শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ধারাবাহিক - সুবীর সরকার

এপিটাফ
সুবীর সরকার



৩৬।

গান গান করিয়া সর্বনাশ/ তবু না মেটে গানের হাউস খুব বেশি শীত।খীব জাড় বাহে।হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে যায় আলতাফ করাতী।কুয়াশা দলা দলা।অগুণতি পাখিরা কূয়াশাবাড়ীর দিকে।শূন্য সব মাঠে মাঠে শিশিরশব্দ।কোথাও কী যাওয়ার থাকে মানুষের?পাখির ডানার নীচে হেঁটে যেতে যেতে স্মৃতিতাড়িত এক যাপনই সামনে এসে পড়ে বুঝি।শীতের রহস্যময় রাতগুলি যেন না ফুরতে চাওয়া কীসসাগাথা ।অনেকানেক প্রান্তরের জেগে থাকা গানবাড়িগুলি তাকে প্ররোচিত করলেই আমোদিত হবার বহুবর্ণ উপাদান সমেত সম্পন্নতায় আশ্চর্য মিশে যায় কুয়াসাঘেরা চাঁদের আলোর খদলে। এত এতোর ফাঁকে কখন দোতরাবাহিত ঢোল বাসি,সারিন্দাবাহিত জীবনযাপন নিয়েই কখন ধনীবাড়ীর খোলানে এসে দাঁড়ায় গানমাষ্টার ছায়াময় মায়াময় সব দোহার বাদকবৃন্দ সমেতঃ ‘মাছ মারে মাছুয়া দোলাবারিত হালুয়া।‘



৩৭।


চার পাঁচ কুড়ির মাঝামাঝি বয়সের গানমাস্টার ভুলে গেছে তার নিজনাম।৮/৯ বয়স থেকেই বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত অধিকারির সঙ্গে সঙ্গেই গানের দলে কেবল ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখন যৌবন এসে গিয়েছিল, তারপর বাপ ধনকান্তর দলের মূল গিদাল হল সে।বাপের বাপ চন্দ্রকান্ত খুব ভালবাসতেন এই নাতিতিকে।চন্দ্রকান্তই তার দীক্ষাগুরু শিক্ষাগুরু।চন্দ্রকান্ত তাকে জীবন শিখিয়েছেন।চিনিয়েছেন।গানের তত্ত্বতালাশ মণোশীখন শিখিয়েছেণ;বুঝতে শিখীয়েছেন-লোকগান হল শাঢোণা,জীবনবন্দনা।সেই থেকে দিনকাল পেরিয়ে দেশাচার লোকাচার গঞ্জ মানুষ নদিদিঘি মেলামহোতসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে চন্দ্রকান্তর বড়োবেটার বড়োবেটা রতিকান্ত নাম হারিয়ে মাইল মাইল জঙ্গলজনপদ হাওড় হাওয়ার এক পৃথিবীর গান মাস্টার। যার গানে যার বাদ্য বাজনায় অতিপ্রাকিত পাখিরা ,মানুষেরা চিরকালীন হয়ে যেতে থাকে। রসিয়া বসাইছে ফান্দ বানিয়া বসাইছে ফান্দ ৩৮। সে কবেকার কথা।ব্রিটিশ আমল।চারদিকে কত কত জোতদার।পুবে জয়নাব মুন্সি খামারু জোতদার সরকারবাবু ফনিমোহোন তো উত্তরে ঢোল দেওয়ানি খগেন বসুনিয়া হাতি জোতদার। নিজ চোখে কতবার দেখা হাতির পিঠিত চড়ি জোতদারের গমনাগমন।ভবতারণ ধনির বাড়িতে রাসযাত্রা হত।পালোয়ানি কুস্তির লড়াই কুশান যাত্রা দোতারা পালার আসর,সে এক ধুন্ধুমার বেপার।একবার রানিরহাটের এক গানবাড়িতে সে দেখেছিল কোচবিহারের এক রানিকে।পাতলাখাওয়ার জঙ্গল থেকে চিতা বাঘ বেরিয়ে আসতো মাঝে মাঝে।ও ছিল কোচবিহার রাজার রীজাভ ফরেশট।গান মাস্টার একবার রাজাদিঘির খেলার মাঠে পালা গাইতে গিয়েছিল।রাতভর পালা শেষ করে ফিরে আসার পথে দেখেছিল হাতির জুলুস আসছে।বাজনা বাজছে।পথের দু পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মানুসেরা।জানা গেল মহারাজা আসছেন শিকারকাম্পে।একঝলক দেখেওছিল বুঝি রাজাবাহাদুরকে!