বিবর্তনের ইতিকথা - বাংলা রেনেসাঁস
অমলেন্দু চন্দ
যে কোন অগ্রগতির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মধ্যে এটা দেখতে পাওয়া যায় যে প্রধান চরিত্রেরা সাধারণত বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তিত্ত্ব। আভ্যন্তরীণ বা বাইরের কোন কনভালসন থেকে তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন প্রশ্ন নিয়ে আসেন – যেমন ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক লেখাগুলো ফরাসিদের ইতালি অভিযানের কনভালসন প্রসূত, ১৭৮৯ এর বিপ্লব ও পরবর্তীকালে নেপলিয়ানের যুদ্ধোন্মাদ এর প্রসুতাগারে হেগেলিয় ইতিহাসের দর্শনের জন্ম। ১৮৭১ এর ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধ আর তার পর বিসমার্ক এর হহেনজেলার্ন এম্পায়ার এর স্বপ্ন ও স্থাপনা যে ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী জার্মান সাম্রাজ্যবাদ এর জন্ম নীটশের এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এর জন্মও সেই সময়ের কনভালসনের নিরিখে, এক দর্শন যা আজকের দিনের ইতিহাসবাদের অগ্রদূত, যার গভীর ও গম্ভীর অভিপ্রায় পরবর্তী জার্মান দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের মধ্যে ছায়া ফেলেছে। নতুন চিন্তা চেতনার মাটি তখন তৈরি হয় যখন মনন ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে অতিক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। ক্রমবিকাশের ইতিহাস তাই চলিত ইতিহাসের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেই ইতিহাস তখন একটা নিঃসংশয় বর্তমান। এই অনুভব একটা সমাহিত জ্ঞান যার ধারক এক সিংহাসনচ্যুত সম্রাটের মতই সেই কনভালসনে পুড়ে যাওয়া প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে ছাই দিয়ে নতুন অবয়েব নির্মাণ করে। সেখানে থাকে আনন্দ, থাকে যন্ত্রণা, থাকে বিস্ময় আর থাকে সম্পৃক্ত এক নতুন নির্মাণ যা এক নতুন চেতনার অভিধানের পাতা খুলে ধরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপিয়ান কালচারের জন্য এক বিষম সংকট তৈরি করেছিল। এই যুদ্ধ তাদের চিন্তা চেতনার ভিত্তিভূমি এবং দৃষ্টিভঙ্গি কে বদলাতে বাধ্য করে এবং সেই পরিধির বিস্তারের সঙ্গে বোধহয় একমাত্র সাযুজ্য উপমা পারমানবিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তার পরিধির বিস্তার। এই বিস্তার সেই চিন্তা চেতনাকে ঋদ্ধ করার মাটি যুগিয়েছে।
প্রতিটি কালচারের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা তাদের আকর্ষণ বা তাদের অস্তিত্বের উপস্থিতির বিকিরনক্ষমতার সুবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দের তাদের সংসর্গে নিয়ে আসেন যেখানে তাদের ভূমিকা এক পথ নির্দেশকের। এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এটা মনে করে যে কোন ক্রাইসিসের ধ্বংসাত্মক চেহারা বা যে কোন কনভালসনের পেছনে প্রকৃতির দিক থেকে একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কার্য কারন কাজ করে। তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে যে কনভালসন টা না থাকলে নতুনের সৃষ্টি হবে না! সম্ভবত। তাহলে এটাও করোল্যারি হিসেবে ধরা যেতে পারে কি যে চিন্তা চেতনার নবীকরণের এই পদ্ধতিটাও একটা ন্যাচারাল সিলেক্সানের অঙ্গ? অন্তত বদলের ধারার খোঁজ তো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।
একটা পর্যায়ে চিন্তা চেতনার স্তরে বৌদ্ধিক কনভালসনের ঐতিহাসিক নাম রেনেসাঁস। ইউরোপিয়ান রেনেসাঁস মধ্যযুগীয় ফিউড্যাল পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর চিন্তা চেতনার থেকে লোকায়ত হতে আরম্ভ করে দিল নাকি ফেরত যেতে শুরু করল, বেগবান হল কারন বহু ভাষিক সেই সব কবি সাহিত্যিক শিল্পী চিন্তাবিদেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বহু দিনের কালচারের ঝুলির থেকে বার করে আনতে লাগলেন সব অমূল্য রত্ন। অবশ্যই এই রেনেসাঁসের পেছনে রয়েছে সেই সময়ের ইতিহাস যখন কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর এবং ডার্ক এজ এর সমাপতনে ইতালির দিকে পালিয়ে এলেন অনেক গ্রীক এবং নন গ্রীক ইন্টেলেকচুয়াল, বাইজেন্তিয়ান সভ্যতার কেন্দ্রে যারা এতকাল বসবাস করেছেন। ততদিনে রোমের পাপ্যালসি সচেষ্ট হয়েছে ইউরোপের মাটিতে একটা আধ্যাত্মিক এবং বস্তুতান্ত্রিক জীবন সংগঠনের, অবশ্যই চার্চের হেজিমনিস্টিক উদ্দেশ্য নিয়ে। এদিকে পুরনো সামন্ত্রতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে একটা স্থিতিশীল ইউনিফাইং কাঠামো গড়ে উঠছে, জাতীয় মনারকির গুরুত্ব বৃদ্ধি হচ্ছে, জাতীয় ভাষার উন্নয়ন চলছে। ফ্রান্স জার্মানি স্পেন পর্তুগাল ইংল্যান্ড হয়ে উঠল সেই ব্যাবহারিক বিকাশের রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র। রেনেসাঁস স্কলার ক্লারিক দের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল বৌদ্ধিক চেতনার বিস্তারের স্পিরিট, নাম হল তার হিউম্যানিস্ম।
মধ্যযুগীয় রিলিজিয়াস ধ্যান ধারনা মোক্ষলাভের পদ্ধতিগত ধার্মিক বিশ্লেষণ পেন্যান্সের গ্লোরিফিকেসানের স্থলাভিষিক্ত হল সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম এবং প্রকৃতির ওপরে বিজয়েচ্ছায় মানুষী প্রয়াস। মানুষের সম্ভ্রমবোধ তার নিজের প্রতি, সে আবার ফিরে পেতে চাইল প্রাচ্য প্রতীচ্যের সেই লিগ্যাসি – সেই পুরাতন স্পিরিট আর উইসডম। সাথে যোগ হল মানুষী চেষ্টার জয়গান, তাই কলম্বাসেরা ছুটল দিকে দিকে – ভাঙো ভৌগলিক ব্যারিয়ার।
এই একই জিনিস লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকিয়া বাংলা ভাষার চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে – বাংলার রেনেসাঁস। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিভিন্ন তত্ত্ববিদ্যা – এ তো ছিল সেই সময়ের একটা নিঃসংশয় বর্তমান। সামাজিক মূল্যবোধের তত্ত্বে এলো সেই সময়ের নিরিখে যুগান্তকারী বৈপ্লবিক চিন্তা – বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা। উত্তপ্ত অভ্রান্ত সেই সময়ের অবিসম্বাদি বর্তমান, আজকের ইতিহাস। সে সময়ের এক একজন মননশীল শক্তিশালী শিক্ষিত চিন্তাবিদ এক সঙ্গে সংস্কৃত, জার্মান ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজিতে সুদক্ষ ছিলীন যাদের চিন্তাধারায় একসাথে সেই সব ভাষার কালচারের অতলান্তিক বয়ে যেত নিশিদিন, জ্বলে থাকত একটা নীল সরু শিখার মত অভ্রান্ত লাইটহাউস। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা, অনুভুতির তীব্রতা আর আনন্দের উদ্ভাসের সম্মিলিত গ্রন্থনা শিল্পিত হয়েছিল সব কিছুতে। সেই সময়ের এক উজ্জ্বলতম বুদ্ধিবাদি চরিত্রের নাম হেনরি ডিরোজিও। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ এর প্রকৃতিপ্রেম আর মানবতাবোধ, তাঁর প্রখ্যাত সব উত্তরসুরী শেলি কীটস - ইংরেজি সাহিত্যের একটা অন্যতম অধ্যায় রোম্যান্টিসিজম এর ভাবনাপুষ্ট ডিরোজিও এই সময়ের যুব সম্প্রদায়ের নবজাগরনের পেছনে এক অন্যতম প্রতিভা। প্যারিচাদ মিত্র তাঁর অন্যতম শিষ্য। কলকাতার পার্ক স্ট্রীট সিমেট্রি র সমাধিফলকে ১৯৭৮ সালে লেখা হয়েছে – টিচার পোয়েট মেন্টর অফ ইয়ং বেঙ্গল। ইতিহাস এবং সাহিত্যের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একজন কবিও ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের একটা শ্লোগান ছিল – হি হু উইল নট রিজন ইজ এ বাইগট, হি হু ক্যান নট রিজন ইজ এ ফুল, অ্যান্ড হি হু ডাজ নট রিজন ইজ এ স্লেভ।
বাংলার রেনেসাসের ছিল সেই সময়কার সমাজমনে চেতনার বিবর্তনের বদলের ও ভেঙে গড়ার প্রয়োজনবোধ যার মুলে ছিল সোশ্যাল এভিল এর বিরুদ্ধে লড়াই । ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর উত্তরনের গল্প করতে গেলে প্রথমেই একটা নাম এসে পরে - রাজা রাম মোহন। বেনারসের সংস্কৃত ঘরানার শিক্ষা দীক্ষা পাটনায় থাকাকালীন তিনি গভীরভাবে পড়াশুনা করেন পারসিয়ান আর অ্যারবিক জাতিগত ঐতিহ্য নিয়ে। মোনোথেইস্ম বা একেশ্বরবাদ নিয়ে এই সময় তিনি কিছু লেখা লেখিও করেন। এর সাথে যুক্ত হয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আর তদনান্তিন পশ্চিমা মডার্ন কালচারের প্রভাব। কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করার পর -
সেটা বোধহয় ১৮১৪ - তিনি আরম্ভ করেন বেদান্ত আর উপনিষদের অনুবাদ, পাশাপাশি চলছিল তাঁর আত্মীয় সভা’র কাজ কম্ম, আর এসবের মুল উদ্দেশ্য ছিল জনসমক্ষে এটা তুলে ধরা যে সব ধর্মই মুলে মোনোথেইস্ট, তার লড়াইটা ছিল গোঁড়া পুরোহিত তন্ত্র সর্বশ্য হিন্দু বাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানেই থামেন নি তিনি, ১৮২০ থেকে তাঁর বিস্ফোরক এবং বিতর্কমূলক লেখা বেরোতে শুরু করে যেখানে তিনি খ্রীষ্টের নীতিকথা বা মর্যাল মেসেজ কে পাদ্রীতন্ত্রের অলৌকিকের ওপরে নির্ভরশীলতা ও তাদের প্রণীত খৃষ্টান তত্ত্বের থেকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করে দেখান যে সেগুল কেন হয়েছে। সে সব বোধহয় ১৮২৩ বা ২৪ যখন মিসন্যারি রা হিন্দু পুরোহিত ও গোঁড়া সমাজ তাঁর ওপরে খড়্গ হস্ত হয়ে ওঠে। ১৮২৮ এ ব্রাহ্ম সমাজের স্থাপনা করেন। ডেভিদ হেয়ার এর সঙ্গে তাঁর অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ও সখ্যতা এবং ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপনার পেছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য
সতীপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই তাকে এক অদ্ভুত আসনে বসিয়ে রেখেছে আমাদের মনে। সতীদাহের দানবীয় প্রথার ব্যপারে একটা নথিভুক্ত তথ্য হল ১৮১৪ থেকে ১৮২৯ এর মধ্যে নাকি প্রায় ১০,০০০ বিধবা কে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮২৯ এর দিসেম্বারে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেন। প্রথম বাংলা খবরের কাগজের সৃষ্টিও তাঁর হাতেই, ১৮১৮ সালে - সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। তাঁর নাটকীয় ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ নমুনা – কু সংস্কার ভাঙতে চেয়ে – তাঁর কালাপানি যাত্রা, মানে জাহাজে চেপে বিদেশ যাত্রা। এরকম একটা লোক ১৮৩০ সালের ফ্রেঞ্চ রেভলিউসানের পরে ঘরে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন নি, সরাসরি সংস্পর্শে আসার তাগিদে ১৮৩০ এই ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। ১৮৩৩ সালে সেই দেশেই মারা যান, ব্রিস্টলের আরনোস ভেল সিমেট্রি তে তাঁর সমাধি রয়েছে।
ডিরোজিও’র ইয়ং বেঙ্গল – কৃষ্ণমোহন ব্যানারজি, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, রাম গোপাল ঘোষ – যাকে বাংলার ডেমস্থিনিস বলা হত তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতার জন্য। প্যারি চাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার – বিশেষ করে প্যারি চাঁদের গদ্য। রাম তনু লাহিড়ী যিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর নাটকীয় ব্রাহ্মনত্বের অভিজ্ঞান উপবীত অনুষ্ঠান করে পরিত্যাগ করার জন্য।
একদিকে রাম মোহনের শিক্ষিত পরিশীলিত কিন্তু তীব্র প্রতিবাদী সংস্কার মুলক আচরন অন্যদিকে ডিরোজিয়ানদের কান্ড কারখানার প্রতি অনীহার এর টানা পোড়েনের মাঝে সেই সময়ের পরিবর্তন কামী মডারেট দৃষ্টিভঙ্গি নেতৃত্ব খুঁজে নেয় দেবেন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের মধ্যে। এই সময়ের আর একজন অত্যন্ত প্রতিভাশালী কিন্তু ক্ষনজন্মা ব্যক্তিত্ব হলেন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত – সংবাদ প্রভাকর এর খ্যাতনামা এডিটর, লেখক, চিন্তাবিদ। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন (১৮১২ – ১৮৫৯) কিন্তু তাঁর মধ্যেই চিরকালের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের পরিষ্কার জায়েগা করে নিয়েছেন – তাঁর উল্লেখ ছাড়া এ ভাষার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এ ছাড়া অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর তত্ত্ব বোধিনী পত্রিকার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে না গেলে রেনেসাসের ছবি সম্পূর্ণ হয় না। প্যারি চাঁদের টেক চাঁদ নামের আড়ালে আলালের ঘরের দুলাল, আর প্রায় এক সময়েই কালিপ্রসন্ন সিংহের হুতোম – যতদিন বাংলা আছে, এরা থাকবেন।
ঈশ্বর বিদ্যাসাগর আর একজন - লড়াইয়ের অন্য নাম। বাল্যকালে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই, হিন্দু সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনা, পরে ফোরট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃতের পন্ডিত থেকে ধাপে ধাপে প্রিন্সিপ্যাল হওয়া। এই লোকটা না থাকলে হয়ত বাংলা ভাষা শিক্ষার আদল কয়েক শো বছর পিছিয়ে থাকত।
এই সব যখন চলছে তখন সময় এসে গেছে ১৮৫৭ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশানের নেতৃত্ব ডিরোজিয়ানদের হাত থেকে চলে যায়। এরি মধ্যে নীলচাষ আর মালিকদের কান্ড কারখানা, দীনবন্ধু মিত্র, নীল দর্পণ, সেটা ১৮৫৯-৬০।
এই সময়েই মাইকেল শুরু করলেন তাঁর কাজ কম্ম, অন্যদিকে বঙ্কিম – বলা যেতে পারে প্রানবন্ত শিক্ষিত বাংলার এই সব রত্নেরা নতুন চেতনার জমিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ তা তুলে ধরতে শুরু করলেন, রেনেসাসের বর্ধিষ্ণু বোধের সমাপতনে।
১৮৫৯-৬০ মাইকেলের ব্ল্যাঙ্ক ভারস, ১৮৬০ বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, যাত্রা শুরু। ১৮৭২ এ বঙ্কিম লেখেন আনন্দমঠ। বঙ্কিম এর সমস্ত লেখাতেই জাতীয়তা বাদের এবং বোধের ছবি উঠে আসে কোন না কোন ভাবে। আনন্দমঠ এক অর্থে সেই বোধের কালমিনেসান।
এই সময়ের নব্য হিন্দুত্বের জনজাগরনের শিল্পিত প্রতিরুপ হলেন একদিকে কেশব চন্দ্র সেন অন্যদিকে রামকৃষ্ণ। কেশব চন্দ্র সেন দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর পর একসময় ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। খোদ দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নাম দেন ব্রহ্মানন্দ। অদ্ভুত ইতিহাস, একটা সময়ের এই ফায়ার ব্র্যান্ড ব্রাহ্ম যার নব্যচেতনার আগুনের টানে বহু জুবক ব্রাহ্ম সমাজে র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, কুচ বিহারের রাজার সঙ্গে বৈবাহিকী সুত্রের প্রয়োজনে , তাঁর মেয়ের সঙ্গে রাজার এক পুত্রের বিবাহ হয়, সেই পুরাতন সমস্ত পদ্ধতি মেনে নেন, যার ফলে সেই সময়ের ইয়ং টার্ক রা ক্ষেপে যান। তাদের মধ্যে আনন্দ মোহন বোস, সুরেন্দ্রনাথ, শিবনাথ শাস্ত্রী অন্যতম। এই সুরেন্দ্রনাথ আর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজি আলাদা লোক। এদের সক্রিয়তায় ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে তৈরি হয় সাধারন ব্রাহ্ম সমাজ। এরা ধর্মীয় মতবাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার এবং স্বাধীনতার বোধে সম্পৃক্ত হতে থাকেন। ফলত এরা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরু হয় ন্যাশনাল সেন্তিমেন্তের প্রচার প্রসার ও ইন্সটিটিউসন্যালাইজেসান। জন্ম হয় প্রথম ইন্ডিয়ান অ্যাসসিয়েসানের ।
১৭৬৫ সালে শাহ আলম গীর এর কাছ থেকে বাংলা বিহার আর উড়িষ্যার অংশের দেওয়ানী নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্প্যানি পত্তন হয়েছিল। ১৮৫৭ র সিপাই বিদ্রহ্র ডিস্টিঙ্কট অধ্যের মধ্যে জে রেনেসাসের আবর্তনচক্র ছিল তাঁর কাল্মিনেসান আসে স্বাধীনতার লড়াইয়ের অঙ্কুরোদ্গমে। ন্যাস্নালিস্ম এই সময়েই আস্তে আস্তে শেকড় ছড়াতে আরম্ভ করে।
যে কোন অগ্রগতির ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের মধ্যে এটা দেখতে পাওয়া যায় যে প্রধান চরিত্রেরা সাধারণত বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তিত্ত্ব। আভ্যন্তরীণ বা বাইরের কোন কনভালসন থেকে তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন প্রশ্ন নিয়ে আসেন – যেমন ম্যাকিয়াভেলির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক লেখাগুলো ফরাসিদের ইতালি অভিযানের কনভালসন প্রসূত, ১৭৮৯ এর বিপ্লব ও পরবর্তীকালে নেপলিয়ানের যুদ্ধোন্মাদ এর প্রসুতাগারে হেগেলিয় ইতিহাসের দর্শনের জন্ম। ১৮৭১ এর ফ্রাঙ্কো-প্রুসিয়ান যুদ্ধ আর তার পর বিসমার্ক এর হহেনজেলার্ন এম্পায়ার এর স্বপ্ন ও স্থাপনা যে ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে পরবর্তী জার্মান সাম্রাজ্যবাদ এর জন্ম নীটশের এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এর জন্মও সেই সময়ের কনভালসনের নিরিখে, এক দর্শন যা আজকের দিনের ইতিহাসবাদের অগ্রদূত, যার গভীর ও গম্ভীর অভিপ্রায় পরবর্তী জার্মান দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের মধ্যে ছায়া ফেলেছে। নতুন চিন্তা চেতনার মাটি তখন তৈরি হয় যখন মনন ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসকে অতিক্রমণের পর্যায়ে চলে যায়। ক্রমবিকাশের ইতিহাস তাই চলিত ইতিহাসের থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেই ইতিহাস তখন একটা নিঃসংশয় বর্তমান। এই অনুভব একটা সমাহিত জ্ঞান যার ধারক এক সিংহাসনচ্যুত সম্রাটের মতই সেই কনভালসনে পুড়ে যাওয়া প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে ছাই দিয়ে নতুন অবয়েব নির্মাণ করে। সেখানে থাকে আনন্দ, থাকে যন্ত্রণা, থাকে বিস্ময় আর থাকে সম্পৃক্ত এক নতুন নির্মাণ যা এক নতুন চেতনার অভিধানের পাতা খুলে ধরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপিয়ান কালচারের জন্য এক বিষম সংকট তৈরি করেছিল। এই যুদ্ধ তাদের চিন্তা চেতনার ভিত্তিভূমি এবং দৃষ্টিভঙ্গি কে বদলাতে বাধ্য করে এবং সেই পরিধির বিস্তারের সঙ্গে বোধহয় একমাত্র সাযুজ্য উপমা পারমানবিক পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তার পরিধির বিস্তার। এই বিস্তার সেই চিন্তা চেতনাকে ঋদ্ধ করার মাটি যুগিয়েছে।
প্রতিটি কালচারের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকেন যারা তাদের আকর্ষণ বা তাদের অস্তিত্বের উপস্থিতির বিকিরনক্ষমতার সুবাদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দের তাদের সংসর্গে নিয়ে আসেন যেখানে তাদের ভূমিকা এক পথ নির্দেশকের। এম্পায়ারিক্যাল হিস্টোরিসিস্ম এটা মনে করে যে কোন ক্রাইসিসের ধ্বংসাত্মক চেহারা বা যে কোন কনভালসনের পেছনে প্রকৃতির দিক থেকে একটা ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার কার্য কারন কাজ করে। তাহলে কি এটা ধরে নিতে হবে যে কনভালসন টা না থাকলে নতুনের সৃষ্টি হবে না! সম্ভবত। তাহলে এটাও করোল্যারি হিসেবে ধরা যেতে পারে কি যে চিন্তা চেতনার নবীকরণের এই পদ্ধতিটাও একটা ন্যাচারাল সিলেক্সানের অঙ্গ? অন্তত বদলের ধারার খোঁজ তো সেই দিকেই ইঙ্গিত করে।
একটা পর্যায়ে চিন্তা চেতনার স্তরে বৌদ্ধিক কনভালসনের ঐতিহাসিক নাম রেনেসাঁস। ইউরোপিয়ান রেনেসাঁস মধ্যযুগীয় ফিউড্যাল পৃষ্ঠপোষকতা নির্ভর চিন্তা চেতনার থেকে লোকায়ত হতে আরম্ভ করে দিল নাকি ফেরত যেতে শুরু করল, বেগবান হল কারন বহু ভাষিক সেই সব কবি সাহিত্যিক শিল্পী চিন্তাবিদেরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষার বহু দিনের কালচারের ঝুলির থেকে বার করে আনতে লাগলেন সব অমূল্য রত্ন। অবশ্যই এই রেনেসাঁসের পেছনে রয়েছে সেই সময়ের ইতিহাস যখন কনস্টান্টিনোপলের পতনের পর এবং ডার্ক এজ এর সমাপতনে ইতালির দিকে পালিয়ে এলেন অনেক গ্রীক এবং নন গ্রীক ইন্টেলেকচুয়াল, বাইজেন্তিয়ান সভ্যতার কেন্দ্রে যারা এতকাল বসবাস করেছেন। ততদিনে রোমের পাপ্যালসি সচেষ্ট হয়েছে ইউরোপের মাটিতে একটা আধ্যাত্মিক এবং বস্তুতান্ত্রিক জীবন সংগঠনের, অবশ্যই চার্চের হেজিমনিস্টিক উদ্দেশ্য নিয়ে। এদিকে পুরনো সামন্ত্রতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে একটা স্থিতিশীল ইউনিফাইং কাঠামো গড়ে উঠছে, জাতীয় মনারকির গুরুত্ব বৃদ্ধি হচ্ছে, জাতীয় ভাষার উন্নয়ন চলছে। ফ্রান্স জার্মানি স্পেন পর্তুগাল ইংল্যান্ড হয়ে উঠল সেই ব্যাবহারিক বিকাশের রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র। রেনেসাঁস স্কলার ক্লারিক দের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল বৌদ্ধিক চেতনার বিস্তারের স্পিরিট, নাম হল তার হিউম্যানিস্ম।
মধ্যযুগীয় রিলিজিয়াস ধ্যান ধারনা মোক্ষলাভের পদ্ধতিগত ধার্মিক বিশ্লেষণ পেন্যান্সের গ্লোরিফিকেসানের স্থলাভিষিক্ত হল সৃষ্টির জন্য সংগ্রাম এবং প্রকৃতির ওপরে বিজয়েচ্ছায় মানুষী প্রয়াস। মানুষের সম্ভ্রমবোধ তার নিজের প্রতি, সে আবার ফিরে পেতে চাইল প্রাচ্য প্রতীচ্যের সেই লিগ্যাসি – সেই পুরাতন স্পিরিট আর উইসডম। সাথে যোগ হল মানুষী চেষ্টার জয়গান, তাই কলম্বাসেরা ছুটল দিকে দিকে – ভাঙো ভৌগলিক ব্যারিয়ার।
এই একই জিনিস লক্ষ্য করা যায় উনিশ শতকিয়া বাংলা ভাষার চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রে – বাংলার রেনেসাঁস। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিভিন্ন তত্ত্ববিদ্যা – এ তো ছিল সেই সময়ের একটা নিঃসংশয় বর্তমান। সামাজিক মূল্যবোধের তত্ত্বে এলো সেই সময়ের নিরিখে যুগান্তকারী বৈপ্লবিক চিন্তা – বিধবা বিবাহ, নারী শিক্ষা। উত্তপ্ত অভ্রান্ত সেই সময়ের অবিসম্বাদি বর্তমান, আজকের ইতিহাস। সে সময়ের এক একজন মননশীল শক্তিশালী শিক্ষিত চিন্তাবিদ এক সঙ্গে সংস্কৃত, জার্মান ফ্রেঞ্চ আর ইংরেজিতে সুদক্ষ ছিলীন যাদের চিন্তাধারায় একসাথে সেই সব ভাষার কালচারের অতলান্তিক বয়ে যেত নিশিদিন, জ্বলে থাকত একটা নীল সরু শিখার মত অভ্রান্ত লাইটহাউস। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা, অনুভুতির তীব্রতা আর আনন্দের উদ্ভাসের সম্মিলিত গ্রন্থনা শিল্পিত হয়েছিল সব কিছুতে। সেই সময়ের এক উজ্জ্বলতম বুদ্ধিবাদি চরিত্রের নাম হেনরি ডিরোজিও। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ারথ এর প্রকৃতিপ্রেম আর মানবতাবোধ, তাঁর প্রখ্যাত সব উত্তরসুরী শেলি কীটস - ইংরেজি সাহিত্যের একটা অন্যতম অধ্যায় রোম্যান্টিসিজম এর ভাবনাপুষ্ট ডিরোজিও এই সময়ের যুব সম্প্রদায়ের নবজাগরনের পেছনে এক অন্যতম প্রতিভা। প্যারিচাদ মিত্র তাঁর অন্যতম শিষ্য। কলকাতার পার্ক স্ট্রীট সিমেট্রি র সমাধিফলকে ১৯৭৮ সালে লেখা হয়েছে – টিচার পোয়েট মেন্টর অফ ইয়ং বেঙ্গল। ইতিহাস এবং সাহিত্যের অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি একজন কবিও ছিলেন। ইয়ং বেঙ্গলদের একটা শ্লোগান ছিল – হি হু উইল নট রিজন ইজ এ বাইগট, হি হু ক্যান নট রিজন ইজ এ ফুল, অ্যান্ড হি হু ডাজ নট রিজন ইজ এ স্লেভ।
বাংলার রেনেসাসের ছিল সেই সময়কার সমাজমনে চেতনার বিবর্তনের বদলের ও ভেঙে গড়ার প্রয়োজনবোধ যার মুলে ছিল সোশ্যাল এভিল এর বিরুদ্ধে লড়াই । ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এর উত্তরনের গল্প করতে গেলে প্রথমেই একটা নাম এসে পরে - রাজা রাম মোহন। বেনারসের সংস্কৃত ঘরানার শিক্ষা দীক্ষা পাটনায় থাকাকালীন তিনি গভীরভাবে পড়াশুনা করেন পারসিয়ান আর অ্যারবিক জাতিগত ঐতিহ্য নিয়ে। মোনোথেইস্ম বা একেশ্বরবাদ নিয়ে এই সময় তিনি কিছু লেখা লেখিও করেন। এর সাথে যুক্ত হয় ইংরেজি ভাষা শিক্ষার আর তদনান্তিন পশ্চিমা মডার্ন কালচারের প্রভাব। কলকাতায় থাকতে আরম্ভ করার পর -
সেটা বোধহয় ১৮১৪ - তিনি আরম্ভ করেন বেদান্ত আর উপনিষদের অনুবাদ, পাশাপাশি চলছিল তাঁর আত্মীয় সভা’র কাজ কম্ম, আর এসবের মুল উদ্দেশ্য ছিল জনসমক্ষে এটা তুলে ধরা যে সব ধর্মই মুলে মোনোথেইস্ট, তার লড়াইটা ছিল গোঁড়া পুরোহিত তন্ত্র সর্বশ্য হিন্দু বাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখানেই থামেন নি তিনি, ১৮২০ থেকে তাঁর বিস্ফোরক এবং বিতর্কমূলক লেখা বেরোতে শুরু করে যেখানে তিনি খ্রীষ্টের নীতিকথা বা মর্যাল মেসেজ কে পাদ্রীতন্ত্রের অলৌকিকের ওপরে নির্ভরশীলতা ও তাদের প্রণীত খৃষ্টান তত্ত্বের থেকে আলাদা করে বিশ্লেষণ করে দেখান যে সেগুল কেন হয়েছে। সে সব বোধহয় ১৮২৩ বা ২৪ যখন মিসন্যারি রা হিন্দু পুরোহিত ও গোঁড়া সমাজ তাঁর ওপরে খড়্গ হস্ত হয়ে ওঠে। ১৮২৮ এ ব্রাহ্ম সমাজের স্থাপনা করেন। ডেভিদ হেয়ার এর সঙ্গে তাঁর অসম্ভব ভাল বোঝাপড়া ও সখ্যতা এবং ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপনার পেছনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য
সতীপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই তাকে এক অদ্ভুত আসনে বসিয়ে রেখেছে আমাদের মনে। সতীদাহের দানবীয় প্রথার ব্যপারে একটা নথিভুক্ত তথ্য হল ১৮১৪ থেকে ১৮২৯ এর মধ্যে নাকি প্রায় ১০,০০০ বিধবা কে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৮২৯ এর দিসেম্বারে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দেন। প্রথম বাংলা খবরের কাগজের সৃষ্টিও তাঁর হাতেই, ১৮১৮ সালে - সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ। তাঁর নাটকীয় ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠ নমুনা – কু সংস্কার ভাঙতে চেয়ে – তাঁর কালাপানি যাত্রা, মানে জাহাজে চেপে বিদেশ যাত্রা। এরকম একটা লোক ১৮৩০ সালের ফ্রেঞ্চ রেভলিউসানের পরে ঘরে স্থির হয়ে বসে থাকতে পারেন নি, সরাসরি সংস্পর্শে আসার তাগিদে ১৮৩০ এই ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। ১৮৩৩ সালে সেই দেশেই মারা যান, ব্রিস্টলের আরনোস ভেল সিমেট্রি তে তাঁর সমাধি রয়েছে।
ডিরোজিও’র ইয়ং বেঙ্গল – কৃষ্ণমোহন ব্যানারজি, রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, রাম গোপাল ঘোষ – যাকে বাংলার ডেমস্থিনিস বলা হত তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতার জন্য। প্যারি চাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার – বিশেষ করে প্যারি চাঁদের গদ্য। রাম তনু লাহিড়ী যিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর নাটকীয় ব্রাহ্মনত্বের অভিজ্ঞান উপবীত অনুষ্ঠান করে পরিত্যাগ করার জন্য।
একদিকে রাম মোহনের শিক্ষিত পরিশীলিত কিন্তু তীব্র প্রতিবাদী সংস্কার মুলক আচরন অন্যদিকে ডিরোজিয়ানদের কান্ড কারখানার প্রতি অনীহার এর টানা পোড়েনের মাঝে সেই সময়ের পরিবর্তন কামী মডারেট দৃষ্টিভঙ্গি নেতৃত্ব খুঁজে নেয় দেবেন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের মধ্যে। এই সময়ের আর একজন অত্যন্ত প্রতিভাশালী কিন্তু ক্ষনজন্মা ব্যক্তিত্ব হলেন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত – সংবাদ প্রভাকর এর খ্যাতনামা এডিটর, লেখক, চিন্তাবিদ। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন (১৮১২ – ১৮৫৯) কিন্তু তাঁর মধ্যেই চিরকালের জন্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের পরিষ্কার জায়েগা করে নিয়েছেন – তাঁর উল্লেখ ছাড়া এ ভাষার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। এ ছাড়া অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর তত্ত্ব বোধিনী পত্রিকার প্রসঙ্গ ছুঁয়ে না গেলে রেনেসাসের ছবি সম্পূর্ণ হয় না। প্যারি চাঁদের টেক চাঁদ নামের আড়ালে আলালের ঘরের দুলাল, আর প্রায় এক সময়েই কালিপ্রসন্ন সিংহের হুতোম – যতদিন বাংলা আছে, এরা থাকবেন।
ঈশ্বর বিদ্যাসাগর আর একজন - লড়াইয়ের অন্য নাম। বাল্যকালে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই, হিন্দু সংস্কৃত কলেজে পড়াশুনা, পরে ফোরট উইলিয়াম কলেজে সংস্কৃতের পন্ডিত থেকে ধাপে ধাপে প্রিন্সিপ্যাল হওয়া। এই লোকটা না থাকলে হয়ত বাংলা ভাষা শিক্ষার আদল কয়েক শো বছর পিছিয়ে থাকত।
এই সব যখন চলছে তখন সময় এসে গেছে ১৮৫৭ সালে। সিপাহি বিদ্রোহের ফলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশানের নেতৃত্ব ডিরোজিয়ানদের হাত থেকে চলে যায়। এরি মধ্যে নীলচাষ আর মালিকদের কান্ড কারখানা, দীনবন্ধু মিত্র, নীল দর্পণ, সেটা ১৮৫৯-৬০।
এই সময়েই মাইকেল শুরু করলেন তাঁর কাজ কম্ম, অন্যদিকে বঙ্কিম – বলা যেতে পারে প্রানবন্ত শিক্ষিত বাংলার এই সব রত্নেরা নতুন চেতনার জমিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠ তা তুলে ধরতে শুরু করলেন, রেনেসাসের বর্ধিষ্ণু বোধের সমাপতনে।
১৮৫৯-৬০ মাইকেলের ব্ল্যাঙ্ক ভারস, ১৮৬০ বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী, যাত্রা শুরু। ১৮৭২ এ বঙ্কিম লেখেন আনন্দমঠ। বঙ্কিম এর সমস্ত লেখাতেই জাতীয়তা বাদের এবং বোধের ছবি উঠে আসে কোন না কোন ভাবে। আনন্দমঠ এক অর্থে সেই বোধের কালমিনেসান।
এই সময়ের নব্য হিন্দুত্বের জনজাগরনের শিল্পিত প্রতিরুপ হলেন একদিকে কেশব চন্দ্র সেন অন্যদিকে রামকৃষ্ণ। কেশব চন্দ্র সেন দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর পর একসময় ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। খোদ দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নাম দেন ব্রহ্মানন্দ। অদ্ভুত ইতিহাস, একটা সময়ের এই ফায়ার ব্র্যান্ড ব্রাহ্ম যার নব্যচেতনার আগুনের টানে বহু জুবক ব্রাহ্ম সমাজে র সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, কুচ বিহারের রাজার সঙ্গে বৈবাহিকী সুত্রের প্রয়োজনে , তাঁর মেয়ের সঙ্গে রাজার এক পুত্রের বিবাহ হয়, সেই পুরাতন সমস্ত পদ্ধতি মেনে নেন, যার ফলে সেই সময়ের ইয়ং টার্ক রা ক্ষেপে যান। তাদের মধ্যে আনন্দ মোহন বোস, সুরেন্দ্রনাথ, শিবনাথ শাস্ত্রী অন্যতম। এই সুরেন্দ্রনাথ আর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজি আলাদা লোক। এদের সক্রিয়তায় ব্রাহ্ম সমাজ ভেঙে তৈরি হয় সাধারন ব্রাহ্ম সমাজ। এরা ধর্মীয় মতবাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার এবং স্বাধীনতার বোধে সম্পৃক্ত হতে থাকেন। ফলত এরা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানারজিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। শুরু হয় ন্যাশনাল সেন্তিমেন্তের প্রচার প্রসার ও ইন্সটিটিউসন্যালাইজেসান। জন্ম হয় প্রথম ইন্ডিয়ান অ্যাসসিয়েসানের ।
১৭৬৫ সালে শাহ আলম গীর এর কাছ থেকে বাংলা বিহার আর উড়িষ্যার অংশের দেওয়ানী নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্প্যানি পত্তন হয়েছিল। ১৮৫৭ র সিপাই বিদ্রহ্র ডিস্টিঙ্কট অধ্যের মধ্যে জে রেনেসাসের আবর্তনচক্র ছিল তাঁর কাল্মিনেসান আসে স্বাধীনতার লড়াইয়ের অঙ্কুরোদ্গমে। ন্যাস্নালিস্ম এই সময়েই আস্তে আস্তে শেকড় ছড়াতে আরম্ভ করে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন