মৃৎ-সাহিত্য - এপিটাফ
সুবীর সরকার
১৩
খোকা বর্মন সানাই বাজায়। খোকা বর্মন হাতঘড়ি-প্যান্ট-সার্ট লুঙ্গি এসব কিছুই পড়ে না। পাজামা ও ফতুয়া পরে। খোকা বর্মন নদী ভালোবাসে। আর নদীর পর নদী পেরিয়ে সে নদীপথেই ফিরে আসে। ঘর বানায়। সংসার বানায়। বানায় নাকি নির্মাণ করে। আবার নির্মাণ করে বলেই খোকার একটা বসতবাড়ি হয়। খোকা বর্মন সানাই বাজায় এটা কোনো ঘটনাই নয়। কেননা পৃথিবীতে হাজার হাজার সানাই বাজানেওয়ালা মানুষ আছে। তবু খোকা বর্মন সানাই বাজায়। এটা একটা ঘটনাই। ঘটনার সাথে তুরন্ত জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-দশটি গ্রাম। মানুষজন। খোকা বর্মনের সানাই ছাড়া সেইসব গ্রামে কোনো বিয়ে হবে না, অন্নপ্রাশন হবে না, লোকদেবতার পজো হবে না। মাটির গভীর থেকে সানাই-এর সুর উঠে আসে। আর উঠে এসেই সেই সুর কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে না। খোকার এমনই যাদু যে সুর প্রথমে স্বল্পগতির দৌড় লাগায়। এরপর ক্রমাগত গতিশীল হয়। গতিশীল দৌড় একটা বহুরৈখিকতা অর্জন করে। অর্থাৎ সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে পড়ে মাঠ প্রান্তর নদী বসতবাড়ি বৃক্ষরাজি বালক বালিকা মেঠোপথ যাবতীয় গ্রাম্য অনুষঙ্গের ওপর দিয়ে। ‘ওপর দিয়ে’র মানে বদলে ভিতর দিয়ে বা মধ্য দিয়েও হয়। খোকার সানাই বাদন আবার নাচগান ভুলতে বসা গ্রামের মেয়েবউদের টেনে নিয়ে আসে চিরাচরিত বিবাহনাচের কাছে। অর্থাৎ আনন্দের কাছে। খোকার সানাই টুকরো চাঁদের নিচে ঝুলে থাকে। ঝুলে থাকলেও সানাইকে মোতেও দোলনা অথবা মই মনে হয় না। মনে হয় না কেননা খোকার সানাই অপদেবতার পুজোতে বাজে, বাজতেই থাকে অথচ আমাদের গা ছমছম বা ভয় ভয় কিছুই করে না। খোকা কি জানে বা টের পায় বা বোঝে পৃথিবীতে মেয়েদের জীবন আদতে কষ্ট আর কান্নার জীবন। সেই সানাই শুনে অনেক মেয়েই আবার কান্নাতেই মুখ ঢাকে। কেননা সেই কান্না প্রকৃতই কান্না নয়। তা আসলে বিড়বিড় করে কথা বলে, মেয়েদের নিজস্ব ভাষায়।
১৪
আমার খুব ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে। উল্টোপাল্টা করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে বাঁশি বাজিয়ে পুনরায় নদীকে পুরনো খাতে ফিরিয়ে আনতে। মাঠে মাঠে আমি তো শূণ্যতাকেই খুঁজি। আর বাজপোড়া গাছ, কালো কয়লার মতো, শূণ্যতাকেই রেখে যায়। আগুনে পোড়া লাশ, যুদ্ধ ও দাঙ্গার গল্পে কেঁপে কেঁপে ওঠা রেলব্রিজ; অথবা রেলসেতু ঘামে ভেজা দুপুরের রেলিং ছুঁইয়ে উড়ন্ত পাখির ঠোঁট হয়ে যায়। ঠোঁট নড়ে। আর রামকথার আড়ালে জীবনগাথা গেয়ে চলেন কোনো কোনো লোকশিল্পী। শূণ্যতা তুমি তবে পিরামিড হও। ফুলবাগানের কোণে কোণে আমি রেখে আসি ছেঁড়া বোতাম। বোতামের গা জুড়ে রক্তের দাগ। জীবন মানে আপোষ। আত্মহত্যা। অথবা হননদৃশ্যের শুরুতেই অদৃশ্য থেকেই উলুধ্বনি। উলুধ্বনি থেমে গেলে জনপদ জুড়ে আশ্চর্য প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়। গণধোলাইয়ের আগে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ধূপ ও ধুনো। এই জনপদ গূঢ কোনো বধ্যভূমি। চৌদিকে মাংস পোড়ার গন্ধ। আমি কি যাদু জানি। আমি কি আগের মতন হাতের উপর রাখতে পারবো হাত। বিচ্ছেদপর্বে খুব অন্ধকার। বিষাদের গন্ধ লেবুপাতার মতো। আর শান্ত মেয়েটির মুখের কাছে সামান্য মৃদু মেঘ। জোড়া শিমূলের গাছ। বোবার শত্রূ নেই – এই প্রবাদ ফিকে হয়ে আসছে। তাই পিচকারি থেকে শূণ্যতা ছড়াই। আমার স্বপ্নে প্রিয়জন বা অগ্রজ কবিদের কেউ কেউ তো আসতেই পারেন। আসেনও। তাই বলে কি আমি সমস্ত গোপনীয়তা চুরমার করে পুনশ্চ ফিরিয়ে আনবো সান্ধ্যভাষা, শীত ও শিরির। আর আমার দুপুরের ঘুমে বারবার কড়া নাড়ে মহাশূণ্যতা। শূণ্যতার গোপনাঙ্গ ধুয়ে দিচ্ছে জলের দাগ। আর তা অনুসরণ করতে থাকুক মেঘের শব্দ।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন