মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

ছোটগল্প – শুভেন্দু ধারা

স্কন্ধ কাটা কনিষ্ক
শুভেন্দু ধারা



( ১ )

অনেক খানি পথ । রাস্তার দুধারে হেমন্তের সবুজ ধানে বাঁধ ভেঙ্গেছে বাতাস, আর কানে রঙ্গন দা। - দ্যাখ অমিত , এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। আমাদের একটা কিছু করা দরকার ।

যেমন কী করা দরকার বলে তোমার মনে হয়? আমার কিন্তু তেমন কিছু করতে ইচ্ছে যাচ্ছে না, আফটার আল এটা তো শহর নয়, এটা গ্রাম। এখানে ওইসব বললে কিসসু হবে না দাদা ।

হবে । আরে , হোক না হোক, চেষ্টাটা তো করতে পারি । করতে পারি নয়, করা উচিত আমাদের

উচিত । কত কিছু উচিত ছিল গাছের পাতায় পাতায় । একটুও ঝড় সইতে না পারা গ্লানি নিয়ে গাছটা অনুচিত হয়েছে কখন তা জানাও যায় না । পেছন ফিরে দেখা যায় তেমন গাছের সারি সারি স্থাপনা দু পথের ধারে । এই যে প্রতুল দা , তারও কি ওটা উচিত ছিল? কি হত যদি এই দিনটা না হত ? এই পুতুল মত একটি বউ আর ঐ পুতুল খেলোয়াড় নয় বছরের শানু নামের দু টা ক্যারেক্টার যদি না লিখত আত্মজীবনীতে ? কি হত? কিছুই হত না। তেমন টা হয়নি । আসলে নিজেও জানত না তো সে , এভাবে তো এখনও এই ধূলি কিংবা লাল সুরকি তে এত কিছু ভাবনা আসেনি। কে আর দেখতে পাচ্ছে চিলে কোঠায় ঘুণ ধরেছে কতটুকু ।

তা তো বুঝলাম দাদা। কিভাবে কি করবে একটু বলবে ? না কি হাওয়ায় ভাসবে ? নিজের মানসিক তুষ্টি চেয়ে কিছু করবে? না কি ফল দায়ক কিছু করবে যাতে সর্বনিম্ন প্রাপ্তি হিসেবে অন্তত যেন বাচ্চাটার স্কুল যাওয়া নিশ্চিত হয় । সাথে এটাও জেনে রেখ কিন্তু রঙ্গন দা, ভেবনা সব সহজে হয়ে যাবে। পথে কাঁটায় পা রক্তপাত হবেই, আর তার দায় পুরোটা বর্তাবে তোমার উপর , কেননা তুমিই এই ক্লাবের লিডার ।

সে যা হবার হবে, দেখা যাবে পরে। এত গুলো ছেলে আছি আমরা । আমাদের ভয় কি সে ওদের?

ভয় অন্য কিছু নয় । দেখবে শেষে ঝামেলা পাকবে খুব । আর তা গড়াবে শেষ মেশ আমাদের প্রত্যেকের ঘর পর্যন্ত । সেটার জন্য তৈরি আছো তো ?

সাইকেলটা এদিক ওদিক ঘুরে চলছে দিবাকর সামন্ত’র বাড়ি । পঞ্চায়েত সদস্য। সেকালের ম্যাট্রিক পাশ, অতএব অশিক্ষিত বলা যাবে না। তার উপর জন দরদি আভভাব টুকু রাজনীতির প্রথম বর্ণ পরিচয় হিসেবে নিয়েছিলেন বলে আজ নির্বাচিত মেম্বার । কতটুকু কি করেছেন মানুষের জন্য সে প্রশ্নে অমিতের তেমন কিছু যায় আসে না , সে এসেছে অন্য কিছু প্রশ্ন নিয়ে এবং এই কাজটা রঙ্গনদা তাকেই দিয়েছে শেষে । অন্য কাউকে দিলে দেতে পারত । যেমন তুষার , কথা বার্তায় তুখোড় যাকে বলে , কাজটা ওকে দিলেই ভালো হত , কিন্তু কেন যে তাকে দিল ! আসলে অমিতের একটা গুড বয় ইমেজ আছে গ্রামে । হায়ার সেকেন্ডারিতে গ্রামের প্রথম ছেলে যে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণই হয়েছিল । যদি ভাল ছেলে বলে ওর কথা মেনে নেয় সবাই । আফটার অল রেজাল্ট দরকার ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল দিবাকর সামন্ত’র বাড়ীর সামনে । সাইকেল টা থামল যথা রীতি । তার পর অমিত এগিয়ে গেল দরজার দিকে । দরজা খুলে দাঁড়াল সীমা । সীমা চেনে অমিত কে কিংবা অমিত ও চিনে তাকে । কোনও এক বিকেলে তাদের এই চেনা শুনা যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিল , কিন্তু বিকেলের উজ্জ্বলতা আর কতক্ষণ স্থায়ী হয় !

তুমি? তুমি কেন বাড়িতে এসেছ !

অমিতের রাগ হচ্ছে খুব । বলতে ইচ্ছে করছে - তোর জন্যে তোর জন্যে এসেছি । যেন ঘরে কেউ যুবক ছেলে আসতে পারে না, যুবক ছেলে মানেই যেন জেলে , আর ওরা সব নিজেকে রূপালি মাছ ভাবে যেন এই ধরতে এল কেউ !

তোর বাবা কোথায় ? থাকে তো বল গিয়ে আমি একটু দেখা করতে এসেছি ।

বেঞ্চে বসেছে সে দুয়ারের খোলা মেলায় । সামনে রাস্তা , রাস্তার পাড়ে পুকুর । পুকুরের এক পাড়ে প্রতুল দার ঘর । এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মোড়ের টিউব ওয়েলটাও । দুদিকে দু টা নিদর্শন দিবাকর বাবুদের কাজের । বসে বসে দেখছিল অমিত । দিবাকর বাবু এসে পাশে বসেছেন , বললেন ,

বলো অমিত, কি খবর । কি দরকার পড়ল যে এখানে আসতে হল। ভালো আছো তো ? আর তোমার পড়াশুনা ?

সব ঠিক ঠাক চলছে । আসলে আপনার সাথে একটা দরকার ছিল । সেটার জন্যই এসেছিলাম আমি ।

সে ঠিক আছে । তার আগে কি খাবে বল ? চা ? খাবে?

উত্তরের অপেক্ষা করল না । হাঁক দিয়ে চা করতে বললেন তিনি । অমিত কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না , অযথা দেরি করে লাভ নেই তার -

কাকু, আমি প্রতুল দার বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছিলাম। এভাবে ওকে এক ঘরে করে রাখার মানে কি? কিংবা শানুকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার মানে কি? যত দূর জানি ও তো আপনার পার্টির লোক । নিজের দলের লোক খুন করলেও আপনারা আশ্রয় দেন তো , ঘড়ি টা তো তাই বলে । আর প্রতুল দা তো কাউকে খুন করেনি।

কিছুটা অবাক হলেন দিবাকর সামন্ত । এই ছেলেটা যে তার কাছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছে , সেটা কিছুটা হলেও অপছন্দ লাগল তার । লাগারই কথা । দু দিনের যোগী যদি ভাত কে অন্ন বলে গোসা হবে না তো কি? এই পুটকে ছেলে , দ্যাখো, যেন সব জেনে বসে আছে । হাতে একটা মোবাইল নিয়ে ভাবে সব হাতের মুঠোয় ।

দিবাকর বাবুকে এভাবেই ধীরে ধীরে বয়সের ভার পেয়ে বসছিল কিছুক্ষণ । কিন্তু নানা যুক্তি দিয়ে , পুরো পাতা খুলে যখন অমিত দেখাল যে এটা ছোঁয়াচে রোগ নয় কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কিছু নয় , তখন যেন কিছুটা যুদ্ধ হারা রাজা । ততক্ষণে চা এসে গেছে , চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনি বলছেন – সবি বুঝি অমিত , কিন্তু আমি একা কি করব বল? তুমি বরঞ্চ প্রশান্ত বাবুর কাছে যাও ।

পরিচয়ে হাই স্কুলের টিচার প্রশান্ত বাবু । পাশের গ্রামে চাকরী করেন । অমিত তার কাছে গেল , প্রাপ্তি নতুন কিছু নয় , সেই – সবি বুঝলাম , কিন্তু ... তুমি বরঞ্চ গোকুল বাবুর কাছে যাও। গোকুল বাবুর কাছে গেল সে , তিনিও বুঝদার লোক, অতএব ফল সেই একি রইল , নতুন কিছুই নয় । তিনি যেতে বললেন পার্থ বাবুর কাছে ।

পার্থ বাবু প্রাইমারি স্কুলের টিচার । অমিতের সাইকেল থামল একে বারে স্কুল মাঠে এসে । এই স্কুলেই সে পড়েছে । তখন বিল্ডিংটা মাটির ছিল, এখন নতুন পাকা বিল্ডিং । চারিদিকে কচি কচি শালিকের কিচির মিচির , এদের সাথেই একসময় শানুকেও দেখা যেত । কিন্তু আজ নেই সে , কেন? সেইটাই জানতে চায় অমিতেরা । স্কুল অফিসে ঢুকল সে, সামনে নতুন প্রধান শিক্ষক । পার্থ বাবু এই স্কুলে গত চার বছর এসেছেন । তবুও অমিত কে সে চেনে । কারণ ওই যে, ভালো ছেলের তমকা। কিংবা গ্রামের প্রথম ছেলে যে হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে । বিনয়ের সাথে সে বলল –

স্যার, আপনার সাথে শানুর বিষয় টা নিয়ে কথা বলতে চাই একটু, যদি একটু সময় দেন ।

কোন শানু অমিতে ?

কিছু লিখছিলেন। কলম থামিয়ে তাকাল অমিতের দিকে।

প্রতুল দার ছেলে , যাকে আপনি স্কুল থেকে ......

ও হ্যাঁ, বলো কি বলবে ।

স্যার, বলছিলাম কি , আপনি তো সবি বোঝেন। তাহলে কেন ওকে স্কুল থেকে বের করে দিলেন? রোগটা তো তার বাবার হয়েছে। তার তো হয়নি । তবে কেন মিছি মিছি ...

পার্থ বাবু কি যেন ভাবলেন গম্ভীর ভাবে । তার পর বললেন ,

তুমি জান না, এটা আমার সিদ্ধান্ত নয় । তোমাদের গ্রামের লোকেরাই এটা করেছে । আমি শুধু মেনেছি মাত্র ।

আপনি নাও মানতে পারতেন চাইলে !

তাতে লাভ হতনা কিছুই , ওরা বলেছিল, যদি শানু স্কুলে আসে, তাহলে ওরা ওদের বাচ্চাদের আর স্কুলে পাঠাবে না । একটি ছেলের জন্য এত গুলো ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে মন চায়নি আমার। তুমি এটাকে দোষ বললে বলতে পারো। কিন্তু এছাড়া আমার কাছে তেমন কোনও উপায় ছিল না। তুমি বরঞ্চ সহ দেব বাবুর কাছে যাও, ওরা রাজি থাকলে তোমাদের মত আমিও খুব খুশি হব, এইটুকু বিশ্বাস রাখতে পারো ।


( ২ )

হাঁপিয়ে গেছে , মাথার ভেতর এক রাশ ক্রোধ হতাশা ডামাডোল পাকাচ্ছে কিছু সময় ধরে। কেউ একবারও বলেনি যে- বুঝলাম না , শুধু শেষে জুড়ে দিয়েছে একটা ‘কিন্তু’, ছোট্ট ‘কিন্তু’ টা কি ব্যাপক ভাবে আটকে দিচ্ছে যা কিছু সম্ভাব্য ছিল । দিবাকর বাবু বলেন প্রশান্ত বাবুর কাছে যাও। প্রশান্ত বাবু বললেন গোকুল বাবুর কাছে যাও, গোকুল বাবু বললেন তুমি পার্থ বাবুর কাছে যাও । প্রত্যেকেই একক ভাবে বুঝছে , বলছে , আমি মেনে নিচ্ছি , সমাজ কি মানবে ! আরে ! সবাই মেনে নেওয়ার পরও সমাজ কে? কোথা থেকে আসছে ? অমিত আজ বুঝল, সমাজ টমাজ আর কিছু নয় ,স্কন্ধ কাটা কনিষ্কের আর এক নাম সমাজ রাখা যেতে পারে ।

যাই হোক, তবুও হার না মানা এই সব সাত পাঁচ পঁইত্রিশ করতে করতে অমিত এল সহদেব মান্নার বাড়ি ,গত অভিজ্ঞতা বলেছে সাত পাঁচ দুই , সেখান থেকে দেখলে কিছু লাভ হবে বলে মনে হল না তার , বাস্তবে লাভ কিছু হলও না । উলটে অমিত কে একটা উলটো কথা শুনতে হল।

তোমাকে আমরা ভালো ছেলে বলেই জানি। তুমি শুধু শুধু ওই রঙ্গনের পাল্লায় পড়ে এসব নোংরা বিষয়ে মাথা না ঘামালেই পারো

কেন জেঠু , মন্দ হয়ে যাব তাতে ? তাই হলাম না হয় কিন্তু প্রতুল দা কে রেহাই দিন ।

গ্রামের মোড়ল ইনি । ইনিই সভা করে নিদান দিয়েছিলেন প্রতুল দাকে , সাথে বলেছিলেন - এরা নষ্ট হয়ে গেছে , এদের সাথে নিয়ে চললে সবাই একদিন নষ্ট হয়ে যাবে । অতএব আজ থেকে প্রতুল একঘরা হয়ে থাকবে । কারো অমান্য করার কিছু ছিল না । কিছুটা পরম্পরা মোতাবেক কোনও বিপরীত আওয়াজ ওঠেনি সেদিন । তার একটা অন্য কারণ ও আছে। পয়সার অভাব ছিল না এনার কোনও কালে । জমি জাগা প্রচুর। তাই বয়সে চাকরী বাকরি করেন নি । চাষ বাস নিয়ে থেকেছেন । আর মানুষের প্রয়োজনে , অসুবিধায় ছুটে গেছেন সবার আগে ।

গ্রাম জুড়ে একটা আধিপত্য বিস্তার করেছেন , শুধু কেন যে ইনি রাজনীতি টা করলেন না, সেটা অনেকের মতো অমিতও জানে না , তবে এটা জানত ইনিই শেষ গুটি । এর পর আর কোথাও যেতে হবে না। হয়ত ইনি বড়জোর দিবাকর সামন্তের কাছে যেতে বলবে । কিন্তু সেটা এখনও বলেনি, যা কিছু বোঝাতে চেয়ে বলেছে এতক্ষণ , তার সব কিছু সে শুনেছে । বুঝেছি বলেনি, উপর নিচে ঘাড় নেড়ে শেষে বলেছেন -

তোমার বাবা জানে? তুমি এইসব যে করছ?

না, জানে না। জানলেই বা কি ? আমি কিংবা আমরা কি ভুল কিছু বলছি ?

হয়ত তাই । আবার সাইকেলে চড়ে বসল সে । আর কোথাও যাবে না সে । একবার প্রতুল দার বাড়ি যেতে হবে । যেতে যেতে লক্ষ করল সে দিবাকর বাবু তার বাড়ির দুয়ারে বসে। সে দেখল শুধু দিবাকর বাবু নয় , আরও অনেকে তাকে লক্ষ করছে অদ্ভুত ভাবে । করুক, এতে তার কিছু এসে যায় না। কাল থেকে শুধু মন্দ ছেলে বলবে তো ! বলুক । যত খুশি বলুক , তাইবলে আর এই সব মেনে নেওয়া যাবে না । সাত দিন হল প্রতুল দা কে মিটিং করে গ্রাম সভা একঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে । কারো সাথে কোনও যোগাযোগ রাখা বারণ তার । বারণ আছে মোড়ের টিউব ওয়েল টা ব্যাবহারেও । বারণ আছে প্রতিবেশী দের বাড়িতে যাওয়া কিংবা কোনও প্রতিবেশীর তার বাড়িতে যাওয়া । এমন কি ছোট্ট শানুর স্কুল যাওয়াও বন্ধ ।

সাইকেল টা প্রতুলের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই সানুকে দেখা গেল বাইরে একটা বল নিয়ে খেলছে একা । আরও দুটি ছেলে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে কিন্তু খেলছে না ওর সাথে । অমিত দেখল, শানু ডাকছে তাদের কে

আয় না, খেলি একটু ।

যেন ডাক নয়, কাতর এক আবেদন । কিন্তু তা বোঝবার মত বয়স দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা দুটোর নেই। হয়ত ছিল , কিন্তু অপারেশন করে সে জায়গায় বিষ ভরে দিয়েছে কেউ বা কারা , তা বিলক্ষন জানে অমিত । তবু দেখা গেল দুজনের এক জন আসছিল এগিয়ে । আর একজন ঠিক তখনি তার হাতটা ধরে টেনে ধরেছে । বলছে

না, যাবি না ভাই, বাবা মারবে জানলে পরে ।

শানু শুনতে পায় সে কথা। কি বুঝল জানে না অমিত, শুধু দেখল বাচ্চাটা সজোরে একটা লাথি মারল ফুটবল টায় , যেন বলে নয়, অন্য কিছুকে লাথি মারতে চাইছে । লক্ষ করল সে , কি রকম একটা রাগ ফুটে উঠছে শানুর মুখ জুড়ে , তাকে দেখে কিছুটা যেন শান্ত হল সে । কিন্তু অন্যান্য দিনের মত কাকু কাকু বলে ছুটে এল না ত ছেলে টা ! এগিয়ে যায় অমিত , তাকে এগিয়ে আসতে দেখেই শানু এক ছুটে ঘরের ভেতরে পালিয়ে গেল এবং আবার ফিরে এল মায়ের হাত ধরে । রানু বৌদি খুব খুশি হল অমিত কে দেখে , গত সাত দিনে এই প্রথম কেউ তাদের বাড়িতে এসেছে , কেউই ঘৃণায় কিংবা সমাজের ভয়ে এপথ মাড়ায় নি ।

অমিতকে ভেতরে যেতে বলে সে, কিন্তু হঠাত মাথায় জিদ চেপে যায় অমিতের । না, সে এখানেই বসবে , এই বাইরেই , যাতে সবাই দেখতে পায় তাকে । রানু বৌদি মানা করে করে শেষে হেরে গিয়ে প্রতুল কে ডেকে আনে বাইরে । প্রতুল এই ছেলে গুলোকে চেনে ভাল করেই , তাই কথা না বাড়িয়ে সে পাশে এসে বসল । তারপর বলল – তোর এখানে আসতে ভয় করল না রে ?

অমিত হা হা করে হেসে ওঠে , ভয় করলে কি সেই দুপুর থেকে এভাবে সে চরকা কেটে ঘুরে বেড়াত ! না। সে বলে –

ছাড়ো ওসব ফালতু কথা । তুমি বল আগে বৌদির ব্লাড টেস্ট রিপোর্ট করালে কিনা ? আর শানু?

হ্যাঁ, করিয়েছি । কিন্তু নেগেটিভ । ওটাই অনেক নিশ্চিন্ত করেছে আমায়। না হলে শানু পুরো ডুবে যেত । তুই জানিস ? সানুকে স্কুল থেকে বের করে দিয়েছে ওরা !

জানি , সব জানি । কিন্তু চিন্তা করো না । আমরা সবাই তোমার সাথে আছি ।

আমার কিছু চাই না অমিত। তোরা যদি পারিস সানুর পড়া শুনাটার ব্যবস্থা করে দে প্লিজ । আমি আর তোর বৌদি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব তোদের কাছে ।

না, সব চাইবে তোমরা । আর এটাই আমি বলতে এসেছি , আমরাও দেখতে চাই কীভাবে না দেয় ।

কথার মাঝে পকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল । বের করে দেখে একটা অজানা নাম্বার । রিসিভ করল অমিত , ওপাশ থেকে একটা ধমকের সুর বলছে –

তুমি প্রতুলের বাড়ি গিয়েছ?

হ্যাঁ, কেন বলুন তো? আপনি কেই বা বলছেন?

সহদেব মান্না বলছি, তোমাকে বারণ করেছিলাম না এটা নিয়ে মাথা না ঘামাতে ?

এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার ।

না, এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার না। এটা গ্রাম সভার সিদ্ধান্ত ছিল যে ওদের সাথে কেউ কোনও যোগাযোগ রাখবে না ।

ধুস। যত সব মোড়ল গিরি , শুনুন , ওই সব আর দেখাবেন না । যা দেখিয়েছেন দেখিয়েছেন । রাখুন ।

উলটো ধমক দিয়েই ফোন কেটে দিল অমিত । কথা বলতে ইচ্ছে যায় না । পকেটে মোবাইল ঢোকাতে না ঢোকাতে আবার বেজে উঠল । না, এবার আর অজানা নম্বর না। নিজের বাড়ির নাম্বার । রিভিস না করে উপায় নেই । ওপাশে তার বাবার গলা , -

তুই ওখানে গিয়েছিস কেন?

অমিত কিছু বলার আগেই আবার ধমক আসে ওপাশ থেকে ।

তুই সমাজের উপরে যেতে চাস? মাতব্বরি করছিস ? শোন, এখুনি বাড়ি আয় বলছি ।

কার ফোন ছিল রে অমিত ? প্রতুল কিছুটা আন্দাজ করেছে কথা বার্তায় তবু জানতে ইচ্ছে করছে তার কে বা কারা ফোন করল ? আর কিই বা বলল ! পাশেই সানু দাঁড়িয়ে ছিল । তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অমিত বলল – বাবা র ফোন ছিল । সহদেব মালটা বাবা কে লাগিয়েছে নিশ্চয় ।

তুই নিশ্চয় আর আসবি না আমার বাড়ি ?

অমিত তাকাল প্রতুলের দিকে , দেখল তার প্রতুল দা হাসছে , উপহাস করছে যেন । কিন্তু কাকে ? এইডস হয়েছে বলে তাকে পুরোপুরি একঘরে করে রাখার পরও সে যেমন করে উপহাস করে যাচ্ছে মৃত্যুকে প্রতিদিন তেমন করে হাজার রক্তচক্ষু কেও কি উপহাস করেনি সে ! করেছে । সাতদিন কম নয় । তবু তো সে ভেঙ্গে পড়েনি । কারো পায়েও ধরতে যায়নি , দিন গেছে রাতও গেছে যথারীতি নিতি মেনে তা অমিত জানে বিলকুল ।

ততক্ষণে রানু বৌদি এসে দাঁড়িয়েছে চায়ের কাপ নিয়ে । প্রায় ছয়টা বাজে, তার টিউশন পড়ানো আছে । সেদিকে খেয়াল করেই সে তাড়াতাড়ি কাপ ফাঁকা করে বৌদির হাতে দিতে দিতে বলল - পরে এসে চুটিয়ে আড্ডা মেরে যাবো। আজ যাই , আমার পড়ানো আছে , আর হ্যাঁ, কাল সোমবার শানু স্কুল যাবে আগের মতোই , তোমরাও টিউব ওয়েল ব্যাবহার করবে , যা যা আগে করতে সব করবে । শুধু কাউকে ভয় করবে না একদম ।

সাইকেলের স্ট্যান্ড তুলে প্যাডেলে চাপ দিল অমিত । টিউশন, টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরলেই বাবা হয়ত আবার ধমকে উঠবে। বলবে – তুই সমাজের উপরে যেতে চাস? যেমন করে প্রায়ই বলেন – বিলের মোষ তাড়ানো ছাড় এবার অমিত । কিন্তু অমিত ছাড়ে কি করে ? সে লক্ষ করল, সে ফিরে যাচ্ছে স্কুল মাঠে । প্রতিপক্ষ সহজ নয়, তবু রঙ্গন দা সবার কানে কানে বলছে – ,স্কন্ধ কাটা কনিষ্ক কে হারিয়ে জিততে আমাদের হবেই, আজ অনেক দিন পর আবার থিতিয়ে পড়া জলে স্রোতের আভাস দেখছে অমিত । সেই স্রোত যে ধুয়ে সাফ করে দিতে পারে শ্যাওলার আধিপত্য ।