শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অনুবাদ কবিতা - সুদীপ ব্যানার্জী

 


রণক্লান্ত গাজা : চারটি কবিতা
অনুবাদ - সুদীপ ব্যানার্জী

 

গাজা ভূমধ্যসাগরের ধারে মাত্র তিনশো পঁয়ষট্টি বর্গকিমির এক বন্দর মরুদ্যান আরবী ভাষায় গাজা মানে 'শক্তি' তাই বোধকরি যুগ যুগ ধরে পূব পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতা শক্তিপ্রদর্শন করে চলেছে গাজার উপর, যা একই সঙ্গে তিন তিনটি ধর্মের তীর্থক্ষেত্রের ধারক ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হানায় আজ গাজা প্রায় মেদিনীস্পৃষ্ট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে শুধু জুলাই মাসেই অপুষ্টিতে মারা গিয়েছেন তেষট্টিজন মানুষএই দু:স্বপ্নের নেক্রোপোলিসে, দান্তে-কথিত যন্ত্রনার সাক্ষাৎ সাগরে কেমন আছে সাধারণ মানুষ? কেমন আছেন কবিরা? ক্ষেপচুরিয়াস সংগ্রহ করেছে প্যালেস্তাইন - ইজরায়েল - গাজার  সাম্প্রতিক শব্দচিত্র, কবিদের ভাষায়

 প্রথম কবি তাইসির আবু ওদেহ্ জর্ডনে জন্ম পরিবার নির্বাসিত গাজা থেকে একপুরুষ আগেই এই নিজভূম ছেড়ে পরভূমে বাস সযত্নে লালিত গাজা নামক এক ইউটোপিয়ার অপমৃত্যু  -- তার চেতনায় গভীর ছাপ ফেলেছে তার কবিতার রূপক তাই যেমন তীক্ষ্ণ , তেমনই প্রবল বাস্তব সাধারণ কিন্তু সে সাধারণ ভয়ংকর তার লেখা নগ্ন করে দেয় মানবিকতার আদিগন্তকাল থেকে  প্রচলিত সমস্ত ট্যাগলাইন আয়নায় মুখোমুখি জীবন মরণ তার চির চেনা যুদ্ধ - বিধ্বস্ত গাজা শহরকে তিনি  কী চোখে দেখছেন, পড়া যাক তার কবিতা " The Widowed City "তে

 

একটি বিধবা হওয়া শহর

বিধবা হওয়া শহরটি ফুটিয়ে তুলতে

এই মুহূর্তে আমি ধরে নিচ্ছি
তার
গোলাকার কাঁধগুলো
আচারের
শিশি
আর
ডুমুরগুলো তার মরা বাচ্চা,
বাচ্চাদের জুতো
ক্যামেরা ছাড়াই আমি হাঁটছি আমার
খুন হওয়া ঘরে,
বিধ্বস্ত রান্নাঘর থেকে
কবর দেওয়া চেয়ারগুলিতে
একটি মৃতদেহ থেকে
আরেকটি মৃতদেহে
হেঁটে
চলেছি আমি শান্ত,
শান্ত, ওরা টা টা করছে
আমাকে রক্তাক্ত হাতে

খান ইউনিস থেকে এক অচেনা মানুষের সাথে দেখা হয়,
সে বলেছিল, "আমি একটা ঘেয়ো কুত্তাকে নিজের লেজ চাটতে দেখেছি, না খেয়ে
আছে বেশ 'দিন আর কুত্তাটার পাশেই

পড়ে আছে মেন ইন দ্য সান'এর পাতা
আর
বিয়ের ফটোর ছেঁড়া এ্যালবাম "
মানুষের হাসিমুখ, ওরা ব্যঙ্গ করছে
আমাকে
, আমার বেদনায়

 

 পরবর্তী কবিতাটির নাম " Under the Rubble" কবি মোসাব আবু তোহা পেশায় সাংবাদিক পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কবির কবিতা যেন গাজা শহরের অন্তরাত্মার কথা বলেব্যক্তিগতভাবে কবি গাজা থেকে বর্তমানে প্রাণ বাঁচিয়ে প্রতিবেশী দেশে বাস করছেন সাংবাদিক-কবি প্রতিদিনই তার কলমে গাজার নরসংহারের প্রতিবাদ করে চলেছেন শান্তি রক্ষায়, গাজার শিশুদের রক্ষায় তার আর্তি  কান পাতলেই শোনা যায় সোশাল মিডিয়া প্রিন্ট মিডিয়ায়আর তার কবিতায় যে নির্লিপ্ত ট্র্যাজেডি আঁকা হয় দৈনন্দিন স্বাভাবিকতার চলনে গাজার অতীত, বর্তমান ভবিষ্যত যে ভয়ংকর এক রৌরবেতর ল্যাবিরিন্থে আবদ্ধ  প্রতিটি ছত্র তার সাক্ষ্য

 

ধ্বংসস্তূপের তলায়

 

মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল বিছানায়
সেই ঘুম আর ভাঙেনি তার
বিছানাটাই তার কবর এখন
নিজের ছাদের তলাতেই তার সমাধি
ছাদটিও
স্মৃতিস্তম্ভ এক
নাম নেই, জন্মসাল নেই
মৃত্যুর বছর নেই, খোদাই হয়নি
কোনো
ফলকও
শুধু রক্ত আর দুমড়ানো ভাঙাচোরা
একটি ছবির ফ্রেম
'ড়ে তার পাশে

 

জাবালিয়া ক্যাম্পে এক মা
জমিয়ে রাখছেন তার মেয়ের মাংস
ছোট্ট
একটি মাটির ভাঁড়ে
কিনবেন তিনি জমি এক
নদীর
উপরে, ভিন কোন দেশে

 

চুপ করিয়ে দেওয়া কিছু মানুষ
ইশারায় কথা বলছিল
যখন একটা বোম পড়ল
ওরা
চুপ মেরে গেল


গত রাতে আবার বৃষ্টি হয়েছে
গ্যারেজে একটা ছাতা খুঁজছিল
নতুন
গাছটি
প্রবল হল বোমাবৃষ্টি 
আমাদের বাড়িটা খুঁজছে আশ্রয়
বাড়িগুলোতে

 

ঘরের দরজাগুলো
খোলাই রাখি, যাতে
আমার
বইয়ের শব্দগুলো,
বইয়ের শিরোনামগুলি,
লেখকদের নামগুলো,
আমার প্রকাশকেরা
বোমের শব্দ শুনেই
পালাতে
পারে


একবার
আমার বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল

কিন্তু আমার শহরের ধ্বংসস্তূপ
বেছানো ছিল রাস্তায় 

 

ওরা একটাও স্ট্রেচার জোগাড়
করতে পারেনি তোমার মৃতদেহ
বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য
ওরা তোমার দেহটি রেখেছে
দরজার
একটি পাল্লার ওপর,
চাপা পড়েছিল ওটা
ধ্বংসস্তুপের তলায়
আর তোমার প্রতিবেশীরা :
চলমান দেওয়াল

 

আমাদের বাচ্চাদের মুখের কাটাদাগ
খুঁজে
বেড়াবে তোমাদের
আমাদের শিশুদের কাটা পা
তাড়া করবে তোমাদের

 

লোকটি বেরিয়েছিল কিনতে
কিছু রুটি তার বাচ্চাদের জন্য
লোকটার মরার খবর
পাঠানো হয়েছে বাড়িতে
কিন্তু রুটি নয়
রুটি নেই
একটু বসে আছে গিলে খেতে
যে 'টা বাচ্চা বেঁচে আছে এখনো
টেবিলও লাগছে না, রুটিও না

এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল এক বাবার

দেখলেন দেওয়ালে

নানা রঙের আঁকিবুকি শিশু হাতে আঁকা
তারই বছর চারেকের কন্যার
রঙগুলো লম্বায় ধরুন প্রায় চার ফুট
পরের বছর ওরা পাঁচ ফুট হবে

খালি যে শিল্পী এঁকেছে এগুলো
সে মারা গেছে এয়ার স্ট্রাইকে

আর তো কোনো রঙ নেই
নেই আর কোনো দেওয়াল

জায়গা পাল্টে আমার বইগুলো

সাজিয়ে রাখলাম দেরাজে
দুদিন পর, যুদ্ধ লেগে গেল
সাবধান তোমার বইগুলোর
স্থান পরিবর্তন করবে না

 

 কী চিন্তা করছেন আপনি?  

চিন্তা কী?
আপনি কী?
আপনি?
এখনো কি আপনি আপনিই আছেন?
আপনি ঠিক যেখানে ছিলেন?

 

মানুষ তাহলে যাবেটা কোথায়?
একটা লম্বা মই বানাবে কি
আকাশে
উঠবার?
কিন্তু আকাশ তো ঘেরাও
করে রেখেছে ড্রোন আর এফ সিক্সটিন
আর
মৃত্যুর ধোঁয়া ?

 

আমার পুত্র প্রায়ই বলে,
যখন আমরা গাজায় ফিরব আমি ওকে একটা বাচ্চা কুকুর
কিনে দিতে পারব?  
আমি বলি, "অবশ্যই পারব,
যদি একটাও বেঁচে থাকে "

 

পুত্রকে প্রায়ই বলি,
বড় হয়ে পাইলট হবি নাকি?
বলে না, মানুষ আর বাড়ির
উপর
বোমা ফেলতে
ইচ্ছে করে না আমার

 

যখন আমরা মারা যাই,
আত্মারা আমাদের দেহ ছেড়ে
চলে
যায় নিয়ে যায়
যা
কিছু তারা ভালোবাসে,
আমাদের শোয়ার ঘরে
রাখা
পারফিউমের বোতল,
মেকআপ বাক্স, নেকলেস
এমনকি কলমগুলোও 
কিন্তু গাজাতে দেহ, বাড়ি
সব পুরো গুঁড়িয়ে যায়
নেওয়ার জন্য কিছুই
থাকে না আত্মার
এমনকি আমাদের আত্মারাও
চাপা পড়ে থাকে
ধ্বংসস্তূপের তলায়,
হপ্তার পর হপ্তা

 

 চারপাশে হত্যা, ধ্বংস, স্বপ্নহীনতা এরই মাঝে চলছে প্রতিবাদ তীব্র প্রতিবাদ পরবর্তী কবি নুর হিন্দি কবিতার নাম "Fuck Your Lecture on Craft, My People Are Dying " প্যালেস্তনীয়- আমেরিকান এই মহিলাকবির কলমে মুখোশ টেনে খোলা হচ্ছে  বিশ্বের তথাকথিত শান্তিকামী, ভণ্ড ক্ষমতাবান রাষ্ট্রগুলির

 

গাঁড় মারাক,  শিল্প নিয়ে আপনার লেকচার, আমার লোকেরা মরছে


সাম্রাজ্যবাদীরা ফুল নিয়ে কাব্যি করেন
আমি সেই শিশুদের নিয়ে করছি
যারা
ডেইজি ফুল হওয়ার
কয়েক সেকেন্ড আগে
ইজরাইলি ট্যাঙ্কে পাথর ছুঁড়েছিল

আমি হতে চাই সেই কবি

চাঁদ নিয়ে যার নানা কল্পনা
কিন্তু জেলের কুঠুরি
আর গারদের আড়ালে
প্যালেস্তানীয়
আমরা
সেই
একই চাঁদ দেখি না

কী সুন্দর চাঁদ তাই না

কী সুন্দর ওরা, ফুলগুলো
আমিও ফুল তুলি
আমার
মৃত আব্বার কবরে দেব বলে
যখন
আমার দুঃখ হয়

আর তো আল-জাজিরা চালিয়েই

রাখে সারাদিন
আর আমি চাই জেসিকা এবার
"
শুভ রমজান" টেক্সট্ করাটা থামাক

আমি জানি আমি ঠিক এক আমেরিকান

আমি ঢুকলেই কারও ঘরে
কিছু
না কিছু 'রে

মৃত্যু মায়াবী রূপক

তার কবিতায় যিনি ভাবেন
ভূতেরা
শুনতে পায়
যখন আমি মরব,মাইরি বলছি, 
বারবার হানা দেব তোমাদের নিদ্রায়

একদিন আমি ফুল নিয়ে লিখবই,

যে সব ফুলের মালিক আমরা

 

 শেষ কবিতাটি একটু পুরোনো কিন্তু এই সফর আপাততঃ এই কবিতাটি দিয়েই শেষ করছি কবি ইয়েহুদা আমিচাইয়ের " Wild Peace " ইজরায়েলি এই কবি শান্তির ছবি আঁকছেন এই কবিতায় একটা যথাযথ শান্তিকে আকার দিতে চাইছেন তাদের নিজেদের মতো করে হয়তো গাজা অঞ্চলের দাবীও তাই নিজস্ব এক শান্তি স্বাভাবিক বুনো

 

বুনো শান্তি

অস্ত্র বিরতির শান্তি নয়

এমনকি নেকড়ে বাঘ ভেড়ার
দর্শন দিয়েও নয়
বরঞ্চ আসুক
হৃদয়
থেকে
উত্তেজনা প্রশমনের পর
যে
হৃদয় নিয়ে
তোমরা
শুধুই গ্লানির
কথা
বলো

আমি জানি যে, আমি জানি

কীভাবে হত্যা করতে হয়,
এই বোধই আমাকে প্রাপ্তবয়স্ক করেছে

 আর আমার ছেলে খেলা করে

খেলনা বন্দুক নিয়ে
জানে কীভাবে চোখ খুলতে হয়
কীভাবে
চোখ বন্ধ করতে হয়
আর
কখন 'মা' বলে ডাকতে হয়

শান্তি আসুক

সমরাস্ত্রকে কৃষিজ যন্ত্রে

পরিণত করার
বড়
বড় বুকনি ছাড়াই

 

কোনো শব্দ ছাড়াই,
ভারী রবার-স্ট্যাম্পের ছাপ্পার
শব্দ
ছাড়াই

 

শান্তি আসুক
হাল্কা
, ভাসমান, অলস ফ্যানার মতো

 

সামান্য বিশ্রাম আঘাতগুলির জন্য --
সম্পূর্ণ নিরাময়ের কথা কে বলছে?


(আর অনাথদের আর্তনাদ বয়ে চলুক
এক
প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে, যেভাবে রিলে রেসে, বেটন পড়ে না মাটিতে)


আসুক
শান্তি
বুনোফুলের
মতো,
হঠাৎই, মাটির দাবি
বুনোশান্তি

8 comments:

  1. হৃদয়স্পর্শী অনুবাদ। সাবলীল ও চলমান।

    উত্তরমুছুন
  2. খুবই ভালো লাগলো। ধ্বংসস্তূপের তলায় ' পাঠের অভিঞ্জতার জন্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন