জন্মের সময় রুনা জানত না বার্থ সার্টিফিকেট ছাড়াও ওর আরেকটা মূল্যবান সার্টিফিকেট আছে। দিব্যি বেড়ে উঠছিল আর পাঁচটা শিশুর মতোই । রোজ বাড,নার্সারি, কিণ্ডার গার্ডেন পেরিয়ে একদিন পা দিল ভু-শুণ্ডির মাঠে । নিজের নাম বাবার নাম বাড়ির ঠিকানা ইংরাজিতে লিখতে লিখতে ইরেজার ঘষার প্রয়োজন কমলো । গৃহ শিক্ষক মন্তব্য করলেন "খুব উন্নতি হচ্ছে" । তারপর ছোট ছোট যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের রেসিপি গুছিয়ে রুনা এখন ক্লাস ফোর । পেন্সিল ছেড়ে পেন গৃহ শিক্ষক ছেড়ে কোচিং ক্লাস । টপটপ শিখে নিচ্ছে ভূগোলের গোলার্ধ বিন্যাস ইতিহাসের তেহেল্কা ইংরেজিতে বাক্য গড়া । এখন নিজের নাম লেখার আগে স্মার্টলি লিখতে পারছে ‘মাই নেম ইজ...’ । ফোরের বৃত্তি পরীক্ষাতেও লিখে এলো নিজের নাম বাবার নাম বাড়ির ঠিকানা সাথে আরেকটা প্রশ্ন বাবার জীবিকা-‘মাই ফাদার ইজ এ ল’ইয়ার’ । কোলকাতা হাইকোর্টে ১২ বছর রয়েছেন মিস্টার সাত্যকি বাগ । যথেষ্ট নাম ডাক আছে ভদ্রলোকের । হাজরা ল’কলেজ থেকে এল এল বি কমপ্লিট করে জুনিয়ার হিসেবে চুরন্ত প্র্যাকটিস পর্বের ক্রুসিয়াল সময় কাটিয়ে এখন জীবনটাকে দেখেন ১১ তলা অ্যাপার্টমেণ্টের আলিসান ফ্ল্যাটের ডুরিয়ানের সোফায় বসে । এ কবছরে বেশ সাজিয়ে নিয়েছেন সংসার । একমাত্র মেয়েকে তৈরি করছেন মনের মতো করে । কোর্ট থেকে ফিরে মেয়ের পড়াশুনার খবর নেন,চায়ের কাপ নিয়ে ইংরাজি বানান শেখাতে বসেন কখনও আবার কখনও খেলার চলে আদিম মানুষের চাকা আবিষ্কারের গল্প শোনান । সাধারণ জ্ঞান বেড়ে ওঠে রুনার । যাই হোক, নিজের মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল তার কিন্তু বৃত্তিতে ভালো নম্বর পেলেও বৃত্তি পুরষ্কার পাওয়ার পর্যাপ্ত নম্বর পায়নি । একটা আকাশী সার্টিফিকেট পেয়েছিল রুনা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের তরফ থেকে-তখনও সে জানে না এর থেকেও ওর একটা কত মূল্যবান সার্টিফিকেট আছে ।
ভুশুণ্ডির মাঠ পেরিয়ে রুনা এগিয়ে চলেছে । একেকটা হার্ডেল রেস একেকটা জাম্প । জাম্পের টেকনিক ছকে ছক কষে দিচ্ছেন প্রতিটি বিষয় ভিত্তিক প্রাইভেট কোচিং ক্লাসের কোচরা মাসিক মোটা অর্থের বিনিময়ে । এখন সে দশম শ্রেণী,স্কুল ড্রেস স্কার্ট-শার্ট । এই প্রথম জীবন বিজ্ঞানের পাতায় সংরক্ষণের উদাহরণ সহ সংজ্ঞা শিখল রুনা । বাবার মুখে আগে শুনেছে শব্দটা কিন্তু ঠিক ক্লিয়ার ছিলনা আইডিয়াটা । জানতে চাইলে বাবা বলেছে বড় হলে বুঝবে । উদাহরণ থাকলে হয়ত সব কিছু ক্লিয়ার হয়ে যায় । বিজ্ঞানটা তাই বেশ ভালো লাগে রুনার ।
পড়াশুনায় তুখর না হলেও গোপন সুত্রে খবর মাধ্যমিকটা টেনে হিঁচড়ে ৬০৫-১০ ছুঁয়ে যাবে সে । অ্যাডিশানাল ওয়ার্ক এডুকেশান-পি.টি । মাধ্যমিক হোল রেজাল্ট বেরল কোচদের অনুমানকে সঠিক প্রমাণ করে । রুনার সংগ্রহে আবার একটা সার্টিফিকেট । মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তির সময় ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে রুনা শিখল আরেকটা সংরক্ষণের সংজ্ঞা । না মাধ্যমিকে শেখা সংজ্ঞার সাথে এর এক কনাও মিল নেই । সে কোনো বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি নয়,তার খাদ্য বাসস্থান নিরাপত্তার অভাব নেই বরং অর্থ শিক্ষা সবই রয়েছে-উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা চলে তাদের । বরঞ্চ ইতিহাসের সাথে মিলে যাচ্ছে ব্রাহ্মনের ছেলে ব্রাহ্মণ আবার ম্যাথরের ছেলে ম্যাথর । কিন্তু সেটাও তো তার ক্ষেত্রে একদমই যায় না যার বাবা একজন উকিল!সব কেমন গোলমাল হয়ে যেতে থাকে রুনার । এখন রুনা জানে একটা অন্যরকম সার্টিফিকেট আছে তার কিন্তু সেটা মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটের থেকে কতটা মূল্যবান সে জানে না ।
ভুশুণ্ডির মাঠের মাঝখানে একটা অদৃশ্য রেখা টের পায় রুনা । অঙ্ক ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বায়োলজি সব কিছুর ঊর্ধ্বে । স্কুলে ভর্তির পর শুনেছে ও লড়েছে ৫০ টা সিটের মধ্যে জায়গা করতে আর যারা এটা বলে তারা ৩৫ টা! প্রতিযোগিতা সমান সমান নয়...কিন্তু রুনা প্রায় ওদের কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে । ইদানিং স্কুলে একটা কথা প্রচলন হয়েছে “এক সার্টিফিকেট জো লাইফ বদল দে” । অস্বস্তি লাগে রুনার । বাবাকে বললে বলে “কান দিও না ওরা হিংসুটে” । ওদের কথা শুনে হিংসা মনে হয়না রুনার মনে হয় এক অজানা রাগে ফুটছে ওরা । জয়েন্টের প্রাইভেট ক্লাসেও স্যার বলেন রুনার চিন্তা নেই মোটামুটি র্যাঙ্ক করলেই ভালো জায়গায় চান্স পাকা,আর কথাটা আরও লম্বা করে পূর্ণচ্ছেদ দেয় সহপাঠীরা “কারণ রুনার বাবার একটা কার্বাইডের ফ্যাক্টরি আছে!”...ভুশুণ্ডির মাঠে দুটো বছর অদ্ভুত কাটল রুনার । অনেক কিছু দেখেছে সে । পয়সার অভাবে উন্নত শিক্ষা না পাওয়া শিক্ষার্থী একবেলা খেয়ে পড়াশুনার জন্য খরুচে পরিবার এদের মধ্যে অনেকেই রুনার থেকে পড়াশুনায় ভালো । তবে রুনার ঘরে যে ধন আছে ওদের অভাবের ঘরে সে ধন ছিল না । ওদের বাবাদের না ছিল শিক্ষাগত যোগ্যতা না ছিল ১১ তলা ফ্ল্যাট লোডশেডিং এ উজ্জ্বলতা ভরে দেওয়ার ইনভার্টার । এসব দেখে কষ্ট হত রুনার কিন্তু তাৎক্ষণিক । সময় গড়াল উচ্চমাধ্যমিক পাশ করল রুনা । আবার একটা সার্টিফিকেট হাতে এল । জয়েন্টের রেজাল্টও বেরল । স্যারেরা বলেছে সরকারি কলেজে পেয়ে যাবে সে কিন্তু অনুরিমা পাবে না । অনুরিমা মুখোপাধ্যায় রুনার জয়েন্ট ক্লাসের বন্ধু । ওর বাবার একটা মুদির দোকান আছে বাজারে । মায়ের খুব হার্টের প্রব্লেম চলছে । অনুরিমা রুনার থেকে বেশ আগে র্যাঙ্ক করেছে কিন্তু ও পড়তে পারবে না ইঞ্জিনিয়ারিং । ওর বাবার ক্ষমতা নেই তিন চার লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেট কলেজে পড়ানোর । অনুরিমা এমন একটি মেয়ে যে কখনও রুনাকে অনুভব করতে দেয়নি তাদের দুজনের মধ্যে কি বিশাল পার্থক্য । অনুরিমা ফিজিক্সে অনার্স করবে বলে ঠিক করেছে । জয়েন্টের রেজাল্ট বেরনোর দিনই শেষ দেখা হয়েছিল দুজনের । তারপর আর অনুরিমাকে খুঁজে পায়নি রুনা...
রুনার কাছে এখন দুটো সার্টিফিকেট যেগুলোর গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে প্রতিবার বাবা আরেকটা সার্টিফিকেট জুড়ে দেয় শেষে । ঠিক তখন রুনার নিজের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া সার্টিফিকেট গুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় । মনে হয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার অনুঘটকের সংজ্ঞাটার কথা । রুনা এখন সব সার্টিফিকেটের মূল্য বোঝে আর এটাও বোঝে তার বাবার পড়াশুনার পুরো যোগ্যতাটা তার একার নয় । তবুও সুবিধা কে না চায় । লোকে যাই বলুক, রুনা তো একা এই সুবিধা পাচ্ছে না - তার মতো আরও অনেকে পাচ্ছে যাদের দারকারই নেই এই সুযোগ তারাও । ভুশুণ্ডির মাঠ অনেকটা পেরিয়ে গেছে রুনা সাথে তিন পুরুষ মিলিয়ে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীর গণ্ডিও পেরিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে তার পরিবার । ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসের ফোর্থ ইয়ারের একগুচ্ছ সার্টিফিকেটের সঙ্গে সম্পত্তির মতো আজকাল তাই এই অনুঘটক জাতীয় সার্টিফিকেটটাও যত্ন করে রাখে সে । দশম শ্রেণীতে পড়া সংরক্ষণের সংজ্ঞা এখন পুরোপুরি বদলে গেছে তার কাছে । সেও শিখে গেছে সংরক্ষণের প্রসঙ্গ স্মার্টলি এড়িয়ে যেতে । বড়ো হলেই হয়তো সংরক্ষণের সঠিক সংজ্ঞা বোঝা যায়...
অলংকরণ – কৌশিক বিশ্বাস ও অমিত বিশ্বাস
2 comments:
খুব ভালো লিখেছিস উল্কা , খুব ভালো ।
থ্যাংকস মিলন দাদা...
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন