শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

ছোটগল্প - অভীক দত্ত

ব্ল্যাকআউট
অভীক দত্ত


বসে ছিলাম চৌরঙ্গীর মোড়ে। এখানে সাধারনত প্রচুর লোক থাকে। কিন্তু আজকে কেউ ছিল না। মাসিক কাগজের দোকানের উল্টোদিকে আমি আর পিঙ্কি রিক্সায় বসে ছিলাম। রিক্সাচালকও কেউ ছিল না।

পিঙ্কি অনেকক্ষণ থেকে বলে চলেছে ওর আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ওকে কিভাবে আইসক্রিম খাওয়াব। আইসক্রিম কিনতে হলে রিক্সা থেকে নামতে হবে। তার থেকেও বড় কথা একটা দোকানও মনে হচ্ছে না খোলা আছে। সবকটা বন্ধ।

পিঙ্কির নাম একসময় সোহিনী ছিল। তারপর সোনা। তারপর আমার মা হঠাৎ করে ওকে দেখে বলল ওকে নাকি মার ছোটবেলার বন্ধু পিঙ্কির মত দেখতে। মা-ও পিঙ্কি বলা শুরু করল। আমিও। তারপর দেখলাম সোহিনীও খুব একটা আপত্তি করল না। তাই শেষমেশ এই নামটাই স্থায়ী হল। আমার জীবনের একমাত্র প্রেমিকা।

পিঙ্কিরও নাকি আমিই প্রথম প্রেমিক। কিন্তু আমার বন্ধুরা এই কথা বিশ্বাস করে না। ওরা বলে সুন্দরী মেয়েরা হল স্পঞ্জের মত। সবাই হাতে করে দেখতে চায়। যদি প্রেমিক নাও থাকে তবু কোথাও না কোথাও ভিড় বাসে ট্রামে জায়গামত হাত পড়ে গেছে। এইসব কথা শুনলে আমার মনখারাপ হয়। মাঝে মাঝে জটিল জটিল প্রশ্ন আসে। কোন কোনটা পিঙ্কিকে জিজ্ঞেসও করে ফেলি। শুনে পিঙ্কি মুখ ভার করে ফেলে। কখনও কখনও কথা বলে না। দু তিনদিন আমার ফোন ধরে না। তারপর অনেকগুলো এস এম এস করতে হয়। “সরি”, “আমি আর কোনদিন এরকম কথা তোমায় জিজ্ঞেস করব না”, এই ধরনের কথা।

পিঙ্কিকে একজন অঙ্ক করায়। ওর দাদার বন্ধু,খুব হ্যান্ডসাম। আমার বন্ধুরা বলে পড়ানোর ফাঁকে ওই ছেলেটা নাকি পিঙ্কির হাত ধরে। আমার খুব রাগ হয়। তারপর পিঙ্কিকে বলেই ফেলি ওই ছেলেটার কাছে পড়ার কি আছে? আর কেউ নেই যে পড়াতে পারে?

শুনে পিঙ্কি রাগ করে। গম্ভীর হয়ে যায়। আর আমাকে আবার সবকিছু মেনে নিতে হয়।

কিন্তু ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যায়। বিশ্বাস হয় না ওই ছেলেটা আর পিঙ্কির মধ্যে ভিতর ভিতর কিছু হয় না।

আজ কেউ নেই এখানে। রিক্সাটার মধ্যে সন্ধ্যে থেকে আমি আর পিঙ্কি বসে আছি। আর থেকে থেকে ও আমার কাছে আইসক্রিম খেতে চাইছে। চারদিকটা অন্ধকার। রাস্তার লাইটগুলি কোনটা জ্বলছে কোনটা জ্বলছে না।

হাওয়া দিচ্ছে না। কিন্তু গরমও লাগছে না, তবে ভয় লাগছে। কেউ যদি আমাকে চিনে ফেলে? চিনে ফেলে যদি তাড়া করে? তাহলে পিঙ্কি কি ভাববে? বেইজ্জতির একশেষ হয়ে যাব তো! আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি একটা ভয়ঙ্কর কোন অপরাধ করেছি। লোকে দেখলে যখনই কেউ আমাকে চিনতে পারবে তখনই আমার কলারটা ধরে আমাকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করবে আর পিঙ্কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

যদিও এই জায়গাটা এখন জনমানবশূন্য তবু একটু আগে বিশুকে দেখলাম যেন। কড়া চোখে আমাকে দেখতে দেখতে চলে গেল। বিশু কি আমার থেকে টাকা পায়? কি জানি।

আমার থেকে কে কে টাকা পায় এখন ঠিক মনে করতে পারছি না। নাকি আমি কাউকে প্রতারণা করেছি? খুব বাজে কিছু কাজ। হতে পারে। না হওয়াটা আশ্চর্য না। এই রিক্সাটায় এসে বসার পর আমার সেরকমই কিছু একটা মনে হচ্ছে।

পিঙ্কি আইসক্রিম খেতে চাইলেও তাই খাওয়াতে পারছি না কোনভাবেই। মনে হচ্ছে রিক্সা থেকে নামলেই ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়ে যাবে। চারদিক থেকে সবাই ছুটে আসবে, আমার দিকে আঙুল তুলবে। আর পিঙ্কিকে আমি হারিয়ে ফেলব।

পিঙ্কিদের বাড়িতে অনেক ছেলের যাতায়াত। ওদের একান্নবর্তী পরিবার। ওর কাকার ছেলে আছে, ওর দাদা আছে, তাদের বন্ধুরা হরবখত যাতায়াত করে চলেছে ওদের বাড়িতে। তাদের কাউকে যদি পিঙ্কির পছন্দ হয়ে যায় তাহলে আমি কোথায় যাব?

তার উপর এখন মনে হচ্ছে এই তো সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। আমি কিছুই পড়াশুনা করিনি। সবটাই সামনের ছেলেটার থেকে টুকব। লুস শিটে লিখে ছেলেটা বেঞ্চিতে রাখবে আমি সুরুৎ করে সেটা নিয়ে আমার লুস শিটের সাথে মিশিয়ে ফেলে সেটা থেকে টুকতে যাব আর গার্ড আমায় ধরে ফেলবে। আমার বাড়িতে খবর যাবে। বাবা মারবে। মা মারবে। আর পিঙ্কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।

তারপর আমি একা একা ঘুরব। কোথাও কেউ থাকবে না।

ঘুরতে ঘুরতে একটা স্টেশনে এসে পড়ব। যেটার ওভারব্রিজে ওঠার পর দেখতে পাব সামনের পাটাতন কয়েকটা নেই। এদিকে ট্রেন এসে পড়েছে। আমাকে পার হতেই হবে। ওপারে যেতেই হবে। ওপারে যাবার জন্য লাফ দেব আর তারপরে সব কিছু আবার আগের মত গুলিয়ে যাবে।

পিঙ্কির বাবা আমাকে পছন্দ করে। ওদের বাড়িতে গেলে অনেকরকম কথা বলে। পিঙ্কির মা যত্ন আত্তি করে। কিছু না কিছু খেতে দেয়। আর আমি দেখি পিঙ্কিদের নীচের ঘরে আসা কাকার ছেলের বন্ধুদের। কোন কোনটা উচ্চিংড়ে টাইপ। দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয় গিয়ে দিই দু-ঘা। এদের নিশ্চয়ই কারও কারও পিঙ্কির উপর গোপনে ভালবাসা আছে। চেষ্টা করে হাসির কিছু বলে পিঙ্কির মনকে জিতে নেবার। পিঙ্কি যখন এদের সাথে গিয়ে হেসে হেসে কথা বলে তখন আমি কিছু খেতে পারি না। মনে হয় গিয়ে পিঙ্কিকে ঠাসিয়ে চড় কসাই। বলি লজ্জা করে না নিজের বয় ফ্রেন্ডের সামনে ছেনালিগিরি করছ?

কিন্তু কিছুই করতে পারি না। চুপচাপ দেখে যাই। খেয়ে দেয়ে ফোন অফ করে বাড়ি চলে আসি। সারারাত ঘুমাতে পারি না। এপাশ ওপাশ করি। তারপর মাঝরাতে উঠে ফোন অন করে দেখি পিঙ্কি অনেকগুলি এস এম এস করেছে। আমিও কড়া ভাষায় কতগুলি এস এম এস করি। তারপর পিঙ্কি ফোন অফ করে দেয়। আমি জেগে বসে থাকি।

এই রিক্সাটায় বসে আছি কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে রাস্তায় লোক না থাকলেও এবাড়ি ও বাড়ির জানলা থেকে সবাই পিঙ্কিকেই দেখছে। তাদের কারও না কারও সাথে পিঙ্কির গোপনে যোগাযোগ আছে। আমার ফোন রেখেই পিঙ্কি তাদের ফোন করে। পিঙ্কির ফোন ব্যস্ত পেলে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বারবার ফোন করতে থাকি। আর যতবার ব্যস্ত পাই আমার মাথার ভেতরে আগুন জ্বলতে থাকে। মনে হয় সব ধ্বংস করে দিই। তারপর যখন বলে ওর পিসি ফোন করেছিল আমার বিশ্বাস হয় না। মনে হয় নির্ঘাত মিথ্যা কথা বলছে।

আমি যদি এবার আইসক্রিম আনতে যাই, এই চত্বরের সব দোকানই তো বন্ধ, আর এই রিক্সাওয়ালাও নেই তারমানে আমাকে এখানে পিঙ্কিকে রেখে যেতে হবে। আর রেখে গেলেই পিঙ্কির সাথে কারও না কারও দেখা হয়ে যাবে।

হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল। মোটা মোটা সূচের মত জলগুলি আমার আর পিঙ্কির গায়ে এসে লাগতে লাগল। পিঙ্কির সাদা সালোয়ার ভিজিয়ে দিতে লাগল, আমি ভিজতে লাগলাম আর শুধু মাথায় আসতে লাগল পিঙ্কিকে যেভাবেই হোক আমার কাছে রাখতে হবে, ওকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না।

আমি রিক্সার মধ্যে পিঙ্কিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছি একটা ছেলে এসে দাঁড়াল রিক্সার পাশে। “ওই” বলে চেঁচিয়ে আমাকে ডাকল। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি মুখ ফিরিয়ে ছেলেটাকে দেখলাম। লম্বা, চুলগুলি ছোট ছোট করে কাটা... আমার দিকে তাকিয়ে বলল “নাম, নাম রিক্সা থেকে...”



পিঙ্কিও কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে আমার পাশ থেকে। আমার পা দুটো কেউ জোর করে আটকে রেখে দিয়েছে। আর আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। চারদিক জনমানবশূন্য...