ফ্রাঙ্কেনস্টাইন !
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
“আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি সুসভ্যতার আলোক
আমি চাইনা হতে নব বঙ্গে নবযুগের চালক”
আমি চাইনা হতে নব বঙ্গে নবযুগের চালক”
আমি যে বিষয়টি নিয়ে শব্দ সাজাবো তাতে রবীন্দ্রনাথের ‘জন্মান্তর’ কবিতার এই প্রথম দুটি পঙক্তি সুপ্রযুক্ত এমন কথা না বললেও, কোথাওনা কোথাও এই পঙক্তি দুটির ভাবগত প্রাসঙ্গিকতা খুজতে চেষ্টা করেছি । মারণ বিজ্ঞানের ধ্বংশকামী অনুশীলন ও আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বংসমুখী শক্তির বিরুদ্ধে মানব মনের অনন্ত মুক্তির সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । ধ্বংসকামী শক্তি কখনোই কাম্য ছিলনা তাঁর কাছে ।
একথা সত্য, জীব ও জড় জগতের তাবৎ সৃষ্টিই তার নিজের মধ্যে নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করে চলে। কিন্তু তা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সূত্র মেনে । সেই সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের সৃষ্টিও ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর হতে পারে মানব ইতিহাসে তার অজস্র নজির রয়েছে । বিজ্ঞানী ওপেনহিমার কি জানতেননা তাঁর আবিষ্কৃত এটম বোমা হিরোশিমা, নাগাসাকি শহর দুটিকে ধ্বংস করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করবে, মানব সমাজের কি বিপর্যয় ঘটাবে ! তবুও অপেনহিমার ভগবৎ গীতার উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে সদম্ভে বলেছিলান “মনে হচ্ছে আমিই মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা” ।
আধুনিক বিজ্ঞান নাকি মানুষের প্রতিরূপ ‘ক্লোন’ সৃষ্টি করতে সক্ষম । ১৯৬০এর দশক থেকে এরকম প্রয়াস শুরু হয়েছিল । নোবেল জয়ী জসুয়া লিডারবার্গ প্রথম ১৯৬৬তে তাঁর একটি লেখায় ‘ক্লোন’ সৃষ্টির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন । জন্ম – মৃত্যুর চিরন্তন সূত্রকে অস্বীকার করে মানুষের প্রতিরূপ সৃষ্টি হলে কি ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক চলে । অবশেষে ২০০১এ রাষ্ট্রসঙ্ঘ সব ধরণের মানব প্রতিরূপ বা ‘হিউম্যান ক্লোনিং’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানায় তার সদস্য দেশগুলির কাছে । অস্ট্রেলিয়া , কানাডা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি , বৃটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানান প্রদেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে । আর মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতো ‘খোদার ওপর খোদকারি’র এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে ফতোয়াই জারি করেছিল । জন্ম-মৃত্যুর জাগতিক সূত্রকে জীবন সৃষ্টির প্রয়াস কি বিপর্যয়কর হতে পারে এমনকি তার স্রষ্টার কাছেও তা আজ থেকে দুশ’ বছর আগেই জেনেছিলাম মেরি শেলীর উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ । হ্যাঁ বাংলা উচ্চারণ এটাই হওয়া উচিত (Frankenstein) ।
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ -- এই নামটা প্রায় দুশ’ বছর যাবত প্রায় প্রবাদের মত এক ভয়ংকর কল্প-বস্তু হয়ে আছে যে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনি । আমরা প্রবাদের মত বলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ সৃষ্টি করেছ, সে তোমাকেও রেয়াত করবেনা’ । আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে ভয়াল ভয়ংকর ধ্বংসকামী এক বিকট মূর্তি । না , সেই বিকট মূর্তি কিন্তু ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নয় , তার সৃষ্টিকর্তার নাম ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন । সেই নামেই মেরি শেলী তাঁর এই সাড়া জাগানো উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন অর মডার্ন প্রমিথিউস’ । বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে মানুষের প্রতিরূপ - সেই ভয়াল সৃষ্টির জনক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন কে কেন লেখিকা গ্রীক পুরানের বীর নায়ক প্রমিথিউস এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন জানিনা । গ্রীক পুরানের কাহিনি , প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে । মানব অস্তিত্বের অগ্রদূত হিসাবেই প্রমিথিউস পূজ্য । দেবলোক থেকে আগুন চুরি করার জন্য প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েছিলেন সম্রাট জিউ,একটা প্রস্তরখন্ডের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন তার দেহাংশ, শকুনের ভক্ষ্য রূপে । গ্রীকবীর হারকিউলিস অমরত্ব অর্জন করা প্রমিথিউসকে মুক্ত করেছিলেন । লেখিকা মেরি শেলি তাঁর উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিনকে আধুনিক প্রমিথিউস মনে করেছিলেন, হয়তোবা রীতিবিরুদ্ধ বা নিষিদ্ধ বিজ্ঞান সাধনার জন্য, যেমন নরলোকে নিষিদ্ধ আগুন প্রমিথিউস চুরি করেছিলেন দেবলোক থেক্ যার দন্ডও তিনি ভোগ করেছিলেন । প্রমিথিউস অমরত্ব অর্জন করেছিলেন আর মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ নামটি প্রায় দুশ বছর ধরে অমর হয়ে আছে প্রবাদের মত, হয়তো থাকবেও আরো অনেকদিন ।
মেরি শেলি তার এই প্রবাদ প্রতীম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে - যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর , শেষ করেছিলেন ২১ বছর বয়সে, অর্থাৎ তিনবছর লেগেছিল উপন্যাসটি লিখতে । লর্ড বায়রন, পি বি শেলী, জন কীটস’এর সমসাময়িক মেরি শেলী ইংরাজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের লেখিকা । আমাদের দেশে তখন গদ্য সাহিত্যের জন্মই হয়নি । সবেমাত্র শ্রীরামপুর মিশনারীরা রামরামবসু প্রমুখদের দিয়ে কিছু পন্ডিতি বাংলা লেখা শুরু করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ কৌমুদি’ ইত্যাদি সংবাদপত্র । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ছদ্মনামে লন্ডন থেকে । ১৮২৩এ ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ২য় সংস্করণ থেকে লেখিকা মেরি শেলীর নাম জানা যায় । উপন্যাসটিকে বলা হয় একাধারে গথিক উপন্যাস এবং বিজ্ঞান কাহিনি বা সায়ান্স ফিকশন’, আবার রোমাঞ্চ কাহিনি বা ‘হরর স্টোরি’ ও বটে । বস্তুত মেরি শেলীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ বিশ্বের প্রথম সার্থক সায়ান্স ফিকশন রূপেই খ্যাত । এরপরে যুগে যুগে অনেক রোমাঞ্চ কাহিনি লেখা হয়েছে সেগুলির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে- কিন্তু কোনটাই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর মত প্রবাদ-প্রতীম হয়ে ওঠেনি ।
উপন্যাসটি আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা । উত্তর মেরু অভিযানকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ওয়ালটন তার বোন মার্গারেটকে চিঠিতে তার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, এভাবেই শুরু হয়েছে কাহিনি । ক্যাপ্টেন ওয়ালটন ছিলেন এক ব্যর্থ লেখক , বাসনা ছিল উত্তর মেরু অভিযানের মধ্যদিয়ে জানবেন বিজ্ঞানের রহস্য আর তা দিয়ে তিনিও বিখ্যাত হয়ে যাবেন ।
ওয়ালটনের জাহাজের কর্মীরা এক অতিকায় মানবকে একটি কুকুরকে নির্দয় ভাবে হত্যা করতে দেখেন , কয়েক ঘন্টা পরে তারা এক বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায় লোককে উদ্ধার করে , তিনিই বিজ্ঞানী ভিকটর ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ঐ অতিমানবের সৃষ্টিকর্তা । সুস্থ হবার পর ভিক্টর তার কাহিনী বলতে থাকেন । বলেন কিভাবে বিজ্ঞানের উচ্চাশা ও রীতিবিরুদ্ধ চর্চা যার ফলশ্রুতি এক অতিমানবের সৃষ্টি এবং সে তার জীবনে কি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল, সেই রোমাঞ্চকর কথা ।
প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের প্রথাগত বিজ্ঞানসম্মত সূত্রগুলি বোধয় ভিক্টরকে ক্লান্ত করেছিল । ভিক্টর আয়ত্ত করেছিলেন মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করার বিদ্যা । ল্যাবরেটরিতে মৃত মানুষের ও পশুর দেহাবশেষ দিয়ে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । ভিক্টর চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি হবে সুন্দর , কিন্তু হ’ল ৮ফুট দৈর্ঘের , হলুদবর্ণ চোখের এক ভয়াল সৃষ্টি । ভিক্টর তার নিজের সৃষ্টিকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন । সৃষ্টি করলেন বটে কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কায়দা তার আয়ত্তে ছিলনা । সে সৃষ্টির পরমুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আতঙ্কিত ভিক্টরকে প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে চলে , ভিক্টর গৃহত্যাগ করেন । মাস চারেক পরে ফিসে এসে দেখেন তার ছোটভাই উইলিয়াম খুণ হয়েছেন। উইলিয়ামের গলার লকেটটি পাওয়া যায় তার দিদিমা জাষ্টিনের পকেটে , দিদিমার ফাঁসি হয় । ভিক্টর ঘটনাস্থলে তার সৃষ্ট অতমানবটিকে দেখতে পান এবং নিশ্চিত হন যে সেইই প্রতিশোধ স্পৃহায় এই হত্যা ঘটিয়েছে, উইলিয়ামের লকেটটি তার দিদিমার পকেটে চালান করে তাঁরও মৃত্যুর কারণ হয়েছে । ভিকটর বিবাহ করেন তাঁর প্রেমিক এলিজাবেথকে , সেইদিনই এলিজাবের খুন হয়ে যান, ভিকটরের সেই ভয়াল সৃষ্টির হাতে । নির্মম প্রতিশোধ স্পৃহায় ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি একে একে হত্যা করে তার সৃষ্টি কর্তার ভাই , উইলিয়াম, বন্ধু ক্লেভারেল, ও প্রেমিকা এলিজাবেথকে ।
ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে অবশেষে দাবী করে ভিকটর যেন তার মতই তার এক প্রেমিকা সঙ্গি সৃষ্টি করে দেন , কেননা তারও জৈবিক সুখের অধিকার আছে । তাহলে সে তার সঙ্গিকে নিয়ে জনমানব হীন কোন স্থানে চলে যাবে । পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভিক্টর সম্মত হয় । কাজটা করার জন্য চলে যায় ইংল্যান্ডে । সেখানেও হাজির হয় দানবটি , সে ভিক্টরের প্রতিমুহুর্তের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলে । ভিক্টর সেই দানবের প্রেমিকা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন । কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভিক্টর উপলব্ধি করেন তাঁর এই দ্বিতীয় সৃষ্টি আরো কি ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্ট করতে পারে । যদি তারা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হন তবে হয়তোবা এক ভয়াল ভয়ঙ্কর অতিমানবের জাতি সৃষ্টি হয়ে যাবে যা সমগ্র মানব সভ্যতারই সংকট ডেকে আনবে । ভিক্টর তার অসমাপ্ত সৃষ্টিটি ধ্বংস করে দেন । ভিক্টর পালিয়ে যান । কিন্তু যাবেন কোথায় ? তারই সৃষ্ট দানব প্রতি মুহুর্তে তার পিছু পিছু থাকছে । অবশেষে ক্যাপ্টেন ওয়ালটন আন্টারটিকায় বিধ্বস্ত , মৃতপ্রায় ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনকে উদ্ধার করেন । উপন্যাসের শেষটা বড় করুণ – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের মৃত্যু হয়েছে । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন ভিকটরের সৃষ্ট সেই দানব তার সৃষ্টিকর্তার মৃত দেহের সামনে শোকার্ত অনুতপ্ত । নিজেই নিজেকে ধ্বংশ করতে উদ্যত, কারণ সে বুঝেছিল তার সৃষ্টিকর্তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অস্তিত্বও অর্থহীন । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন আন্টার্টিকার বরফের স্তুপের মধ্যে বিলিন হয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে ।
একটি সমাজ ছাড়া সৃষ্টি - দুশ’ বছর ধরে তাবৎ বিশ্বের মানুষের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে । চচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ের মধ্যদিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে । রোমাঞ্চকর কাহিনি বা হরর ফিকশন বিশ্বসাহিত্যে কম নেই । ব্রাম স্ট্রোকারের ‘ড্রাকুলা’ , কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ বাস্কার ভিল’ , ভ্যাম্পায়ার’ হিচককের ‘সাইকো’ এই রকম অজস্র রোমহর্ষক চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি, কিন্তু তার কোনটাই ফ্রাঙ্কেনস্টিনের মত এমন স্থায়ী প্রভাব ফেলেনি । মজার কথা কাহিনির নাট্যায়ন বা চলচ্চিত্রায়ন দেখে যতটা আতঙ্কিত হই উপন্যাসটি পড়লে ততটা হইনা । কারণ চলচ্ছিত্রে নানা ডালপালা যুক্ত হয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে আতঙ্কের দৃশ্যায়ন করা হয় । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রবাদ প্রতীম হয়ে যাওয়ার সেটাই মুখ্য কারণ ।
আমাদের জানা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ কি আদৌ ‘ধ্বংশকামী’ অতিমানবীয় সৃষ্টি ছিল ? উত্তর হ্যাঁ এবং নাও বটে । সেতো তার চারপাশের সমাজ সংসারকে ধ্বংশ করতে চায়নি । সেও এই সমাজেই বাস করতে চেয়েছিল । এমনকি সে বলেছিল তার সৃষ্টিকর্তাকে তারই মত এক সঙ্গিকে সৃষ্টি করতে যাকে নিয়ে সে মানব বহির্ভূত কোন স্থানে চলে যাবে । একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তার ছিল, তা ছিল তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি – তাকে সকলে ভয় পাবে তার অতিমানবীয় ভয়াল ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে – এমন সমাজ ছাড়া সৃষ্টির জন্য । তার জিজ্ঞাসা ছিল ভিক্টর যদি তাকে সৃষ্টিই করলেন তাহলে সে জাগতিক সুখ থেকে বঞ্চিত হল কেন ?
কাহিনি থেকে জেনে যাই, ভয়াল অতিমানবটির স্রষ্টা ভিক্টর ছেলেবেলা থেকেই রীতি বিরুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় আকৃষ্ট ছিল , অশ্রদ্ধা ছিল প্রচলিত মূল্যবোধগুলির প্রতি । তার সমাজ ছাড়া সৃষ্টিটিরও তাই সমাজের প্রতি, তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একটা প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিয়েছিল তার সৃষ্টির পরমুহুর্ত থেকেই । তবুও সে তার সৃষ্টিকর্তার মৃতদেহের সামনে এসে শোকানুতপ্ত হয়েছিল এবং নিজেকেই ধ্বংশ করেছিল । এই মনস্তাত্বিক প্রশ্নে কোন কোন সমালোচক উপন্যাসটির লেখিকা মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন । লেখিকা মেরি শেলী তার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাঁর মাকে হারান, তার চার বছর বয়সে পিতা গডউইন পুণর্বিবাহ করেন । সতেরো বছর বয়সে মেরি তার পিতৃবন্ধু বিবাহিত পার্শি শেলীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন । পরের দুবছর তাদের জীবনে নানান বিপর্যয় , ঋণগ্রস্ততা, শিশু সন্তানের মৃত্যু ইত্যাদির পর পার্শিকে বিবাহ করেন , তা্র ব্যক্তিজীবনে কিছুটা স্থিরতা আসে । লেখা শুরু করেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’, কিন্তু ছদ্মনামে । ১৯২৩এ স্বনামে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগে ১৮২২এ মেরির স্বামী পার্শি শেলির মৃত্যু হয় জলে ডুবে ।
এই অভূতপূর্ব সৃষ্টিতে মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার ছায়াপাত ঘটেছে কিনা তা আমার আলোচ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি, দুশ’বছর আগে, কি অসামান্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে মেরি শেলী তার প্রবাদপ্রতীম উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বকে বিজ্ঞানের অপব্যবহার সম্পর্কে সাভধান বার্তা দিয়েছিলেন । এই অনুষঙ্গেই এটম বোমার আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী ওপেন হিমারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম , কোথাও যেন ধ্বংশকামী ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ আর ওপেন হিমারের দম্ভোক্তি একাকার হয়ে যায় । ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ নিশ্চিত ভাবেই দুশ’ বছর আগের এক সাবধান বার্তা, যে প্রাকৃতিক ও জীবজতের দ্বান্দ্বিক সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের যে অনুশীলন তা অপবিজ্ঞান এবং সেই অপবিজ্ঞান সৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হীন কোন কিছুই মানব সভ্যতার পক্ষে শুভ হতে পারেনা, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনা । তাহলে কে সেই ভয়াল দানব ? আমাদের জানা মেরি শেলীর কল্প-চরিত্র অতিমানবটি নাকি তার উপন্যাসের নায়ক ব্যর্থ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন ?
একথা সত্য, জীব ও জড় জগতের তাবৎ সৃষ্টিই তার নিজের মধ্যে নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করে চলে। কিন্তু তা প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের সূত্র মেনে । সেই সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের সৃষ্টিও ভয়াবহ ও বিপর্যয়কর হতে পারে মানব ইতিহাসে তার অজস্র নজির রয়েছে । বিজ্ঞানী ওপেনহিমার কি জানতেননা তাঁর আবিষ্কৃত এটম বোমা হিরোশিমা, নাগাসাকি শহর দুটিকে ধ্বংস করে কয়েক লক্ষ মানুষকে হত্যা করবে, মানব সমাজের কি বিপর্যয় ঘটাবে ! তবুও অপেনহিমার ভগবৎ গীতার উদ্ধৃতি উচ্চারণ করে সদম্ভে বলেছিলান “মনে হচ্ছে আমিই মৃত্যু, বিশ্বের ধ্বংসকর্তা” ।
আধুনিক বিজ্ঞান নাকি মানুষের প্রতিরূপ ‘ক্লোন’ সৃষ্টি করতে সক্ষম । ১৯৬০এর দশক থেকে এরকম প্রয়াস শুরু হয়েছিল । নোবেল জয়ী জসুয়া লিডারবার্গ প্রথম ১৯৬৬তে তাঁর একটি লেখায় ‘ক্লোন’ সৃষ্টির পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন । জন্ম – মৃত্যুর চিরন্তন সূত্রকে অস্বীকার করে মানুষের প্রতিরূপ সৃষ্টি হলে কি ব্যাপক সামাজিক বিপর্যয় ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক চলে । অবশেষে ২০০১এ রাষ্ট্রসঙ্ঘ সব ধরণের মানব প্রতিরূপ বা ‘হিউম্যান ক্লোনিং’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আহ্বান জানায় তার সদস্য দেশগুলির কাছে । অস্ট্রেলিয়া , কানাডা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি , বৃটিশ যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানান প্রদেশ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে । আর মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতো ‘খোদার ওপর খোদকারি’র এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে ফতোয়াই জারি করেছিল । জন্ম-মৃত্যুর জাগতিক সূত্রকে জীবন সৃষ্টির প্রয়াস কি বিপর্যয়কর হতে পারে এমনকি তার স্রষ্টার কাছেও তা আজ থেকে দুশ’ বছর আগেই জেনেছিলাম মেরি শেলীর উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ । হ্যাঁ বাংলা উচ্চারণ এটাই হওয়া উচিত (Frankenstein) ।
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ -- এই নামটা প্রায় দুশ’ বছর যাবত প্রায় প্রবাদের মত এক ভয়ংকর কল্প-বস্তু হয়ে আছে যে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনি । আমরা প্রবাদের মত বলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ সৃষ্টি করেছ, সে তোমাকেও রেয়াত করবেনা’ । আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে ভয়াল ভয়ংকর ধ্বংসকামী এক বিকট মূর্তি । না , সেই বিকট মূর্তি কিন্তু ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নয় , তার সৃষ্টিকর্তার নাম ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন । সেই নামেই মেরি শেলী তাঁর এই সাড়া জাগানো উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন অর মডার্ন প্রমিথিউস’ । বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে মানুষের প্রতিরূপ - সেই ভয়াল সৃষ্টির জনক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন কে কেন লেখিকা গ্রীক পুরানের বীর নায়ক প্রমিথিউস এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন জানিনা । গ্রীক পুরানের কাহিনি , প্রমিথিউস দেবলোক থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে । মানব অস্তিত্বের অগ্রদূত হিসাবেই প্রমিথিউস পূজ্য । দেবলোক থেকে আগুন চুরি করার জন্য প্রমিথিউসকে শাস্তি দিয়েছিলেন সম্রাট জিউ,একটা প্রস্তরখন্ডের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখেছিলেন তার দেহাংশ, শকুনের ভক্ষ্য রূপে । গ্রীকবীর হারকিউলিস অমরত্ব অর্জন করা প্রমিথিউসকে মুক্ত করেছিলেন । লেখিকা মেরি শেলি তাঁর উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিনকে আধুনিক প্রমিথিউস মনে করেছিলেন, হয়তোবা রীতিবিরুদ্ধ বা নিষিদ্ধ বিজ্ঞান সাধনার জন্য, যেমন নরলোকে নিষিদ্ধ আগুন প্রমিথিউস চুরি করেছিলেন দেবলোক থেক্ যার দন্ডও তিনি ভোগ করেছিলেন । প্রমিথিউস অমরত্ব অর্জন করেছিলেন আর মেরি শেলির ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ নামটি প্রায় দুশ বছর ধরে অমর হয়ে আছে প্রবাদের মত, হয়তো থাকবেও আরো অনেকদিন ।
মেরি শেলি তার এই প্রবাদ প্রতীম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে - যখন তাঁর বয়স ১৮ বছর , শেষ করেছিলেন ২১ বছর বয়সে, অর্থাৎ তিনবছর লেগেছিল উপন্যাসটি লিখতে । লর্ড বায়রন, পি বি শেলী, জন কীটস’এর সমসাময়িক মেরি শেলী ইংরাজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের লেখিকা । আমাদের দেশে তখন গদ্য সাহিত্যের জন্মই হয়নি । সবেমাত্র শ্রীরামপুর মিশনারীরা রামরামবসু প্রমুখদের দিয়ে কিছু পন্ডিতি বাংলা লেখা শুরু করেছেন, প্রকাশিত হয়েছে ‘সংবাদ কৌমুদি’ ইত্যাদি সংবাদপত্র । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ছদ্মনামে লন্ডন থেকে । ১৮২৩এ ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত ২য় সংস্করণ থেকে লেখিকা মেরি শেলীর নাম জানা যায় । উপন্যাসটিকে বলা হয় একাধারে গথিক উপন্যাস এবং বিজ্ঞান কাহিনি বা সায়ান্স ফিকশন’, আবার রোমাঞ্চ কাহিনি বা ‘হরর স্টোরি’ ও বটে । বস্তুত মেরি শেলীর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’ বিশ্বের প্রথম সার্থক সায়ান্স ফিকশন রূপেই খ্যাত । এরপরে যুগে যুগে অনেক রোমাঞ্চ কাহিনি লেখা হয়েছে সেগুলির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে- কিন্তু কোনটাই ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর মত প্রবাদ-প্রতীম হয়ে ওঠেনি ।
উপন্যাসটি আত্মকথনের ভঙ্গিতে লেখা । উত্তর মেরু অভিযানকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন রবার্ট ওয়ালটন তার বোন মার্গারেটকে চিঠিতে তার অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন, এভাবেই শুরু হয়েছে কাহিনি । ক্যাপ্টেন ওয়ালটন ছিলেন এক ব্যর্থ লেখক , বাসনা ছিল উত্তর মেরু অভিযানের মধ্যদিয়ে জানবেন বিজ্ঞানের রহস্য আর তা দিয়ে তিনিও বিখ্যাত হয়ে যাবেন ।
ওয়ালটনের জাহাজের কর্মীরা এক অতিকায় মানবকে একটি কুকুরকে নির্দয় ভাবে হত্যা করতে দেখেন , কয়েক ঘন্টা পরে তারা এক বিধ্বস্ত, মৃতপ্রায় লোককে উদ্ধার করে , তিনিই বিজ্ঞানী ভিকটর ফ্রাঙ্কেনস্টিন – ঐ অতিমানবের সৃষ্টিকর্তা । সুস্থ হবার পর ভিক্টর তার কাহিনী বলতে থাকেন । বলেন কিভাবে বিজ্ঞানের উচ্চাশা ও রীতিবিরুদ্ধ চর্চা যার ফলশ্রুতি এক অতিমানবের সৃষ্টি এবং সে তার জীবনে কি ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছিল, সেই রোমাঞ্চকর কথা ।
প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের প্রথাগত বিজ্ঞানসম্মত সূত্রগুলি বোধয় ভিক্টরকে ক্লান্ত করেছিল । ভিক্টর আয়ত্ত করেছিলেন মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করার বিদ্যা । ল্যাবরেটরিতে মৃত মানুষের ও পশুর দেহাবশেষ দিয়ে জীবন সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন । ভিক্টর চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি হবে সুন্দর , কিন্তু হ’ল ৮ফুট দৈর্ঘের , হলুদবর্ণ চোখের এক ভয়াল সৃষ্টি । ভিক্টর তার নিজের সৃষ্টিকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে গেলেন । সৃষ্টি করলেন বটে কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ করার কায়দা তার আয়ত্তে ছিলনা । সে সৃষ্টির পরমুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়, আতঙ্কিত ভিক্টরকে প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে চলে , ভিক্টর গৃহত্যাগ করেন । মাস চারেক পরে ফিসে এসে দেখেন তার ছোটভাই উইলিয়াম খুণ হয়েছেন। উইলিয়ামের গলার লকেটটি পাওয়া যায় তার দিদিমা জাষ্টিনের পকেটে , দিদিমার ফাঁসি হয় । ভিক্টর ঘটনাস্থলে তার সৃষ্ট অতমানবটিকে দেখতে পান এবং নিশ্চিত হন যে সেইই প্রতিশোধ স্পৃহায় এই হত্যা ঘটিয়েছে, উইলিয়ামের লকেটটি তার দিদিমার পকেটে চালান করে তাঁরও মৃত্যুর কারণ হয়েছে । ভিকটর বিবাহ করেন তাঁর প্রেমিক এলিজাবেথকে , সেইদিনই এলিজাবের খুন হয়ে যান, ভিকটরের সেই ভয়াল সৃষ্টির হাতে । নির্মম প্রতিশোধ স্পৃহায় ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি একে একে হত্যা করে তার সৃষ্টি কর্তার ভাই , উইলিয়াম, বন্ধু ক্লেভারেল, ও প্রেমিকা এলিজাবেথকে ।
ভিক্টর সৃষ্ট দানবটি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে অবশেষে দাবী করে ভিকটর যেন তার মতই তার এক প্রেমিকা সঙ্গি সৃষ্টি করে দেন , কেননা তারও জৈবিক সুখের অধিকার আছে । তাহলে সে তার সঙ্গিকে নিয়ে জনমানব হীন কোন স্থানে চলে যাবে । পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভিক্টর সম্মত হয় । কাজটা করার জন্য চলে যায় ইংল্যান্ডে । সেখানেও হাজির হয় দানবটি , সে ভিক্টরের প্রতিমুহুর্তের গতিবিধি লক্ষ্য করে চলে । ভিক্টর সেই দানবের প্রেমিকা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন । কিন্তু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভিক্টর উপলব্ধি করেন তাঁর এই দ্বিতীয় সৃষ্টি আরো কি ভয়ঙ্কর সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্ট করতে পারে । যদি তারা প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হন তবে হয়তোবা এক ভয়াল ভয়ঙ্কর অতিমানবের জাতি সৃষ্টি হয়ে যাবে যা সমগ্র মানব সভ্যতারই সংকট ডেকে আনবে । ভিক্টর তার অসমাপ্ত সৃষ্টিটি ধ্বংস করে দেন । ভিক্টর পালিয়ে যান । কিন্তু যাবেন কোথায় ? তারই সৃষ্ট দানব প্রতি মুহুর্তে তার পিছু পিছু থাকছে । অবশেষে ক্যাপ্টেন ওয়ালটন আন্টারটিকায় বিধ্বস্ত , মৃতপ্রায় ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনকে উদ্ধার করেন । উপন্যাসের শেষটা বড় করুণ – ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টেইনের মৃত্যু হয়েছে । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন ভিকটরের সৃষ্ট সেই দানব তার সৃষ্টিকর্তার মৃত দেহের সামনে শোকার্ত অনুতপ্ত । নিজেই নিজেকে ধ্বংশ করতে উদ্যত, কারণ সে বুঝেছিল তার সৃষ্টিকর্তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার অস্তিত্বও অর্থহীন । ক্যাপ্টেন ওয়ানটন দেখলেন আন্টার্টিকার বরফের স্তুপের মধ্যে বিলিন হয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে ।
একটি সমাজ ছাড়া সৃষ্টি - দুশ’ বছর ধরে তাবৎ বিশ্বের মানুষের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে । চচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ের মধ্যদিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে । রোমাঞ্চকর কাহিনি বা হরর ফিকশন বিশ্বসাহিত্যে কম নেই । ব্রাম স্ট্রোকারের ‘ড্রাকুলা’ , কোনান ডয়েলের ‘হাউন্ড অফ বাস্কার ভিল’ , ভ্যাম্পায়ার’ হিচককের ‘সাইকো’ এই রকম অজস্র রোমহর্ষক চলচ্চিত্র আমরা দেখেছি, কিন্তু তার কোনটাই ফ্রাঙ্কেনস্টিনের মত এমন স্থায়ী প্রভাব ফেলেনি । মজার কথা কাহিনির নাট্যায়ন বা চলচ্চিত্রায়ন দেখে যতটা আতঙ্কিত হই উপন্যাসটি পড়লে ততটা হইনা । কারণ চলচ্ছিত্রে নানা ডালপালা যুক্ত হয়, প্রযুক্তির ব্যবহারে আতঙ্কের দৃশ্যায়ন করা হয় । ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এর প্রবাদ প্রতীম হয়ে যাওয়ার সেটাই মুখ্য কারণ ।
আমাদের জানা ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ কি আদৌ ‘ধ্বংশকামী’ অতিমানবীয় সৃষ্টি ছিল ? উত্তর হ্যাঁ এবং নাও বটে । সেতো তার চারপাশের সমাজ সংসারকে ধ্বংশ করতে চায়নি । সেও এই সমাজেই বাস করতে চেয়েছিল । এমনকি সে বলেছিল তার সৃষ্টিকর্তাকে তারই মত এক সঙ্গিকে সৃষ্টি করতে যাকে নিয়ে সে মানব বহির্ভূত কোন স্থানে চলে যাবে । একটা প্রতিশোধ স্পৃহা তার ছিল, তা ছিল তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি – তাকে সকলে ভয় পাবে তার অতিমানবীয় ভয়াল ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে – এমন সমাজ ছাড়া সৃষ্টির জন্য । তার জিজ্ঞাসা ছিল ভিক্টর যদি তাকে সৃষ্টিই করলেন তাহলে সে জাগতিক সুখ থেকে বঞ্চিত হল কেন ?
কাহিনি থেকে জেনে যাই, ভয়াল অতিমানবটির স্রষ্টা ভিক্টর ছেলেবেলা থেকেই রীতি বিরুদ্ধ বিজ্ঞান চর্চায় আকৃষ্ট ছিল , অশ্রদ্ধা ছিল প্রচলিত মূল্যবোধগুলির প্রতি । তার সমাজ ছাড়া সৃষ্টিটিরও তাই সমাজের প্রতি, তার সৃষ্টিকর্তার প্রতি একটা প্রতিশোধস্পৃহা জন্ম নিয়েছিল তার সৃষ্টির পরমুহুর্ত থেকেই । তবুও সে তার সৃষ্টিকর্তার মৃতদেহের সামনে এসে শোকানুতপ্ত হয়েছিল এবং নিজেকেই ধ্বংশ করেছিল । এই মনস্তাত্বিক প্রশ্নে কোন কোন সমালোচক উপন্যাসটির লেখিকা মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার প্রতিফলন দেখতে চেয়েছেন । লেখিকা মেরি শেলী তার জন্মের এগারো দিনের মাথায় তাঁর মাকে হারান, তার চার বছর বয়সে পিতা গডউইন পুণর্বিবাহ করেন । সতেরো বছর বয়সে মেরি তার পিতৃবন্ধু বিবাহিত পার্শি শেলীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন । পরের দুবছর তাদের জীবনে নানান বিপর্যয় , ঋণগ্রস্ততা, শিশু সন্তানের মৃত্যু ইত্যাদির পর পার্শিকে বিবাহ করেন , তা্র ব্যক্তিজীবনে কিছুটা স্থিরতা আসে । লেখা শুরু করেন সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কেনস্টিন’, কিন্তু ছদ্মনামে । ১৯২৩এ স্বনামে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগে ১৮২২এ মেরির স্বামী পার্শি শেলির মৃত্যু হয় জলে ডুবে ।
এই অভূতপূর্ব সৃষ্টিতে মেরি শেলীর ব্যক্তিজীবনের অপূর্ণতার ছায়াপাত ঘটেছে কিনা তা আমার আলোচ্য নয় । আমি বুঝতে চেয়েছি, দুশ’বছর আগে, কি অসামান্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে মেরি শেলী তার প্রবাদপ্রতীম উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টিন’এ শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বিশ্বকে বিজ্ঞানের অপব্যবহার সম্পর্কে সাভধান বার্তা দিয়েছিলেন । এই অনুষঙ্গেই এটম বোমার আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী ওপেন হিমারের প্রসঙ্গ এনেছিলাম , কোথাও যেন ধ্বংশকামী ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ আর ওপেন হিমারের দম্ভোক্তি একাকার হয়ে যায় । ‘ফ্রাঙ্কেন্সটিন’ নিশ্চিত ভাবেই দুশ’ বছর আগের এক সাবধান বার্তা, যে প্রাকৃতিক ও জীবজতের দ্বান্দ্বিক সূত্রকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানের যে অনুশীলন তা অপবিজ্ঞান এবং সেই অপবিজ্ঞান সৃষ্ট নিয়ন্ত্রণ হীন কোন কিছুই মানব সভ্যতার পক্ষে শুভ হতে পারেনা, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও রেয়াত করেনা । তাহলে কে সেই ভয়াল দানব ? আমাদের জানা মেরি শেলীর কল্প-চরিত্র অতিমানবটি নাকি তার উপন্যাসের নায়ক ব্যর্থ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টিন ?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন