সতীনাথ মাইতি
এ ক’দিন একটাও লেখা লিখিনি। লিখতে পারিনি। যখনই মনে পড়ছে ফোনালাপের শেষে সেই কণ্ঠস্বরে ‘ তুমি ভালো থেকো’ তখনই কি-বোর্ড থেকে সরে গেছে হাত। নিব থেকে সমস্ত কালি শুষে নিয়েছে পাতা। সেই শূন্য পাতা যার দিকে চেয়ে কবি লিখেছিলেন ‘ সাদা পৃষ্ঠা ও কলম নিয়ে বসে আছি’ ( “ হে প্রথম লাইন” )।
প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর লেখা একশো বছর পরে মানুষ পড়বে কি না, তা নিয়ে। উত্তরে বলেছিলেন ‘ না কেউ পড়বে না ’। আমরা বলি পড়বে। কারণ তাঁর লেখা আপাত লঘু মনে হলেও ওখানেই সর্বনাশ, যেমন- ‘ সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম’
( ‘হে সুন্দর’ / “বালুকণার মতোন অ-সামান্য ’’ )। একবার পড়লেই মনে থেকে যায়। তাই-তো তিনি বলেছিলেন – আমি তো লিখি না, পাতা উল্টে যাই কেবল। লেখার আগেই তাঁর মধ্যে লেখা তৈরি হয়ে যায় আর তাই উচ্চারিত হয় অমোঘ পঙক্তি। ধ্বনিত হয় এমন এক এক শব্দাক্ষর যা আবিষ্ট করে মনকে। মন আপন ঢঙে বলে ওঠে, ভালোবাসি কবি তোমায়। ভালোবাসি তোমার কবিতা।
সত্যি কথাটা বলে গিয়েছেন আজীবন। কি বাস্তবে , কি কবিতায়। সম্প্রতি লিখেছেন ‘ একটিমাত্র সন্তান/ স্বাতী এখন ভুল বুঝতে পারছে’ ( “এক সন্তান’’ )।
সুনীল এখন কোথায়? দিকশূন্যপুরে না নিশ্চিন্তপুরে? নাকি উভয় স্থানে? কে জানে?
তার আগে কিছু আলোচনা সেরে নেওয়া যাক।
প্রেম পদাবলী
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
“দেখা হবে”
‘আমার কুঠার দূরে ফেলে দেব, চলো যাই গভীর গভীরতম বনে...’
কোথায় হারিয়ে গেলেন নীললোহিত?
শিরায় শিরায় ধুম লাগিয়ে কোথায়? কোনো অজানায়? ইতিমধ্যে নীরার মৃত্যু ঘটেছে বুঝি? তাই চলে গেলেন! গাছের শাখায় শাখায় পাতা আর রোদের ফাঁকে ধ’রে ফেলেছেন বুঝি প্রেম? হে অরণ্য তোমার দিন রাত্রি দিয়ে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছে দাও। খুবই নিভৃতে। গোপনে, গহীনে। নিরাকার নীরা-তে কোথায় জাগেন ঈশ্বরী?
যারা কলকাতা শাসন করত তারা কী আবার মিলবে নীরানগরীতে? লোকচক্ষুর অন্তরালে দেবী বন্দনায়?
“আয়ু যত কমে আসে, ততই আরও তোমাকে আরও কাছে পেতে চাই ভালোবাসা”
এই ভালোবাসা কবির একান্ত নিজস্ব। যা ঘুরে ফিরে আসে কবির নিজস্ব গানে, অন্তরালে ও শয়নে। নীরা ক্রমশ একক নারী থেকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক সঙ্গমে। নিরাকার সাধনায় কবির ‘বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন’। রবীন্দ্র-দর্শন থেকে একই আদলে কিন্তু ভিন্ন মাত্রা সংযোগে ।
তাই-তো নীরা-র কোনো ছবি হয় না। প্রেমিকা যখন সাধনা হয়ে ওঠে তখন সেই বিষয় থেকে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর কবি তো নারী প্রীত হবেন-ই। সেখানে বিখ্যাত বা অখ্যাত ব’লে কিছু হয় না। তাই নীরা থুড়ি নারীর স্বরূপ উন্মোচিত হতেই থাকে। কবি সবই প্রকাশ করেন মনোভঙ্গি দিয়ে আর আমরা মানুষগণ কৌতুহলো নিরসনে অযথা প্রশ্ন ক’রে যাই, এই দোষে দুষ্ট হ’তে থাকলে আমরা বোধহয় বাঙালি হয়েই থাকবো, সুনীলের ন্যায় আন্তর্জাতিক বাঙালি হ’তে পারবো না।
“বহতার দূতী তুমি কী এনেছ দু'হাতে?
দিগন্তের বর্ণময়ী দু'চোখে কেন অশ্রুর কুয়াশা
পা ধোবে এই শুকনো নদীর ঘাটে?
এখানে অনেক দীর্ঘশ্বাস ছিল
সব উড়ে গেল তোমার হাসির শব্দে”
দিগন্তের বর্ণময়ী দু'চোখে কেন অশ্রুর কুয়াশা
পা ধোবে এই শুকনো নদীর ঘাটে?
এখানে অনেক দীর্ঘশ্বাস ছিল
সব উড়ে গেল তোমার হাসির শব্দে”
কে যে হাসির শব্দে আজ আমাদের দীর্ঘশ্বাস থুড়ি আর্তনাদ উড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে চঞ্চল অভিসারে? কে জানে?
“অনেক হয়েছে, শরীরে এবার শিকল সরাও
বাঁধ ভাঙা এই নদীর কিনারে
বসে আছি আমি সেই কবে থেকে বন্দিমানুষ
আমায় এবার জল ছুঁতে দাও” ( “পাখির চোখে দেখা ৫”)
শারদীয়ার আঙিনায় অনেক লিখে জল তো ছুঁলেন। স্থলেও এলেন বোধহয়। তারপর উৎসবের ভরা মরশুমে ফিরে গেলেন কোনো অচিনপুরে? নিজেকে যিনি ভালোবাসেন তিনিই একাধিক নাম দেন নিজের, যেমন- নীলু, নীল উপাধ্যায়, সনাতন পাঠক। এত নামে রক্ষে নেই, তাই এসে হাজির সেই নাম “নীললোহিত”। তা নীলু বন্দনাদি-কে রক্তাক্ত ক’রে দিকশুন্যপুরে থুড়ি নিশ্চন্তপুরে এ তোমার কেমন যাত্রা? নীল, নীলু, ও নীললোহিত?
উত্তর দিচ্ছ না যে বড়ো!
দিনলিপিঃ ১৯৯০
সুনীল আপনি ৩, ৫,১১,১৮,২৫ জানুয়ারিতে লিখেই কি ফেলেছিলেন
“কিছুই ভালো লাগছে না। কিছু না। এক একদিন এরকম হয়?”
আজ এই ২৫শে অক্টোবরে যদি লিখে ফেলি কিছুই ভালো লাগছে না আমাদের তবে নিশ্চিন্তপুর থেকে একটি শিরিনফুল পাঠিয়ে দেবেন। ওই দিয়ে যখন “ছাতিম ফুলের মশলা মশলা গন্ধ” বেরোবে তখন যদি বুঝতে পারি আবার ফিরে আসছে উৎসব, কিন্তু শারদ সং খ্যা-তে আপনি নেই; তখন কেমন ক’রে আমরা তাকাবো, কেমন ক’রে? উত্তর দিন সুনীল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। এমন তো কথা ছিল না । স্বাতীকে পটিয়ে ঘুম দেখতে চেয়েছিলাম আমি। তা এ কোনো ঘুম উপহার দিলেন কবি? এ কোনো ঘুম!
১৯৩৩ সালের একটু আগের সময়ের আপনি এই ২০১২-র ২৪ শে অক্টোবরকে চিনতে পারছেন? এখন তীব্র আলোকের শেষে ঘন বুনটের আঁধার নেই। এখন কেবল ‘ অন্ধকার রাত্রি’। মধ্যের ৭৮টি বছর কী আপনার ছিল “নীললোহিত?” অ-নিশ্চিন্তপুর থেকে ‘গুণিনের বাণের’ মতোন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যান নিশ্চিন্তপুরের যাত্রী আপনি অধরা সুনীল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন