বড় বড় সাহিত্য পুরস্কারের নেপথ্যে কোন ব্রেন ইটিং অ্যামিবা
কেরালায় নেগলেরিয়া ফাউলিয়া নামক এককোষী নিছক একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব আমাদের মতো বহুকোষী জীবশ্রেষ্ঠ মানবদের মস্তিষ্ক শুনছি ইদানীং ভক্ষণ করে চলেছে। বাংলাতেও এ ভারি চিন্তার ব্যাপার। চিন্তা? যন্তরমন্তরে ঢুকে যাওয়া বঙ্গে চিন্তা-টিন্তা কোত্থেকে আসে? ‘সকল দেশের রানি সেজে’ এই বঙ্গভুমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা কোথায় -- না আছে তার ব্যবহার, না আছে ভালোমন্দ বিচার করার ক্ষমতা, না আছে প্রশ্ন তোলার মতো ফ্রন্টাল লোবের উৎপীড়ন। মস্তিষ্কের যদি নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার মতো পীড়াই না থাকে তাহলে মস্তিষ্ক থেকেই বা লাভ কী! অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক ‘হুলি গান-ইজম’-এর গানের কলিগুলি তাই সত্যি – “সুতরাং মরুক মরুক মরুক যত শুকনো পাতা ঝরুক / ঝরে যাক।”
এই অণুজীবটি কিন্তু যে সে ব্যক্তি নয় হে, জীব সৃষ্টির প্রথম রূপগুলির মধ্যে একটি। অর্থাৎ বলা যায় বিবর্তনের সৃষ্টিকর্তা কিন্তু যখন তখন পারে বিবর্তনের নিশান মিটিয়ে দিতে। যাইহোক, ৮৬ বিলিয়ন নিউরন সমন্বিত মস্তিষ্ক স্রেফ খেয়ে ফেলা মুখের কথা নয়। তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে এই ব্রেন-ইটিং অ্যামিবা যেন কবেই প্রবেশ করে গেছে বঙ্গীয় সমাজের মস্তিষ্কে, এখানে আমাদের বিষয় যেহেতু সাহিত্য তাই বিষয় কেন্দ্রিকতা আনতে বলা যায় ব্রেন ইটিং এর কুফল ভোগ করছে বর্তমান সাহিত্যসমাজ। নইলে এই যে প্রত্যেকবার বিবিধ সাহিত্যসংস্থাগুলি থেকে যে সব সাহিত্য পুরস্কারগুলি ঘোষিত হচ্ছে, তার প্রকৃত মূল্যায়ন নিয়ে কীভাবে যেন নীরব থাকছে পাঠক-পাঠিকা গোষ্ঠী, পত্রিকাগোষ্ঠী, লেখক-কবি গোষ্ঠী, সর্বোপরি সমালোচক গোষ্ঠী। একবার ফেসবুক কমেন্টে পড়েছিলাম, পুরস্কার হল শিশুকে নতুন জামা পরানোর মতো, পরিধান করলেও ভালো লাগে আবার না করলেও ভালো লাগে। একজন প্রকৃত যোগ্য লেখকের ক্ষেত্রে একদম সত্যি। কিন্তু এখানে একটা ব্যাপার আছে, বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত এইসব পুরস্কারগুলির নিরিখে প্রত্যহ সংগঠিত হচ্ছে একটা বৈষম্য। তাৎক্ষণিকভাবে আধা মস্তিষ্কের পাঠকদের কাছে তৎসহ আধা মস্তিষ্কের সম্পাদকের কাছে এই পুরস্কারপ্রাপ্তির বৈষম্যের নিরিখে তৈরি হচ্ছে উচ্চবর্গের লেখক ও নিম্নবর্গের লেখক – উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আদম খুঁজছিল ইভকে। এখন একজন সুশীলা তিনি একটি কহ-তব্য পুরস্কার পেলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আদমবাবুও খুঁজে পেলেন তাঁর কাঙ্খিত ইভকে, আর বাকি সব হয়ে গেল ক্লীব। সুতরাং এই কথা সহজেই অনুধাবনযোগ্য-- বৈষম্যের একদিকে থাকছে স্টারকাস্ট আর অন্যদিকে তিলে তিলে তৈরি হচ্ছে স্টারডাস্ট। এখন মনে রাখতে হবে এই নক্ষত্র আর নক্ষত্রচূর্ণ মিলিয়েই আমাদের সাহিত্যসম্পদ। কখনও সখনও সম্ভাব্য নক্ষত্র অবহেলায়, অনালোচিত হয়ে নক্ষত্রচূর্ণে পরিণত হয় যা আগামী দিনে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটা ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করবে। অন্তত বিগত কয়েক বছরের প্রদত্ত সাহিত্যসম্মানগুলির গতিপ্রকৃতি যেদিকে ধাবিত হচ্ছে তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে -- যেসব সাহিত্যসৃষ্টিগুলি সম্মানিত বা পুরস্কৃত হচ্ছে তা আদৌ গুণগত মানসম্মত কিনা? কিন্তু বিবেচনা করার মানুষ কোথায়, প্রশ্ন কোথায়!
যেমন আমরা যদি এই বছর শুধুমাত্র যুবাদের দেওয়া হয়, এমন একটি বাংলাভাষায় সর্বভারতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, বিস্ময়চিত্তে দেখি, একবিংশ শতকের এক চতুর্থাংশ যেখানে শেষ হতে চলেছে তখনও পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় অপরিপক্ক লেখনীতে ‘আমি’–‘তুমি’ এর প্রবলমাত্রায় আধিক্য। অবাক হতে হয় এই দেখেও যে পুরস্কৃত কবি এই বিষয়ে হয়তো অবহিতই নন যে কীভাবে ক্রিয়াপদকে ব্যবহার করে কবিতার পঙক্তি থেকে সর্বনাম পদ অবলুপ্ত করতে হয়। বহু কবিতায় অনুজ্ঞাবাচক পঙক্তি সমন্বিত, ‘মতো’ শব্দের সরাসরি অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, চিত্রকল্প নির্মাণে অপারদর্শীতা বারবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। কোন স্বতন্ত্র স্বর উপহার পেল বাংলা সাহিত্য। তাহলে এই বইতে কী আছে? শান্ত ভাসিয়ে দেওয়া স্বর? চিরুণি তল্লাশি করেও পুরস্কৃত হবার মতো শান্ত মোহময় আবহ নির্মাণ খুঁজে পেলাম না, প্রায় প্রতিটা কবিতাতেই শেষে আমিত্বের অবস্থান, আধুনিক কবিতার মুক্ত সম্প্রসারণ বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। বুঝতে পারলাম না তাহলে তাঁকে কোন নিমিত্তে পুরস্কৃত করা হল! বাংলা সাহিত্য এই পুরস্কার বা উৎসাহ প্রদানে কী লভ্যাংশের অংশীদার হল!
শুনছিলাম, নেগলেরিয়া ফাউলেরি রোগ আক্রান্তকারী ঘাতক অ্যামিবাটি জলের মধ্যে থেকে মানুষকে আক্রমণ করছে। লোকজনকে বলছি নোংরা জল, পচা জল, ভালো জল কোনও জলেই বাবা নেবো না। কোন জলে যে অ্যামিবাটি আছে বোঝা মুশকিল। কেস সেই একই -- যোগ্য জল, অযোগ্য জল আলাদা করা যাচ্ছে না। তেমনই যোগ্য পুরস্কার, অযোগ্য পুরস্কারও এখন আর কেউ আলাদা করছে না। কিন্তু তা বলে কি যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পাচ্ছেন না, অবশ্যই পাচ্ছেন। আর পাচ্ছেন বলেই সাহিত্যসমাজ নিজে নিজেই তার পাপমুক্তির নিজস্ব প্রকরণ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আনন্দ পাচ্ছি স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার প্রাপ্তিতে, আমরা আনন্দ পাচ্ছি শমীক ঘোষের ‘যুব পুরস্কার’ (২০১৭) প্রাপ্তিতে, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ প্রাপ্তিতে।
যেহেতু ক্ষেপচুরিয়াস মূলতই একটি সমালোচনামূলক পত্রিকা ও সাহিত্যগোষ্ঠী সুতরাং নিঃসংকোচে কণ্টকময় পথে পদচারণায় আমাদের পদযুগল কম্পিত হবে না, এমনকি আমাদের সেই লেজুড়ও অবলুপ্ত যেখানে কেউ পদপৃষ্ট করতে পারবে। অতীতে আমরা যখন এই পত্রিকাটি প্রকাশ করতাম তখনও একটা পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল। মধ্যে বেশ কিছুদিন আমরা নিজেরাই সরে ছিলাম। বর্তমান সময় আবার যখন এতবছর পর আমরা ফিরে আসছি, কিছুর তাড়নাতেই ফিরে আসছি, এখনও আমাদের মনে হচ্ছে পত্রিকা যখন হচ্ছে তখন তার উদ্দেশ্যও নির্দিষ্ট হোক এবং আমাদেরও আশু সেই লক্ষ্যে ধাবিত হবার প্রয়োজন। এই শারদ সংখ্যায় যা হবার হলো, তার সাহিত্যগুণ পাঠক বিচার করবে, কিন্তু আগামী দিনে ক্ষেপচুরিয়াস নিজেদের একটি কঠোর সমালোচনামূলক ভীতিহীন পত্রিকা হিসাবেই নিজেকে উপস্থাপিত করবে। আর তরুণ প্রজন্মের সামনে থাকবে একটি খোলা দ্বার। না না কোনও সিংহদরজা নয়, কবিতার পাগলা গারদে ঢোকার গুপ্ত দরজা। হ্যাঁ আবার।
ও হ্যাঁ, এবছর অন্যান্য যে সব শারদ পত্রিকাগুলো আন্তর্জাল বা মুদ্রিত প্রকাশ পেয়েছে তাদেরকেও আমাদের শুভেচ্ছা ও ভালোলাগা জানাই।
- জুবিন ঘোষ
এই ক্ষেপুকেই চাই।
উত্তরমুছুনক্ষেপা ফিরে আসুক ....
উত্তরমুছুন