রবিবার, ২ মার্চ, ২০১৪

ধারাবাহিক – সৌমিত্র চক্রবর্তী

বহুগামীতায় থাক হে ঈশ্বর – পাঁচ



“কোথা মধুবংশীগলি
শরাবের দোকান খালি
যতই চাবে ততই পাবে
পয়সা লাগে না”।


কি অপরিমেয় অভাবের অন্ধকার শুঁড়িপথে হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাসে এক একটা মাইলস্টোন খোদাই করেছিলেন ওই লোকপুরুষ! এ কি শুধুই এক নেশাসক্তের সংলাপ?

হাঁটতে হাঁটতেই মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায় সে। কাদাগোলা বর্ণহীন চরিত্রের মধ্যে কোনো বৈচিত্রই খুঁজে পাওয়া যায় না বছরের এই সময়ে। গভীর ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে নিজের পরিচয়ও যেন হারিয়ে ফেলেছে আজকের আকাশ। কয়েকদিন ধরেই মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। ঠিক ঐ আকাশের মতই, শীতঘুম ভেঙে আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই রোদ ঝলমলে দিন সপাটে এক হ্যাঁচকা টানে নিম্নচাপের থলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর থেকেই চারপাশ শুধুই তেঁতো ওষুধের বিষন্নতায় মোড়া।

ন্যাংটো একটা ছেলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে মাঠের প্রান্ত জুড়ে। তার দিনমজুর বাবা হয়তো ব্যাস্ত পেটের গাঢ়পুরানের আদিম জোগাড়ে। আজকের বহিরপৃথিবীর স্পেসজেট গতিতে ছুটে চলার কোনো আঁচ পড়েনা এদের মন্থর জীবনে। সারি সারি তাল গাছের আড়ালে থাকা এক পুকুরের উঁচু পাড় বেয়ে নেমে আসছে গ্রাম্য তরুণী বউ। সদ্য কাচা কাপড়ের স্তুপ সামলাতে সামলাতে অন্তর্বাস শূন্য বুক ফিকফিক হাসে শস্তার ছাপা শাড়ীর আলুথালু আড়ালে। হাঁটতে হাঁটতেও সেদিকে অমোঘ দৃষ্টির তীর ছোঁড়ে লোকটা। ঠোঁটের কোনে জেগে ওঠে ধনুকছাপ হাসি। কয়েকদিন আগের বৃন্তখেলার ইতিকথা মনে পড়ে গেছে তার।

এই মনখারাপের শেকড় কিছুতেই খুঁজে পায়না সে। কেন হয়? কখন হয়? কিভাবে হয়? কোন অতল তলে গুনগুন গুঞ্জনের মত মৌমাছির দল ক্রমাগত উড়ে বেড়ায়। অকারণ ভুল বোঝাবুঝির মায়াবী বৃত্ত মুহূর্তের মধ্যে মেঘে মুড়ে ফেলে একটানা ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে পেছল করে তোলে সুগম রাস্তা। লোকটা পিছলে যেতে থাকে, দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরার ব্যস্ত চেষ্টায় ক্ষয়ে যেতে থাকে দশ আঙুলের নখ। নখের গভীরে ঢুকে যেতে থাকে কাদা-মাটি-ছোট ছোট কাঁকুরে জঞ্জাল। নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে নেমে যেতে থাকে অন্ধকার তলদেশ দেখতে না পাওয়া খাদের একেবারে নীচে। সেই নিকষ সময়ে সব কিছুই অসহ্য লাগে। কোনো সম্পর্কই বাঁধা থাকেনা নিখাদ স্থায়ী কাছির গাঁঠবন্ধনে। নিজের অস্তিত্বও তখন বাড়তি মনে হয়। এক একসময় আত্মহত্যার প্রবল ইচ্ছেয় তলিয়ে যেতে থাকে লোকটা।

সাদাকালো ছোট ছোট কাঁকড়ার দল ইতিউতি চরে বেড়াচ্ছে। যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। কাঁধের ঝুলিটা একপাশে সামলে উবু হয়ে বসে পড়ে সে সেই মাঝমাঠের ধূসর প্রান্তরে। দূরে সরষে বুনেছে চাষী। উজ্জ্বল হলুদ আর সবুজের অদ্ভুত মায়া ছেয়ে রেখেছে প্রান্তিক পৃথিবীর বর্ণহীনতা। টুকটুক চরে বেড়ানো কাঁকড়ার ঝুন্ড দেখতে দেখতে, তাদের সন্ধানী দাঁড়া নিয়ে সন্দিগ্ধ চলাফেরা দেখতে দেখতে কখন যেন সেও ছোট্ট ওই জগতের মাঝে ঢুকে পড়ে। পাশ দিয়ে বুকে হেঁটে চলে যায় এক মাঝারি জলঢোঁড়া সাপ। তারও গায়ের রঙ সাদাকালো। অবাক হয়ে ভাবে লোকটা এই ছোট্ট জগতটার কি আর অন্য রঙ নেই? কয়েকটা গুগলি মন্থরগতিতে চলার রেকর্ড গড়ে এগিয়ে চলেছে ভিজে একটা রেখা পেছনে ফেলে রেখে।

পেছনে জলের রেখা ফেলে সেও হেঁটে এসেছে এতদিন। সেই কোন শিশুকাল থেকেই দুপায়ের চাকায় গড়িয়ে চলেছে সে। মাঝে কত মুখের কোলাজ, কিছু মনে পড়ে আর বাকিসব স্মৃতি রেখে দিয়েছে সযত্নে তার অন্ধ কুঠরীর লকারে। সে সব কখনো বা ঝলক দেয় স্বপ্নসম্ভবতায়। আপনমনে হেসে ওঠে সে। আজ মনখারাপীর লক্ষ্মণগন্ডী ডিঙিয়ে এসেছে সে। শীত থেকে গরমে ঢোকার আগে শেষ ঠান্ডার কামড় বসানোর কাল যেমন মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। তারপরেই রোদ ঝলমল না ঠান্ডা না গরমের প্রেমবিহ্বল বাসন্তিক ভালোলাগা। কিন্তু উচ্ছ্বল এই উজ্জ্বলতার দিন যে তার জীবনে একেবারেই স্থায়ী হয়না, তাও সে জানে। প্রতিটি বাঁকে ওঁত পেতে বসে থাকে ঘোর কালো। কখন যে সেই রাহুর বিকটদর্শন মুখ তাকে গ্রাস করবে তা সে জানেনা। সে হাঁটে, হেঁটে যায় হাঁটতে হবে বলেই। জন্ম থেকেই এই তার কাজ, এই পথই তার ভালোবাসা, তার ঘর বাড়ী, তার জীবনদর্শন জেনে এসেছে সে। সে হাঁটে পেছনে পড়ে থাকে সূক্ষ জলের আচরব্যাপ্ত দাগ।

পকেট হাতড়ে বিড়ি বার করতে গিয়ে দেখে ছোট্ট পাউচে রবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা কিছুটা টলটলে সাদা আগুন কখন মনের ভুলে রয়ে গেছে। গত সন্ধের অবশেষ। কাল সেই মোহিনী হাত একমুখ হেসে বাড়িয়ে দিয়েছিল এটা। তার ভুক্তাবশেষ স্বামী আগেই রান আউট হয়ে একপাশে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল । সেই অমোঘ রাতে মোহিনীর উজ্জ্বল কেউটে শরীরের আগুন নেভানোর কোনো ক্ষমতাই ছিল না সেই নেশাড়ু আইনগত প্রভুর। একচুমুক খেয়ে বাকিটা সযত্নে রবার ব্যান্ডে বেঁধে পকেটে রেখে দিয়েছিল লোকটা। তারপরেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কালদিঘীতে সাঁতার কাটতে। শঙ্খলাগায় কোনো আলাদা উজ্জীবনের দরকার তার হয়না। কতরাত্রি পর্যন্ত উথাল পাতাল সমুদ্রমন্থন চলেছে তা তারা কেউই জানেনা। একসময় ঘুম নেমে এসেছিল আপন স্বভাবে। সকালে উঠে চলে আসার সময়ও সেই তথাকথিত প্রভু অচেতন গ্যাঁজলায়। আর মোহিনী চেপে ধরেছিল দুহাত। আস্তে আস্তে সে বাঁধন ছাড়িয়ে নেমে এসেছিল সে নিজের একান্ত চেনা রাস্তায়। রবারের বাঁধন খুলে বাকি আগুন গলায় ঢেলে নেয় সে।

আজ পর্যন্ত কেউই তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। কেউ না। বাঁধনের রাশ যতই শক্ত হয়ে চেপে বসার চেষ্টা করুক না কেন তার মননে, তার পরিব্যাপ্ত কর্তব্যের ওপর, কখন যেন আশ্চর্য রূপকথার জাদুতে নিজেই সে গ্রন্থি খসে পড়েছে আলগা হয়ে। কূপমন্ডুক হয়ে বাঁচা তার ললাটলিপিতেই নেই। এই ব্রহ্মান্ডব্যাপী নতুন সর্বদা ডাকে তাকে, টিকতে দেয় না এক পল কোথাও। পায়ের নীচের সরষে ক্রমাগত চিমটি কাটে, সুড়সুড়ি দেয়। খোলা আকাশের নীচে এনে ছেড়ে দেয় তাকে। তাড়িয়ে বেড়ায় । কিশোরবেলার এই বাসন্তিক সময়ে রুক্ষ ধূ ধূ প্রান্তরে ছোটো ছোট বুনো কুলের ঝোপ আর পলাশের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের গলির মধ্যে লাগামছাড়া উল্লাসে ভেসে যেতে যেতে মনে হত, এই বুঝি জীবনের শ্রেষ্ঠ মানে। স্কুলের লাইব্রেরী থেকে অজানা জগতের গল্পের বই পাওয়ার দিন মনে হত এই বুঝি আনন্দের ফুটন্ত অধ্যায়। প্রান্তিক প্রবাস থেকে গ্রামের ইলেকট্রিকহীন বাড়ীতে বাৎসরিক ফেরার দিন মনে হত সব উচ্ছ্বাস ওঁত পেতে বসে আছে সেই গ্রামীণ স্টেশনের দোরগোড়ায়। কিন্তু সময় কোনো উল্লাসকেই স্থায়ী হতে দেয়নি। একের পর এক চেনা মুখ কেড়ে নিয়ে বদলে দিয়েছে নতুন মুখ, নতুন বিতর্কের পরিচ্ছেদ।

তীক্ষ্ম হুইসলের শব্দে চটকা ভেঙে উঠে দাঁড়ায় লোকটা। দুরন্ত গতিতে একটা ট্রেন মাঠের লোমশ বুক চিরে ছুটে যাচ্ছে। এখনো এই বয়সেও ট্রেনের বাঁশির আওয়াজ তাকে উতলা করে তোলে। মনে হয় অনেকটা পথ পেরোনো বাকী। কত কিছুই এখনো অধরা রয়ে গেল। কিন্তু ছোটোবেলার সেই ট্রেনবাঁশি মনে হয় বদলে অনেক যান্ত্রিক হয়ে গেছে। বিষন্ন হাসির হলদে রেখা মুহূর্তে খেলে যায় লোকটার ঠোঁটে। একটা সদ্য জন্মানো বাছুর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে, আর তাকে ধরার ইচ্ছেয় অনর্গল কথার ফুলঝুরি ছিটিয়ে পেছনে দৌড়নোর ব্যর্থ চেষ্টায় এক মধ্যবয়সীনি। টিন আর খড়ের ছাউনি দেওয়া দিনমজুর গ্রামের সকাল শুরু হয়ে গেছে দৃপ্তগতিতে। মধ্যবয়সী চাষা বাবুর বাড়ী থেকে বলদ তাড়িয়ে এনে জুড়তে শুরু করেছে দাসত্বের গাড়ীতে। খোলা উঠানের মাঝে খোঁড়া গর্তকে উনান বানিয়ে তার ওপরে তোবড়ানো এলুমিনিয়ামের ডেকচিতে ভাত বসিয়েছে এক উলুঝুলু আট নয়ের খড়ি ওঠা কিশোরী। বাবা মা দুজনেই কাজে গেছে। ছোট ছোট ভাই বোন আর রান্নার দায়িত্ব তার। স্কুল কি জিনিস সে জানেনা এখনো। ছোট্ট এক ছাউনির তলে একমনে চপ আর আলুরি ভেজে চলেছে গ্রাম্য দোকানী তার কখনো না মাজা কালিতে ভর্তি অন্ধকার কড়াইয়ে।

অন্ধকার এই মানুষগুলোর জীবনসঙ্গী। এই অন্ধকূপের মধ্যে থাকতে থাকতে কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কোনো তারতম্যই করতে পারেনা এরা। জন্ম থেকেই এদের পশুত্বপ্রাপ্তি। শহুরে মাপকাঠিতে এদের মনন মাপা দুঃসাধ্য। তবু ক্ষমতার লোভে প্রতি বছর সেই চেষ্টাই করে যায় কিছু লোক, আর এরা বোঝার কোনো ইচ্ছে না রেখেই তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয় ভিক্ষের দান। পরিমিত আনন্দের দিনের মধ্যে এই লোকগুলোর একদিন ভোটউৎসব। খিদে আর রমন ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছেই জাগেনা এদের। আচ্ছা এটাই কি সেই নরক? এই ঘন রোদ্দুরের মাঝেও হঠাৎই যেন শীত করে ওঠে লোকটার। কোথায় যেন একপাল বুনো ঘোড়া ছুটে চলেছে। ধূ ধূ খোলা মাঠের ওই প্রান্ত থেকে যেন ভেসে আসছে সেই ছোট্টবেলার বরিশালী স্টীমারের ভোঁ। সামনে গজিয়ে ওঠে সেই চুনারগড় কেল্লায় দেখা মস্ত হাঁ করা বিশাল কুয়ো। আচমকা যেন পিছলে গড়িয়ে পড়তে থাকে সে। দৌড়তে শুরু করে লোকটা দিগ্বিদিক ভুলে। পেছনে তাড়া করেছে ভয়, ছুটে আসছে বুনো ঘোড়ার নিষ্ঠুর কর্কশ ক্ষুরের আওয়াজ।

1 comments:

Soumitra Chakraborty বলেছেন...

দুরন্ত ক্ষেপুর পাগলা ঘোড়ার চাল...