শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অরূপ ঘোষের পৃথিবী - অত্রি ভট্টাচার্য্য

 


গঘ শব্দটি মূল ডাচ উচ্চারণে শুনলে নাকি মনে হয় কেউ কাশছে, অর্থাৎখখ ভ্যান গঘের ছবি খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে হঠাৎ এই উচ্চারণ শুনলে, হতে পারে, দৃশ্যত ছবির উপরের আবছায়াটি সরে যাবে যে সাময়িক অসুস্থতা সর্দি-কাশির সময় চোখ চোখের উপরের পর্দাকে নশাস করে, চোখের পাতার উপর অপার্থিব ঢেউ খেলায়, সেই ইন্টারপ্রিটেশনে ছবির সঙ্গে ক্রমে বয়স্থ হয়ে যাবে চোখ গঘের ছবির রঙ কি উজ্জ্বল? নিষ্প্রভ? রঙিন বিষয়ের আধিপত্য? খুব অ্যাবসোলিউটিস্ট ধারণায় না গিয়েও বলা যায়, রঙের আধিপত্য ছবির সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক নির্ধারণ করে না, বরং আবেগকে কী চোখে দেখছে এই থেমে থাকা দৃশ্যতা নিয়ে দিগন্তের পর দিগন্ত আবিষ্কার হতে পারা যায় ! আমাদের কাছে গঘের রঙের মূল প্রতিপাদ্য কি ওই ছোট ছোট স্ট্রোকগুলি, নাকি একাধিক রঙের স্ট্রোক একটু দুরত্ব থেকে যে নতুন অ্যামালগামেশন ঘটায়তার প্রতি? এর কোনটাই কোন সুস্থির সুসংবিঘ্ন জবাব নয়, হতে পারে না; বস্তুত চিত্র মাত্রেই, ব্যাপকার্থে শিল্পের ক্ষেত্রে - নিজস্ব ! তাহলে শিল্পী শিল্পের যে মাঝের সম্পর্ক শিল্পীর যে দৈনন্দিনের দ্বারা নির্ধারিত হয়, তা থেকে শিল্প ইটসেলফ কখনো নৈর্ব্যাক্তিক হতে পারে কি, যদি শিল্পকে ব্যাক্তিগতের একটা চেতনাচেম্বারে বসিয়ে প্রশ্ন করা যায়?

অরূপ ঘোষের প্রথম বই হাওয়া নিয়ে একটা অদেখার মত স্মৃতি ছিল, যেহেতু বই কোনদিন হাতে আসেনি, যেমন প্রায় আঠারো বছর অপেক্ষা করিয়ে এসেছিল বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কহে বিশ্বমুখ অরূপ ঘোষের ফেসবুক পেজ খুললে দেখা যায় তিনি ২০২৩-এর পর কোন সুষ্ঠু পোস্ট দেননি আর তাদের বেশীরভাগ বিমূর্ত স্কেচ, সাদাকালো টেক্সচারধর্মী, কিন্তু লাইনগুলি মূলতঃ বহুমুখী শিথিল, অভিমুখহীন কিন্তু অথচ প্রধানতঃ অনুভূমিক উল্লম্ব রেখার বিন্যাস বেশী এক্ষেত্রে তার লেখা নিয়ে একটা আবছা কিন্তু দৃঢ় সন্দেহ তৈরী হওয়া অস্বাভাবিক না যে রেখা রঙের এই বৈপরিত্য কি তার লেখার অভ্রে অপরিচ্ছন্ন কোন আয়না? যা হয়নি বা হচ্ছে না তা নিয়ে লেখা জুড়ে ফ্যান্টাসাইজ করা কি সম্ভব? বা উচিত? Platero and I গদ্যকবিতায় হিমেনেথ একটি অধ্যায়ের শেষে Swallows (বাংলায় ভরতপাখি )-দের নিয়ে লিখছেন“They dare not go up and come down Nueva Street in insistent straight line with the little flourish at the end, nor go down to their nests in the wells, nor perch, in classic post-card fashion, by the white transformer on the telegraph wires, through which the wind hums….They will freeze to death, Platero !”  

মাংসমার্থক

                মাংস দিয়ে তৈরী”- প্রথম প্রকাশ ২০১৪, দ্বিতীয় সাম্প্রতিক, ২৫-, উভয়েই বইমেলায় এই এগারো বছরে যেভাবে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ব্যাক্তিমানুষকে কেন্দ্রে রেখে বদলেছে তা মূলতঃ পুঁজিবাদের সাধারণ নিয়ম মেনে, মানুষকে একই সঙ্গে পণ্য উপভোক্তা হিসেবে ব্যবহার করে এর ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতার দিগন্তে কিছু প্রশ্ন গতি পেয়েছে ডানায়, লিঙ্গের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বাইনারির ভাঙন আইনের সাহচর্য্য পেয়েছে, তার ফলেই হয়তো সামাজিক প্রতিকূলতা সেক্ষেত্রে বেড়ে গিয়েছে ঢের পৃথিবী জুড়ে গোঁড়া মৌলবাদ জনসমর্থন পাচ্ছে ক্রমশঃ, রাষ্ট্রের মাথায় চড়ছে একরৈখিক হেজিমনির উন্মাদনা; এর সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু ধারণা শব্দ পুরনো ক্রমশঃ অফেন্সিভ রূপ পেয়েছে মানবমনে যে কোন ভাষার মূলস্রোত থেকে কিছু কিছু শব্দ প্রায় রোজ- ঝড়ে পড়ছে আর্থসামাজিক মাপকাঠিতে বাতিল হয়ে যাচ্ছে ফলে প্রায় এক দশকের ব্যবধানে যখন কোনও টেক্সট পুনঃপ্রকাশিত হয়, অন্তত একবিংশ শতাব্দির প্রেক্ষাপটে, তার ব্যাখা উদ্দেশ্য প্রশ্নাতীত হবার সুযোগ খুব কম অরূপের এ বই-এর প্রথম গদ্যটির (কবিতাটির ?) কথাই ধরি

                এক প্যারাগ্রাফে পাতাজোড়া টানা গদ্যে লেখাটির শিরোনাম হ্যাং কিছু কিছু কবিতা তার সমগ্র শরীর দিয়ে সারসংক্ষেপের চেষ্টাকে প্রতিরোধ করে প্রতিটি পংক্তি অভিমুখ বদলায়; শব্দ, বাক্য, ফ্রেজ, এক্সপ্রেশন, বিষয় প্রেক্ষিৎ ক্ষণে ক্ষণে গোঁৎ খেয়ে পাঠককে অসমসত্ত্ব -সুচারু ক্যাওসে নিয়ে যেতে পারে এক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী গিভ-অ্যাওয়ে হতে পারত শিরোনাম অরূপের মোটামুটি চলন্ত কলম প্রায় নিওন সাইনের মত জ্বালিয়ে রেখেছে গোটা লেখায়, যদিও হ্যাংওভারের প্রাথমিক অবস্থা শুরু হয় মদ খেতে খেতেই, তার পরে নয় Hillary Gravendyk-এরHARM (২০১০)” কাব্যের নামকবিতাটি মনে পড়ে, যা আলোচ্য লেখাকে প্রায় অ্যান্টিথিসিসের মত সপ্রমাণ করতে সক্ষম

পংক্তির পর পংক্তি অরূপ তাৎক্ষণিককে আবিষ্কার করতে করতে গিয়েছেন, আর পদে পদে তার অবচেতনা হোঁচট খেয়েছে প্রতিটি আপাত-ইল্যুসিভ ছবির নেপথ্যে সাদাকালো কোলাজ সাধারণ ঘরোয়া স্মৃতির কাঠামো ধরে রেখেছে উদাহরনতঃ-

“…বিছানার তলা থেকে উদ্ধার করল অজস্র স্তন বিভিন্ন আকৃতির বিভিন্ন রঙের স্তনগুলি সে কেটে কেটে সাঁটাল দেওয়ালে দেওয়ালের আর কোথাও দেওয়াল ছিল নাদু-একটা ছবি তাকে অনেক তলায় নিয়ে গেল মাকড়সার জালের ভিতর দেখল তার প্রেমিকার ঠোঁট চোখ ঝুলছে জগৎধারণা এখনোও নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়নি তার মনে হল

হ্যাংওভারের ভিতরেও কোনও কিশোরের টুকরো মহার্ঘ্য তথা খেলো বয়ঃসন্ধিযাপন লক্ষ্য করা যায় বিছানার তলায় স্তনের ছবি কেটে কেটে জমানো, তাদের সেঁটে সেঁটে দেওয়াল ছেয়ে ফেলা ; তারপর একসময় ইউনিফায়েড প্রেমিকার উত্থান জীবনে, তখন নারীশরীর নিয়ে কৌতুহল বা আগ্রহের প্রতি তার মধ্যবিত্ত অপরাধবোধ সবই, বৃহত্তর চিত্রে সাধারণ সহজ; কিন্তু পোস্ট অ্যালকোহলিক অ্যাপোক্যালিপসের জগতে অপরাধবোধ- মাকড়সার জালের মত স্বপ্নের পর্দার মালকিন ব্ল্যাক উইডো, কামড়ে ছাড়ে না, মনভরা বিষ ঢুকিয়ে দেয় লেখার শেষে (?) দেখছি অরূপ লিখছেন

খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো পরিবেশন করা হল লেটুস ভ্যানিলা মিশিয়ে কৌটো, বাটি, থালা সবই সাজানো হল চালের উপর বসে ওড়ানো হল আর্তসংগীতের পতাকা ভাইয়েরা আমার মাংসের মোমবাতিগুলি জ্বালালো সুপ্রাবিদ্যুতে বর্বর যোনির গর্জনে হিম পড়ল পাটালির উনোনগুলোয়পতন এল চলে গেল ঘন্টা বাজিয়ে

মোটামুটি আদর্শ বিমূর্ত লেখায় যতটুকু জাগতিক কাঙ্খিত থাকে, অংশের অবজেক্টিভিটি তার চেয়ে অধিক সুপ্রযুক্ত নয় কিছু অংশ স্বাভাবিকভাবেই ধরাছোঁয়ার কাছাকাছি এসেছে, যেমন ওড়ানো হল আর্তসংগীতের পতাকা  অথবাকৌটো, বাটি, থালা সবই সাজানো হল চালের উপর বসেকিন্তু তাতে রহস্যের প্রতি আদর এতটুকু কমেনি বলাই যায়, একটি চরম দান মেরে লেখায় আপ্ত উপসংহার বসিয়েছেন অরূপ, এক জাইগ্যান্টিক হ্যাংওভারের অপূর্ণতাকে পূর্ণ সন্মান দিয়ে

এবার একটি লেখা, সঙ্গে কনসিডারেবলি অলঙ্করণ রয়েছে, যথারীতি কবির স্বহস্তে এবং বিমূর্তে কতটুকু তার পারস্পরিক অনুসারী সে তর্কে না গিয়ে, কতটুকু স্পেস ভাগ করেছে তা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, ছবির নেপথ্যে পিকাসোর আবছা গোয়ের্নিকা জ্বলজ্বলায়মান ফাইবারে অবশ্যই চাইনিজ ইঙ্কের শুকনো ব্রাশ স্ট্রোক প্রতিভূ, কিন্তু ভণিতাবিহীন উল্লম্ব ছবিটার উপরদিকে অন্তত একটি নখরদন্তোদ্যত আগ্রাসী শ্বাপদের আকৃতি প্রতীয়মান সেক্ষেত্রে ছবি শুধু আলোচ্য লেখায় নয়, গোটা বইয়ের ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক লেখা বলছেঃ- 

               

লেখার আকৃতি পংক্তিসজ্জায় একটি মানুষের মাথার আবছা আভাস লক্ষ্য করুক পাঠক, তাকে মনে রাখুক লেখায় লেখার গদ্যের অব্যক্ত পাংচুয়েশনগুলি নিয়ে ভাবুক ভাষা কোথায় বাঁক নিচ্ছে ব্যকরণ থেকে অসাম্যে, ভেবে দেখুকঠেসমূলগুলি তোমার দেহ থেকে, অন্ত্র থেকে, প্লীহায়/না সমাঝদার বর্ণমালাগুলি…”  শরীরের আন্তঃযন্ত্র থেকে ঠেসমূল ঠেলে উঠবার যে ভিস্যুয়াল তার সঙ্গে বর্ণমালা যখন একার্থ হয়, ছবির চেহারা বদলে যায় বৈকি রঙিন থেকে সাদাকালোয়, অলঙ্করণ সেখানে সার্থক নয়? অথবা সমাপ্তির চেতনাকল্পটি“…না বেরিয়ে/মাংসের ভিতর স্বয়ং একটি পিয়ারার চারা/এই বীজ গ্রীষ্মে ডৌল, কৌতুহলীপড়ে থাকে/ঘুমের গণিকা হয়ে/কালো হলুদ/নীচের আকাশে” – এত অপূর্ব মুন্সিয়ানায় চিত্রের আধান শব্দের সামান্য লেহনে বাড়িয়ে তীব্রতাপোপম করে দেওয়ার উদাহরণ বর্তমানে চোখে পড়ে খুব কম, এখনো, যারা নিজস্ব ডিকশন নিয়ে ভাবেতাদের কাছে শুধু সমগ্র একটির অংশ হিসেবে নয়, ভিন্ন ভিন্ন কল্পে এই তিনটি পূর্ণাঙ্গ এক্সপ্রেশন – “মাংসের ভিতর স্বয়ং একটি পিয়ারার চারা”, “এই বীজ গ্রীষ্মে ডৌল, কৌতুহলীঘুমের গণিকাতিনটি পৃথক নির্মাণের উদাহরণ প্রথমটি স্যুররিয়াল, নিখাদ নিখুঁৎ; দ্বিতীয়টি অপূর্ব প্রাকৃতিক রিয়্যালিস্টিক, ভাষার্থে এবং শেষতমটি বিশুদ্ধ বিমূর্ত এদের পাশাপাশি বসিয়ে এত সুন্দর একটি ছবি নির্মাণ কি স্রেফ অন্যমনস্কতা থেকে আসে? কে জানে?

গদ্য ট্রাডিশনাল কবিতা ছাড়াও আরেকটি পৃথক আকৃতির লেখা আছে বই-য়ে, একাধিক পৃষ্ঠায় দুটি পাশাপাশি প্যারাগ্রাফে টানা গদ্যে লেখা, যা কবির ইচ্ছাকৃত আরোপন বলেই মনে হয় একটি দেখি -

প্রথম লেখাটি হতে পারত একটি সুশৃঙ্খল শোকপালন, একটি নামহীন শবদেহের ওবিচুয়ারি। হয়তো হতে চেয়েছিল-ও সেইরকম, সাধারণ হিন্দুবাড়ির মৃত্যুদৃশ্য, একমাত্র পুত্রের হাহাকারমূলক মনোলগ, অতঃপরঅতঃপর লেখা ঘুরে গিয়েছে একটি আবছা স্যুররিয়ালের দিকে। শরীর নেই হয়ে সত্ত্বা এক হয়েছে পারম্পর্য্যে, বংশপরিক্রমায়, বকলমে হয়তো প্রজন্মভিত্তিক স্ট্রাগলে। বৃহদার্থে একটি সুস্পষ্ট আর্থসামাজিক নেপথ্য নির্মাণ করা যায়, আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যববস্থার যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষণের কালের সঙ্গে অপরিবর্তিত স্বরূপ নিয়ে লেখা যায় পাতার পর পাতা। কিন্তু তা তো উদ্দিষ্ট নয়।

নয়, কারণ মৃতদেহ নিজেই নিজেকে ডাকছে, দেখছে, নিজেকে চড়িয়ে দিতে বলছে চিতার আগুনে, যাবতীয় উপঢৌকনসহ রওনা করে দিতে বলছে নিজেকে, মহাপ্রস্থানের দিকে। একটা দুনম্বরী ভূতের গল্প? গোষ্ঠিবদ্ধ সমাস? নাকি লেখার সমস্ত আকুতি, অতিভৌতিক উপাদান লুকিয়ে আছে ওই একটি পংক্তিতে, ওই আমি কি আমারই সন্তান প্রভু…”? আখ্যানে নয়, কবিতার আধানের উচ্চাবচ থরথর তার নির্মাণের ফাইবারে অহরহ গৃহীত ও প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে।  সেই কম্পনে পরিমাপহীন হয়ে যায় মেকী সামাজিকতা, মরালিটি, সম্পর্কের হায়ারার্কি যা জিনের মধ্যে দিয়ে চারিত হয় সন্তান থেকে সন্তানে। তাই কবিতা প্রধানত অবচেতনের বাসিন্দা। নিজে নিজের সন্তান হবার প্রসঙ্গে, অপ্রসঙ্গতঃ মনে পড়ে যাচ্ছে ইথান হক  অভিনিত Predestination (2014)ছবিটির কথা, যেখানে প্রোটাগনিস্ট নিজের সঙ্গে নিজে মিলিত হয়ে নিজের জন্ম দিচ্ছে এবং ইভেঞ্চুয়ালি নিজেই নিজেকে মেরে ফেলছে। সেখানে ছবির নায়ক যদি সময় হয়ে থাকে, এখানে, ওয়েল, স্থান। বাড়ির পিছনে বাবার আত্মার চরকি কাটা, আবার বাবার মৃতদেহে সন্তানের নিজেকে খুঁজে পাওয়া ! বলতেই হয়, বর্ণনার মোচড়ে এই চূড়ান্ত ব্যাক্তিগত অনুভবকেও পাঠকের করে তুলতে পেরেছেন অরূপ !

পাশের লেখাটিকে বলা যায় পূর্বেরটির শান্ত, সমাহিত, অব্যবহৃত বাদের এক ভার্শন। এখানেও কথক নিজের মৃতদেহকে দেখছে, কিন্তু সে ইতিমধ্যে জীবিত; ঘুরে ঘুরে জল খেয়ে এসেছে জীবনের নানান ঘাটে। কিন্তু এক স্কেলে বাঁধা ন্যারেটিভের মধ্যেও ট্যুইস্ট এনেছেন কবি, মাঝেমধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন চিন্তার উপাদান। মাঝে মাঝে লিখেছেন-

অসুখের কথা লিখি, নার্সের মিষ্টিমুখ
শিশুরা অনেক ভাবে। বালক ঈর্ষা করে বিবাহিতের। চোর চম্পট দেয় গৃহস্থ সজাগ হওয়ার আগেই
চিনে ফ্যালে কণ্ঠচোর

প্রসঙ্গতঃ, দ্বিতীয় উল্লিখিত পংক্তির তিনটি বাক্যই একই মানুষকে নির্দেশ করছে বলাই বাহুল্য। আর কী করছে? শিশুর ভাবনা আর গৃহস্থের ভাবনাহীন ঘুমের গ্রাফটি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে আসলে একটি জার্নি বিপ্রতীপভাবে নির্দেশ করছে। শিশুরা অনেক ভাবলেও তাদের ভাবনা উদ্বেগহীন, নিষ্কলঙ্ক। অন্যদিকে গৃহস্থের ঘুম গভীর হলেও তার রয়েছে চুরি যাবার ভয়। এর মাঝে বালক, যে নির্ভার ভাবনার মেদ ফেলে বিবাহিতের (পড়ুন গৃহস্থের) ঘুমকে ঈর্ষা করে, জানে না তার অবহেলিত ভাবনাই হয়ে উঠবে তার অন্বিষ্ট ।

এ লেখার সমাপ্তি অশেষ ও অবাঙ্ময় মাতৃস্নেহ, যা, যে কোন কবিতাকে বাধ্যত আধার দেয়, অবাধ্যতঃ, পাঠকের পথ শেষ করে দেয় সর্বজনীন কোলে। সুতরাং এই শেষ বাক্য ও তাতে বর্ণিত হাহাকার, উপমা ও সম্পর্কের আশানুরূপভাবেই ফ্যান হলাম না।

উপমাংসংহার

                অরূপের লেখার মাংস তার নিজের শরীরের, চিন্তার, আঁকা-, অনিয়ন্ত্রিত কিন্তু ঋজু নেশাগ্রস্ততার। আরোও কিছু বই বেরিয়েছে তার, যাদের খুঁজে পাওয়া জটিল, পরিশ্রমসাধ্য-ও বটে। তবু তার মাংসের নিয়মিত সেবা করলে এ জ্বালাযন্ত্রনাময় সান্নিধ্য আপন করে তুলতে পারে তার ক্র্যাফট, আপাতসরল কিন্তু লাইনে লাইনে হিল্লোল তোলা জীবনচর্যা। ক্র্যাফট শব্দটি সশব্দে ঘৃণা করতেন লরেন্স ফেরলিংগেটি, তার কাছে যা নিছক মেকী বা অনুকরণযোগ্য পরিশ্রমের নামান্তর ছিল। অরূপের ক্ষেত্রে ক্র্যাফট কতটা প্রযোজ্য শব্দ সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, তার স্বতঃস্ফুর্ততারও একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ রয়েছে, যা, ক্রমশঃ নদীর বুকের বালি খূঁড়ে বেদনা বাড়ানোর পদ্ধতির সঙ্গে তুলনীয়। তার এ পথে আরোও প্রবাহিত করবার ইচ্ছা রইল ভবিষ্যতে।

 

মাংস দিয়ে তৈরী (২০১৪)
অরূপ ঘোষ প্রণীত একটি ক্যাওস
নিবেদনে হপ্তাক কাচড়া


 

2 comments: