বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

স্মরণে - রাজীব চৌধুরী

সুচিত্রা সেন স্মরণে
রাজীব চৌধুরী




উত্তমের বাইক-পেছনে সুচিত্রা

সাড়াশব্দহীন লীলাচলে শুভ্র আলোক রশ্মি। সেই আলোকরশ্মিতেই যেন আরো আলোকিত একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে একটা বাইক নিয়ে। খানিক পর পর হাত ঘড়ি দেখছে। অথচ তার হাত খালি। সেখানে কোন ঘড়ি নেই। পরনে তার একটি ফতুয়া। ফতুয়াতে তাকে বেশ মানায়। খুব ভালোলাগে বলেই তাকে খুব প্রিয় একজন দিয়েছিল পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠনে।

বাইকে স্টার্ট দিয়েছে সে।বাইকের উপর বসল সে। ছোট্ট একটি বাইক। পুরাতন ফ্যাশনের। তাতেই তার ভালোবাসা। বহুদিন ধরে সে বসে আছে তো আছেই। এই অপেক্ষার শেষ হতে চলেছে অবশেষে। ভুটভাট শব্দে তার বাইক ও বোধহয় আনন্দে আত্মহারা।

ঈশান কোণে তাকাচ্ছে সে। সেখানে ধীরে ধীরে আলোক রেখা প্রতিভু হচ্ছে। সে জানে তার বহুদিনের আক্ষেপের অবসান হতে চলেছে অবশেষে। এই দিনটির জন্য সে অপেক্ষায় ছিল বহুদিন। সময়ের হিসাবে তা ও প্রায় তেত্রিশ বছর। শুধু একটি দিনের জন্যেই তার অপেক্ষাই ছিল-যা পূরণ হবে আজ।

দূর থেকে আলোর রেখাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। যুবক জানে কে আসছে। তবুও সে অপেক্ষা করতে পারছেনা আর।বার বার অদৃশ্য হাত ঘড়ি দেখছে। এই মুহুর্তের জন্য তার বহু বছরের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে শেষ পর্যন্ত। দূর থেকেই মেয়েটির অবয়ব দেখা যাচ্ছে। কালো পেড়ে একটি শাড়ি পড়েছে। মলিন কিন্তু সুশ্রী। কপালে সেই লাল টিপ। ধোঁয়াশার মাঝে যেন গনগনে সুর্য। ঠোঁটে সেই স্ফিত হাসি। শুধু বয়েসটা একটু বেড়েই গেছে হয়ত! কাছে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটি। মুখে স্ফীত হাসি। অধর বেয়ে যেন আনন্দ ধারা ছুঁয়ে দিল যুবকটিকেও। যুবক বলে উঠল- - কতকাল ধরে অপেক্ষা করছি আমি। তুমি এতোদিন পরে এলে? - অনেক কষ্ট হয়েছে না তোমার?- কেঁপে উঠল তার উচ্ছ্বল ভ্রুজোড়া। - তা একটু তোমার জন্যেই না হয়! - কি করি বলো? ওরা আমাকে ছাড়তেই চাইছিলোনা। আর আমি তো তোমার মত সিগারেট খাইনি আজীবন। - আমি কি সিগারেটেই শেষ হয়েছিলাম? হয়েছিল তো টিউবার কিউলোসিস! - আমি জানি সব। রাতভর মদ খেয়ে খেয়ে শেষ করেছ নিজেকে। আমি কি আর তোমার মত...! - আচ্ছা এবার আসো তো? - আমায় কোথায় নিয়ে যাবে তুমি? - আমি? সেই কবে থেকে বসে আছি। কথা ছিল হারিয়ে যাব... - কিন্তু সেই সীমানা কি তোমার অজানা? - আমি জানি- শুধু তেত্রিশ বছর ধরে এই পথে অপেক্ষা শুধু তোমার জন্য রমা। - আহ- কতদিন পরে এইনামে ডাকলে! - কেন? তুমি ও তো আমাকে উত্তম বলে ডাকতে। আমি কি তোমাকে রমা নামে ডাকিনি? - হ্যাঁ ডেকেছিলে বটে। সে অনেক দিন। তেত্রিশ বছর কম সময় তো নয়! - এসো পেছনে বসো। - পড়ে যাবো নাতো? - আরেহ না- তুমি কি বুড়িয়ে গেছ সুচি? - তাতো বেঁচে থাকলে বুড়োতেই হয়। - আমি তো এখনো যৌবনে আছি প্রিয়া্‌ - মরণ হলে বয়স থেমে যাবে এটাই তো সত্য উত্তম। কিন্তু আমি সেই যৌবনে নেই। শেষ কালে খুব বুকে ব্যাথা ছিল। অনেক শ্বাস কষ্ট হত! - এখনো কি? - নাহ- এখন আর হচ্ছেনা। কে যেন বলেছিল মরে গেলে যৌবন ফিরে আসে! - ধুর সে কথা ছাড়ো। শরীর না থাকলে যৌবন কি করি বলো? - একটু সামনে যাবে? - এসো - তুমি এখনো সেই আগের মতোই আছো উত্তম। সেই হাসি। সেই ঠোঁট- সেই চোখের মায়া। - শুধু তুমি ই দিদিমা হয়ে গেছ। তোমার নাতনিদের রুপ তোমার চাইতে কম নয় গো। - আমি যদি সেই আগের রুপে ফিরে আসতাম! - দুঃখ কোরোনা।যেখানে চলেছি সেখানে রুপ ফিরে পাওয়া যাবে বলেই শুনেছি। - কে বল্লো তোমায়? - কেউ না, শুধু শুনেছি। মায়া সরোবরে স্নাত হয়ে যাব দুজনে। - তুমি কি আমার জন্যেই সেখানে যাওনি উত্তম? - হ্যাঁ সুচি। অনেক দিন ধরে আমি এই দোলাচলে অপেক্ষমান। - আমি কি সেই আগের মতো তোমার ভালোবাসা পাব উত্তম? - ভালোবেসেই তো অপেক্ষা করে আছি সুচি। তোমার জন্য আর কেউ তো নেই। সবাই মায়া সরোবরে স্নান করে ফিরেছে নিজ দেহে। শুধু আমিই - চলো তবে? - এসো... - তোমায় কি সেই আগের মত জাপটে ধরার শক্তি আছে উত্তম? - বললাম তো তুমি বুড়িয়ে গেছ। কতদিন আড়ালে আছ তুমি। আমি কি তোমায় এতোই কষ্ট দিয়েছিলাম? - কি জানি। শুধু তুমিহীন আমাকে আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনি জানো? - জানি। জানি বলেই তো অপেক্ষা আমাকে করতে হয়েছে হে। - চলো তবে আর অপেক্ষা কেন? - চলো... - আচ্ছা এই পথ যদি শেষ হয়ে যায়? - শেষ তো হবেই। - তবু যদি সেদিনের মত পথটা শেষ না হতো? - চাও কি তবে শেষ না হয়? - চাই উত্তম। কতদিন একসাথে পথ চলিনা উত্তম। চলো- যাই

উত্তম বাইক টানতে শুরু করেছে। আলোকের হাওয়া এসে উড়িয়ে দিতে শুরু করেছে সুচিত্রার বার্ধক্য। ধীরে ধীরে পাকা চুলগুলো কালচে হতে শুরু করেছে। গলার কাছটায় ভাঁজ গুলো মেলে ধরতে শুরু করেছে নিজেদের। ঠোটদুটো নিটোল হতে শুরু করেছে সুচিত্রার। উত্তম জানতো এমনটাই হবে। শুধু আলোকের পথেই এমনটি হয়।উত্তম কুমার সুচিত্রাসেনকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে আলোর পথে। শুধু সুচিত্রা চাইছে এই পথ চলা যেন কোনদিন শেষ না হয়। অশেষ সীমানা পর্যন্ত এই ভালোবাসার বাইক যেন চলতেই থাকে...