মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

গদ্যের অনুষঙ্গ - নজরুল ইসলামের গদ্য

নজরুল ইসলামের গদ্য
দন্ত্যন ইসলাম


কাজী নজরুল ইসলামের গদ্য যে কবির লেখা এ নিয়ে সংশয় প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। তাঁর গদ্য রচনা পঠনের সময় একটা বিষয় কিছুতেই দৃষ্টি এড়ায় না। সেটা তাঁর অভিমান। এই শব্দটি নানান উপলক্ষে কখনো বা উপলক্ষ সৃষ্টি করে আমাদের চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু শব্দটি যেখানে নেই সেখানেও দেখি মান-অভিমান ঠিকই চলছে_কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা অন্তর্লগ্নরূপে, কিন্তু সকল সময়েই আনন্দিত চাঞ্চল্যে। নজরুল ইসলাম তাঁর গদ্য রচনায় খুব স্পষ্ট করেই অভিমানী। এই অভিমান প্রথমদিককার রচনায় তুলনাগতভাবে অধিক, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই একেবারে অনুপস্থিত নয়।

তাঁর অভিমানের উৎস দুটি। প্রথমত এই বোধ যে, তিনি একজন শিল্পী এবং সেই কারণে তিনি অনন্য সাধারণ। নিজেকে তিনি বলেছেন সত্যের তূর্যবাদক, ভগবানের হাতের বীণা। এই উক্তি চকিত মুহূর্তের অনুপ্রাণিত ভাষণ নয়। এ সেই প্রত্যয় যার গুণে ইতিহাস সৃজনকারী পুরুষেরা ঐতিহাসিক ক্ষমতায় প্রবুদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছেন। এই প্রত্যয়ের আলোকে আলোকিত যে ভুবন সেখানে তিনি বীর; নিজেই নায়ক নিজের কাছে। এক অভিভাষণে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, যাঁরা আমার নামে অভিযোগ করেন তাঁদের মত হলুম না বলে_তাঁদেরকে অনুরোধ, আকাশের পাখিকে, বনের ফুলকে, গানের কবিকে তাঁরা যেন সকলের মত করে না দেখেন।' এই বোধ তাঁর নিত্যসঙ্গী।

তিনি সকলের মত নন, দিনানুদৈনিকের সামাজিক মাপে তাঁর মাপ হয় না। তিনি অনুপ্রাণিত। বাইরে দুর্বল হলেও ভেতরে সবার চেয়ে সবল, কেননা, তাঁর মধ্য দিয়ে সত্যের মহিমাময় প্রকাশ, সেই সত্যের যার ক্ষয় বা পরাজয় নেই। তিনি যে দায়িত্ব পালন করেছেন তা যৎসামান্য নয়, তদ্তুলনীয় সম্মান তাঁর অবশ্যই প্রাপ্য। অন্যদিকে আবার তিনি দুঃখ-লাঞ্ছিত, কণ্টক-বিক্ষত।

নজরুলের গল্প-উপন্যাসে নায়ক একজনই_নজরুল নিজে। এই আত্মমুগ্ধ নায়ক নিজের জগৎ মনের মত করে তৈরি করে, তারপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজার মত। সে আছে তাই অন্যেরা আছে। তাঁর সৌরলোকে অন্যেরা গ্রহ-উপগ্রহ। দুঃখ এই নায়কদের ললাটভূষণ; অনেক রচনারও, যেমন, ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী, অতৃপ্ত কামনা, দুর্দিনের যাত্রী, মৃত্যুক্ষুধা। আত্মপ্রেমের কারণেই নায়কেরা দুঃখী, এর কারণেই অন্যকে আঘাতে উদ্ধত। তারা কখনো ভুলতে পারে না যে, পৃথিবীটা তাদের জন্য নিষ্ঠুর, এখানে তারা যা পাচ্ছে প্রাপ্যের তুলনায় তা অকিঞ্চিৎকর। অনেক সময় দুঃখ যেন হাতের আয়না, নায়ক তাতে দেখতে পায় তার নিজেকে। অথবা বলা চলে অস্তিত্বের নাটকে দুঃখই নাট্যকার, সে যদি চলে যায়, নাটক যাবে পিছু পিছু। আর ঐ যে দুঃখের অবিরাম কথন এতে বিলাস যেমন আছে তেমনি আছে অন্যকে সাক্ষী করা, সাক্ষী এই সত্যের যে, তারা আছে, দুঃখেরা আছে। নজরুলের নায়কেরা সামাজিক জীব নয়_এমনকি তখনো নয় যখন তারা সমাজের কথা বলে।

নজরুল কথা-সাহিত্যে মা'কে নিয়ে খুব ব্যস্ততা। 'ব্যথার দানে'র শুরুতেই দু'জন মায়ের উল্লেখ আছে। নায়কের জন্মদাত্রী মাতা জান্নাতবাসিনী; কিন্তু বেঁচে আছেন অন্য মা_দেশমৃত্তিকা। 'দু'একদিন ভাবি হয়তো মায়ের এই অন্ধ স্নেহটাই আমাকে আমার বড় মা দেশটাকে চিনতে দেয়নি।' মাতৃস্নেহটা মস্ত একটা শিকল হয়েছিল, সে-শিকল কেটে যাওয়ার নায়ক এখন মহীয়সী জন্মভূমিকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু এ চিনতে পারাটাও একটা বন্ধনই-বন্ধন, সে ছোটই হোক বড়ই হোক, থাকছেই। 'রিক্তের বেদনে'র নায়ক দেখছে বাঙালি তরুণেরা চলেছে যুদ্ধে। যুদ্ধে যে যাচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ উপার্জন। কিন্তু নায়ক ভাবছে অন্য কথা ঃ 'জননী জন্মভূমি'র মঙ্গলের জন্য সে কোন অদেখা দেশের আগুনে প্রাণ আহূতি দিতে একি অগাধ অসীম উৎসাহ নিয়ে ছুটেছে তরুণ বাঙালিরা_আমার ভাইরা!' হয়তো এটা আত্মপ্রবঞ্চনা, কিন্তু এটা না করে উপায় নেই; নইলে নির্মম সত্যটা অহমিকায় এসে ঘা দেয়, ইংরেজের জন্যে প্রাণত্যাগ করছি এই জ্ঞান আত্মমর্যাদাকে বিনষ্ট করে। তাই নায়ক আদর্শকে টেনে নিয়ে আসে, যুদ্ধের সঙ্গে মাতৃভক্তিকে যুক্ত করে দেয়।

পরে সে মা'কে বোঝাচ্ছে কেন যাবে যুদ্ধে। 'আচ্ছা মা! তুমি বিএ পাস করা ছেলের জননী হতে চাও, না বীর মাতা হতে চাও? নিঝুম ঘুমের আলস্যের দেশে বীর মাতা হবার মত সৌভাগ্যবতী জননী কয়জন আছে মা।' অর্থাৎ কিনা সে সাধারণ লোক নয়, যুদ্ধ তাকে বীর করবে, মাকে করবে বীরমাতা। আর, দ্বিতীয়ত সে যে মা'য়ের বন্ধন ছিন্ন করছে সেটা নিষ্ঠুরতার সঙ্গে নয়, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, প্রবোধ দিয়ে, মা'য়ের মনে অহমিকা ও গৌরবাকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে। যুদ্ধক্ষেত্রে যখন গেছে তখনও ভুলতে পারে না পেছনের সেই ছোট বন্ধনকে। 'আহ আমায় আদেশ দিয়ে আশীষ করার সময় মা'র গলার আওয়াজটা কী রকম আর্দ্র গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।'

মাতৃঋণ শোধ করার ব্যাপারে নজরুল ইসলাম নিজেও সচেতন এবং আগ্রহী ছিলেন। যেমন, 'আমার সুন্দর' রচনায় বলেছেন, সহসা কোনো করাল ভয়ঙ্কর-শক্তি আমায় নিচের দিকে টানতে লাগল। বলতে লাগলাম, 'তোমার মাতৃঋণ- তোমার স্বদেশের ঋণ শোধ না করে কোথায় যাবে উন্মাদ'- এই বলে পৃথিবীর মায়া আমাকে মায়ের মত প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বক্ষে ধরলেন, চুম্বন করতে লাগলেন, কাঁদতে লাগলেন। কাজটা একপক্ষীয় নয়_যেমন সন্তানের দায় আছে মাতৃঋণ পরিশোধের, তেমনি মায়েরও কর্তব্য আছে স্নেহপরায়ণতার। ঐ যে মা প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বক্ষে ধরেছেন, চুম্বন করছেন, কাঁদছেন ওটি একটি আদর্শায়িত মাতৃমূর্তি। এই আদর্শকে তিনি অহরহ খুঁজেছেন এবং বললে অত্যুক্তি হবে না যে, নিজের মা'য়ের সে আদর্শ দেখতে না পাওয়ার কারণেই অন্বেষণটা আরো জরুরি, আরো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নজরুলের প্রথমদিককার গল্প-উপন্যাসে অভিমানের প্রকাশ অধিক, দাবি ততোধিক। এই অভিমান পরে কমেছে- কিন্তু এর পক্ষে একেবারে অবসিত হওয়া সম্ভব। আবার পরের রচনায় অভিমান যদি কমেছে তো অহমিকা বেড়েছে। যেমন- আনসার চরিত্রে।

আনসার অবশ্য শিল্প নয়, কিন্তু তবু তার সুযোগ আছে অহমিকার_সে জেলখাটা বিপ্লবী। এ পরিচয়টা যে বিশেষ মর্যাদার লেখক তা ভোলেন না, ভুলতে দেন না। উল্টো বারবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন। অন্য নায়কদের নায়কোচিত যোগ্যতার বিশেষ একটা লক্ষণ আনসারের মধ্যেও আছে_সে একাধিক নারীর ভালোবাসা আকর্ষণ করেছে। তার প্রতি লতিফার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা অতিশয় আপনজনের, তাই লতিফা যখন আনসারের জন্য চা তৈরি করে, তখন চায়ের পানিতে, চোখের পানি মেশে। আরেকজনের বিবাহিতা পত্নী সে। রুবি বিধবা। সে সামান্যা মেয়ে নয়; তার বাবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, সে চলাফেরা করে প্রকাণ্ড মোটর গাড়িতে, তার মুখ হাস্যোজ্জ্বল, সে শ্বেতসনা। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রুবি আনসারের আগুনে আত্মাহুতি দিচ্ছে, ক্ষয়রোগের রক্তবীজ সে স্বেচ্ছায় নিজ দেহে গ্রহণ করেছে। সামান্যা মেয়ে নয় মেঝ বৌও। অন্যেরা যখন তাকে ভক্তি করে, তখন তার নিজের ভক্তি আনসারের প্রতি। 'কত দিন বিনা কাজে লতিফার কাছে গিয়ে বসে থাকতো এই লোকটিকে দেখবার জন্য, ওর জীবনের অদ্ভূত গল্প সব শুনবার জন্য। ও যেন আলেফ-লায়লা কাহিনীর বাদশাজাদা, যেন পুঁথির হরমূজ মনু চেহের!' আর এই যে প্রকৃত লোককে রূপকথার নায়ক বানানো এ নিজেও একটা প্রমাণ মেঝ-বৌর অসামান্যতার, সে অশিক্ষিতা কিন্তু সুবোদ্ধা। আনসারের বিশেষ কদর পুলিশের কাছেও। অর্থাৎ একের পর এক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে এই সত্যের যে, আনসার সাধারণ নয় মানুষ হিসেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষকে সে ভালোবাসে। সব থাকা সত্ত্বেও সে এসে ভিড় জমাচ্ছে সর্বহারাদের মাঝে। তবু সে তাদের একজন হয়ে যায়নি, তাদের মধ্যমণি তাদের নেতা হয়ে রয়েছে।

নজরুল ইসলামের দুই রূপের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। একরূপে তিনি বিদ্রোহী, অন্যরূপে প্রেমিক। কবি নিজেই এই দুই পরিচয়ের কথা প্রচার করেছেন।

ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হয়ত আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাকে ফেলেও দেইনি। আমি গোধূলি বেলার রাখাল ছেলের সাথে বাঁশি বাজাই, ফজরের মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যা্ে#৮২০৬;হ্ন খর তরবারি নিয়ে রণভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার খেলার বাঁশি হয়ে উঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙ্গা।

কোমলের প্রতি এই কবির বিশেষ পক্ষপাত আছে। বাঁধনহারা'র রবিয়ল যা বলেছে নূরুকে সেটা নজরুল সম্বন্ধেও বলা চলে :

তোর উপরটা লোহার মত হলেও ভেতরটা ফলের চেয়েও নরম। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, বিদ্রোহটা তো অভিমান আর ক্রোধেরই রূপান্তর? তিনি বিদ্রোহী বন্ধন আছে বলে; বন্ধনের কারণেই তাঁর বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহে শুধু ক্রোধ নেই অভিমানও আছে; এ প্রায় অসন্তুষ্ট সন্তানের বিদ্রোহ অপারঙ্গম পিতার বিরুদ্ধে।

বিদ্রোহী ও প্রেমিক_এই দুই রূপের মধ্যে কোন্টাকে আমরা অধিক মর্যাদা দেব? কোন্ পরিচয়ে তিনি দীর্ঘজীবী হবেন সে নিয়ে তর্ক করা চলে। কিন্তু এ সত্য বোধ হয় তর্কাতীত যে, আমাদের এই বাংলাদেশে ফুল বড় সহজে ফোটে, কান্না অতি অল্পতেই আসে। ফুল নেব না অশ্রু নেব_এ খুবই সঙ্গত প্রশ্ন, কেননা উভয়েই আছে অনেক পরে। ফুল ও পাখি, মেঘ ও বৃষ্টি, চাঁদ ও জোয়ার, প্রদীপ ও পতঙ্গের বিস্তৃত এলাকাটা নজরুল ইসলামের একটা প্রধান অংশ সন্দেহ নেই; কিন্তু তাঁর নিজস্বতাকে বোধ হয় অন্যত্রই খোঁজা বাঞ্ছনীয়। তাঁর প্রেম বিষয়ক রচনার শিল্পমূল্য নিশ্চয়ই সামান্য নয়; কিন্তু তিনি অনেক বেশি অসামান্য তাঁর বিদ্রোহে। তিনি যে চমকে দিয়েছিলেন, আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই আদরণীয় হয়ে উঠেছিলেন সে ঐ রণতূর্যের কারণেই, দীপ্ত মধ্যা্ে#৮২০৬;হ্ন রণভূমিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যই। এই ঝাঁপিয়ে পড়াটা বিপজ্জনক কাজ; কেননা এটা স্বাভাবিক নয়, এতে অতি নাটকের প্রশ্রয় আছে। এমন সন্দেহ হতে পারত যে, তিনি অভিনয় করেছেন_ তাঁর হাতের তলোয়ার যাত্রা দলের। তুলনায় রাখাল ছেলের সঙ্গে বাঁশি বাজানোয়।

মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলিয়ে আজান দেয়াতে প্রথাবদ্ধ স্বাভাবিকতা অনেক বেশি। কিন্তু কৌতুক দূরে থাক, তাঁর ঝাঁপিয়ে পড়া আমাদের প্রথমে আকৃষ্ট ও পরে প্রভাবিত করে। এর একটা কারণ নায়ক- পুরুষের আন্তরিকতা। সাহিত্যে আন্তরিকতা পর্যাপ্ত মূলধন নয়। শক্তিহীনের আন্তরিকতা কৌতুকের সৃষ্টি করতে পারে, নয়ত করুণার। কিন্তু নজরুল ইসলামের আন্তরিকতা যেমন নিশ্চিদ্র ও সংক্রামক, শৈল্পিক ক্ষমতা তেমনি অসামান্য ও স্বতঃপ্রকাশ।

যেখানে নজরুল সামাজিক রচনা লিখেছেন_ সংবাদপত্রের উদ্দীপ্ত সম্পাদকীয়তে কিংবা জনসমাবেশে প্রদত্ত ওজস্বী অভিভাষণে সেখানে তাঁর তরবারির ক্ষর দীপ্তিটাই বড়; সেখানে ফুলেরা গেছে পিছিয়ে, অশ্রু গেছে শুকিয়ে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বোধকরি সঙ্গত যে, অভিমানের কান্না বা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস যখন কবিতায় থাকে তখন তারা ছন্দের, ধ্বনির বাক্যস্পন্দের একটা অন্তরাল পায়, এই অন্তরাল শিল্পেরই নামান্তর। গদ্য রচনায় এই অবগুণ্ঠনের অভাব হয় তো আছে, কিন্তু সে অভাবের ক্ষতিপূরণ হয় তাঁর তেজস্বীয়তার সঙ্গে সেই প্রত্যক্ষ পরিচয়ে যা আমাদের মুগ্ধ ও উদ্দীপ্ত করে, যার ভেতরে নজরুলের নিজস্বতাকে অতি সহজেই স্পর্শ করতে পারি। তাঁর নিজের ভাষায় এখানে তিনি 'শক্তি সুন্দর'।

সামাজিক রচনাগুলোর প্রতি পক্ষপাত দেখাতে গেলে হয়ত বিচারটা সম্পূর্ণত শিল্পবিচার থাকে না, সামাজিক বিচারও হয়ে দাঁড়ায়। তা হোক, তবু এই ফুলের দেশে লোহার বিশেষ মর্যাদা থাকবেই। কিন্তু এই বিচারের মধ্যে তাঁর অন্যান্য রচনা সম্পর্কে কোন কটাক্ষ থাকার প্রয়োজন নেই। তাঁর সব রচনাই নজরুল ইসলামের রচনা, কোনটাই উপেক্ষনীয় নয়। যে রচনাই পড়ি না কেন, দেখা যাবে তার গায়ে কবির হাতের ছাপ, তার বক্তব্যের শিরা-উপশিরা দিয়ে কবির কল্পনা ও হৃদয়ের উত্তাপ বাহিত।

কল্পনার পরিচয় আছে চিত্রকল্পের ঐশ্বর্যে। তাঁর যে কোনো লেখার যে কোনো অংশে চোখ রাখি না কেন দেখতে পাব সামনে দিয়ে চলেছে উপমার এক বিচিত্র বর্ণালী শোভাযাত্রা।

চোখ ফেরানো দায়। ভাবনার স্রোতে কল্পনা এসে মিলেছে। নজরুল ইসলাম চিন্তা করেন চিত্রের সাহায্যে। 'মত' ও 'যেন'র ব্যবহার আছে কিন্তু 'মত' ও 'যেন' প্রায়ই পেছনে পড়ে থাকে বিষয় ও বাহন এক হয়ে যায়, বিদ্রোহী সুদেহী হয়ে উঠে। ওপরে উদ্ধৃত উদাহরণগুলোর সাক্ষ্য এখানে নেয়া যেতে পারে। সাক্ষ্য আরো নেয়া যায়। মেঝ বৌ সম্বন্ধে যখন তিনি বলেন, ও যেন বসরা- গোলাপের লতা, শাখা ভরা ফুল, পাতা ভরা কাঁটা। অথবা 'ও যেন বোবা টাকা। শুধু রূপো, খাদ নেই। বাজাতে গেলে বাজে না! লোকে জানে, ও টাকা দিয়ে সংসার চলে না। খুব জোর গলায় তাবিজ করে রাখা যায়।

আবার উদাহরণ নেয়া যাক 'মৃত্যুক্ষুধা' থেকে। নদীর বর্ণনা : 'টলমল টলমল করছে- বোম্বাই শাড়ি পরা ভরা যৌবন বধূর পথ চলার মত। যত না চলে, অঙ্গ দোলে তার চেয়ে বেশি।' 'কুঞ্জে-ঘেরা সবুজ', 'শান্ত নিশ্চুপ' গ্রামের বর্ণনা : 'সবুজ শাজি-পরা বাসর খরের ভয়-পাওয়া কনে বৌটির মত।' এই সম্পর্ক স্থাপনের কাজটা অবিরাম আসে। অনায়াসে চলতে থাকে এই উপমারা।

শুধু উপমা নয়, কবির আসক্তি শব্দেও। তিনি একই সঙ্গে দেখেন ও শোনেন; তাঁর কল্পনা যেমন দৃশ্যগত তেমনি শব্দগতও। কখনো কখনো এমনও মনে হয় যেন তিনি শোনেন আগে, দেখেন পরে, দৃষ্টি সতর্ক হয় শ্রুতির প্রতিক্রিয়ায়। তাই উপমার শোভাযাত্রার পাশে চলে শব্দের কলকল্লোল। একের পর এক শব্দরা জেগে উঠে।

এক শব্দ অন্য শব্দের সৃষ্টি করে। এ ব্যাপারে কোনো পূর্ব পরিকল্পনার আবশ্যকতা থাকে না। 'জরা' এলে 'জয়গান'ও এসে পড়ে, চেঁচাতে চেঁচাতে বলা হলে বাঁশের চাঁচারি আর বসে থাকে না। অবিরাম চলে অনুপ্রাস আর শব্দের মিলন ঝঙ্কার। যেমন ঃ 'সেই হারই আমার গলার হার হয়ে উঠল', 'ইহাদের ফতুয়াভরা ফতোয়া', শুধু আয়োজনেই ঘটা হচ্ছে এবং ঘটও ভাঙছে', 'আমাদের ক্ষতির ক্ষেত্রে ফুলের ফসল ফলেছে'_

এই যে শব্দেরা দ্রুত আসে শব্দের পেছনে এটা তাঁর প্রতিভার কারণে। শব্দের কোলাহলের ভেতর তিনি থাকতে চান, জীবনে যেমন চেয়েছেন সাহিত্যেও তেমনি। তাঁর গদ্যে শব্দাধিক্য আছে। কিন্তু শব্দে অর্থকে আচ্ছন্ন করে দেয় না। ধ্বনিরা চিত্রকল্পের প্রতিপক্ষ নয়, চিত্রকল্পের পরিপূরক। ধ্বনির সাহায্যে চিত্রগুলো পূর্ণ হয়ে উঠে।

কাজী নজরুল ইসলাম হলেন শব্দের সাবলীল রূপকার। তিনি যেমন সিদ্ধহস্ত কবিতায় কিংবা গজল-গানে, তেমনি সমান পারদর্শী গদ্য সাহিত্যেও। উপরের বর্ণনার পরিসর খুবই সংকুচিত নজরুলের গদ্য সাহিত্য নিয়ে, এর মাঝেও যথেষ্ট চেষ্টা করেছি সুন্দর একটা লেখা লিখতে। শব্দের গাঁথুনির সাথে নজরুল ইসলাম যেরূপভাবে রচনা করতেন তাঁর লিখনীতে_ আমি শুধু বয়ান করেই চলেছিলাম মাত্র ক্ষুদ্র পরিসরে। সবিশেষ এটাই বলবো, নজরুল ইসলাম বিনির্মাণ করেছেন সাহিত্যাকাশের শ্রেষ্ঠ ফসলগুলো।