আমার চর্যাপদ
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য
ভাষা বলতে, বিশেষ করে কথ্য ভাষা বা মুখের কথাই বোঝায় । তবে, কথ্যভাষার মধ্যেও অসম্পূর্ণতা আছে । মুখোমুখি কথা বলতে গেলে, বক্তা আর শ্রোতাকে সামনাসামনি আর একই সময়ে থাকতে হয় । ইদানীং- সেল ফোন, ডেস্কটপ ফোন, টিভি, সিডি প্লেয়ার, নেট চ্যাট ; এসব এসে যাওয়াতে একজায়গায় না থাকলেও চলে কিন্তু সমকালে থাকতে হয় ।
টিভি, সিডি প্লেয়ার – এই সবের বেলায় বক্তা / শ্রোতা সমকাল এবং কাছাকাছি থাকে না, আর তাই সেটাকে কথোপকথন চলে না । শুধু, কথা আর দৃশ্য দেখা যায় ।
তাই এটাকে আমি লিখিত ভাষা বলব, কারণ লিখিত ভাষায় কোনো কথোপকথন চলে না । তবে,আজকাল ওয়েবজিন আসাতে, এই সমস্যার সমাধান হয়েছে কিছুটা । পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কিছুটা হলেও পাওয়া যায়, কিন্তু মুদ্রিত বা লিখিত কোন ব্যাপারে এই সব সম্ভব নয় । আর এটা ভেবেই আমি আশ্চর্য্য হই ।
সাম্প্রতিক কালের কথা বলছি না । বলছি, সেই সব দিনের কথা, যখন মুদ্রণ ব্যাপারটাই ছিল অকল্পনীয় । এইসব কেই বোধহয় যুগোত্তীর্ণ লেখা বলে ! লেখাগুলো ভরপুর হয়ে থাকে মন । কেন ? সেটা বলছি ! তার আগে আরও কিছু ভূমিকা করে নেই ।
১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে প্রাপ্ত সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধপুঁথির একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। এই তালিকাটির নাম ছিল- Sanskrit Buddhist Literature in Nepal। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (২৬.৭.১৮৯১) মৃত্যুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাংলা-বিহার-আসাম-উড়িষ্যা অঞ্চলের পুথি সংগ্রহের দায়িত্ব দেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী-র উপর। এই সূত্রে তিনি ১৯০৭ সালে নেপালে যান (তৃতীয় অনুসন্ধান-ভ্রমণ)। এই ভ্রমণের সময় তিনি নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থাগারে কিছু নতুন পুঁথির সন্ধান পান। এই পুঁথিগুলোসহ হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামেএকটি সংকলন প্রকাশিত হয় ১৩২৩ বঙ্গাব্দে (১৯১৬) সালে। এই সংকলনের একটি গ্রন্থ ছিল চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়।
গ্রন্থনাম : ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে নেপালে প্রাপ্ত তালপাতার পুথি সম্পর্কে একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। এই তালিকার নামছিলো- A Catalogue of Palm Leaf and selected Paper MSS belonging to the Durbar Library, Nepal। এর দ্বিতীয় খণ্ডের তালিকায় এই পুথির নাম হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন -চর্য্যাচর্য্যটীকা। এই নামটি পুথির মলাটে লিখা ছিল। কিন্তু ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা- নামক গ্রন্থের ভূমিকায় এই গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন- চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চিয়। কেন তিনি গ্রন্থটির নাম পরিবর্তন করেছিলেন তার ব্যাখ্যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেন নি।
এই পুঁথির বন্দনা শ্লোকে আছে-
'শ্রীলূয়ীচরণাদিতিসিদ্ধরচিতেহপ্যাশ্চর্য্যাচেয়সদ্বার্ত্মাবগমায়নির্মলগিরাং......। এই শ্লোকে উল্লিখিত 'আশ্চার্য্যচর্য্যাচয়' শব্দটিকে এই গ্রন্থের নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন বিধুশেখর শাস্ত্রী। প্রবোধকুমার বাগচী এবং সুকুমার সেন এর যথার্থ নাম হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন- চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চিয়। এই গ্রন্থের মনুদত্তের তিব্বতী অনুবাদ অনুসরণে এই পুথির নাম চর্যাগীতিকোষবৃত্তি নামকরণের প্রস্তাব করেছেন। নামকরণের এই বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে এই পুথিকে চর্যাগীতি বা চর্যাগীতিকা নামেই পরিচিত।
রচনাকাল : বিভিন্ন গবেষকগণ এই পুথিঁর পদগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য কিছু মত দেওয়া হলো। যেমন-
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় : খ্রীষ্টীয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত "চর্য্যাপদ" নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই। [ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। রূপা।বৈশাখ ১৩৯৬]
সুকুমার সেন : বাঙ্গালা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য-চতুর্দশ শতাব্দ (৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা' নামক বইটির প্রথম গ্রন্থ "চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়" অংশে সঙ্কলিত চর্যাগীতিগুলি আদি স্তরের অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালার নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইলেও এগুলির ভাষা খাঁটি আদি স্তরের বাঙ্গালা নহে। [ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪]
সুনীতি চট্টোপাধ্যায় : খ্রীষ্টীয় ৯০০ হইতে ১২০০-র মধ্যে রচিত "চর্য্যাপদ" নামে পরিচিত কতকগুলি বৌদ্ধ সহজিয়া মতের গানে আমরা বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন পাই। [ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। রূপা।বৈশাখ ১৩৯৬]
সুকুমার সেন : বাঙ্গালা ভাষার আদি স্তরের স্থিতিকাল আনুমানিক দশম হইতে মধ্য-চতুর্দশ শতাব্দ (৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা' নামক বইটির প্রথম গ্রন্থ "চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়" অংশে সঙ্কলিত চর্যাগীতিগুলি আদি স্তরের অর্থাৎ প্রাচীন বাঙ্গালার নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইলেও এগুলির ভাষা খাঁটি আদি স্তরের বাঙ্গালা নহে। [ভাষার ইতিবৃত্ত। আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪]
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়। [বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮]
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটা খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিসহ প্রতিষ্ঠিত করেন। চর্যার প্রধান কবিরা হলেন লুইপাদ, কাহ্নপাদ, ভুসুকুপাদ, শবরপাদ এবং আরও অনেকে।
যে পুঁথিতে তিনি ঐ বৌদ্ধগানগুলো পেয়েছিলেন তার নাম ছিল- চর্য্যাচর্য্য- বিনিশ্চয় । চর্য শব্দের অর্থ হলো- আচরণীয় আর অচর্য্য অর্থে- অনাচরণীয় ।
এটা থেকে পরিস্কার বোঝা যায়, যে এই সব রচিত হয়েছিল- ধর্মসম্বন্ধীয় বিধিনিষেধ নিয়ে ।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে ভাষাবিদদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন- ৬৫০ খ্রীঃ বাংলা সাহিত্যের আরম্ভকাল। এছাড়া ফরাসী পণ্ডিত সিলভ্যাঁ লেভির (Sylvain Levi) তাঁর Le Nepal ( Vol. I.P 347) গ্রন্থে বলেছেন- “মৎসেন্দ্রনাথ (নাথপন্থার আদি গুরু) ৬৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে গমন করেন”। ফলে এটা ধারণা করা অস্বাভাবিক নয় যে, ৬৫০ খ্রীঃ এর দিকেই বাংলা সাহিত্যের জন্ম। কিন্তু আরেকজন প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Origin and Development of the Bengali language (Vol I.P 122)-এ উল্লেখ করেন, “মীননাথের শিষ্য গোরাক্ষনাথের সময় খ্রীঃ ১২শ শতকের শেষে।” ফলে মীননাথ দ্বাদশ শতকের লোক। এজন্য তিনি প্রাচীনতম বাংলা রচনার কাল ৯৫০ খ্রীঃ অঃ বলে নির্দেশ করেন। এবং সুকুমার সেন সহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব পণ্ডিতই সুনীতিকুমারকে সমর্থন করেন ।
লুইপাদ বৌদ্ধসিদ্ধাচার্য ও চর্যাপদের প্রবীণ কবি, এই মত প্রকাশ করেছেন অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, লুইপা ছিলেন শবরপার শিষ্য। তাই তিনি প্রথম কবি হতে পারেন না। তাঁর মতে লুইপা ৭৩০ থেকে ৮১০ খ্রীঃ মধ্যে জীবিত ছিলেন। লুইপাদ বাংলাদেশের লোক ছিলেন। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে। ‘ব্স্তন্-গু্যরে শ্রীভগবদভিসময়’ নামক একটি তিব্বতী পুস্তকে তাকে বাংলাদেশের লোক বলা হয়েছে। আবার, তিব্বতী ঐতিহাসিক লামা তারনাথের মতে লুইপা পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার ধারে বাস করতেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, তিনি রাঢ় অঞ্চলের লোক। এবং শ্রীযুক্ত রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর একটা হিন্দী অভিভাষণে বলেছেন – “লূয়িপা মহারাজ ধর্মাপালকে কায়েস্থ বা লেখক থে।” লুইপা রচিত পদ দুটি- ১ ও ২৯ নং। তার রচিত সংস্কৃতগ্রস্থগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়- অভিসময় বিভঙ্গ, বজ্রস্তত্ত্ব সাধন, বুদ্ধোদয়, ভগবদাভসার, তত্ত্ব সভাব। লুইপার প্রথম পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-
“কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল ।।”
আধুনিক বাংলায়ঃ “দেহ গাছের মত, এর পাঁচটি ডাল/ চঞ্চল মনে কাল প্রবেশ করে।”
কুক্কুরীপাদ > পদ নং- ২/২০/৪৮
চর্যাপদের দ্বিতীয় পদটি কুক্কুরীপাদ রচিত। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ব্যতীত অন্য অনেকে মনে করেন তিনি তিব্বতের কাছাকাছি কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন। নিশ্চিতভাবে বললে কপিলসক্র। মুহঃ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন, কুক্কুরীপাদ বাঙলা দেশের লোক। তার জন্মকাল নিয়ে দ্বিধামত নেই। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে তার জন্ম। কুক্কুরীপাদের নাম নিয়ে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। ড. সুকুমার সেন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, কুক্কুরীপাদের ভাষার সাথে নারীদের ভাষাগত মিল আছে। তাই তিনি নারীও হতে পারেন। আবার তার সহচারী যোগিনী পূর্বজন্মে লুম্বিনী বলে কুক্কুরী ছিলেন বলে, তার এই নাম হয়েছে; এমতও পোষণ করেন অনেক ঐতিহাসিক। চর্যাপদে কুক্কুরীপাদের তিনটি বৌদ্ধগান ছিল। কিন্তু একটি অপ্রাপ্ত। ২ ও ২০ নং তার লিখিত পদ। এবং চর্যাপদে খুঁজে না পাওয়া ৪৮ নং পদটিও তার রচিত বলে ধরা হয়। কুক্কুরীপাদের পদযুগল ছিল গ্রাম্য ও ইতর ভাষার। কুক্কুরীপার দ্বিতীয় পদটির দু’টি উল্লেখযোগ্য চরণ-
“দিবসহি বহূড়ি কাউহি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরু জাই ।।”
আধুনিক বাংলাঃ “দিনে বউটি কাকের ভয়ে ভীত হয় / (কিন্তু) রাত হলেই সে কামরূপ যায় ।”
(চলবে )
এই লেখাটির জন্য আমি যে সব বই এবং যাদের লেখার সাহায্য নিয়েছি :-
১। চর্যাপদ- ডঃ সুকুমার সেন ।
২। 'চর্যাপদ' কবিদের সংক্ষিপ্ত জীবনী -মুহম্মদ মাজ্হারুল ইসলাম মাজ্হার
5 comments:
aro ekbar choryapod niye smriti jhalano holo....
উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।...
onek kichu janlam......
chorjyapod porechhilam school e, 'Bangla Sahityer Itihas' e. Tate porikkha pass er bhoy thakto. ekhon abar poRe khub bhalo laglo. Ghanada jindabaad.....
ইদানিং রামকৃষ্ণদার কলমে গবেষণা মূলক যে সব লেখা উঠে আসছে তাতে আমরা উপকৃত হচ্ছি। লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাই।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য এর লেখা যত পড়ি আমি আবাক হয়ে যাই। লেখককে কৃতজ্ঞতা জানাই।
একাদশ শ্রেণীতে "টালত মোর ঘর নাহি প্রতিবেশী " পরেছিলাম, তারপর আবার
এই লেখা পরলাম - অনেকদিন পর আবার চর্যাপদের উপর লেখা , খুব সুন্দর লাগলো
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন