শিল্পী সুধীরঞ্জন মুখার্জীর সাক্ষাৎকার
( সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিল্পী অমিত বিশ্বাস )
( সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিল্পী অমিত বিশ্বাস )
১) প্রথমেই জানতে চাইবো শিল্পজগতে কি ভাবে এলেন ?
বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ওনার পাঞ্জাবীর পকেটে থাকতো খড়ির টুকরো বা Chalk। আমার ছবি আঁকার হাতে খড়ি তাই দিয়েই। তখনও আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। চন্দননগরে ভাড়াবাড়ির লাল মেঝের লম্বা বারান্দায় মনের আনন্দে এঁকে যেতাম রেলগাড়ি, মানুষ, বাড়িঘর এইসব। অন্যান্য মফঃস্বলের মতো চন্দননগরেও বারোয়ারী পূজোর খুব ধূম ছিল। আর বাড়ির কাছেই ছিল কুমোরবাড়ি। তাই একটা কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে মূর্তি নির্মাণের শেষ পর্যায় পর্যন্ত দেখতাম। এই সব দেবতারাও আমার চকখড়ির ড্রইং এ প্রাণ পেতো। মেঝেতে ঠাকুর আঁকলেই বাড়ির লোক এবং বাড়িওলা ভদ্রলোক সকলেই অস্বস্তিবোধ করতেন। ঠাকুরের ছবিতে পা লেগে যাবে এই পাপবোধে আক্রান্ত হয়ে বাড়িওলা মানুষটি আমাকে ছবি আঁকা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন।
অবশেষে বাবার এক বন্ধু আমার ছবি আঁকার আগ্রহ দেখে আমাকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বললেন। এক রবিবার সকালে বাবার হাত ধরে পৌঁছে গেলাম সেই স্বপ্নরাজ্যে। চন্দননগর কানাইলাল স্কুলের ফরাসী বিভাগের দোতলায় রবিবারের আঁকার স্কুল 'শিশু কলা ভবন'। দোতলার বারান্দার জাফরির রেলিং এর ফাঁক দিয়ে আসা উজ্জ্বল রোদে বসে একরাশ ছেলে মেয়ে ছবি এঁকে চলেছে। লম্বা করে সরু ফালি চট পাতা। সেই চটের পাশে পাশে ৫/৬ টি করে কাঁচের ডিশে নানা রঙ গোলা ও তার সঙ্গে নানা আকারের তুলি। বারান্দার শেষপ্রান্তে মাস্টারমশাই শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বসে আছেন। সামনে একটি কাঠের বাক্স ও অনেকগুলি প্যাস্টেল বক্স রাখা। সেদিন সেখানেই আমার দ্বিতীয় জন্ম হলো। পিতৃপ্রতিম বঙ্কিমবাবুর হাত ধরেই শিল্পজগতে আমি প্রবেশ করলাম। এই 'শিশু কলাভবনে' আমি থেকে গিয়েছিলাম উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত।
(২) শিল্পীর ছবির নির্মাণ সম্পর্কে দর্শক সাধারণের বিশেষ আগ্রহ থাকে, আপনার ছবির নির্মাণ সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন।
ছোট থেকেই যা চারপাশে দেখতাম, যা ভালো লাগতো তাই আঁকতাম। সেই মানসিকতা এখনও থেকে গেছে। বিশেষ কোনো message, কোনো বক্তব্য বা সমাজ সচেতনতা আমার ছবির নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনোভাবেই আসে না। সমাজ বা বর্তমান জগতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা যা প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় তা মনকে নাড়া দিলেও ছবি বিষয় হিসাবে প্রকাশ পায় না। বরং ছবি impersonal হলে বা ছবিকে নৈব্যক্তিক দিকে নিয়ে যাওয়াতে আমার আগ্রহ থাকে বেশী। মানুষ, প্রকৃতি এ সব থেকেই আমার ছবির ভাবনার ভিত্তি গড়ে ওঠে। ছবির জন্য নির্দিষ্ট পট বা space কে আমি গুরুত্ব দিই। ঐ নির্ধারিত পরিসরে (কাগজ বা ক্যানভাস) আমার বিষয়টিকে কি ভাবে স্থাপন করবো, কি ভাবে সাজাবো, কি ভাবে ভাঙ্গবো, আবার কি ভাবে গড়বো - সেই খেলা চলতে থাকে। Composition বা রচনার এই পর্যায় ভীষণ মাতিয়ে রাখে আমাকে। এরপর রঙের ছোঁয়া। হাল্কা ও গাঢ় আলো-ছায়ার খেলা। ছবিকে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ছবির নির্মাণের পর্যায়ে যে রূপ মনে মনে প্রত্যক্ষ (visualise) করি তা শেষ পর্যায়ে পাই না। সেই না পাওয়ার দুঃখ থেকেই যাবে।
(৩) চন্দননগর-কলিকাতা মেট্রোপলিটন থেকে শান্তিনিকেতনের নিবিড় ছায়া, এই রূপান্তর কি কোনো প্রভাব ফেলেছে আপনার শিল্প মননে ?
হ্যাঁ, ভীষণ ভাবে। জন্ম থেকেই দেখা কর্মব্যস্ত শহর, মানুষের ভীড়, শহুরে জীবনের নানা বিষয় ছবিতে উঠে এসেছে। ১৯৭৫ এ একদিন দুপুরে দানাপুর প্যাসেঞ্জারে তল্পিতল্পা নিয়ে শান্তিনিকেতনের মাটিতে যেই পা রাখলাম, দেখলাম বড় বড় মহীরুহ সব ছাতার মত যেন শান্তিনিকেতনে আগলে রেখেছে। ভুবনডাঙা পেরিয়ে রিক্সায় করে ফার্স্ট গেট (বর্তমান স্টেট ব্যাঙ্ক এর বিপরীতে) দিয়ে ঢুকে দেখলাম বাঁদিকে পর পর তিনটি মাটির বাড়ি ও বাঁশঝাড়। সামনে 'দ্বিজবিরাম' বাড়িকে ফেলে রেখে যতই এগোতে লাগলাম সত্যিই যেন এক আশ্রমজীবনের পরিবেশ। এতদিন রবীন্দ্রভারতীতে জোড়াসাঁকো বাড়ির ভেতরের ছোট ছোট ঘর ও সিঁড়ির অন্ধকার আনাচ-কানাচ মিলিয়ে যে পরিবেশ পেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনে এসে যেন এক দমকা হাওয়ায় একরাশ আলোর মধ্যে পড়া। ভাবলে অবাক লাগে এই দু জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য কেটেছে।
এখানে এসে গাছপালা চিনতে শিখলাম, দেখতে শিখলাম। গাছপালার অন্তঃকরণ যেন অনুভব করতে শিখলাম। আলাদা আলাদা ভাবে গাছের গড়ন ও চরিত্র অনুধাবন করতে লাগলাম। আমার গাইড শ্রী দিনকর কৌশিক (তৎকালীন কলাভবনের অধ্যক্ষ) একদিন নন্দন লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে নন্দলাল বসুর আঁকা ছোট ছোট Postcard এ একরঙে গাছের study ও sketch দেখালেন। দেখলাম আর অশেষ মুগ্ধতায় আবিষ্ট হলাম। আস্তে আস্তে মানুষের ভীড় আর কর্মব্যস্ত শহর আমার ছবি থেকে সরে যেতে লাগলো।
(৪) আপনার সাম্প্রতিক ছবিতে ধরা পড়ে নিসর্গ, জ্যামিতি, নক্সা - এগুলি কি ভাবে আসছে আপনার ছবিতে, একটু বিশদে বলুন।
প্রথমেই বলি নক্সা বা অলংকরণ কিন্তু আমার ছবিতে নেই। সেটা আছে মঞ্চসজ্জায়।
নিসর্গ ভীষণ ভাবে মনে রেখাপাত করেছিল পল সেজানের ছবি দেখে। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই বিভিন্ন বই এ Post-impressionist দের ছবি আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তবে সব থেকে বেশী নাড়া দিয়েছিল পল সেজানের ছবির নির্মাণ ও জ্যামিতি। প্রকৃতিকে উনি খুশীমতো ভাঙ্গাগড়া করে পটের ওপর নির্মাণ করতেন। এই Structure আমাকে টেনেছিল। সেজান ছাড়াও মন্দ্রিয়ান, পিকাসো, ব্রাক এই কারণেই আমার ভীষণ প্রিয়। এই জ্যামিতিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে ছবির বিষয়বস্তু প্রতিষ্ঠা করা গণেশ পাইন , হুসেন, হেব্বার, রেজা ও রামকুমারের ছবিতেও দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। গাছ দেখলেই চোখে ছাঁকনির মতো করে ছেঁকে নিই তার মূল গড়ন ও অন্তর্নিহিত জ্যামিতি। তারপর দৃঢ় রেখার আঁচড়ে চলে তার নবনির্মাণ। একদিকে শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ গাছকে ও গাছের চরিত্রকে চিনতে শিখিয়েছে, অন্যদিকে সেজানের প্রকৃতির মধ্যে জ্যামিতির মেরুদন্ড ছবির ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখিয়েছে।
(৫) বাঙালী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে নিসর্গ-শিল্পী সংখ্যাধিক। আপনার কি উপলব্ধি ঐ শিল্পীদের ঘিরে ?
এইমুহূর্তে গণেশ হালুই এর ছবির প্রকৃতি চেতনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কি সুন্দরভাবে প্রকৃতির মূল রূপ বা নির্যাসটুকু উনি ধরেছেন ছবিতে অল্প সংযত কিছু রেখার মাধ্যমে। বেশ কিছু ছবিতে আমি নিজেকেও দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছি।
নিসর্গ শিল্পী বলতে প্রকৃতি যেমন দেখছি ঠিক তেমন ভাবেই হুবহু আঁকলে আমার এখন আর খুব একটা আগ্রহ জন্মায় না, আগে যেটা হতো। একটা অন্য অনুভূতি, একটু অন্যরকম ভাবে গাছকে দেখা এবং সেই দেখা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হলে খুব ভালো লাগে। Nature study করতে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তারপর ছবি। সেটা কাজের দিক। তবে সব ছাড়িয়ে চোখ ভরে তাকে দেখে নিয়ে স্মৃতি থেকে নিজস্ব অভিব্যক্তির রসে ডুবিয়ে আঁকতে পারলে তার অভিজ্ঞতাই আলাদা। নন্দলাল বসু এই পথের পথিক ছিলেন।
নিসর্গ-শিল্পী বলতে অবশ্যই গোপাল ঘোষের ছবি ভালো লাগে। আর ভালো লাগে রামকিংকরের জলরঙের ওপরে কালো দৃঢ় রেখার সাবলীল ব্যবহারে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলা।
(৬) আপনাদের গ্রুপ “QUEST” এর কি অবদান সমসাময়িক শিল্পকলা জগতে ?
কিচ্ছু না। ছাত্রজীবনের শেষে নিজেকে ও নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরার তাগিদে আমাদের পাঁচজনেই ছবি নিয়ে ভাবতাম, আলোচনা করতাম, প্রকাশ্যে একে অপরের সমালোচনা করতাম। বেশ কেটেছে সে সব দিনগুলো। তবে এটাও ঠিক তখন শিল্পকলার জগত (১৯৮১ থেকে), দর্শক, সমালোচক সব মিলিয়ে পরিবেশটা অন্যরকম ছিল।
(৭) যতদূর জানি 'বাজার' সম্পর্কে এই মুহূর্তে আপনার অনাগ্রহ আছে ... পূজিত কালাপাহাড় কেন ব্রাত্য ?
না, 'বাজার' সম্পর্কে অনাগ্রহ নেই। আর সেখানে আমিই 'ব্রাত্য'। 'শিল্প'ও হলো, আবার 'বাজার'ও হলো। মনের মধ্যে বেশ একটা চনমনে ভাব। কিন্তু এই 'চনমনে ভাব' ধরে রাখতে গেলে অনেক 'পূজো' দিতে হবে, অনেক 'মানত' করতে হবে। সকলেই হুসেন বা গণেশ পাইন হয় না। নিজের ছবি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকবে, আবার ছবির চাহিদাও তুঙ্গে - এ সব শিল্পীর ভাগ্যে জোটে না। 'বাজার' ধরে রাখতে গিয়ে নিজের স্বভাব বদলাতে হয়েছে, ছবি গিয়েছে একটা বিশেষ ধরণে থেকে - অন্য পথের পথিক হতে হয়েছে - এই অবস্থা বেশ কিছু শিল্পীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে।
(৮) অনেক কবি-বন্ধুকে বলতে শুনেছি যে আপনার তুলির আঁচড় থেকে উঠে আসে কবিতার আবেশ, আপনি নিজে কি বিশ্বাস করেন একথা ?
আমি ভালো ফিল্ম দেখতে খুব ভালোবাসি। বিদেশী নানা ছবি দেখতে দেখতে শুনেছিলাম রাশিয়ান পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির ছবি নাকি খুব Poetic বা কাব্যিক। ঠিক বুঝিনি তখন। ওনার ছবিগুলো যখন দেখতে শুরু করলাম কথাটা তখন উপলব্ধি করলাম। ওনার Solaris ছবিতে স্বচ্ছ জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া একটি পাতার দৃশ্য সত্যি যেন কবিতা রচনা করে।
নিজের ছবি সম্পর্কে প্রশংসা ও নিন্দা, দুই ই শুনেছি। কবিতাও যেমন এমনি এসে ভেসে যায়, ছবিও তেমনি ভেসে আসে মনের মধ্যে - শুধু ঠিক তেমনিভাবে তাকে ধরতে পারি না।
(৯) অন্য মাধ্যম আপনাকে কি সহায়তা করে শিল্প-নির্মাণে ?
হ্যাঁ, অবশ্যই করে। ছবির ভাবনা মঞ্চসজ্জার কাজে লাগে। ছবির জ্যামিতি অ ভারসাম্য রক্ষার কাজ আলপনা দিতে গিয়েও খুবই প্রয়োজন হয়। এখানেও সেই 'নির্মাণ'। যথার্থ বাঁধুনী চাই 'নির্মাণে'। তা না হলে যে শিল্প মাধ্যমই হোক না কেন তা ভেঙ্গে পড়বে।
(১০) আপনার একটি শিল্পকর্মের জন্ম সম্পর্কে কিছু বলুন।
অনেক আগের কথা। রবীন্দ্রভারতীর Painting এর ক্লাসে চারতলা ওপর থেকে দেখা চিৎপুরের অসংখ্য বাড়ির ছাদ একত্রে একটা অদ্ভুত ছবি রচনা করেছিল। সামনে দেখা বড় বড় বাড়ি ও ছাদগুলো থেকে একেবারে দূরে আকাশের গায়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া ছোট ছোট বাড়িগুলো এককথায় Cityscape। প্রথমে এই বিষয় নিয়ে Sketch, তারপর ছবি। তারপর Oil colour এ ঐ একই বিষয় নিয়ে ছবি করতে গিয়ে কিছুতা পরিবর্তন হলো। তখন শুধু Horizontal আর Vertical lines গুলোই প্রধান হয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের শিক্ষক শানুদি (শানু লাহিড়ী) ছবিটা দেখে বললেন "আচ্ছা, ধরো এই দৃশ্য তাই যদি তুমি একটা Wide angle lens এ বা Concave lens এ দেখো, তাহলে কেমন হবে?" ভাবনাটা খুব মনে ধরলো। আবার রেখা দিয়ে Lay out করতে লাগলাম ঐ বিষয় নিয়ে, ঐ ভাবনা মাথায় রেখে। এর থেকে যে ছবির জন্ম হলো সেটা Abstract বলেই মনে হবে। সেদিন ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলাম Reality থেকে abstraction এর যাত্রাপথটুকু। আর অবাক হয়েছিলাম যখন এই ছবিটা আমাদের “QUEST” এর exhibition এ টাঙালাম এবং খুব সাধারণ দর্শকরা সেটা Appreciate করেছিলেন।
(১১) ছাত্রছাত্রীদের কি ভাবে সাহায্য করেন শিল্প-নির্মাণে ?
শান্তিনিকেতন এমন একটা জায়গা যেখানে স্কুলে ছবি আঁকা, হস্তশিল্প, ভাস্কর্য অন্যান্য বিষয়ের মতই বাধ্যতামূলক। এর একটা ভালো দিক তো আছেই। সাধারণভাবে ছোটদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার নির্দেশটা কম দিতে চেষ্টা করি। ওদের নিজস্ব ভাব ধরেই ওদের স্বাধীনতা দিই। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী থেকে বাস্তব জগতটা সম্পর্কে সচেতন করে দি। অর্থাৎ একটা মানুষ, বাড়ি বা গাছ কেমন দেখতে সেটাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে। এরপর নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আলাদা ভাবে প্রত্যেকের ওপর নজর দিতে হয়। এই নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে বিষয়টি ঐচ্ছিক। সকলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ওরা নিজের আগ্রহবশতঃ এই বিষয়টি নেয়।
(১২) সাধারণ মানুষকে কিভাবে আরো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফেলা যায় ... এরকম চিন্তাভাবনার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে ?
মোবাইল ফোন, কেবল টি.ভি. আর ডিশ টি.ভি.-এর যুগে সুরুচি জিনিষটাই ক্রমশঃ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির মহিলারা সন্ধ্যে থেকে বোকা বোকা সিরিয়াল হজম করছেন। আর চারিদিকে Reality show। এই সবের মধ্যে সত্যিকারের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষকে Involve করতে পারলে খুবই ভালো। তবে সেটা ধরে রাখা খুব শক্ত।
(১৩) ভিসুয়াল পোয়েট্রি সম্পর্কে আপনার কি উপলব্ধি ?
রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি, গৌরী ভঞ্জ ও যমুনা সেনের (নন্দলাল বসুর দুই কন্যা) হাতের আলপনা, বতিচেল্লীর ছবি আমার কাছে ভিসুয়াল পোয়েট্রির চরম উদাহরণ। কেন তা ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
(১৪) কোনো শব্দ বা কোনো কবিতার অংশবিশেষ থেকে কি কখনো ছবি গড়ে উঠতে পারে ?
হয়তো পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চয় পারে। আসলে এটা বিশেষ বিশেষ কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির স্তর। ঐ বিশেষ কবিতার অংশ থেকে প্রেরণা পেয়ে ছবি আঁকলে দর্শকেরও যে সেই ছবি থেকে একই অনুভূতি হবে - সেটা নাও হতে পারে। তেমনি ভাবে কোনো চিত্র বা ভাস্কর্য দেখেও কবিতার জন্ম হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের "ঐ রে তরী দিলো খুলে" গানটির ভাব থেকে আমার বেশ কয়েকটি ছবির জন্ম হয়েছিল।
(১৫) ছবি আঁকিয়ে না হলে কি হতেন ?
বলা খুব শক্ত। তবে উচ্চ-মাধ্যমিকের পর ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে পড়ার কথা ছিল। সেই বিষয় নিয়ে কলেজে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। না হলে হয়তো ইংরাজী নিয়ে পড়ে ঐ বিষয়ের শিক্ষক হতাম বা অফিসে চাকরী করতাম।
বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ওনার পাঞ্জাবীর পকেটে থাকতো খড়ির টুকরো বা Chalk। আমার ছবি আঁকার হাতে খড়ি তাই দিয়েই। তখনও আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। চন্দননগরে ভাড়াবাড়ির লাল মেঝের লম্বা বারান্দায় মনের আনন্দে এঁকে যেতাম রেলগাড়ি, মানুষ, বাড়িঘর এইসব। অন্যান্য মফঃস্বলের মতো চন্দননগরেও বারোয়ারী পূজোর খুব ধূম ছিল। আর বাড়ির কাছেই ছিল কুমোরবাড়ি। তাই একটা কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে মূর্তি নির্মাণের শেষ পর্যায় পর্যন্ত দেখতাম। এই সব দেবতারাও আমার চকখড়ির ড্রইং এ প্রাণ পেতো। মেঝেতে ঠাকুর আঁকলেই বাড়ির লোক এবং বাড়িওলা ভদ্রলোক সকলেই অস্বস্তিবোধ করতেন। ঠাকুরের ছবিতে পা লেগে যাবে এই পাপবোধে আক্রান্ত হয়ে বাড়িওলা মানুষটি আমাকে ছবি আঁকা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিতেন।
অবশেষে বাবার এক বন্ধু আমার ছবি আঁকার আগ্রহ দেখে আমাকে ছবি আঁকার স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বললেন। এক রবিবার সকালে বাবার হাত ধরে পৌঁছে গেলাম সেই স্বপ্নরাজ্যে। চন্দননগর কানাইলাল স্কুলের ফরাসী বিভাগের দোতলায় রবিবারের আঁকার স্কুল 'শিশু কলা ভবন'। দোতলার বারান্দার জাফরির রেলিং এর ফাঁক দিয়ে আসা উজ্জ্বল রোদে বসে একরাশ ছেলে মেয়ে ছবি এঁকে চলেছে। লম্বা করে সরু ফালি চট পাতা। সেই চটের পাশে পাশে ৫/৬ টি করে কাঁচের ডিশে নানা রঙ গোলা ও তার সঙ্গে নানা আকারের তুলি। বারান্দার শেষপ্রান্তে মাস্টারমশাই শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বসে আছেন। সামনে একটি কাঠের বাক্স ও অনেকগুলি প্যাস্টেল বক্স রাখা। সেদিন সেখানেই আমার দ্বিতীয় জন্ম হলো। পিতৃপ্রতিম বঙ্কিমবাবুর হাত ধরেই শিল্পজগতে আমি প্রবেশ করলাম। এই 'শিশু কলাভবনে' আমি থেকে গিয়েছিলাম উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত।
(২) শিল্পীর ছবির নির্মাণ সম্পর্কে দর্শক সাধারণের বিশেষ আগ্রহ থাকে, আপনার ছবির নির্মাণ সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন।
ছোট থেকেই যা চারপাশে দেখতাম, যা ভালো লাগতো তাই আঁকতাম। সেই মানসিকতা এখনও থেকে গেছে। বিশেষ কোনো message, কোনো বক্তব্য বা সমাজ সচেতনতা আমার ছবির নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে কোনোভাবেই আসে না। সমাজ বা বর্তমান জগতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা যা প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় তা মনকে নাড়া দিলেও ছবি বিষয় হিসাবে প্রকাশ পায় না। বরং ছবি impersonal হলে বা ছবিকে নৈব্যক্তিক দিকে নিয়ে যাওয়াতে আমার আগ্রহ থাকে বেশী। মানুষ, প্রকৃতি এ সব থেকেই আমার ছবির ভাবনার ভিত্তি গড়ে ওঠে। ছবির জন্য নির্দিষ্ট পট বা space কে আমি গুরুত্ব দিই। ঐ নির্ধারিত পরিসরে (কাগজ বা ক্যানভাস) আমার বিষয়টিকে কি ভাবে স্থাপন করবো, কি ভাবে সাজাবো, কি ভাবে ভাঙ্গবো, আবার কি ভাবে গড়বো - সেই খেলা চলতে থাকে। Composition বা রচনার এই পর্যায় ভীষণ মাতিয়ে রাখে আমাকে। এরপর রঙের ছোঁয়া। হাল্কা ও গাঢ় আলো-ছায়ার খেলা। ছবিকে একটা পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ছবির নির্মাণের পর্যায়ে যে রূপ মনে মনে প্রত্যক্ষ (visualise) করি তা শেষ পর্যায়ে পাই না। সেই না পাওয়ার দুঃখ থেকেই যাবে।
(৩) চন্দননগর-কলিকাতা মেট্রোপলিটন থেকে শান্তিনিকেতনের নিবিড় ছায়া, এই রূপান্তর কি কোনো প্রভাব ফেলেছে আপনার শিল্প মননে ?
হ্যাঁ, ভীষণ ভাবে। জন্ম থেকেই দেখা কর্মব্যস্ত শহর, মানুষের ভীড়, শহুরে জীবনের নানা বিষয় ছবিতে উঠে এসেছে। ১৯৭৫ এ একদিন দুপুরে দানাপুর প্যাসেঞ্জারে তল্পিতল্পা নিয়ে শান্তিনিকেতনের মাটিতে যেই পা রাখলাম, দেখলাম বড় বড় মহীরুহ সব ছাতার মত যেন শান্তিনিকেতনে আগলে রেখেছে। ভুবনডাঙা পেরিয়ে রিক্সায় করে ফার্স্ট গেট (বর্তমান স্টেট ব্যাঙ্ক এর বিপরীতে) দিয়ে ঢুকে দেখলাম বাঁদিকে পর পর তিনটি মাটির বাড়ি ও বাঁশঝাড়। সামনে 'দ্বিজবিরাম' বাড়িকে ফেলে রেখে যতই এগোতে লাগলাম সত্যিই যেন এক আশ্রমজীবনের পরিবেশ। এতদিন রবীন্দ্রভারতীতে জোড়াসাঁকো বাড়ির ভেতরের ছোট ছোট ঘর ও সিঁড়ির অন্ধকার আনাচ-কানাচ মিলিয়ে যে পরিবেশ পেয়েছিলাম, শান্তিনিকেতনে এসে যেন এক দমকা হাওয়ায় একরাশ আলোর মধ্যে পড়া। ভাবলে অবাক লাগে এই দু জায়গাতেই রবীন্দ্রনাথের শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য কেটেছে।
এখানে এসে গাছপালা চিনতে শিখলাম, দেখতে শিখলাম। গাছপালার অন্তঃকরণ যেন অনুভব করতে শিখলাম। আলাদা আলাদা ভাবে গাছের গড়ন ও চরিত্র অনুধাবন করতে লাগলাম। আমার গাইড শ্রী দিনকর কৌশিক (তৎকালীন কলাভবনের অধ্যক্ষ) একদিন নন্দন লাইব্রেরীতে নিয়ে গিয়ে নন্দলাল বসুর আঁকা ছোট ছোট Postcard এ একরঙে গাছের study ও sketch দেখালেন। দেখলাম আর অশেষ মুগ্ধতায় আবিষ্ট হলাম। আস্তে আস্তে মানুষের ভীড় আর কর্মব্যস্ত শহর আমার ছবি থেকে সরে যেতে লাগলো।
(৪) আপনার সাম্প্রতিক ছবিতে ধরা পড়ে নিসর্গ, জ্যামিতি, নক্সা - এগুলি কি ভাবে আসছে আপনার ছবিতে, একটু বিশদে বলুন।
প্রথমেই বলি নক্সা বা অলংকরণ কিন্তু আমার ছবিতে নেই। সেটা আছে মঞ্চসজ্জায়।
নিসর্গ ভীষণ ভাবে মনে রেখাপাত করেছিল পল সেজানের ছবি দেখে। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগেই বিভিন্ন বই এ Post-impressionist দের ছবি আমার ভীষণ ভালো লাগতো। তবে সব থেকে বেশী নাড়া দিয়েছিল পল সেজানের ছবির নির্মাণ ও জ্যামিতি। প্রকৃতিকে উনি খুশীমতো ভাঙ্গাগড়া করে পটের ওপর নির্মাণ করতেন। এই Structure আমাকে টেনেছিল। সেজান ছাড়াও মন্দ্রিয়ান, পিকাসো, ব্রাক এই কারণেই আমার ভীষণ প্রিয়। এই জ্যামিতিক নির্মাণের মধ্য দিয়ে ছবির বিষয়বস্তু প্রতিষ্ঠা করা গণেশ পাইন , হুসেন, হেব্বার, রেজা ও রামকুমারের ছবিতেও দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। গাছ দেখলেই চোখে ছাঁকনির মতো করে ছেঁকে নিই তার মূল গড়ন ও অন্তর্নিহিত জ্যামিতি। তারপর দৃঢ় রেখার আঁচড়ে চলে তার নবনির্মাণ। একদিকে শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ গাছকে ও গাছের চরিত্রকে চিনতে শিখিয়েছে, অন্যদিকে সেজানের প্রকৃতির মধ্যে জ্যামিতির মেরুদন্ড ছবির ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখিয়েছে।
(৫) বাঙালী চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে নিসর্গ-শিল্পী সংখ্যাধিক। আপনার কি উপলব্ধি ঐ শিল্পীদের ঘিরে ?
এইমুহূর্তে গণেশ হালুই এর ছবির প্রকৃতি চেতনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কি সুন্দরভাবে প্রকৃতির মূল রূপ বা নির্যাসটুকু উনি ধরেছেন ছবিতে অল্প সংযত কিছু রেখার মাধ্যমে। বেশ কিছু ছবিতে আমি নিজেকেও দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছি।
নিসর্গ শিল্পী বলতে প্রকৃতি যেমন দেখছি ঠিক তেমন ভাবেই হুবহু আঁকলে আমার এখন আর খুব একটা আগ্রহ জন্মায় না, আগে যেটা হতো। একটা অন্য অনুভূতি, একটু অন্যরকম ভাবে গাছকে দেখা এবং সেই দেখা ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হলে খুব ভালো লাগে। Nature study করতে হয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তারপর ছবি। সেটা কাজের দিক। তবে সব ছাড়িয়ে চোখ ভরে তাকে দেখে নিয়ে স্মৃতি থেকে নিজস্ব অভিব্যক্তির রসে ডুবিয়ে আঁকতে পারলে তার অভিজ্ঞতাই আলাদা। নন্দলাল বসু এই পথের পথিক ছিলেন।
নিসর্গ-শিল্পী বলতে অবশ্যই গোপাল ঘোষের ছবি ভালো লাগে। আর ভালো লাগে রামকিংকরের জলরঙের ওপরে কালো দৃঢ় রেখার সাবলীল ব্যবহারে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তোলা।
(৬) আপনাদের গ্রুপ “QUEST” এর কি অবদান সমসাময়িক শিল্পকলা জগতে ?
কিচ্ছু না। ছাত্রজীবনের শেষে নিজেকে ও নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরার তাগিদে আমাদের পাঁচজনেই ছবি নিয়ে ভাবতাম, আলোচনা করতাম, প্রকাশ্যে একে অপরের সমালোচনা করতাম। বেশ কেটেছে সে সব দিনগুলো। তবে এটাও ঠিক তখন শিল্পকলার জগত (১৯৮১ থেকে), দর্শক, সমালোচক সব মিলিয়ে পরিবেশটা অন্যরকম ছিল।
(৭) যতদূর জানি 'বাজার' সম্পর্কে এই মুহূর্তে আপনার অনাগ্রহ আছে ... পূজিত কালাপাহাড় কেন ব্রাত্য ?
না, 'বাজার' সম্পর্কে অনাগ্রহ নেই। আর সেখানে আমিই 'ব্রাত্য'। 'শিল্প'ও হলো, আবার 'বাজার'ও হলো। মনের মধ্যে বেশ একটা চনমনে ভাব। কিন্তু এই 'চনমনে ভাব' ধরে রাখতে গেলে অনেক 'পূজো' দিতে হবে, অনেক 'মানত' করতে হবে। সকলেই হুসেন বা গণেশ পাইন হয় না। নিজের ছবি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকবে, আবার ছবির চাহিদাও তুঙ্গে - এ সব শিল্পীর ভাগ্যে জোটে না। 'বাজার' ধরে রাখতে গিয়ে নিজের স্বভাব বদলাতে হয়েছে, ছবি গিয়েছে একটা বিশেষ ধরণে থেকে - অন্য পথের পথিক হতে হয়েছে - এই অবস্থা বেশ কিছু শিল্পীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে।
(৮) অনেক কবি-বন্ধুকে বলতে শুনেছি যে আপনার তুলির আঁচড় থেকে উঠে আসে কবিতার আবেশ, আপনি নিজে কি বিশ্বাস করেন একথা ?
আমি ভালো ফিল্ম দেখতে খুব ভালোবাসি। বিদেশী নানা ছবি দেখতে দেখতে শুনেছিলাম রাশিয়ান পরিচালক আন্দ্রেই তারকোভস্কির ছবি নাকি খুব Poetic বা কাব্যিক। ঠিক বুঝিনি তখন। ওনার ছবিগুলো যখন দেখতে শুরু করলাম কথাটা তখন উপলব্ধি করলাম। ওনার Solaris ছবিতে স্বচ্ছ জলের স্রোতে ভেসে যাওয়া একটি পাতার দৃশ্য সত্যি যেন কবিতা রচনা করে।
নিজের ছবি সম্পর্কে প্রশংসা ও নিন্দা, দুই ই শুনেছি। কবিতাও যেমন এমনি এসে ভেসে যায়, ছবিও তেমনি ভেসে আসে মনের মধ্যে - শুধু ঠিক তেমনিভাবে তাকে ধরতে পারি না।
(৯) অন্য মাধ্যম আপনাকে কি সহায়তা করে শিল্প-নির্মাণে ?
হ্যাঁ, অবশ্যই করে। ছবির ভাবনা মঞ্চসজ্জার কাজে লাগে। ছবির জ্যামিতি অ ভারসাম্য রক্ষার কাজ আলপনা দিতে গিয়েও খুবই প্রয়োজন হয়। এখানেও সেই 'নির্মাণ'। যথার্থ বাঁধুনী চাই 'নির্মাণে'। তা না হলে যে শিল্প মাধ্যমই হোক না কেন তা ভেঙ্গে পড়বে।
(১০) আপনার একটি শিল্পকর্মের জন্ম সম্পর্কে কিছু বলুন।
অনেক আগের কথা। রবীন্দ্রভারতীর Painting এর ক্লাসে চারতলা ওপর থেকে দেখা চিৎপুরের অসংখ্য বাড়ির ছাদ একত্রে একটা অদ্ভুত ছবি রচনা করেছিল। সামনে দেখা বড় বড় বাড়ি ও ছাদগুলো থেকে একেবারে দূরে আকাশের গায়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া ছোট ছোট বাড়িগুলো এককথায় Cityscape। প্রথমে এই বিষয় নিয়ে Sketch, তারপর ছবি। তারপর Oil colour এ ঐ একই বিষয় নিয়ে ছবি করতে গিয়ে কিছুতা পরিবর্তন হলো। তখন শুধু Horizontal আর Vertical lines গুলোই প্রধান হয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের শিক্ষক শানুদি (শানু লাহিড়ী) ছবিটা দেখে বললেন "আচ্ছা, ধরো এই দৃশ্য তাই যদি তুমি একটা Wide angle lens এ বা Concave lens এ দেখো, তাহলে কেমন হবে?" ভাবনাটা খুব মনে ধরলো। আবার রেখা দিয়ে Lay out করতে লাগলাম ঐ বিষয় নিয়ে, ঐ ভাবনা মাথায় রেখে। এর থেকে যে ছবির জন্ম হলো সেটা Abstract বলেই মনে হবে। সেদিন ভালোভাবে উপলব্ধি করেছিলাম Reality থেকে abstraction এর যাত্রাপথটুকু। আর অবাক হয়েছিলাম যখন এই ছবিটা আমাদের “QUEST” এর exhibition এ টাঙালাম এবং খুব সাধারণ দর্শকরা সেটা Appreciate করেছিলেন।
(১১) ছাত্রছাত্রীদের কি ভাবে সাহায্য করেন শিল্প-নির্মাণে ?
শান্তিনিকেতন এমন একটা জায়গা যেখানে স্কুলে ছবি আঁকা, হস্তশিল্প, ভাস্কর্য অন্যান্য বিষয়ের মতই বাধ্যতামূলক। এর একটা ভালো দিক তো আছেই। সাধারণভাবে ছোটদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমার নির্দেশটা কম দিতে চেষ্টা করি। ওদের নিজস্ব ভাব ধরেই ওদের স্বাধীনতা দিই। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী থেকে বাস্তব জগতটা সম্পর্কে সচেতন করে দি। অর্থাৎ একটা মানুষ, বাড়ি বা গাছ কেমন দেখতে সেটাকে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে। এরপর নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত আলাদা ভাবে প্রত্যেকের ওপর নজর দিতে হয়। এই নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে বিষয়টি ঐচ্ছিক। সকলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ওরা নিজের আগ্রহবশতঃ এই বিষয়টি নেয়।
(১২) সাধারণ মানুষকে কিভাবে আরো সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে ফেলা যায় ... এরকম চিন্তাভাবনার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে ?
মোবাইল ফোন, কেবল টি.ভি. আর ডিশ টি.ভি.-এর যুগে সুরুচি জিনিষটাই ক্রমশঃ উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির মহিলারা সন্ধ্যে থেকে বোকা বোকা সিরিয়াল হজম করছেন। আর চারিদিকে Reality show। এই সবের মধ্যে সত্যিকারের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সাধারণ মানুষকে Involve করতে পারলে খুবই ভালো। তবে সেটা ধরে রাখা খুব শক্ত।
(১৩) ভিসুয়াল পোয়েট্রি সম্পর্কে আপনার কি উপলব্ধি ?
রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি, গৌরী ভঞ্জ ও যমুনা সেনের (নন্দলাল বসুর দুই কন্যা) হাতের আলপনা, বতিচেল্লীর ছবি আমার কাছে ভিসুয়াল পোয়েট্রির চরম উদাহরণ। কেন তা ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
(১৪) কোনো শব্দ বা কোনো কবিতার অংশবিশেষ থেকে কি কখনো ছবি গড়ে উঠতে পারে ?
হয়তো পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিশ্চয় পারে। আসলে এটা বিশেষ বিশেষ কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির স্তর। ঐ বিশেষ কবিতার অংশ থেকে প্রেরণা পেয়ে ছবি আঁকলে দর্শকেরও যে সেই ছবি থেকে একই অনুভূতি হবে - সেটা নাও হতে পারে। তেমনি ভাবে কোনো চিত্র বা ভাস্কর্য দেখেও কবিতার জন্ম হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের "ঐ রে তরী দিলো খুলে" গানটির ভাব থেকে আমার বেশ কয়েকটি ছবির জন্ম হয়েছিল।
(১৫) ছবি আঁকিয়ে না হলে কি হতেন ?
বলা খুব শক্ত। তবে উচ্চ-মাধ্যমিকের পর ইংরাজীতে অনার্স নিয়ে পড়ার কথা ছিল। সেই বিষয় নিয়ে কলেজে ভর্তিও হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। না হলে হয়তো ইংরাজী নিয়ে পড়ে ঐ বিষয়ের শিক্ষক হতাম বা অফিসে চাকরী করতাম।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন