বেওয়ারিশ
অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়
ঠিক এই সময়টাতে ষ্টেডিয়ামের বড় গেটের লাগোয়া এই দোকানটায় ঝাঁপ ওঠে । খুট করে বাল্ব জ্বলে উঠলেই সদ্য জেগে ওঠা বয়ামগুলোর ছায়া পড়ে সামনের বেঞ্চিতে। থপথপে উনুনটা প্রাতঃরাশ সেরে নেয় গোটা কয় ঘুঁটে আর কয়লার টুকরো পেটে গুঁজে । তারপর থ্যাবড়া মত মুখে আয়েস করে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়ার টান ছড়িয়ে দেয় গুড়ি গুড়ি কুয়াশায়। বুড়ির পাকা চুলের মত সে ধোঁয়া উড়তে উড়তেও আঠার মত লেগে থাকে উনুনের ঠোঁটে। তবে একঘেয়ে এই কাজ গুলো করতে, বেশ মজাই পায় রমাপদ। সবচেয়ে মজা পায়, টিনের ঝাঁপের কপালে বড় বড় করে লেখা অক্ষরগুলোর ওপরে নোংরা গামছাটা বুলিয়ে দিতে দিতে জমে থাকা সারারাতের কুয়াশার স্যাঁতস্যাঁতপনাকে আলতো করে মুছতে। মুছতে মুছতেই জ্বলজ্বল করে জেগে ওঠে সাদা রঙে লেখা 'রমাপদর চায়ের দোকান'। লেখাটা দেখে তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মাঝবয়েসি মানুষটার মুখ।
আর ঠিক এই সময়েই মৈত্র সাহেব দোকানে এসে দাঁড়ান। ফর্সা টুকটুকে লাল চুলো বিদিশি সাহেব নয় মোটেই। ষাট পেরোনো থলথলে চেহারার মানুষটা। রমাপদ দেখেছে 'সাহেব' বললে খুশি হয়ে যান মানুষটা। উনি এলেই রমাপদ একগাল হেসে 'গুড মর্ণিং সাহেব' বলে, আর তারপর ঝটপট করে প্লাষ্টিকের ব্যাগে ভরে দেয় গাদা গাদা বিস্কুট। ব্রিটানিয়া থেকে লেড়ো, ক্রিম- ক্র্যাকার থেকে নারকেল-গন্ধ কিছুই বাদ যায় না। প্লাষ্টিকটা হাতে নিয়ে সাহেবের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ছলকে পড়ে গাল জুড়ে। রমাপদর ফতুয়ার পকেটও সকাল সকাল উষ্ণ হয়ে ওঠে। গেট দিয়ে ষ্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েন মৈত্র সাহেব ওরফে দেবদুলাল মৈত্র।
এসময়ে প্রায় কেউ থাকে না ষ্টেডিয়ামে। সারারাত্তিরের পাহারাদারির পরে গেটের মুখে খাঁকি পোশাকগুলো এলিয়ে থাকে চেয়ারেই। পাশে হেলানো লাঠিগুলোকে ভেংচি কেটে কুকুরগুলো দৌড়ে বেড়ায়। পূর্তভবনের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবদুলাল মৈত্র হাঁটতে থাকেন একা একাই। আধো অন্ধকারে।
ঠিক এই সময়টা 'ওদের' কাছেও পরিচিত। ঘড়ি ছাড়াই 'ওরা' টের পেয়ে যায় মৈত্রসাহেবের পায়ের শব্দ। চারপায়ের হাড্ডিতে খর্ খর্ শব্দ তুলে ধুলো উড়িয়ে দৌড়িয়ে আসে ওরা। ভোউউউউ। ওদের আদুরে ডাকে আধো-অন্ধকার প্রাক-ভোরের নৈশব্দ্য আকৃতিহীন ভাবে ছিঁড়ে যায় টুকরো টুকরো হয়ে।
দেবদুলাল মৈত্র এগোতে থাকেন দুলকি চালে। পেছনে এগোতে থাকে বেওয়ারিশ কুকুরদের মিছিল। প্লাষ্টিকের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্কুট বের করতে করতে মুখ দিয়ে শব্দ ছুঁড়ে দেন মৈত্রসাহেব... আয় আয়। হাত থেকে গোটাকয় বিস্কুট ছড়িয়ে দেন আকাশে। পেছনের দু পায়ে ভরদিয়ে শরীরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বাতাসের সাথে কুস্তি লড়ে বেওয়ারিশের দল। দাঁতে আটকে থেকে লালাসিক্ত বিস্কুটের টুকরোগুলো,বেঁচে থাকে ওদের যোগ্যতম হয়ে ওঠার দলিল!মৈত্র সাহেব এগোতে থাকেন হরির লুটের মত বিস্কুট ছড়িয়ে,সারাটা পথে।
আর ঠিক এই সময়েই আজ একটি গাড়ি ঢোকে ষ্টেডিয়ামের গেট দিয়ে। ঢিলেঢালা সুরক্ষার সুরঙ্গকে পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকে ষ্টেডিয়ামের পরিধিঘেরা বৃত্তাকার পথে, যে পথে খানিক আগেই এগিয়ে গিয়েছেন দেবদুলাল মৈত্র। এ গাড়িতে দেখা যায় পুরু ঠোঁটের একটি লোক লাল চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। পাশের লোকটির মুখ গায়ের চাদরে ঢাকা। চাদর খানিক সরলেই দেখা যায় পরিমলকে । মৈত্রসাহেবের একমাত্র ‘বাড়ির লোক’! নিঃসন্তান দেবদুলাল মৈত্র মাঝবয়েসেই স্ত্রীকে ক্যানসারে হারিয়ে যখন বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন,পরিমলের তখন কতই বা বয়েস? দশ কি বারো হবে। বাপ মা মরা ছেলেটা বাংলাদেশ থেকে তারকাঁটা পেরিয়ে চলে এসেছিল মামার হাত ধরে। মামাবাড়িতে অবশ্য আর ঠাঁই হয়নি। অফিসের সামনে চায়ের দোকানে ছেলেটার মায়াভরা মুখ দেখে মনে ধরেছিল মৈত্রসাহেবের। ছেলেটা আশ্রয় পেয়েছিল বিরাট বড় বাড়িটার ফাঁকা একটা ঘরে। মৈত্রসাহেব স্কুলে ভর্তি করে দিলেও মন ছিল না বেশিদিন পড়ার। তবুও শেষ অব্দি পরিমল হয়ে উঠল মৈত্রসাহেবের খাস লোক। গাড়ি পোঁছা থেকে বাজার করা, পোষ্ট অফিস থেকে ইলেক্ট্রিক বিল, পরিমলই যেন একমাত্র উত্তর। সবকিছু করলেও হিসেবে বড্ড কাঁচা ছেলেটা। মৈত্রসাহেবের বেজায় বিরক্তি তাই। বার বারই বলে, ‘ওরে হিসেব না শিখলে হয়? তেমন লোক হলে নাকানিচোবানি খাওয়াবে’। পরিমল শুনলে তো!
কিন্তু তাও,দিনগুলোতে সোজাসাপটার গন্ধটা তখনও লেগেই ছিল। কিন্তু মানুষ তো, স্বাভাবিক ছকগুলোকে হাতের কাছে পেয়ে গেলে উল্টে পাল্টে দেখতে চায় স্বভাববশেই!বেওয়ারিশ পরিমলের মনে স্বার্থের লোভ উথলে উঠল একসময়। দেবদুলাল মৈত্রের এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা এসব খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিল অল্পপড়ুয়া পরিমল। মৈত্রসাহেবের কৈফিয়ত নেবার কস্মিনকালেও কেউ নেই, কাছের মানুষেরা হয় পরপারে নয় দেশান্তরী। কাজেই ভিটেতে ঘুঘু না চরিয়ে প্রোমোটারের হাতে ধরিয়ে দেওয়াই পরিমলের কাছে অনেক বুদ্ধিমত্তা মনে হয়েছিল। অবশ্য পরিমল কি একাবুদ্ধির মানুষ? ওই যে ঠাকুরনগরের জেলে পাড়ার মেয়েটা? দোলন! ওর বুদ্ধি না হলে পরিমল এসব ভাবতে পারত? প্রেমে পড়লে মানুষ শুধু অন্ধ নয়,স্মৃতিহীনও হয়ে যায় পরিমলকে না দেখলে কে বলত! দেবদুলাল মৈত্রের সাথে কাটানো সময়গুলো ভুলে দোলনের ঠ্যাঙারে দাদা ছোটকুর হাতে নিজের লোভকে সঁপে দিল অচিরেই। প্রোমোটারের পোষা গুন্ডা এই ছোটকু। দলিল টলিল জাল করা যার জলভাত। আজ এই কাক-ভোরে ওদের দুজনকেই দেখা যাচ্ছে গাড়ির জানলার কাঁচ পেরিয়ে গাড়ির ভেতরে। পরিমল চাদরের ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো দিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে সন্ধানী দৃষ্টি। আর ছোটকু পরিমলের পাশে বসে লাল লাল চোখ দিয়ে রিভলবারটা বের করে মন দিয়ে দেখছে! মৈত্রসাহেবের জীবনটার জন্য এই ছোট্ট মেশিনটা যেন শিল্পীর তুলি। একটা সূক্ষ্ম আঁচড়েই ছবির মানে পাল্টে দিতে পারে অবলীলায়!
দেবদুলাল মৈত্র হাঁটতে হাঁটতে তৃপ্তিতে ভরে উঠছেন। রোজই ওঠেন আজকের মতোই। মনে মনে মাঝে মাঝে বলেন,পরিমলটা কি বোকা,সোজা হিসেবটাও বোঝে না! বলে, ‘সাতসকালে উঠে কুকুরগুলোকে খাইয়ে কি পুণ্য হচ্ছে তোমার? তাও যদি ভালো একটা পুষতে ঘরে, পাহারা দিত! তা না,যত সব বেওয়ারিশের জাত। বিস্কুট দিচ্ছ বলে তোমার পেছনে লেজ নাড়াচ্ছে। কাল না দিলে কামড়ে দেবে। অন্য কেউ ভালো বিস্কুট দিলে লেজ নাড়িয়ে দৌড়বে’।
কি বোকা পরিমলটা! কুকুরগুলোর মনটা যদি দেখতে পেত ও! এই বিস্কুটগুলো ওদের কাছে শুধু খাবার যে নয় কে বোঝাবে ছেলেটাকে। কি করে বোঝাবে ওদের চোখ দেখলেই বোঝা যায় কতখানি ভরসা আর আদর পেতে দৌড়ে আসে সাতসকালে। পরিমল বুঝলে তো!বড্ড অবুঝ ছেলেটা। মৈত্রসাহেবের ভারি চিন্তা ছেলেটাকে নিয়ে। উনি চলে গেলে ছেলেটার কি হবে? ছেলেটার নামে টাকা পয়সা তো অনেকটাই লিখে রেখে যাবেন,কিন্তু ও কি পারবে এসব সামলাতে? অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে বাড়িটাকে মিশনকে দান করে দেন। পরিমলের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে মিশনকে বলেই। মনে মনে এসব দাবা খেলেই চলেন দেবদুলাল মৈত্র। ওদিকে মৈত্রবাবুর পেছন পেছন ঘুরতে থাকে কুকুরের দল,বিস্কুটের গন্ধে ঠোঁটে নিয়ে।
ঠিক এই সময়টাতেই মৈত্রসাহেবের চোখে পড়ে নিরীহ গাড়িটা এগিয়ে আসছে গড়িয়ে গড়িয়ে। নতুন শিখছে বোধ হয়! ভাবেন মনে মনে। উনি এগোতে থাকেন। গাড়ির সাথে দূরত্ব কমতে থাকে। কমতে কমতে শেষ বিন্দুতে এসে চাপা একটা শব্দ যেন শুনতে পাওয়া যায়, ঠ্যাপ্... ! ঠিক যেন কাগজভর্তি বড় একটা পিচবোর্ডের বাক্স পিচরাস্তায় পড়ল।
কুকুরগুলো থমকে দাঁড়ায় হঠাৎই। কাকেদের দল থমকে যাওয়া অবিরাম কর্কশ গলাসাধায়! দেখতে পাওয়া যায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছেন দেবদুলাল মৈত্র! ছিটকে যাচ্ছে হাতে ধরা বিস্কুটের প্যাকেট, মোটাফ্রেমের চশমা। মানুষটার মুখে যন্ত্রনার বিকৃতি। ওদিকে গাড়ির ভেতর লাল চোখ দুটোতে তৃপ্তির আভাস টগবগ করছে! কিন্তু চাদরঢাকা পরিমলের মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ঘামে ভিজে গেছে। সাইলেন্সর রিভলবারটিকে ব্যাগে ভরে রাখে ছোটকু। ড্রাইভারকে কর্কশ গলায় গাড়ির বেগ তুলতে আদেশ দেয়।
এদিকে থমকে যাওয়া দৃশ্যটির সাথে খানিক ধাতস্থ হয়ে নিতে যেটুকু সময় লাগে সেই মুহুর্তটুকু পেরিয়ে গেলেই দেখা যায় কুকুরগুলো দৌড়তে শুরু করেছে গাড়িটার পেছন পেছন। প্রানপন সে দৌড়। ধরতেই হবে খুনীকে যেন! দাঁতগুলো ঝলসে উঠছে, লাল গড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। ওরা পাগলের মত দৌড়চ্ছে।
‘আরে ছোটকুদা ,কুত্তাগুলো দৌড়ে আসছে তো?’ড্রাইভার বলে উঠল।
‘আবে শালা,কুত্তাকে ভয় পাচ্ছিস? চালা জোরে’ লাল চোখ আরো রাঙিয়ে বলে উঠল ছোটকু।
‘জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে যদি লাফ মেরে?’ ড্রাইভার ছোকরার চোখে মুখে যেন ভয়!
‘আরে বিস্কুট আছে? জানলা দিয়ে ছেটাও’ পরিমল বলে ওঠে।
‘বিস্কুট তো নেই। তবে লাড্ডু আছে। দেব?’ ড্রাইভার ছোকরা বড় প্রশ্ন করে যেন!
‘আরে যা আছে ছেটা। শালা বেওয়ারিশ কুত্তা। খাবার পেলে সব ভুলে যায়’ ছোটকুর মুখে তাচ্ছিল্য।
কুকুরগুলো দৌড়তে দৌড়তে দেখল হলুদ হলুদ টুকরোগুলো উড়ে উড়ে আসছে। মুহুর্তের জন্য যেন থেমে গেল ওরা। চাটল খানিক। জিভে এপাশ ওপাশ লাড্ডুর টুকরোগুলো। লালা-ভরা মিষ্টির স্বাদ। পরিমলের চোখদুটো চকচক করছে উটকো বিপত্তিটাকে এড়িয়ে। মনে মনে বলল, জানতাম এটাই হবে। ছোটকু ড্রাইভারকে বলল, ‘টেনে চালা এবার’।
কিন্তু পরিমল ভুলে যায় হিসেব মেলাতে কোনোদিনই সে পারেনা । পারেনি! তীব্র পাশবিক কোলাহলে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে কুকুরের মিছিল আবার ধেয়ে আসছে গাড়িটার দিকে। আর সে বেগ ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে ছোকরা ড্রাইভার সামনে তাকিয়ে দেখে গেটের সামনে জটলাভরা কালো কালো মাথা। মর্ণিং ওয়াকে ঢুকছে এক দল মানুষ। কি করবে ছোকরা এখন ?
দেখা যায়, গাড়ির পেছনে বেওয়ারিশের দলের মিছিলের দূরত্ব কমে এসেছে আরো। ঘেউ ঘেউ শব্দে আক্রোশ ঝরে পড়ছে। খেয়াল করলে বোঝা যায় তীব্র প্রতিহিংসা উগরে আসছে।
মিছিলটা কি আছড়ে পড়বে গাড়িটার ওপরে?
নাকি সামনের সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবে গাড়িটা? গিজগিজে লাশেদের শরীরগুলো নির্দয়ের মত টপকাতে টপকাতে!কি হবে এবার?
ঠিক সেই মুহুর্তে এসব কিছু হিসেবের থেকে খানিক দূরেই দেখা যায় দেবদুলাল মৈত্রের বেওয়ারিশ শরীরটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। জামার পকেট থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত পিচরাস্তায় গলে গলে পড়ছে।
আর সেখানে গাল পেতে শুয়ে আছে যে কুকুরটি, তার জলজলে চোখের আশপাশের সদ্য ভিজে ওঠা লোমে রক্তের আঁশটে গন্ধ মিশে যাচ্ছে । কি মায়া ওর চোখে!
হয়ত মৈত্রসাহেব বেঁচে থাকলে ভাবত,পরিমলটা কি বোকা,এসব দেখতেই পায় না!
ঠিক এই সময়টাতে ষ্টেডিয়ামের বড় গেটের লাগোয়া এই দোকানটায় ঝাঁপ ওঠে । খুট করে বাল্ব জ্বলে উঠলেই সদ্য জেগে ওঠা বয়ামগুলোর ছায়া পড়ে সামনের বেঞ্চিতে। থপথপে উনুনটা প্রাতঃরাশ সেরে নেয় গোটা কয় ঘুঁটে আর কয়লার টুকরো পেটে গুঁজে । তারপর থ্যাবড়া মত মুখে আয়েস করে আগুন ধরিয়ে ধোঁয়ার টান ছড়িয়ে দেয় গুড়ি গুড়ি কুয়াশায়। বুড়ির পাকা চুলের মত সে ধোঁয়া উড়তে উড়তেও আঠার মত লেগে থাকে উনুনের ঠোঁটে। তবে একঘেয়ে এই কাজ গুলো করতে, বেশ মজাই পায় রমাপদ। সবচেয়ে মজা পায়, টিনের ঝাঁপের কপালে বড় বড় করে লেখা অক্ষরগুলোর ওপরে নোংরা গামছাটা বুলিয়ে দিতে দিতে জমে থাকা সারারাতের কুয়াশার স্যাঁতস্যাঁতপনাকে আলতো করে মুছতে। মুছতে মুছতেই জ্বলজ্বল করে জেগে ওঠে সাদা রঙে লেখা 'রমাপদর চায়ের দোকান'। লেখাটা দেখে তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মাঝবয়েসি মানুষটার মুখ।
আর ঠিক এই সময়েই মৈত্র সাহেব দোকানে এসে দাঁড়ান। ফর্সা টুকটুকে লাল চুলো বিদিশি সাহেব নয় মোটেই। ষাট পেরোনো থলথলে চেহারার মানুষটা। রমাপদ দেখেছে 'সাহেব' বললে খুশি হয়ে যান মানুষটা। উনি এলেই রমাপদ একগাল হেসে 'গুড মর্ণিং সাহেব' বলে, আর তারপর ঝটপট করে প্লাষ্টিকের ব্যাগে ভরে দেয় গাদা গাদা বিস্কুট। ব্রিটানিয়া থেকে লেড়ো, ক্রিম- ক্র্যাকার থেকে নারকেল-গন্ধ কিছুই বাদ যায় না। প্লাষ্টিকটা হাতে নিয়ে সাহেবের মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ছলকে পড়ে গাল জুড়ে। রমাপদর ফতুয়ার পকেটও সকাল সকাল উষ্ণ হয়ে ওঠে। গেট দিয়ে ষ্টেডিয়ামে ঢুকে পড়েন মৈত্র সাহেব ওরফে দেবদুলাল মৈত্র।
এসময়ে প্রায় কেউ থাকে না ষ্টেডিয়ামে। সারারাত্তিরের পাহারাদারির পরে গেটের মুখে খাঁকি পোশাকগুলো এলিয়ে থাকে চেয়ারেই। পাশে হেলানো লাঠিগুলোকে ভেংচি কেটে কুকুরগুলো দৌড়ে বেড়ায়। পূর্তভবনের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক দেবদুলাল মৈত্র হাঁটতে থাকেন একা একাই। আধো অন্ধকারে।
ঠিক এই সময়টা 'ওদের' কাছেও পরিচিত। ঘড়ি ছাড়াই 'ওরা' টের পেয়ে যায় মৈত্রসাহেবের পায়ের শব্দ। চারপায়ের হাড্ডিতে খর্ খর্ শব্দ তুলে ধুলো উড়িয়ে দৌড়িয়ে আসে ওরা। ভোউউউউ। ওদের আদুরে ডাকে আধো-অন্ধকার প্রাক-ভোরের নৈশব্দ্য আকৃতিহীন ভাবে ছিঁড়ে যায় টুকরো টুকরো হয়ে।
দেবদুলাল মৈত্র এগোতে থাকেন দুলকি চালে। পেছনে এগোতে থাকে বেওয়ারিশ কুকুরদের মিছিল। প্লাষ্টিকের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে বিস্কুট বের করতে করতে মুখ দিয়ে শব্দ ছুঁড়ে দেন মৈত্রসাহেব... আয় আয়। হাত থেকে গোটাকয় বিস্কুট ছড়িয়ে দেন আকাশে। পেছনের দু পায়ে ভরদিয়ে শরীরটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বাতাসের সাথে কুস্তি লড়ে বেওয়ারিশের দল। দাঁতে আটকে থেকে লালাসিক্ত বিস্কুটের টুকরোগুলো,বেঁচে থাকে ওদের যোগ্যতম হয়ে ওঠার দলিল!মৈত্র সাহেব এগোতে থাকেন হরির লুটের মত বিস্কুট ছড়িয়ে,সারাটা পথে।
আর ঠিক এই সময়েই আজ একটি গাড়ি ঢোকে ষ্টেডিয়ামের গেট দিয়ে। ঢিলেঢালা সুরক্ষার সুরঙ্গকে পাশ কাটিয়ে এগোতে থাকে ষ্টেডিয়ামের পরিধিঘেরা বৃত্তাকার পথে, যে পথে খানিক আগেই এগিয়ে গিয়েছেন দেবদুলাল মৈত্র। এ গাড়িতে দেখা যায় পুরু ঠোঁটের একটি লোক লাল চোখ ঘুরিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। পাশের লোকটির মুখ গায়ের চাদরে ঢাকা। চাদর খানিক সরলেই দেখা যায় পরিমলকে । মৈত্রসাহেবের একমাত্র ‘বাড়ির লোক’! নিঃসন্তান দেবদুলাল মৈত্র মাঝবয়েসেই স্ত্রীকে ক্যানসারে হারিয়ে যখন বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন,পরিমলের তখন কতই বা বয়েস? দশ কি বারো হবে। বাপ মা মরা ছেলেটা বাংলাদেশ থেকে তারকাঁটা পেরিয়ে চলে এসেছিল মামার হাত ধরে। মামাবাড়িতে অবশ্য আর ঠাঁই হয়নি। অফিসের সামনে চায়ের দোকানে ছেলেটার মায়াভরা মুখ দেখে মনে ধরেছিল মৈত্রসাহেবের। ছেলেটা আশ্রয় পেয়েছিল বিরাট বড় বাড়িটার ফাঁকা একটা ঘরে। মৈত্রসাহেব স্কুলে ভর্তি করে দিলেও মন ছিল না বেশিদিন পড়ার। তবুও শেষ অব্দি পরিমল হয়ে উঠল মৈত্রসাহেবের খাস লোক। গাড়ি পোঁছা থেকে বাজার করা, পোষ্ট অফিস থেকে ইলেক্ট্রিক বিল, পরিমলই যেন একমাত্র উত্তর। সবকিছু করলেও হিসেবে বড্ড কাঁচা ছেলেটা। মৈত্রসাহেবের বেজায় বিরক্তি তাই। বার বারই বলে, ‘ওরে হিসেব না শিখলে হয়? তেমন লোক হলে নাকানিচোবানি খাওয়াবে’। পরিমল শুনলে তো!
কিন্তু তাও,দিনগুলোতে সোজাসাপটার গন্ধটা তখনও লেগেই ছিল। কিন্তু মানুষ তো, স্বাভাবিক ছকগুলোকে হাতের কাছে পেয়ে গেলে উল্টে পাল্টে দেখতে চায় স্বভাববশেই!বেওয়ারিশ পরিমলের মনে স্বার্থের লোভ উথলে উঠল একসময়। দেবদুলাল মৈত্রের এই বিশাল বাড়ি, সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা এসব খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিল অল্পপড়ুয়া পরিমল। মৈত্রসাহেবের কৈফিয়ত নেবার কস্মিনকালেও কেউ নেই, কাছের মানুষেরা হয় পরপারে নয় দেশান্তরী। কাজেই ভিটেতে ঘুঘু না চরিয়ে প্রোমোটারের হাতে ধরিয়ে দেওয়াই পরিমলের কাছে অনেক বুদ্ধিমত্তা মনে হয়েছিল। অবশ্য পরিমল কি একাবুদ্ধির মানুষ? ওই যে ঠাকুরনগরের জেলে পাড়ার মেয়েটা? দোলন! ওর বুদ্ধি না হলে পরিমল এসব ভাবতে পারত? প্রেমে পড়লে মানুষ শুধু অন্ধ নয়,স্মৃতিহীনও হয়ে যায় পরিমলকে না দেখলে কে বলত! দেবদুলাল মৈত্রের সাথে কাটানো সময়গুলো ভুলে দোলনের ঠ্যাঙারে দাদা ছোটকুর হাতে নিজের লোভকে সঁপে দিল অচিরেই। প্রোমোটারের পোষা গুন্ডা এই ছোটকু। দলিল টলিল জাল করা যার জলভাত। আজ এই কাক-ভোরে ওদের দুজনকেই দেখা যাচ্ছে গাড়ির জানলার কাঁচ পেরিয়ে গাড়ির ভেতরে। পরিমল চাদরের ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো দিয়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে সন্ধানী দৃষ্টি। আর ছোটকু পরিমলের পাশে বসে লাল লাল চোখ দিয়ে রিভলবারটা বের করে মন দিয়ে দেখছে! মৈত্রসাহেবের জীবনটার জন্য এই ছোট্ট মেশিনটা যেন শিল্পীর তুলি। একটা সূক্ষ্ম আঁচড়েই ছবির মানে পাল্টে দিতে পারে অবলীলায়!
দেবদুলাল মৈত্র হাঁটতে হাঁটতে তৃপ্তিতে ভরে উঠছেন। রোজই ওঠেন আজকের মতোই। মনে মনে মাঝে মাঝে বলেন,পরিমলটা কি বোকা,সোজা হিসেবটাও বোঝে না! বলে, ‘সাতসকালে উঠে কুকুরগুলোকে খাইয়ে কি পুণ্য হচ্ছে তোমার? তাও যদি ভালো একটা পুষতে ঘরে, পাহারা দিত! তা না,যত সব বেওয়ারিশের জাত। বিস্কুট দিচ্ছ বলে তোমার পেছনে লেজ নাড়াচ্ছে। কাল না দিলে কামড়ে দেবে। অন্য কেউ ভালো বিস্কুট দিলে লেজ নাড়িয়ে দৌড়বে’।
কি বোকা পরিমলটা! কুকুরগুলোর মনটা যদি দেখতে পেত ও! এই বিস্কুটগুলো ওদের কাছে শুধু খাবার যে নয় কে বোঝাবে ছেলেটাকে। কি করে বোঝাবে ওদের চোখ দেখলেই বোঝা যায় কতখানি ভরসা আর আদর পেতে দৌড়ে আসে সাতসকালে। পরিমল বুঝলে তো!বড্ড অবুঝ ছেলেটা। মৈত্রসাহেবের ভারি চিন্তা ছেলেটাকে নিয়ে। উনি চলে গেলে ছেলেটার কি হবে? ছেলেটার নামে টাকা পয়সা তো অনেকটাই লিখে রেখে যাবেন,কিন্তু ও কি পারবে এসব সামলাতে? অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে বাড়িটাকে মিশনকে দান করে দেন। পরিমলের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে মিশনকে বলেই। মনে মনে এসব দাবা খেলেই চলেন দেবদুলাল মৈত্র। ওদিকে মৈত্রবাবুর পেছন পেছন ঘুরতে থাকে কুকুরের দল,বিস্কুটের গন্ধে ঠোঁটে নিয়ে।
ঠিক এই সময়টাতেই মৈত্রসাহেবের চোখে পড়ে নিরীহ গাড়িটা এগিয়ে আসছে গড়িয়ে গড়িয়ে। নতুন শিখছে বোধ হয়! ভাবেন মনে মনে। উনি এগোতে থাকেন। গাড়ির সাথে দূরত্ব কমতে থাকে। কমতে কমতে শেষ বিন্দুতে এসে চাপা একটা শব্দ যেন শুনতে পাওয়া যায়, ঠ্যাপ্... ! ঠিক যেন কাগজভর্তি বড় একটা পিচবোর্ডের বাক্স পিচরাস্তায় পড়ল।
কুকুরগুলো থমকে দাঁড়ায় হঠাৎই। কাকেদের দল থমকে যাওয়া অবিরাম কর্কশ গলাসাধায়! দেখতে পাওয়া যায় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছেন দেবদুলাল মৈত্র! ছিটকে যাচ্ছে হাতে ধরা বিস্কুটের প্যাকেট, মোটাফ্রেমের চশমা। মানুষটার মুখে যন্ত্রনার বিকৃতি। ওদিকে গাড়ির ভেতর লাল চোখ দুটোতে তৃপ্তির আভাস টগবগ করছে! কিন্তু চাদরঢাকা পরিমলের মুখটা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ঘামে ভিজে গেছে। সাইলেন্সর রিভলবারটিকে ব্যাগে ভরে রাখে ছোটকু। ড্রাইভারকে কর্কশ গলায় গাড়ির বেগ তুলতে আদেশ দেয়।
এদিকে থমকে যাওয়া দৃশ্যটির সাথে খানিক ধাতস্থ হয়ে নিতে যেটুকু সময় লাগে সেই মুহুর্তটুকু পেরিয়ে গেলেই দেখা যায় কুকুরগুলো দৌড়তে শুরু করেছে গাড়িটার পেছন পেছন। প্রানপন সে দৌড়। ধরতেই হবে খুনীকে যেন! দাঁতগুলো ঝলসে উঠছে, লাল গড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। ওরা পাগলের মত দৌড়চ্ছে।
‘আরে ছোটকুদা ,কুত্তাগুলো দৌড়ে আসছে তো?’ড্রাইভার বলে উঠল।
‘আবে শালা,কুত্তাকে ভয় পাচ্ছিস? চালা জোরে’ লাল চোখ আরো রাঙিয়ে বলে উঠল ছোটকু।
‘জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে যদি লাফ মেরে?’ ড্রাইভার ছোকরার চোখে মুখে যেন ভয়!
‘আরে বিস্কুট আছে? জানলা দিয়ে ছেটাও’ পরিমল বলে ওঠে।
‘বিস্কুট তো নেই। তবে লাড্ডু আছে। দেব?’ ড্রাইভার ছোকরা বড় প্রশ্ন করে যেন!
‘আরে যা আছে ছেটা। শালা বেওয়ারিশ কুত্তা। খাবার পেলে সব ভুলে যায়’ ছোটকুর মুখে তাচ্ছিল্য।
কুকুরগুলো দৌড়তে দৌড়তে দেখল হলুদ হলুদ টুকরোগুলো উড়ে উড়ে আসছে। মুহুর্তের জন্য যেন থেমে গেল ওরা। চাটল খানিক। জিভে এপাশ ওপাশ লাড্ডুর টুকরোগুলো। লালা-ভরা মিষ্টির স্বাদ। পরিমলের চোখদুটো চকচক করছে উটকো বিপত্তিটাকে এড়িয়ে। মনে মনে বলল, জানতাম এটাই হবে। ছোটকু ড্রাইভারকে বলল, ‘টেনে চালা এবার’।
কিন্তু পরিমল ভুলে যায় হিসেব মেলাতে কোনোদিনই সে পারেনা । পারেনি! তীব্র পাশবিক কোলাহলে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে কুকুরের মিছিল আবার ধেয়ে আসছে গাড়িটার দিকে। আর সে বেগ ক্রমশ বাড়ছে। এদিকে ছোকরা ড্রাইভার সামনে তাকিয়ে দেখে গেটের সামনে জটলাভরা কালো কালো মাথা। মর্ণিং ওয়াকে ঢুকছে এক দল মানুষ। কি করবে ছোকরা এখন ?
দেখা যায়, গাড়ির পেছনে বেওয়ারিশের দলের মিছিলের দূরত্ব কমে এসেছে আরো। ঘেউ ঘেউ শব্দে আক্রোশ ঝরে পড়ছে। খেয়াল করলে বোঝা যায় তীব্র প্রতিহিংসা উগরে আসছে।
মিছিলটা কি আছড়ে পড়বে গাড়িটার ওপরে?
নাকি সামনের সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাবে গাড়িটা? গিজগিজে লাশেদের শরীরগুলো নির্দয়ের মত টপকাতে টপকাতে!কি হবে এবার?
ঠিক সেই মুহুর্তে এসব কিছু হিসেবের থেকে খানিক দূরেই দেখা যায় দেবদুলাল মৈত্রের বেওয়ারিশ শরীরটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। জামার পকেট থেকে গড়িয়ে পরা রক্ত পিচরাস্তায় গলে গলে পড়ছে।
আর সেখানে গাল পেতে শুয়ে আছে যে কুকুরটি, তার জলজলে চোখের আশপাশের সদ্য ভিজে ওঠা লোমে রক্তের আঁশটে গন্ধ মিশে যাচ্ছে । কি মায়া ওর চোখে!
হয়ত মৈত্রসাহেব বেঁচে থাকলে ভাবত,পরিমলটা কি বোকা,এসব দেখতেই পায় না!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন