নীচের কোলাহলো বাড়িয়ে দিয়ে সে ধাতব পাতটায় উঠে দাঁড়ায়। দুপাশে দুটো যমজ শহরকে ধরে রেখেছে পায়ের তলার ব্রীজটা। মাঝ অক্টোবরের ধারালো শান্ত রোদ আগলে রেখেছে বাঙালি কলকাতা। দিগন্ত বরাবর কোনো একটা পাখি যেন বয়ে যায়। শহরের হৃৎস্পন্দনে ব্রিজের গাড়ির আর্তনাদ চাপা পড়ে গেল। আলতো হাওয়ায় চুল উড়ছে তার। সিঁথিটা উড়ে গিয়ে নদীর পাড়ের জং ধরা নোঙ্গরে গিয়ে বসলো যেন।
এক পা।
এক পা এগিয়ে সে নীচে নামতে থাকে, শান্ত রোদটা নদীর জলে পড়ে ঠিকড়ে এসে চোখে বিঁধে যাচ্ছে। তাকানো যাচ্ছে না। চোখ বোজে সে। আর সাথে সাথেই ছোটবেলার জবাকুসুম গন্ধটা নাক মুখ দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। মা, চুল আঁচড়ে দিতো স্নানের পরে, এখন যেমন হলদেটে চিরুনি হাতে এগিয়ে আসছে। সেও পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এ’ঘর থেকে ও’ঘর আলো আর অন্ধকারে, চুল আঁচড়ানো এড়াতে। এই মা ধরে ফেলল! মা এখনও সব গোপন কথা জানতো, তেল আর ঘাম কপাল বেয়ে নেমে আসছে, “মা, দিদি না অনেক হিন্দি গান শিখেছে ” আবছা গলায় মা বলছে আজ বাড়ি এলে ওর হবে, “কি হবে মা?” জিজ্ঞেস করা হয় না । উঃ! চুলে টান লাগে, মা লাগছে, আস্তে আঁচড়াও না! উঃ! ব্রীজের কোলাহলো বা গাড়ির আওয়াজ কোনোটাই তার কান অবধি পৌঁছাতে পারে না, হাওয়ার আওয়াজে আর আদরে নিজেকে গাঙচিলের মতো লাগে। ব্রীজের কাঁধে হেলান দিয়ে বসে তামাশা দেখছে শহরটা, একসময় তার পাশে এসে বসলেন রবীন্দ্রনাথ, বাউলের পোষাকে, একতারা হাতে।
“ক্ষেপা তুই না জেনে তোর আপন খবর
যাবি কোথায়?
আপন ঘর না বুঝে তুই বাহির পানে,
পড়বি ধাঁধায়।”
শহরটা পোড় খাওয়া। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরে নিজেকে সংযত রাখতে শিখে গেছে। গণধোলাই, খুন, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ,- কিছুতেই আর তার হার্টবিট বাড়ে না। ঠোঁটের কোণা থেকে পানের পিক মুছে সে আবার চলতে শুরু করে। তার মাথা ফ্লাইওভার মাড়িয়ে যায়, হাইরাইজ এসে দৃষ্টিপথ আটকায়। সে অবিচলিত ভাবে পথ খুঁজে ঠিক বেরিয়ে আসে। তারই আনাচে কানাচে আমরা আটকে আছি, ঘুমিয়ে আছি, জেগে আছি। পাঁচ মাথা মোড় থেকে ময়দান হয়ে গঙ্গা পর্যন্ত বিছিয়ে আছি। আর বৃদ্ধ কচ্ছপের মতো শহরটা পিঠে সময় বয়ে চলেছে। অমূল্য সময়, শহরের সবচেয়ে বিত্তবানের কাছেও যা সীমিত। আর সীমিত বলেই রোজ রোজ কত তুচ্ছ জিনিসও মূল্য পেয়ে বসে, প্রেমিকার হাসি, সন্তানের প্রথম বুলি, জন্মদিন, কবিতার লাইন, গানের কথা। ছোটদের খেলনার বাক্সের মতো এইসব সামান্য জিনিসে ঠাসা শহরটা, তিলোত্তমা। ঠিক সকাল দশটা বাজে যখন, অনেকের সাথে রাস্তায় নেমে আসে দীপান্বিতা, গত তিন মাসের অস্বস্তিটা ব্যাগে ভরে। গাড়িটা জ্যাম কাটিয়ে, ট্রাফিক রুল ভেঙে কলেজে পৌঁছে যায় সময় মতো। ভারী অস্বস্তিটা টেনে ফ্যাকাল্টি রুমে ঢোকে সে, জল খায়, সই করে, ব্যাগ রেখে ক্লাসের দিকে মেপে মেপে পা বাড়ায়। তার ছায়ার সাথে অস্বস্তিটা তখনও ঝুলতে থাকে। সেপ্টেম্বরের আর্দ্রতা মুখ, গলা, ঘার থেকে মুছে নেয় সে ওয়েট টিস্যু দিয়ে। ক্লাসে গড়পড়তা ছাত্র- ছাত্রীরা নতুন কোনো উত্তেজনা বা আগ্রহ আনতে পারেনা। সময় মতো চকের গুড়ো কাঁধে বয়ে সে ফ্যাকাল্টি রুমে ফিরে আসে, চেয়ারে বসার সাথে সাথে তার সঙ্গের অস্বস্তিটাও গা ছেড়ে দেয়।
“তোর কি হয়েছে বলতো?”
“কি হবে?” টেবিল থেকে মাথা না তুলেই সুলগ্নাকে জবাব দেয় সে।
“কয়েক দিন ধরেই কেমন যেন লাগছে তোকে, কারোর সাথে ঠিক মতো কথাও বলছিস না। সেদিন দুর্জয়দাও এক কথা বলল!”
“কিচ্ছু হয়নি আমার।” দীপার স্বরে ক্লান্তি ধরা পড়ে।
“তীর্থঙ্করদা ঠিক আছে তো? কোনো প্রবলেম হলে জানাস আমায়!” সুলগ্না ক্লাসে চলে যায়।
বিরক্তির প্রলেপ লেগে অস্বস্তিটা আরও বেড়ে যায়। এতো নাক গলানোর কী আছে? গসিপের গন্ধ খোঁজা বন্ধ করবে না এরা কোনোদিনই! দীপা মাথা তোলে না। আজ আবার ট্রিট দেওয়ার কথা সুলগ্নাকে, কী কারণে মনে পরে না দীপার। সুলগ্নাই খুঁজে বার করে উপলক্ষ, সুলগ্নাই এনজয় করে। আর অজান্তেই মাথা ধরে যায় তার। তীর্থর প্রতি উৎসাহটা এদের গেল না! যতসব মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি! তিন মাস আগে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম নাইট থেকে বাড়ি ফেরার পথে দীপা টের পেয়েছিল, সে একা ফিরছে না। গলার মধ্যে আটকে থাকা আরও কিছু একটা গাড়ি বোঝাই হয়ে ফিরছে তার সাথে। রোজকার মতো বাড়ি ফিরে বাবাকে ফোন করে সে, অস্বস্তিটাকে আমল না দিয়েই। কিন্তু অভিজ্ঞ ডঃ ঘোষ মেয়ের অমনোযোগ টের পেয়ে গিয়েছিলেন। দূরত্ব বজায় রাখতে যেমন পারিবারিক অশান্তিতে জড়াননি তিনি, তেমন এক্ষেত্রেও ঘাটাননি মেয়েকে। খালি ফোন রাখার আগে দীপাকে অবাক করে দিয়ে একবার আসতে বলেছিলেন। ‘বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের একমাত্র আস্তানা’ মোটো যার তার থেকে এমন আনুরোধ পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে সে, রাতে ঘুম আসতে একটু দেরী হয়।
দু তিনদিন এমনি এসে ভেসে যায়, দীপার অস্বস্তিটা বাড়তে থাকে। কলেজ, রাস্তা, বাথরুম কোথাও তাকে একা ছাড়েনা এই যন্ত্রণাটা। এই প্রথম অদ্ভুত ভাবে ক্লাসে ট্রাজেডি পড়াতে গিয়ে কান্না দলা পাকিয়ে আসে তার! দীপান্বিতা চ্যাটার্জীর কান্না পায়! তীর্থকে স্বচক্ষে পরকীয়ারত দেখেও যা হয়নি কোনোদিন। কোলকাতা নিজে অবাক হয়ে পড়ে, রাস্তায় রাস্তায় কবিতার লাইন চাপা পড়ে ট্রামে, পার্সী টাওয়ারে চিলগুলো এসে বসতে ভুলে যায়, মা বৈদেহী সারা সপ্তাহে একটাও ক্লায়েন্ট পান না হাত দেখার জন্য। কান্না চেপে শহরে সন্ধ্যা নামে, একার ফ্ল্যাটে আলো জ্বলে ওঠে, বাথরুমে জল গরম হয়। স্নানের জলের সাথে সাথে কষ্টগুলো ড্রেন দিয়ে শহরের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে।
“বাবা, আমার কষ্ট হচ্ছে!”
“আমার কাছে এসে থেকে যাও কটাদিন।“
“না বাবা, সেরকম না!” নিঃশব্দে জল গড়িয়ে নেমে আসে দীপার চিবুকে।
ডঃ ঘোষ ফোনের ওপারে থেকেও তা টের পান। “ভাইএর সাথে দেখা করো, ওকে ডেকে নাও কিছুদিনের জন্য।“
“হুম্!”
“শোনো, এস এম এস এ কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে পাঠাচ্ছি। কিনে ইন্সট্রাকশান মতো খেয়ো।“
“আচ্ছা।“
“তীর্থঙ্করের সাথে এই নিয়ে কোনো কথা হয়েছে?”
“না বাবা।”
“ঠিক আছে, আমি রাখছি। কাল কলেজ থেকে ফিরে এস এম এস করে দিও, আমি সময় মতো ফোন করবো তোমায়। আর ওষুধগুলো খেতে ভুলো না।”
মিথ্যে বলতে ভালো লাগে না দীপার। তীর্থকে ফোনে সমস্যাটার কথা জানিয়েছিল সে সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে রেখে। প্রত্যুত্তরে তীর্থর বলা “ম্যানিয়া!”র তাচ্ছিল্য অস্বস্তিটাকে নিমেষে গগনচুম্বী করে তোলে, বাবাকে বলা হয় না, টাটা সেন্টার ছাড়িয়ে সেটা অন্ধকারে উঠে যায়। ময়দানের হাওয়ায় রবীন্দ্রসংগীতের সুর লেগে থাকে, রবীন্দ্র নাথ তার পিছনে ছুটে চলেন, তাঁকে অনুসরণ করতে করতে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর সামনে এসে থেমে যেতে হয়, সেখানে তিনি নেই, গঙ্গার জলে নৌকা হয়ে ভেসে গেছেন সবার অগোচরে। তাই তিলোত্তমা শহরটায় আরও একা হয়ে পড়ে দীপা। সে নিয়মিত ওষুধ নেয়, বাবার সাথে ফোনে কথা বলে, ভাইয়ের খোঁজ নেয় এখানে ওখানে, কলেজে যায়, বাড়ি ফেরে। আর গত তিনমাস ধরে অস্বস্তিটার সাথে সহবাস করে চলে।
পাঁচ মাথার কোনো একটা মোড়ে গাড়িটাকে গুঁজে রেখে ছোটো, পুরনো, বিখ্যাত চাইনিজ হোটেলটায় ঢুকে আসে দীপা আর সুলগ্না। স্বল্প পরিসরের হোটেলটায় আর মাত্র তিনটে চেয়ার বাকি। কোনো রকমে ভিতরে ঢুকে বসে তারা। লাল চপ্পল পরা ছোটলোক মতো ছেলেটাকে অর্ডার দিতে গিয়ে মাথা ব্যথাটা পারদ চড়ায় গায়ে। সুলগ্না নিয়ম মেনে বেছে বেছে সবচেয়ে দামী ডিশটাই পছন্দ করে। স্বাদের থেকে পয়সার ধাতব আওয়াজটা তার বেশি প্রিয়।
“তুই আর কিছু নিবি?” সুলগ্না এমন ভাবে প্রশ্নটা ছোড়ে যেন দীপা নয়, সেই খাওয়াচ্ছে।
সব কিছু ইনটলারেবেল লাগে দীপার, দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “না।” আরো কিছু বলার আগেই হুড়মুড় করে কেউ একজন তার পিঠে ভেঙে পড়ে। কিছু কড়া শব্দ তৈরী করে পিছু ফিরতেই সুলগ্নার কথা কানে আসে তার, “আরে! তুমি! তুমিই তো দোপাটি!? ফ্রেশার্সে গান গেয়েছিলে, না?”
চশমাটা মাটি থেকে তুলবে না জবাব দেবে বুঝে পায়না মেয়েটা। রাগ হওয়ার পরিবর্তে মায়া হয় দীপার। হাল্কা লাগে নিজেকে, অবাক লাগে। বিস্ময়টা সংক্রামিত হয় সুলগ্নার মধ্যেও যখন দীপা মেয়েটাকে তাদের সাথে বসতে বলে অর্ডার বদলে তিনটে প্লেট আনতে বলে।
বছর দশের ছেলেটা দেখল তাকে ফেলে তার মা দ্রুত একটা বাসে উঠে গেল। “মা, কোথায় যাচ্ছো!” হাহাকারের জবাব না দিয়ে বাসটা পালাতে থাকে। রাস্তার পায়রাগুলোও যেন ছেলেটার সঙ্গ দিতে বাসের পিছনে ছুটে যায়। ততক্ষণে আরও চারটে রুটের বাসের আগে গা ঢাকা দিয়েছে বাসটা, যার জালনায় ধূসর আঁচলে শক্ত করে মুখ ঢেকে বসে আছে ছেলেটার মা। চোখের জলে অথবা ধুলোর পিছনে ছেলেটা একসময় আবছা হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে নজরের আড়ালে চলে যায়। পাঁচ মাথার মোড়ে হাহাকারটা দেশনায়কের মূর্তির মতোই অবহেলিত পড়ে থাকে, ব্যস্ততায় পদদলিত হতে থাকে। ছেলেটার মুখ থেকে আলগা ভাবে বেরিয়ে আসে কয়েকটা শব্দ যেন নিজেকেই সে জিজ্ঞেস করে, “কেন আমায় ফেলে গেলে মা?” দেশনায়ক ছাড়া আর কারওর কানে তা পৌঁছায় না।
খানিক পরে ট্রাফিক পুলিশের তাড়ায় আর পাঁচটা পথচারীর সাথে এক কোণায় গড়িয়ে যায় ছেলেটা। এর ওর সাথে ঠোক্কর খেতে খেতে ট্রামডিপো অবধি পৌঁছে যায়, সেখান থেকে ঝাড়ুদারের টোকায় এক গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। কতো পা সামনে, খয়েরী, কালো, ছাই রঙের প্যান্ট পরা। ধাক্কা খেতে খেতে একসময় ছেলেটা দেখে লাল চপ্পল, লোমশ পায়ের এক হাফপ্যান্ট তার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলছে।
“কিরে, বল! কানে শুনিস না? কাঁদছিস কেন? তুই কি হারিয়ে গেছিস?”
“হারিয়ে গেছি” শব্দদুটো পাঁচ মাথা মোড় থেকে দ্রুত সড়ক পথে যেন পুরো শহরে ধেয়ে যায়। ছেলেটা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অজ্ঞান হয়ে যেতে যেতে সে দেখে তার চোখের ওপারে কলকাতা শহরটাও তারই মতো হারিয়ে গেল কোথায়।
[ধারাবাহিক চলবে...]
অলংকরণ – মেঘ অদিতি, প্রণব ফৌজদার
4 comments:
ছোট ছোট দৃশ্যকল্পগুলি অদ্ভুত এক মায়ার জগতে নিয়ে যায়। অনেকটা কবিতার মত ছন্দ আছে লেখন ভঙ্গিমায়।অলঙ্করণ ও যথোপযুক্ত। শুরুটা ভালো। পরবর্তী সংখ্যাগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।
ছোট ছোট দৃশ্যকল্পগুলি এক অদ্ভুত মায়ার জগতে নিয়ে যায়। অনেকটা কবিতার মত ছন্দ আছে লেখন ভঙ্গিমায়।অলঙ্করণ ও যথোপযুক্ত। পরবর্তী সংখ্যাগুলোর অপেক্ষায় রইলাম।
শুরু থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বেশ পরিণত হাতের ছাপ। কিন্তু শেষাংশে এসে একটু খাপছাড়া লাগল।দৃশ্যকল্পও বেশ ভাল। সংলাপ আর একটু গভীরতা দাবী করছে। শীর্ষ অলঙ্করণ ভাল হয়েছে।
পঞ্চম কিস্তি পড়ার পর ফেরত এসে প্রথম কিস্তি পড়ছি। ফলে ভালো না খারাপ, কোনটা লেগেছে এসবের আর প্রাসঙ্গিকতা নেই। ভালো না লাগলেই জনাব, সত্যি বলছি, একদম লজ্জা করবনা। :) তুই আপাতত লিখতে থাক, এগোতে থাক।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন