রবিবার, ২ মার্চ, ২০১৪

প্রবন্ধ – ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



এই সমাজ ও নারী – যুগে যুগে



আমার উদ্যোগে এক তরুণ বাংলায় টাইপ করা শুরু করেছে, মাঝে মাঝে ফোনে জিজ্ঞাসা করে নিজে না পারলে । কদিন আগে ফোনটা কানে দিতেই তরুণটির কন্ঠ ‘ ‘জেঠু, রেপ করবো কি করে’ ? ‘কার সঙ্গে কি কথা বলছিস ?’ বলে ধমক লাগালাম । ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তরুণটি বললো ‘না গো জেঠু, কার্তিক বর্মণ কথাটা টাইপ করত পারছি না তাই জিজ্ঞাসা করছি । বুঝলাম । হালকা রসিকতা করে কথাটা বললাম বটে কিন্তু ‘ধর্ষণ’ শব্দটা এখন জলভাতের চেয়েও সহজ উচ্চারণ।  সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে এখন পাঁচ ছয় বছরের শিশুও অবলীলায় শব্দটা বলতে শিখে গেছে । অর্থটাও শিখেছে নিশ্চয় !

‘ধৃষ’ শব্দ থেকে আসা শব্দটির আভিধানিক অর্থ নারীর ওপর উৎপীড়ন, বলাৎকার ইত্যাদি । কিন্তু বাংলা ভাষী সংবাদ মাধ্যমগুলোর শব্দটির ইংরাজী আভিধানিক অর্থই বেশি পছন্দ । মনে হয়, তাদের কাছে বলাৎকার বা পাশবিক অত্যাচার কথা দুটো নেহাতই নিরামিষ ! তো এই শব্দটি ইদানিং মুড়িমুড়কির মত হয়ে যাওয়ার পেছেনেও রয়েছে নারী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ।

সংবাদ মাধ্যমে একটা কথা খুব শোনা যায় । এসব ঘটনা আগেও ছিল। তখন জানা যেতো না, এখন মিডিয়া হাইপের জন্য জানতে পারছি । সমাজের বেশ উঁচু যায়গা থেকেও বলতে শুনছি সংবাদ মাধ্যম একটু বাড়িয়ে বলছে ইত্যাদি । অর্থাৎ বিষয়টাকে বা সমাজের অসুখটাকে একটু হালকা চালে দেখা । এসব ‘চিরকালই হয়’ বলে নারী পীড়নের বিষয়টাকে হালকা করে দেওয়া প্রচ্ছন্ন অনুমোদনেরই নামান্তর । চোখ অন্ধ থাকলে কবেই বা প্রলয় বন্ধ থাকে !

হ্যাঁ, নিশ্চিত ভাবেই নারীর ওপর বলাৎকারের ঘটনা আগেও হ’ত । পঞ্চাশ বছর আগে কেন? আমাদের সমাজ গঠনের শুরু থেকেই তো ছিল ক্ষমতায় বলীয়ান পুরুষের নারীকে তার দখলে আনার । তারপর কয়েক হাজার বছরে হয়তো আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে অনেক প্রসাধনী বদল হয়েছে কিন্তু নারী সম্পর্কে সমাজের মনভাব শিকড় সহ উৎপাটন হয় নি।

আমি বাংলা ভাষার প্রথম সাহিত্যকর্ম চর্যাপদ’র একটি পদের উদ্ধৃতি দিই । কবি ভুসুকু পাদ’ বর্ণনা দিচ্ছেন –
“ বাজনার পাড়ি পউয়া খালে বাহিউ ।
অদঅ দঙ্গালে দেশ লুড়িউ ।।
আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী
ণিঅ ঘরিণী চন্ডালেঁ লেলী ।।

[ অর্থাৎ, বাজরা নৌকার পাড়ি, পদ্মার খালে বাওয়া ।
দয়াহীন দাঙ্গাবাজে দেশ লুট করে ।
আজ ভুসুকু বাঙালি হয়ে গেল ।
নিজ গৃহিণীকে চন্ডালে নিয়ে গেল”।
আরো একহাজার বছর পেছনে আসি । প্রায় দুশ বছর আগের, ৯ই জুলাই ১৮২৫ সালের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ উদ্ধৃত করি । (দুশ বছর আগেকার বাংলা গদ্য ভাষাতেই হুবহু দেওয়া হ’ল) সংবাদটি এইরকম –

“বলাৎকার – শুনা গেল যে মোং মীরজাপুরনিবাসি কোন কায়স্থের এক পরম সুন্দরি যুবতী স্ত্রী সমীপবর্তিনী পুষ্করিনীরমধ্যে গাত্রধৌতার্থ গমন করিয়াছিল ইতিমধ্যে ঐ কামিনীকে একাকিনী পাইয়া অত্রস্থ বর্ধিষ্ণু সীতারাম ঘোষের পুত্র বাবু পীতাম্বর ঘোষ কএক জন লোক সমভিব্যাহারে আসিয়া বলে অবলার অম্বর ধরিয়া অন্তঃপুরে লইয়া স্বাভিলাষ পূর্ণ করিয়া পরিত্যাগ করাতে কামিনী রাগিণী হইয়া অতিদ্রুত গমনে পটলডাঙ্গা থানায় গমন করিয়া সমুদায় বিবরণ নিবেদন করাতে পরদিবস প্রাতে জমাদার সকলের জবানবন্দি লিখিয়া এক্ষণে পুলিশে প্রেরণ করিয়াছে” ।

(‘সংবাদ পত্রে সেকালের কথা’/প্রথম খন্ড – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়)

এ তো দুশো বছর আগেকার কথা । নারী নিপীড়নে সমাজের তেমন কোন হেলদোল থাকতো না । কারণ নারী নিপীড়নের নানান বন্দোবস্ত তখনকার সমাজই অনুমোদন করতো । কুলিন হওয়ার গৌরবে বহু বিবাহ, একাধিক উপ-পত্নী রাখা, বেশ্যালয় গমন তখনকার বাঙ্গালির আভিজাত্য বলেই মান্য হ’ত । দুশ’ বছর আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে নৈতিকতার বালাই ছিলনা । পরের একশ’ বছরে বাঙ্গালির সমাজ প্রভূত এগিয়েছে, শিক্ষার প্রসার হয়েছে, নারী সচেতনতা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো । বিশ শতকের গোড়াতেই নারীর প্রতিবাদী কন্ঠ শুনতে পায়েছি । ধর্মই যে নারীকে বেঁধে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার যাবতীয় অবমাননার ঢাল হিসাবে, সে কথাও উচ্চারিত হতে শুরু করেছে । ১৯২১শে হিন্দু নারীদের মধ্যে প্রথম প্রতিবাদী কন্ঠ শোনা গেল জ্যোতির্ময়ী দেবীর লেখায় “... নারী হন্তা, দুর্বলের প্রতি অত্যাচারী, পূণ্যের নামে,ধর্মের নামে উৎপীড়ক যে ধর্ম সে ধর্ম পবিত্র নয়” । তারপর সমাজ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু নারীদের প্রতি সমাজের মনোভঙ্গির কিছুমাত্র বদল হয়নি । ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথচলায় কত পরিবর্তন হয়ে গেছে – হয়ে চলেছে নিয়ত । আমাদের সমাজ ও পরিবারের কাঠামোয় কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, আমাদের মূল্যবোধগুলির কত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের মনোভাবের বিষয়টি সেই এক সনাতনী বিশ্বাসের অচলায়তনে বন্দি । নারী পুরুষের আশ্রিতা, পুরুষের ভোগ্যা সামগ্রী, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে সে যেন এক আলাদা প্রজাতি । পিতৃপ্রধান যৌথ পরিবার ভেঙে এখন অণু পরিবার, কিন্তু সেখানেও আধুনিক সমাজ কতটুকু স্বাধীনতা দিতে সম্মত নারীকে ? স্ত্রী তার পুরুষ স্বামীর আশ্রিতা – এ ভিন্ন অন্যকিছুই পুরুষ ভাবে না । সমাজ তাকে অন্য কিছু ভাবতে শেখায় না । নারী নিজেও এই ভাবনার অচলায়তনে বন্দি, ধর্মের বাঁধন তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয় না ।

উনিশ শতকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েহে সত্য । উনিশ শতকে যখন অনভিজাত নারী অন্দর মহল থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, সমাজের চোখে তারা ছিল কুল কলঙ্কিনী । যাদের শ্রমশক্তির ওপর দাড়িয়েছিল সেকালের হিন্দু সমাজ তারা হয়ে গিয়েছিলেন গণিকালয়ের মালিকদের শিকার আর নতুন গজিয়ে ওঠা বড়লোকদের গৃহ পরিচারিকা। এ যুগে শিক্ষিত মহিলারা অনেক উচ্চ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে উঠছেন সত্য, কিন্তু প্রান্তিক নারীসমাজ, কৃষক রমণী, খণি শ্রমিক, আয়া, পরিচারিকারা নারীত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে যান ।

১৯৪০এ পূর্ব পশ্চিম মিলিয়ে বাংলার লোকসংখ্যা ছিল ৫কোটির মতো । ১৯৮১এ বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ এসেম্বলিতে পেশ করা নথিতে নারী নিগ্রহের ১১১৯টি মোকদ্দমার কথা বলা হয়েছিল আর সত্তর বছর পরে সেই সংখ্যাটা চারগুণেরও বেশি হয়ে গেছে । কিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, বেশির ভাগই হয় নি । হয়তো সেসব ঘটনা আমাদের শহুরে চৈতন্যকে তেমন নাড়া দেয়নি । তবে এখনকার মত এমন বীভৎসতা দেখা যেতো না । রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পরিবারকে বলাৎকারের টার্গেট করা বা সেইসব ঘটনাকে পরোক্ষ অনুমোদন দেওয়ার মত বিকৃতি হাল আমলের ব্যাপার ।

শুকনো পরিসংখ্যান কিছুই জানায় না । ‘আম আদমি’র সেইসব পরিসংখ্যান জানার উৎসাহ থাকারও কথা নয় । তবু সমাজের উঁচু যায়গা থেকে যখন হামেশাই শোনা যায় ‘এসব চিরকালই ছিল, তখন খবর হ’ত না, এখন হচ্ছে’ তখন এইসব কথাকে দুর্বৃত্তদের প্রতি আশ্বাসবাণী মনে হয় । আর নারী নির্যাতনের ঘটনা বাড়তেই থাকে । ১৯১১য় পশ্চিম বাংলায় বলাৎকারের ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছিল ২৩১৭টি আর ২০১৩তে সেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২০৪৬এ । আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি সংখ্যায় মেয়েরা তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করছেন এটা দেখে আহ্লাদিত হচ্ছেন, এ নাকি প্রগতির লক্ষণ ! আর আমরা ক্রুদ্ধ হতেও ভুলে গিয়েছি। সমাজের সর্বগ্রাসী পচন দেখে সয়ে যাওয়া আমাদের আর ক্রোধ জাগে না ।

আমরা শিক্ষিত মানুষেরা মনে করি ধর্ষণ ব্যতিক্রমী ঘটনা । বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেই একজন নারী নিজে থেকেই শিখে যায় ধর্ষণের মানে, আর সেই সময় থেকেই এক অদ্ভুত ভীতি থাকে তার বাকি জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী । পরিসংখ্যান জানাচ্ছে এখন নাকি প্রতি ৩০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন । আর বিচার ও শাস্তি দানের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার কথা না বলে নির্যাতিতা মেয়েটির পোষাক উত্তেজক ছিল কি না, রাত্রে সে একা একা বেরিয়েছিল কেন ? এইসব অদ্ভুত প্রশ্নের সামনেই মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে দিই আমরা, ধর্ষণের দায় মেয়েটির ঘাড়েই চাপিয়ে দিই । ক্বচ্চিৎ ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের মত কেউ কেউ চরম শাস্তি পেয়ে যান কিন্তু অধিকাংশ অপরাধীই জটিল ও বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ায় পার পেয়ে যান । কারা জড়িত থাকে এইসব ঘটনায় ? একথায় সবাই । অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক, পুলিশ কর্মী,বৃদ্ধ পুরোহিত, ধর্মগুরু, চিকিৎসক, নির্যাতিতার নিকট-আত্মিয়, শিক্ষক – সকলের লালসার শিকার হয় নারীরা । স্কুলের কিশোরী হেতাল পারেখের ধর্ষণ ও খুন করার অপরাধে ফাঁসি হয়ে যাওয়া ধনঞ্জয় ছিল সেই বহুতলেরই সিকিউরিটি গার্ড । ১৯৯২এর সেপ্টেম্বরে ফুলবাগান থানায় এক ঝুপড়ির মেয়েকে তুলে এনে ধর্ষণ করে শঙ্কর মাইকাপ নামে এক পুলিশ কর্মী । ১৯৯৮এ ১৬বছরের এক কিশোরীকে সুস্থ করে দেবার নাম করে মন্দিরের ভেতরেই ধর্ষণ করে এক ৬৭ বছরের পুরোহিত । কোর্টে নিয়ে যাবার পথে মূক বধির কিশোরীকে ধর্ষণ পুলিশ ভ্যানের ভেতরেই । স্কুল শিক্ষক দ্বারা নাবালিকা ছাত্রীকে ধর্ষণ, নিকট আত্মীয় দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা তো আকচার ঘটছে । কারা বেশি আক্রান্ত হয় ? গৃহবধু আর তার শাশুড়ি মাতা, স্কুল কলেজ ছাত্রী, ইটভাটার শ্রমিক, এমনকি পাঁচ ছয় বছরের অবোধ শিশুও বাদ যায় না । চৈতন্য অসাড় হয়ে যায়, কোন আলোর রেখা দেখা যায় না ।

আসলে সেই আদিযুগ থেকেই আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের বিশ্বাসেও গভীর ভাবে গেঁথে দেওয়া গিয়েছে যে ভোগ্যপণ্য ছাড়া নারীর আর কোন পরিচয় নেই । সমাজ গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতে যেমন ‘অস্ত্র যার নারীও তার’ কয়েক হাজার বছর পরেও তাই । আর নারী যে পণ্য ছাড়া কিছুই নয় সেই কথাটাই নিপুণ ভাবে আমাদের এবং তরুণ প্রজন্মের মনে গেঁথে দেওয়ার কাজ করে চলেছে বহুজাতিক কোম্পানীগুলির বিজ্ঞাপন । মোটর গাড়ি থেকে আলুভাজা সব বিজ্ঞাপনেই স্বল্পবাস সুন্দরীদের হাস্যময় ছবি ! প্রসাধনী বাজার দখলের পথ খুলে দিতে ক’জন ভারত ললনা বিশ্বসুন্দরী হওয়ায় আমরা ‘দেশের মুখ ঊজ্বল হ’ল’ বলে উল্লাস করেছি আবার তারই প্রভাবে খোলামেলা নারী শরীরের বিজ্ঞাপন হোর্ডিং দেখে ‘অশ্লীলতা দূর হটো’ বলে চিৎকারও করেছি ! কবেই বা বুঝেছি, এতোদিন লালিত সংস্কৃতি আর মূল্যবোধগুলির ধ্বংস সাধনই তাদের ‘পবিত্র লক্ষ্য’ । হ্যামলিনের বাশিওয়ালা যেন ! আমরা ছুটে চলেছি । তো এই হ্যামলিনের বাঁশীওয়ালার সুরে ভেসে যাওয়ার ফলের একটা মাত্র নমুনা পেশ করি । একদম টাটকা বিবরণ । ২৭ফেব্রুয়ারির আনন্দ বাজার পত্রিকায় একটি লেখায় প্রকাশিত হয়েছে । কলকাতার দুই উচ্চবিত্ত পরিবারের নামি স্কুলে পড়া ১২ ও ১৪ বছরের দুই বালিকা গর্ভবতী হয়ে পড়ে । এখন আর গর্ভপাতের উপায় নেই কারণ তাদের পিতা মাতা যখন বিষয়টি জেনেছেন তখন বালিকাদুটি ৮ এবং ৭ মাসের গর্ভবতী । উচ্চবিত্ত দুই পেশাদার ও প্রতিষ্ঠিত পিতাই বালিকাদুটির সন্তান প্রসব করাবেন কোন হোমে কিন্তু পৃথিবীর আলো দেখা সন্তান দুটিকে নিয়ে যাবেন না । গায়ে চিমটি কেটে প্রশ্ন করি পচনের শেষ সীমায় যেতে আর কতটা বাকি !

এ এমন দেশ – যেখানে মুকেশ আম্বানী তাঁর স্ত্রীর পঞ্চাশতম জন্মদিন পালন করতে অতিথিদের অন্য প্রান্ত থেকে তাঁর রাজকীয় প্রাসাদে নিয়ে যান নিজের জেট বিমানে, “আর সেই একই দিনে কচি কচি মেয়েরা রাস্তায় মিছিল বের করে, তাদের ছোট ছোট হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে – আমাদের ধর্ষণ করো না । যে ছাত্রীটির স্কুল ব্যাগ পুকুরপাড়ে পড়ে থাকে আর তার ধর্ষিত শরীর পুকুরের জলে ভাসতে থাকে, তারা পৃথিবীর কোন সভ্য কল্পনায় এক দেশের মানুষ হতে পারে না” (দেবেশ রায়ের একটি লেখা থেকে) । আমরা তো ক্রুদ্ধ হতেই ভুলে গেছি । ক্রোধ জাগানোর কোন সংকেতও তো পাওয়া যাচ্ছেনা তেমন !

প্রয়াতা মল্লিকা সেনগুপ্তর একটি কবিতা উদ্ধৃত করে শেষ করি ।
বাবার বন্ধুর সঙ্গে
বাবার বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছিল সে
মেয়েটা বোকাই ছিল, নাহলে কিভাবে
নিজেকে ভাবল কুন্তী আর ঢ্যাঙা কালো
উনষাট বছরের লোকটাকে সূর্য ভেবে নিল !
সত্যি ভেবেছিল নাকি মগজ ধোলাই!
ছোটবেলা লোকটাকে কাকু ডেকেছিল
শিশুকাল থেকে ওর মাথায় কুয়াশা
পড়তে পারে না, কিছু ভাবতে পারে না,
অবোধ চোখের ভাষা দৃষ্টিকটু লাগে
উনিশ বয়সী ওর বাড়ন্ত শরীরে ।

রঙ তুলি নিয়ে শুধু হিজিবিজি কাটে
রক্ত ঝরে পড়ে সাদা ক্যানভাস জুড়ে
জাপটে জড়িয়ে ওকে ঘর বন্ধ করে
দিয়েছে লোকটা আঁকা শেখানোর ছলে ।
মরে বেঁচে গেছে তার ছাপোষা গৃহিণী ।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন বাচ্চাটা জন্মাল
জানালাউ উঁকি দিল পাড়ার মস্তান –
‘ফোকটে আমিও বাবা হতে চাই, ইট
পেতে রাখলাম’ । ‘ছিঃ ছিঃ’শিউরে উঠল
পাড়ার মাসিমা । ভাই বলল, ‘রান্ডী রে
এত যদি ইচ্ছে কেন রাস্তায় গেলি না’ ।
মেয়েটা গোল্লায় গেল, এ তো স্বতঃসিদ্ধ ।
কিন্তু এতদিন যারা দর্শক ছিলেন,
মেয়েটার পিতৃবন্ধু কবি ও শিল্পীরা,
প্রস্তুত থাকুন, আর দুবছর পরে
ভালো করে কথা শিখে নিষ্পাপ শিশুটি,
ঐ জারজ শিশুটি, প্রশ্ন করবেই –
কোন পরিচয়ে আমি বাঁচব সমাজে ?
ঐ অপরিণত বালিকাদুটি তার ধনী পিতার গৃহে ফিরে যাবে, হয়তো তারা ভুলেও যাবে অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের ঘটনা বা দুর্ঘটনাটি । কিন্তু অচিরে সেও তো জানতে চাইবে । উত্তর দেবে কোন সমাজ ?