শনিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২

মলয় রায়চৌধুরী



মলয় রায়চৌধুরী

'পাড়া' বলতে ঠিক কী বোঝায়? মহানগরগুলোয় 'পাড়া' জিনিসটা ক্রমশ লোপাট হয়ে চলেছে। বা, বলা যায়, মহানগরের অনুন্নত এলাকাগুলোয় টিকে থাকছে আধখ্যাঁচড়া 'পাড়া'। কলকাতার কেন্দ্র থেকে পাড়া চলে গেছে শহরের পরিধিতে; কসমোপলিসের পরিধি মানেই তো প্রান্তিক। ভুল বললুম, কলকাতায় দলতন্ত্রের দাপটে, তা সে যে দলই রাজত্ব করুক, 'পাড়া'র অস্তিত্ব অবলুপ্ত। আগের দল পাড়ার নতুন নামকরণ করেছিল 'মোহোল্লা', কেন তা জানি না। কিন্তু সেই মোহোল্লায় অংশভাগ ছিলেন কেবল দলের হবুগবুরা। শহরতলি বা গ্রামেও, পশ্চিমবঙ্গে 'পাড়া' সমাজতাত্ত্বিকদের গবেষণার আওতায় চলে গেছে। হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় বসতবাড়িতে যখন থাকতুম, ছোটোবেলায়, পাড়া ছিল জীবন্ত জীবনপ্রক্রিয়া। তারপর তো নাকতলায় যে রাস্তায় থাকতুম তার নাম 'লেটারবক্সপাড়া' হলেও, দুই দলের জগঝম্পতে অঞ্চলটি থেকে পাড়া উবে গিয়ে যে সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। কিংবা, হয়তো, পরস্পরের পরিচিত কয়েকজন মানুষ-মানুষী মহানগরের এক জায়গায় উদ্দেশ্যহীন জড়ো হলে একটা তাৎক্ষণিক পাড়া গড়ে ওঠে ।

আমি এখন মুম্বাইয়ের শহরতলিতে থাকি। এই অঞ্চলে যাঁরা থাকেন তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে পরিচয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যখন পাটনার ইমলিতলা পাড়ায় থাকতুম তখন ওই পাড়ার সবাই সবাইকে চিনতুম; আমরা ছোটোবেলায় চোর-পুলিশ খেলার সময়ে যে কোনো বাড়ির যে কোনো ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়তে পারতুম। এমনকি পাড়ার শিয়া মসজিদে গিয়ে লুকোলেও, নামাজের সময় ছাড়া, নিষেধ করতেন না ইমামসাহেব। মসজিদের সামনে নাজিম-কুলসুম আপাদের বাড়িতেও যে কোনো ঘরে লুকোনো যেত। ইমলিতলা থেকে 'পাড়া' নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেল ধর্মীয় ভেদাভেদ আর জাতিপ্রথার রাজনীতিকরণের কারণে। 'পাড়া' উবে যাবার সঙ্গে ছোটোদের বহু খেলাও, মহানগরে, লোপাট হয়ে গেছে। চোর-পুলিশ, গুলি, লাট্টু ইত্যাদি আর বোধহয় খেলা হয় না। 'পাড়া' জিনিসটার আরেকটা অবদান ছিল - গোপন প্রেম। কসমোপলিসগুলোয়, কিশোর-কিশোরী আর তরুণ-তরুণীদের, প্রৌঢ়রাও বাদ যান না, কাজ-কারবার দেখে আঁচ করতে পারি যে প্রেমও তার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে ফেলেছে ।


আমাদের বিল্ডিঙের তিন দিকে রাস্তা, যার একটি ওয়েস্টার্ন এক্সপ্রেস হাইওয়ে, একটি সার্ভিস রোড আর অপরটি খ্যাত সাঁই-টেমপল স্ট্রিট। হাইওয়ে কখনও ঘুমোয় না; রাতে বরং আওয়াজের রকমফের পায়ে হাইওয়ে উড়তে থাকে নানা বেগবতী আলোগুলোকে ধাওয়া করে। মন্দিরের রাস্তাটা ঘুমোতে বাধ্য হয় কেন-না গাড়ি পার্ক করে চারিদিকের আবাসিকরা চলাচলের অযোগ্য করে দেন মাঝরাতের পর। সার্ভিস রোডটা, যার দুধারে দোকানপাট, আধা-মল, স্কুল, পলিটেকনিক-কলেজ, ফুটপাথ জুড়ে ফল, সবজি আর নানা টুকিটাকি, রাত্রিবালা ঘুমোয় না, ঝিমোয়--যেকোনো সময়ে অটো বা ট্যাক্সি পাওয়া যায়, রাতদুপুরেও, কেননা এই রাস্তাটা সকাল থেকে তার রূপ বদলাতে থাকে। বহু আকাশমুখো আবাসন এই সার্ভিস রোডে আর তার ফ্যাঁকড়াগুলোয়। বেশ কয়েকটা নার্সিং হোম থাকায় রাতের দিকে অ্যামবুলেন্সের হুটার ঘুমন্ত বুড়োদের হুশিয়ারি দিতে-দিতে চলে যায়। ভোরের দিকে বিটকেল নামের চকচকে মোটরগাড়িতে চেপে শুটিং সেরে ফেরেন টিভি-সুন্দরীরা, যাঁরা না ঘুমিয়েও কি করে যে রূপ ধরে রাখেন জানতে ইচ্ছা করে।

সার্ভিস রোডের দু'ধারে, অন্ধকার থাকতে, ভোরবেলা থেকে, কোচিংক্লাসের জন্য কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা জড়ো হতে থাকে, বিভিন্ন বিল্ডিঙের ওপরতলার কোচিং ইন্সটিটিউটে ঢোকার আগে, ছোটো ছোটো পাড়া গড়ে ওঠে। এই সমস্ত কোচিং ক্লাসেও সহজে স্থান পাওয়া যায় না, তার ওপর কোচিং ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ের জন্য ফিজ প্রতিমাসে আমার পেনশনের কয়েকগুণ। বেশ কয়েকটির বিষয়-অনুযায়ী বাৎসরিক চার্জ; এক লক্ষ টাকার কাছাকাছি বা বেশি। সকলেরই ৯৫% এর চেয়ে বেশি মার্কস চাই। আগের বছর যারা মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ে ৯৯% মার্কস পেয়েছিল বা যারা ক্যাট আইআইটি জেইইতে সফল হয়েছে তাদের মুখের ছবি দিয়ে বিরাট-বিরাট ব্যানার টাঙিয়েছে বিভিন্ন কোচিং ক্লাস, সেসব ব্যানারের মাপ এলাকার খুচরো রাজনৈতিক নেতাদের মুখের ব্যানারের চেয়ে বড়।


এই প্রায়ান্ধকার ভোরেও কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের কাউকে দেখি না যে সে ঘুম থেকে উঠেই চলে এসেছে, পিঠে বইখাতার রাকস্যাক ঝুলিয়ে। সকলেই হাল আমলের রঙচঙে পোশাকে। যারা ৯৯% পেতে চায় বা নিজের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে চায়, তারা কেউই যে আনস্মার্ট নয় তাও হয়তো কোচিং ক্লাসেই শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে, জীবনযুদ্ধে লড়াইটা যে অবস্হায় পৌঁছেছে, পার্সোনালিটি তৈরি করার কাজও চলছে পাশাপাশি। পাশ দিয়ে যাবার সময়ে ভেসে আসে পারফিউম। মানুষ যত ধনী হয় ততই তার দেহের গন্ধ নকল হতে থাকে। অবশ্য এক-আধজন যুবতীর হরমোন এতই কড়া যে বৈভবশালী পরিবারের হওয়া সত্ত্বেও পারফিউম দিয়ে তা চাপা পড়ে না। এই সময়ের, ভোর রাতের, বাস-ট্রেনেও যথেষ্ট ভিড় হয়, সেই গাদাগাদি সামলে ফুরফুরে চেহারায় সুগন্ধ বয়ে নিজেদের হাজির করা সহজ নয় নিশ্চই। আমি তো আর বাস-ট্রেনে চাপতে পারি না, তা সারাদিনে যে সময়েই হোক। মোটর সাইকেলেও আসতে দেখেছি ছাত্রদের, পেছনে গার্লফ্রেন্ডকে বসিয়ে, যদিও যারা কিশোর চেহারার তাদের তা চালাবার লাইসেন্স আছে কিনা সন্দেহ। বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের মোটরসাইকেল পাখা মেলে দেয় হাইওয়ের ওপর।

অন্য শহরের কথা জানি না। নতুন এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের এত কাছ থেকে অবজার্ভ করার সুযোগ অন্য শহরগুলোয় ছিল না। আমার স্কুলে পড়ার শেষ পর্বে, কোএডুকেশান থাকলেও, সহপাঠিনীদের সঙ্গে তেমন হৃদ্যতা সম্ভব ছিল না; তারা সবাই আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিল; বয়স্ক সহপাঠীদের দিকেই ছিল তাদের টান। মুম্বাইতে অধিকাংশ স্কুলে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছোলে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড জুটি তৈরি হতে থাকে। সবচেয়ে সুন্দরীরা সৌম্যকান্তি ছেলেদের বয়ফ্রেন্ড হয়ে ওঠে। যে মেয়েটির চটক নেই তার ভাগ্যে বয়ফ্রেন্ডটিও তেমন জোটে। কোচিং ক্লাস শুরু হবার আগে মোটর সাইকেলের সিটে বা দোকানের বন্ধ শোকেসের সামনের চাতালে জুটিতে বসে গ্যাঁজায় যারা তাদের দেখে এরকম আন্দাজ করে নিয়েছি। পড়াশুনায় সকলেই নিশ্চয় ভালো নয়তো কোচিং ক্লাসেও সিট পাওয়া কঠিন। ভোরবেলা থেকেই জেরক্সের দোকানে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত দেখে ধারণাটা আরও দৃঢ় হয়।

ইংরেজি পড়ার, শেখার ও বলার ক্লাসের পর্ব ফুরোলে অন্যান্য বিষয় ও ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং ক্লাস শুরু হয়। কোচিং ক্লাস শেষ হবার পর দলে-দলে শিশুদের দেখা মেলে স্কুলের পথে। মায়েরা টানতে-টানতে বা অটো বা গাড়িতে করে নিয়ে চলেছেন। তারই ফাঁকে কাঁধে নানা আকারের ব্যাগ ঝুলিয়ে অফিসযাত্রী আর যাত্রিণী । তারপর বেরোন বিভিন্ন বয়সের মহিলা ও পুরুষ, বাজারে কেনাকাটা করার জন্য। এই মহানগরে লোকে সব সময়ই কিছু না কিছু কিনছে! কোনো দোকান দুপুরে বন্ধ হয় না। রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। দোকানপাট বন্ধ হবার পর সার্ভিস রোডের ওপর এলাকার বিয়ার বার জ্বলে ওঠে রঙিন আলোয়, জড়ো হতে থাকে কত রকমের গাড়ি, রাস্তার দুই ধারে। রাত তিনটে পর্যন্ত ওই ঝিলমিলে আলোগুলো দেখতে পাই আমার ছয় তলার জানলা দিয়ে। মৌমাছির চোখের মতন হয়তো হয়ে ওঠে গাড়ির দিকে এগোতে থাকা মাতালদের চোখ, কারোর কারোর কাঁধে সঙ্গিনীর মাথা। জানলা দিয়ে দেখেছি বিভিন্ন বিল্ডিঙে রাত তিনটের সময়েও লোকে টিভিতে দেখছেন কোনো প্রোগ্রাম বা হয়তো ব্লু ফিল্ম। মদ খাবার জন্য, তা সে বাড়িতে বসে হোক বা বারে, আবগারি দপতরের প্রমাণপত্র প্রয়োজন হয় মুম্বাইতে। মদের দোকানে কিনতে গেলে বা বারে মদ খেতে গেলে যথাযথ চার্জ নিয়ে তারা নিজেরাই দিয়ে দেয় প্রমানপত্রখানা। মাঝে শখের কেক প্রস্তুতকারিণী এক মহিলা বাড়িতে বেশ কয়েকটা বোতল রেখেছিলেন বলে পুলিশের খপ্পরে পড়েন! আমি কেবল সিঙ্গল মল্ট খাই যা ছেলে বা মেয়ে এনে দেয় বিদেশ থেকে--প্রমাণপত্র ছাড়াই খাই। প্রতিদিন মদ খাবার প্রমাণপত্র নিতে হলে ডাক্তারের লেখা চিঠি চাই ।

সার্ভিস রোডের ধারে বৃদ্ধদের জন্য ঝকঝকে-তকতকে একটা আড্ডা মারার ঘর তৈরি করে দিয়েছে মুম্বাই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন-- ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে যাঁরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন তাঁরা এখানে বসে জিরিয়ে নেন, স্ত্রী বা ছেলের বউয়ের বারণ-করা সিগারেটটি ফুঁকে নেন। অবশ্য এই ঘরে বসে কোচিং ক্লাসের কচি খুকিদের দেখার আর তাদের কথাবার্তা শোনার আনন্দটাও পেয়ে যান সেই ফাঁকে। নতুন প্রজন্মের খোকা-খুকুদের কথাবার্তা শোনেন মুচকি মুখে। গ্যাপ যে কতগুলো জেনারেশানের তা কপালের ভাঁজের সংখ্যা দিয়ে টের পাওয়া যায়। এলাকাটা গুজরাতিতে ওপচানো; ফলে বুড়োরা, ভেতরে-ভেতরে যাই হোন, মুখে সংরক্ষণশীল। অধিকাংশ গুজরাতিরা ব্যবসাদারি করেন, আর সে কারণে 'বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকা পড়েন, যে পত্রিকাটিতে গত বছর আমার সম্পর্কে বড়সড় ফোটো দিয়ে একটা সাক্ষাৎকার-নির্ভর প্রবন্ধ লিখেছিলেন নয়নিমা বসু। সেই থেকে কয়েকজন জানেন যে আমি কবিতা লিখি।

আমার সকালের হাঁটাহাঁট শেষে, দুধের প্যাকেট আনতে গিয়ে যেদিন দেখি বুথটা তখনও খোলেনি, আমিও অবসর সময়টা খুকিদর্শন আর ছেলেমেয়েদের কথাবার্তা শোনায় খরচ করি। অত্যন্ত বোল্ড প্রজন্ম, সন্দেহ নেই। নিজেদের মধ্যে এরা প্রায় সবাই ইংরেজিতে বা মুম্বাইয়া হিন্দিতে কথা বলে। অধিকাংশ সময় ইংরেজিতেই, যেহেতু শিট, ফাক, কান্ট, আসহোল, সাকার, হুকার, ফাক ইউ ইত্যাদি শব্দ মাতৃভাষায় বললে যেমন কাঁচা শোনায়, ইংরেজিতে বললে নোংরা শোনায় না। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় চেতলা বাজারের ওপর ওনার ফ্ল্যাট থেকে প্রতিদিন সকালে নেমে আসতেন বাজার থেকে চরিত্র আর চরিত্রানুযায়ী সংলাপ সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে, কেননা বার্ধক্যে পোঁছে কম বয়সের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমশ ফরম্যাল হয়ে ওঠে।

ইংরেজি ক্লাসের একটি সৌম্যদর্শন তরুণ, যাকে দেখে অনুমান হয় যে সে বোধহয় কোনো তরুণীকে গার্লফ্রেন্ড করতে চায়নি বা সে এতই সোফিসটিকেটেড যে কোনো তরুণী তার বন্ধুনী হবার সাহস যোগাড় করতে পারেনি, প্রায়ই ইংরেজি সংলাপ আওড়ায়। তরুণ-তরুণীরা তার সংলাপ বলার ধরণে আকৃষ্ট হয়ে তাকে ঘিরে থাকে। হয়তো মুম্বাইয়ের কোনো নাটকদলে অভিনয় করে--বহু নাটকদল আছে সোবোতে বা সাউথ বম্বেতে যারা নিয়মিত ইংরেজি নাটক করে। একদিন যখন তরুণটি একটা দীর্ঘ সংলাপ শোনাচ্ছিল সমবেত তরুণ-তরুণীদের, পাশের বিল্ডিঙের দোতলার কোচিং ক্লাসের ইংরেজির অধ্যাপক আমার পাশে এসে বসলেন। ইনিও পারফিউম মেখে বেশ সেজেগুজে আসেন, প্রতিদিন প্রেস-করা ফুলশার্ট আর ট্রাউজারে, নিজে স্কোডা অকটাভিও ড্রাইভ করে। ফিসফিস করে বললেন, শুনুন শুনুন, ছেলেটি যে কবিতাটা আবৃত্তি করছে, সেটা ভালো করে শুনুন। শোনবার চেষ্টা করলুম কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পেলুম না।

অধ্যাপকমশায় ডাকলেন তরুণটিকে। জানতে পারলুম ছেলেটির নাম মন্দার। মন্দারের সঙ্গে তার বন্ধুবান্ধবরাও এলো পেছন-পেছন। অধ্যাপক মন্দারকে আমার পরিচয় দিয়ে বললেন যে ইনিও কবিতা লেখেন। তুমি যে কবিতাটা সবাইকে এতক্ষণ শোনাচ্ছিলে সেটি ইনিও শুনতে চাইছেন। ছেলেটি কুন্ঠিত। আমি বললুম, লজ্জার কি আছে, শোনাও না, তোমার সহপাঠীদের তো শোনাচ্ছিলে, বেশ মনোমুগ্ধকর তোমার কন্ঠস্বর। মন্দার নাটুকে আবৃত্তি আরম্ভ করল, অনেকটা উৎপল দত্তের স্টাইলে। শুনলুম। সমবেত গুজরাতিরা হাততালি দিলেন। তরুণটি ও তার সহপাঠীরা চলে গেলে অধ্যাপক বললেন, ফিসফিস করেই বললেন, জানেন কি যে এটি শেকশপিয়ারের একটি বিখ্যাত সনেট।


নিজেকে নিজে চুপচাপ শোনালুম বিখ্যাত? শেকশপিয়ারের ১৫৪টি সনেটই তো বিখ্যাত। ১ থেকে ১২৬ পর্যন্ত সনেটগুলো একজন পুরুষকে উদ্দেশ্য করে রচিত, যার সঙ্গে কবির অন্তরঙ্গ রোমান্টিক সম্পর্ক। তাঁর সনেটগুলো শেকশপিয়ার উৎসর্গ করেছিলেন ডাবল্যু এইচ নামে রহস্যে মোড়া কোনো একজনকে, যিনি, সমালোচকদের মতে, পেমব্রোকের আর্ল উইলিয়াম হারবার্ট। অবশিষ্ট ১২৭ থেকে ১৫৪ পর্যন্ত সনেটগুলো একজন কৃষ্ণাঙ্গী নারী, যিনি 'ডার্ক লেডি' নামে খ্যাত, এবং যিনি নাকি ব্যভিচারিণী ও কুচুটে, তাঁকে নিয়ে লেখা। শেকশপিয়ারের সনেট শক্তি চট্টোপাধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, ওনার নিজস্ব ডিকশানে। ইনটারমিডিয়েটে, অর্থাৎ এখনকার যা উচ্চমাধ্যমিক, কোর্সে শেকশপিয়ারের ১৮ নম্বর সনেটটি পাঠ্য ছিল। আমাদের ইংরেজির অধ্যাপক ড. দাশগুপ্ত, যিনি আমার হাতে বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকা দেখে আমায় ওনার প্রিয় ছাত্রের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন, ১৮ নম্বর সনেটটি পড়াবার সময় বলেছিলেন, 'শেকশপিয়ারের সনেট আগু-পিছু ক্রিটিকাল অ্যাসেসমেন্ট করতে হয়'। ওই আগু-পিছু ইশারাখানা উনি নিজেই পরে খোলোশা করেছিলেন।

মন্দারের অধ্যাপকমশায়কে আমি বললুম, মনে হচ্ছে সনেটটা আপনার বেশ প্রিয়, শোনান না, শুনি, একটু রয়েসয়ে শোনান যাতে বুঝতে পারি। উনি শোনালেন।


A woman's face with Nature's own hand painted

Hast thou, the master-mistress of my passion;
A woman's gentle heart, but not acquainted
With shifting change, as is false women's fashion;
An eye more bright than theirs, less false in rolling,
Gliding the object whereupon it gazeth;
A man in hue, all 'hues' in his controlling,
Much steals men's eyes and women's souls amazeth.
And for a woman wert thou first created.
Till Nature, as she wrought thee defeated
By adding one thing to my purpose nothing.
But since she pricked thee out for women's pleasure,
Mine by thy love and thy love's use their treasure.

১৯৫৬ এর পর শেকশপিয়ারের সনেট শুনলুম পর-পর দু'জনের কন্ঠে। ১৯৫৬ সালের পরেও শুনেছি, কাঠমান্ডুতে, ১৯৬৬ সালে, চরসের নেশায় চুর ট্রেশাম গ্রেগ নামে এক হিপির কন্ঠে। মন্দার শোনালো ভোরের আলো ফোটার সময়। গ্রেগ শুনিয়েছিল মাঝরাতে, খড়ের ওপর পাতা চাদরের বিছানায় শুয়ে -- রিচার্ড বার্টনের ঢঙে।

অধ্যাপকমশায়, ওনার ফিসফিসে কন্ঠস্বরে ফেরত এলেন, বললেন, এটা শেকশপিয়ারের কুড়ি নম্বর সনেট; 'মাস্টার-মিস্ট্রেস' শব্দটা শুনলেন তো? মাস্টার-মিস্ট্রেস মানে পুরুষ রক্ষিতা। এই কবিতাটি শেকশপিয়ার কোনো নারীকে নিয়ে লেখেননি, লিখেছেন পুরুষ প্রেমিকের উদ্দেশে। শেকসপিয়ার বলছেন, তোমার হৃদয় একজন নারীর মতো কোমল, অথচ তুমি নারীদের মতো আনচান করো না; তাদের চেয়েও তোমার চোখদুটি অত্যুজ্জ্বল ও সৎ, যে বস্তুর দিকে তাকাও তাকেও তুমি তোমার দৃষ্টি দিয়ে আলোকময় করে তোলো।

কিছুক্ষণ থেমে, বোধহয় ভাবলেন আমি ওনার কথাটা ঠিকমতো নিতে পারব কিনা, বললেন, জানেন তো, শেকসপিয়ার উভকামী ছিলেন আর এই কবিতাটিসহ অনেকগুলো সনেট তার প্রমাণ। আমি ওনার মুখের দিকে খুঁটিয়ে তাকালুম, তারপর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সৌম্যকান্তি মন্দারের দিকে তাকিয়ে দেখলুম। ওহ, মন্দারের চোখের আলোয় উনি আলোকিত; কামানো দাড়িতে দামি লোশন মেখে আরও বেশি আলোকিত দেখাচ্ছিল ওনাকে।

উভকামীরা, বিশেষ করে যারা কচি তরুণদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বোধ করে, মনে হয় সত্তর বছর পেরিয়েও সক্রিয় যৌনতা দিব্বি বজায় রাখতে পারে।



অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস ও মেঘ অদিতি 

5 comments:

bidisha sarkar বলেছেন...

Aamar comment kintu Durdanto..........asadharon goddobondho!aami aapluto.......gorbito.......aapnake valobasa i janalam........karon aami sot.Bidisha.

মনবন্দি বলেছেন...

uff porlam.. Eto chomotkar koreje shomaj chitro tule dhorechen.. Amar daru laglo,

Nilanjan Saha বলেছেন...

jubin thiki bolechhilo , ei lekha jekono potrikar sompod hote pare.Anobodyo.

A Fair well to pen. বলেছেন...

অসাধারন মলয়দা - তার অসাধারন গদ্যভাষা - সেসব ছাড়িয়ে অসাধারন বিষয়মুখ ও পরিবেশন। মুগ্ধতা জানানোর কোন কম্পিটিশন হয় না, হতে পারে না, হতে পারলেও তা রিফিউজ করলাম। সারা পৃথিবীর অজস্র কাগজে একাধিক ভাষার মানুষ বহুবার মলয় রায়চৌধুরীকে মুগ্ধতা জানিয়েছেন - উনি টস্ কাননি । আমার ফুল মূর্তির পায়ে না হোক, মন্দিরের সিড়িতে পড়লেও হ'ল (প্রসঙ্গতঃ আমি মন্দিরে যাওয়া বহুবছর হ'ল ছেড়ে দিয়েছি।) হ্যাঁ, একটা দুটো কথা বলার। প্রথমটা হ'ল - এই আদ্যন্ত সাইকো-আনালিসিসটা (আগা থেকে গোড়া - পাঠককে শুধু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে আবার শেষ থেকে শুরু পর্যন্ত পড়তে হবে।), উপযুক্ত পড়াশোনা থাকলে বলতে পারতাম - মনোবিদ্যার একটি আকাডেমিক কেসস্টাডি হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখে কিনা। পড়াশোনা নেই, তবুও বলি হ্যাঁ, রাখে। আর দুই, তিন (যথাক্রমে) - পশ্চিমবঙ্গে পাড়া কালচার অন দ্য কনট্রারী, খুব জাঁকিয়েই রয়েছে - এখন রয়েছে। কলকাতা থেকে মাইলখানেক বেরোলেই পাড়া পাবেন, পাচ্ছেন দক্ষিণের সবক'টা জেলাতেই মোটামুটি এবং উত্তরে, অন্ততঃ দিনাজপুর-মালদা-শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি 'তক প্রত্যেক জেলাতেই পাড়া আছে এবং সগৌরবেই আছে। কি ক'রে জানলাম? পড়াশোনার সুবাদে সব জেলা থেকেই কিছু কিছু বন্ধু আছে আমার। তারাই বলেছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য - গোটাকয় মুম্বইয়া বন্ধু-র সুবাদে এ-ও জানি,- মুম্বই-এ লোকাল-ট্রেন-বাসে সারাদিন-ই ভীড় থাকে। ঠাসাঠাসি ভীড়।
তৃতীয় হ'ল যে, মুম্বই-এ মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক হয় কি? মলয়দা টেন্থ স্ট্যান্ডার্ড আর প্লাসটু বোঝাতে চেয়েছেন। তাই না?

যাই হোক, মুগ্ধতা এবং মুগ্ধতা ।

Pavel Mahmud বলেছেন...

valo laglo..