শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

বিস্মৃত ইতিহাস - মিলন চট্টোপাধ্যায়

কালের আড়ালে শ্যামাচরণ
মিলন চট্টোপাধ্যায়



বাঙ্গালী সতত গর্ব করে তার ইতিহাস নিয়ে , চায়ের পেয়েলায় তুফান তুলতেও আমাদের জুড়ি মেলা ভার । আবার ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা কতটা পারঙ্গম তাও আমাদের জানা এবং এক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞানপাপী বলাটাও অত্যুক্তি নয় ।

আজ থেকে দু'শো বছর আগে বিহারের পূর্ণিয়াতে এমন একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন যাঁকে বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বললেও কম বলা হয় । কিন্তু আমরা তাঁর কিছুই প্রায় জানিনা । যে জাতি বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের নামে মাথা নিচু করে তাদের এমন বিস্মৃতি শুধু হতাশাজনকই নয় লজ্জাকর'ও বটে ।

সন - ১৮১৪ ( ১২২০ বঙ্গাব্দ , ৮ই চৈত্র , রবিবার ) , বিহারের রানি ইন্দুমতি'র দেওয়ান , চৈতন্য দীক্ষাগুরু কেশব ভারতী'র উত্তরপুরুষ হরনারায়ণ সরকারের ঘরে বেজে উঠল মঙ্গলশঙ্খ , বাবা হলেন তিনি । পুত্রের নাম রাখা হল শ্যামাচরণ । আদরে - আহ্লাদে বেড়ে উঠতে লাগলেন তিনি । কিন্তু সৌভাগ্য কারো বেশীদিন থাকে না , মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃহারা হলেন তিনি । মায়ের হাত ধরে ফিরে এলেন পিতৃগৃহ নদীয়া জেলার মামজোয়ান গ্রামে । সেখানে একটিমাত্র পাঠশালা , তেমন পড়াশোনার সুবিধা নেই ; তবুও নিরুপায় হয়েই শিক্ষালাভ হতে থাকলো পাঠশালায় । চোদ্দ বছর বয়সে এক জ্ঞাতির শ্রাদ্ধ উপলক্ষে কৃষ্ণনগর গেলেন শ্যামাচরণ, সেখানেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা'র পরিচয় পেয়ে তাঁকে নিজের বাড়িতে থেকে পড়তে বললেন কাকা হরচন্দ্র সরকার । হাতে চাঁদ পেলেন শ্যামাচরণ , সেখানে তাঁকে পড়াতে শুরু করলেন রামতনু লাহিড়ী'র জ্ঞাতি শ্রীনাথ লাহিড়ী । অল্পদিনের মধ্যেই ফারসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করলেন শ্যামাচরণ । ইতিমধ্যে রামতনু লাহিড়ী'র সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তাঁর । কুড়ি বছর বয়সে কোলকাতায় এসে পিতৃবন্ধু রীড সাহেবের অধীনে ১০ টাকা বেতনে মুন্সী পদে নিযুক্ত হলেন । কিছুদিন পরে একটি মামলায় রীড সাহেবের হয়ে মিথ্যা সাক্ষী দেবেন না বলে চাকরী ছেড়েও দিলেন । এইসময় রামতনু লাহিড়ী'র চেষ্টায় জোসেফ কোম্পানির অফিস ইনচার্জ জোসেফ সাহেবকে হিন্দি পড়ানোর জন্য মাসিক কুড়ি টাকায় নিযুক্ত হলেন , তখন তাঁর বয়স বাইশ বছর , এই সময়েই তিনি রামতনু লাহিড়ী'র কাছে ইংরাজি পড়তে শুরু করলেন । ইতিমধ্যে একদিন অশুদ্ধ উর্দু বলে উপহাসিত হওয়ায় তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন উর্দু শিখবেন এবং ১৮৩৭ সালের আগেই হিন্দি, ইংরাজি ও উর্দুতে পারঙ্গম হয়ে উঠলেন । এইসময়েই তিনি ল্যাটিন, গ্রীক, ইটালিয়ান ভাষা শিখতেও শুরু করলেন ।

১৮৩৭ সালে , কোলকাতা মাদ্রাসায় বাংলা পণ্ডিত হিসাবে মাসিক পঁচিশ টাকায় নিয়োজিত হলেন শ্যামাচরণ , পরে তা বেড়ে মাসিক চল্লিশ টাকা হয় । এরপর ১৮৪২ সালে কোলকাতা সংস্কৃত কলেজে মাসিক সত্তর টাকায় দ্বিতীয় ইংরাজি শিক্ষক রূপে যোগদান করেন । ছ'বছর পর তিনি সদর দেওয়ানি আদালতে পেশকার রূপে নিয়োজিত হন , এইসময় তাঁর খ্যাতি অনুবাদক হিসেবে ছড়িয়ে পরে এবং তখন তিনি মাসিক চারশ টাকায় এই আদালতে প্রধান অনুবাদক হিসেবে যুক্ত হন ( ১৮৫০ ) । ১৮৫৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট তাকে 'Chief interpreter' হিসেবে মাসিক ছয়শ টাকায় নিয়োগ করে । বাঙ্গালীদের মধ্যেই শ্যামাচরণ'ই প্রথম এই পদ অলঙ্কৃত করেন । ১৮৭২ সালে তিনি ' Tagore law lecturer ' মনোনীত হন । এই ঘটনাটি ১৮ ই জুলাই ১৮৭২ এর অমৃতবাজার পত্রিকায় ছাপা হয় । এই পদের সম্মানদক্ষিণা ছিল দশহাজার টাকা । এই সময় মুসলমান আইন নিয়ে তিনি যে বক্তৃতা দেন তা ১৮৭৩-৭৪ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় । এরপর ১৮৭৪ সালে শ্যামাচরণ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হন যা ৬ ই মার্চ, ১৮৭৪ এ ভারত সংস্কারক পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এ প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি ( ২৬ শে জুলাই ১৮৭৬ ) ।

১৮৫৮ সালে তিনি এক বৈপ্লবিক কাজ করেন , নিজের গ্রাম মামজোয়ানে প্রতিষ্ঠা করেন ইংরাজি- বাংলা অবৈতনিক বিদ্যালয়, এছাড়াও প্রচুর জনহিতকর কাজও তিনি এসময় করেন । মা যাতে গ্রামের বাড়ি থেকে ট্রেন দেখতে পান সেজন্য তিনি মামজোয়ান থেকে বাদকুল্লা পর্যন্ত একদম সোজা একটি রাস্তা নির্মাণ করান যা ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ - মাতৃভক্তির এ এক অসামান্য নিদর্শন । এই রাস্তাটি বর্তমানে ' শ্যামাচরণ সরকার রোড 'নামে খ্যাত । ১৮৮২ সালের ১৪ ই জুলাই শ্যামাচরণ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

শ্যামাচরণ শর্ম সরকারের লেখা কিছু বই ~

(১) Introduction to the Bengali Language adapted to students who know English - In two parts BY a Native.
(২) বাঙ্গলা ব্যাকরণ
(৩) ব্যবস্থা দর্পণ
(৪) THE MUHAMMADAN LAW : being a digest of the law applicable especially to the sunnis of India, Calcutta 1873, P.P 567 , TAGORE LAW LECTURES, 1873
(৫) THE MUHAMMADAN LAW : being a digest of the sunni code in part and lmaniyah code, Calcutt 1875 , TAGORE LAW LECTURES, 1874
( এই দুটি বই প্রথম মুসলিম আইন গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত । এইজন্য এখনও একে 'SHYAMACHARAN LAW ' বলে অভিহিত করা হয় । )
(৬ ) সিরাজিয়া
(৭) VYAVASTHA CHANDRIKA, a digest of Hindu Law as current in all the provinces of India, Except Bengal proper vol. 1. 1878, vol. 11.1880
(৮) পাঠ্য সার ।
(৯) নীতি দর্শন ।

শ্যামাচরণই একমাত্র ,যার বই মস্কো লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে । প্রথম আইন গ্রন্থ প্রণেতা, এখনও মুসলিম আইন নিয়ে কথা বলতে ‘আমরা শ্যামাচরণ ল‘এর শরণাপন্ন হই ।প্রথম সিনট্যাক্স সম্বলিত বাংলা ব্যাকরণ প্রণেতা , পরপর পাঁচবার সুপ্রীমকোর্টের 'Chief interpreter' , প্রথম বাঙালি হিসেবে ' Tagore law lecturer ' ( প্রসন্নকুমার ঠাকুরের নামে এই পদ ) ।

শ্যামাচরণের ভাগ্যে বহু অপবাদ জুটেছিল , তারমধ্যে অন্যতম হল তিনি নীল বিদ্রোহের সময় চুপ ছিলেন । আজ জানা যাচ্ছে - দীনবন্ধু মিত্র'র 'নীলদর্পণ' নাটকের অনুবাদ করেছিলেন শ্যামাচরণ ' BY a Native ' নামে যা তৎকালীন আরেক বিখ্যাত পুরুষ ' বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ' , মধুসূদন দত্ত'র লেখা বলে প্রচার করেছিলেন ! যদিও স্বয়ং দীনবন্ধু মিত্র , তাঁর 'সুরধনী' কাব্যে লিখেছিলেন -

" চলিতে চলিতে পরে চড়ি যে লহরী
দেখিলাম সুখে মামজোয়ানি নগরী
মামজোয়ানিরে তোর সার্থক জীবন,
দিয়াছ সমাজে শ্যামচরণ রতন ... "
আশা করা যায় , স্বয়ং নীলবিদ্রোহের অন্যতম রূপকার বিনাকারনে এই প্রশস্তি করেন নি । যদি শ্যামাচরণ নীলবিদ্রোহকে সমর্থন নাই করতেন তবে এই লেখা লিখিত হত কি ?

আরেক সম্মানীয় মানুষ ' বিদ্যাসাগর ' , শ্যামাচরণের ব্যাকরণ না পড়েই ' ফুঃ ফুঃ ' করে তাচ্ছিল্য করে সরিয়ে রেখেছিলেন ! ভাবতে অবাক লাগে যাকে আমরা জানি 'দয়ারসাগর' রূপে তিনিও এমন করেছিলেন ! যদিও পরবর্তীতে বিদ্যাসাগর স্বীকার করেছিলেন তাঁর ভুল হয়েছিল ।

আজ এই সময়ে আমাদের উচিৎ এমন এক মানুষের জন্য কিছু অন্তত করা , যাতে এতদিন যে অনাদরের ধুলো পড়েছে তাঁর গায়ে তা কিছুটা হলেও মোছা যায় ।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি -

১। শ্যামাচরণ সরকারের জীবনচরিত / বেচারাম চট্টোপাধ্যায়
২। 'গোরাগাঙনি'
৩। স্মারক পত্র
( মহাত্মা শ্যামাচরণ শর্ম সরকার দ্বিশতবর্ষ উদ্‌যাপন সমিতি , শান্তিপুর শাখা কমিটি )

বিশেষ কৃতজ্ঞতা -

গোরাগাঙনি টীম,
দীনবন্ধু সরকার ,
গৌতম অধিকারী,
গৌতম চট্টোপাধ্যায়
এবং
নিজের কানজোড়া'কে ।