মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর, ২০১৩

ছোটগল্প- আরফ করিম

পিঠা
আরফ করিম



(১)

তখনো পুরোদস্তুর ফ্রীল্যান্সার হয়ে উঠিনি। গ্রাফীক্স ডিজাইনিংটা প্রায় রপ্ত করে ফেলেছি। আমি, অমিত আর অভ্র মিলে কিছু কিছু কাজ করছি। কাজ অমিতের বাড়ীতেই করতাম কারণ ওটাই ছিলো সবথেকে সুবিধাজনক জায়গা। রোজগারো মোটামুটি হচ্ছিল। কিন্তু এই রোজগারেই তো আর চলে না তাই একটা ফার্মেও ১০টা-৫টা চাকড়ী করছিলাম।

সকাল ৯টায় বেড়িয়ে চাকড়ী, আড্ডা আর ডিজাইনিং সেড়ে বাড়ী ফিরতে কোনদিন বাজতো রাত দশটা তো কোনদিন এগারোটা। এভাবেই চলে যাচ্ছিল।

রুটিন মাফিক একদিন রাত ১০টার পর বাড়ী ফিরলাম। হাতমুখ ধুয়ে একটু জিরিয়ে কেবল কম্পিউটারটা ওপেন করে বসেছি, মা এসে হাজির। হাতে ছোট একটা টিফিন বক্স। বক্মটা খুলে সামনে রেখে বলল- “পিঠা খাও, তালের রস দিয়ে বানিয়েছি।”
“কোনদিন খেতে দেখেছ, এসব মিষ্টি জিনিস?”-আমি বললাম। মিষ্টি আমি একেবারেই পছন্দ নয়।
“একটা খাও বাবা।”-কথাটা যেন আব্দারের মতই শোনাল।
এর পর তো আর না করা যায় না তাই একটা পিঠা নিয়ে কোন রকমে গলাধকরণ করলাম। আমার চেহারাই মনের ভাব বলে দিচ্ছে তাই মা চুপচাপ বক্সটা নিয়ে চলে গেলেন। তারপর কম্পিউটারে দু’একটা টুকটাক কাজ সেড়ে কয়েকটা গান শুনে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোর তখন কটা হবে? সাড়ে পাঁচ টা কি ছ’টা। বাবা এসে ডেকে তুললেন। ঘুম জড়ানো অবস্থাতেও বুঝতে পারলাম বাবার কণ্ঠটা যেন অপরিচিতের মত লাগছে। ঠিক কি বলছেন তাও বুঝতে পারলাম না। কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানিয়ে দিলো যা ঘতেছে তা ভালো ঘটেনি। হুড়মুড় করে উঠতেই বাবা পাশের ঘড়ে ছুট লাগালেন। আমিও পেছন পেছন ছুটলাম। বাবা বিছানার পাশে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লেন, যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছেন সম্পুর্ণ। পাশেই মা বিছানায় শুয়ে অছেন। মা’র মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো একটা শিশু গভীড় ঘুমে আচ্ছন্ন। বাবা আমার চোখের দিকে অসহায়ের মত তাকালেন। বাবার অসহায় দৃষ্টি আমার ভেরটাকে তোলপাড় করে দিয়ে জানিয়ে দিল যে- শিশুটির ঘুম আর কোনদিনো ভাংবেনা।

(২)

জানাজার জন্য মাকে খাটিয়ায় করে বাড়ী থেকে বের করা অব্দি পুরো সময়টা যেন কেমন অস্থির ছিল। কেউ কাঁদছে, কেউ ছুটাছুটি করছে, কেউবা এসে আমায় জড়িয়ে ধরে কি সব বোঝানোর চেষ্টা করছে। শুধু স্থীর আমার শরীরটা, একদম মায়ের মত। কিন্তু বুকের ভেতরটা যে চৌচিড় হয়ে যাচ্ছে।

জানাযা পড়ে দাফন শেষে যখন বাড়ীতে এলাম তখন যেন আমার আর করার কিছুই নেই। মনে হলো আত্মাটা হঠাতি বিকল হয়ে গেছে।

আচমকাই আমার মনে হলো গত রাতের সেই পিঠাগুলোর কথা। ওটা আমার জন্য তৈরি মা’র হাতের শেষ খাবার। নিজেকে বড্ড অপরাধি মনে হলো তখন, সবগুলো পিঠা খেলেই তো পারতাম তাহলে মা আরেকটু সময় বেশি দাড়ীঁয়ে থাকতেন আমার পাশে। হয়তো আর একটা-দু’টা কথা বেশি বলতে পারতাম। হয়তো একটু ছুঁয়ে দিতেন শেষ বারের মত। হঠাৎ মনে হলো-“আচ্ছা, পিঠাগুলো যদি কেউ খেয়ে নেয়। তাহলে তো আমি আর কোন দিন তা খেতে পাবো না।” ছুট লাগালাম ডাইনিং রুমের দিকে। ফ্রীজের দরজাটা খুলেই দেখলাম পিঠাভর্তি সেই বক্সটা। ঢাকনাটা খুলেই একের পর এক পিঠা ঠেসে দিতে থাকলাম মুখের ভেতর। আশেপাশে থাকা আত্বিয় স্বজন আর বন্ধুরা ভাবলো আমি বুঝি পাগলামি করছি। ওরা আমার হাত থেকে পিঠার বক্সটা নিয়ে নিতে চাইলো আমাকে শান্ত করে বসাতে চাইলো খাটের উপর, কে যেন একগ্লাস পানিও নিয়ে এলো। পিঠায় মুখ ভরে থাকার কারনে আমি ওদের বলতেও পারছিনা কিছু যা বলছি তা গোঙানীর মত শোনাচ্ছে আবার একবুক কান্না এসে গলার কাছে জমা হওয়ায় পিঠাগুলো নামছেও না গলা দিয়ে। বহু কষ্টে দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে গিলতে পারলাম মুখের ভেতর থাকা পিঠাগুলো। ততক্ষনে আমার হাত থেকে বক্সটা নিয়ে কে যেন আবার ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখেছে।

রাতে আমায় ভাত খাওয়ানোর চেষ্ট করা হলো কিন্তু একটুও খেতে পারলাম না। অসহ্য লাগলো। অভ্র যখন আমায় বিছানায় শুইয়ে দিলো তখন রাত যথেষ্টই গভীড় অথবা ভোরের কিছু আগে। ও আমার পাশেই শুয়েছিলো, ও চাইছে আমি একটু ঘুমাই। ঘুম! সেটাতো এখন একান্তই মায়ের।

(৩)

ঝিমুনি অথবা ঘুমের কাছাকাছি অবস্থাটা যখন ছুটে গেলো তখন ভোর। গত ভোরের মতই আমি হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠলাম, ছুটে গেলাম ডাইনিং রুমে ফ্রীজের কাছে। ফ্রীজের দরজাটা খুলে দেখলাম ভেতরে পিঠার বক্সটা নেই। ডানে-বামে তাকাতেই চোখ গেলো ডাইনিং টেবিলের উপড়, বক্সটা ওখানে। ছুটে গিয়ে বক্সটা হাতে নিলাম আর বুঝতে পারলাম বক্সটা খালি। কি এক অবর্ণনিয় কষ্ট যে তখন আমার ভেতর সৃষ্টি হলো তা শুধু আমিই উপলব্ধি করেছি। মনে হলো শরীরের ভেতর প্রকান্ড শক্তিশালী একটা বোমা রয়েছে যা এখনি বিস্ফোরিত হবে। হঠাতি চোখের সামনে সব ঘোলা হয়ে এলো….

জ্ঞন হারিয়ে ফেলেছিলাম। যখন জ্ঞন ফিরলো তখন দেখি বাবা আমার মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছেন আর আমার আশেপাশে অনেকেই জড়ো হয়েছে। পিঠাগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো আমার । কিন্তু এখন আর কোন কষ্টের অনুভূতি নেই ওগুলোর জন্য। মনে হলো-আমার যেটুকু পাওয়ার আমি পেয়েছি বাদবাকী ভালোবাসাটুকু তো ছড়িয়ে পড়লো অন্যদের মাঝে। হঠাৎ করেই মনে হলো, বাবার কোলে কেন মাথা রেখেছি আমি কিছুক্ষণ আগেই তো মায়ের কোলে ছিলো! তবেকি আমি স্বপ্ন দেখেছি মা’কে…