এই সংখ্যার কবি
সুমিত রঞ্জন দাস - জন্ম ১১ই ডিসেম্বর, ১৯৬৭ বর্ধমান শহরে। বাবা গোপীবল্লভ দাস, মা সনকা দাস। জন্ম থেকেই বর্ধমানে বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা সুত্রে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পেশা দুর্গাপুর স্টীল প্ল্যান্টে মানব সংশাধন বিকাশ কেন্দ্রে কম্পিউটারের বরিষ্ঠ শিক্ষক। অবসর সময়ে আত্মতুষ্টির তাগিদে লেখা। প্রথম বই ২০১১ সালে - "বিষাদ ভেজা ময়ূরী বসন্ত", রচনাকাল: ২০০৯-২০১১ ।
বিশ বাঁও জলে যে কথাকলি
(১)
খড়কুটো দিয়ে জীবন গড়ায় ব্যস্ত যে লোকটা
তার বিছানায় শতছিন্ন চাঁদ;
ঢেঁরা গুনে কেটে যায় অনেক একুশ
বদ্যি-হত্যে-সমালোচনা সঙ্গী থাকে এরাই
এবারও বুঝি জীবন বেচেই খাবে লোকটা
দেবীপক্ষ আসতে বুঝি অনেক বাকি!
(২)
কাল কিছু মানুষ নষ্ট হবে
নষ্ট হবে চাঁদ
নষ্ট ছেলেবেলা
নষ্ট লেখা কবির কবিতা
সার বেঁধে দাঁড়াবে এরা সবাই
বৈকুন্ঠপুরের সদ্যপ্রকাশিত শারদকরচায়;
শিরোনাম হোক নাহয় 'প্রেম' -
খিদেকে ভোলাতে পারেনি যে কখনো।
(৩)
রোদচশমার কাঁচে অবলোহিত আলো;
নীল সবুজ নিদেনপক্ষে হালকা বাদামী
পড়ন্ত বিকালের সবকটা রঙ ছিল ফ্রেমে
বিকিয়ে গেল চার পাঁচ কিম্বা আটআনায়
ষোলআনা যে অনেক দামী
সারাটা জীবনে
অধরাই রয়ে গেল তাই রামধনুর ছটা।
(৪)
মেটে রঙের প্রলেপ এখনো অনেক দেরী,
আজকাল ঝিঁঝিপোকারাতে কেবল
সুখস্বপ্নের মিহিদানাবারি
শুকোতে চায়না কাঁচা মাটির ভালবাসা;
একচিলতে দড়মার পলেস্তারা
আর খড়কুটো বাঁধা কয়েকটা জীবন
হড়কায় ভেসে যাবার আগে এটুকুই আশা
'মা' আসছেন, আর মাত্র ক'টা দিন পর...
(৫)
দুরমাঠে সূর্য অস্তাচলে
পাঁচের টেবিলে তিনটে হাফ
সতেরোয় ডবল একটা চিনিছাড়া হবে
একুশে কেউ নেই আজও;
প্লাসটিকের হাতপাখায়
প্লাসমাইনাস কাটাকুটি
হিসাব কষে যায় প্রবীন কবি
ঝর্ণা কলমটায় কালি শুকিয়ে গেছে বহুদিন।
(৬)
ফিরে আসছে শুরুর দিকে এক চিলতে আলো
আয়ু কিনে বেড়ানো অতীতের গল্পগুলো
উগড়ে দিচ্ছে জীবনের অস্তিত্ত্ব
আমি দৌড়চ্ছি
আলোর গতি বেড়ে চলেছে
আরও জোরে, জোরে
ঠিকরে পড়েছে আলো
ঝকমক করে উঠছে চাহিদাগুলো
দৌড়চ্ছি আরও জোরে
আর কয়েকটা মুহুর্ত সামনে -
আমার গন্তব্যস্থল যেন বিন্দুতেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
(৭)
খেলাঘরে আমরা দুজন
আমি আর আমার একাকীত্ব -
আমি খেলি আমার একাকীত্বের সাথে
একাকীত্ব আমাকে খেলায়
আমার একাকীত্ব আর আমি
কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না;
খেলার বিরতিতে কে যেন হঠাৎ কড়া নেড়ে যায়
আমি তখন অপেক্ষায় থাকি, খেলা সাঙ্গ হবার
জীবনরাত আর একটু গাঢ় হলেই
আমি এসব না দেখে এবারে ঘুমিয়েই পড়ব।
(৮)
অমলকান্তির রোদ্দুর ভালো লেগেছিল
বিষন্ন মেঘলা আকাশ কখনও চায়নি
একলাটি চাঁদ জোৎস্নার আলোআঁধারে
মিলিয়ে যেতে চেয়েছিল
ঝাউপাতার ঝিরিঝিরি বাতাস
উড়ে যেতে চেয়েছিল সেও নিরুদ্দেশে;
এইসব বিষন্নতা দীর্ঘশ্বাস সময়ের ফাঁক গলে
কে জানে কোনদিন অমলকান্তি
কবিতা হতে পারবে কিনা।
(৯)
একটা গল্প লিখে দেবে আমায়
কালরাত রক্তক্ষরন হত্যা শিহরনে ভরা
চেনা শব্দ খুঁজে পাক সংবাদের শিরোনাম
রূপোলী আলোয় শমন পাঠাক ঈশ্বর
মেঘলা কাঁচে নিঃশ্বাস ফেলুক মৃত্যু
তবুও আমি স্পষ্ট দেখতে পাব -
ঈশ্বর অসুস্থ আমার অপেক্ষায় তার শেষ সময়;
ভাবছি এবারে বেরিয়ে পড়ব যে কোন একদিন।
(১০)
সব কথা ভুলে যাই আমরা
কেবল বিষাদের রক্ত লেগে থাকে পায়ে
সব হারিয়ে যায়
দিনের শেষে ছেলেবেলা কৈশোর যৌবন নিতম্ব
সোনালী দিনগুলো বেহিসাবী ছুটে চলে
বিষাদহোলীখেলায় লিপ্ত হয়ে পড়ি
এসবের মাঝে কেবল ইতিহাস অপেক্ষায় থাকে
কোন এক নক্ষত্রের ছাই হয়ে যাওয়া স্মৃতিবিষ
আগলে রাখবে বলে।
(১১)
চিন্তার সব ছবিতে একদিন ভোর হয়
আলো নিভে গেলেও জৌলুস কমে না একটুও
রগরগে পোস্টারগুলো কেবল পলেস্তারা খসায়
যৌনতা ঝেড়ে ফেলে হোঁচট খায় আবছা অন্ধকারে
আয়ুকেনা জীবনের পৌরানিক ছাপাখানায়
চেনা হরফ গলে গলে পড়ে; ইতিহাসে
মৃতবৎসের পান্ডুলিপি লেখা হবার আগে
কেবল ক্যালেন্ডারে জন্মের তারিখ বদল হয়
কোন রকম ভুমিকা ছাড়াই।
(১২)
হিমবাহ নিঁখুত পাথর হয়ে যায়
ইতিহাস কাঁপে বিধ্বংসী ভুমিকম্পে
বৃষ্টিভেজা নির্বিকার সময়
হামাগুড়ি দিয়ে যায় নিঃশব্দে
কায়াহীন সংখ্যাহীন যত আবেগ
অনুচ্চারিত রয়ে যায় জিহ্বায়
কেবল জীবন তখন অন্যভাবে হেঁটে যায়
আজকের তথ্যচিত্রে মুকাভিনয় করবে বলে।
(১৩)
একটা সাদা চক লিখে যায়
দিদিমনি কথকথা
সাদা চক লিখে যায়
দিদিমনির জীবনের কথা
মুছে যাওয়া সাদা সিঁথির মেঘলা আকাশে;
শব্দগুলো খেলা করে এখন অন্যরকম খেলা
ব্যস্ততম যত দিন হয়ে যায় অব্যক্ত ভাযাহীন
যেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাতিল হয়ে যাবার আগে
লিখে যায় - ব্ল্যাকবোর্ডের শরীর বুঝি ভাল নেই।
(১৪)
অকাল বৃষ্টি আজকাল চোখের পাতা ধুয়ে দেয়
ভিটে মাটি বাতাস আর নতুন গল্প বলে না
হলদেটে ভালোবাসা বাৎসায়ন উপকথা
জলরং তেলেভাজা কিছু ভাল লাগে না
স্যাঁতসেতে হাতপাখা অমরত্বের পাকাদেখা
গুগলের মানচিত্রে বুঝি কোনদিন ঠাঁই হয় না
এইসব লেখাজোকা শব্দজব্দ ঢাকা আয়না
প্লাস্টারে কাগজের মন্ড - এছাড়া আর কিছু হয় না।
(১৫)
কিছু মানুষ প্রতিদিন থাকে
সব মানুষ কিছুদিন
কিছু মানুষ আমাকে ডাকে
সব মানুষ ডলফিন
ডুব দেয় আর ওঠে বেহুলাবাসায়
বন্দী থাকেনা জলের তলায়
গভীর নীচে গাছপালা পাহাড় সংশয়
বুকে হেঁটে যাওয়া হামাগুড়ি জীবন
তবু ভালোলাগে বিরতি বিশ্রাম
সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসতে হবে বলে।
(১৬)
মাটি খোঁড়া মেঠো আলু
জলে ফোটানো ঘাসবীজ আর
বেঁচে থাকার নুন্যতম অঙ্গীকার -
এসব নিয়েই বড় হয় হেমব্রেম পরিবার
এসব নিয়েই লেখা হয় পরিবারের গল্পগাথা,
সরকার মাঝে মাঝে এদের কথা বলে; ইতিহাসে
সেদিন সংযোজিত হয় আর এক নতুন অধ্যায়।
(১৭)
স্বপ্নরাতে শজারু আসে আজকাল
আগে কাঁটা পরে গ্রহনীয় মাংসের হাতছানি; টান
অনির্দিষ্ট তারুন্যের স্রোতে ভাসা
আনখা নৌকায় ঘুমন্ত যুদ্ধের সাজে দেখে
দুরে চলে যায়;
এ অন্য শজারু
নিশ্চিত গন্তব্য ছেড়ে জলের গভীরে ডুবতে চায়
পরিচয় দেয় না উত্তর মেলে না
কেবল নিস্তব্ধ দুপুরের মত
মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়।
(১৮)
নিত্য অনুশীলনে নিরাকার হতে থাকে অজানা মুখ
বিষাদক্লিষ্ট তাপসের খোঁজে আজও বেহিসাবী সাজ
কেবল ইতস্ততঃ মেঘ চারিপাশে,
ভিজব না আমি
ভিজবে কেবল গোধূলির আকাশ
বিভাব এমনি গোধূলিয়া হলে হেঁটে যাব ঠিক
কেটে যাবে হরদম দাঁড়ানোর ঝোঁক;
অদূরে তখন হাসবে চন্দ্রাতপ জোৎস্না।
(১৯)
পাহাড়ের দুঃখ নিয়ে আঁকিবুকি
আঁচড় কাটা কয়েকটা মুহুর্ত
মিশরীয় মমি হয়ে আছে
অথচ সর্বত্র আজ বসন্তের হোলী!
এখনও সময় আছে, বুনে যাও কল্পনাজাল
স্বপ্নের মাঝে ঘসে ঘসে
রঙীন করে তোলো তোমার জীবনী
চিহ্ন রেখে যাও - বেঁচে আছো
পাপপূণ্য নয় বেঁচে আছো, এটুকু জানাতে
সব ভুলে এবার ছুটে যাও পিছনের দিকে;
পাহাড়ের সীমা ছেড়ে রঙের পোঁচ
মিশে যাক অবসন্ন ঢেউয়ের খাঁজে
তোমার সংহার শেষে সব শোধ দেবে বলে।
(২০)
বৃত্তের বাইরে যে মেয়েটা বিলি করছে নিষিদ্ধ ইস্তেহার
মান অপমান অহঙ্কারের সিলমোহরে পাচার হচ্ছে পলকে;
সৌজন্যের শেষ বাতিটুকুও নিভে গেলে
ধীর পায়ে বাড়ি ফিরে যায় অভিজ্ঞ বৃদ্ধ
অভিযোগ জমা হয় প্রতিদিন বিজ্ঞাপনের মোড়কে
নিশুতি রাতে পথ হারায় অস্ফুষ্ট গোঙানীর শব্দ
আমিও বসে থাকি যমযন্ত্রনা পান করে
তাম্বুলপাত্রে একটুকরো বিসর্গসুখের আশায়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন