বাণীব্রত কুণ্ডুর ২০টি কবিতা
▀ অলখ হাওয়ার ঘ্রাণ
পাথর কাটা রাস্তা ছুঁয়েছে চূড়া
যেখানে দেবীর পূজার আসন পাতা
মেঘেরা হাজির নিত্যদিনের মতোই
নিত্যসেবায় মেতেছে ভূ-মন্ডল
#
চড়াই ভেঙে এগিয়ে যাবার পথে
হঠাৎ কিছু অলখ হাওয়ার ঘ্রাণ
চমকে দিয়ে উড়িয়ে নিল মন
মনের হদিশ কোথায় খোয়ালাম!
#
আবছা আলোয় পাহাড় ছলনাময়
নিথর মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল একা
মা তুমি না প্রেয়সী জানিনা তখনো
মায়ার খেলায় নিথর আমিও একা...
▀ অনন্ত সূর্য়ের বাসর
হেমন্তের জানালা বেয়ে নেমে আসা উড়ো মেঘের দল
কিশোরী মেয়েটির কানে কানে কী বলে যায়!
দু-পায়ে। নুপূর পড়ে গান্ধর্বীর তালে
নেচে নেচে, কোথা যায়! কোথা ছুটে যায়?
#
গঞ্জের হাটে বেচাকেনা সেরে মা বাবার ফিরতে হবে দেরি
দুপুর গড়িয়ে গেলেই যত পল্লীর ছেলেমেয়ের
সাদা হাত রেঙে ওঠে কুসুমকুসুম খেলায়
সে শুধু একা ঘরে চেয়ে চেয়ে গোধূলির আসা যাওয়া দেখে
#
ঋতুদল তার কাছে উবু হয়ে বসে সকাল সাজায়
বাউণ্ডুলে হাওয়া উঠোন ভরে দেয় ফুলের পরাগে
প্রকৃতির বাসনা সেজে ওঠে অনন্ত সূর্য়ের বাসরে
তবু মেয়ে একা ঘরে এখানো নিভৃতে চাঁদ কুটে যায়...
▀ অন্য মহালয়া
বার-বাংলোর মাটি এসে গেছে কুমোরপাড়ায়
শুরু হবে প্রতিমা নির্মাণ;
কাঠামোর গায়ে সোমত্তো নারীশরীর
এক অদ্ভূত দ্যোতনায় সেজে ওঠে মাতৃরূপিণী
শক্তিকামী পুরুষ তার পুজোয় মাতে
বছর বছর, আগমনীর সুরে...
যদিও ছিন্নবস্ত্রা পাগলিনি এক মা
মোহনকলোনির পথে পথে অন্য মহালয়া গায়
‘যা নারী সর্বকালেষু ভোগ্যারূপেণ সংস্থিতা...’
#
আজো, পিতৃপক্ষ অবসানে
দূর-দূর গৃহ থেকে ভেসে আসে
অমোঘ মন্ত্রোচ্চারণ –
“যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা...”
তবুও
বলিষ্ঠ পুরুষের কাছে পরাজিত মেয়ে
এলিয়ে পড়ে থাকে ত্যক্ত বিছানায়
দগদগে অপমান ক্ষতচিহ্নগুলি নিয়ে
#
স্ফুটে ভেসে আসে স্তব এক অন্য মহালয়ার...
▀ আরণ্যক
আমি এখন আরণ্যক জীবনের পথে পথে
তোমাদের ছেড়ে একা একা খুঁজে বেড়াছি
জ্যোৎস্না নদিতে স্নানের আনন্দ
এখানে ভালোবাসারা পাখিদের ঠোঁটে ঠোঁটে
গেয়ে ফেরে মাথুর-সঙ্গীত, আর
পথে পথে আমি একা অরণ্যচারী
খুঁজে বেড়াচ্ছি জ্যোৎস্না নদীতে স্নানের আনন্দ
▀ বর্ণশঙ্খ
বিকেলভরা বৃষ্টি ঝরে শহরতলির বুকে
উন্মনা মন বৃক্ষরাজি এদিক ওদিক ঝুঁকে
চেয়েই থাকে নির্ণিমেষে তোমার দিকে ফিরে
চেয়েই থাকে অপলকে লজ্জাশরম রেখে।
#
বৃষ্টিগুঁড়ির ফোঁটায় ফোঁটায় কাব্য জমা থাকে
আলসেমিতে ছড়িয়ে গিয়ে ছন্দ খোঁজে ফাঁকে
ওর মনের ওই মঞ্জরীকে মোহনবাঁশি ভেবে –
রাঙিয়ে তোলে মূর্চ্ছণাতে কাব্যকথাটাকে...
#
বর্ণে বর্ণে শঙ্খ বাঁধে শব্দনীলের ঝাঁকে
ধূ ধূ শাদায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন কত আঁকে
ওলোট পালোট তুলোট নেশায় সবাই যখন বুঁদ
দু-চোখ তখন চোখ ফেরানোর দারুণ অপেক্ষাতে!
▀ ভালোবাসা
মোহরাত্রে তুমিও তো ছিলে চাঁদ
শরীরে শরীর জড়িয়ে ছিলাম আমরা
হঠাৎ আসা ভূকম্পনের ঝোঁকে
ঢেকে দিল প্রেম পুরনো পলেস্তারা!
#
পাঁচশ বছর পার হয়ে গেছে এখন
তবুও আছি মাটির ঘ্রাণে ঘ্রাণে!
শরীর যদিও রক্ত-মাংস শূন্য
ভালোবাসা ঠিক বেঁচে থাকতে জানে...
▀ ভালোবাসাকথা
জ্যোৎস্না ভেজা প্রাঙ্গণে তুমি মৈথিলি কবিয়াল
রাধিকার ভালোবাসা বুকে এঁকে
পাখির ডানায় কাব্যকথা লেখো
পাখা মেলে উড়ে যায় সে; মাতিস আকাশে
গেয়ে ফেরে ব্রজবুলি সুর
যমুনার কিনারে কিনারে...
#
বসে থাকে তৃষিত হৃদয়; সেই ঘাটে-
যেখানে এক শ্যামকিশোর মেতেছিল জলক্রীড়ায়...
▀ বিভাব
এতো আর কিছু নয়
হয়তো, আরও বেশ কিছুদিন
মনে রাখার অবলম্বন মাত্র –
#
আরো অনেকের কাছে পৌঁছে যাওয়ার
কারো কারো মনের সাথে
মনের কথা বুঝে নেওয়ার
#
কিংবা, কিছু অবজ্ঞা অবহেলা
কুড়িয়ে পাওয়ার
ঝরা শিমূলের মতোই!
#
বাসনা যাই হোক, জানি –
প্রহেলিকা নির্মাণ করে
সম্পর্কের আলেয়া;
#
আমার তোমার মধ্যে এমনই কিছু কথা
লুকিয়ে রাখার...
▀ বৃষ্টির ছায়ালিপি
অতীতের অবুঝ পংক্তিমালা চুঁয়ে
আজো নেমে আসে আমার কিশোরীবেলার প্রেম
যেখানে এক নবীন যুবক গায় রবিঠাকুরের গান
আর আমিও
শ্রীরাধা সেজে চামেলি ফুলের সুবাসে ভরিয়ে গা
বেরিয়েছি কত ঋতুসন্ধিকাল...
#
অনুগত দাম্পত্যের মস্ত করিডোরে
এখনো ছায়া ঘুরে বেড়ায় সেই সব বৃষ্টিলিপির
নিপুণ হাতে ঘর সাজিয়ে রেখে
মোহনিয়া বিকেল এলে মাধুর্য়্য কুড়োই
আঘ্রাণ নিই
পুরোনো শাড়ির ভাঁজে লেগে থাকা যুবকগন্ধ... ▀ চন্দ্রকোণা
সমতল আর ভালো লাগে না তাই
এবার এলাম মালভূমিময় দেশে
অনেক বাবু সাহেব সেজেছি আগে
আর নয় তাই এলাম বাউল বেশে
#
দিগন্ত যেন কাঁকুড়ে মাটিকে ছোঁয়
কিন্তু গাছেরা মাথা তুলে অবনত
গান বাঁধি আজ শব্দে সুরে গেঁথে
একতারাটা বেজে চলে অবিরত
#
আকাশের মাপে মাঠ আছে ফাঁকা পড়ে
কত যে কি গাছ বেড়ে চলে অগোছালো
মাটির ভিতর নক্সা খুঁজে অনার্য়দল
পাতায় পাতায় মুক্ত হবার রোদ ছড়াল...
▀ চিত্রকর ও বৃষ্টি হওয়ার পদ্য
আমি আকাশের কোলে
তোমাকে নির্মাণ করেছিলাম
মেঘের মমতা দিয়ে –
স্কেচের ভাঁজে ভাঁজে
সন্তর্পণে এঁকেছিলাম
সুদর্শন অন্ধকার,
সমস্ত শৈলীতে ছিল
এক আদিম মায়াবী
অরণ্যের নেশা...
#
আমি তোমাকে –
মাটির কাছ থেকে এনেদিলাম সুবাস
তুমি তা গ্রহণ করলে,
জলের কাছ থেকে এনেদিলাম টলমলতা
তুমি রসবতী হলে
বায়ুর কাছ থেকে তোমাকে দিলাম স্পর্শভাব
তুমি ছুঁইয়ে দিলে মন
আগুনও তোমাকে ঢেলে দিয়েছিল তার রূপ
তুমি পুড়িয়ে দিলে
পুড়িয়ে দিলে সব...
চোখ ধাঁধিয়ে গেল অসহ রূপময়তায়!
#
আমি ভুল বুঝতে পারলাম,
এভাবে তোমাকে অপূর্ব করা ঠিক হয়নি –
দহনবেলায়...
তাই তোমার শরীরে ছিটিয়ে দিলাম
বিরহ রঙ
তুমি বৃষ্টি হয়ে গেলে,
আর আমি –
বৃষ্টির সাথে সাথে আমার বেদনাকে মিশিয়ে
অপরূপ হয়ে রইলাম –
এই মাটি, জল, হাওয়ার কাছে...
▀ ইন্সেক্টিভোরাস
ঝোড়ো হাওয়ার মতো ভালোবাসা এসেছিল।
দ্বারে করাঘাত ছিল না; আগল ভেঙে সোজা
ঢূকে পড়েছিল উঠোনে, বারান্দায় এবং শেষে
একমুঠি ব্যালকনিতে, - নিঝুম রাত হয়ে...
#
আদর ভেজা গলায় বলেছিল অনেক কথা
বুক ভরে দিয়েছিল এক আকাশ নক্ষত্রের দৃঢতায়
ছুঁইয়েছিল কোরক, ভালোবাসার নরম
অনুভবেও আবেশজড়ানো অস্তিত্বের অধিকার!
#
তারপর! ওম ভাঙা পৃথিবীর ঘ্রাণ
শিকারি ফুলের মতো!
▀ ঝিনুক
চারকোল আর প্যাস্টেল নিয়ে সঙ্গে
আজন্ম ছুঁইয়ে আছো রাশিবিজ্ঞান তুমি
যা হবার হবে যা পাবার পাবে
হাজার জীবন শুয়ে থাকার সমুদ্রভূমি!
#
তারায় তারায় স্বাতীকেই শুধু খুঁজি
এই বুঝি অশ্রু ঝরাবে এবার
যেটুকু সময় আসতে লাগবে এখানে
মুক্ত-জন্মের সেটুকু সময় বাকি আর!
▀ মেঘে ঢাকা প্রেম
মোহনচূড়ার পাতাগুলো হলুদবর্ণ
স্বপ্নপাখিরা উড়ে গেছে বিষাদডানা মেলে
অতীত ঘুরে বেড়ায় ভগ্নমন্দিরের চারপাশ
খোলা জানালায় ঠেস দিয়ে
দেখছিলে মেঘে ঢাকা প্রেম
কবেই বাণ ডেকে ভাসিয়েছিল তোমার সব সম্পদ-
এখন শুধু অবশিষ্ট মোনালিসা হাসি...
তবু গোধূলিবেলা যখন
আজও তোমার ভাঙাচোরা কোলে মাথা রেখে
এক সমাহিত সুখ খুঁজে পেতে চাই...
▀ নক্ষত্রভাষা
আমার অবসন্ন সময়গুলো
সন্ধ্যানামা ঘরমুখো পাখির ডানায়
ছিট্কে যাওয়া হাওয়ার মতোই
মুখ থুবড়ে পড়ে –
নিভে আসা দেওয়ালের গায়
#
ক্রমে রাত বাড়ে,
নক্ষত্রভাষা ফুটে ওঠে
মুখরিত হয় গভীর নীরব!
সব বলা পৌঁছে না মাটি পর্য়ন্ত
#
আমি এবং নক্ষত্রেরাও জানে
অবধিটানা শব্দও দায়বদ্ধ রাজনিয়মে
#
তবু, আজও ভো-কাট্টা হয়
মুক্তির আনন্দে, আর বিস্ময়ে
আমার অবসন্ন সময়গুলো ভাবে-
কতটা শব্দ পারে একসাথে
ভেঙে দিতে- দেয়াল অথবা
ঈশ্বরীয় প্রিজমের নির্মাণ...
▀ নীল মুক্তির খোঁজে
অসংখ্য ভাঙা-গড়ার মাঝেও বেঁচে থাকে মহাকাশ
কুসুম সূর্য় আবির ছড়িয়ে যায়...এখনও
এখনও বাতাস বয়ে যায় আদিম নিয়মেই –
পাথরছোঁইয়া জল এখনও ছুটে আসে সাগরের দিকে...
#
গাছেরা ছায়া মেলে শ্রান্তের আ-শরীর-মন
মেঘে মেঘে বৃষ্টি জমে আজও
জোনাকিরা বুঝে নেয় টেনে সন্ধ্যার কাপশি
রাত্রি সেভাবেই পথ খুঁজে পায় _ অন্যান্যে।
#
বদলায়নি কিছুই; আকাশ এখনও নীল
প্রকৃত ভালোবাসাও বদলায়নি তার ভাষা
ঠিকানা পৌঁছে যায় ঠিক বাসার ভিতর, যেমন
পাখির দু-ডানা আজও উড়ে চলে মুক্তির খোঁজে...
▀ পাঠান্তর
ওরা জনগণ সাধারণ প্রজা
নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর কুশীলব
ভগবান দেখেনি ওরা –
জনক রাজারা মাটি খুঁড়ে পায় সীতা।
আজ বহু অনুবাদ যুগ পার হয়ে
সীতার বুক চিড়ে জন্ম দিলেন এ কোন সন্তান!
ক্ষয়ে গেল কত শিলা নারায়ণ হোতে গিয়ে।
উপসংহার একইরকম তবু
অন্তমিলের মতোই –
ভগবান দেখেনি ওদের...
▀ পসারিণি
আমার ছাত্রী পসার সাজিয়ে বসে
জ্যোত্স্না পথে
পড়াশোনায় মন ছিল না তার;
ভাগ্যবশে মহল গড়েছে নতুন
যেখানে চির বাসন্তী ফুল ফোঁটে
সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে রূপের ঢেউ তুলে
এগিয়ে যায় নবীন পসারিণি...
এখন তার হাজার অনুরাগী
টপ্পার সুরে মুখোরিত গলিমুখ
সে এক অন্য পাঠশালা; অনেক ছাত্র আসে
জ্যোত্স্না পথে
ভালোবাসার ঘর ভেঙেছে যার...
▀ পুতুলের ঘরবাড়ি
আমাদের সব পুতুলবেলার খেলা
শেষ হয়ে যায় অনেক আগের দিনে
তখন বাতাসে না বুঝে খেলেছি যাকে
ভালো হয় যদি তাকেই না বুঝে নিই চিনে
#
আমাদের সব পৃথিবীর গ্রামে গ্রামে
পুতুলের বড়ো প্রয়োজন বোধ করি
তখন যদি বা বুঝতাম এতকিছু
দু-হাতে নিতাম তুলে পুতুলের ঘরবাড়ি...
▀ শুধু আগুন জ্বালাতে চাই না
টুকরো সময়গুলো জমিয়ে রাখি যত্নে
যদি একটা পূর্ণতার দিন পাওয়া যায়
#
খুচরো কিছু প্রণয় জমিয়ে রাখি গোপনে
একটা সহজিয়া প্রেম পাওয়ার আশায়
#
শুধু আগুন জ্বালাতে চাই না কখনো
পুড়িয়ে ছাই করার অপরাধ রাখব কোথায়...
1 comments:
bhalo laaglo ...can i join...if ya then how?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন