শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ব্যক্তিগত গদ্য - মধুছন্দা পাল

বিয়ে, আমাদের বাড়ীর
মধুছন্দা পাল

প্রায় প্রত্যেক বছর আমাদের বাড়ীতে একটা তো বটেই কখনও কখনও দুটো বিয়েও লাগতো । বাড়ীর দাদা দিদিদের ছাড়াও জ্যাঠতুত দিদির মেয়েদের বিয়েও আমাদের বাড়ী থেকে হতে দেখেছি ।

রান্না ঘরের ঠিক পাশেই একটা ঘর ছিল আমরা সেটাকে বড় ঘর বলতাম ।রান্নাঘর আর বড় ঘরের মাঝখানে একটা দরজা নিরামিষ উনুন ঘেঁষে । পিসিমা নিরামিষ উনুনে দুধ জ্বাল দিয়ে বড় ঘরের চৌকাঠের ওপারে রাখা বাটিতে বাটিতে ঢেলে রাখতো । কি ছিলনা ঐ ঘরে ! গৃহস্থের সাংসারিক প্রয়োজনের সব জিনিষ পত্র রাখার ব্যবস্থা ছিল ওখানে । আমাদের জমি থেকে আসা চাল ভর্তি বস্তা,একটার ওপর একটা উঁচু করে সাজিয়ে রাখা মাচার ওপর। উঁচুতে ঝোলান কাঠের শক্ত পোক্ত চার কোনে চারটে লোহার শেকল দিয়ে ঝোলান মাচায় বাড়ীর সমস্ত লেপ কম্বল । শীতের শেষে তুলে রাখা । , বড় একটা চৌকির ওপর বড় থেকে ছোট করে সাজানো খান দশেক শিল নোড়া , নানা মাপের লোহার হামানদিস্তা । আরও নানা রকম বাসন পত্র , পাথরের বাসনের সেট , আর চৌকির নীচে গরমকালে বস্তার ওপর সাজানো শ’দরে কেনা আম , উঁচু স্ট্যান্ডের ওপর সারি সারি খাবার জলের কলসি । ঐ ঘরের একটা খোপ মতো জায়গায় থাকতো ছোটকাকীমার বেলা দশটার স্পেশাল চায়ের সরঞ্জাম আর থাকতো পিসিমার খই ভাজার পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া বালি ভর্তি কড়া আর একটা নারকোল কাঠির ছোট ঝাঁটা । ,আর ।যা থাকতো সেটাকে বলা হত যজ্ঞির বাসন ।

সে সময় মনে হয় এখনকার মতো বাসন ভাড়া পাওয়া যেতনা । তাই বাড়ীতেই এই সমস্ত বাসনের ব্যবস্থা থাকতো । তবে আমাদের বাড়ী থেকে বাঙ্গালী প্রতীবেশীদেরও অনুষ্ঠানের জন্যে বাসন নিয়ে যেতে দেখেছি ।

কি কি বাসন ছিল একটু মনে করি । যতদুর মনে পড়ে বিশাল বিশাল কালো রঙের কড়া , হাঁড়ী , হাতা ঝাঁজরি , ডেকচি, নৌকো , বিরাট বড় বড় বারকোশ । আরও হয়তো কিছু ছিল । পেতলের বড় বড় গামলা । বঁটি বেশ অনেক গুলো । পরিবেশনের করার জন্যে ছোট বালতি , হাতা চামচ জল দেওয়ার জন্যে পেতলের জলের জগ।

বিয়ের আগে সে সমস্ত নামানো হতো । বেশ কিছুদিন ধরে চলত মাজাঘষার পর্ব । বাসনের ঘড়াম ঘড়াম আওয়াজেই মনে হতো শুরু হয়ে গেল বিয়ে বাড়ী।

কার বিয়ে কি বৃত্তান্ত অত কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় কে? বাড়ীতে কতো লোকজন আসতো । কতো ছোট বাচ্চা । সেই আনন্দেই মশগুল । একটাকে ট্যাঁকে নিয়ে সারা বাড়ী চষে বেড়াতে পারলে আর কি চাই ! একবার মনে আছে , কার বিয়ে মনে নেই বড় বউদির এক বান্ধবী এসেছে বিয়ে উপলক্ষে । মনে হয় গায়ে হলুদের সময় । দিনের বেলা ।, কোলে একটা ছোট্ট বেশ মোটাসোটা মেয়ে । আমি ওকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি হঠাত বাচ্চাটা কিলবিল করে উঠলো আর আমার কোল থেকে সোজা মাটিতে থপাস করে পড়ে গেল । সত্যি করেই আওয়াজ হোল , থপাস । একটু দুরেই মেয়ের মা এবং আরও অনেকে । বাচ্চাটা একটু কান্না কাটি করলো ,ওর মা এসে কোলে নিলো । আমায় অবশ্য কেউই তেমন কিছু বললোনা ।

বিয়ের সময় আমাদের পুরনবাড়ী নতুন করে সাজত । দরকার বুঝে রঙ করানো হতো । বিয়ের দিন থামে থামে রঙিন কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হত নানা রঙের । আলো লাগানো হতো । আমাদের সেই বাড়ীকে যেন চিনতেই পারা যেতনা ।

কতো যে লোকজন আসতো বাইরের শহর থেকে । একেকটা ঘরে মেঝেতে টানা বিছানা হতো ।পছন্দমতো সঙ্গী বেছে তার পাশে শুয়ে বকবক করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম । কলকাতা থেকে যেতো জ্যাঠামনির ছোট মেয়ে জামুদি । তার দুই মেয়ে প্রায় আমারই বয়সী । এইরকম আরও ছিল কেউকেউ

।আমরা কতো যে দৌরাত্ম করতাম । হাজার বার একতলা তিনতলা করতাম । পড়তাম , কেটে যেত , ছড়ে যেত । থুতনি কাটা তো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল । খুব বকুনি খেয়েছি বলে মনে পড়েনা ।

আমাদের বড়দি মানে সবচেয়ে বড় জ্যেঠতুত দিদি যেত কলকাতার কাছাকাছি কোন ছোট শহর থেকে । কয়েকটি ছেলে মেয়ে থাকতো সঙ্গে । একবার কারো বিয়ের দুদিন পর যে যেখানে পেরেছে দুপুরে ঘুমিয়ে ক্লান্তি কাটাচ্ছে বা গল্প গাছা করছে । আর আমরা নেচে বেড়াচ্ছি সারা বাড়ী । বড়দির এক মেয়ে একটা পছন্দসই জায়গায় কষে ঘুম লাগিয়েছে । সেই সুযোগে কেউ একজন তার সারা মুখে আলতা দিয়ে এঁকেছে দাড়ি গোঁফ । সে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এলে সবাই ওকে দেখে হাসাহাসি করলেও বেচারা কিছুই বোঝেনি , একটু অবাক হলেও সকলের সঙ্গে হাসছে , কিছু বুঝতে না পেরে ।

শেষে অনেকপরে কেউ ওকে টেনে আয়নার সামনে গিয়ে হাসির কারণ দেখিয়ে দিল , বেচারি আমাদের জ্যাঠাইমার কোলে মুখ গুঁজে “ও দিদা , তুমি কেন কিছু বললেনা ।” বলে খানিকটা কেঁদে নিল । এই রকম ঘটনা আরও ঘটতো ।

সবসময়ই বিয়ে হয়েছে অন্য শহরের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে । অন্য শহর থেকে বর এসে উঠত ধরমশালায় । ভাগলপুরে ভালো হোটেল তখনও হয়নি মনে হয় । ধর্মশালা বললে যেমন শোনায় ঠিক তেমন ছিলনা সেগুলো । সেসময় পূন্যকামী মাড়োয়াড়িরা অনেকেই পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে একটা করে ধর্মশালা স্থাপন করতেন । অনেক জায়গা নিয়ে । বড় বড় ঘর , বাগান , ইত্যাদি নিয়ে দুতলা বাড়ী । আমাদের পাড়াতেও ছিল তেমন গোটা দুয়েক । খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হতো । তো বরযাত্রীদের সেখানে ওঠানো হতো । বাকি আদর আপ্যায়ন বাড়ী থেকে করা হতো । লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে মহিলারা সে সময় বরযাত্রির সঙ্গে আসতেননা মনে হয় । তাঁদের কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা ।

বিয়ের বেশ কদিন আগে বসতো মিষ্টির ভিয়েন । রান্নাঘরের সামনের উঠোনে । এমনিতেই আমাদের গৃহদেবতা গোপালের মিষ্টি তৈরি হতো বাড়ীতে । সন্দেশ , রসগোল্লা , পান্তুয়া । আমাদের বাড়ীর তৈরি মিষ্টির নাম ডাক ছিল । কাজেই বিয়ের মিষ্টিও হতো খুবই উপাদেয় । বোঁদে হতো মনে আছে । বিয়ের সময় আমরা দইয়ে বোঁদে দিয়ে খেতাম । , মাটীর খুরিতে জমাট টক দই তার ওপর রসে টুপটুপে বোঁদে , আহা ! কি স্বাদ তার । মিষ্টির ভিয়েনের পর হতো যজ্ঞির রান্না । যখন মাছ ভাজা হত দাদারা মাছ ভাজা চুরি করে ওপর নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে খেত । কদিন ধরে একতলার বারান্দায় লম্বা দুটো সারিতে আমরা খেতে বসতাম । বিয়ে কিম্বা বৌভাতের সময় তিনতলার ছাদে খাওয়া হতো । তখনও টেবিল চেয়ারে বসে খাওয়ার চলন হয়নি বিয়েবাড়ীতে । মাটিতে বসে শালপাতায় খাওয়ার ব্যবস্থা হতো। কলকাতার মতো কলাপাতায় নয় । শালপাতা আর মাটীর খুরি ,গ্লাস । কি যে খাওয়া হত সব মনে নেই । খুব সুন্দর পাঁঠার মাংস হতো মনে আছে । পরদিন সকালে আমরা বাসি লুচি দিয়ে পাঁঠার মাংস খেতাম জলখাবারে আর বোঁদে । আর একটা বিশেষ পদের কথা অনেকেই মনে করতে পারবেন , সেটা হোল “ছ্যাঁচড়া” । মাছের কাঁটা তেল ইত্যাদি আর শাক পাতা দিয়ে তৈরী। নাম শুনে যতই নাক সিঁটকান হোকনা কেন ঐ রকম স্বাদু চচ্চড়ি আর খেয়েছি বলে মনে হয়না । তবে এই পদটা হতো “ঘর যোগে” অর্থাৎ বাড়ীর লোকজনের খাওয়া দাওয়ার সময় ।

বাড়ীর ছেলেরা পরিবেশন করতো । কোমরে তোয়ালে অথবা গামছা জড়ানো পরিবেশকদের নিশ্চয়ই মনে আছে , অনেকেরই ! লুচির ঝোড়া হাতে “ লুচি, লুচি” বলতে বটে যাওয়া । মাছ কিংবা মাংসের বালতি হাতে আর একটুকরো মাছ অথবা মাংস বা মিষ্টি নেওয়ার জন্যে পেড়াপিড়ি । সেসব কোথায় আজ চলে গেছে । আমরা ছোটরা নুন লেবু আর জল দেওয়ার অনুমতি পেয়ে ধন্য হয়ে যেতাম । আর একটা কাজ করতাম মনে আছে । গোছা গোছা শালপাতা ধুয়ে ঠাকুরঘরের বারান্দায় রাখা থাকতো । আমাদের কখনও কখনও পরিস্কার কাপড় দিয়ে সেই শালপাতা মুছে রাখতে বলা হত ।

ছেলেদের বিয়ে হলে বউ আসতো সাধারনতঃ সকালের ট্রেনে ।সন্ধ্যেবেলা একটা মহিলা মহলের ঘরোয়া আড্ডা বসতো । সেখান নতুন বৌকে ঘিরে বসতো বাড়ীর আর প্রতিবেশী মহিলারা ।

প্রধানত নতুন বউয়ের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার জন্যেই। নতুনবৌকে দিয়ে গান গাওয়ানো হতো । এ ছাড়া আর যার যা গুন আছে সে তাই প্রকাশ করতো । সে এক কাণ্ড ।আমি আর আমার উনিশদিনের ছোট জ্যাঠতুত বোন একদম সামনে গিয়ে বসতাম । আগে থেকেই জানতাম গান শুনে হাসি পাবে । জানিনা কেন এমন মনে হতো । সত্যি করেই হাসি পেত । হাসি চাপার জন্যে নানারকম দুঃখের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করতাম ( পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা মনে পড়ছে তো ?) কিছুতেই কিছু হতোনা ।শেষ পর্যন্ত উঠে পড়তাম । আর এই রকম অসভ্যতা করার জন্যে বড় দিদিদের কাছে বকুনিও খেতাম ।

এটা আমার শোনা ঘটনা - আমাদের লালুদা আমাদের বাড়ীর বড় ছেলে । তার জন্যে মেয়ে দেখতে যাওয়া হয়েছে বিহার আর বাংলার সীমানার কোন শহরে । প্রথম ছেলের বিয়ে বলে কথা ! জ্যাঠা, কাকারা প্রায় সবাই গেছে ।সঙ্গে আমার দাদা । বেশ ছোট তখন । বড় বড় চেহারার পেছনে চাপা পড়ে গেছে প্রায় । মিষ্টিমুখ করার সময় দাদাকে আর কারো চোখেই পড়েনি । আমাদের হবু বৌদির ছাড়া । সে কাউকে দিয়ে ছোট্ট দেওরটিকে বাড়ীর ভেতরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাবার খাইয়েছে একটা হাঁড়ীর ঢাকায় করে ! মনে হয় রেকাবি কম পড়েছিল । পরে দাদা বড় হয়ে বউদিকে এই নিয়ে ঠাট্টা করতো আর বৌদি বলতো “তুই আবার কথা বলছিস ? খাওয়া তো হতই না , আমি না দেখলে । মুখচোরা কোথাকার ।”

এমনি করেই আনন্দ করে শেষ হতো বিয়ের দিন গুলো । অষ্টমঙ্গলার পর একএক করে ফিরে যেতো যারা যারা এসেছিল । বাসনপত্র উঠে যেত তাদের যায়গায় । আবার সেই আগের রুটিন । কিছুদিন খুব মন খারাপ লাগতো । আবার সব আগের জায়গায় ফিরে যেত। আমরাও ।