বাণীব্রত কুন্ডু
“কাবা এখন বারানসী
রাম হয়েছেন রহিম ভবে...”
এই কথা যিনি সগৌরবে, দ্বিধাহীন কন্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন তিনি আর কেউ নন; তিনি অতিসাধারণ অথচ অসাধারণ, আমাদের সকলের সুপরিচিত সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিসত্ত্বা – যার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে ছাত্রাবস্থায়, ইতিহাসের পাতায়। ইতিহাস শব্দটা শোনা মাত্রই যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, ক্ষমতার প্রসার...এর কথাই ভেসে ওঠে আমাদের চেতনায়। কিন্তু তথাকথিত ইতিহাসের গন্ডীর বাইরে যে অন্য এক প্রবাহধারা সাবলীল ভঙ্গীমায় নিরবধি প্রবাহমান তাও তো বিস্মৃতির নয় বরং বিস্ময়ের। আর তেমনি এক অবিরত ধারার প্রতিনিধি ভারতীয় ভক্তি-আন্দোলনের অন্যতম ঋত্বিক মৌখিক পরম্পরার কবি মরমীয়া কবীর।
সামাজিক ইতিহাসের যতগুলো পাতা তিনি অধিকার করে আছেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি আলো ছড়িয়ে আছেন সাহিত্যাকাশে, নীরব চাঁদের মতোই। তাঁর রচিত অসংখ্য দোঁহাবলী (দোঁহা মানে দ্বিপদী) সাহিত্যের অতি মূল্যবান সম্পদ। এই দোঁহাগুলো কেবল যে দৃষ্টিনান্দনিক তাই নয়, উপরন্তু সেগুলো বড়ো বেশি শ্রুতিসুখকরও বটে। এমন কি এই রচনার মধ্যে দিয়ে তত্কালীন সমাজের বিভিন্ন দিক উঠে আসে অনির্বাপিত তুষাগ্নিপ্রায়। এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কেননা, তিনি সমাজের যে স্তর থেকে মাথা তুলেছেন সেখানে ছিল শুধুই পুড়ে যাবার ইতিকথা। আর সেকারণেই তিনি হতে পেরেছিলেন – পৃথিবীর মতো সহনশীল, জলের মতো নিরবয়ব, অগ্নির মতো পবিত্র,বায়ুর মতো স্বচ্ছন্দ্য এবং আকাশের মতো উদার – তাঁর এক দেহে লীন হয়েছিল পুরুষ ও প্রকৃতি, এক আধারে মিলেছিল একতার সর্বোত্কৃষ্ট নিদর্শন।
কে বলতে পারে! হয়তো বা এ সমস্তের শিকড়ে লুকিয়ে আছে তাঁর বৈচিত্র্যময় রহস্যঘন জন্মকথা। এ যেন এক কিংবদন্তির চরিত্রগাথা। যার জন্ম-জীবন-জরা সবই হেঁইয়ালিপূর্ণ। সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ জন্য কোনো কোনো বিদগ্ধজন কবীরের অস্তিত্ত্ব বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন – হয়তো কোনো মুক্তমনস্ক মানুষ কবীর-এর ছদ্মনামে ধর্মের বাহ্য আচারাদি অন্তর্মুখিনতাকে বাক্শলাকায় বিদ্ধ করেছিলেন, যিনি কিনা সর্বদা একটা থাকা না থাকার মধ্যে, ধর্ম-বিধর্মের মধ্যে অবস্থান করতেন। অথচ সমস্ত কিছুর শেষ তাঁর মধ্যেই নিহিত। তাই হয়তো তিনি লিখেছিলেন –
“আমারই ভিতর সপ্তসাগর, আমারই ভিতর প্রবাহিত নদী আর শাখানদী।
আমারই ভিতর কাশী ও দ্বারকা, আমারই ভিতর দেবমন্দির শোভে নিরবধি।
আমারই ভিতর চন্দ্র সূর্য়, আমারই ভিতর ন’লক্ষ তারা।
কবীর কহেন, ওহে সজ্জন, পরম সত্য তিনি আমাতেই হয়েছেন হারা।”
তবে একেবারে অভ্রান্ত কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও নানা মুনির নানা মতো অতিক্রম করে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনি জীবিত ছিলেন তা মোটামুটি সন্তোষজনক। যদিও কবীর-গবেষক ডঃ ক্ষিতিমোহন সেন সুনিশ্চিত করেছেন, ১৩৯৮ খ্রিঃ, জ্যৈষ্ঠমাসে পূর্ণিমাতিথিতে সোমবারে কাশীর লহরতালার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫১৮ খ্রিঃ, মাঘমাসে কাশীর নিকটবর্তী বস্তীজেলার মগহর গ্রামে পার্থিবলীলা সংবরণ করেন। জন্মকাল সম্পর্কিত সমস্যার আপাত সমাধান হলেও তার পরিচয় বিষয়ে বেশ কিছু লোককথার উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন – তিনি নাকি এক দিব্যজ্যোতি থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আবার অন্য একটি বিবরণ থেকে জানা যায়, লহরতালার এক দীঘিতে বিকশিত পদ্মফুলে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল। তবে এসমস্ত অতিলৌকিক বৃত্তান্ত ছাড়াও দুটি আপাতগ্রাহ্য তথ্য এই যে – তিনি এক ব্রাহ্মণ বিধবার পরিত্যক্ত সন্তান এবং নিরু ও নিমা নামের এক মুসলমান মোমিন বা জোলা অর্থাৎ তন্তুবায় দম্পতি তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন অথবা, তিনি ঐ দম্পতির গৃহে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা থেকে জানা যায় যে, খুবই অল্প বয়সে তাঁর পিতামাতা মায়ালোক ছেড়ে যান। তবে তিনি যাদেরই সন্তান হন না কেন, তাঁর ছিল স্ত্রী লোয়ী, পুত্র কামাল ও পুত্রী কমালী-কে নিয়ে আটপৌরে সংসারজীবন।
আবার জন্মপরিচয় যেহেতু এককাট্টা নয় তাই তিনি কোনো ধর্মাম্বলী ছিলেন সে বিষয়েও যথেষ্ট মতানৈক্য সুপ্রতিষ্ঠিত। শোনা যায়, ছেলেবেলায় হিন্দু বালকেরা তাকে মুসলমান আর মুসলমান বালকেরা হিন্দু বলে রাগাত। তিনি কোথাও নিজেকে মুসলমান বলে উল্লেখ করেননি, বরং পিতাকে ‘গোসাই’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার বাদশা ইব্রাহিমের সভায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সত্যই ইসলামধর্ম ত্যাগ করেছেন। এভাবে তাঁর ধর্মপরিচয়ও প্রহেলিকাময়। যদিও তিনি কোনোদিনই মুসলমান বা হিন্দু, কোনো ধর্মসম্প্রদায়েরই ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্ব মেনে নেননি। কোনো ধর্মেরই কোনো গোঁড়ামিতে তাঁর মন বাঁধা পড়েনি। তিনি যেমন নমাজ, মোল্লা, মসজিদ, রোজা, হজ, কাবা – এসব কিছুই মান্য করতেন না তেমনি, হিন্দুদের বর্ণভেদপ্রথা, পৌত্তলিকতার ঘোরতর বিরোধীও ছিলেন। এবং কবীরের এই ধর্মবিরূপতা সৃষ্টি করেছে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের ঘৃণা। একারণে কবীর নিজের শ্রেণিগত অবস্থান কখনোই ভুলে যাননি। তিনি তাঁর কবিতায় সে কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন।
কবীর শব্দের অর্থ মহান, তাঁর এই নামকরণ করেন একজন কাজিসাহেব। কোরাণ খুলেই তিনি এই শব্দটি দেখতে পান। একটি দোঁহায় কবীর বলেছেন,-
“মহান তুমি, প্রভু, কবীর তুইও সেই, ‘মহান’ নাম তোর ভবে।
শরীর মায়া আগে ত্যজিতে পার যদি রামরতন লাভ হবে।”
সত্যিই! সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ পরমেশ্বরের মতো কবীর নিজেও এক মহান মনের মানুষ। মুসলমানের প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির প্রতি কবীরের তাচ্ছিল্যভাব দেখে একবার এক বিখ্যাত পির তাকে ‘কাফির’ বলে সম্বোধন করলে কবীর বলেন,- “যারা পরের ব্যথা বোঝে তারাই পির, যারা বোঝে না তারাই কাফির।” – এই একটি মাত্র কথা থেকেই বোঝা যায় তিনি কত বড়ো মাপের, বড়ো মনের মানুষ। মন কত বেশি সংবেদনশীল হলে তবে এই কথা বলা যায় তা সত্যি অভাবনীয়। অন্তরের অন্তস্থল থেকে যেন কুলকুন্ডলিনীর মধ্যে দিয়ে উদ্গীরণ হয়েছিল এই বাণীর, এই চরম সত্যের। সে যুগে কবীরের এরকম পরবেদনাকাতর মনোভাবের কারণে, স্পষ্টবাদিতার কারণে শুধু অবহেলিত, শুধু বিদ্রূপভাজন হতে হয়েছিল তাই নয়, বর্ণনাতীত শারীরিক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছিল – তা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট। শুধু তিনিই নন, আমরা দেখেছি যুগে যুগে যাঁরা মানবধর্মকে প্রতিষ্ঠা দিতে এসেছেন তাঁরা সকলেই গোঁড়ামির ধারকবাহকদের দ্বারা চরম নিগৃহীত হয়েছেন। তাই,- সন্ত কবীর, কবীর শা, আল কবীর, কবীর সাহেব, কবীর কিংবা কবীরদাস – যে যাই বলে তাঁকে সম্বোধন করুন না কেন মুহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, যিশুখ্রিষ্ট প্রমুখের মতো সমকালে না হোক পরবর্তী সময়ে তাঁর ধর্মদর্শন সার্বজনীনতা পেয়েছে – এখানেই তিনি সার্থক।
ভক্ত কবীর প্রায় দীর্ঘ একশকুড়ি বছর জীবিত ছিলেন। শোনা যায়, তিনি যখন অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়; তখন হিন্দু ও মুসলমান অনুরাগীদের মধ্যে তাঁর পারলৌকিক কৃত্যবিষয়ে বিবাদ বাধে। এই দুই সম্প্রদায়ই কবীরকে স্বজাতিভূক্ত বলে দাবি করেন। কিন্তু এই হট্টগোল তাঁর পছন্দ হল না, তিনি একটি চাদর নিয়ে নিভৃতে গিয়ে শয়ন করেন। এবং যখন চাদর সরানো হল তখন সেখানে শুধু একরাশ ফুল পাওয়া গেল। যার অর্ধেক মুসলমানেরা নিয়ে কবর দেন আর বাকি অর্ধেকে হিন্দুরা বানালেন সমাধি। আজও যেখানে দুই ধর্মমতের অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাপূর্ণ বিনম্র ভক্তিরস বকুলফুলের সৌরভের মতোই মানবধর্মকে পৌঁছে দেয় বিশ্বময়।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রায় পাঁচশো বছর আগে একজন নিম্নশ্রেণির নিরক্ষর, প্রথাগত শিক্ষাহীন, হতদরিদ্র, জাতকুলমানরহিত ব্যক্তি শুধুমাত্র সত্যনিষ্ঠার জোরে, আত্মবিশ্বাসের ঔদার্য়ে, মহানুভবতার মাহাত্ম্যে, অকল্পনীয় দুঃখ-দুর্দশার দৌরাত্ম্যে ও পারিপার্শ্বিক সর্বপ্রকার জ্বালা যন্ত্রণার দশচক্রে জনগণের ভাষাকে অবলম্বন করে হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা। বারানসীর সেই জোলা ভিন্ন ভিন্ন মতো, পথ ও রূপের ভারতজীবনের বিক্ষিপ্ত তন্তুগুলোকে সংগ্রহ করে যেন অপূর্বসুন্দর একটিমাত্র বয়নকর্ম সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। ভারতের ইতিহাসে একতার এতো মনোরম এবং ভাববহুল পথপ্রদর্শনের দ্বিতীয় উদাহরণ অসম্ভব। সে সময়েই এই মুসলিম জোলার মানবধর্মের বাণীতে এমন এক অদ্ভূত আকর্ষণ ছিল যে, কবীরের সাথে পরিচিত হবার পর কোনো সাধারণ হিন্দু একজন সাধারণ মুসলমানকে ঘৃণা করতে পারত না। আর তাই কালের নিয়মে অনেক বড়ো বড়ো পির-পুরোহিত ধরাধামে এসেছেন আবার বিলীনও হয়েছেন নিয়মতো। শুধু এক সত্যপির কবীরদাস যেন প্রতি মন্বন্তরেই নৌকা ডুবে গেলে একটি বালকের রূপ ধরে একটা গুলবাগের ছালের উপর শুয়ে অন্তহীন স্রোতে ভেসে যেতে যেতে গেয়ে চলেছেন সেই গান, যে গান গেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য, যে গান গেয়েছিলেন ফকির লালন, যে গান গেয়েছিলেন কবি চন্ডীদাস –
“শুনহ মানুষভাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই...”
সামাজিক ইতিহাসের যতগুলো পাতা তিনি অধিকার করে আছেন তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি আলো ছড়িয়ে আছেন সাহিত্যাকাশে, নীরব চাঁদের মতোই। তাঁর রচিত অসংখ্য দোঁহাবলী (দোঁহা মানে দ্বিপদী) সাহিত্যের অতি মূল্যবান সম্পদ। এই দোঁহাগুলো কেবল যে দৃষ্টিনান্দনিক তাই নয়, উপরন্তু সেগুলো বড়ো বেশি শ্রুতিসুখকরও বটে। এমন কি এই রচনার মধ্যে দিয়ে তত্কালীন সমাজের বিভিন্ন দিক উঠে আসে অনির্বাপিত তুষাগ্নিপ্রায়। এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কেননা, তিনি সমাজের যে স্তর থেকে মাথা তুলেছেন সেখানে ছিল শুধুই পুড়ে যাবার ইতিকথা। আর সেকারণেই তিনি হতে পেরেছিলেন – পৃথিবীর মতো সহনশীল, জলের মতো নিরবয়ব, অগ্নির মতো পবিত্র,বায়ুর মতো স্বচ্ছন্দ্য এবং আকাশের মতো উদার – তাঁর এক দেহে লীন হয়েছিল পুরুষ ও প্রকৃতি, এক আধারে মিলেছিল একতার সর্বোত্কৃষ্ট নিদর্শন।
কে বলতে পারে! হয়তো বা এ সমস্তের শিকড়ে লুকিয়ে আছে তাঁর বৈচিত্র্যময় রহস্যঘন জন্মকথা। এ যেন এক কিংবদন্তির চরিত্রগাথা। যার জন্ম-জীবন-জরা সবই হেঁইয়ালিপূর্ণ। সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এ জন্য কোনো কোনো বিদগ্ধজন কবীরের অস্তিত্ত্ব বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন – হয়তো কোনো মুক্তমনস্ক মানুষ কবীর-এর ছদ্মনামে ধর্মের বাহ্য আচারাদি অন্তর্মুখিনতাকে বাক্শলাকায় বিদ্ধ করেছিলেন, যিনি কিনা সর্বদা একটা থাকা না থাকার মধ্যে, ধর্ম-বিধর্মের মধ্যে অবস্থান করতেন। অথচ সমস্ত কিছুর শেষ তাঁর মধ্যেই নিহিত। তাই হয়তো তিনি লিখেছিলেন –
“আমারই ভিতর সপ্তসাগর, আমারই ভিতর প্রবাহিত নদী আর শাখানদী।
আমারই ভিতর কাশী ও দ্বারকা, আমারই ভিতর দেবমন্দির শোভে নিরবধি।
আমারই ভিতর চন্দ্র সূর্য়, আমারই ভিতর ন’লক্ষ তারা।
কবীর কহেন, ওহে সজ্জন, পরম সত্য তিনি আমাতেই হয়েছেন হারা।”
তবে একেবারে অভ্রান্ত কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও নানা মুনির নানা মতো অতিক্রম করে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনি জীবিত ছিলেন তা মোটামুটি সন্তোষজনক। যদিও কবীর-গবেষক ডঃ ক্ষিতিমোহন সেন সুনিশ্চিত করেছেন, ১৩৯৮ খ্রিঃ, জ্যৈষ্ঠমাসে পূর্ণিমাতিথিতে সোমবারে কাশীর লহরতালার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫১৮ খ্রিঃ, মাঘমাসে কাশীর নিকটবর্তী বস্তীজেলার মগহর গ্রামে পার্থিবলীলা সংবরণ করেন। জন্মকাল সম্পর্কিত সমস্যার আপাত সমাধান হলেও তার পরিচয় বিষয়ে বেশ কিছু লোককথার উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন – তিনি নাকি এক দিব্যজ্যোতি থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আবার অন্য একটি বিবরণ থেকে জানা যায়, লহরতালার এক দীঘিতে বিকশিত পদ্মফুলে তাঁকে পাওয়া গিয়েছিল। তবে এসমস্ত অতিলৌকিক বৃত্তান্ত ছাড়াও দুটি আপাতগ্রাহ্য তথ্য এই যে – তিনি এক ব্রাহ্মণ বিধবার পরিত্যক্ত সন্তান এবং নিরু ও নিমা নামের এক মুসলমান মোমিন বা জোলা অর্থাৎ তন্তুবায় দম্পতি তাঁকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন অথবা, তিনি ঐ দম্পতির গৃহে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর কবিতা থেকে জানা যায় যে, খুবই অল্প বয়সে তাঁর পিতামাতা মায়ালোক ছেড়ে যান। তবে তিনি যাদেরই সন্তান হন না কেন, তাঁর ছিল স্ত্রী লোয়ী, পুত্র কামাল ও পুত্রী কমালী-কে নিয়ে আটপৌরে সংসারজীবন।
আবার জন্মপরিচয় যেহেতু এককাট্টা নয় তাই তিনি কোনো ধর্মাম্বলী ছিলেন সে বিষয়েও যথেষ্ট মতানৈক্য সুপ্রতিষ্ঠিত। শোনা যায়, ছেলেবেলায় হিন্দু বালকেরা তাকে মুসলমান আর মুসলমান বালকেরা হিন্দু বলে রাগাত। তিনি কোথাও নিজেকে মুসলমান বলে উল্লেখ করেননি, বরং পিতাকে ‘গোসাই’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার বাদশা ইব্রাহিমের সভায় প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সত্যই ইসলামধর্ম ত্যাগ করেছেন। এভাবে তাঁর ধর্মপরিচয়ও প্রহেলিকাময়। যদিও তিনি কোনোদিনই মুসলমান বা হিন্দু, কোনো ধর্মসম্প্রদায়েরই ধর্মগ্রন্থের কর্তৃত্ব মেনে নেননি। কোনো ধর্মেরই কোনো গোঁড়ামিতে তাঁর মন বাঁধা পড়েনি। তিনি যেমন নমাজ, মোল্লা, মসজিদ, রোজা, হজ, কাবা – এসব কিছুই মান্য করতেন না তেমনি, হিন্দুদের বর্ণভেদপ্রথা, পৌত্তলিকতার ঘোরতর বিরোধীও ছিলেন। এবং কবীরের এই ধর্মবিরূপতা সৃষ্টি করেছে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের উচ্চবর্ণের ঘৃণা। একারণে কবীর নিজের শ্রেণিগত অবস্থান কখনোই ভুলে যাননি। তিনি তাঁর কবিতায় সে কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন।
কবীর শব্দের অর্থ মহান, তাঁর এই নামকরণ করেন একজন কাজিসাহেব। কোরাণ খুলেই তিনি এই শব্দটি দেখতে পান। একটি দোঁহায় কবীর বলেছেন,-
“মহান তুমি, প্রভু, কবীর তুইও সেই, ‘মহান’ নাম তোর ভবে।
শরীর মায়া আগে ত্যজিতে পার যদি রামরতন লাভ হবে।”
সত্যিই! সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ পরমেশ্বরের মতো কবীর নিজেও এক মহান মনের মানুষ। মুসলমানের প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির প্রতি কবীরের তাচ্ছিল্যভাব দেখে একবার এক বিখ্যাত পির তাকে ‘কাফির’ বলে সম্বোধন করলে কবীর বলেন,- “যারা পরের ব্যথা বোঝে তারাই পির, যারা বোঝে না তারাই কাফির।” – এই একটি মাত্র কথা থেকেই বোঝা যায় তিনি কত বড়ো মাপের, বড়ো মনের মানুষ। মন কত বেশি সংবেদনশীল হলে তবে এই কথা বলা যায় তা সত্যি অভাবনীয়। অন্তরের অন্তস্থল থেকে যেন কুলকুন্ডলিনীর মধ্যে দিয়ে উদ্গীরণ হয়েছিল এই বাণীর, এই চরম সত্যের। সে যুগে কবীরের এরকম পরবেদনাকাতর মনোভাবের কারণে, স্পষ্টবাদিতার কারণে শুধু অবহেলিত, শুধু বিদ্রূপভাজন হতে হয়েছিল তাই নয়, বর্ণনাতীত শারীরিক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়েছিল – তা তাঁর কবিতায় স্পষ্ট। শুধু তিনিই নন, আমরা দেখেছি যুগে যুগে যাঁরা মানবধর্মকে প্রতিষ্ঠা দিতে এসেছেন তাঁরা সকলেই গোঁড়ামির ধারকবাহকদের দ্বারা চরম নিগৃহীত হয়েছেন। তাই,- সন্ত কবীর, কবীর শা, আল কবীর, কবীর সাহেব, কবীর কিংবা কবীরদাস – যে যাই বলে তাঁকে সম্বোধন করুন না কেন মুহম্মদ, শ্রীচৈতন্য, যিশুখ্রিষ্ট প্রমুখের মতো সমকালে না হোক পরবর্তী সময়ে তাঁর ধর্মদর্শন সার্বজনীনতা পেয়েছে – এখানেই তিনি সার্থক।
ভক্ত কবীর প্রায় দীর্ঘ একশকুড়ি বছর জীবিত ছিলেন। শোনা যায়, তিনি যখন অসুস্থ, মৃত্যুশয্যায়; তখন হিন্দু ও মুসলমান অনুরাগীদের মধ্যে তাঁর পারলৌকিক কৃত্যবিষয়ে বিবাদ বাধে। এই দুই সম্প্রদায়ই কবীরকে স্বজাতিভূক্ত বলে দাবি করেন। কিন্তু এই হট্টগোল তাঁর পছন্দ হল না, তিনি একটি চাদর নিয়ে নিভৃতে গিয়ে শয়ন করেন। এবং যখন চাদর সরানো হল তখন সেখানে শুধু একরাশ ফুল পাওয়া গেল। যার অর্ধেক মুসলমানেরা নিয়ে কবর দেন আর বাকি অর্ধেকে হিন্দুরা বানালেন সমাধি। আজও যেখানে দুই ধর্মমতের অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাপূর্ণ বিনম্র ভক্তিরস বকুলফুলের সৌরভের মতোই মানবধর্মকে পৌঁছে দেয় বিশ্বময়।
পরিশেষে বলা যায় যে, প্রায় পাঁচশো বছর আগে একজন নিম্নশ্রেণির নিরক্ষর, প্রথাগত শিক্ষাহীন, হতদরিদ্র, জাতকুলমানরহিত ব্যক্তি শুধুমাত্র সত্যনিষ্ঠার জোরে, আত্মবিশ্বাসের ঔদার্য়ে, মহানুভবতার মাহাত্ম্যে, অকল্পনীয় দুঃখ-দুর্দশার দৌরাত্ম্যে ও পারিপার্শ্বিক সর্বপ্রকার জ্বালা যন্ত্রণার দশচক্রে জনগণের ভাষাকে অবলম্বন করে হয়ে উঠলেন সর্বভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা। বারানসীর সেই জোলা ভিন্ন ভিন্ন মতো, পথ ও রূপের ভারতজীবনের বিক্ষিপ্ত তন্তুগুলোকে সংগ্রহ করে যেন অপূর্বসুন্দর একটিমাত্র বয়নকর্ম সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন। ভারতের ইতিহাসে একতার এতো মনোরম এবং ভাববহুল পথপ্রদর্শনের দ্বিতীয় উদাহরণ অসম্ভব। সে সময়েই এই মুসলিম জোলার মানবধর্মের বাণীতে এমন এক অদ্ভূত আকর্ষণ ছিল যে, কবীরের সাথে পরিচিত হবার পর কোনো সাধারণ হিন্দু একজন সাধারণ মুসলমানকে ঘৃণা করতে পারত না। আর তাই কালের নিয়মে অনেক বড়ো বড়ো পির-পুরোহিত ধরাধামে এসেছেন আবার বিলীনও হয়েছেন নিয়মতো। শুধু এক সত্যপির কবীরদাস যেন প্রতি মন্বন্তরেই নৌকা ডুবে গেলে একটি বালকের রূপ ধরে একটা গুলবাগের ছালের উপর শুয়ে অন্তহীন স্রোতে ভেসে যেতে যেতে গেয়ে চলেছেন সেই গান, যে গান গেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য, যে গান গেয়েছিলেন ফকির লালন, যে গান গেয়েছিলেন কবি চন্ডীদাস –
“শুনহ মানুষভাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই...”
অলংকরণ – মেঘ অদিতি
5 comments:
সাধুবাদ - বানীব্রত, এ লেখার জন্য।
দুর্দান্ত লিখেছিস ভাই ।
লেখায় আপনাকে পেয়ে ভালো লাগলো দাদা!
থ্যাঙ্ক ইউ ভাই মিলন!
মেঘ অদিতিদিকে আমার অনেক ভালোলাগা জানাই এই সুন্দর অলংকরণটির জন্য।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন