বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

মুক্তগদ্য - জব্বার আল নাঈম

কবিতা নিয়ে গদ্য
জব্বার আল নাঈম




আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: পোড়খাওয়া মানুষের গভীর অন্তর্দৃষ্টির নাম

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সফল ও স্বল্পপ্রজ একজন কথাসাহিত্যিক। তার লেখনীতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উঠে এসেছে সমাজবাস্তবতার সুনিপুণ চিত্রকল্প, ইতিহাস এবং রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, পোড়খাওয়া মানুষের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধে রচনাকে করে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী সুষমা। হালের লেখকদের অন্তর্দৃষ্টিতে গভীরভাবে পৌঁছে গেছে কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জীবন ও জীবনবোধ এবং সামাজিক চিন্তাচেতনা। যেখানে সত্যিকার অর্থে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অন্যতম সাহিত্য প্রতিনিধি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) স্বল্প জীবদ্দশায় উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ (১৯৮৭) এবং ‘খোয়াবনামা’ (১৯৯৬)। ছোটগল্প ‘অন্যঘরে অন্যস্বর’ (১৯৭৬), ‘খোঁয়ারি’ (১৯৮২), ‘দুধভাতে উৎপাত’ (১৯৮৫), ‘দোজখের ওম’ (১৯৮৯) এবং জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭) অন্যতম। এ ছাড়া বাইশটি প্রবন্ধ নিয়ে প্রবন্ধ সংকলন ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ এখনো বোধের অবস্থান জানান দেয়।

সাধারণ মানুষকে মুক্তির বন্দনা শোনাতে বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং মরিয়ম ইলিয়াস দম্পতির ঘর উজ্জ্বল করে ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে অখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ওরফে মঞ্জু জন্মলাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে অনার্স-মাস্টার্স পাস করেন। পরে জগন্নাথ কলেজে (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। এই অসামান্য প্রতিভাবান মানুষটি সারা জীবন যেমন করে বৈরী পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করেছেন। তেমনি করে লড়েছেন ডায়াবেটিস ও জন্ডিসসহ নানাবিধ রোগে। সাহিত্যের এই বরপুত্র ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

কিন্তু তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ যেন অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী উপন্যাস। মহান মুক্তিযুদ্ধ এক দিনে আসে না। অনেক চড়াই-উতরাই আর চাওয়া-পাওয়ার পর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আসে। যেই সংঘর্ষের আগে ছিল ১৯৬৯ সালের আতঙ্কিত পূর্ব বাংলা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই সময়ের পেক্ষাপটকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলির আঁচড়ে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে লিপিবদ্ধ করেন। গণমানুষের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে সে পথে হেঁটেছেন ইলিয়াস। তার ‘চিলেকোঠার সেপাই’ সমাজবাস্তবতার আলোকে উজ্জ্বল এবং প্রাসঙ্গিকই মনে হয়। ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে রাজপথে জীবনস্পর্ধী মন্ত্রের মুখে মৃত্যু বিস্ফোরিত হতে থাকে। যখন মুহূর্তে মুহূর্তে কেঁপে ওঠে মানুষের বুক, বাংলার মাটি আর ছোট শহর ঢাকা। কাঁপে কারণে-অকারণে গ্রামগঞ্জ, নিভৃত চার দিক এমনকি দখল করা চরাঞ্চল। ভয়ে শীতল হয় কোটি কোটি প্রাণ। এই বিপদ-বিপর্যয় আসে দুর্বিষহ বুলেটের আঘাত, অভাব ও স্বভাবে। এক দিকে চলে মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির চরম আকাক্সা, অন্য দিকে ক্ষমতাসীনের চর দখলের বাহাদুরি। দিনরাত বিরামহীনভাবে চলতে থাকে মিছিল-মিটিং-গুলিবর্ষণ-কারফিউ ভাঙার স্লোগান; গণ-আন্দোলন, গণ-আদালত, ক্ষোভ আর রাজবিদ্রোহ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মনের চেম্বারে অধিষ্ঠিত হতে থাকে একটাই শব্দ- মুক্তি, মুক্তি এবং মুক্তি। একটা সময় এই মুক্তি শব্দটাকে বুকে ধারণ করে বাঙালি হয়ে ওঠে অটল-অবিচল। মুক্তির স্বাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হয়। মুক্তি আসে বিভিন্নভাবে শহর, বন্দর ও গ্রামে। নির্লজ্জ জাতির বিরুদ্ধে সর্বশ্রেণীর একাত্মতা ঘোষণা করে ‘দিকে দিকে আগুন জ্বালো’ স্লোগানে স্লোগানে।

‘তোমার রঞ্জু পড়ি রইলো কোন বিদেশ-বিভুঁয়ে, একবার চোখের দেখাটাও দেখতি পাল্লে না গো! কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে ওসমান একটার পর একটা লেবুপাতা ছেঁড়ে আর মায়ের বিলাপ শোনে। ৩টে আঙুলে লেবুপাতা চটকাতে চটকাতে উঠানের দিকে এগিয়ে গেলে কে যেন তাকে দেখে ফেলে, ওরে! রঞ্জুকে এট্টু কাঁধ দেতে দে! লোকটা কে? সেই লোকটাই ফের আফসোস করে, আহা হাজার হলেও বড় ছেলে, জ্যেষ্ঠ সন্তান! কুথায় পড়ে রইলো সে, বাপের মুখি এক ফোঁটা পানি দিতি পাল্লো না! আহারে, বাপ হয়ে ছেলের হাতে একমুঠি মাটি পেলো না গো!’

এভাবেই শোকাবহ বিলাপের মাধ্যমে গল্পের ভেতরে আমাদেরকে নিয়ে যান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে থাকে আধুনিক ঢাকা শহর। বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির ঘিঞ্জি গলির মধ্যে একটি বাড়ি। সেই লেনে বসবাস করে ওসমান গনি ওরফে রঞ্জু মিয়া। এই রঞ্জু মিয়া ’৬৯-এর অভ্যুত্থান সব দেখে। শোনে। বিপ্লবীদের কাতারে শামিল হয়ে মিছিল করে, মিটিং করে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে কেন যেন তার উপস্থিতি নেই বলে মনে হয় তার কাছে। চার দেয়ালের চিলেকোঠার মাঝে রঞ্জু বারবার নিজেকে আবিষ্কার করে। দেয়াল টপকে সে বের হতে পারে না আত্মমগ্ন প্রেমের কারণে। এই দেয়াল বিচ্ছিন্নতার ও আত্মপ্রেমের। সহনামী প্রতিবেশী রঞ্জুর বোনের প্রতি ওসমান গনি ওরফে রঞ্জু মিয়া বেশ আসক্ত। তার ধ্যানজ্ঞান মেয়েটির যৌবন উপচে পড়া শরীর। মাঝে মাঝে রঞ্জু মিয়া প্রেমের বিষাদ থেকে নিজেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কক্ষ ত্যাগ করতে চায়। কিন্তু ত্যাগ করাটা যে এত সহজ না। ডানা ঝাপটে তিরতির করে উড়তে চাইলেই কি ওড়া যায়? ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি উত্থাপন হওয়ার পর আসে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। এই গণ-অভ্যুত্থানে সন্ত্রস্ত শাসকদের নতুন করে আরোপ করা সমরিক শাসনের নির্যাতন শুরু হলে বন্ধুরা যখন শোক ও ভয়ে বিহ্বল, ঠিক তখন ওসমানের ডানায় লাগে প্রবল বেগ। আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে প্রতিবেশী সহনামী কিশোর রঞ্জুকে সে চুম্বনে চুম্বনে রক্তাক্ত করে। এমনকি ঠোঁট থেকে এক টুকরো মাংস ছিঁড়ে নেয়। তবে তা যৌনতার বশে ছিল না। ঘিঞ্জি গলির ভেতরে অনেকেই রঞ্জুকে বদ্ধপাগল হিসেবে জানে বা চেনে। এই উৎসাহে অনুরাগী বন্ধুরা ব্র্যাকেটবন্দী করে রাখে তার নিজ ঘরে। রঞ্জু চায় না সে নিজেকে বন্দী অবস্থায় দেখতে। সে একজন নার্সিসাস। কিন্তু এখানেই তার ফিনিশিং নেই। গৃহবন্দী থেকে বের হওয়ার জন্য প্রচণ্ড ক্রোধে সে ডানা ঝাপটায়। একসময় রঞ্জুকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেয়ার জন্য পাঁজাকোলা করে রেলিং ডিঙানোর ভয়ঙ্কর উদ্যোগ নেয়। কারণ হিসেবে রঞ্জুর আত্মকণ্ঠে জানা যায়, ‘খিজিরের কাছে আমি প্রমিজ বাউন্ড, আমি ওকে কথা দিয়েছি।’ কিন্তু এখানেও দেখা যায় তা ছিল রঞ্জুর আত্মপ্রেমে বিসর্জনের অসম প্রস্তুতি।

গৃহবন্দী ওসমান ওরফে রঞ্জু বারবার নিজেকে মুক্তি দিতে চায়। জনবিচ্ছিন্নতার জন্য তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই রহস্যবন্দী থেকে কে দেবে তাকে মুক্তি? এই বন্দিদশা থেকে কে পারে তাকে উদ্ধার করতে? এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন!

নাকি ভোটপ্রার্থী আলতাফ? বাম রাজনীতি বিশ্লেষক আনোয়ারের সাথে বেশ কয়েকবার তার হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তি হয়েছিল। তাহলে এই বন্দিদশা থেকে কিভাবে ওসমান গনি ওরফে রঞ্জুর মুক্তি মিলবে? খিজিরই তাহলে তার শেষ ভরসা। কিন্তু হাড্ডিসার এই খিজির নিজের বাপের নাম জানে না। তার পরও এই খিজির তাকে চিলেকোঠার দুর্গ থেকে বের হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। যার মা-বউ দু’জনেই মহাজনের ভোগ্য। গণ-অভ্যুত্থানের সক্রিয় সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফিউ চাপা রাস্তায় মিলিটারির হাতে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়। কিন্তু খিজিরের আহ্বানে ওসমান গনি প্রচণ্ড শক্তিমত্তা দিয়ে ঘরের তালা ভেঙে সবার অগোচরে কারফিউর দাফট অগ্রাহ্য করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। মধ্যরাতে দৃশ্য-অদৃশ্য খিজিরের পেছন পেছন ছুটতে থাকে রঞ্জু। একের পর এক পুরান ঢাকার অলিগলি পার হতে থাকে। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে কখনো কুকুর, কখনো বিড়াল আবার কখনো কখনো কারফিউ সামরিক শাসকের চোখ ফাঁকি দিয়ে সামনে হাঁটছে। কখনো কখনো খিজির বিদ্যুৎ প্রবাহিত তারের ভেতর দিয়ে সেনা ভয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। রঞ্জু খিজিরকে দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড জোরে শব্দ করে ডাকতে থাকে। খিজির হাসতে হাসতে তার উপস্থিতি জানান দেয়। খিজির খুঁজতে চায় জুম্মনকে। জুম্মনকে খোঁজে বের করা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু জলজ্যান্ত শরীর নিয়ে রঞ্জু বাংলাদেশের সব দিকেই তাকাতে পারছে।

উচ্চমার্গীয় আখতারুজ্জামানের পক্ষে এসব ভাষা, শব্দ ও জীবনযাত্রার চিত্রকল্প তুলে সত্যিকার অর্থে বাস্তবতার ছোঁয়া পেয়েছে। সাধারণ জনজীবনকে হৃদয় থেকে অনুধাবন না করলে সত্যিই দুরূহ কাজ। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি লেখক সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, ‘কি পশ্চিমবঙ্গ কি বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক। ইলিয়াসের পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।’ সত্যিকার অর্থেই প্রথিতযশা এই অমর কথাশিল্পীকে যে কেউ অতিক্রম করতে গেলে ভাবনার বাড়িতে বারবার যেতে হবে। দীর্ঘ ১৫-২০ বছর ধরে তার অমর শৈল্পিক সাহিত্য উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই এবং খোয়াবনামা’ বাংলা উপন্যাসের মাইলফলক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।