও আসে দায়িত্ববোধ আর ব্যস্ততা। মাঝে মাঝে মুহিন জানতে চাইলে এ কথাগুলোই বলে তুলিরেখা। মুহিনের সাথেও আর আগের মত কথা হয় না। চাপা ক্ষোভ নিয়ে মুহিন এড়িয়ে চলে তুলিরেখাকে। এতদিন যে শ্রেফ নিজের প্রয়োজননিজের অবসর সময় কাটাতে তুলিরেখা মুহিনের সাথে সম্পর্করেখেছেএতদিনে সেটা পরিস্কার হয় তার কাছে।মুহিন আজ নিজেকে ধিক্কার দেয় সবচেয়ে বেশি। নিজের মনকেই ঠাট্টা করে নির্মম ভাবে।
তুলিরেখার সাথে যোগাযোগটা একেবারে হয় না বললেই চলে আজকাল। বেশ কয়েকবারই মোহিন চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার। নিজের ব্যস্ততা, একথা সেকথা বলে যখন তুলিরেখা অজুহাতের পর অজুহাত ফাঁদে, তখনই মোহিন বুঝে গেছে যা বুঝার। ফের নিজের আত্মসম্মান আর খোয়াতে চায় না সে।
তারও প্রায় মাস তিনেক পর মোহিন হঠাৎ একদিন তুলিরেখাকে দেখতে পায় অন্য একটি ছেলের সাথে। নিউমার্কেট হয়ে নীলক্ষেতের দিকে হেঁটে যাচ্ছে ওরা দুজন। হাতে হাত, হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ছেলেটিকে মুহিনের চেনা চেনা মনে হয়। একটু কাছে আসতেই স্পষ্ট ধারনাকরতে পারে, এ তো তুলিরেখার সেই বন্ধু যার কথা অনেক আগেতাকে বলেছিল। বন্ধুটির কথা এতবার বলেছিল যে এখনো বর্ণনা চোখে লেগে আছে। বর্ণনার সাথে ছেলেটমিলে যাচ্ছে হুবুহু। শ্লেষের হাসি ফুটে উঠে মোহিনের ঠোঁট জোড়ায়। করুণা হয় ছেলেটির জন্য, সেই সাথে তুলিরেখার প্রতিও। বেচারি তুলিরেখা!
এরই মাঝে দু’একবার তুলিরেখাও যে চেষ্টা করেনি মুহিনের সাথে যোগাযোগ করার তা কিন্তু নয়। তবে মুহিন পাত্তা দেয়নি। আর নিজ চোখে ছেলেটির সাথে তুলিরেখাকে দেখার পর থেকে কেমন যেন বিশ্বাসটাই উঠে গেছে।
-তিন-
তারও মাস ছয়েক পর একটা নাম্বার থেকে পর পর আট দশটা কল আসে মুহিনের মোবাইলে। ফিরতি কলে ওপাশ থেকে এক পরিচিত অথচ কেমন যেন বিষণ্ণ এক নারী কণ্ঠ কথা বলে উঠে।
-হ্যালো মুহিন, আমি তুলিরেখা বলছি।
মাঝে মাঝে তার এমন হয় যে কোন বন্ধু কিংবা আপনজন যাকে সে একবার মন থেকে মুছে ফেলেছে তার সাথে দীর্ঘদিন পর হঠাৎ কথা হলে নিজের কথা আটকে যায়। মুখে আটকে থাকা কথাগুলোগলার মধ্যে দলা পাকাতে থাকে। তুরেখাকেও ততদিনে ভুলে গেছে সে। তুলিরেখা নামটা মুছে দিয়েছে স্মৃতি থেকে। আজ ইচ্ছে করলে কলটা কেটে দিতে পারতো, কিন্তু মুহিন তা করে নি। সে শুনতে চায় কি বলে তুলিরেখা।
-হ্যাঁ। মুহিন বলছি।
-কেমন আছো?
-যথারীতিভালো।
-আমার মনটা ক’দিন ধরে ভালো নেই। তোমার সাথে কি আজ একটু দেখা করা যাবে?
-সরি। আমি আজ ব্যস্ত আছি।
-তাহলে কাল?
-কালও ব্যস্ত থাকবো। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাব।
-ঠিক আছে। রাখলাম। বাই।
-বাই।
এতদিন পর হঠাৎ কেনই বা তুলিরেখা তাকে ফোন করে দেখা করতে চাইলো হিসাব মেলাতে পারছে না। অবশ্য মুহিন আজ হিসাব মেলাতেও চায় না। অনেক হিসাব মিলিয়েছে এতদিন, হৃদয়খাতা শুন্য আজ। সে ভুলে যেতে চায় সব। ইদানীং ভুলে যাওয়াটা বেশ রপ্ত করেছে। সকালের কথা বিকেলে, রাতের কথা সকালে আর মনে পড়ে না। এইসব হিজিবিজি ভাবনা ছেড়ে একসময় অফিসের কাজে ডুবে যায় মুহিন। সব কাজ ঘুচিয়ে রেখে কাল আবার সকাল সকাল অফিসে আসতে হবে। এগারোটা তিরিশের ঢাকা-কুমিল্লা প্রাইম সার্ভিস বাসের টিকেট কাটা।
-চার-
কাক ডাকাভোরে ঘুম ভাঙ্গে মুহিনের।আটটা নাগাদ বেড়িয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োর মাঝে আজকের পত্রিকাটা দেখা হয় নি বাসায়। অফিসে পৌঁছেই পিয়নকে চা দিতে বলে টেবিলে রাখা আজকের একটা দৈনিক টেনে নেয় মুহিন। প্রথম পাতার শেষ দিকের একটা কলামে এসে স্থির হয়ে যায় চোখ।শিরোনাম “পারিবারিক অশান্তির জের ধরে তুলিরেখা নামের এক বধুর আত্মাহুতি।” লেখার ভেতরে ঢুকে বিস্তারিত পড়ার সাহস হয় না তার। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে।
অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় মনটা ছেয়ে যায় মুহিনের। মুহিন বুঝেযায় তুলিরেখাকে এতদিন উপেক্ষা করার বেদনা, গতকাল তুলিরেখার সাথে দেখা না করার দুঃখ, কিংবা তুলিরেখার এই চির প্রস্থান সংবাদ তাকে বয়ে বেড়াতে হবে জীবনের বাকিটা সময়।
পরক্ষনেই ভয়ে কুচকেআসে মুহিন। চিন্তারা পাক খায় অবিরত, ভাবনায় ভিড় করেগতকাল তাকে করাফোন কলটাই যদি তুলিরেখার শেষ কল হয়!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন