শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

অলোকপর্ণা



অলোকপর্ণা


হাবুলদা খুব ভালো, নিজের ভাগের থেকে মাঝে মাঝে ঘুগনি বাঁচিয়ে তাকে দেয়। হাবুলদা কাছে এলেই তার গায়ের ইস্পিরিং এর মতো লোমগুলো গায়ে লাগে। সুরসুরি লাগে। হাবুলদা মাঝে মাঝে গালে গাল ঘষে দেয়, দাঁড়ি ফুটে গিয়ে জ্বালা করে। “রেজ্জাক! টেবিল নাম্বার চারে দে এটা!” হাবুলের থেকে সাদা মোটা চিনেমাটির প্লেট তিনটে নিয়ে ছেলেটা নড়বড় করতে করতে চার নম্বর টেবিলের দুজন মহিলা আর এক তরুনীর কাছে পৌঁছে দেয়। যতক্ষণ না ঘুমের মধ্যে মাকে বাসে উঠে পড়তে দেখে ততক্ষণ সে এদের সাথে মায়ের কোনো মিল পায় না, তাই এদের কাউকে দেখেই তার মায়ের কথা মনে পড়ে না। হাবুলদা আজও সেই হাফ প্যান্টটাই পড়েছে। গত তিন মাসে একদিনও তাকে অন্য কিছু পরতে দেখেনি রেজ্জাক। সামনে পুজো আসছে, হাবুলদা বলেছে রেজ্জাককেও নিজের মতো লাল চপ্পল কিনে দেবে। এর মধ্যে অবশ্য অনেক কিছুই হাবুল তাকে দিয়ে দিয়েছে, নিজের দুসেট ছোট গেঞ্জি হাফপ্যান্ট, গামছা, চিরুনি, একটা ব্রাশ। হাবুলের ছোটো হলেও গেঞ্জি দুটোয় হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা পড়ে যায় রেজ্জাকের। প্যান্ট পরার দরকারই হয়না। হাফপ্যান্ট দুটো রেজ্জাক বাড়ি ফিরে ভাইজানকে দেবে বলে ঠিক করেছে। হাবুলদা যখন হাসে তখন ভাইজানের মতো ভুরু কুঁচকে যায়। রেজ্জাক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ভাইজান না হাবুলদা, কে তাকে বেশি ভালোবাসে ভাবতে ভাবতে রেজ্জাক পাঁচ মাথা মোড়ের ছোটো, পুরনো, বিখ্যাত চাইনিজ হোটেলটার দোতলার রান্না ঘরের মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রাচীন শহরটা ঘুমোয় না, রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে জেগে থাকে। মত্ত নিশাচর মানুষগুলো টলতে টলতে তাকে দোলা দিয়ে যায়, তাও সারারাত যশোর রোডের ধারে ব্রিজের নীচের ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’-এ তাকে সঙ্গমরত দেখা যায়, শোভাবাজারের গঙ্গার ধার নেশাগ্রস্থ হয়ে তাকে জীবনানন্দ আওড়াতে শোনে, উত্তরের হলুদ গলি গাঢ় প্রসাধনীতে ঝলমল করে উঠে শরীরের হাত ধরে আঁধারে ডুবে যায়, শিয়ালদহ স্টেশান ছাড়িয়ে সবুজের মধ্যে আট বছর বয়সী তাকে ডেন্ড্রাইট হাতে হারিয়ে যেতে দেখে রাতের বয়স বাড়ে। সারারাত জেগে থাকায় পুবদিকে শহরের চোখ তখন লাল।



দ্বৈপায়ন বেরিয়ে পড়েছে। না, আক্ষরিক ভাবে বললে বলা হবে দ্বৈপায়নকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মেস থেকে। শিয়ালদহ স্টেশানের বাইরে সিঁড়িতে বসে সে লোক গুনছে। এখনও পর্যন্ত চশমাধারীরাই এগিয়ে- ১৪৮/১৩৩। এখানে না এলে বোঝাই যেত না কোলকাতা শহরে এতো মানুষ চোখে কম দেখে! অবশ্য খবরের কাগজ দেখেই এটা বুঝে যাওয়া উচিত ছিল তার, শিরোনামে কি এমনি এমনি ‘খোলা ম্যানহোল দিয়ে পড়ে শিশুমৃত্যু’, ‘সাতসকালে সিটি রোডে খুন’, ‘কেউ এগিয়ে এলেন না অসুস্থ বৃদ্ধাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে’ আসে! নাহ, দিন কে দিন আরও বোকা হয়ে যাচ্ছে সে। তার চেনা শোনার মধ্যে নিজের বাবার, দিদির, জামাইবাবুর,- সবার চশমা আছে। এরমধ্যে বাবারটা ছোটবেলায় গ্লোব দেখতে সাহায্য করত। এছাড়া আর কোনো চশমার সাথে দ্বৈপায়নের গত উনত্রিশ বছরে সরাসরি এনকাউন্টার হয়নি। চশমাধারীদের সে সফল ও বুদ্ধিমান বলে মনে করে। এসব প্রসঙ্গ মনে আসতে দ্বৈপায়ন গা থেকে আলস্য ঝেড়ে পাবলিক টেলিফোনের দিকে এগিয়ে আসে। দিদির নম্বরটা হাজার চেষ্টাতেও তার মনে পড়েনি। অগত্যা সে একমাত্র টাকাটা দান করে দিয়ে বাবার নম্বর ডায়াল করে।
“হ্যালো?”
“পিকু!”
“হ্যাঁ বাবা।”
“কোথায় ছিলে এতদিন!”
“মেসে বাবা।”
“কিন্তু তোমার দিদি যে বলেছে ওখানে ফোন করে পায়নি তোমায়।”
“ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে।”
“ওহ, সব ভালো তো পিকু?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“তোমার দিদির তোমাকে দরকার। না, সে বলেনি, আমার মনে হয়েছে। পারলে যোগাযোগ কোরো।”
“হ্যাঁ। তুমি দিদিকে বোলো এই নম্বরে ফোন করতে।”
“আচ্ছা। শোনো, আমি একটু পরে ফোন করি তোমায়? সাবধানে থেকো, আর বুদ্ধি করে চলো।”
“নিশ্চয়ই বাবা।”
তেত্রিশটা সেকেন্ড কাটতে না কাটতে ফোন রেখে দেন ডঃ ঘোষ। নিজের জায়গায় ফিরে আসতে আসতে দ্বৈপায়ন কড় গুনে হিসেব করে দেখে সেকেন্ডের হিসেবে তার সাতাশটা পয়সা বাবা নষ্ট করেছে। আর তখনই খেয়াল হয় মেস থেকে বিতাড়িত হওয়ার খবর বাবাকে দেওয়া হলো না! নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই অবাক হয়ে যায় দ্বৈপায়ন। সে এটাও জানে যে সারাদিনে আজ বাবার আর সময় হবে না বুথে ফোন করার। বাবা অকারণে তাকে সর্বক্ষণ “বুদ্ধি করে” চলতে বলে না! ধপ করে সিঁড়িতে বসে পড়ে সে। যদি বাবা দিদিকে নম্বরটা দেয় তাহলে একটা উপায় হতে পারে, না হলে এখন খালি পায়ে সুদূর বালিগঞ্জে দিদির কাছে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। পাশ ফিরতেই একটা চেনা মুখ দেখতে পায় সে। সহাস্যে সেটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
“গৃহহারা?”
“আপনি জানলেন কি করে?”
বৃদ্ধের দাঁড়ি কমা মাখা জঙ্গুলে মুখ আন্দোলিত হয়ে হাসি খেলে যায়। “জানি।”
“আপনিও ঘরছাড়া?”
“উঁহু। গোটা কোলকাতা আমার ঘর। বুঝলে?”
“আপনি তো বিত্তবান!”
“তা নয়, বরং দেনা শোধ করতে করতে অনেকটা জীবন কাটিয়েছি আমি।”
“তাহলে?”
“ভাগ্য বলতে পারো, ক্ষমতাও বলতে পারো। যেখানে বাঙালি, সেখানে আমার ঘর।”
দ্বৈপায়ন বিমোহিত হতে থাকে বৃদ্ধের কথা শুনে, এমনি এমনি এরা বাউল! গুণ থাকতে হয়। একতারা তুলে বাজাতে শুরু করেন বয়স্ক মানুষটি।
“আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে আমার। আপনি কে?”
একতারার আওয়াজে বৃদ্ধের কথা কানে আসে না। সে   জোরে জিজ্ঞেস করে, “কী বলছেন শুনতে পাচ্ছি না!”
একতারার সুর ছাপিয়ে এবার সে শুনতে পায়, “রবি। সবাই চিনবে একডাকে।” অমূল্য হাসিতে বয়স্ক মুখে আলো জ্বলে ওঠে যেন, সন্ধ্যার শিয়ালদহ স্টেশান আলোকিত হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ গান ধরেন।
                  
                   “আমি তারেই জানি তারেই জানি যে জন আমায় আপন জানে -
                              তারি দানে দাবি আমার যার অধিকার আমার দানে।।”

শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড ব্যথার বোধে ঘুম ভাঙলো দ্বৈপায়নের। কিছু বোঝার আগেই কন্সটেবলটি তাকে সিঁড়ি থেকে লাথি মেরে গড়িয়ে দিল। অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্যেও দ্বৈপায়ন টের পেল উচ্ছেদ চলছে, ভবঘুরেদের। রাত নটা নাগাদ পুলিশের তাড়ায় শিয়ালদহ স্টেশান থেকে মৌলালীর দিকে ছুটতে থাকে সে। পথচলতি মানুষের সাথে ধাক্কা লাগে তার, অথচ পুলিশের প্রতি জিনগত ভয়টা তাকে সরি বলতেও সময় দেয় না, ছুটিয়ে নিয়ে চলে। দৌড়োনর মধ্যেই বারবার একটা রবীন্দ্রসংগীত তার মাথায় ঘুরে ঘুরে আসতে থাকে, কেন, সে বোঝে না। “আমি তারেই জানি তারেই জানি”র সাথে ভবঘুরে উচ্ছেদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে ভাবতে ভাবতে পিঠ ভরা ব্যথাটা অগ্রাহ্য করে সে এন্টালীর দিকে ছুটে যায়।


সমস্ত শরীর গোলাচ্ছে কঙ্কাবতীর। এস এন ব্যানার্জী রোড ধরে নিরাপদেই ফিরছিল সে, কনুইয়ের ধাক্কা, বেমালুম উড়ে আসা হিন্দি গানের বখাটে লাইনকে অবজ্ঞার বর্ম দিয়ে প্রতিহত করে। কিন্তু এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। এন্টালীর দিকে মুখ ফিরিয়ে সে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে। শরীর নাড়াতে পারছে না, মাথা ঘুরছে, অদম্য জেদে বমিটা আটকে রেখেছে সে। এক পা হাঁটলেই যেন দুপুরে কলেজে খাওয়া পরোটা আর আলুর দমের উচ্ছিষ্ট গলা বেয়ে বেরিয়ে আসবে। দোপাটি! একমাত্র এই মেয়েটাই তাকে সাহায্য করতে পারত এখন, ইস, ফোনে ব্যালেন্স ভরাতে বলেছিল মা পই পই করে! আলস্যে দেরী করে ফেলেছে কঙ্কাবতী। আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না, ট্রেনটা বেরিয়ে যাবে। রেডি, ওয়ান, টু, থ্রি! গলার মধ্যে আলুর দমের ভগ্নাংশটা ফেরত পাঠিয়ে সে দৌড় লাগায়, শিয়ালদহ স্টেশানে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামে না। সময়ের অনেক আগে দৌড়ে এসেছে কঙ্কাবতী। এই ফাঁকে ফোনে রিচার্য করিয়ে নিতে পারলে ভালো হোত। পিছু ফিরতে টেলিফোন বুথটা নজরে আসে তার, আবার আলস্যের জয়গান বাজিয়ে সে টপ আপ না ভরিয়ে রিসিভার তোলে।
“হ্যালো!”
“দোপা!”
“তুই? এটা কার নাম্বার? ট্রেন পেয়েছিস তো?”
“আহ্‌! থামবি তুই!” অধৈর্য ভাবে বলে কঙ্কাবতী।
“কী হয়েছে তোর? ঠিক আছিস তো?”
কঙ্কাবতীর প্রায় কান্না পেয়ে যায়, “আমার শরীর খারাপ লাগছে খুব, মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে! তুই আসতে পারবি?”
“আমি তো বাসে উঠে পড়লাম! কী হয়েছে? এই তো একটু আগেই ঠিক ছিলি!”
“একটা লোক,” খাবি খায় কঙ্কাবতী।
“কী করেছে! আর ইউ ওকে?”
“ধাক্কা মেরেছে।”
“পড়ে গেছিস নাকি! চোট লেগেছে? দাঁড়া আসছি আমি।”
“না, ঠিক আছি।”
“তাহলে?!” ওপাশ থেকে কয়েকটা বিস্ময় এসে পড়ে।
“মুখে শ্বেতী!”
কিছুক্ষণ কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। কঙ্কাবতী আরও ধৈর্য হারায়, “হ্যালো! হ্যালো!”
“তুই পারিসও বটে! আমি আর একটু হলেই বাস থেকে নেমে পড়ছিলাম! তোর ট্রেন ছেড়ে যাবে না? যা, উঠে পড়!”
“তুই কিছু বলবিনা আমাকে?”
“কি বলবো? হ্যাঁ ডাক্তার দেখাতে পারিস, নিজেকে।” হাসি চাপতে চাপতে কথাগুলো তার কানে এসে ঢোকে। রাগে ফোন কেটে দেয় কঙ্কাবতী। নটা উনত্রিশের ট্রেনটার অ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে যেতেই আবার ফোনের আওয়াজ কানে ঢোকে তার। নিশ্চয়ই দোপাটি, ভুল বুঝতে পেরে এখন ক্ষমা চাইবে। বুথে ফিরে গিয়ে সে ফোনটা তোলে। অপরিচিত মহিলা কন্ঠ বলে ওঠে, “পিকু!”
আরো রাগ চড়ে যায় তার। “কোনো পিকু টিকু নাই এখানে!”
“তুমি কে?”
“আমি যেই হই আপনার কী !” ধমকে ওঠে কঙ্কাবতী।
দমে যাওয়া গলায় মহিলা বলেন, “যেই হও, পিকুকে বলো দিদি ফোন করেছিল।”
“আমি পিকু বলে কাউকে চিনি না, খামোখা আমার ট্রেনটা মিস করাবেন না।” ট্রেনের আওয়াজ ফোনের ওপার অবধি পৌঁছোয়।
“ট্রেন! এটা কোথায়?”
“শিয়ালদা স্টেশান!” ঝাঁঝিয়ে উত্তর দিয়ে সে ফোন নামিয়ে রাখে, “আজব সব!” কাঁধ নাড়িয়ে পুলিশের ভীড় পার করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকে আসে কঙ্কাবতী। মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাব শিয়ালদহর সিঁড়িতে পড়ে থাকে। 

(অলংকরণ – মেঘ অদিতি)