উল্কা
।।করবী গলি নম্বর এক।।
ব্লাউজের হাতায় হেম ফোঁড় দিতে দিতে ভেজানো সদর দরজার দিকে আবার ঘুরে তাকাল করবী। আজ সকাল থেকে কালো হয়ে আছে সারা আকাশ সাথে ঝড়ো হাওয়াও দিচ্ছে। মুনিয়াকে তাই আজ বেরনোর আগেই ছাতাটা মনে করে সাথে দিয়েছে করবী। প্রতি রবিবার এইসময় প্রাইভেট টিউশান পড়তে যায় মেয়েটা। সামনের সপ্তাহে চব্বিশে পা দেবে। দেখতে দেখতে কেমন বেড়ে উঠছে মুনিয়া। ছ’বছর আগে যখন করবী তার বড় মেয়ের সম্মন্ধের জন্য দাবিহীন সৎপাত্র খুঁজে বেড়াচ্ছিল তখন মনেই হয়নি আজকের এই দিনটার কথা। তুলির বয়স তখন একুশ। বিয়েটা ইচ্ছা করেই তাড়াতাড়ি দিয়েছিল করবী। নির্ভীকের মতো ছেলেকে জামাই হিসেবে পাওয়া পরম সৌভাগ্য বলে মনে হয়। নির্ভীক দেখতে ভালো, সচ্ছল পরিবারের ছেলে। মাদারডেয়ারিতে কাজ করে আয়ও মন্দ না। তুলি ছোট থেকেই ঘর কন্নার কাজ ভালো পারত তাই দেখাশোনা মিলিয়ে বিয়েটা ভালোই হয়েছে। মেয়েটা সুখে সংসার করছে। সেইদিক থেকে অনেকটা নিশ্চিন্ত করবী। অন্যদিকে মুনিয়া ঠিক উল্টো সংসারে একদম মন নেই, সবসময় পড়াশুনায় মেতে আছে। বাংলায় এম.এ পাশ করে এখন চাকরীর পড়াশুনা শুরু করেছে। আর পড়াশুনার সাথে সাথে স্কুলের চার পাঁচটা ছেলে মেয়েকেও আর্টস গ্রুপ পড়াচ্ছে। ইদানিং তাই ব্যস্ততা বেড়েছে। গত বছর মুনিয়ার জন্য দু-তিনটে সম্বন্ধ এনেছিল করবীর বড় জা শেফালী। বুঝিয়ে শুনিয়ে লজ্জাবতীটি সাজিয়ে মুনিয়াকে মাত্র একবার পাত্র পক্ষের সামনে হাজির করাতে পেরেছিল করবী। আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর ছেলের মা বলেছিল – “কিছু মনে করবেন না দিদি মেয়ের সামনের দাঁতটা বেশ উঁচু। ওটা যদি ঠিক করা যায়...আর কি। একটু দেখুন।” আমতা আমতা করে বিদায় নিয়েছিল তারা। আর কোনো উত্তর আসেনি ওই তরফ থেকে। আজকাল বিয়ের কথা বললেই মুখ বেঁকিয়ে নিজের কাজে মন দেয় মুনিয়া। মাঝে মাঝে আবার হাসতে হাসতে জবাব দেয় “চিন্তা করছ কেন তোমার এতো রূপসী মেয়ে দেখবে কোনো এক রাজপুত্র এসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে!” করবী জানে মুনিয়া নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। তাই মুনিয়ার সাথে বিয়ের ব্যাপারে বেশি কথা হয় না ওর। এ বাড়ি ও বাড়ির ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়ে পড়শিরা ফোড়ন কাটে “কি গো সেজ বৌ তোমার ছোট মেয়ে তো সারা দিন উড়ছে। ঠিক যেন ব্যাটা ছেলেটা! তা জামাইয়ের বদলে এবার ঘরে বৌমা আসবে নাকি গো?” কোনো উত্তর দেয় না করবী। চটপট দুহাতে জামা কাপড়গুলো ছাদের দড়িতে মেলে ঘরে ফিরে আসে। কষ্ট পায়না সে...মুনিয়ার হাসি মুখটার দিকে তাকালে সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। নিজের না পাওয়াগুলো মেয়ের পাওয়ার মধ্যে খুঁজে পায় করবী। দুই মেয়ের মধ্যে নিজের মেয়েবেলার ঝলক দেখে চমকে ওঠে। পড়াশুনা সংসার স্বপ্ন সবই তো ছিল কিন্তু সব কিছু কেমন উধাও হয়ে গেছে চঞ্চল করবীর ডাইরি থেকে। ঘড়ি দেখে খাটের পায়ায় হেলান দিয়ে করবী ছড়িয়ে বসল। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে কদিন যাবৎ। মেঝের উপর সেলাইয়ের কৌটো থেকে একটা লাল সূতোর রিল উঁকি দিচ্ছে সাথে মুখ খুলে চিৎপাত হয়ে পড়ে রয়েছে সবুজ হ্যান্ডেলওলা কাঁচিটা। মুনিয়া ফিরতে এখনও ঘণ্টা তিনেক দেরি। ভারী বৃষ্টিতে ট্রেন মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেলেই হয়েছে...ব্লাউজের হাতার ভাঁজে ছুঁচটা গেঁথে পাশে নামিয়ে রেখে চশমা খুলে, অপেক্ষা গলি পেরোতে চোখ বুজল করবী। বেশীক্ষণ সেলাই করলে আবার চোখে যন্ত্রণা শুরু হবে।
।।করবী গলি নম্বর দুই।।
বি.এ সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা শেষের আগের রাত। খুব গরমে মাথার উপর পাখাটা যতই জোরে ঘুরুক না কেন বড্ড আস্তে বলে মনে হয়। করবী বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া অস্বস্তি জনক ঘাম মুছে নিচ্ছে। সংসারের কাজ মিটিয়ে পড়তে বসতে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছিল। এখন রাত দেড়টা বাজে। খাটে অকাতরে ঘুমচ্ছে চিনু আর বনি। খুব দুষ্টু হয়েছে দুটোতে। ওদের সামলাতে নাকানিচোবানি খেতে হয় সকলকে। তবুও এটাই শান্তি বাড়িতে কারোর কথা না শুনলেও করবীকে ভয় পায় তার ছোট ভাই চিনু আর বোন বনি। সবসময় দিদি দিদি করে আঁকড়ে থাকে। চিনুর জন্মের পর থেকেই দায়িত্ব পড়েছিল করবীর উপর। তখন করবী মাত্র পনেরো। মায়ের মতোই চিনুকে মানুষ করেছে সে-খাওয়ানো পড়ানো স্কুলে ভর্তি করা, পড়তে বসানো থেকে সবকিছু। তার দু বছর পর আবার দায়িত্ব বাড়ল। তখন থেকেই তিন ভাই বোন এক ঘরেই থাকে। বনি এখনও বেশ ছোট আর চিনু স্কুলে যাচ্ছে সবে সবে। এই সময়ে ওদের ঘুম ভাঙলে পড়া মাথায় উঠবে তাই টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পরীক্ষার দিনে কাজ চালাচ্ছে সে। বই থেকে মুখ তুলতেই চোখটা ধাঁধিয়ে গেল করবীর। অনেকক্ষণ আলোর মধ্যে থেকে অন্ধকারে তাকালে ওর চোখের সামনে প্রচুর হিজিবিজি ঘুরে বেড়ায়। সাথে কম আলোয় বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রভাব বেশ ভালোই পড়েছে ওর চোখে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসে, ওর সাথে চোখ থেকে মাথার যন্ত্রণাটা বেশ কিছুক্ষণ শুরু হয়েছে। “এই দিদি হিসি পেয়েছে...” খাটের কাছ থেকে চিনুর ঘুম জড়ানো গলা ভেসে এল না?
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের এ।।
করবীদের বাড়িটা বেশ বড়ই। সেটাকে গত আঠাশ বছর ধরে যদিও আর আমার বাড়ি বলা হয়নি ওর। শুনেছে ওই বাড়িটা ওর বাবার অনেক কষ্টের অনেক বিনিদ্র রাতের অনেক ত্যাগের ফসল। করবী যখন দুবছরের তখন ভাড়া বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে এই বাড়িতে চলে আসে ওরা। তখন শুধু নিচের তলার দুটো ঘর ছিল। নিপু তখন মায়ের পেটে। তারপর দোতলা হলো, পরিবার বাড়ল। মণি আর বিলু দোতলার ঘরে মায়ের কাছে ঘুমাতো। নিচের একটা ঘরে বাবা- নিপু আর একটা ঘরে করবী একা। মায়ের থেকে কেমন দূরে সরে গেছিল সে। বোন ভাইদের সামলাতে সামলাতে মা-ও যেন তার চোখের সামনে একজন অন্য নারী হয়ে উঠছিল। সংসারের ভার পড়েছিল ওর উপর। প্রতিদিন উনুন থেকে গরম চাটুটা নামিয়ে ছুট লাগাতো মোটর সাইকেলের আওয়াজ লক্ষ্য করে। বাবা ফিরলে পায়ে জল দিয়ে নিজে মোটর সাইকেল ঠেলে নিয়ে আসতো গ্যারেজে। বদলে মিলত বাবার অপত্য স্নেহ মাখানো হাসি। করবীর বাবা ভালো মানুষ। এলাকার সকলেই সম্মান করেন তাঁকে। শ্যামবর্ণ এবং তিনি পুরুষ বলেই হয়তো তার রূপ নিয়ে কখন কথা ওঠেনি এবং দিব্যি স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সংসার করছেন। ছোটবেলায় করবী শীতলা পুজোয় মামার বাড়ি গিয়ে একবার দিদিমাকে বলতে শুনেছিল সে একদম তার বাবার মতো দেখতে আর যে মেয়ে তার বাবার মতো হয় সে নাকি খুব ভাগ্যবতী। এরকম কথা মণি আর বনির বেলায় বলতে শোনেনি সে।
দেরী হলেও কার্ড ছাপা হয়ে বাড়ি এল। লাল কার্ডে একটা সোনালী ঘোমটা টানা মুখ নিচে লেখা ‘শুভ বিবাহ’ একটা নীল রাংতার প্রজাপতিও ছিল কার্ডটাতে। চিনু বাবার সাথে গিয়ে পছন্দ করেছিল কার্ডটা। সিঁদুর হলুদের ছাপ লাগিয়ে বাবা মায়ের সাথে সেও গিয়েছিল আত্মীয়দের বাড়ি তার সমবয়সী ভাই বোনদের ভালো করে বলে আসার জন্য। সে এখন বড় হয়ে গেছে। রাতে একা শোয় দোতলার একটা ঘরে। বনি করবীর সাথে একতলার ঘরে। নিপু আর বিলু রাতে দেরিতে বাড়ি ঢুকছে কদিন ধরে। তাই বাবা বাইরের ঘর ছেড়ে দোতলার ঘরে ঘুমাতে যান। আবার হয়তো স্থান পরিবর্তন হবে। আর সব থেকে বড় পরিবর্তন হবে করবীর। অনেক চেষ্টার পর করবীর জন্য পাত্র পাওয়া গেছিল তবে উপযুক্ত কিনা সেটা বিচার করার মানসিকতা বোধয় সেই মুহূর্তে কারোরই ছিল না। বয়েস বাড়ছিল করবীর পিছনে ছিল মণি। তবে তার জন্য সুপাত্রটি দোর গোড়ায় অপেক্ষায় আছে দেখে করবীর মা তার বড় মেয়ের বিয়ের জন্য তীব্র ভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ভালো দামেই বর কিনেছিলেন করবীর বাবা তার জন্য। বিয়ের আগে পাকা দেখার দিন করবী কয়েক মিনিটের জন্য তার ভবিষ্যতের সামনে একবার দাঁড়িয়ে ছিল। পাত্র পক্ষের মধ্যে থেকে একজোড়া চোখ যেন তাকে ক্ষুধার্ত পশুর মতো গিলে চলেছে তবে শুভ দৃষ্টির সময়ে কল্যাণীয়া করবী দত্তের কল্যাণীয় রমাকান্ত বণিককে একটু অন্য রকম লেগেছিল। বলা যেতে পারে কিছুই লাগেনি...তন্দ্রাচ্ছনের মতো আত্ম সম্প্রদান করে ফেলেছিল কন্যা সম্প্রদানের আগেই। শ্বশুর বাড়ি চলে আসার আগে দিদিমা আশীর্বাদ করে বলেছিল “অখণ্ড সৌভাগ্যবতী হও...” বাকি আরও অনেক কথা বলেছিল দিদিমা কিন্তু কেন জানিনা ওই টুকু শোনার পর মাথাটা কেমন ভারী হয়ে এসেছিল করবীর। রমাকান্ত খুচরো শ্যাকরা টুকটাক কাজ জানে দুঁদে শ্যাকরাদের মতো গয়না তৈরি করতে না পারলেও ছোটখাটো অশৈল্পিক কাজ করে মোটামুটি আয় করে। বাড়িতেই ছোট্ট কারখানা। উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করার পর রোজগার পর্ব শুরু হয় তার। একমাত্র রূপের দিক থেকে হয়তো সে করবীর উপযুক্ত বলে এই বিয়েটা এতো গুছিয়ে হয়ে গেল! এতদিন নিরাভরণ থাকার পর বাবা মায়ের দেওয়া এত গয়না খুব ভারী লাগছিল করবীর।
।।করবী গলি নম্বর একের এ।।
কাছাকাছি কথাও খুব জোরে বাজ পড়ল।
“মুনিয়া কখন ফিরবে? আনতে যাব নাকি স্টেশনে?”
“কটা বাজে?” রমাকান্তের কথায় চোখ বুজেই জবাব দিল করবী।
“সওয়া একটা...”
“দুটো নাগাদ যেও একবার। বৃষ্টিতে ট্রেন লেট আসবে...”
“স্টেশনে খুব জল জমে যাবে ততক্ষনে... বাইরে বৃষ্টির যা বহর!” বলতে বলতে চলে গেল রমাকান্ত।
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের বি।।
সেদিনও খুব বাজ পড়ছিল। করবীর মেজো জা সোমা ষষ্ঠী পুজো সেরে আঁতুড় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। দুপুর বেলা তাই ছোট্ট রিঙ্কুকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে ফিরে বিয়েতে পাওয়া শরৎ রচনাবলীটা নিয়ে শুয়েছিল সে। খুব মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা সংসারের কাজের পর ওকে নিয়েই সময় কাটে করবীর। তার ওপর দুদিন ধরে শরীরটাও ভালো লাগছে না সে কথা কাউকে জানায়নিএমনকি রমাকান্তকেও না। বিয়ের দশ মাস পেরিয়েছে সবে তাই নিজের সমস্যা গুরুতর না হলে কাউকে কিছু জানাবার দরকার আছে বলে মনে করে না করবী। বিয়ের পর ও বাড়ি যায়না তেমন, ভাইবোনেরাই আসে দেখা করতে। অষ্টমঙ্গলার পর থেকে বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়নি তার। সমস্যাটা মেজদিকে বলার কথা ভেবে শরৎ রচনাবলীতে পেজমার্ক গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর ঘরে যাচ্ছিল সে। মেজো ভাসুর এসময় বাড়ি থাকেন না। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। দালানে গ্রিলের ফাক থেকে আকাশ চেরা আলো করবীর চোখে পড়তেই দু কানে আঙুল চেপে ধরল। বাজটা যদিও বেশি জোরে পড়েনি। কান থেকে আঙুল সরাল। দরজার ওপার থেকে অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত আওয়াজ আসছে ক্রমাগত। আওয়াজটাকে পরিস্থিতির সাথে মেলাতে পারছিল না করবী সাথে দরজাটা ছিটকিনি দেওয়ার পরিবর্তে ভেজানো। হাত কাঁপছিল ওর...দরজাটা ঠেলে দিয়েছিল এক নিঃশ্বাসে। রমাকান্ত-মেজদি কারোরই হুঁশ ছিল না তখন। টলমল করে নিচের তলায় নেমে এসেছিল সে। কাউকে আর কিছু বলার অবস্থা ছিলনা করবীর।
মাস ডিঙানোর খবরটা অগত্যা শাশুড়িকে জানিয়েছিল করবী। লজ্জা লেগেছিল বিয়ের এক বছরের মাথায় এমন একটা কথা বলতে। গত দু মাসে রমাকান্তের সাথে কোনো রকম অতিরিক্ত কথা বলেনি করবী হাসতেও পারেনি কোনো হাসির কথা শুনে। রমাকান্তকে খাট পুরো ছেড়ে বিছানা পেতে নিয়েছিল মাটিতে। ক্রমে দূরত্ব আরও বেড়েই চলল...
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের সি।।
তুলি এসে বাবা মায়ের সম্পর্কটা একটু হলেও জুড়তে পেরেছিল। প্রথম সন্তানের খুশিতে করবী ডগমগ হলেও রমাকান্ত পুত্র শোকে ব্যাথিত হয়ে পড়েছিল। পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষায় প্রায় জোর করেই রমাকান্ত করবীকে আবার খাটে তুলে এনেছিল। মুনিয়া আসার পর রমাকান্তের সেই আকাঙ্ক্ষা জেদে পরিণত হয়ছে বুঝেছিল করবী। তুলি মুনিয়া দুজনেই প্রায় তাদের বাবার মতো দেখতে। দুজন ভাগ্যবতীর পর আরেক ভাগ্যবতী আসলে তার ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল সে চিন্তা করবীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার ছোট বোন বনি ওরফে বহ্নিশিখা। বনি এখন কলেজ যাচ্ছে তাই ওর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি করবীর। মণির প্রেগ্নেন্সির খবর দিতে এসেছিল ও...করবীর তখন তৃতীয় মাতৃত্বের আড়াই মাস। কাউকে কিছু না বলেই গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে সাথে লাইগেশন। বহুদিন বাদে অপরেশানের পর বিশ্রাম সুবাদে বাপের বাড়িতে দুই মেয়ে নিয়ে নিশিযাপনে গিয়েছিল সে...
।।করবী গলি নম্বর একের বি।।
অনেকক্ষণ ধরে বাজছে মোবাইলটা। নির্ভীক, তুলির কথায় জামাই ষষ্ঠীতে দিয়েছে ওটা। রিং হতে হতে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে আর গোল হয়ে ঘোরে। ওই অবস্থায় ফোনটা দেখতে বেশ মজা লাগে করবীর। চোখ খুলে সবুজ বোতাম টিপে ফোনটা কানে ধরল-
“কি গো মা...কতক্ষণ ধরে ফোন করছি ঘরে ছিলে না নাকি?”
“না না বল ওই একটু...”
“হ্যাঁ শোন...আজ ডাক্তারের কাছে চেকআপে গিয়েছিলাম। ও নিয়ে গেছিল...ডাক্তার বলল সব ভালো আছে। আমার প্রেশারটা একটু হাই তবে বেশি চিন্তা করতে না করেছেন।”
“যা বলেছেন মেনে চলিস। বেশি দৌড় ঝাঁপ করবিনা। আর ঠিকঠাক খাবি বুঝলি? আমি আসছে রবিবার পারলে যাব তোর বাড়ি।”
“হুম জানি কিন্তু আমার পেটটা একটুও ফোলেনি জান? ওখানে যারা এসেছিল সবারই ফোলা। ওদের সাথে কথা বলছিলাম বলল পেটের মধ্যে গুঁতা মারে...”
“তোরও মারবে একটু অপেক্ষা কর।” মেয়ের কথায় হালকা হেসে জবাব দিল করবী। “নে এবার বিশ্রাম নে...”
তুলির দু মাস চলছে প্রথম সন্তান। নির্ভীক, তুলি দুজনেই খুব উত্তেজিত। ওদের দেখে আনন্দ পায় করবী। তুলি এই অবস্থায় খালি এখানে আসতে চায় অনেক ভুলিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। প্রতি মাসেই একবার করে তুলির বাড়ি যাওয়ার অনুরোধ করেছে নির্ভীক। ফোন কেটে আবার স্ট্যান্ডবাই মোড ছেড়ে ফিরে এল করবী।
।।করবী গলি নম্বর একের সি।।
হঠাৎ লোডশেডিং ও হয়ে গেছে। অন্ধকারে সেই হিজিবিজিগুলো কেমন যেন ঘিরে ধরছে করবীকে। এগুলো নতুন নয় সবসময়েই তো ছিল তার সাথে...মোবাইলের স্ক্রিনে সময় দেখল সে। দুটো বারো... বারান্দায় মুনিয়ার ছাতাটা শুকাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সবেই এল। ভিজে গেছে বোধয় তাই ডাক না দিয়েই বাথরুমে ছুটেছে। সেলাইয়ের বাক্সটা গুছিয়ে রেখে উঠে পড়ল করবী। কারাখানা থেকে চলে এসেছে রমাকান্ত। বোধয় মেয়েকে নিয়ে একসাথেই ঘরে ঢুকেছে। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে আবার বসতে হবে কাজ নিয়ে। ব্লাউজটা আজই শেষ করতে হবে কাল অর্ডার সাপ্লাইয়ের শেষ দিন। ডলিকে অনেক বলার পর দুদিন বাড়িয়েছিল। মুনিয়ার পড়াশুনার জন্য এভাবেই কিছু অতিরিক্ত রোজগারের চেষ্টা করে করবী। দরজার পাশে রাখা মুনিয়ার ভিজে ব্যাগটা তুলে নিল সে। নোটের খাতাটা পুরো ভিজে গেছে। সাথে ভিজেছে রবিবারের খবর কাগজটাও। প্রতি রবিবার মুনিয়া ফেরার পথে কিনে আনে খবর কাগজটা। ভালো ভালো গল্প ছাপে ওরা রবিবারের পাতায়। ভাত খাওয়ার পর সে সব গল্প পড়ে শোনায় করবীকে আর করবী নিজের গল্প সেলাই করে দেয় ব্লাউজের প্রতিটা ভাঁজে। মেয়ের কিনে আনা পুরনো কাগজগুলো যত্ন করে রাখে সোমবারের তাকে।
এভাবে অনেক কাগজ জমে গেছে। এই কাগজ গুলো বিক্রি করতে দেয়না করবী...বে-বারের দুপুরগুলোতে মুনিয়ার আধেক স্বপ্ন পূরণের হেম ফোঁড় ছেড়ে সে পেন্সিল দিয়ে কাগজে গোল দাগ দিয়ে খোঁজ করে বেড়ায় মুনিয়ার বাদবাকি উপযুক্ত স্বপ্নের।
(অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস)
।।করবী গলি নম্বর দুই।।
বি.এ সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা শেষের আগের রাত। খুব গরমে মাথার উপর পাখাটা যতই জোরে ঘুরুক না কেন বড্ড আস্তে বলে মনে হয়। করবী বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া অস্বস্তি জনক ঘাম মুছে নিচ্ছে। সংসারের কাজ মিটিয়ে পড়তে বসতে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছিল। এখন রাত দেড়টা বাজে। খাটে অকাতরে ঘুমচ্ছে চিনু আর বনি। খুব দুষ্টু হয়েছে দুটোতে। ওদের সামলাতে নাকানিচোবানি খেতে হয় সকলকে। তবুও এটাই শান্তি বাড়িতে কারোর কথা না শুনলেও করবীকে ভয় পায় তার ছোট ভাই চিনু আর বোন বনি। সবসময় দিদি দিদি করে আঁকড়ে থাকে। চিনুর জন্মের পর থেকেই দায়িত্ব পড়েছিল করবীর উপর। তখন করবী মাত্র পনেরো। মায়ের মতোই চিনুকে মানুষ করেছে সে-খাওয়ানো পড়ানো স্কুলে ভর্তি করা, পড়তে বসানো থেকে সবকিছু। তার দু বছর পর আবার দায়িত্ব বাড়ল। তখন থেকেই তিন ভাই বোন এক ঘরেই থাকে। বনি এখনও বেশ ছোট আর চিনু স্কুলে যাচ্ছে সবে সবে। এই সময়ে ওদের ঘুম ভাঙলে পড়া মাথায় উঠবে তাই টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পরীক্ষার দিনে কাজ চালাচ্ছে সে। বই থেকে মুখ তুলতেই চোখটা ধাঁধিয়ে গেল করবীর। অনেকক্ষণ আলোর মধ্যে থেকে অন্ধকারে তাকালে ওর চোখের সামনে প্রচুর হিজিবিজি ঘুরে বেড়ায়। সাথে কম আলোয় বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রভাব বেশ ভালোই পড়েছে ওর চোখে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসে, ওর সাথে চোখ থেকে মাথার যন্ত্রণাটা বেশ কিছুক্ষণ শুরু হয়েছে। “এই দিদি হিসি পেয়েছে...” খাটের কাছ থেকে চিনুর ঘুম জড়ানো গলা ভেসে এল না?
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের এ।।
করবীদের বাড়িটা বেশ বড়ই। সেটাকে গত আঠাশ বছর ধরে যদিও আর আমার বাড়ি বলা হয়নি ওর। শুনেছে ওই বাড়িটা ওর বাবার অনেক কষ্টের অনেক বিনিদ্র রাতের অনেক ত্যাগের ফসল। করবী যখন দুবছরের তখন ভাড়া বাড়ির একটা ঘর ছেড়ে এই বাড়িতে চলে আসে ওরা। তখন শুধু নিচের তলার দুটো ঘর ছিল। নিপু তখন মায়ের পেটে। তারপর দোতলা হলো, পরিবার বাড়ল। মণি আর বিলু দোতলার ঘরে মায়ের কাছে ঘুমাতো। নিচের একটা ঘরে বাবা- নিপু আর একটা ঘরে করবী একা। মায়ের থেকে কেমন দূরে সরে গেছিল সে। বোন ভাইদের সামলাতে সামলাতে মা-ও যেন তার চোখের সামনে একজন অন্য নারী হয়ে উঠছিল। সংসারের ভার পড়েছিল ওর উপর। প্রতিদিন উনুন থেকে গরম চাটুটা নামিয়ে ছুট লাগাতো মোটর সাইকেলের আওয়াজ লক্ষ্য করে। বাবা ফিরলে পায়ে জল দিয়ে নিজে মোটর সাইকেল ঠেলে নিয়ে আসতো গ্যারেজে। বদলে মিলত বাবার অপত্য স্নেহ মাখানো হাসি। করবীর বাবা ভালো মানুষ। এলাকার সকলেই সম্মান করেন তাঁকে। শ্যামবর্ণ এবং তিনি পুরুষ বলেই হয়তো তার রূপ নিয়ে কখন কথা ওঠেনি এবং দিব্যি স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে সংসার করছেন। ছোটবেলায় করবী শীতলা পুজোয় মামার বাড়ি গিয়ে একবার দিদিমাকে বলতে শুনেছিল সে একদম তার বাবার মতো দেখতে আর যে মেয়ে তার বাবার মতো হয় সে নাকি খুব ভাগ্যবতী। এরকম কথা মণি আর বনির বেলায় বলতে শোনেনি সে।
দেরী হলেও কার্ড ছাপা হয়ে বাড়ি এল। লাল কার্ডে একটা সোনালী ঘোমটা টানা মুখ নিচে লেখা ‘শুভ বিবাহ’ একটা নীল রাংতার প্রজাপতিও ছিল কার্ডটাতে। চিনু বাবার সাথে গিয়ে পছন্দ করেছিল কার্ডটা। সিঁদুর হলুদের ছাপ লাগিয়ে বাবা মায়ের সাথে সেও গিয়েছিল আত্মীয়দের বাড়ি তার সমবয়সী ভাই বোনদের ভালো করে বলে আসার জন্য। সে এখন বড় হয়ে গেছে। রাতে একা শোয় দোতলার একটা ঘরে। বনি করবীর সাথে একতলার ঘরে। নিপু আর বিলু রাতে দেরিতে বাড়ি ঢুকছে কদিন ধরে। তাই বাবা বাইরের ঘর ছেড়ে দোতলার ঘরে ঘুমাতে যান। আবার হয়তো স্থান পরিবর্তন হবে। আর সব থেকে বড় পরিবর্তন হবে করবীর। অনেক চেষ্টার পর করবীর জন্য পাত্র পাওয়া গেছিল তবে উপযুক্ত কিনা সেটা বিচার করার মানসিকতা বোধয় সেই মুহূর্তে কারোরই ছিল না। বয়েস বাড়ছিল করবীর পিছনে ছিল মণি। তবে তার জন্য সুপাত্রটি দোর গোড়ায় অপেক্ষায় আছে দেখে করবীর মা তার বড় মেয়ের বিয়ের জন্য তীব্র ভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ভালো দামেই বর কিনেছিলেন করবীর বাবা তার জন্য। বিয়ের আগে পাকা দেখার দিন করবী কয়েক মিনিটের জন্য তার ভবিষ্যতের সামনে একবার দাঁড়িয়ে ছিল। পাত্র পক্ষের মধ্যে থেকে একজোড়া চোখ যেন তাকে ক্ষুধার্ত পশুর মতো গিলে চলেছে তবে শুভ দৃষ্টির সময়ে কল্যাণীয়া করবী দত্তের কল্যাণীয় রমাকান্ত বণিককে একটু অন্য রকম লেগেছিল। বলা যেতে পারে কিছুই লাগেনি...তন্দ্রাচ্ছনের মতো আত্ম সম্প্রদান করে ফেলেছিল কন্যা সম্প্রদানের আগেই। শ্বশুর বাড়ি চলে আসার আগে দিদিমা আশীর্বাদ করে বলেছিল “অখণ্ড সৌভাগ্যবতী হও...” বাকি আরও অনেক কথা বলেছিল দিদিমা কিন্তু কেন জানিনা ওই টুকু শোনার পর মাথাটা কেমন ভারী হয়ে এসেছিল করবীর। রমাকান্ত খুচরো শ্যাকরা টুকটাক কাজ জানে দুঁদে শ্যাকরাদের মতো গয়না তৈরি করতে না পারলেও ছোটখাটো অশৈল্পিক কাজ করে মোটামুটি আয় করে। বাড়িতেই ছোট্ট কারখানা। উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করার পর রোজগার পর্ব শুরু হয় তার। একমাত্র রূপের দিক থেকে হয়তো সে করবীর উপযুক্ত বলে এই বিয়েটা এতো গুছিয়ে হয়ে গেল! এতদিন নিরাভরণ থাকার পর বাবা মায়ের দেওয়া এত গয়না খুব ভারী লাগছিল করবীর।
।।করবী গলি নম্বর একের এ।।
কাছাকাছি কথাও খুব জোরে বাজ পড়ল।
“মুনিয়া কখন ফিরবে? আনতে যাব নাকি স্টেশনে?”
“কটা বাজে?” রমাকান্তের কথায় চোখ বুজেই জবাব দিল করবী।
“সওয়া একটা...”
“দুটো নাগাদ যেও একবার। বৃষ্টিতে ট্রেন লেট আসবে...”
“স্টেশনে খুব জল জমে যাবে ততক্ষনে... বাইরে বৃষ্টির যা বহর!” বলতে বলতে চলে গেল রমাকান্ত।
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের বি।।
সেদিনও খুব বাজ পড়ছিল। করবীর মেজো জা সোমা ষষ্ঠী পুজো সেরে আঁতুড় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছে। দুপুর বেলা তাই ছোট্ট রিঙ্কুকে ঘুম পাড়িয়ে ঘরে ফিরে বিয়েতে পাওয়া শরৎ রচনাবলীটা নিয়ে শুয়েছিল সে। খুব মিষ্টি হয়েছে মেয়েটা সংসারের কাজের পর ওকে নিয়েই সময় কাটে করবীর। তার ওপর দুদিন ধরে শরীরটাও ভালো লাগছে না সে কথা কাউকে জানায়নিএমনকি রমাকান্তকেও না। বিয়ের দশ মাস পেরিয়েছে সবে তাই নিজের সমস্যা গুরুতর না হলে কাউকে কিছু জানাবার দরকার আছে বলে মনে করে না করবী। বিয়ের পর ও বাড়ি যায়না তেমন, ভাইবোনেরাই আসে দেখা করতে। অষ্টমঙ্গলার পর থেকে বাবা মায়ের সাথে দেখা হয়নি তার। সমস্যাটা মেজদিকে বলার কথা ভেবে শরৎ রচনাবলীতে পেজমার্ক গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর ঘরে যাচ্ছিল সে। মেজো ভাসুর এসময় বাড়ি থাকেন না। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। দালানে গ্রিলের ফাক থেকে আকাশ চেরা আলো করবীর চোখে পড়তেই দু কানে আঙুল চেপে ধরল। বাজটা যদিও বেশি জোরে পড়েনি। কান থেকে আঙুল সরাল। দরজার ওপার থেকে অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত আওয়াজ আসছে ক্রমাগত। আওয়াজটাকে পরিস্থিতির সাথে মেলাতে পারছিল না করবী সাথে দরজাটা ছিটকিনি দেওয়ার পরিবর্তে ভেজানো। হাত কাঁপছিল ওর...দরজাটা ঠেলে দিয়েছিল এক নিঃশ্বাসে। রমাকান্ত-মেজদি কারোরই হুঁশ ছিল না তখন। টলমল করে নিচের তলায় নেমে এসেছিল সে। কাউকে আর কিছু বলার অবস্থা ছিলনা করবীর।
মাস ডিঙানোর খবরটা অগত্যা শাশুড়িকে জানিয়েছিল করবী। লজ্জা লেগেছিল বিয়ের এক বছরের মাথায় এমন একটা কথা বলতে। গত দু মাসে রমাকান্তের সাথে কোনো রকম অতিরিক্ত কথা বলেনি করবী হাসতেও পারেনি কোনো হাসির কথা শুনে। রমাকান্তকে খাট পুরো ছেড়ে বিছানা পেতে নিয়েছিল মাটিতে। ক্রমে দূরত্ব আরও বেড়েই চলল...
।।করবী গলি নম্বর দুইয়ের সি।।
তুলি এসে বাবা মায়ের সম্পর্কটা একটু হলেও জুড়তে পেরেছিল। প্রথম সন্তানের খুশিতে করবী ডগমগ হলেও রমাকান্ত পুত্র শোকে ব্যাথিত হয়ে পড়েছিল। পুত্র লাভের আকাঙ্ক্ষায় প্রায় জোর করেই রমাকান্ত করবীকে আবার খাটে তুলে এনেছিল। মুনিয়া আসার পর রমাকান্তের সেই আকাঙ্ক্ষা জেদে পরিণত হয়ছে বুঝেছিল করবী। তুলি মুনিয়া দুজনেই প্রায় তাদের বাবার মতো দেখতে। দুজন ভাগ্যবতীর পর আরেক ভাগ্যবতী আসলে তার ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল সে চিন্তা করবীর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার ছোট বোন বনি ওরফে বহ্নিশিখা। বনি এখন কলেজ যাচ্ছে তাই ওর কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো মনে হয়নি করবীর। মণির প্রেগ্নেন্সির খবর দিতে এসেছিল ও...করবীর তখন তৃতীয় মাতৃত্বের আড়াই মাস। কাউকে কিছু না বলেই গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে সাথে লাইগেশন। বহুদিন বাদে অপরেশানের পর বিশ্রাম সুবাদে বাপের বাড়িতে দুই মেয়ে নিয়ে নিশিযাপনে গিয়েছিল সে...
।।করবী গলি নম্বর একের বি।।
অনেকক্ষণ ধরে বাজছে মোবাইলটা। নির্ভীক, তুলির কথায় জামাই ষষ্ঠীতে দিয়েছে ওটা। রিং হতে হতে কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে আর গোল হয়ে ঘোরে। ওই অবস্থায় ফোনটা দেখতে বেশ মজা লাগে করবীর। চোখ খুলে সবুজ বোতাম টিপে ফোনটা কানে ধরল-
“কি গো মা...কতক্ষণ ধরে ফোন করছি ঘরে ছিলে না নাকি?”
“না না বল ওই একটু...”
“হ্যাঁ শোন...আজ ডাক্তারের কাছে চেকআপে গিয়েছিলাম। ও নিয়ে গেছিল...ডাক্তার বলল সব ভালো আছে। আমার প্রেশারটা একটু হাই তবে বেশি চিন্তা করতে না করেছেন।”
“যা বলেছেন মেনে চলিস। বেশি দৌড় ঝাঁপ করবিনা। আর ঠিকঠাক খাবি বুঝলি? আমি আসছে রবিবার পারলে যাব তোর বাড়ি।”
“হুম জানি কিন্তু আমার পেটটা একটুও ফোলেনি জান? ওখানে যারা এসেছিল সবারই ফোলা। ওদের সাথে কথা বলছিলাম বলল পেটের মধ্যে গুঁতা মারে...”
“তোরও মারবে একটু অপেক্ষা কর।” মেয়ের কথায় হালকা হেসে জবাব দিল করবী। “নে এবার বিশ্রাম নে...”
তুলির দু মাস চলছে প্রথম সন্তান। নির্ভীক, তুলি দুজনেই খুব উত্তেজিত। ওদের দেখে আনন্দ পায় করবী। তুলি এই অবস্থায় খালি এখানে আসতে চায় অনেক ভুলিয়ে রাখা হয়েছে ওকে। প্রতি মাসেই একবার করে তুলির বাড়ি যাওয়ার অনুরোধ করেছে নির্ভীক। ফোন কেটে আবার স্ট্যান্ডবাই মোড ছেড়ে ফিরে এল করবী।
।।করবী গলি নম্বর একের সি।।
হঠাৎ লোডশেডিং ও হয়ে গেছে। অন্ধকারে সেই হিজিবিজিগুলো কেমন যেন ঘিরে ধরছে করবীকে। এগুলো নতুন নয় সবসময়েই তো ছিল তার সাথে...মোবাইলের স্ক্রিনে সময় দেখল সে। দুটো বারো... বারান্দায় মুনিয়ার ছাতাটা শুকাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে সবেই এল। ভিজে গেছে বোধয় তাই ডাক না দিয়েই বাথরুমে ছুটেছে। সেলাইয়ের বাক্সটা গুছিয়ে রেখে উঠে পড়ল করবী। কারাখানা থেকে চলে এসেছে রমাকান্ত। বোধয় মেয়েকে নিয়ে একসাথেই ঘরে ঢুকেছে। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়িতে সুখটান দিচ্ছে।
দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে আবার বসতে হবে কাজ নিয়ে। ব্লাউজটা আজই শেষ করতে হবে কাল অর্ডার সাপ্লাইয়ের শেষ দিন। ডলিকে অনেক বলার পর দুদিন বাড়িয়েছিল। মুনিয়ার পড়াশুনার জন্য এভাবেই কিছু অতিরিক্ত রোজগারের চেষ্টা করে করবী। দরজার পাশে রাখা মুনিয়ার ভিজে ব্যাগটা তুলে নিল সে। নোটের খাতাটা পুরো ভিজে গেছে। সাথে ভিজেছে রবিবারের খবর কাগজটাও। প্রতি রবিবার মুনিয়া ফেরার পথে কিনে আনে খবর কাগজটা। ভালো ভালো গল্প ছাপে ওরা রবিবারের পাতায়। ভাত খাওয়ার পর সে সব গল্প পড়ে শোনায় করবীকে আর করবী নিজের গল্প সেলাই করে দেয় ব্লাউজের প্রতিটা ভাঁজে। মেয়ের কিনে আনা পুরনো কাগজগুলো যত্ন করে রাখে সোমবারের তাকে।
এভাবে অনেক কাগজ জমে গেছে। এই কাগজ গুলো বিক্রি করতে দেয়না করবী...বে-বারের দুপুরগুলোতে মুনিয়ার আধেক স্বপ্ন পূরণের হেম ফোঁড় ছেড়ে সে পেন্সিল দিয়ে কাগজে গোল দাগ দিয়ে খোঁজ করে বেড়ায় মুনিয়ার বাদবাকি উপযুক্ত স্বপ্নের।
সমাপ্ত
(অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস)
1 comments:
্কি সুন্দর লিখেছিস রে!!! খুব সুন্দর প্লটে একটু একটু করে উতরেছিস। ভাল রে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন