“মর্ডান-পোস্টমর্ডান এসব ধারনা কবিতা বা গদ্যে বা গদ্যে
কোনও ছাপ ফেলে না আদৌ। কোনও কবি
লিখতে বসে তার সৃষ্টি মর্ডান বা পোস্ট-মর্ডান
অঙ্কে হিসেব না করেই লেখে। কিছু কিছু লোক বা পত্রিকা
তাদের এগজিসটেন্স বোঝানোর
জন্যে এটা প্রচার করে বেড়ায়।”--- বললেন আশির
বিখ্যাত কবি
প্রবালকুমার বসু। অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়।
[ আশির
দশক থেকে লিখে যাচ্ছেন বাংলার বিখ্যাত
কবি
প্রবালকুমার বসু। তিনি আবার বিখ্যাত
সম্পাদক ও প্রকাশক দেবকুমার বসুর আত্মজও বটে।
তরুণ কবিদের কাছে প্রবালকুমার বসুর জনপ্রিয়তাও
তাঁকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দেয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
কবিতা, দীর্ঘকবিতা,
গল্প, কাব্যনাটকের পাশাপাশি তরুণ
কবিদের আগলে রাখতে যাপনচিত্র নামে একটি পত্রিকা
ও প্রকাশনীও করেন। এছাড়াও ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক
ফাউন্ডেশন’--এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা
সদস্য।
একসময় সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদিত বিখ্যাত
কৃত্তিবাস পত্রিকার দুয়েকটি
সংখ্যার সহকারী
সম্পাদনাও করেন বর্ণময় এই মানুষটি। এই সময়
তরুণ কবিদের মাথার ওপর
যে বৃক্ষগুলি ছায়া
দেয়, সেই একটি চিরতরুণ সবুজ বৃক্ষের নাম
প্রবালকুমার বসু। যিনি
মনে করেন ---“হৃদয়, মনন ও মস্তিষ্কের মহাসম্মিলনে তিনটি গ্রন্থি গ্রন্থি
যখন
এক লয়ে বেজে ওঠে ওঠে সেটাই কবিতা”---দীর্ঘ আলাপচারিতায় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর এক
তরুণ কবি স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। ]
এক লয়ে বেজে ওঠে ওঠে সেটাই কবিতা”---দীর্ঘ আলাপচারিতায় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আর এক
তরুণ কবি স্বপ্না বন্দ্যোপাধ্যায়। ]
স্বপ্না- কবিতা লেখার প্রথম ইনস্পিরেশন কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আপনার বাবার
কাছ থেকে নিশ্চয়ই?
প্রবালকুমার বসু- নাহ্ ইনস্পিরেশন
ব্যাপার ভিতর থেকে আসে ওটা ঠিক বাইরের লোক দিতে
পারে না। তাগিদ। ভিতরের উথাল-পাথাল
তাগিদ লেখাটাকে লিখিয়ে নেয়। বাইরের লোক, সে যেই
হোক, হয়তো সাপোর্ট দিতে পারে। বাবা
ছিল সেই সাপোর্ট।
স্বপ্না-দেবকুমার বসু ছিলেন প্রখ্যাত সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁর কবিতার কাগজে
লেখার উৎসাহ দিতেন? ‘সময়ানুগ’-এ নিশ্চয়ই আপনার লেখা কবিতা প্রকাশ হয়েছিল?
প্রবালকুমার বসু-বাবা দুটো কাগজ
করতেন। একটি পাক্ষিক। নাম “দর্শক” অন্যটি মাসিক
“সময়ানুগ”। এই দুটো কাগজের সূত্রেই
আমাদের বাড়িতে আসতেন সুনীল, শক্তি, বিনয়, সুভাষ,
সমরেশ বসু, তারাপদ রায়েরা। শৈশব
থেকেই এদের সঙ্গে মিশেছি। কলেজস্ট্রিটে বাবার যে বইঘর
ছিল সেখানেও ওরা যেতেন।
‘সময়ানুগ’ পত্রিকাতেই আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় ১৯৭৮/৭৯
সালে। আমি শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের ফ্যান ছিলাম তাই ঐকান্তিক ইচ্ছে ছিল যদি আমার একটা কবিতাও
প্রকাশিত
হয় কোনও পত্রিকায় সেখানে যেন শক্তির একটা কবিতা অন্তত থাকে। যেমন ইচ্ছা
তেমন কাজ,
কবিতা তো লিখলাম বাবাকেও দেখালাম; কিন্তু বাবা সে কবিতা প্রকাশই করেন না।
অবশেষে
‘একটি কবিতা’ নামের একটা কবিতা বাবা প্রকাশ করলেন ‘সময়ানুগ’-এ। অবাক হয়ে
দেখলাম সে
সংখ্যায় শক্তির কোনও কবিতাই নেই। খুব হতাশ হলাম। প্রতিবছর জুন মাসে
সারাবাংলা
কবিসম্মেলন হতো। সেবার প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার হলে ‘প্রবাহ’ পত্রিকার হয়ে
সম্মেলনে আমিও ছিলাম। আমার কবিতাও অন্যসব প্রবীণ ও নামী কবির সঙ্গে প্রকাশিত
হয়েছিল।
সুতরাং সেই সম্মেলনে কবিতাও পড়লামেবং উপস্থিত শ্রোতা ও কবিদের প্রভূত
প্রশংসা পেলাম।
কবিতা লিখে এত ভালোবাসা পাওয়া যায় ভেবে অবাক হলাম। এরপর থেকেই
নিয়মিত লেখালিখি
শুরু করলাম।
স্বপ্না- আপনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন জলপাইগুড়ি
থেকেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তাই না?
প্রবালকুমার বসু- হুম ১৯৮০ সালে
জলপাইগুড়িতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছিলাম। জলপাইগুড়ির সুন্দর
পরিবেশ, চা-বাগান,
কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার কবিতাকে আরও প্রাণিত করল। ফলে আশির শেষ দিকে
নিয়মিত কবিতা তো
লিখতামই, সম্পাদনাও শুরু করলাম। পত্রিকার নাম ছিল ‘আলিঙ্গন’, পরে অবশ্য
নাম পাল্টে
হয় ‘সাতকর্ণী’। আজকাল পত্রিকায় ‘সাতকর্ণী’ নিয়ে একবার কিছু লেখাও বেড়িয়েছিল।
স্বপ্না-
কবিতা দিয়ে পাঠকের কাছে পৌছনো কি সহজ? আপনার কী মনে হয়?
প্রবালকুমার বসু- মোটেই সহজ নয়।
দেখো, যেকোনও কবির কবিতাকে পাঠকের কাছে পৌঁছে
দেবার একমাত্র উপায় লেখা দিয়ে তাঁকে
স্পর্শ করা। পাঠকের অন্তরে অনুরণন তৈরি করা।
স্পর্শ
না করলে পাঠক মনে রাখবে কেন
সেই কবিতা?
স্বপ্না- কবিতায় কারুর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি
প্রাথমিকভাবে? মোট ক’টা কবিতার বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে?
প্রবালকুমার বসু- প্রথমেই বলেছি
আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার দারুণ ভক্ত ছিলাম। আর শক্তি
পারিবারিকভাবে খুবই
ঘনিষ্ঠ ছিলেনও বটে। আমার প্রথম কবিতার বই ‘তুমিই প্রথম’ (১৯৮৯)-এর
ম্যানুস্ক্রিপ্ট
শক্তিই দেখে দিয়েছিলেন এবং বলতে বাঁধা নেই অনেক শব্দ বা পঙ্ক্তি মানানসই করেও
দিয়েছিলেন। বইটি গৌরী ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিল। পুরস্কারমূল্য ছিল ৫০০০
টাকা। এরপরই
শক্তি থেকে সচেতনভাবে বেড়িয়ে এসে নিজস্ব ভাষা খোঁজার চেষ্টা শুরু করি।
আমার আরও কবিতার বই
হল ‘ব্যক্তিগত স্মৃতিস্তম্ভের পাশে’ (১৯৮৭), ‘জন্মবীজ’ (১৯৯৩), ‘যাপনচিত্র’
(১৯৯৮), ‘যেমন করে গাইছে
আকাশ’ (২০০২), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০০৭), ‘অধর্ম কথা’
(২০০৯) ইত্যাদি।
স্বপ্না-এখন যে নতুনভাষা বা ভাবনা
আসছে তা জরুরী। বাংলা সাহিত্যে নতুন জোয়ারের মতো। আস্তে
আস্তে বাংলা কবিতা
আন্তর্জাতিকতার। ট্রিপিক্যাল ন্যাকা ন্যাকা মধ্যবিত্ত ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসছে
একটা
আশাপ্রদ। নতুন প্রজন্মরা বলিষ্ঠ লেখক এদের ভাবনা চিন্তা বেশ প্রগাঢ়। এরা
প্রত্যেকেই নিজস্ব
জায়গা থেকে লিখে নিজের শৈলী তৈরি করেছে।
স্বপ্ন- যুগবিভাগ কি বাংলা কবিতার বাঁক বদল করেছে?
প্রবালকুমার বসু- উহু
মর্ডান-পোস্টমর্ডান এসব ধারনা কবিতা বা গদ্যে বা গদ্যে কোনও ছাপ ফেলে না
আদৌ। কোনও
কবি লিখতে বসে তার সৃষ্টি মর্ডান বা পোস্ট-মর্ডান অঙ্কে হিসেব না করেই লেখে। কিছু
কিছু লোক বা পত্রিকা তাদের এগজিসটেন্স বোঝানোর জন্যে এটা প্রচার করে বেড়ায়। ‘কবিতা
ক্যাম্পাস’
একসময় ‘ভাষাবদলের কবিতা’ নাম দিয়ে এমনই কিছু একটা করার চেষ্টা করেছিল।
ওরা যে ধরণের
ভাষা ব্যবহার করা শুরু করল।
তা চলল না বলাবাহুল্য। ওই নবনির্মিত ভাষার সঙ্গেও কয়দার সঙ্গে
বাংলাভাষার
ঐতিহ্যের যোগসূত্র ছিল না, তাই তা পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হল না। কিন্তু এঁদের
অনেকেই খুব শক্তিমান কবি ছিলেন। শুধু ছবি তৈরিই না, চিত্রকল্পের ঝলকানি দিয়ে নয়,
কোনও শব্দে
কোনও চিন্তায় পাঠককে একবার ছুঁয়ে দিতে হবে ব্যাস্ ; ওটাই মির্যাকল,
ওটাই কবিতা। আইওয়া থেকে
ফিরে সুনীল যা লিখতে শুরু করলেন পাঠক তা সাগ্রহে মেনে নিল।
স্বপ্না-কবিতাকে কেউ কেউ আবেগ ও বুদ্ধির স্ফূরণ মনে
করে কবি হিশেবে আপনার মতামত কী?
নেই। আবেগ কবিতাকে নষ্ট
করে সুচারু শিল্পে
পরিণত হতে দেয় না। হৃদয়, মনন ও মস্তষ্কের
মহাসম্মেলনে তিনটি
গ্রন্থি যখন যখন এক লয়ে বেজে
ওঠে সেটাই হয়ে ওঠে কবিতা।
স্বপ্না- তবে কি বুদ্ধিজীবী এই কাগুজে শব্দটা এখন
কবি-সাহিত্যিকদের উপমা হয়ে গেছে?
প্রবালকুমার বসু- বুদ্ধিজীবী
অর্থাৎ বুদ্ধি লাগিয়ে জীবিকা। তুমি কী বলতে চাইছ বুঝেছি। কবি-সাহিত্যিক-
শিল্পী
মানেই যে বুদ্ধিজীবী তা নয়। বরং এঁদেরকে এঁদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করাটাও
আমাদের
সমাজের সমস্যা। আমাদের পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে তবু এখনও বাংলা সাহিত্য পড়ে
বাংলার
ছাত্রছাত্রীরা কবিতা লেখে। সেটার জায়গাটা এখনও সংকীর্ণ হয়ে আছে। বাংলা
কবিতা লিখতে গেলেও
আন্তর্জাতিকমানের লেখা পড়া উচিৎ।
স্বপ্না- বিষাদ থেকে, অপূর্ণতা থেকে, না পাওয়ার
জানালা থেকেই কি কবিতারা উঠে আসে?
প্রবালকুমার বসু- আমার লেখার মূল
জায়গা হল ‘সম্পর্ক’। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা থেকে উঠে
আসে বিষাদবিষ অথবা
আনন্দধারা। ধরো, এই সম্পর্ক আমার সঙ্গে বর্হিজগতের, বা আমার সঙ্গে
সমাজের, বা
আমার সঙ্গে আমার বা অন্তরজগতের।
স্বপ্না-
নিজের লেখা এমন কোনও কবিতার কথা মনে পড়ছে কি যেটা বিশেষভাবে আপনার কাছে
উল্লেখযোগ্য?
প্রবালকুমার বসু- হ্যাঁ, ‘দক্ষিণ
আফ্রিকা’ নামের একটা কবিতা লিখেছিলাম
নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে। ১৯৮৯ সালে। দেশ
পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ম্যান্ডেলা এদেশে আসলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে ওই
কবিতাটা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ইংরেজিতে অনুবাদ করে।
স্বপ্না- এখন তো খাতার পাতায় লেখার লোক কমে গেছে।
বেশিরভাগ লেখকরা কম্পিউটার মাধ্যমে লেখেন এমনকি প্রিন্টেড ম্যাগের পাশাপাশি ওয়েব
ম্যাগাজিন এসে গেছে এবং জনপ্রিয়ও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?
প্রবালকুমার বসু- ছাপা বইয়ের জন্য
উৎকণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।
এখনও বিদেশে নতুন বই বেরোলে ১০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়।
ওখানে তো
আরও অনেক আগেই কম্পিউটার এসেছিল। টিভি বাড়িতে
আসার পরেও কি নাটক বা
সিনেমার কদর কমে গেছে?
স্বপ্না-আমি একবার সুনীল’দার (গঙ্গোপাধ্যায়)
সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এমনই একটা প্রশ্ন করেছিলাম। সুনীল’দার উত্তর ছিল উনি চান
ছাপা পত্রিকা বন্ধ হোক, কারণ তাতে নাকি গাছেরা বাঁচবে।
প্রবালকুমার বসু- সুনীল’দা জানতেন
না এখন আর গাছ থেকে কাগজ তৈরি হয় না, কৃত্রিম উপায়ে কাগজ
তৈরি করার উপায় বহুদিন হল
আবিষ্কৃত হয়েছে।
স্বপ্না-
কৃত্তিবাসের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা যদি বলেন...
প্রবালকুমার বসু- সুনীল’দাকে
পারিবারিক সম্পর্কের থেকে যে আগে থেকেই চিনতাম তা তো বলেইছি।
কৃত্তিবাসের নবপর্যায়
শুরু হয় ৯৮ সাল থেকে। ২০০০ সাল থেকে সুনীলদার সঙ্গে নিয়মিত আদানপ্রদান
হত। ওই সময়
থেকেই আমি কৃত্তিবাসের ঘরের লোক হয়ে উঠি। একবার কৃত্তিবাসের গল্পসংখ্যার
সম্পাদনার
ভার সুনীল’দা আমাকে দিয়েছিলেন আর একবার শিল্পীদের লেখালেখি নিয়ে কৃত্তিবাসের একটা
সংখ্যা হয়েছিল তার সম্পাদনা আমি ও সুনীল’দা যুগ্মভাবে করেছিলাম এবং সম্পাদকীয়
লিখেছিলাম।
স্বপ্না- শুধু কবিতা নয় আপনি তো গল্পও লেখেন। আপনার
দুটি গল্পের বইও আছে তাই না?
প্রবালকুমার বসু- আসলে অনেক সময়
মনে হয় যা বলতে
চাইছি সেটা হয়তো অন্যভাবেও বলা যেতে পারে সেখান
থকেই গল্প লেখার
প্রয়াস। তবে আমি কখনই গতানুগতিক
গল্প লিখতে চাইনি একটু নিরীক্ষামূলক বিশেষতঃ
অ্যাবস্টার্ড গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। আর খুব অদ্ভুত
ব্যাপার, কবিতার বইয়ের প্রকাশক পেতে অনেক চেষ্টা
করতে হয় কিন্তু গল্পের বইয়ের প্রকাশক সহজেই পেয়ে
গেছি।
আমার গল্পগ্রন্থদুটির নাম—‘আমার গল্প আমার সময়’ (পুনশ্চ-২০০৮) এবং ‘গল্পই গল্প’
(কারিগর-২০১১)।
স্বপ্ন- আর কাব্যনাটক? সেও তো প্রচুর লিখেছেন...
প্রবালকুমার বসু- তুমি জানো?
বাহ... আমার কাব্যনাট্য চর্চার একটা জায়গা ছিল। বাংলায় প্রবল কাব্যনাট্য
প্রযোজনা
হয় ১৯৫৭-৫৮ সালে আমার বাবা দেবকুমার বসুর প্রযোজনায়। বাবাই প্রথম বাঙলায়
কাব্যনাট্য প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। নাটকটির নাম ছিল ‘নীলকণ্ঠ’। নাটকের লেখক রাম
বসু।
পরবর্তীতে ‘গন্দর্ভ’ নামে একটি নাট্য পত্রিকার কাব্যনাটকের উপর একটি সংখ্যা
আমার হাতে আসে।
আমি টি.এস. এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দ্যা ক্যাথিড্রাল’ ও ‘ফ্যামিলি
রিইউনিয়ন’ এই কাব্যনাটকদুটি পড়ে
ফেলি। এরপর সেসময় বাঙলায় যত কাব্যনাটক লেখা হয়েছিল
সেগুলো পড়তে শুরু করি তারপর
আধুনিক সাংস্কৃতিক পরিষদ নামে আমাদের যে সাংস্কৃতিক
গোষ্ঠী ছিল সেখান থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের
‘একা গেল’ কাব্যনাটকটি প্রযোজনা করি।
আমরা গিরিশংকরের একটি কাব্যনাটক প্রযোজনা করেছিলাম।
এরপরে এগুলোই আমাকে কাব্যনাটক
লেখার প্ররোচনা যোগায়। আমার কাব্যনাট্যসংগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে
এই বইমেলায়, যার
ভূমিকা লিখছেন শ্রদ্ধেয় আনিসুর জামান। আমার বেশিরভাগ কাব্যনাটকই ‘বহুরুপী’
ও
‘স্যাস’ নাট্যপত্রে প্রকাশিত।
স্বপ্না-
আপনি এইসময়ের অন্যতম একজন কবি যিনি প্রচুর দীর্ঘকবিতা লিখেছেন। আপনার দীর্ঘকবিতার
বই ‘জন্মবীজ’ বাংলাসাহিত্যে অন্যতম দীর্ঘকবিতার কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘকবিতা সম্পর্কে
আপনার কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই।
প্রবালকুমার বসু- ‘জন্মবীজ’
লিখেছিলাম যখন আমার ২৭-২৮ বছর
বয়স। সে বয়সে যা হয়... ইচ্ছে ছিল মহাকাব্য লিখব,
সেটা হয়ে উঠল
‘জন্মবীজ’। এই বইটি নিয়ে ক্রমাগত তরুণ কবিদের আগ্রহ এতদিন
অরেও আমাকে
বিস্মিত করে। ‘জন্মবীজ’-এর তৃতীয় সংস্করণ পর্যন্ত
প্রকাশিত হয়েছে। যদি জিজ্ঞেস করো,কেন দীর্ঘকবিতা লিখেছিলাম, তবে
বলি, ১৯৭৮ সালে দেবকুমার বসুর সম্পাদনায় প্রথম
দীর্ঘকবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাভাষার নাম করা
কবিদের সঙ্গে নিজের লেখা
জায়গা পাবার আকাঙ্ক্ষায় আমি প্রথম দীর্ঘকবিতা লিখি এবং পিতৃদেব
পুত্রস্নেহবশত সেটি
প্রকাশও করেন। অন্তত এরকমই আমার ধারণা। কিন্তু ওই সংকলনে আমার কবিতা
প্রকাশই আমাকে
উজ্জীবিত করে আরও দীর্ঘকবিতা লিখতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে
ফিরে
আসার পর শক্তি আমাকে বলেন আমার উত্তরবঙ্গে চার বছর থাকার অভিজ্ঞতা আমি যেন এক
দীর্ঘকবিতায় ধরে রাখি। লিখেছিলাম। ১৯৮৪ সালে ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিতও
হয়েছিল। কবিতাটি
অনেকদিন পরে ‘কোথা থেকে শুরু করবো’ বইতে স্থান পেয়েছে।
স্বপ্না- স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরের ইংরেজি কবিতার
তর্জমা সম্পাদনা করেছেন আপনি। বইটার নাম ‘সাইন পোস্ট’। অবাঙালি ও প্রবাসী বাঙালি
(যারা বাংলা পড়তে পারেন না) পাঠকের কাছে এই বইটি পরম আদৃত। এই বইটি সম্পাদনার
ব্যাপারে কিছু বলুন?
প্রবালকুমার বসু- অফিসের কাজে
ভারতের নানান জায়গায় আমাকে যেতে হয়। দেখেছি, অনেক প্রবাসী
বা অবাঙালি আছেন যারা
বাংলা পড়তে না পারলেও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে খুব আগ্রহী। এদের কথা
ভেবেই এই কাজটা
করার কথা মাথায় আসে। আমাকে সর্বতভাবে সাহায্য করলেন বর্ণালী রায়। দিল্লীর
রূপা প্রকাশনীর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন নির্মলকান্তি ভট্টাচার্য। সুনীল’দার উপস্থিতিতে
গুলজার
দিল্লীতে এই বইয়ের উদ্বোধন করতে এসে বলেছিলেন, “যে আমরা বাংলা কবিতাকে আগে
চিনতাম
গীতাঞ্জলী দিয়ে, এখন চিনব এই বই দিয়ে।”
স্বপ্না- কলকাতা আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম
প্রতিষ্ঠাতা আপনি। এই প্রথম সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র-নাটক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের
বিভিন্ন মানুষের সমস্ত লোকেরা একত্রিত হয়ে কিছু চেষ্টা করেছিল...
প্রবালকুমার বসু- শোনো, আমার
বরাবরই ইচ্ছে ছিল কবিতা নিয়ে
একটা একাডেমি তৈরি করা যেখানে আর্কাইভ থাকবে,
লাইব্রেরি
থাকবে, সমস্ত কবিতার বইয়ের প্রথম সংস্করণ রক্ষিত হবে, কবিতা
পড়ার জায়গা
থাকবে। এইরকম একটা ভাবনা ভিতরে ভিতরে যখন
কাজ করছিল শিল্পী যোগেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হল। জানতে
পারলাম তিনিও শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে এরকম কিছু একটা ভাবছিলেন।
এরপর দীর্ঘদিন আমাদের মতো বিনিময় চলতে থাকে এবং আমি,
যোগেন চৌধুরী ও বর্ণালী রায়
এই তিনজন প্রায়
একবছরের উপর মতামত আদানপ্রদানের পর এটাকে একটা রূপ দিই তারপর
সূনীল’দা, শঙ্খ ঘোষ,
গণেশ হালুই, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি বিদগ্ধজনদের
আমন্ত্রণ করি। এই প্রয়াস থেকেই ‘কলকাতা
ফাউন্ডেশন’-এর জন্ম। আমাদের কেন্দ্রীয়
সরকার এই সংস্থা নির্মাণের জন্যে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন
এবং আমরা এই কেন্দ্র
নির্মাণের জন্য যাযা করণীয় তা করেছি।
স্বপ্না- শেষ প্রশ্ন, আপনার অণুপ্রেরণায় ‘যাপনচিত্র’
তরুণদের কবিতার বই প্রকাশ করার অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে যেখানে অন্যান্য প্রকাশনী নতুন
কবিদের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে বই প্রকাশ করছে সেখানে ‘যাপনচিত্র’ তরুণ কবিদের
প্রথম বইটি নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করবে---এমন সিদ্ধান্ত, এমন ভাবনা কেন এলো?
প্রবালকুমার বসু- নিজে কবিতা লেখার
সুবাদে একজন তরুণ কবিকে তার বই প্রকাশের জন্য কী
সমস্যার সন্মুখীন হতে হয়, তা আমি
বুঝি। বহু প্রকাশক নানা প্রলোভন দেখিয়ে বহু অর্থ আত্মসাৎ করে
বই প্রকাশের যে প্রথা
তৈরি করেছেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এ সিদ্ধান্ত। কোনও তরুণ কবি
ভালো লিখলে
তার প্রথম কবিতার বই প্রকাশের জন্য তাকে আর ভাবতে হবে না, সে দায়িত্ব ‘যাপনচিত্র’
নেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন