বুধবার, ১৫ মে, ২০১৩

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা - প্রসেনজিৎ দত্ত

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা
প্রসেনজিৎ দত্ত


অভিজ্ঞতাপ্রবণ লোকজনেদের নিয়ে কবিতার কাজকারবার। পৃথিবীর সমস্ত কারবারী উপাদানগুলিকে একত্র করে কবিতা কবির বেশে ভূমিষ্ঠ হল। আর ভূমিষ্ঠ হল যখন, তখন তো তার মাথা গোঁজবার জন্য প্রয়োজন ‘কবির রক্তমাংস’, বস্ত্রের জন্য প্রয়োজন ‘কবির সর্বস্ব’ আর খাদ্যের জন্য প্রয়োজন ‘কবির খিদে’। যদি বলা হয়, কবিতার খিদে পেয়েছে কবির! যদি বলা হয়, এই উত্তর কলকাতা, এই বাগবাজার, এই ঠাকুর রাধাকান্ত লেন, গঙ্গা, গঙ্গা থেকে গঙ্গাপূজা, ভাসান উৎসব, দুই পাড়ের পাট ও বাঁশ বিনিময়, পাড় লাগোয়া কারখানা, কাশিপুর গান অ্যান্ড সেল, সূচক হুটারে জেগে ওঠা সময় কবির সঙ্গে কথা বলে—তবে? অতিকাল চলো। কালস্য কুটিলা গতিঃ—প্রবাদ মিছে হল। এরপর পাতা উল্টে দেখব। গঙ্গায় সোপানের অপেক্ষা। সার পেতে গিয়ে নির্যাস পেলাম—গঙ্গার জল গঙ্গা র’ল, পিতৃপুরুষ উদ্ধার হল।
‘অতিকাল যাও... আমার অপর এই গঙ্গাধ্‌ধারে
বটবৃক্ষমূলে দ্যাখো গামছা পেতেছে... বাঁকুড়ার
গোলাপী গামছা... আহা কী শীতল... অতিকাল
যাও... ওকে একটু শুতে দাও বিরক্তও কোরো না...
ক্ষমতা বাচনে ঘেরা সমসত্ত্বা থেকে দূরে
ঐ গামছাটি পাতা... যাবতীয় মাধ্যমের
উদ্বেজনা থেকে দূরে ঐ গামছাটি পাতা...
বাগবাজারের গঙ্গাধ্‌ধারে পক্ষীবিষ্ঠাময় কোনো
বটমূলে বাঁধানো চাতালে... থামো অতিকাল...
দূর থেকে গামছাটিকে প্রণাম জানাও’

এ কোন দীক্ষা? সমালোচক অনুমান করেন, কিন্তু অনুধাবন? স্মরণ করি ‘উত্তর কলকাতার কবিতা’র কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা—
‘‘যং কাময়ে তং উগ্রং কৃণোমি
তং ব্রহ্মাণং তম্‌ ঋষিং তং সুমেধাম।

মানে, আমি যাকে কামনা করি তাকেই করে তুলি উগ্র বা প্রতিভাবান, করে তুলি ব্রহ্ম, করে তুলি ঋষি, করে তুলি জ্ঞানী। যারা জানেন বুঝবেন যে এই বাকসুক্তে ঋষি শব্দে ‘কবি’ অর্থই নিতে হয়। সার্থক কবিতা মাত্রই তাই প্রকৃত অপৌরুষেয়। কবিত্বশক্তির নিজস্ব স্বতন্ত্র লীলা। তাকে কী বলি? বলি, Our Lady Of Immaculate Conception? কারণ, পুরুষ তো কেবল সাক্ষিরূপ নিমিত্ত মাত্র! শিব। অথবা অন্য প্রান্তে দোষভাগ, জীব। এই দুইয়েরই আশ্রয়রূপা বর্ণমালা মা আমার, তোমাকে প্রণাম। তোমার সুন্দরীতমা প্রকাশরূপ কবিত্বশক্তিকে প্রণাম। তার অপৌরুষেয় প্রসবোল্লাস, Immaculate Conception—কবিতাকে প্রণাম।’’—বাগবাজারের গঙ্গাধ্‌ধারে পক্ষীবিষ্ঠাময় কোনো বটমূলে বাঁধানো চাতালে সত্যিই কি কখনও থেমে থাকতে পারে ‘অতিকাল’? ওই গামছাটিই বা কার? ছেলেছোকরার দল ওই গঙ্গায় গাঙ্গেয় সুখে মজে থাকে রোজ। ডুব ডুব গঙ্গা ভাজে। অথবা পুরোহিত তার নৈবেদ্য দেন গঙ্গা জলে। শেষ স্নানে শুদ্ধ হন তিনি। সবকিছুই আমাদের জানা ছবি। গঙ্গার দোষ নেই কোনও। আহা কী শীতল! হয়তো এই পাড়ের এক বাসিন্দা বলে উঠল—গঙ্গা গঙ্গা না জানি কত রঙ্গা-চঙ্গা। কেন বলল সে? কী তার কারণ? গঙ্গার পরিচয় ফলে। ওই বাসিন্দারও বিশ্বাস—গায়ের কালি ধুলে যায়, মনের কালি ম’লে যায়। ওই বাসিন্দা অতি সাধারণ। ওর বিশ্বাস ওকে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা করলে ওটা হবে। ওটা করলে সেটা। সে জানে গঙ্গাস্নানে পুণ্যি। সে জানে ডুব বেশি দিলে কালি মুছবে। পাপ মুছবে। সে এটাও জানে, মনের কালি মোছে না সহজে; এমনকী মরলে পরও সহজে নয়। ওই বাসিন্দা রোজ দেখে। পায়ে হেঁটে মায়ের ঘাট যায়। বসে থাকে। ট্রেন যায়। ট্রেন আসে। তবু বাসিন্দার জীবন পাল্টে যায় না। জীবন যেন তার কাছে অনুপ্রেরণায় রূপান্তরিত। সে যখন পড়াশুনা করত, মাস্টারমশাই তাকে দার্শনিক ভালেরির কথা বলেছিলেন। পাঠককে অনুপ্রাণিতে রূপান্তরিত করবার কাজ নাকি কবির। সে কবিতা বোঝে না। জীবনের অত ভারি ভারি সার কথাও বোঝে না সে। তার গণ্ডী বাগবাজার। গঙ্গাধ্‌ধার। বটবৃক্ষমূল। ওই গোলাপী গামছাটি তার। অথবা তার মতো কারোর। অথচ এই সব পরিচিত দেখা যখন পরস্পর বাক্য হয়, তখন বুঝতে পারে ওই বাসিন্দা। এ যেন তার কাছে পরিচিত বহুদিনের। তা জটিল নয়। অহেতুক তাত্ত্বিক দর্শনে ভারি নয়। এ যেন তার চেনা প্রাত্যহিককে গুছিয়ে দেওয়া শুধু—
‘... মানুষের মনে কেন এত হনোলুলু চলছে... কেন এত
লোহূলালা বয়ে যাচ্ছে... অনাসৃষ্টি অনাসম্পাত... নতুন নতুন
প্যাঁচ... পতঞ্জল... যেন বদলের বুভুৎসব যেন ধোঁয়া উঠছে...
জীবনকে খানিকটা অন্তত বোঝা তো দরকার... বলো... কিন্তু
ধোঁয়ার মধ্যে ধুন্ধুমকার মধ্যে আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না...
বলো মনোময়... জীবন থেকে এত দুন্দুভি উঠছে কেন... আর
নেতিয়ে পড়ছে লিভার... জেলেপাড়া... পুরো মারহাট্টা ডিচ লেন’

একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওই বাসিন্দাকে­—‘আপনি কী ভাবেন সারাদিন?’ ফটাফ্‌ফট উত্তর মিলেছিল—‘ছাইপাশ’।

—দেখুন, এই অঞ্চল এমনই, আপনি না বললে আমি অবিশ্বাস করব।

—বিশ্বাস করা আবার কেমন ব্যাপার?

—আপনার ছাইপাশ শব্দে আমার বড় আপত্তি। আপনি জানেন অনেক কিছু!

—ভুল জানেন বলছি না, তবে আপনি ঠিক নন।

—ঠিক কোনটা?

—ওই ছাইপাশ ভাবনাগুলি।

—বেশ, তবে ছাইপাশ ভাবনাটা কি, জানতে পারি?

—চলুন, হাঁটা যাক, হাঁটবেন?

—চলুন।

আচরো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনম্; নিষ্ঠা বৃত্তিস্তপো দানং নবধা কুললক্ষণম্। বোঝা গেল যে আজ কিছু মিলবে। যাই হোক, চলা যাক। চলতে চলতে পথ বর্তে দিল অনেক কিছু। ঐতিহ্য আর ইতিহাসের দোহাই ছাড়া উপায় কি কিছু আছে বলতে পারেন? যে ভাষায় কথা বলি, সে তো হাজার বছরের বেশি পুরনো। আমি প্রসূনদা-র লেখা পড়ি আর ভাবি, ভাবনার বীজ কোথায় থাকে! এ যেন, আচারে বাড়া, বিচারে এড়া। বুঝি না কিছু। আবার কখনও-সখনও সবটাই বুঝে যাই—সবটা! সেই পেরিন সাহেব, পেরিন সাহেব থেকে পেরিন্স গার্ডেন, গার্ডেন পরবর্তী পেরিন-বাগ থেকে বাগবাজার, বাগবাজারি ভাগীরথীর কল্পিত সেতুপথ ডিঙিয়ে ধীবরের জেলেপাড়া, বর্গী আক্রমণের সেই সম্ভাবনা, ঘুমন্ত ইংরেজ শাসনের জেগে ওঠা, তাদের নিরাপত্তার সেতু, সেতুর নীচে খালকাটা, চারপাশ বসতি অতিপরিচিত মারহাট্টা ডিচ লেন! আবার বাগবাজার বলেই ভাষার ব্রজবুলিও আছে­—
‘বাদরিয়া ঘেরি আয়ি চারহু ঔর কারি
দোদুল ঘরে মাঝে সঘন মশারি
দোদুল গঙ্গামধ্যে ইলিশের নাও
খিচুড়ি চাপাও বঁধু খিচুড়ি চাপাও’

রসনার মেহেফিলে ছ্যাঁকা লাগছে। পাল্টে যাচ্ছে সমস্ত উচ্চারণ, সমস্ত বাক্যের বন্ধনী—
‘... আমার আর মাইরী প্রেমিক হতে
ভাল্লাগে না... তাই আমি ভুষো চাদর
আর চিটে নুঙি পরে একমুখ সাদা
দাড়ি নিয়ে তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি
আর ওদের বলছি মা দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা...
অনেকদিন কিছু লিখতে পারছি না... মা গো
দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা’

দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা! ছলের বশে একজন স্বভাব কবির ঢঙেই বোধহয় এমন সম্ভব—দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা, মেট্রোপলিটন কলকাতার ‘ক্ষমতা বাচনে’ যেন সমস্ত ইতির শেষে উঁকি মারছে রকবাজ কলকাতা—মা গো, ব্যঙ্গার্থের আড়ালে দেখো তোমার স্তুতি, দেখো নেই-এর মাঝেও ফিরে আসা আড্ডা—দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা মা... সারদা, দুটো ভিক্ষে দিয়ে যা !

1 comments:

illutionist milan বলেছেন...

তোকে যে অন্যমার্গের কবি বা লেখক বলি - সেটা আবার প্রমাণিত ।
অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত লেখা । জিও ।