বৃহস্পতিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

কল্প গদ্য - মুজিব মেহদী

কল্প গদ্য
মুজিব মেহদী



লতা বাওয়ার কাজবাজ প্রায়শই হয়ে যায় জাদু বাস্তবিক

‘ম্যাজিক রিয়ালিজম, ও হ্যাঁ, বাংলায় যাকে বলে জাদু বাস্তবতা, এটি হলো কল্পগল্পকে সত্যস্বত্বের পোশাক পরানো, সত্যের মতো দেখতে-শুনতে সত্যোপম সব আখ্যান বানানো, জানো, নামবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রাঙ্ক রোহ, উনিশশ’ বিশ-এ, লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে আছে ও ছিল, বাংলার লোকগল্পেও আছে এই টইটই জাদু, ছিল অন্য বহু স্থানে এবং কালেও, আলেহো কার্পেন্তিয়ার, কিউবার, চল্লিশে জানান দেন যে, ‘অধিকাংশ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যেরই এটি মৌলিক চারিত্র্য’, ছোট্ট একটা আড়মোড়া ভেঙে ও বলে, ‘কলাম্বিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও চিলির ফিকশনে ওটার ঠাসবুনন লক্ষণীয়, চাও তো বলতে পার, মাখামাখি’


টিভিতে তখন মূর্ছিত সেতার
‌‘তোমার জানা আছে যে, ম্যাজিক রিয়ালিজম কোনো শিল্পান্দোলন বা দর্শন নয়, একটা অ্যাখ্যান-ঘরানা মাত্র, মার্কোয়েজ, আমাদো, বোর্হেস, কার্তেজার, আলেন্দে... (এর পরই নিজের নাম বলতে ইচ্ছে করে পাখিটার) ম্যাজিক রিয়ালিজমের একেকজন মহান স্রষ্টা’, একটু পাখা ঝাপটিয়ে বলে যে, ‘মার্কোয়েজ বিশ শতকের অমর সাহিত্যস্রষ্টাদের একজন, মিস্ত্রাল, নেরুদা, আস্তুবিয়াস ও বোর্হেসের পর তিনি চতুর্থ লাতিন আমেরিকান শিল্পতারকা’

স্বকণ্ঠনিঃসৃত ‘মাখামাখি’ শব্দটা তিতলি পাখির মাথা থেকে কিছুতেই সরছে না, যদিও পরে অনেক কথা বলা হয়ে গেছে, শব্দটির গন্ধে আনমনা হয়ে যায় ও, উড়ে এসে লতার নিকটজুড়ে বসে, নড়ে ওঠে তরু বল্লরী বীথি, অবসন্ন দেখায় পাখিটাকে, বলে, ‘শোনো, মার্কোয়েজের কারুগদ্যের মডেল ছিলেন দুজন, ফকনার ও হেমিংওয়ে, উত্তর আমেরিকান মহাজন’

ইত্যবসরে তিতলি পাখির ভেতরে কিছু একটা বদল ঘটে গেছে, তার হয়ত কোনো প্রকাশও ছিল, টের পেয়ে যায় লতা, সহজাত আগ্রহ জাগে তার মধ্যে, দেখে, পাখির চোখ চকচক করে উঠছে, নেতিয়ে পড়ে ও আরো, এক ফোঁটা কুয়াশার ভারও যেন আর বইতে পারছে না, এমন লাগে ওকে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিতান্ত অনিচ্ছা থেকে ও বলে, ‘মার্কোয়েজ বলেন...’


তবলায় তিন তাল, জাকির হোসেন
পাখিটা হঠাৎই চরকি ওড়া দিয়ে এসে আরোহণ করতে থাকে পাতা থেকে পাতায়, তারপর একইভাবে অবরোহণ, লতার আঁকশিতে আটকে থাকে খানিক, ঠিক পরের বোলে ফ্রি, কিন্তু মার্কোয়েজের কোন কথাটি বলতে চেয়েছিল তার কিছুই আর বলে না ও, লতার পক্ষে জানার ইচ্ছেও তখন মৃতপ্রায়

পাখিটিকে বেশ পটিয়স লাগে, তেতালে যদিও আগে লতা বায় নি ও, রঙেরূপে অনাকর্ষণীয় এবং গানবোবা বলে কখনো কেউ ফিরে তাকায় নি ওর দিকে, সে আরো দ্রুত হয় ও ঘন শ্বাস ফেলে, পথ ছেড়ে দিয়েছে লতার পাতা ও আঁকশিরা, ততক্ষণে, খেলাচ্ছলে আরেকটি ওড়া দিতে গিয়ে পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপে চোখ পড়ে ওর, দেখে স্বয়ম্প্রকাশিত দু-দুটি চিনামাটি হিল, বিজয়পুরে, ক্রোকারিজ ব্যবসায়ীদের ইজারায় এখন, প্রতিদিনই ট্রাক ট্রাক সরে যাচ্ছে মাটি, সার সার কর্কট দাগ, নেমে এসে সহসাই ঠোঁট বসিয়ে দেয় একটি ফুলে, রস ফুরোলে অন্যে, এরই ঢালে কিয়দ্দূরে মরা সোমেশ্বরী, নিচে শুকনো খাদ, ওর এক কিনারে পৌঁছেই বিবর্তনের নিয়ম ভেঙে তিতলি পাখি সরীসৃপ হয়ে যায়, ঊষর প্রান্তর চষে ফেলে স্রোতস্বী ক্যানেলের খোঁজে, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা


ডিসকভারিতে বিচ ডকুমেন্টারি, উঁচু ঢেউ আর সানবাথ

ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে ও অস্বচ্ছন্দ, ক্রোশ কয় দূরের সাগরে আরো বেশি, তবু এগোয়, নিষ্কেশা সরীসৃপ সাগরসঙ্গমে অনভিজ্ঞ, আযৌবন ব্যাক পেইনের ভারে পীড়িত, চির রোগা, গায়ে বাতাস লাগলে কুঁচকে যায়, উড়তে পারে না ঝড়ের বিপরীতে, ফুঁ দিয়ে চা খায়, ফুঁ লাগলে ওড়ে যায় দূরে

লতা ততক্ষণে কুয়াশাসিক্ত ছোট নদী, এই লতাই নাকি কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মাসকাটা নাম ধরেছে, শোনা গল্প, তারপর ছোটো-বড়ো আরো নদী, এরও পরে পাতরার জঙ্গল, বালুঢাল ও মোহনা, বঙ্গোপসাগরের


ঐশ্বর্য রাইয়ের ডলনাচ

রাইয়ের মুদ্রাবাহুল্যে ভরা নৃত্যপ্রয়াসটিও আগে মন দিয়ে দেখত পাখি, এবার তার অন্যথা হলো, নাচ ভুলে ও সমুদ্রমন্থন শুরু করে, মন্থন আর লেহন, লেহন আর মন্থন, ও খোঁজে অমৃত, পায় না, গরল ওঠে দ্বিতীয়বারেও, তৃতীয় চেষ্টার আগেই ওর শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যায়, সাগর মোহনায় তখন তরঙ্গিত শুধু ফেনা আর বালিজল

মার্কোয়েজ মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে নোবেল জিতেছিলেন, আর লতা জিততে চায় অর্গাজম, জ্যেষ্ঠতার অধিকারে, ধৈর্যেরও ওটা দাবি, কিন্তু সফেন সমুদ্রের তুলনায় অত্তটুকুন সরীসৃপ, ভয়ে কুঁজো হয়ে যায়, অর্ধমুদিত চোখে বলে, ‘আই কান্ট কিস, আই কান্ট মেক কমপ্লিট লাভ, আই...’, শতবর্ষের নীরবতা নামে ওর অবয়বে

মার্কোয়েজ স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে মারা যান উনিশশ’ বিরাশিতে, সরীসৃপ বিনা স্বীকৃতিতে, ঠিক তার তেইশ বছর পরে, অ্যাডভেঞ্চারে

লতা উলম্ব, লতা আনুভূমিক, লতা সূর্যমুখী, লতা বহমান, লতা স্পর্শ ও জ্ঞানকাতর, লতা প্রেমপ্রতারিত, লতা মা, লতা দিদি, লতা বন্ধু, লতা রতিতরঙ্গিনী, লতা পাতাদের ঝোপ, লতা রহস্যসরোবর, লতার ভেতরের ছন্দনাচ তার নিজের কাছেই ভীষণ অপমানকর লাগে তখন, এলিয়ে পড়ে সে কাঁদতে থাকে, প্রশ্রয়টাকে, যা তার থেকেই উৎসারিত, অপরাধ বলে মনে হয়, অক্ষমার্হ এখন নিজের কাছে সে নিজে, পয়জন আইভি ভাবতে লাগে সে এবার নিজেকে

লতা বিশ্বাস করে, ম্যাজিক রিয়ালিজম উত্তর-ঔপনিবেশিক লেখাজোখার এক সহজাত উদ্ভাস, তাই মার্কোয়েজের জন্মকে সে নিতান্তই ঠাট্টা ভেবেছিল