বেহালা
অফিস থেকে বের হয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে আফসানার জন্য অপেক্ষা করছে আরিফ। কপালের ঘাম মুচ্ছে আর বারবার চোখ ঘুরাচ্ছে। একবার মুঠোফোনের স্কিনে ভাসা ঘড়ির দিকে- একবার পথের দিকে- চোখ যতোদূর যায়। এ অপেক্ষা করাটা এক সময় প্রতিদিনের রুটিন ছিলো আরিফের কাছে। আফসানার জন্য পার্কে, রেস্টুরেন্টে, কলেজ গেটে, লাইব্রেরিতে কোথায় না অপেক্ষা করেছে আ...রিফ। মিনিট মিনিট করে
ঘন্টা চলে গেছে। ধৈর্যে-অধৈর্যে হতাশা কুড়িয়ে, ব্যথা কুড়িয়ে কুড়িয়ে যখন ক্লান্ত হয়েছে, আফসানার দিস্তা-দিস্তা অজুহতই নিমিশে ভুলিয়েছে সব। মায়াবি অজুহতই যেন বৈধতা দিয়েছে যতো তামাদি ঋণ। তারপর সকল অপেক্ষাকে ছুটি দিয়ে আফসানাকে একদিন ঘরে নিয়ে আসে আরিফ। মা-বাবা, ভাই-বোন নেই- একদম নিজেদের সংসার।
অপেক্ষার ছুটি নয় বরং পারসন চেন্জ করে আসলো ঘরে। প্রতিদিন সাড়ে আট্টায় আরিফ অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়। ফেরে সন্ধ্যা হয় হয়। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যা পেরুয়ে রাত। শুক্রবার ছুটি তবু গাদাগাদা ফাইল। তবু এখানে যাও, সেখানে যাও। মিসেস আরিফ, তুমি এবার অপেক্ষা করতে থাকো। আরিফ সাহেব তুমিও এবার বানাও অজুহতের নব সংষ্করণ। অতঃপর অজুহতই ভেঙে দেয় দ্বিধার দেয়াল। অজুহতই পড়িয়ে দেয় কাঁচের
চুড়ি। বাজে ঝুমকো ফুল। বাজে শঙ্খনিনাদ।
অনেকদিন পরে আবার আফসানার জন্য অপেক্ষা করছে আরিফ। অনেকদিন পর পুরানো অভ্যাসের চর্চা। পঞ্চান্ন মিনিট পর রিক্সায় চড়ে আরিফের সামনে এসে দাঁড়ালো আফসানা। এই পঞ্চান্ন মিনিটে দশ-বারো বার মুঠোফোনে ডায়াল করেছে আরিফ। তিনবার ওয়েটিং বাকিগুলো নো আন্সার। এমনতো হয়নি কখনো! আফসানার কল লিস্টে আরিফ ছাড়া আর কেউ ছিলোনা কখনো। হয়তো কখনো ওর বাবার বাড়ি থেকে কিংবা কোনো বান্ধবি ফোন করেছে।
সেটা নিতান্তই মাসে কিংবা দু’মাসে একদিন এক থেকে দুই মিনিট। কিন্তু আজ কী হলো? বিমর্ষ মুখ নিয়ে আফসানা দাঁড়ালো পাশে। কোনো অজুহত নেই। অবাক হলো আরিফ।
কী হয়েছে?
কিছুনা।
ফোন রিসিভ করলেনা যে?
কোনো শব্দ নেই। প্রশ্নটা কান পর্যন্ত নিয়েছে কিনা কে জানে।
একটা রিক্সা ডেকে উঠলো দু’জন। আরিফ বারবার তাকাচ্ছে আফসানার মুখের দিকে। কোথায় হারিয়েছে ও! আফসানার জন্য একটি শাড়ি কেনার কথা আজ। সেজন্যই আজ আফসানার বের হওয়া- আর আরিফের অপেক্ষার প্রহর গোণা।
একটি একটি করে কয়েকটি দোকান ঘোরা হল। শাড়ি দেখা হলো ঢের। পছন্দ করা কিংবা কেনার প্রতি একদম মনোযোগ নেই আফসানার। অবশেষে ‘পছন্দ হচ্ছেনা’তে ইতি। এমনটি হয়নি কোনোদিন। পছন্দের ব্যাপারে অন্যান্য রমণীদের মতো ওর খুঁতখুতে স্বভাব নেই। কিন্তু আজ কী যে হলো! ভেবে ভেবে এ মহাসমুদ্রের কিছুতেই নাগাল পায়না আরিফ।
কী খাবে?
কিছু না।
কী হয়েছে?
কিছু না।
একটা কিছু খাও?
নাহ্। বাসায় চলো।
আরিফ বুঝে নিলো কিছু একটা লুকোচ্ছে আফসানা। আসতে কেনো দেড়ি হলো, ফোনে কার সাথে কথা হয়েছে কিছুই আর জিজ্ঞেস করেনি আরিফ।
সন্ধ্যার সিঁড়ি বেয়ে সময় উঠে যাচ্ছে রাতে। চাকা ঘুরছে। রিক্সা, অটো, মটোর-বাইক, নছিমন...। রিক্সায় আফসানার একদম গাঘেসে বসেছে আরিফ, তবু ব্যাবধান যেনো কতোদূর...। নাগাল পেতে কিছুক্ষণ পরপর আরিফ তাকাচ্ছে ওর চোখ-মুখের দিকে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছেনা ভালো। তবু তাকাচ্ছে। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে আসা মটোর-বাইকে হেডলাইটের আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠলো আফসানার চোখের বহিমিয়ান বহমান জল।
বাসায় ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করেই শুয়ে পড়লো আফসানা। আরিফ অফিসের কতোগুলো ফাইল নিয়ে বসলো টেবিলে। কাল্কের মধ্যে এগুলো শেষ করতে হবে। চোখ ফাইলের দিকে তবু কিছুতেই চোখ নেই ফাইলে। অফিস ছুটি থেকে এ সময়ের মধ্যে দুই কাপ চা চলে। এক কাপ অফিস থেকে বের হয়ে ফুটপাথের দোকানে। এক কাপ বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরে আরিফ প্যান্ট-শার্ট ছেঁড়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসতে আসতে আফসানার চা রেডি। এরপর গল্পে গল্পে চলে
চা-চক্র, টিভি-সিরিয়াল-খেলা-টকশো...। এরমধ্যেই চলে অফিসের কাজ।
দৃষ্টি আর ফাইলে আটকে রাখতে পারলোনা আরিফ। পায়চারি করতে করতে ড্রয়িং রুম-বারান্দা-ড্রয়িং রুম-বেড রুম। হঠাৎ বালিশের পাশে আফসানার মুঠোফোনে চোখ পড়লো। আফসানা মুঠোফোনের উল্টোদিকে কোলবালিশে মুখ লুকিয়ে হয়তো ঘুমোচ্ছে। আরিফ মুঠোফোনটা হাতে নিলো। রিসিভ-ডায়াল লিস্টে একটিই আন্নোন নাম্বার। একটি আনরিড মেসেজ ‘প্রাণপাখি তোমার জন্য এতোটা বছর আপেক্ষা করলাম... যাহোক সুখী হও’।
আরিফের চোখে-মুখে ধ্বনিত হতে লাগলো প্রাণপাখি-প্রাণপাখি-প্রাণপাখি...। হঠাৎ ভোল্টেজ বেড়ে গেলো আর সিলিং ফ্যানটা আরো দ্রুত গতিতে ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে লাগলো প্রথম দেখা থেকে এক আফসানার কতো কতো মুখ। সিলিং ফ্যানের সাথে ঘুরতে লাগলো নিঃসঙ্কোচে আফসানাকে বলে দেয়া ডায়রির সবকটি পৃষ্ঠা।
কিনা বলেছে আরিফ আফসানাকে? প্রথম কোন্ মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো। কোন্ কোন্ মেয়ের জন্য নির্ঘুম রাতের পর রাত কাটিয়েছে। কোন্ মেয়ে বুকের সবটুকু শরাব ঢেলে বলেছিলো ‘তুমিহীন কোনোদিন বাঁচবোনা’। কোন্ মেয়ে জোছনা কুড়িয়ে পুড়িয়ে কয়লা রেখে গেছে বুকে। সেইসব ছবিছায়ার চিত্রণ আফসানাকে দেখিয়েছে সব। আফসানা দেখায়নি কিছুই। যতোবার জিজ্ঞেস করেছে, বলেছে ‘তুমি ছাড়া কোনো প্রেম ছোঁয়নি
আমায়, তুমি ছাড়া কোনো প্রেমাগুনে পুড়িনি আমি।’
বেডরুম ছেড়ে আরিফ এখন বারান্দায়। একটি চেয়ারে বসে একটি চেয়ারে পা বিছিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছে। কতোদিন তারা দেখা হয়না। বাসায় যখন টিভি ছিলোনা রোজ দু’জন বারান্দায় বসতো । তারা দেখতো। রাতের আকাশটাই যেনো হয়ে উঠতো টিভিমনিটর। গল্পে-গানে রঙিন হয়ে যেতো যাবতীয় অন্ধকার।
আকাশের সব তারা যেনো বিদ্রুপের ঢঙে হাসছে আজ। বাদুর উড়ে উড়ে ডানা ঝাপটা দিয়ে যেনো রেখে যাচ্ছে বিদ্রুপের বার্তা- সরলরেখার মাঝেও কি তবে একাধিক বক্ররেখা থেকে যায়? পাঠ্যের সবটুকু পড়েও কিছু প্রশ্ন কমন পড়েনা পরীক্ষায়, পরীক্ষা-পরীক্ষা বয়স কাটিয়ে আজ আবার বুঝলো আরিফ।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো আরিফ। কিছুক্ষণ পায়চারি করলো বারান্দায়। তারপর বেডরুমে। চাতেষ্টা পেয়েছে খুব। আফসানা এখনো একই ভাবে- হয়তো ঘুমোচ্ছে। নিজেই চা তৈরি করে সাদা পেয়ালায় ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে আরিফ। আর চায়ের সাথে পান করছে নিজেকে বুঝাতে না পারা কালো কালো ব্যর্থতা। চা পান শেষে আফসানার পাশের বালিশে শুয়ে পড়লো।
কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়েছিলো আরিফ। ঘুম পালালে দেখে আফসানা পাশে নেই। মুঠোফোনে ২:০০ এএম। বিছানা ছেড়ে উঠলো আরিফ। বাথরুমে নেই। এ রুম, ও রুম শেষে বারান্দায় গিয়ে যেনো দম নিলো আরিফ। ঘুমের আগে আরিফ যে ভাবে একটি চেয়ারে পা বিছিয়ে একটি চেয়ারে বসে তারা দেখছিলো সেই একই ভঙ্গিতে তারা দেখছে আফসানা। আরিফের উপস্থিতি টের পায়নি বিন্দুমাত্র। আরিফ পা টিপে টিপে কিছুটা এগুতেই দু’জনের ছায়ারা
আলিঙ্গন করে নিলো অজান্তে। পেছন থেকে আরিফ ‘প্রাণপাখি’ বলে ডাকতেই চমকে উঠলো আফসানা। বাইরের অন্ধকারে তালপাতার মধ্যে লুকানো একঝাঁক চামচিকা হঠাৎ উড়ে গেলো। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো আফসানা। আরিফ আফসানার মেঘচুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো, অতীত তো অলংকার- নিউরনে বাজতে থাকা বেহালার সুর- ধ্রুপদী নেচে যাওয়া পায়ের নূপুর...। যাবতীয় অলংকারকে ধরে রাখতে হবে দস্যু বিস্মৃতির হাত থেকে।
বর্তমান প্রাণকে তো বিসর্জন দিয়ে নয়। বর্তমানকে বিক্রি করে কি কুড়াবো অতীত অলংকার?
আফসানা আরিফের বুকের মধ্যে মুখ লুকালো। বেহালা বাজছে যেনো উভয়ের চোখে...
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন