শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অমলেন্দু চন্দ



অমলেন্দু চন্দ

সেই সময়ের টানাপোড়েনের কত স্মৃতি কত কথা কত হাঁসি কত গান যত আনন্দ তত’ ব্যথা – অমিত দেবু সৌমেন ওরা আজও বোকারো’তেই আছে। ওখানেই থাকবে টিল রিটায়ারমেন্ট। মানে আরও বছর দশেক তো বটেই।  এটা দু হাজার বারো। 
সেটা ছিল উনিশশো পঁয়ষট্টি। পাটনা ফিরে এসেছি আমরা বছর খানেক হয়েছে। বাবা’র ট্র্যান্সফার হলো কলকাতা থেকে ফেরত পাটনা, আমি তখন ক্লাস ফোরে উঠেছি। ভরতি হলাম পাড়ার স্কুলে -  বিদ্যাবিথি নার্সারি স্কুল। পরের বছর উঠলাম ক্লাস ফাইভ,  এমন সময়ে মায়ের বন্ধু রীতা মাসি মাকে বললেন একবার তার বাড়িওলা মুনেস্বর ঝা’র সঙ্গে কথা বলতে কারণ আমার স্কুল বদল করতে হবে – বিদ্যাবিথি’র শেষ ক্লাস ছিল ফোর। মুনেস্বর ঝা তৎকালীন বিহার কংগ্রেস’এর এক এম এল এ ছিলেন। মা গিয়ে তাকে রিকোয়েস্ট করল একটা স্কুল এ ভর্তি করিয়ে দেবার জন্য। রিতা মাসি ও দোহার ধরেছিলেন মনে পড়ে যে একটা কিছু করতে হবে। তো মুনেস্বর বাবু এক্সপ্যান্সিভলি বললেন মানে বেশ একটা রাজা রাজা মেজাজে যে – চলো গভর্নমেন্ট স্কুল’এ ভরতি করিয়ে দিচ্ছি। মা তো শুনে কি বলবেন আর কি করবেন ঠিক করতে পারছিলেন না তখন আবার রিতা মাসি হাল ধরলেন – আঙ্কল তাহলে ও কবে যাবে আপনার সঙ্গে প্রীন্সিপালের সাথে কথা বলতে। ভদ্রলোক বোধকরি ঈষৎ খোঁচা খেয়েছিলেন ইগো’তে, হাজার হোক এম এল এ’ তো, তবে ভদ্রলোক, তাই একটু বিব্রতভাবে বলেছিলেন – আবার কথা বলার কি আছে, আমার সঙ্গে যাবে ভরতি করিয়ে দেব, কালকেই চলো। মা কিছু বলবেন ভাবছিলেন। তখন রিতা মাসি চোখ টিপেছিলেন মা চেপে গেছিলেন। বোধহয় ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিলেন।

পরের দিন মা সকাল সকাল আমাকে নিয়ে চলে এলেন মুনেস্বর ঝা’র বাড়ি। তারপর রিক্সা করে পাটনা কলেজিয়েট গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে’র দিকে।

শুনতে একটু আর বলতেও একটু অদ্ভুত লাগছে – “রিক্সা করে”, বলে নিই তিনি তখন তিন বারের এম এল এ আর বোধকরি কৃষ্ণ বল্লভ সহায়ের মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানায় একজন মিনিস্টার’ও ছিলেন। তিনি চলেছেন রিক্সা চেপে পাশে আমার মা আর কোলে আমি । এখন তো এম এল এ হবার আগেই গাড়ি বাড়ি আরও কি কি থাকে নাকি। মন্ত্রী তো ভাবাই যায় না – মানে রিক্সা?

আজকাল তো লোকপাল ব্যাবস্থার দাবী নিয়ে ধুন্ধুমার, তাতেই যে দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে করাপশন নিয়ে কথা শুরু করলে লোকজনের অবস্থা আমি জানি সেই বঙ্কিমের শঙ্কিত প্রশ্নের মতো হয়ে যাবে – তিনি থামেন তো?  কিন্তু বলুন তো সত্যি থামি কি করে, বেড়াল আর ঝুলির গল্প ফেল মেরে যাচ্ছে,
এতো বেড়াল এত বেড়াল –
মাটির মতো স্থায়ী হোক মানুষের শান্তি
এইসব কথা টথা বলে, পাড়ার আমীন বাহাদুর
একদিন উঠলেন নেতা হয়ে, তারপর এলেমদার মানুষেরা যেরকম
পারদর্শী হন, ঠিক সেরকম
নমিনেশন ইলেকশন মাইক্রোফোন জোড়হাত
ইত্যাদি ঘটনার সিংদরজা উঠোন পেরিয়ে
ক্ষমতার অন্দরমহলে গিয়ে ডেরা বাঁধলেন ।
ইতিমধ্যে উন্নতির দ্রুতগতি ছুটের চেহারা-
পুরপিতা হওয়া থেকে আগুয়ান হতে হতে মন্ত্রী সাব্যস্ত হলে
সাইরেন বাজানো গাড়ি, আর তার পর
দু তিনটে বড় বড় চারচাকা, ছেলে মেয়ে বউ’এর দরকারে;
সে তো গেল গোড়াপত্তনের ইতিহাস –
যাকে বলে পেশায় সম্ভ্রান্ত হওয়া।
একদিন কখন যে দু চার একর জোড়া
উঁচু দেয়ালের মাঝে সিনেমার ছবির মতো বাংলোবাড়িতে বিস্থাপন
বোঝাই গেলনা ।
সত্যি এটা, খুব বড় কেউ কেটা নয়
পলিটিক্সে আসা রাম শ্যাম যদু মধুদের ইতিহাস ।
কি বিড়ম্বনা! কত রক্ত কত প্রান নিয়ে
স্বাধীনতা শেষে এই দিল???
   
স্বাধীনতা! দেশ ভাগ আমি তো দেখিনি, শুনেছি অনেক কিছু বাবা মা আর আমার মায়ের মা দিদার মুখে। ভাগ হয়ে যাওয়া অতীত, ভিন্ন ঠাঁই মানুষ। পারটিসানড্ পাস্ট, পারটিসানড্ সেলফ। ইংরেজ চলে গেল, ছেড়ে গেল, তৈরি করে দিয়ে গেল এমন কিছু ঘটনা পরম্পরার জমিন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল – দ্য লারজেস্ট সিংগল মাইগ্রেসান ইন হিস্ট্রি। আসলে সংখ্যাগত দিক থেকে তো এ সাব কন্টিনেন্ট চিরকালই তুলনাবিহীন – ফলে জীবনের মানে মহা মুল্যবান সেই বস্তুটির মূল্য দুনিয়ার এ ধারে চিরকালই কম, আজও তাই। সাইজ আর ডাইমেন্সান এর নিরিখে এই ট্র্যাজেডি’র কাছাকাছি একমাত্র ইউরোপিয়ান হলোকস্ট আসতে পারে, দাঙ্গার জেনোসাইড।

কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা, যুক্তি তক্ক গপ্পো - এই  ছবিগুলোয় ঋত্বিক তো এই যন্ত্রণা থেকেই উৎসরিত  গাঁথা ছবিতে রচনা করে গেছেন। ভাঙনের যন্ত্রণা, ছিন্নমুল বাস্তুহীনতার আর বিচ্ছেদের কাহিনীচিত্র। হয়তো অনেকটাই আরকিটাইপ্যাল, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত এক ইন্টেলেকচুয়াল এর নিজস্ব স্টাইলে ছবিগুলো তাড়া খাওয়া মানুষের গল্প। সে গল্পে থেকেছে আরও অনেক কিছু, যেটা নেই তা হল এই ভয়ঙ্কর এক পরিণতির দায়ভাগ নির্দিষ্ট করার প্রসঙ্গে, কোনো রাজনৈতিক চেতনাকে তুলে ধরা। আমার কাছে ব্যাক্তিগতভাবে যেটা কোনোদিন অ্যাক্সেপ্টেবল মনে হয়নিসেটা হল, ঋত্বিকের একটা কন্‌সাস শৈল্পিক আরকিটাইপ নির্মাণ – যেন এ সমস্ত কিছুই এক ধরনের নিয়তি নির্ধারিত, যেন এতে কখন সে ভাবে কারো হাত ছিল না, এক পরমেশ্বর ছাড়া! ইন ফ্যাক্ট যুক্তি তক্কো’র নীলকণ্ঠ তো বলেই ফেলে – জীবন জীবিতের, জীবিতের ধর্ম বহতা অমোঘ দুর্নিবার, সব পুড়ছে, ব্রহ্মান্ড পুড়ছে, আমিও পুড়ছি... ।

হয়তো এটা শিল্পের দায়, নাকি শিল্পীর – তার শিল্পবোধের কাছে। উত্তর মেলেনা। যেটা মনে হয় সেটা হল যে জীবন উপপাদ্য হয়ে শিল্পে নেমে এল, তার বহমানতার জাঙালে যারা যারা তাদের স্বার্থ সিদ্ধির কারনে বাঁধ দিয়েছিল, মেঢ বেঁধেছিল স্রোত ঘোরাবে তাদের ইচ্ছার বাঁকে, তাদের প্রয়োজনে, তাদের প্রসঙ্গ এল না একবারও। এ কোনো জীবনের গান যেখানে সত্যের  নীরিখে জীবিত তার ভাঙনের ইতিহাসের পাতার অনেক দুর্ধর্ষ কুশীলবের কথা জানতেই পারল না। অবশ্য এটাও মানি যে এই ভাবনাটা একটা স্কুল অফ থট, শিল্পের বিচারে আরও অনেক কিছু আছে বা থেকে যায় যা শিল্পের সত্য। পঞ্চাশ বছর বয়েসে যে লোকটা নীলকণ্ঠের মুখে ওই কথাগুলো তুলে ধরেছিল এক বছর পরে সে লোকটা মারা যায়, ও কি জানত ওর ইনিংসের শেষ এসে গেছে! আর তাই ওই অমোঘ শব্দের ধ্বনি – ব্রহ্মান্ড পুড়ছে, আমিও পুড়ছি।

ছিন্নমূল স্মৃতির চাতালে – শর্তাধীন কিম্বা কিছু শর্তহীন পৃথক প্লাবন, অজা এক নিজস্ব আগুন জ্বলে দাউ দাউ ধিকি ধিকি, মন বা মানুষ পুড়ে খাক হয় সময়ের মিশ্র খাম্বাজে।

(অলংকরণ – মেঘ অদিতি)