রাইটার
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
পাঁচ সিকে দাম ছিল সেই ঝর্ণা কলমের । একটা ইঞ্জিরি নামও ছিল সেটার । রাইটারস্ । মাতামহ কিনে দিয়ে বলেছিলেন- এটা তোকে দিলাম । মেড ইন জাপান ! পরীক্ষায় ভালো করে লিখতে পারবি তুই এই কলমে ।
ছোট মামা ফুট কাটলো-আঙ্গো লিখতে পুঙ্গ ফাটে, সে আবার লিখবে ? তাও আবার পরীক্ষার খাতায় ? ও যদি লিখতে পারে, তবে আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে ।
কলিকালেও কারও যে শপথ করা যে সত্যি হয়, সেটা যাচাই করতে বিশ্বনিন্দুকেরা এসে দেখে যেতে পারেন আমার অধুনা বৃদ্ধ ছোটমামাকে । হাতের তালুর চুল, রেগুলার সেলুনে গিয়ে সাইজ করে আসেন । কারণ, সেই পরীক্ষায় হঠাৎ করে আম্মো পাশ করে গেছিলাম।
তখনও, আমি আলী সাহেবের লেখা পড়ি নি ! আমার ধারণা ছিল, গল্পের বই পড়লেও সেটা লেখা পড়ার মধ্যে পড়ে । তাই মৎস্য মারিব, খাইবো সুখের ধারণাটা আমার মনে গভীর ভাবে পোঁতা হয়ে গেছিল, একেবারে শিলা ন্যাসের মত । পড়াশোনা করা ধাতেই ছিল না ।
আমার এই হাল দেখে, সেজ মামা বঙ্কিম থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন:-
“ছাত্র জীবন হইত বড় সুখের জীবন
যদি না থাকিত এগ-জামি-নেশন!”
আমার মোটা মাথায় বোঝার কথা নয়, বুঝিও নি । তবে সেজ মামা যখন আলী সাহেবের রেফারেন্স দিলেন, তখন বুকে বল- ভরসা এলো ।
পরীক্ষার খাতাতে মুজতবা সাহেব নাকি এ্যায়সা আ্যানসার ঝেড়েছিলেন, যে পরীক্ষকেরা বলেছিলেন-
-এনকোর! ( ফিরসে বা রিপিট) আর সেই ক্লাসে তাঁকে আবার রেখে দিতেন। পরের বছর পর্যন্ত পরীক্ষকেরা অপেক্ষা করতেন, কখন আবার এইরকম উত্তর মুজতবা সাহেব লিখবেন। ( এটা মুজতবা সাহেব নিজেই লিখে গেছেন)
এনকোর ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বললে বোধহয় ভালো হয়। আগেকার দিনে,যাত্রা থিয়েটারে কোন সিন ভালো লাগলে, দর্শকেরা বলতেন--এনকোর! (ইংরেজি শব্দ) আর কুশীলবেরা সেই দৃশ্যটি আবার অভিনয় করতেন!
এ দিক দিয়ে আমার পরীক্ষকেরা আমাকে এনকোর না বললেও, ফার্স্ট কল বা থার্ড কলেও আমাকে পাশ করাতেন না! ফলং- প্রহারং। আবার দাদু গিয়ে বণ্ড দিয়ে আমাকে ওপরের ক্লাসে ওঠাতেন।
পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার জন্য একবার ইতিহাসের পাতায় আমার এক তালেবর গুরুর নকল করে ইঞ্জিরিতে লিখেও এসেছিলাম :-
বাবর ওয়াজ এ গ্রেট এম্পপেরর্। হি ফ্যাটাচুলেটেড্ আ্যণ্ড ল্যাটাচুলেটেড্। হি অলসো পারপেনডিকুলারলি গরমরালাইজড্ এভরিথিং!
এহেন আমি পাশ টাস দিয়ে ( বাবা বলেছিলেন- বোর্ড আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কেস করবেন, আমাকে পাশ করানোর জন্য, তবে হিতৈষীদের অনুরোধে গজগজ করে থেমে গিয়ে আর সেই সুকর্মটি ভাগ্যিস করেন নি ) উমেদারি করে একটা বেচুবাবুর চাকরী করার সুযোগ পেয়েছিলাম । কালচারাল শক হয়েছিল- আমার পরিবারের সকলের, তবে ব্যাপারটা আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল তাঁদের ।
কালের নিয়মে অবসর নিতেই হলো দু হাজার তিন সালে । মনে প্রথমেই সাধ জাগলো আমার, আলী সাহেব পড়তে । প্রথমেই একটা শক্ ।
তিনি লিখছেন :-
“পেটের দায়ে লিখছি মশাই, পেটের দায়ে! বাংলা কথা,স্বেচ্ছায় না লেখার কারণ-
আমার লিখতে ভালো লাগে না। আমি লিখে আনন্দ পাই নে। এমন কোনো গভীর, গূঢ় সত্য জানি নে যা না বললে বঙ্গভূমি কোনো এক মহা বৈভব থেকে বঞ্চিত হবেন না।
আমি সোশাল রিফর্মার বা প্রফেট নই যে দেশের উন্নতির জন্য বই লিখব।
খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক্ লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কিনা, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোল্ড ব্লাডেড, যে রকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয়- অর্থাৎ আত্মীয়- স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কিনা?-শবনমের সঙ্গে আবার দেখা হলো কিনা, “চাচা”টি কে, আমি আমার বৌকে ডরাই কিনা- ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মত খাটাশ টাকেও একনজর দেখে নিতে চান! কারণ কোলকাতার ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতিমধ্যে আর কি করা যায়। এবং এসে রীতিমত হতাশ হন। ভেবেছিলেন দেখবেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মত সৌম্যদর্শন নাতি বৃদ্ধ এক ভদ্রজন লীলাকমল হাতে নিয়ে সুদূর মেঘের পানে তাকিয়ে আছেন; দেখেন বাঁদিপোতার গামছা পরা, উত্তমার্ধ অনাবৃত, বক্ষে ভাল্লুকের মত লোম, মাথাজোড়া টাক- ঘনকৃষ্ণ ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া রঙ, সাতদিন খেউরি হয় নি বলে মুখটি কদমফুল, হাতল ভাঙ্গা পেয়ালায় করে চা খাচ্ছে আর বিড়ি ফুঁকছে!!!!!!”
এটা পড়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম !! আমার লেখার ইচ্ছে ছিল না, লিখবো বলে ভাবিও নি । সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো এসে সব গরমণ্ডালাইজড্ হয়ে গেল ।
পড়াশোনা শেষ করে, আবার শেখা !! লাও ঠ্যালা ! প্রথমে কম্পু, তারপর টাইপ ! আরও সব বখেরা আছে ।
আমার যে কম্পু মাষ্টার মশাই ছিলেন, তিনি আমার ছেলেকে বলেছিলেন – ইনি আপনার বাবা ?
ছেলে উত্তর দিয়েছিল – কোই শক্ ? (এখানে – শক্ বলতে সন্দেহ, কিন্তু মাস্টারমশাই ছেলেটি, এই হিন্দি শব্দটার মানে ইংরেজিতে বুঝেছিল) ।
শক্ তো বটেই, মানে- উনি এই সোনার মাথাটা কোত্থেকে পেয়েছিলেন, সেটা জানলে পরের বারে স্টুডেন্ট নেবার সময় সাবধান হব- এই আর কি !
ছেলের সেই হাড় পিত্তি জ্বালানো হাসি দেখে, আমার গিন্নির সে কি ধেই ধেই নেত্য! উনি বারবার অভিশাপ দ্যান নিজের বাবাকে, কেন তিনি ভালো করে দেখেশুনে বিয়েটা দ্যান নি ! এই অভিযোগটা বরাবরই ছিল, পরিপূর্ণতা পেল কম্পু মাস্টারমশাইয়ের অভিযোগে !
সাতমণ তেল পুড়িয়ে কোনো রকমে কম্পু তো শিখলাম । এবারে প্রথমে একটা সাইটের সদস্য হলাম । প্রথমে, কেউ বন্ধু হতে চায় না ! অজানা অচেনা লোককে কেনই বা বন্ধু করবে ?
দু তিনটি বন্ধু হলো অবশেষে ! তাদের সঙ্গে বাতচিত করতে গিয়ে দুকলম লিখতেই হতো । তেনারা মুগ্ধ হতেন ।
পরে জানলাম আমার পাণ্ডিত্যপূর্ণ আকাট মূর্খতায় তারা আল্হাদে ডগমগ ।বিপরীতা লঙ্কার বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ আকাট মূর্খতা – এই শব্দ বন্ধকে নাকি ইংরেজিতে বলে অক্সিমোরোন ! পণ্ডিতের আবার মূর্খতা ? প্রশ্ন করেছিলাম এক বিদগ্ধ জনকে । তিনি আবার সংস্কৃতে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের একটা বাণী শুনিয়ে দিলেন ।
“পণ্ডিতে চ গুণাঃ সর্বে, মূর্খে দোষা হি কেবলম্” ।
পণ্ডিতদের নাকি সবই গুণ, দোষেদের মধ্যে তারা মূর্খ ।
আরও এক বন্ধু, আমার স্ক্র্যাপ পড়ে মতামত দিলেন -দাদাঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:- আপনার প্রেসের নাম “পণ্ডিত প্রেস” কেন?
উত্তরে তিনি সহাস্যে বলেছিলেন:- ,"হবে নাই বা কেন? বস্তু যখন খণ্ড খণ্ড হয় তখন তাকে বলি খণ্ডিত। আমি যেখানেই যাই সব কাজ করি পণ্ড, তাই আমি পণ্ডিত ,এই জন্য“পণ্ডিত প্রেস” ।"
রামকেষ্টো দাদাঠাকুরের মত সত্যিকারের পণ্ডিত মোটেই নন, তবে খণ্ডিত । এই ভদ্রলোকের লেখা পড়লে, সব কাজ পণ্ড এবং বাবা মায়ের কষ্টার্জিত পয়সা খরচ করে যে লেখাপড়া শিখেছি, সব ভুলে যাব ।
এদিকে প্রায়ই ভুল করি বিভিন্ন সাংসারিক কাজে । সেই সব কিছু লিপিবদ্ধ করবো ভাবলাম । ডায়েরী লেখার মত । কিছু লিখলামও । এইবারে কিছু প্রাণের বন্ধু ফোনিয়ে সেগুলো গিন্নীকে জানিয়ে দিলেন ।
মনে হল :- সংসার ছেড়ে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবো ! প্রকৃত বন্ধুর কাজ করেছে বলে , জনে জনে গিন্নি সকলকে জানাতে লাগলেন । এতদিন যাদের দুর্নাম করতেন যে মহিলা, তারাই হলেন দেবদূত । আমি ভূতের পুত রয়েই গেলাম ।
কাউকে বোঝাতে পারি না, আমি লিখলে কি লিখতাম ? কিছু ভারী শব্দ দিয়ে ছন্দ হীন কবিতা ? না কি, নিজে যেটা কোনোদিনই করি নি, সেই সব “কর্তব্য” নিয়ে গুরুগম্ভীর একটা লেখা ?
কারও বাড়ীতে গরমের দিনে জল চাইলে, জলটা কতখানি ঠাণ্ডা চাই, সেই ব্যাপারে জানতে চেয়ে, সগর্ব উক্তি ফ্রিজ লেটেষ্ট মডেলের আর জলও ঠাণ্ডা হয় তাড়াতাড়ি ।
রান্নাটা যে সূক্ষ্ম তরঙ্গে চট জলদি হয়, সেই অযাচিত জ্ঞানলাভও হয় । আমার এইসব জ্ঞান নেই । সেগুলো ধার করে লেখা আমার উচিত নয় সেটাও বুঝি ।
চৌর্য পুরাণে নাকি লেখা আছে- চুরী বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড় ধরা ।
আরও একজন বুদ্ধি দিলেন – চুরী করার সহজ উপায় হলো, গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখা । গুগুল মামা আছে, লাগাও কপি + পেষ্ট ।
শেষ কথা :- অনেকে অনেক কিছু জানে, কিন্তু কারও একটুও গর্ব নেই । আর আমি অনেক কিছু জানি না , তার জন্য একটুও লজ্জা নেই ।
আজকাল, তাই ঠিক করেছি বেশরম হয়ে মনের আনন্দে সব বিষয়েই লিখবো । ঘনাদার কলম চলছে । না লিখলে হয় ? লিখবোই তো ! কানকাটার আবার লজ্জা কি?
শুধু, দয়া করে পড়বেন না ।
পাঁচ সিকে দাম ছিল সেই ঝর্ণা কলমের । একটা ইঞ্জিরি নামও ছিল সেটার । রাইটারস্ । মাতামহ কিনে দিয়ে বলেছিলেন- এটা তোকে দিলাম । মেড ইন জাপান ! পরীক্ষায় ভালো করে লিখতে পারবি তুই এই কলমে ।
ছোট মামা ফুট কাটলো-আঙ্গো লিখতে পুঙ্গ ফাটে, সে আবার লিখবে ? তাও আবার পরীক্ষার খাতায় ? ও যদি লিখতে পারে, তবে আমার হাতের তালুতে চুল গজাবে ।
কলিকালেও কারও যে শপথ করা যে সত্যি হয়, সেটা যাচাই করতে বিশ্বনিন্দুকেরা এসে দেখে যেতে পারেন আমার অধুনা বৃদ্ধ ছোটমামাকে । হাতের তালুর চুল, রেগুলার সেলুনে গিয়ে সাইজ করে আসেন । কারণ, সেই পরীক্ষায় হঠাৎ করে আম্মো পাশ করে গেছিলাম।
তখনও, আমি আলী সাহেবের লেখা পড়ি নি ! আমার ধারণা ছিল, গল্পের বই পড়লেও সেটা লেখা পড়ার মধ্যে পড়ে । তাই মৎস্য মারিব, খাইবো সুখের ধারণাটা আমার মনে গভীর ভাবে পোঁতা হয়ে গেছিল, একেবারে শিলা ন্যাসের মত । পড়াশোনা করা ধাতেই ছিল না ।
আমার এই হাল দেখে, সেজ মামা বঙ্কিম থেকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন:-
“ছাত্র জীবন হইত বড় সুখের জীবন
যদি না থাকিত এগ-জামি-নেশন!”
আমার মোটা মাথায় বোঝার কথা নয়, বুঝিও নি । তবে সেজ মামা যখন আলী সাহেবের রেফারেন্স দিলেন, তখন বুকে বল- ভরসা এলো ।
পরীক্ষার খাতাতে মুজতবা সাহেব নাকি এ্যায়সা আ্যানসার ঝেড়েছিলেন, যে পরীক্ষকেরা বলেছিলেন-
-এনকোর! ( ফিরসে বা রিপিট) আর সেই ক্লাসে তাঁকে আবার রেখে দিতেন। পরের বছর পর্যন্ত পরীক্ষকেরা অপেক্ষা করতেন, কখন আবার এইরকম উত্তর মুজতবা সাহেব লিখবেন। ( এটা মুজতবা সাহেব নিজেই লিখে গেছেন)
এনকোর ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বললে বোধহয় ভালো হয়। আগেকার দিনে,যাত্রা থিয়েটারে কোন সিন ভালো লাগলে, দর্শকেরা বলতেন--এনকোর! (ইংরেজি শব্দ) আর কুশীলবেরা সেই দৃশ্যটি আবার অভিনয় করতেন!
এ দিক দিয়ে আমার পরীক্ষকেরা আমাকে এনকোর না বললেও, ফার্স্ট কল বা থার্ড কলেও আমাকে পাশ করাতেন না! ফলং- প্রহারং। আবার দাদু গিয়ে বণ্ড দিয়ে আমাকে ওপরের ক্লাসে ওঠাতেন।
পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার জন্য একবার ইতিহাসের পাতায় আমার এক তালেবর গুরুর নকল করে ইঞ্জিরিতে লিখেও এসেছিলাম :-
বাবর ওয়াজ এ গ্রেট এম্পপেরর্। হি ফ্যাটাচুলেটেড্ আ্যণ্ড ল্যাটাচুলেটেড্। হি অলসো পারপেনডিকুলারলি গরমরালাইজড্ এভরিথিং!
এহেন আমি পাশ টাস দিয়ে ( বাবা বলেছিলেন- বোর্ড আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে কেস করবেন, আমাকে পাশ করানোর জন্য, তবে হিতৈষীদের অনুরোধে গজগজ করে থেমে গিয়ে আর সেই সুকর্মটি ভাগ্যিস করেন নি ) উমেদারি করে একটা বেচুবাবুর চাকরী করার সুযোগ পেয়েছিলাম । কালচারাল শক হয়েছিল- আমার পরিবারের সকলের, তবে ব্যাপারটা আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল তাঁদের ।
কালের নিয়মে অবসর নিতেই হলো দু হাজার তিন সালে । মনে প্রথমেই সাধ জাগলো আমার, আলী সাহেব পড়তে । প্রথমেই একটা শক্ ।
তিনি লিখছেন :-
“পেটের দায়ে লিখছি মশাই, পেটের দায়ে! বাংলা কথা,স্বেচ্ছায় না লেখার কারণ-
আমার লিখতে ভালো লাগে না। আমি লিখে আনন্দ পাই নে। এমন কোনো গভীর, গূঢ় সত্য জানি নে যা না বললে বঙ্গভূমি কোনো এক মহা বৈভব থেকে বঞ্চিত হবেন না।
আমি সোশাল রিফর্মার বা প্রফেট নই যে দেশের উন্নতির জন্য বই লিখব।
খ্যাতিতে আমার লোভ নেই। যেটুকু হয়েছে, সেইটেই প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নাহক্ লোকে চিঠি লিখে জানতে চায়, আমি বিয়ে করেছি কিনা, করে থাকলে সেটা প্রেমে পড়ে না কোল্ড ব্লাডেড, যে রকম কোল্ড ব্লাডেড খুন হয়- অর্থাৎ আত্মীয়- স্বজন ঠিক করে দিয়েছিলেন কিনা?-শবনমের সঙ্গে আবার দেখা হলো কিনা, “চাচা”টি কে, আমি আমার বৌকে ডরাই কিনা- ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং কেউ কেউ আসেন আমাকে দেখতে। এখানকার বাঘ সিঙ্গি নন্দলাল, সুধীরঞ্জনকে দেখার পর আমার মত খাটাশ টাকেও একনজর দেখে নিতে চান! কারণ কোলকাতার ফেরার ট্রেন সেই বিকেল পাঁচটায়; ইতিমধ্যে আর কি করা যায়। এবং এসে রীতিমত হতাশ হন। ভেবেছিলেন দেখবেন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মত সৌম্যদর্শন নাতি বৃদ্ধ এক ভদ্রজন লীলাকমল হাতে নিয়ে সুদূর মেঘের পানে তাকিয়ে আছেন; দেখেন বাঁদিপোতার গামছা পরা, উত্তমার্ধ অনাবৃত, বক্ষে ভাল্লুকের মত লোম, মাথাজোড়া টাক- ঘনকৃষ্ণ ছ্যাবড়া ছ্যাবড়া রঙ, সাতদিন খেউরি হয় নি বলে মুখটি কদমফুল, হাতল ভাঙ্গা পেয়ালায় করে চা খাচ্ছে আর বিড়ি ফুঁকছে!!!!!!”
এটা পড়ে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম !! আমার লেখার ইচ্ছে ছিল না, লিখবো বলে ভাবিও নি । সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো এসে সব গরমণ্ডালাইজড্ হয়ে গেল ।
পড়াশোনা শেষ করে, আবার শেখা !! লাও ঠ্যালা ! প্রথমে কম্পু, তারপর টাইপ ! আরও সব বখেরা আছে ।
আমার যে কম্পু মাষ্টার মশাই ছিলেন, তিনি আমার ছেলেকে বলেছিলেন – ইনি আপনার বাবা ?
ছেলে উত্তর দিয়েছিল – কোই শক্ ? (এখানে – শক্ বলতে সন্দেহ, কিন্তু মাস্টারমশাই ছেলেটি, এই হিন্দি শব্দটার মানে ইংরেজিতে বুঝেছিল) ।
শক্ তো বটেই, মানে- উনি এই সোনার মাথাটা কোত্থেকে পেয়েছিলেন, সেটা জানলে পরের বারে স্টুডেন্ট নেবার সময় সাবধান হব- এই আর কি !
ছেলের সেই হাড় পিত্তি জ্বালানো হাসি দেখে, আমার গিন্নির সে কি ধেই ধেই নেত্য! উনি বারবার অভিশাপ দ্যান নিজের বাবাকে, কেন তিনি ভালো করে দেখেশুনে বিয়েটা দ্যান নি ! এই অভিযোগটা বরাবরই ছিল, পরিপূর্ণতা পেল কম্পু মাস্টারমশাইয়ের অভিযোগে !
সাতমণ তেল পুড়িয়ে কোনো রকমে কম্পু তো শিখলাম । এবারে প্রথমে একটা সাইটের সদস্য হলাম । প্রথমে, কেউ বন্ধু হতে চায় না ! অজানা অচেনা লোককে কেনই বা বন্ধু করবে ?
দু তিনটি বন্ধু হলো অবশেষে ! তাদের সঙ্গে বাতচিত করতে গিয়ে দুকলম লিখতেই হতো । তেনারা মুগ্ধ হতেন ।
পরে জানলাম আমার পাণ্ডিত্যপূর্ণ আকাট মূর্খতায় তারা আল্হাদে ডগমগ ।বিপরীতা লঙ্কার বা পাণ্ডিত্যপূর্ণ আকাট মূর্খতা – এই শব্দ বন্ধকে নাকি ইংরেজিতে বলে অক্সিমোরোন ! পণ্ডিতের আবার মূর্খতা ? প্রশ্ন করেছিলাম এক বিদগ্ধ জনকে । তিনি আবার সংস্কৃতে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের একটা বাণী শুনিয়ে দিলেন ।
“পণ্ডিতে চ গুণাঃ সর্বে, মূর্খে দোষা হি কেবলম্” ।
পণ্ডিতদের নাকি সবই গুণ, দোষেদের মধ্যে তারা মূর্খ ।
আরও এক বন্ধু, আমার স্ক্র্যাপ পড়ে মতামত দিলেন -দাদাঠাকুরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:- আপনার প্রেসের নাম “পণ্ডিত প্রেস” কেন?
উত্তরে তিনি সহাস্যে বলেছিলেন:- ,"হবে নাই বা কেন? বস্তু যখন খণ্ড খণ্ড হয় তখন তাকে বলি খণ্ডিত। আমি যেখানেই যাই সব কাজ করি পণ্ড, তাই আমি পণ্ডিত ,এই জন্য“পণ্ডিত প্রেস” ।"
রামকেষ্টো দাদাঠাকুরের মত সত্যিকারের পণ্ডিত মোটেই নন, তবে খণ্ডিত । এই ভদ্রলোকের লেখা পড়লে, সব কাজ পণ্ড এবং বাবা মায়ের কষ্টার্জিত পয়সা খরচ করে যে লেখাপড়া শিখেছি, সব ভুলে যাব ।
এদিকে প্রায়ই ভুল করি বিভিন্ন সাংসারিক কাজে । সেই সব কিছু লিপিবদ্ধ করবো ভাবলাম । ডায়েরী লেখার মত । কিছু লিখলামও । এইবারে কিছু প্রাণের বন্ধু ফোনিয়ে সেগুলো গিন্নীকে জানিয়ে দিলেন ।
মনে হল :- সংসার ছেড়ে যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাবো ! প্রকৃত বন্ধুর কাজ করেছে বলে , জনে জনে গিন্নি সকলকে জানাতে লাগলেন । এতদিন যাদের দুর্নাম করতেন যে মহিলা, তারাই হলেন দেবদূত । আমি ভূতের পুত রয়েই গেলাম ।
কাউকে বোঝাতে পারি না, আমি লিখলে কি লিখতাম ? কিছু ভারী শব্দ দিয়ে ছন্দ হীন কবিতা ? না কি, নিজে যেটা কোনোদিনই করি নি, সেই সব “কর্তব্য” নিয়ে গুরুগম্ভীর একটা লেখা ?
কারও বাড়ীতে গরমের দিনে জল চাইলে, জলটা কতখানি ঠাণ্ডা চাই, সেই ব্যাপারে জানতে চেয়ে, সগর্ব উক্তি ফ্রিজ লেটেষ্ট মডেলের আর জলও ঠাণ্ডা হয় তাড়াতাড়ি ।
রান্নাটা যে সূক্ষ্ম তরঙ্গে চট জলদি হয়, সেই অযাচিত জ্ঞানলাভও হয় । আমার এইসব জ্ঞান নেই । সেগুলো ধার করে লেখা আমার উচিত নয় সেটাও বুঝি ।
চৌর্য পুরাণে নাকি লেখা আছে- চুরী বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড় ধরা ।
আরও একজন বুদ্ধি দিলেন – চুরী করার সহজ উপায় হলো, গবেষণা মূলক প্রবন্ধ লেখা । গুগুল মামা আছে, লাগাও কপি + পেষ্ট ।
শেষ কথা :- অনেকে অনেক কিছু জানে, কিন্তু কারও একটুও গর্ব নেই । আর আমি অনেক কিছু জানি না , তার জন্য একটুও লজ্জা নেই ।
আজকাল, তাই ঠিক করেছি বেশরম হয়ে মনের আনন্দে সব বিষয়েই লিখবো । ঘনাদার কলম চলছে । না লিখলে হয় ? লিখবোই তো ! কানকাটার আবার লজ্জা কি?
শুধু, দয়া করে পড়বেন না ।
4 comments:
thakur is anobodyo .. ali saheber i ashibbad ..
অনবদ্য
Bah
eta bes mojadar...
Pando kori bole amio Pondi-to...
বেশ ভালো লেগেছে লেখাটা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন