মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

অনুবাদ – কৌশিক ভাদুড়ী

অনুবাদ কবিতা
কৌশিক ভাদুড়ী


ভূমিকা

শ্রদ্ধেয় কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা বাবুর পরিণতি-সম্পৃক্ত “দ্রোহবাক্য” গ্রন্থভুক্ত গভীর বোধাশ্রিত কবিতাগুলির অনুবাদার্থে আমার কম্পিউটারে ওড়িয়া ফন্ট না থাকায়; শ্রদ্ধেয় সম্বিদ দাশ বাবু আমাকে যৎপরোনাস্তি আদর প্রদর্শন হেতু; স্বহস্তে বাংলা ফন্টে আপলোড করে কবিতাগুলি পাঠিয়েছেন। আমি সম্মানিত। আমি গর্বিত। আমার সীমিত ক্ষমতাতে অনুবাদ প্রচেষ্টা নিচ্ছি।

শ্রী সচ্চিদানন্দ রাউতরায়ের (১৯১৬-২০০৪) পরবর্তী উত্তরাধিকারত্বে ওড়িয়া সাহিত্যের যে ‘নব্য আধুনিক’ (Neo-modernity) যুগের প্রবর্তন হয়, কবি রাজেন্দ্র কিশোর পণ্ডা তার অন্যতম ধারক। ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষায় কবিতার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত। পেশগত জীবনে কবি ভারত সরকারের এক আই-এ-এস আধিকারিক ছিলেন, অধুনা অবসরপ্রাপ্ত।

তত্সম শব্দ ওড়িয়া ও বাংলায় অনুরূপ। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়, অনুরূপ বাংলা শব্দ সব সময় সমান্তরাল অনুভূতি বহন করে না। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় কবিতার আত্মাটিকে( স্প্যানিশ কবিতায় বিবৃত—দুয়েন্দে, লোরকা বিভিন্ন সময়ে শব্দটা ব্যবহার করেছেন) সনাক্ত করে ফুটিয়ে তোলাটাই সঙ্গত ও সঠিক অনুবাদ। এখানেও সামান্য দু একটি জায়গায় তাই করেছি। যদিও ওড়িয়া ও বাংলার ব্যুত্পত্তিগত অতিন্নতা স্বীকার করে তত্সম শব্দ অপ্রতিস্থাপিত রাখার দায় আগাগোড়াই থেকেছে।




প্রিয় নগরী আমার


A city that is set on a hill cannot be hid.
তুমি পয়ারাজয় নয়, পরাজয়ের ভান
(যা পরাজয়ের চাইতেও ন্যূন!)।
দেখ, তোমার কাছে আমি ফিরে এসেছি-
বুকের ঘা শুকিয়ে গেছে আমার,
মহাপৃথিবীকে পশ্চাতে মুর্চ্ছিত রেখে এসেছি,
স্মিত হাসি গ্রহণ কর-
বল কোথায় রেখেছ এতকাল
বিজয় ও বন্ধুত্বের চির-লহরিত ধ্বজপট!
আশ্চর্য!
জং ধরা ময়লা লোহার স্তূপের মত পড়ে আছ তুমি,
গত রাতের শিশিরপাতে
চুঁইয়ে পড়ছে লালচে মরচের ক্ষরণ।
“রক্ত, রক্ত” চিৎকার করছে আবেগময় তরুণ কবি
নিরীহ নাগরিক ক’জন খুঁজে চলেছে কোথায়
স্রাবোত্স তোমার কায়ায় ক্ষতস্থান।

খণ্ড খণ্ড ইঁট জুড়ে
তাপসের নিষ্ঠায় তোমাকে নির্মাণ করেছিলাম,
তুমি মৃতও নও আহতও নও গুরুতর,
আমি জানি।
শুধু একটু ঘষামাজা পেলে তুমি চকচকে
একটু শাণ দিয়ে দিলে তীক্ষ্ণধার
পরাজয় নও, নও বিপর্যস্ত খাণ্ডার,
মি তার ভান।

কালো ওড়না উড়িয়ে দিয়ে
আকাশকে তুমি করতে পার চন্দ্র-তারকাহীন
ইচ্ছে চরিতার্থ করতে
আনতে পার লৌহময় অনন্ত অন্ধকার!
এ নিরালোক কিন্তু আঁধার নয়-
হে প্রিয় নগরী আমার!
প্রত্যাগত আমি, ক্ষতমুক্ত আমি, অদ্বিতীয় প্রেমিক,
স্মিত হেসে আমাকে গ্রহণ কর।
যে গিরিশিখরে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছি তোমাকে,
সেখানে লুকিয়ে থাকা অসম্ভব,
সেখানে নেই চ্যুতি, ক্ষয়, ধ্বংস, পরাজয়।
সেখানে চিরকাল লয়, সেখানে আলয়!
শবমুদ্রাও মহাজীবন্ময়!

প্রিয় নগরী আমার!
ফুলদানীর মতন সাজিয়ে রাখ-
চিরসতেজ জ্যোৎস্নাফুল, পারিজাত, অনামা ফুল,
বজ্রদানী হয়ে ধারণ কর অসংখ্য নিক্ষিপ্ত বজ্র-
প্রচণ্ড প্রখর।

পরাজিত পুরন্দরকে বাহুমূলে টেনে আলিঙ্গন কর
ইচ্ছে হলে, লোহিত-উত্তপ্ত হয়ে প্রকট হও
পুরদেবী লৌহদেবী!
আকাশে ফুটিয়ে দাও
সাত কোটি সতের লক্ষ সাত সহস্র সপ্ত-পঞ্চাশৎ
নতুন তারার স্ফুলিঙ্গ।



ধ্বজাধারী

নানা রঙ নানা বিন্যাসের ধ্বজা আমার হাতে।
কার সংকেত স্বস্তি কার সমর
কার ঘৃণা কার করুণা
কার সংকেত কী আমি জানিনা,
একটার পর একটা উড়তে থাকে
আকাশ পানে নিজেকে উঁচিয়ে।

শোভাযাত্রার জনৈকের মতন চলতে থাকি আমি,
সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি নিবদ্ধ
আমার উপরে।
আমার অগ্রে একজনও কেউ নেই,
আমিই কেবল হচ্ছি অনুসৃত:
একথা আমি বুঝতে পারি না প্রায়শই!

অথচ
বিন্ধ্য হিমাচল নয়,
অসংখ্য বৃক্ষের অরণ্যের ভিতরে অনামা বৃক্ষটি আমি,
শ্যামল ও শীর্ণ,
নক্ষত্রমণ্ডলের এক পতনমুখী ধূমকেতু,
বিশ্বাস কর আমার স্বীকারোক্তি।
বিশ্বাস কর আমি মন্ত্র জানি না, বেদ জানি না ,
কেবলই বিড়বিড় করি।
আমি সত্যকাম নয়, জাবালির পুত্র জারজ!
অন্তত একজনও
বিশ্বাস কর আমার স্বীকারোক্তি।

তেত্রিশকোটির ভিতর
কারুর সাথে আমার পরিচয় নেই,
অসুরদের সাথে
শত্রুতা নেই কি সখ্যতাও নেই।
শুক্র আর বৃহস্পতি আমার কাছে সমান।
অথচ পক্ষ না জেনেই ঢুকে পড়ি খেলার মাঝখানে,
পরিশেষে শুনি আমার বিজয় হয়েছে
ধুন্ধুমার যুদ্ধে।
নগ্ন হয়ে আমি দাঁড়িয়ে পড়লেও শ্বেত পতাকা দেখিয়ে,
শরণ আর সন্ধির জন্যে
নতজানু হন আমার প্রতিস্পর্ধীগণ,
সম্মুখ ভূমিতে।
কে ঘোষণা করেছিল যুদ্ধ ?
কোথায়?
কখন?

নিরুপায় বিজেতার দুঃখ ভারি নিঃসঙ্গ নির্মম।
যে ধ্বজাই আমার হাতে পড়ে,
উড়িয়ে দিই।
যে করতে চায় করুক তার সংকেত-নির্ণয়,
হাওয়ায় ফরফর ওড়ানো আমার ধর্ম।
যেমন দ্বিতীয় সূর্যের নেই আনাগোনা,
দ্বিতীয় পতাকা কারুরই থাকে না-
তেমনই ফরফর উড়তে থাকা আমার নিয়তি !
অন্তত একজনও
বিশ্বাস কর আমার স্বীকারোক্তি ।



বীজঘট

একদিন সূর্যোদয়ের কালে জেগে উঠলাম উৎসর্গীকৃত হয়ে।
নিবিড় আঁধার অরণ্য
নিমেষে হল তুহিন-শীতল।
বাঘিনী, হরিণী, নদী, বিবসনা বৃক্ষপরী,
পক্ষিনী, বিষভুজঙ্গী,
ডাল ডগা পাতা ফুল ফল
সবকিছু আগলে নিয়ে অরণ্য
লুকিয়ে যেতে চায় কোন কন্দরে, অঞ্জলিতে,
দুর ডিবের ভিতর।

ভারি নীরবে কাঁদে, ভারি নীরবে।
রূপ, রঙ, রস, স্পর্শ, গন্ধ, শব্দের উন্নতি ও সঞ্চরণ,
যুযুত্সু করে দিয়েছে জঙ্গমদিগকে
মহাদৈত্য মেতে উঠেছে,
জলে, স্থলে, নভে, মনে, বুদ্ধিতে, অহংকারে,
সব কিছু লুঠে ধর্ষিতা করে দিতে।

কেউ একজন উঠে দাঁড়ান উচিত
স্থির হয়ে, মুখোমুখি।
এই আমিই দাঁড়ালাম।
কাঁদিস না, অরণ্য,
আয়
প্রবেশ করে যা আমার ভেতর, গেঁথে দে আমাকে মাটির গভীরে।
আমাকে অনুমতি দে অঙ্কুরিত হতে।
শক্তি দে,
বালি পঙ্ক কঙ্কর পাথর
ছুঁয়ে ঘুরেফিরে প্রবিষ্ট হোক আমার কোমল অগ্রমূল
তলে তলে আমাকে
এমন গহীরে পুঁতে দে যাতে
আমি ছুঁয়ে দিই প্ররোচনা উসকানি
কোথাও কোন গভীরে থাকা
উগ্রতম আগ্নেয়গিরির
গনগনে দাউদাউ কেন্দ্র-অনল,
পুলকিত বিক্ষিপ্ত হোক আমার বীজঘট,
হাসুক, কাঁদুক, ফাটুক,
বিদীর্ণ হয়ে যাক ...

বিনা অঙ্কুর বিনা কাণ্ড বিনা শাখা প্রশাখায়
অসংখ্য অগ্নিপত্র, অগ্নিফুল, অগ্নিকন্টক অগ্নিফলে
গোটা আকাশ ভর্তি হয়ে যাক।

চিরদিন আকাশও হাতপাতা হয়ে থাক।