লিও
কি দুঃখে যে জগদীন্দ্র বাবু ছেলেকে বাড়ির নাম রাখতে বলেছিলেন । এখন তো কলকাতায় কেন, কলকাতার উপকণ্ঠেও বাড়ি করার যো নেই । প্রথম কথা, প্ল্যান পাশ করাতে গেলেই হাজার ঝামেলা। আসলে প্রোমোটাররা নিগমবাবুদের হাত বড়ো করে দিয়েছে, আজকাল দু-পাঁচ হাজারে কিছু হবার নয়। ঘ্যান ঘ্যান করলেই ভাববাচ্যে শুনতে হবে, আজকাল ইলিশ যাচ্ছে বারোশো করে, কাঁচা লঙ্কাই আট টাকা শ’, এই বাজারে সস্তায় কিছু হয় ? এটা অবশ্য বাবুরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন ধরে নিতে হবে। ওই যে কথায় বলেনা , ‘পড়লে কথা সভার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে’ – সেই আর কি।
তারপর যদিবা প্ল্যান বেরোল, আপনি মিস্তিরি খাটাবেন, তার যো নেই। কাজটা লেবার কন্ট্রাক্টরকে দিতে হবে, সব ‘ইস্কোয়্যার ফুট’ এ হিসেব। গাঁথনিতে মশলা বেশি পড়ছে কেন, ইঁট ভেজানো হয়নি কেন, এসোব প্রশ্ন করার অধিকারও নেই আপনার। আর মশলা ? সবই তো সিন্ডিকেট থেকে কিনতে হবে। যে ইঁট দিয়ে আপনি বাগানের রাস্তার সোলিংও করতেননা, তাই দিয়েই গাঁথনি হবে, যে বালিতে বাদাম ভাজাও হয়না, তাতেই মশলা মাখা হবে, কি আর করা। কিছু বললেই ক্লাবের ছেলেরা বলবে, দাদা, বাঁচবেন তো মেরে কেটে সত্তর, যদি ডেঙ্গিতে তার মধ্যে না মরেন। এখন বয়স পঞ্চাশ। মা কালির দিব্যি এ বাড়িটা কুড়ি বছর টিকে যাবে, গ্রান্টি। তারপর আপনার ছেলের চিন্তা, আপনি খামোখা ব্যাটারী পোড়াবেন না। পাড়ায় ঢোকার ‘ফী’ হিসেবে প্রথমবারের দুগ্গাপূজোয় দশ হাজার টাকা চাঁদার কথা না বললেও চলবে, কাঁচা লঙ্কাই বলে আট টাকা শ’ -
তবে জগদীন্দ্রবাবু বাড়িটা বানিয়েছেন আগে। সে সময়ে নিজের বাড়ি নিজেই করা যেত। আহা কি সুদিন ছিল সে সময়ে। বাড়িটা অবশ্য বিরাট কিছু নয়, একতলা আর সিঁড়ির ঘরের লাগোয়া একটা ছোট্ট মতোন আস্তানা লিওর জন্য। এই দেখ, নিজেই ‘লিও’বলে ফেললেন, কানের কাছে রাতদিন শুনলে হবেনা ? জগদীন্দ্রবাবু ছেলেকে বলেছিলেন, বাড়িটার একটা ভালো দেখে নাম ঠিক করতো, খুব শখ ছিল, নিজের একটা বাড়ি হবে, তার সামনে শ্বেত পাথরের ফলকে নাম লেখা থাকবে, অনেক দিনের শখ।
অনেক ভেবেও বাড়ির নাম ঠিক করতে পারছিলেন না জগাবাবু। ‘আশীর্বাদ’ নামের একশো বিয়াল্লিশটা বাড়ি দেখেছেন, কলকাতা, আসানসোল আর চিত্তরঞ্জন মিলিয়ে। অমুক কুঞ্জ, তমুক আশ্রয়-ও গন্ডায় গন্ডায়। গিন্নীর নাম শ্যামলী, কিন্তু ‘শ্যাম মঞ্জিল’ বা ‘জগদীন্দ্র প্যালেস’ নাম দিলে হাসতে হাসতে বহু লোক মারা পড়বে, তখন আবার খুনের দায়ে। আসলে এমন কিছু বড়ো নয়তো বাড়িটা । পিতৃ স্মৃতি বা মাতৃ স্মৃতি দিতেও উনি রাজী নন। গুরুচরণ বাবু, মানে জগাবাবুর স্বর্গীয় পিতাঠাকুর, ফাটকা খেলে সব টাকা উড়িয়েছেন। কিছু বলতে গেলে মাতাঠাকুরাণী আবার তাঁর পতিদেবকেই সাপোর্ট করেছেন, যা-ই করুক, নিজের টাকায় করেছে, তোর টাকায় তো হাত বাড়ায় নি। অতএব তাঁদের এবাড়িতে আমৃত্য থাকতে দেয়া হয়েছে , এই ঢের। রায়চৌধুরি হাউস, বা মুখার্জী নিবাস, এই ধরণের নামও দেয়া যাচ্ছেনা, ‘কর্মকার’ পদবীটা একটুও কাব্যিক নয়। নিজের বংশধারার ওপর জগদীন্দ্রবাবুর একটা চাপা ক্ষোভ বহুদিন ধরেই পোষা।
জগাবাবুর ছেলের নাম শ্রী নির্মলেন্দু কর্মকার ওরফে নিমু। শ্যামলীদেবী একবার নামকরণের সময়ে গাঁইগুঁই করেছিলেন, হ্যাঁগো, তোমার, আমার কারো নামের ছাপই তো রইলনা, নির্মলেন্দু আবার কেমন হ’ল? নিদেন পক্ষে একটা ‘ইন্দ্র’ তো লাগাবে ? জগাবাবু বললেন, কেন, আমার বাপের নাম তো গুরুচরণ, আছে আমার নামে চরণ টরণ? শ্যামলী দেবীর ভাই রতন বেশ ট্যারা। জগাবাবু বললেন, দেখো ভাই, তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাতের বদলে আঙুল না কামড়ে দেয়। হ’লও তাই, রতন উঃ করে উঠল। বলল, জাঁই বাউ, জলাতঙ্কের ইঞ্জেকশন নিতে হবে নাকি ? জগা বললেন, ধুস্শালা, এটা কুকুরের বাচ্চা নয়, মানুষের।
সেই নির্মলেন্দু, খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, পাস কোর্সে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বসে আছে। আমার ছেলেটার কিসুই হ’লনা, ব্যাটা ম্যাট্রিকটাও পাশ কর্তে পার্লোনা, বলে যে সমবেদনা কুড়োবেন, তারও জো নেই। আর চাকরি বাকরি ? আজকাল এম ফিল, ডক্টরেট, মুভিং অ্যারাউন্ড ফ্যা ফ্যা, তো পাস কোর্সের গ্র্যাজু। সেই নির্মলেন্দু ওরফে নিমুকে জগদীন্দ্রবাবু বলেছিলেন, বাড়িটার একটা ভালো দেখে নাম ঠিক করতো, দেখিস আবার ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ রাখিস না যেন। সুকুমার রায় না কে যেন বলে গেছে ভূমিকম্পে বাড়ি পড়ে যাবে।
নিমু সেসময়ে নানারকম বইপত্তর পড়তো। চাকরি যদিও হওয়ার চান্স শূন্যের সামান্য ওপরে, তবু জেনারেল নলেজ টলেজ খুব ঘাঁটছিল, বলা তো যায়না, অসম্ভবও সম্ভব হয় শোনা যায়। একদিন বিশ্বজয়ীর মুখ নিয়ে এসে জগদীন্দ্রবাবুকে বলল, পেয়ে গেছি। জগাবাবু আরামে নাক খুঁটছিলেন, আঙুল ওখানে রেখেই বললেন, কিঁ পেঁলি বাঁবা, চাঁকরি ? নিমু বলল, নাঃ, বাড়ির নাম – ‘মোনালিসা’।
বিশ্ববন্ধুবাবুকে নিমু জ্যাঠামশাই ডাকে। তিনি যে কলেজে পড়ান, তার নামও ‘বিশ্ববন্ধু কলেজ’।
আধার আর আধেয় এক নাম হলে ব্যাকরণে কি যেন বলে? যাকগে, তিনি বললেন, ‘মোনালিসা’ নাম দিয়েছে ? ছেলে দেখি ক্ষণজন্মা। ওর নাম তাহলে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। সেই থেকে লিওনার্দো, ছোটো করে ‘লিও’। কালে কালে এমন হ’ল। নিমু নামটা হারিয়েই গেল।
নন্দর সেলুনে সকাল থেকে লাইন মেরেছে লিও। নন্দ চুল কাটবে, মাখনের মতো দাড়ি কেটে দেবে, তার ওপর গোলাপি রঙের কি সব চট্চটে জিনিষ মুখে লাগিয়ে ফেশিয়াল না কি বলে, তাই করে দেবে। পাশের ফ্ল্যাট বাড়ির গঞ্জাল্ভেস আঙ্ক্ল একটা সুন্দর নীল রঙের টাই দিয়েছেন। তাঁর ছেলে সেবাস্টিয়ান ডন বস্কোতে পড়ে, বলল, লিও দাদা, তোমায় টাই বাঁধা শেখাতে আমার দিন কাবার হয়ে যাবে, বরং ফস্কা গিঁট বেঁধে দিচ্ছি, তুমি মাথা দিয়ে গলিয়ে নিও। লিওর আজকে ইন্টারভিউ। যদিও প্রাইভেট কোম্পানী, কোনো সোর্স ছাড়া এসোব জায়গায় চাকরি হয়না। তবু আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে আর সেই সব মানুষের মধ্যে লিও-ও পড়ে।
লিও রাত জেগে জি কে মুখস্ত করেছে। পৃথিবী থেকে চাঁদে ছ’বার যাতায়াত করলে কত মাইল ট্র্যাভেল হবে, সোনিয়া গান্ধীর মায়ের কুমারী নাম কী ছিল, উনিশশো বাহাত্তর সালে ভারত কত ভোজ্য তেল আমদানী করেছে, এই সব সোজা সোজা প্রশ্ন আসবে বলে মনে হয়না। তবু, দেখা তো যাক। লিও খুব টেনশনের মধ্যে আছে। লোকাল ট্রেনে শুভযাত্রা বলে একটা ভিখিরীকে পাঁচটাকার নোট ভেবে ভোটার আইডি কার্ডটাই দিয়ে দিয়েছিল। লোকটা ভালো, বলল, মামু এইটা রাখেন, আর একখান পাস ট্যাহা দ্যান তাইলে, আপনের সব কাম সফল অইব, কইয়া দিলাম।
ইন্টারভিউ বোর্ডে একজনই, মিসেস বিজলানি। দুপাশে দুজন রয়েছে বটে, তবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা এলেবেলে। বিজলানি বললেন, ইয়র নেম ? লিও বলল, নির্মলেন্দু কর্মকার স্যার, ইয়ে সরি, ম্যাডাম। বিজলানি বললেন, কোর্মা-কর ? আর ইউ ফ্রম মহারাষ্ট্র ? লিও বলল, ইয়েস স্যার, সরি সরি, নো ম্যাডাম। বিজলানি বললেন, ভেরী ডিফিকাল্ট নেম, সো মেনি আর’স, ওয়ান, টু থ্রী। আই ডু নট লাইক টু কল মাই এমপ্লয়ীস বাই আ ডিফিকাল্ট নেম, ইট ট্রাব্লস মি। ইউ মে গো।
বিরস বদনে উঠে দাঁড়িয়ে নির্মলেন্দু গড়গড়িয়ে বাংলায় বলল, আর একটা নাম আছে স্যার, মানে, ম্যাডাম – ‘লিও’।
বিজলানি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন, লিও ? ডিড ইউ সে লিও ? ওওওও লিও আই মিস ইউ সো মাচ। ফ্যাঁচ করে চোখের জল, নাকের সিকনি সব একসঙ্গে মুছে তিনি বললেন। লিও ওয়জ মাই মোস্ট ফেভরিট ডবারম্যান। হি হ্যাজ লেফট আস ওনলি ইয়েস্টারডে। ওওওওও লিও ( আবার ফ্যাঁচ), ইউ রিপোর্ট ফর ডিউটি ফ্রম টুমরো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললেন, মন দিয়ে কাজ করো, ইউনিয়ন টিউনিয়ন কোরোনা বাবা, আমার লিয়াসোঁ অফিসার অলিম্পিক ফেরৎ, জানতো? পাছায় ততটুকু জোরে লাথ মারবে, অটোস্ট্যান্ড অবধি উড়ে যেতে যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি না। কাল থেকে এসো, কেমন ?
অলংকরণ – মেঘ অদিতি
3 comments:
হা হা হা ! প্রবচনটা মিথ্যে করে দিলে হে, রূপঙ্কর ! গোলাপকে এবার লিও নামেই ডাকতে হবে !
ফ্যন্টা !
খুব মজা পেলাম ! চমৎকার !
খুব মজা পেলাম চমৎকার !
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন